ভ্রান্তিবিলাস
একথা সত্যি যে আমি অদিতির মধ্যে মোহনাকে খুঁজছিলাম। আমার দুঃখবিলাসী মন ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিল গভীরতর মর্মবেদনায়। মোহনার জন্য আকণ্ঠ তিয়াসে সে পুড়ে চৌচির হচ্ছিল রাত্রিদিন। মোহনা আমাকে ভালোবাসে না, চায় না আমাকে, সেকথা জানার পরও তার প্রতি আমার ভালোবাসা তো কমেইনি, উল্টে বেড়েছিল আরো। বেনো জলের মতো উছলে উঠেছিল দুকুল ভাসানো প্রেম। ভালোবাসা কি এমনই হয় আদতে? এমনই কাণ্ডজ্ঞানহীন, অন্ধ আর যুক্তিবিবর্জিত? জানি না। জানতে চাইও না। তবু এটাই সত্যি যে মোহনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। নারীর ভালোবাসায় যে সমর্পণ থাকে, তা যদি পুরুষের ভালোবাসায় স্থানান্তরিত হয় তবে নারী তাকে সস্তা ভাবে, অবজ্ঞায় পাশ কাটিয়ে যায়। মোহনাও আমাকে সস্তা ভেবেছিল। ভেবেছিল নিতান্তই ফেলনা আর খেলো। দারুণ তাচ্ছিল্যে আমাকে সে ফেলে গেছিল পথে। মাড়িয়ে গেছিল তুমুল উপেক্ষায়। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত আর হাস্যকর নয়? মানে এই মানবমনস্তত্ত্ব? নয় জটিল আর কিম্ভুত? অন্তত আমার তেমনই মনে হয়। নইলে যেই মোহনার কাছে আমি নিজেকে উজাড় করে দিলাম, সে-ই কি-না আমাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘর বাঁধল গিয়ে আমারই বন্ধু জাবিনের সঙ্গে। অথচ জাবিন ওকে পাত্তাই দিত না একদম, স্বভাবে ভীষণ রুক্ষ আর বদমেজাজি জাবিন মোহনাকে ভালোবাসে, তেমন আলামত কোনোদিনই পাইনি আমি। তবু কোত্থেকে কী হয়ে গেল। আমার ভালোবাসাকে থোড়াই কেয়ার করে মোহনা জাবিনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল রাতারাতি। কিন্তু আমি দেবদাস বনে যাইনি। বরং হাসিমুখে জাবিন আর মোহনার সুখি ভবিষ্যৎ কামনা করেছি, তাদের কল্যান কামনায় পানও করেছি দুচারপেগ। তারপর অদিতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দিব্যি সংসার সংসার খেলতে শুরু করেছি তার সঙ্গে। শুরু করেছি জীবনের পাশা খেলা। তবু খানিকটা গলদ থেকে গেছে। আছে। থাকেই। অদিতি আমার প্রেমে অন্ধ। আমাকে সে ভালোবাসে নিজের চেয়েও বেশি। কিন্তু এই বেশিতেই যত বিপত্তি। যেমন বিপত্তি ছিল মোহনার প্রতি আমার বেশিতে। বেশি মানেই সস্তা। বেশি মানেই অনাযত্ন, বেশি মানেই অনাসক্তি। মোহনাকে অতিরিক্ত ভালোবেসে আমি যেমন সস্তা হয়ে গেছিলাম তার কাছে, হয়ে গেছিলাম নিতান্তই মূল্যহীন আর তুচ্ছ একজন, অল্পদিনেই অদিতিও তেমনই হয়ে গেল আমার কাছে। বড় সস্তা আর বিবর্ণ লাগল তাকে। আমি মনে মনে তাকে তুলনা করতে থাকলাম মোহনার সঙ্গে। আমার প্রতি ছুড়ে দেয়া মোহনার অপমান আর অবহেলা মনে করে নিজেকে অদিতির প্রতি অকরুণ হওয়া থেকে আমি বিরত রাখলাম ঠিকই, মনে মনে করুণার্দ্রও হলাম বটে তার প্রতি, কিন্তু সেই করুণা যেন তার প্রতিও