একগুচ্ছ রঙ্গন
মানুষের হাতের বুকে হাতের রেখা জালের মতো ছড়িয়ে থাকে। হাতনদীর জল থেকে এ জাল টান দিলে মাছ উঠে কি? উঠুক বা না উঠুক মাঝে মাঝেই মানুষ হাতের রেখাজাল ধরে টান দেয়। মাছ উঠে কি উঠে না কে জানে। মানুষ জানে। মানুষ জানে না।
চারদিক জুড়ে চরম শীত পড়েছে। সূর্য তার বাঘ স্বভাব লুকিয়ে রেখে খরগোশ স্বভাব নিয়ে মেঘবনের আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। আর শীতজয়ী কচ্ছপ। গ্রীষ্মকালে থাকে সূর্যের বাঘচরিত্র। তখনো মানুষ পড়ে বেকায়দা অবস্থায়। যেমনভাবে শীতকালে মানুষ পড়ে আছে বেশ বেকায়দা অবস্থায়। মানুষ মনে করতে পারছে না এ শীতকালের বয়স কত হল। এ শীতকাল কবে যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না।
আলপনা তার হাতের রেখাগুলো ধরে টান দিল আর সেগুলো শীতের পোশাকের পশমি সুতোর মতো বেরিয়ে এল। কোনোকিছুই শূন্যে ঝুলে থাকার জন্য নয়, সবকিছুকেই মাটি তার নিজের দিকে টেনে ধরে। কিন্তু হাত থেকে খুলে ফেলা রেখাগুলো শীতের বাতাসের গায়ে ঝুলে থাকল। তার হাত এখন হোয়াইটবোর্ডের মতো সাদা। রেখাহীন হাত দেখতে অদ্ভুত লাগছে। সে ভাবছে হাতের রেখাগুলো আবার হাতে পরে নিবে কি না। ভাবতে ভাবতে বাতাসে ঝুলে থাকা মাকড়সার নতুন জালের মতো হস্তরেখার দিকে তাকায়। সে দাঁড়িয়ে আছে একটা চা-চকলেট-কফি-সিগারেটের দোকানের সামনে। সবদিক থেকে মানুষ চলাফেরা করছে। মানুষের চলাফেরার শব্দ আছে। সবাই নিঃশব্দতা চায় শব্দ করে। ফলে শব্দ বেড়ে যায়, কমে না। মানুষের শব্দ বাড়তেই আছে সময়ের দশ দেয়ালে।
আলপনা হস্তরেখাহীন হস্তের দিকে তাকাল। এই হস্তরেখাহীন হাত নিয়ে সে যদি কোনো জ্যোতিষীর কাছে যায় জ্যোতিষী ভিরমি খেয়ে পড়বে। জ্যোতিষী বলতে পারে- ‘হাতের রেখাহীন মানুষ আমি কোনোদিন দেখিনি। তুমি কোনো কবির কাছে যেতে পারো বা গানওয়ালার কাছে, সেই তোমার ভাগ্যের ভোগে কী আছে বলে দিতে পারবে।’
চরম এক শীতকাল চলছে জগতে। মগজে শীত গোঁজা হয়ে যাচ্ছে এমনিতেই। মগজের ভেতর শীত ঢুকে যাচ্ছে। এত শীতের ভেতরে কেউ হাসতেও পারছে না। যারা হাসতে পারছে তাদের ভেতর থেকে শীত কিছু কিছু করে বের হয়ে যাচ্ছে ফলে তাদের শীত কিছুটা কম করছে। হাতের রেখা খুলে দেবার পর আলপনার ঠোঁট থেকে মৃদুমধু হাসি চুয়ে চুয়ে পড়ছে। ফলে তারও শীত কিছুটা কম লাগছে। তার ঠোঁট কমলালেবুর কোয়ার মতো রস ধরে বসে আছে। শীতের বাতাসের ঠোঁট আলপনার ঠোঁটের মিষ্টি কমলাকোয়া চুষে নিচ্ছে। সে হাসতে হাসতে তার হাসি বন্ধ করল। এখন তার ঠোঁটে লেপ্টে আছে হাসি বন্ধ করার হাসি। তার ঠোঁটের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে শীতকে আরো গাঢ় করে তুলছে।
২
