দুষ্প্রাপ্য

ইয়ানিস রিতসোসের কবিতা

বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ গ্রিক কবির মধ্যে ইয়ানিস রিতসোস (Yannis Ritsos, ১৯০৯-১৯৯০) একজন বলে বিবেচিত। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রিক-প্রতিরোধের সক্রিয় সদস্য। যদিও তাঁর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ Tractor (১৯৩৪), Pyramids (১৯৩৫) বামপন্থী সমালোচকদের কাছে ইতিবাচক অর্থে গৃহীত হয়নি। তবে ইয়ানিস রাজনৈতিক কবি রূপে গণ্য হতেও অপছন্দ করতেন। ফরাসি কবি লুই অরাগঁ বলেছিলেন, রিতসোস সমকালের শ্রেষ্ঠ কবি। ন-বার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হলে রিতসোস বলেছিলেন, ‘এটি আমার জন্য নোবেলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

১৯৩৬ সালের মে মাসে থেসালোনিকিতে তামাক-শ্রমিকদের প্রচণ্ড বিক্ষেভ শুরু হয়। সেসময় একজন প্রতিবাদকারী মৃত্যুবরণ করে এবং মৃতের ছবি জড়িয়ে ধরে মায়ের কান্নার দৃশ্য রিতসোসকে এতটা আলোড়িত করেছিল যে, তিনি লেখেন তাঁর যুগান্তকারী কবিতা ‘এপিটাফিওস’। যাতে তিনি চিরায়ত ও জনপ্রিয় গ্রিক কবিতার শৈলী অস্বীকার করে অভিনব ভাষার সারল্যে প্রকাশ করেছেন সমস্ত মানুষের ঐক্যের বার্তা। এটির দশ হাজার কপি ছাপা হয়। সে-বছরের অগাস্টে আইওনিস মেটাক্সাসের (Ioannis Metaxas) ডানপন্থী একনায়ক ক্ষমতায় এসে এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস পাদদেশে ইয়ানিসের এপিটাফিওসের অবশিষ্ট আড়াইশ কপি অগ্নিদগ্ধ করে। এমনকি দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলাকালে (১৯৪৬-১৯৪৯) বামপন্থীদের সমর্থনের কারণে তিনি কারারুদ্ধ হন, চার বছর ছিলেন অন্তরীণ। পরবর্তীকালে, পঞ্চাশের দশকে মিকিস থিওডোরাকিসের সংগীতায়োজনে এপিটাফিওস বামপন্থীদের সংগীত হয়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালে তিনি পুনরায় পাপাডোপুলোসের স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়েন এবং তাঁকে প্রথমে গায়ারোসে পরে সামোস ও অবশেষে লেমনোসের কারাগারে পাঠানো হয়। স্বভাবতই স্বদেশে তাঁর কবিতা সিক্ত হয়েছিল নিষিদ্ধের অগ্নিচুম্বনে।

রিতসোসের কবিতার ভাষা অলংকারমণ্ডিত। বক্তব্যের পাশাপাশি তিনি শৈলীর দিকেও ছিলেন বেশ মনোযোগী। ব্যক্তির স্বপ্নময়তা, আশ্চর্যজনক সংসর্গ, প্রাকৃতিকতা এবং এসবের অন্তর্নিহিত স্রোতে কবির যন্ত্রণাক্ত অভিব্যক্তি পরিস্ফুট তাঁর কবিতায়। হৃদয়দ্রবী এবং তিক্ত স্মৃতির উণ্মীলনে পরাবাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়েছিল তাঁর গীতিময়তা। রিতসোসের অন্যান্য কাব্য হল : Epitaph (১৯৩৬) এবং Vigil (১৯৪১-১৯৫৩)। তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন Moonlight Sonata-এর জন্য পেয়েছেন গ্রিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