নয় আদতে! আমার মনে হল আমি অদিতি নয়, বরং মোহনার কাছে আমার অবহেলিত, অপমানিত সত্তাটাকেই অদিতির মধ্যে আবিষ্কার করে মূলত নিজেকেই করুণা করছি। ফলে অদিতির প্রতি যে গোঁজামিলে এক বোধ জন্মাল আমার মধ্যে, তাকে কোনোমতেই ভালোবাসা বলা যায় না। আমি নিজেই নাস্তানাবুদ হতে থাকলাম নিজের ভেতর জন্ম নেওয়া এমনতরো অদ্ভুতুড়ে বোধে, হাঁপিয়ে উঠলাম রীতিমতো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম অদিতি নয়, আমি মূলত মোহনাকেই ধারণ করে চলেছি নিজের ভেতর, সেইসাথে প্রতি পদে আমি অদিতির মধ্যে খুঁজে চলেছি মোহনার ছায়া। ব্যাপারটা ভীষণই ক্লান্তিকর আর একঘেয়ে। আমিও ক্লান্ত হয়ে গেলাম অচিরেই। কিন্তু সমস্যা মোহনা। সে তখনো আমার প্রতি মুগ্ধ আর প্রেমান্ধ। তাকে কী করে এড়াই আমি? আমার প্রতি তার এই অন্ধত্ব কী করে ছাড়াই? আমি কি অনেক দূরে কোথাও চলে যাব? অনেক নির্জন কোনো এলাকায় গিয়ে নতুন করে শুরু করব জীবন? পাহাড়ি কোনো জনপদে গিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করব পথচলা? একা একাই ভাবি। কূল পাই না ভেবে। নিজের ভেতরে মোহনার জন্য হাহাকার বাড়তে থাকে ক্রমশ। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটি মনে হয় আমার। আমার এমন চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অদিতি অস্থির হয়, অদিতি আমাকে সুখি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে, কী করবে ভেবে পায় না সে। তার এই অস্থিরতা আমাকে বিরক্ত করে তোলে আরো। আরো বহির্মুখি হতে তাগাদা দেয়। মন শুধু বলে, পালা রে অনন্ত! জীবনের এই গভীর খাদ থেকে পালিয়ে যা বহুদূরে!
দেখি সময় আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। কোন চোরাবালিতে ডোবায় অথবা ভাসিয়ে নেয় কোন উজানস্রোতে। এমন ভাবনা থেকেই আমি একদিন অতি ভোরে অদিতিকে ঘুমন্ত রেখে বেরিয়ে পড়ি পথে।
আমি অতঃপর মনস্থির করে ফেলি। সব ছেড়েছুড়ে চলে যাব দূরে কোথাও। যেখানে জীবনের নির্লজ্জ স্বার্থপরতা নেই, অহেতুক হ্যাংলামি নেই, তেমন কোনো নির্জন স্থানে গিয়ে আমি গা ভাসাব সময়ের স্রোতে। যাপন করব একান্তই নিজের জীবন। মোহনা বা অদিতির ছায়া মুছে ফেলব জীবন থেকে। ঘুচিয়ে ফেলব সমস্ত হাহাকার। দেখি সময় আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। কোন চোরাবালিতে ডোবায় অথবা ভাসিয়ে নেয় কোন উজানস্রোতে। এমন ভাবনা থেকেই আমি একদিন অতি ভোরে অদিতিকে ঘুমন্ত রেখে বেরিয়ে পড়ি পথে। আচ্ছা, এক জোছনা ধোয়া রাতে সিদ্ধার্থ যখন সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর পথে, শ্বাস নিতে চেয়েছিলেন মুক্ত হাওয়ায়, তখন ঘুমন্ত স্ত্রী-সন্তানের দিকে তাকিয়ে তার কি বুকের ভেতর ঢেউ উঠেছিল কোনো? উঠেছিল অনন্ত মায়ার জোয়ার? জেগেছিল অন্তহীন প্রেম? কে জানে!