একটা লোক তার পুরো শরীর মাথা ঢেকে শীতের সাথে কথা বলছিল। আলপনা লোকটার দিকে তাকায়। লোকটা আলপনার দিকে তাকায়। দুজনের তাকানো মাঝামাঝি জায়গাতে এসে থেমে যায়। আলপনার তাকানোটা লোকটার তাকানোকে বলে সরে পড়ো, আমি আলপনার তাকানো, আলপনা যে লোকটার দিকে তাকিয়েছে সে লোকটার মুখ ছুঁয়ে ঘুরে এসে আবার আলপনার চোখের ভেতর ঢুকে যাব। বড্ড শীত, শীতের ভেতর বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারব না। এসব বলে আলপনার তাকানো লোকটার তাকানোর দিকে রাগীভাবে তাকিয়ে থাকল। লোকটার তাকানোও বেশ নাছোড়। পথ ছেড়ে দাঁড়ালো না, সেও চাইছে সেই আগে গিয়ে আলপনার মুখদৃশ্য ধারণ করে লোকটার চোখে ফিরে আসতে। লোকটার তাকানো আর আলপনার তাকানোর ভেতর বেশ বচসা শুরু হয়েছে। তারা গরম হয়ে উঠেছে। শীতকে তারা আমলেই নিচ্ছে না আর। শীত তাদের ঠান্ডা করতে পারছে না।
আলপনার তাকানো আর লোকটার তাকানো বচসা করতেই থাকল।
‘আরো বেশি শীত করছে’মনে মনে বলে আলপনা কোনো একদিকে হাঁটতে লাগল যেন যেদিকে সে যাচ্ছে সেদিকে শীত নেই। লোকটাও মনে মনে বলছে ‘শীতগুলোকে পোড়াতে পারলে ভালো হত।’সে হাঁটতে শুরু করল একটা দোকানের দিকে, যেন সে দোকান থেকে ম্যাচ কিনে শীতের গায়ে আগুন জ্বালাবে।
আলপনা গেল কিন্তু যেদিকে গেল সেদিকেও দারুণ শীত। লোকটা ম্যাচ কিনল কিন্তু তাতে সিগারেট জ্বলল শীত জ্বলল না। শীত গলল না, শীত টলল না।
৩
আলপনা একা বসে আছে একটা ঘরে। সে চাদরের ভেতর হাত ঢুকিয়ে শীত তাড়াতে লাগল। শীতের ভীত বেশ শক্ত। আলপনা বসে আছে বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায়। তার চোখে শীত, কপালে শীত। তার ফুসফুসে শীত ঢুকছে, হৃৎপি-ের রক্তের সাথে শীত মিশে গিয়ে রক্তের একটা নতুন উপাদান হয়ে গেছে। তার স্তনের নরমের উপর শীত ঠান্ডা হয়ে শুয়ে আছে। সে চা পান করবে কি না ভাবল। চা তৈরির জন্য উঠতেও তার ভালো লাগছে না। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে চা তৈরি করল। চা পান করল মনে মনে। বেশ উষ্ণতাবোধ করল এখন। সে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ থেকে শীত ঝরে পড়ল, তার কপাল, গাল আর ঠোঁট থেকে শীত ঝরল। তার স্তনগদী থেকে শীত তার ঠান্ডা নিয়ে বের হয়ে এল। তার চুলের রাশি খুলে গেল। চুলের ভেতর থেকে সিগারেটের ধোঁয়া বের হতে দেখে সে অবাক। সিগারেটের গন্ধ তার একদম সহ্য হয় না। কিন্তু এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না। চুলের ভেতর থেকে সিগারেটের ধোঁয়া কেন বের হচ্ছে সে বুঝতেই পারছে না।
এখানে ইচ্ছে মতো দাগ কেটে হস্তরেখা মানে ভাগ্যরেখা তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
সে তার হাতের দিকে তাকাল। হাতের রেখা নাই। তার হাত আনকোরা হোয়াইট বোর্ডের মতো সাদা। এখানে ইচ্ছে মতো দাগ কেটে হস্তরেখা মানে ভাগ্যরেখা তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। আলপনা মুচকে হাসল একা একা হাতের দিকে তাকিয়ে। সে একটা কলম খোঁজার জন্য টেবিলের দিকে গেল। টেবিলে যতরকম কলম আছে সবগুলো ব্যবহার করে সে তার হাতের রেখা আঁকবে। লাল, নীল, বেগুনি, সোনালি, রুপালি সমস্ত রঙের হস্তরেখা আঁকবে তার হাতে। আজব, টেবিলে কোনো কলম নাই। টেবিলের উপর পড়ে আছে আইলাইনার। এটা ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকার কথা। এখানে এল কী করে। সে কলম খুঁজেই পেল না। আইলাইনার দিয়েই সে তার হাতের ভাগ্যরেখা আঁকবে নাকি।