দুই

শহীদ কাদরী [১৪ অগাস্ট ১৯৪২-২৮ অগাস্ট ২০১৬] রিতসোসের ৩টি কবিতা অনুবাদ করেন। সেগুলো প্রকাশ হয়েছিল আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকায়, চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৮২, অগাস্ট ১৯৭৫-এ। কবিতা ৩টি হল : ‘হ্যাঁ, সত্যি’; ‘অব্যক্ত’ ও ‘পুষ্পমাল্য’। প্রথমটি শহীদ কাদরীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশ গোধূলির গান [২০১৭] সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে। এখানে শহীদ কাদরীর বিভিন্ন সময়ে নিজের লেখা এবং অনূদিত কবিতা রয়েছে। ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা’ শীর্ষক একটি হ্রস্ব ভূমিকায় সাজ্জাদ শরিফ জানিয়েছেন, বইটির পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন কবিপত্নী নীরা কাদরী। প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত কবিতাগুলো তিনি উদ্ধার করেছেন; অন্যদিকে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কবি পিয়াস মজিদ অনূদিতসহ শহীদ কাদরীর প্রথম জীবনের অনেক কবিতা বিচিত্র উৎস থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছেন। কিন্তু ইয়ানিস রিতসোসের অন্য দুটি কবিতা সংগ্রাহকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। গোধূলির গানে প্রকাশিত কয়েকটি কবিতার উৎস নির্দেশিত হয়নি, যেমন, রিতসোসের ‘হ্যাঁ, সত্যি’ কবিতাটি। সংকলনে এ কবিতাটির পঙ্ইিবন্যাস গণসাহিত্যে মুদ্রিতটির চাইতে স্বতন্ত্র। তুলনামূলক বিচারের সুবিধার্থে পাঠকের জন্য গণসাহিত্যে প্রকাশিত কবিতাটি উপস্থাপিত হলো।

উল্লেখ্য, গণসাহিত্যে প্রকাশিত কবিতাসমূহে মূল কবির নামের বানান লেখা হয়েছে ‘ইয়ানিস’। গোধূলির গানে সেটি ‘ইয়ান্নিস’ রূপে মুদ্রিত। আমরা গণসাহিত্যের রূপটিই রেখেছি। তাছাড়া পত্রিকায় কবিতাগুলোতে অনুসরণ করা হয়েছে তৎকালে প্রচলিত বানানরীতি। অর্থের কোনোরূপ পরিবর্তন না করে একটি সামঞ্জস্য সৃষ্টির জন্য কয়েকটি শব্দ সাম্প্রতিক বানানে রূপান্তরিত হল। যেমন : কোন- কোনো, শাদা- সাদা, মাতারী- মাতারি, গীটার- গিটার, বললো- বলল, করলো- করল, দু’টো- দুটো, ব’লে- বলে, চীৎকার- চিৎকার ইত্যাদি।

সংগ্রহ, সম্পাদনা ও ভূমিকা : জোহা আজাদ

অব্যক্ত

সন্ধ্যার আকাশের নীচে জ্বলছে গোটা শহর;
দুটো লাল, দারুণ লাল, আলোর মণ্ডল
জ্বলজ্বল করছে উঁচুতে,
ঐ ব্যাখ্যাতীত উঁচুতে, আমাদের জানলাগুলো,
ব্রিজগুলো, ট্যাক্সিগুলো, বাসগুলো, রাস্তাগুলো
আলোয় আলোকময় হয়েছে, আলো, কেবল আলো!