সেই ঘুমগ্রস্ত ভোরে ঘুমন্ত অদিতির মুখের ওপর ভোরের এক ঝলক আলো এসে পড়ায় তাকে দারুণ স্নিগ্ধ আর মায়াবী লাগে। মনে হয় দেবীমূর্তি কোনো। পূজার উপাচারে যাকে তুষ্ট করতে উদগ্রীব হয় মন। সেই মুহূর্তে ঘুমন্ত অদিতির মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা বিভ্রম তৈরি হয় আমার ভেতর। মনে হয়, মোহনা ঘুমিয়ে আছে আমার বিছানায়। ইচ্ছে হয় ডেকে তুলি তাকে, করি জীবনের লেনদেন। করি ভাবের বিকিকিনি। পরক্ষণেই ভুল ভাঙে। মোহ কাটিয়ে উঠি। অদিতি বা মোহনা যে-ই হোক, কিছুই এসে যায় না তাতে আর। আমি মুক্ত বিহঙ্গ আজ থেকে। মা মারা গেছে সেই কবে। বাপ থেকেও নেই এখন। সংসারে আর কেউ নেই আমার। অদিতিই একমাত্র বাধা আমার। তাকে কাটিয়ে উঠলেই মুক্তি। তাকে এড়াতে পারলেই বাইরের খোলা হাওয়া। বড় দমবন্ধ লাগে আজকাল। বড্ড হাঁসফাঁস করে বুকের ভেতর। অদিতিকে ছেড়ে যেতে পারলেই পৃথিবী আমার। নিজের মনে তন্ন তন্ন করে খুঁজি, আঁতিপাতি করে সন্ধান করি। না। আর কোনো দুর্বলতা নেই সেখানে। কোথাও কোনো পিছুটান নেই আর। তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ি আমি আগুপিছু না ভেবে।
কত নদী-জল পেরোতে হয় মানুষকে একজীবনে? পাড়ি দিতে হয় কত বিস্তির্ণ দুর্গম পথ? বাঁধাধরা কোনো নিয়ম বোধকরি নেই। কতজনই তো জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়ে দেয় একই চৌহদ্দির ভেতরে, কোনো অসুখ, অপূর্ণতা কিংবা অপ্রাপ্তি স্পর্শমাত্রও করে না তাদের, অথবা করে হয়তো, তারা সেসবকে পাত্তা না দিয়েই, বিচলিত না হয়েই কাটিয়ে দেয় সুদীর্ঘ সময়, যাপন করে চেনা অভ্যাসে রপ্ত জীবন। কিন্তু এই যে যাপিত জীবন তাদের, সেটা কি তাদেরই থাকে শেষ পর্যন্ত? না কি আপাত সুখি জীবনের আড়ালে তারা আসলে যাপন করে যায় অন্যের জীবন? জীবনের চেনা পথ ছেড়ে, পরিচিত বলয় থেকে বেরিয়ে, নতুন বৃত্তপথে ছুটতে ছুটতে এমনতরো ভাবনা আমাকে প্রায়ই পেয়ে বসে আজকাল। মনে হয় নিতান্তই তুচ্ছ আর অর্থহীন এই জীবন। কোনো মানে নেই এই জীবনের। কেন জন্মানো মানুষের আর মৃত্যুই বা কেন, প্রশ্নদুটো আমাকে খুঁচিয়ে মারে অনবরত, উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমি আরো বীতশ্রদ্ধ আর বিমুখ হয়ে উঠি জীবনের প্রতি। এমন ছন্নছাড়া আর উদাস সময়ে আমার দেখা হয় আহেদ আলীর সঙ্গে। ভাগ্যিস দেখা হয়! আহেদ আলী আমাকে নতুন করে জীবন চেনায়। ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার চোখে জীবন এক নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয় সহসা। অথচ আহেদ আলী পাগল। তার দুটি পা-ই ত্রুটিপূর্ণ। সে হাঁটে অনেকটা খুঁড়িয়ে, সামনের দিকে ঝুঁকে। তার পা দুটো নিচের দিকে অতিরিক্ত রকম সরু, হাঁটার সময় অনেকটা দুলে দুলে ওঠে তার পুরো শরীর, মনে হয় সে পড়ে যাবে টাল খেয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পড়ে না আর, টাল সামলে নেয় অদ্ভুত কায়দায়। নিতান্তই পাগলা কিছিমের এক মূর্খ মানুষ আহেদ আলী। ভিক্ষে করে পথে পথে। তার বউ মাজু। অন্ধ। সে-ও ভিক্ষে করে হাটে-বাজারে। বউ অন্ধ হলে তার হাত ধরে ভিক্ষে করাই দস্তুর, অথচ আহেদ আলী আর মাজু ভিক্ষে করে আলাদা আলাদা। সারাদিনে কেউ কারো ছায়াও মাড়ায় না তারা, সন্ধ্যায় হাজির হয় নিজেদের ডেরায়, অন্ধ মাজু আহেদ আলীর সহায়তায় চাল-ডাল ফুটিয়ে যখন খেতে বসে টিমটিমে বাতির আলোয়, তখন তার মুখে বাতির ম্লান আলো পড়ে যে অদ্ভুত সুখের ঝিলিক ওঠে, তার কাছে পৃথিবীর যে কোনো সৌন্দর্য অতি নস্যি।
আহেদ আলী কেন মাজুর সঙ্গে ভিক্ষেয় বেরোয় না, এই প্রশ্ন করায় আহেদ আলী নিতান্তই দার্শনিকের মতো উদাস মুখে উত্তর দেয়, শোনেন ছার, যার জন্যি যা মাইপে থোয়চে আল্লা, সে তাই পাবি। এক সাতে গেলিই কী আর আলাদা গেলিই কী! আর সে কানা বইলেই পথঘাট আমার চায়া ভালো চেনে, আমাক ছাড়াই সে তার জীবনের ম্যালা পত চলেচে একলা একলা, এহনও আমাক ছাড়াই সে পারবি। তার হাত ধইরে নিয়া লাগবিনেন আমার।
আহেদ আলীর মতো নিতান্তই পাগল এক ভিক্ষুকের কাছে সমাজের উঁচুতলার মানুষের কী প্রয়োজন কে জানে! আমার ভাবনায় ছন্দপতন ঘটিয়ে কথা বলে ওঠে আগন্তুক লোকটা।
ভিক্ষে ছাড়াও আরো যে কিছু করে আহেদ আলী, সেটা বুঝতে বেশ কিছুদিন লাগে আমার। ছন্নছাড়া হয়ে ভাসতে ভাসতে আহেদ আলীর কাছে এসে আমার কচুরীপানার জীবনে হালকা একটু শেকড় গজাতে শুরু করেছে ততদিনে। এক সন্ধ্যায় ভিক্ষে থেকে ফিরে চুলোয় চাল-ডাল চড়িয়েছে মাজু, আহেদ আলী ঘরের দাওয়ায় বসে ঢুলছে আনমনে, অদূরে আমি বসে সিগারেটের পর সিগারেট ধ্বংস করে চলেছি, এমন সময় ধুলো উড়িয়ে, হাওয়ায় দারুণ শব্দ ছড়িয়ে একটা কালো জিপ এসে দাঁড়ায় আহেদ আলীর বাড়ির সামনে। ঢেরদিন ধরে আহেদ আলীর বারান্দার মাচানই একমাত্র ঠিকানা আমার, কেমন একটা আলস্য পেয়ে বসেছে আমাকে। আহেদ আলীর এই ভীষণ নির্ভার, নিস্তরঙ্গ জীবন প্রায় বেঁধে ফেলেছে আমাকে। জীবনের নানা ঘোরপ্যাঁচ, খানাখন্দ চেনা আমি আহেদ আলী আর মাজুর এই দারুণ শান্ত জীবনের প্রেমে পড়ে গেছি প্রায়। আচমকা জিপের শব্দে নড়েচড়ে বসি আমি। মাজু বা আহেদ আলীর মধ্যে তেমন কোনো চাঞ্চল্য চোখে পড়ে না। শুধু আহেদ আলী তার উস্কোখুস্কো, ধূলিময় চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে, ছার আয়চে রে মাজু। ম্যালাদিন পরে আইলে ইবার।