সে আইলাইনারটা নিয়ে বিছানায় এসে বসল। ভাবছে সে। ভাবনাজলে অনেকক্ষণ ধরে ভাসছে। শীতের ভাবনা ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ভাবিত হচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ, স্বাদ আবার পায় সে। ভাবনার জল থেকে উঠে আসে আলপনা। ভাবনাজলে সাঁতারকাটা, স্নানকরা কিশোরীর মতো স্নিগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়ায়। বিছানাপুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার অবাক হওয়া, স্তব্ধ হওয়া কাটে না। সে তার হাতের দিকে তাকাল। সে তার হাতে কোনো রেখা টানেনি। সে তার সাদা বেডকাভারের একেবারে আগা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা জ্বলন্ত সিগারেট এঁকেছে। কেন সে সিগারেট এঁকেছে এ প্রশ্নের উত্তর করার সময় দিল না শীত। শীত তার শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। তার কাঁপুনি তাকে জ্বলন্ত সিগারেট আঁকা বিছানায় টেনে আনল। সে ঘুমিয়ে গেল।
আলপনা ঘুমুচ্ছে। আলপনা ঘুমুতে ঘুমুতে সারারাত ধরে একজনকে স্বপনের ভেতর খুন করল। সে খুন করার সময় বুঝতেও পারছে না কাকে খুন করছে। সে ঘুমে তলিয়ে আছে, খুন করাতে, ছুরি চালাতে, রক্ত মাখাতে মাতাল হয়ে আছে স্বপনের ভেতর।
৪
ভোর হয়েছে। জগৎ ভোরকে বুঝে নিচ্ছে, যেমন করে লোকজন হিসাব-কিতাব বুঝে নেয় অন্যের কাছে থেকে। লোকটা ঘুম থেকে জাগে তার ব্যথা নিয়ে। তার শরীরে অদৃশ্য পোঁচানোর ব্যথা। গলগলিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে যেন, সে বুঝতে পারছে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। সে ব্যথা নিয়েই রুম থেকে বের হয়ে আসে। সে চেষ্টা করেছিল ব্যথাগুলোকে খুলে খুলে রুমের ভেতর রেখে আসার। কিন্তু পারেনি। শীত যেমনভাবে মানুষের গায়ের সাথে লেগে থাকে, গ্রীষ্ম যেমন মানুষের গায়ের সাথে লেগে থাকে তেমনভাবে ব্যথাটা লেগে আছে গায়ের সাথে। ব্যথাও লেগে আছে, দেখা যাচ্ছে না।
গতকাল যেমন শীত ছিল আজ তেমন নাই। রোদ উঠেছে চকচকে। সে রোদের ভেতর দাঁড়াল। তার সামনে কাঠগোলাপের গাছ। সে সেই গাছের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। মানুষের দেহের অঙ্গগুলোর মধ্যে চোখ হল বড়ো চোর, চোখেরা চুরি করতে ওস্তাদ। চোখ যে শরীরে থাকে সে শরীরের মালিক যে সে মালিকের কথাও মানে না। সে চুরি করবেই। লোকটা কাঠগোলাপের দিকে না তাকাতে সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু তার চোখচোর চুরি করে আবার কাঠগোলাপের দিকে তাকাল। চোখচোর তার মালিককে ফাঁকি দিয়ে মালিকের ভেতরের বস্তুকে, বিষয়বস্তুকে, ভাবকেও চুরি করে বের করে আনে অন্য লোকের সামনে। বলেই তো, অন্য মানুষে বুঝে নেয় লোকটা খারাপ, লোকটা ভীতু, লোকটা লোভী। যদিও চোখের মালিক প্রাণপণ চেষ্টা করে বুকের ভেতর তার দুর্বলতা লুকিয়ে রাখার কিন্তু চোখ সেগুলো কাগজের প্যাকেট থেকে কাগজ বের করার মতো করে বের করে আনে। তাসের মতো বের করে আনে।