‘আমারও একটি সাইকেল ছিল’—সে বলে উঠল;
‘—আমি দেখেছিলাম একটি স্বপ্ন’—সে বলল আবার।
আসন্ন রাত্রির দূরে-তাকিয়ে-থাকা ঘরের মহিলাটি
দূরেই তাকিয়ে থাকলেন; তাঁর ঠোঁট তৈরি করল না কোনো শব্দ
কিংবা ধ্বনি; তাঁর ডানপাশের পোশাকে সেলাই নেই।
যদি মহিলাটি উঠে দাঁড়ান, দেখা যাবে, একটু কুঁজো!
আর অবশিষ্ট রয়ে যাচ্ছে যা কিছু সেসব সম্বন্ধে যাবে না
বলা কোনো কিছুই;
একটি ঝলমলে গ্লাসের টুকরোর মতো জড়ো করে রাখতে হয়েছে।
তোমাকে নিজের হাতে ওগুলো বহন করে নিতে হবে
যখন আসবে আবর্জনা সংগ্রহের লোকেরা;
একটি অপরাধী আগ্রহে
হলুদ কাগজে মুড়ে ঐ পানি-খাওয়ার টলটলে
কাচের টুকরোগুলো নিয়ে
তোমাকে নামতে হবে সন্তর্পণে,
তোমার মনে সব সময় গেঁথে আছে একটা ভয়;
সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে যদি খামোখা ধাক্কা খাও
রেলিঙের সঙ্গে, তাহলে, তুমি জানো,
দারুণ রঙ্গ ভরে বেজে উঠবে গ্লাসটির মনোরম টুকরোগুলো,
এখনও অসংখ্য ঝংকারে ভরে আছে তারা,
অসংখ্য ধ্বনি, কেননা ছিন্ন হয়নি তার সেই সূত্র
যা তাকে আত্মীয় করে রেখেছে
ঐ দেয়ালের, ঐ জানলার, ঐ বাতাসের।
অন্ধ সংগীতজ্ঞ উঠে আসে ধাপে-ধাপে, ক্লান্ত।
চেয়ারের ওপর রাখে বেহালার বাক্সো; তারপর
নিঃশব্দে খোলে তার ডালা : বেরিয়ে আসে
দুটো উজ্জ্বল, আস্তো, দাগহীন ঝলমলে গ্লাস।

পুষ্পমাল্য

ঝলমলে আর্শির ভেতরে,
হলুদ টেবিলে,
ডান দিকের কোণায়
চাবির গুচ্ছ ফেলে এসেছি।
স্ফটিক কিছুতেই খুলবে না,
কিছুতেই খুলবে না।

*
তোরঙ্গের ওপর একটি গোলাপ।
তোমার হাত বেল্টের সাথে
আংটার মতো লেগে আছে,
তুমি কী বলতে চেয়েছিলে, কী?

*
এই বমি-বমি ভাব।
এ কোনো রোগ নয়।
এটা একটা উত্তর।

*
বাতাসের বন্যতায়,
উঁচুতে, ঐ উঁচুতে,
যেখানে বাজপাখি ধূসর, সাদা
এবং স্বাধীন।

*
বাতাসের চিৎকার।
রাত্রি।
চোখের পাতার মতো আলো কাঁপছে, বন্দরে।
শুল্ক বিভাগের দীর্ঘ করিডোরে
এক মাতারি, পরিষ্কার করছে ময়লা।
স্যুটকেসগুলো বন্ধ।
একটা সাইনবোর্ড : ‘নিষিদ্ধ’।
বাতাস একজন কমরেড।
দ্যাখো : মাস্তুলগুলো, বিশাল মাস্তুলগুলো!

*
নীল রঙে ছাপা আমার ছায়া।
আমি দাঁত মাজি
আমি গিটার বাজাই।
তুমি লুকিয়ে আছ খাটের নীচে।
আমি ভান করি আমি দেখি না।

*
সব কছিুই গোপন—
পাথরের ছায়া,
পাখির পা,
সুতো-জড়ানো মাকু,
চেয়ার,
কবিতা।

হ্যাঁ, সত্যি

আ, সত্যি, সুন্দর এই চরাচর। গাছতলায় দাঁড়ানো একজন লোক
একবার খুব চিৎকার করে কেঁদেছিল ভালোবাসার আনন্দে। সে ছিল
মৃত্যুর চেয়ে মহার্ঘ, মূল্যবান এবং শক্তিশালী, সেই লোকটা—
আর তাই আমাদের গান।

কেউ থামাতে পারবে না এই গান। অবিচ্ছিন্ন আমাদের গান।
‘সুন্দর এই চরাচর’—আমরা বলি, দীপ্র আবেগে বলি, বারবার বলি,
রুটি চিবুতে চিবুতে, দাঁতে-দাঁত পিষে বলি, ‘সুন্দর, সুন্দর, সুন্দর
সুন্দর এই চরাচর’—আমাদের গান আমরা গাইতে থাকি।

লেখাটি শেয়ার করুন :

জোহা আজাদ

জোহা আজাদ। সাহিত্যসমালোচক। শিল্পকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক রচনাও লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!