চুলোর আগুনের আঁচে চকচকে মুখে বাড়ির দেওড়ির দিকে অন্ধ চোখে তাকিয়ে মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে মাজু শুধু বলে, হু।
দেউড়ির মধ্যে জুতোর মসমস শব্দ তুলে দীর্ঘ এক ছায়া ভেতরে ঢোকে। দীর্ঘদেহী, সুঠাম শরীরের পুলিশের পোশাক পরা লোকটাকে রাতের অন্ধকারে ভারি অদ্ভুত আর রহস্যময় দেখায়। লোকটাকে দেখে ভেতরে ভেতরে ভীষণ চমকে যাই আমি। এই পোশাকের, এই শ্রেণির লোককে আহেদ আলীর কাছে আশা করিনি একদম। আহেদ আলীর মতো নিতান্তই পাগল এক ভিক্ষুকের কাছে সমাজের উঁচুতলার মানুষের কী প্রয়োজন কে জানে! আমার ভাবনায় ছন্দপতন ঘটিয়ে কথা বলে ওঠে আগন্তুক লোকটা। গম্ভীর, ভরাট গলায় ডাকে, আহেদ আলী!
আহেদ আলীর মধ্যে বিশেষ কোনো ভাবান্তর নেই। বসা থেকে ধীরে সুস্থে উঠে সে উত্তর করে, জি ছার। ম্যালাদিন পরে আলেন ইবার গরিবির বাড়িত।
কেরোসিনের বাতির ম্লান আলো আগন্তুক লোকটার শরীরে পড়েছে খানিকটা। তাতে তার বুকের ওপর লাগানো নেমপ্লেটটা চকচক করে, বারান্দা থেকে অস্পষ্ট পড়া যায়, ‘এসপি নাজমুল’। মাঝবয়সী লোকটার মুখটা অতিরিক্ত গম্ভীর, পুলিশি কাঠিন্যে ভরাট। লোকটা আহেদ আলীর কথার উত্তরে কিছু না বলে নিজের বক্তব্য পেশ করে, তোমার ভাবি তোমাকে একবার যেতে বলেছে। সম্ভব হলে এখন চলো।
এহন? এহন তো রাইত হয়া গেচে ছার। কাইল গেলি হয় না?
দিনে তো তোমার পাত্তা পাওয়া যায় না। এখনই চলো। আমি তোমার ফিরে আসার ব্যবস্থা করব আবার। বেশিক্ষণ লাগবে না।
মাজুও লোকটার কথায় সায় দিয়ে আহেদ আলীকে বলে, ছার যহন যাতি কচ্চে ত্যে যান। দেহা করে আসেন ভাবির সাতে।
আমাকে হতভম্ব, হতবাক বসিয়ে রেখে অতঃপর আহেদ আলী লোকটার পুলিশ জিপে উঠে, ধুলো উড়িয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যায় চোখের সামনে দিয়ে।
আহেদ আলী খানিকটা পাগলাটে কিসিমের। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি তার কম। আমাকে বলে যাওয়ার কথা তার মাথায়ই আসেনি হয়তো। কিংবা উত্তেজনায় সে এবং মাজু হয়তো ভুলেই গেছে আমার উপস্থিতি। তার চলে যাওয়া পথের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে অতঃপর চোখ ফিরিয়ে নিই। বারান্দার মাচায় বসে অগত্যা মাজুর রান্না দেখি। উঠোনের একপাশে, খোলা আকাশের নিচে মাটির চুলা, তাতে লাকড়ি, শুকনো পাতায় রান্নার ব্যবস্থা। চুলোর আগুনের দবদবে আঁচ মাজুর মুখের ওপর পড়ে জ্বলে, চকচক করে মাজুর মুখ, অন্ধ মাজু একমনে রান্না করে। তার মুখে গাছের পাতারা ছায়া ফেলে এলোমেলো, চুলোর আগুন থেকে ধেয়ে আসা আলো সেই মুখে আলোছায়ার এক আশ্চর্য আল্পনা আঁকে। আমি অবাক তাকিয়ে থাকি। অন্ধ মাজু কি টের পায় যে কেউ অবাক হয়ে দেখছে তার মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা রহস্যময়তা? সম্ভবত না। একফাঁকে আমাকে সে বলে, ছার, আপনে খাতি বসেন, আমার রান্না শ্যাষ। তার আসতি ম্যালা দেরি, আপনে খ্যায়া নেন ততক্ষুণি।