লোকটা এবার জবাফুলের দিকে তাকাল। জবাফুলের লাল হা করা মুখের ভেতর দিয়ে জিহ্বার মতো জননদ- বের হয়ে আছে। ব্যাপারটাকে তার বেশ অশ্লীল মনে হল। ফুল হলেই সে ফেরেশতা হবে এমন কথা নেই। জবাফুলের দিক থেকে তার চোখ সরিয়ে নিল। চোখ শুধু চোর নয় অনুসন্ধানীও বটে। চোখ যেমন তার মালিককে বিপদে ফেলে তেমন সাহায্যও করে। চোখ এবার পড়ল একটা রঙ্গনগাছের দিকে। তরতাজা রঙ্গনগাছ। গাছটাতে একটা মাত্র রঙ্গনের থোকা। চারপাশে আরো রঙ্গনের গাছ আছে, সেগুলো আরো বেশি করে ফুল ধরে আছে। কিন্তু একটা থোকা থাকা রঙ্গনকেই তার পছন্দ হল। সবুজ সুন্দর পাতার ভেতর হৃৎপিণ্ডের মতো জ্বলে আছে একটা রঙ্গন থোকা।
এবার চোখ চোর হল না। লোকটারই চোর হতে ইচ্ছে করল। সে চোর হল। সে দেখে নিল তার চারপাশে কোনো লোকজন আছে কি না। কোনো লোকজন নাই। সে রঙ্গন গাছের কাছে গেল। হাত বাড়াল। ধারালো নখ ডুবিয়ে দিল রঙ্গন থোকার গলায়। রঙ্গন তার হাতে উঠে এল। লাল টকটকে রঙ্গন। ‘মাফ করিস রে গাছ, তোর ফুল তুললাম তার জন্য। তার খোঁপার জন্য’ লোকটা রঙ্গনগাছের দিকে তাকিয়ে বলল।
যে পকেটের কাছাকাছি শিশ্ন থাকে সে পকেটে তার জন্য ফুল রাখা ঠিক হবে না। কোথায় ফুল রাখা যেতে পারে সেটা সে তাড়াতাড়ি ভাবার চেষ্টা করছিল। সে তাড়াতাড়ি করছে কারণ ফুল বেশিক্ষণ হাতে ধরে রাখা যাবে না।
লোকটা রঙ্গন ফুলের থোকাটা কোথায় রাখবে এমন ভাবনার ভেতর পড়ল। এটা হিপ পকেটে গুঁজে রাখা যায়। যখন তার সাথে দেখা হবে তখন হিপপকেট থেকে বের করে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এটা তার কাছে অরুচিকর মনে হল। তাকে নিশ্চয় হিপপকেট থেকে কোনো কিছু বের করে দেওয়া ঠিক হবে না। হিপপকেট শুধু নোংরা টাকা গুঁজে রাখার জন্য। টাকা নোংরা জিনিস, বিশ্বের বেশির ভাগ টাকা নোংরা কাজের জন্য ব্যয় হয়, ফালতু কাজের জন্য ব্যয় হয়। সুতরাং হিপপকেটকে সে ফুল রাখার জায়গা হিসেবে বাদ দিল। সে ভাবল এটা ফ্রন্ট পকেটে রাখা যেতে পারে। ফ্রন্ট পকেট থেকে বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। এটা তার মনোপুত হল। সে পকেটে হাত ঢুকাল দেখে নেবার জন্য যে, পকেটে অন্যকিছু আছে কি না। অন্যকিছু থাকলে তার চাপাচাপিতে ফুল দুমড়ে যেতে পারে। দুমড়ানো ফুল তার হাতে দেওয়া যাবে না। না পকেটে কিছু নেই। সিগারেটের প্যাকেট নেই, ম্যাচলাইট নেই, ফোনও নেই। কিন্তু হাতটা পকেটে ঢুকার পরপরই ঠেকে গেছিল শিশ্নের সাথে। পকেটে অল্প ফুটো আছে সেখান দিয়ে একটা আঙুল ঢুকে শিশ্নের কাছে চলে গেছিল। যে পকেটের কাছাকাছি শিশ্ন থাকে সে পকেটে তার জন্য ফুল রাখা ঠিক হবে না। কোথায় ফুল রাখা যেতে পারে সেটা সে তাড়াতাড়ি ভাবার চেষ্টা করছিল। সে তাড়াতাড়ি করছে কারণ ফুল বেশিক্ষণ হাতে ধরে রাখা যাবে না। ফুল হাতে থাকা অবস্থায় কেউ দেখে ফেললে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে- ‘কার জন্য ফুল তুলেছ কবি?’