লোকটা কে? সুযোগ পেয়ে মাজুকে আমি প্রশ্নটা করি অবশেষে। এতক্ষণ কৌতূহল চেপে আমি মূলত মাজুর কাছে প্রসঙ্গটা তোলার মওকা খুঁজছিলাম। মাজু নির্বিকার উত্তর দেয়, কিডা? পুলিশ ছার? উনি বিরাট পুলিশ অপিচার। উনার বউ পিরায়ই তারে ডাইকে নিয়ে যায়। উনাগের মনে যবর দুক্কু। তাই তারে মাজেমদ্যি ডাইকে নিয়ে দুডে সুক-দুক্কির কতা কয়।
শুনে বিস্ময়ে থ বনে যাই আমি। জগতে মানুষের দুঃখের অন্ত নাই সত্যি, তা বলে এক পুলিশ দম্পতির দুঃখ লাঘবে আহেদ আলীর মত পঙ্গু, পাগল এক ভিক্ষুককে কেন প্রয়োজন, সে হিসেব কিছুতেই মেলে না আমার। হঠাৎই আরেক দিনের কথা মনে পড়ে আমার। সেদিনও এমনই সন্ধ্যারাতের দিকে এক ছাপোষা দম্পতি এসেছিল আহেদ আলীর কাছে। বড় দুঃখী তারা। তাদের একমাত্র সন্তানটিকে তারা খেয়ে না খেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছিল, জমিজমা বিক্রি করে পড়ার খরচ যুগিয়েছিল, পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে, শেষবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার সময় অকস্মাৎ এক দুর্ঘটনায় ছেলেটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পাগলপ্রায় দম্পতিটি নিজেদের সব স্বপ্নের সলিল সমাধিতে এখন আশ্রয় খোঁজে আহেদ আলীর মতো এক পাগল ভিক্ষুকের কাছে। কী খোঁজে তারা আহেদ আলীর কাছে কে জানে! আরেকদিন এক মা এসেছিল তার নেশাগ্রস্ত সন্তানকে নিয়ে আহেদ আলীর কাছে। আহেদ আলীর সঙ্গে দুনিয়ার সব দুঃখী আর অসহায় মানুষদের এত কী কথা, কীসের এত গাঁটছড়া!
কেমন আছে সে? তার মাথা থেকে এতদিনে নিশ্চয় নেমে গেছে আমার ভুত! সুখি হোক সে-ও। মুছে যাক তার জীবন থেকে আমার ছায়া। ভালোবাসার বিনিময়ে করুণা পাওয়ার মতো গ্লানিটুকু যেন না জোটে আর তার ভাগ্যে।
রাতে খাওয়ার পর আমি বারান্দায় শুয়ে একমনে আকাশের তারা দেখি, শনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উড়ে আসা জোছনা দেখি, আকাশে চাঁদ আর মেঘের অবিরাম লুকোচুরি দেখি। ঘুম আসে না। একটার পর একটা সিগারেট পোড়াই। মনের মধ্যে মোহনা উঁকি দেয়, অদিতি ছায়া ফেলে। তাদের থেকে দূরে এসেও মনের মধ্যে বহন করে চলি তাদের ছায়া, ভারি বিরক্ত হয়ে উঠি নিজের ওপর। ঘরের ভেতর মাজু শুয়ে লালনের গান গায়। মাজুর গলা ভালো। আহেদ আলী এখনো ফেরেনি। সে থাকলে প্রতিদিন এ সময় মাজুকে নিয়ে সে গানের আসর বসায়। লালনের ভক্ত মাজু। আহেদ আলীও লালনের গান ভালোবাসে। মাজুর গানে সে চোখ বুজে তাল মেলায় আর মাঝে মাঝে আকুল হয়ে চোখ মোছে। দেখে অবাক হই আমি, বিস্ময় ঘিরে ধরে আমাকে। আহেদ আলীর মতো এক বদ্ধ পাগল লালনের গান ভালোবেসে মাজুর মতো অন্ধের পেছনে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে আর প্রেম নিবেদন করছে, দৃশ্যটা কল্পনা করে প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড় হয় আমার। মাজু খুব দরদ দিয়ে গাইছে,
‘দেখ না মন ঝকমারি
এই দুনিয়াদারি
পরিয়ে কৌপনি ধ্বজা
মজা উড়াল ফকিরী।।’
আকাশে তারাদের ঝিলিমিলি, চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি। মেঘেদের উড়িয়ে দেওয়া ধূসর চাদর দেখতে দেখতে, বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়ে আসা ফুলের সুবাস নাকে মাখতে মাখতে মাজুর কণ্ঠের এই বিবাগি সুর বড় আবিষ্ট করে তোলে আমাকে। আমার কেমন অনিত্য মনে হয় সব। মনে হয় সব মিথ্যে। জীবন, জগত সব মিথ্যে মায়ার খেলা। মোহনা বলে কেউ নেই, অদিতি বলে কেউ নেই, আমিও মিথ্যে এক খেলার অনুসঙ্গ মাত্র। শুধু অন্ধ মাজুর এই কণ্ঠটুকু সত্য, তার কণ্ঠে ঝরে পড়া এই অদ্ভুত নিরাসক্তিটুকুই একমাত্র সারবস্তু। মনে হয়, এ ছাড়া জগতে সত্য বলে আর কিছু নেই, কেবল এই সুরটুকুই জীবন, এই ক্ষণটুকুই জগত, এছাড়া অনিত্য সব। কতক্ষণ এমন আবিষ্ট, বুঁদ ছিলাম কে জানে, ঘোর কাটে মাঝরাতের নীরবতাকে খুন করে দেওয়া জিপগাড়ির বিকট শব্দে। আহেদ আলী ফেরে অবশেষে। পুলিশের জিপ তাকে নামিয়ে দিয়ে আবার চলে যায় তুমুল শব্দ তুলে। আহেদ আলী বারান্দায় পা দিয়ে আমাকে জাগ্রত দেখে অবাক কণ্ঠে বলে, ছার! এহনো গুমান নাই?
ঘুম আসছে না। তোমার কাজ শেষ হল? সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জবাব দেই আমি। এতক্ষণের ঘোরটা হঠাৎ জ্বর ছাড়ার মতো ছেড়ে যায় আমাকে। মনে পড়ে সেই সন্ধ্যারাতে আহেদ আলী আমাকে কিছু না বলে চলে গেছিল এসপি নাজমুল নামক লোকটার জিপে উঠে।
কাম আর কী ছার। এসপি ছারের ছাওয়াল দুডে আর মিয়াডা খুপ অসুস্ত, তাই ভাবি আমারে মাজে-মদ্যি যাতি কয় তাগের বাসায়। গেলি মনডা খারাপ অয়া যায় ছার। মানষির যে কত দুক্কু থাহে জীবনে, টাহা-পয়সা দিয়ে যে সুক কিনা যায় না, তা ছারের বাসায় গেলি বুজা যায়।
বলতে বলতে আহেদ আলী আমার পাশে এসে বসে। প্রথম প্রথম আহেদ আলী সঙ্কোচ করত খুব, আমাকে কোথায় থাকতে দেবে, কোথায় বসতে দেবে, ভেবে কুল পেত না আর। আমার পাশে বসতে চাইত না। অভ্যস্ত সম্ভ্রমে দূরত্ব রেখে চলতে চেষ্টা করত। আমি সে দূরত্ব অতিক্রম করতে তাকে সাহায্য করেছি। নিজেকে আহেদ আলীর সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছি ধীরে। আহেদ আলী আর মাজুর ভিক্ষে করে আনা অন্ন ধ্বংস করতে আমার আর কোনো কুণ্ঠা