৫
এই ফুল তোমার জন্য। লোকটা ফুলগুচ্ছ তার বুকপকেট থেকে বের করে দিল। সে বুকপকেটে ফুল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখানে হৃৎপি- আছে, এখানে ফুসফুস আছে। যদিও সে বহুক্ষণ ধরে নিজের সাথে যুদ্ধ করেছিল ফুল রাখার ক্ষেত্রে একটা মাত্র কারণ নির্ধারণ করার জন্য। সে চেয়েছিল, এখানে হৃৎপি- আছে এই কারণেই ফুল বুকপকেটে রেখেছি, এমনটা বলতে। কিন্তু তা হয়নি। সে তারপর ভেবেছিল, যেহেতু ফুসফুস আছে এখানে সেহেতু ফুলটা এখানে রেখেছি। বুকপকেটে ফুল রাখার ক্ষেত্রে ফুসফুস কারণ না হৃৎপি- কারণ তার সুরাহা না করেই বুকপকেটে ফুল রেখে দিয়েছিল।
‘এই ফুল তোমার জন্য।’লোকটা ফুলগুচ্ছ বের করার সময় এ কথা বলছিল। সে বলেছিল যেহেতু বুকপকেটের কাছে হৃৎপি- আছে সেহেতু তোমার জন্য তোলা ফুল আমি বুকপকেটে রেখেছিলাম। ফুল নেবার সময় সে সুন্দর করে হাসে। লোকটা আবার বলেছিল, যেহেতু বুকপকেটের কাছে ফুসফুস থাকে সেহেতু এ ফুল আমি বুকপকেটে রেখেছিলাম। ফুল নেবার সময় সে সুন্দর করে হাসে।
‘এই ফুল আমার জন্য!’ আলপনা ফুল নেবার সময় বলে। সে বিস্ময় নিয়ে লোকটার দিকে তাকায়। লোকটা গতকাল সিগারেট টানছিল। সিগারেটের আগুনের ভেতর দিয়ে শীত পুড়িয়ে পুড়িয়ে ফুসফুস ভর্তি করছিল। তার সিগারেটের ধোঁয়া কু-লী পাকিয়ে তার খোঁপার কু-লীর ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল।
ফুল গ্রহণ করার সময় আলপনা লোকটাকে বলল- কবি!
কবি বলল- আলপনা!
আলপনা বলল- কবি আমার হাতের রেখা আমি খুলে ফেলেছি। আমার হাতে কোনো রেখা নেই।
কবি আলপনার হাত তার হাতে নেয়। তাদের হাতের ভেতর থেকে শীত ঝরে ঝরে পড়ে। কবি আলপনার হাতের উপর হাত রাখে, যেমনভাবে কাগজের উপর রাবার স্ট্যাম্প রাখে। কবি তার হাত আলপনার হাতের উপর রেখে চাপ দেয়। কবির হাতের রেখার দাগ পড়তে থাকে আলপনার হাতের উপর। আলপনা তার হাতের রেখা যেগুলো খুলে ফেলেছিল আর বাতাসের গায়ে শূন্যে দুলছিল সেগুলো নিয়ে আলপনার ঠোঁটে মাখিয়ে দেয়।
আলপনার হস্তরেখা মাখা ঠোঁটের দিকে কবির ঠোঁট এগিয়ে যায়। আলপনার ঠোঁট থেকে আলপনার হস্তরেখা কবির ভেতর ঢুকতে থাকে।
তাদের চারপাশে প্রচুর লোকজন। কিন্তু তাদের চোখ তাদের সাহায্য করার জন্য পদক্ষেপ নেয়। চারদিকের কোনো দৃশ্য, মানুষের গ্যাঞ্জামপূর্ণ দৃশ্য তাদের চোখ ধরে রাখে না। তাদের চোখ তাদের দেখাচ্ছিল পূর্ণ নির্জনতা। তাদের ভেতর কোনো শীত বিরাজ করছিল না। চারপাশে আর কোনো শীত বিরাজ করছিল না। চুম্বনে চুম্বনে বন তৈরি হচ্ছিল। চুম্বনে চুম্বনে জীবন তৈরি হচ্ছিল।
মানুষজন অবাক হচ্ছিল, হঠাৎ করে শীত উবে গিয়ে বসন্তবাতাস বইতে শুরু করল কীভাবে! মানুষজনের চোখগুলো মানুষজনকে কবি আর আলপনার শীত ঝরিয়ে ফেলার দৃশ্য দেখতে দিচ্ছিল না।
আলপনা রঙ্গনগুচ্ছ চুলে গুঁজে বিরাট এক ফুলের মতো হেঁটে গেল। কবি বিরাট এক সুগন্ধী সিগারেটের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।

আনিফ রুবেদ
১৯৮০ সালের ২৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। এখন পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। কাব্যগ্রন্থ : পৃথিবীর মৃত্যুদণ্ডপত্র, এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি, শরীরীয়ত শরীরীয়া। গল্পগ্রন্থ : মন ও শরীরের গন্ধ, দৃশ্যবিদ্ধ নরনারীগান, জীবগণিত, মানুষাশী মানুষ। উপন্যাস : আগামীকাল থেকে সূর্য পুর্বে উঠবে। তিনি ২০১২ সালে জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।