বা দ্বিধা নেই এখন, আমি নিজেকে এখন ওদের দলেরই ভাবি। শুধু হাত পেতে ভিক্ষেটা শুরু করিনি এখনো, এই যা তফাৎ। এখন আহেদ আলী নিঃসঙ্কোচে আমার পাশে বসে বিড়ি ধরায়, দুঃখ-সুখের গল্প করে অকপটে। আহেদ আলীর কাছেই শুনতে পাই এসপি নাজমুলের ইতিবৃত্ত। তিন তিনটে সন্তান তাদের। তিনজনই বোবা-কালা, পঙ্গু। জন্ম থেকেই শয্যাশায়ী তারা, কোনোদিন হাঁটবে না, কথা বলবে না, পৃথিবী তাদের কাছে নৈঃশব্দ্যের সীমাহীনতায় ঢাকা, ভীষণরকম মূক, বধির। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহেদ আলী বলে, বোচ্চেন ছার, স্বামী-ইস্ত্রি দুইজনেরই রক্তের দোষ, ডাক্তার তাগের আর বাচ্চাকাচ্চা নিতি মানা করেচে, তাগের নাকি বাচ্চা হলিই অমবা অসুস্ত হবি, ইয়ের বলে কোনো চিকিৎসে নাইকো।
বসন্তের বাতাস বয় ধীরে। আমার বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে। কেন কে জানে, মোহনাকে মনে পড়ে। কেমন আছে মোহনা? তার বর জাবিনকে নিয়ে, সংসার, সন্তান নিয়ে সুখে আছে তো? সংসারে সুখ তবে এমন দুর্লভ! সুখে থাক মোহনা। দুর্লভ সুখটুকু ধরা দিক তাকে। আর অদিতি? কেমন আছে সে? তার মাথা থেকে এতদিনে নিশ্চয় নেমে গেছে আমার ভুত! সুখি হোক সে-ও। মুছে যাক তার জীবন থেকে আমার ছায়া। ভালোবাসার বিনিময়ে করুণা পাওয়ার মতো গ্লানিটুকু যেন না জোটে আর তার ভাগ্যে। ভালোবাসায় পূর্ণ হোক তার জীবন। আনমনে বিড়বিড় করি আমি।
চাঁদটা অকৃপণভাবে জোছনা ঢালে পৃথিবীর বুকে। বসন্তের বাতাস দারুণ আকুল হয়ে বয়। কোথাও হাসনাহেনা ফুটেছে, দারুণ সুবাস এসে নাকে লাগে। আমি আহেদ আলীর কথা ভাবি।
ছার কি কিচু কচ্চেন? বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করে আহেদ আলী। উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের মনে বলে যায় অনেক না বলা কথা। আমারও চোখের ওপর থেকে পর্দা সরতে থাকে একটু একটু করে। পঙ্গু, পাগল আহেদ আলী আর অন্ধ মাজু ভিক্ষে করে নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের টাকাটুকু রেখে বাকিটা দান করে দেয় এক অনাথাশ্রমে। সেখানে মাজু আর আহেদ আলীর মতো শিশুদের থাকা-খাওয়া, পড়াশোনা আর হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এসপি নাজমুল সেখানে প্রতি মাসে মোটা টাকা দান করে। আহেদ আলীর কাছে আসে সমাজের উঁচুদরের অনেক মানুষ। যারা তাদের দুঃখের ভাঁড়ার উজাড় করে আহেদ আলীর কাছে। আসে মধ্যবিত্ত আর বিত্তহীন খেটে খাওয়া মানুষও। কিন্তু আহেদ আলীর কাছে কেন আসে তারা? এ প্রশ্নের উত্তরে আহেদ আলী হাসে। বলে, জানিনে ছার। আমি পাগল মানুষ। আমার কাচে কী কামে যে আসে সগলে তা কতি পারিনে। তারা কয় আমার কাচে আসলি নাকি শান্তি পায় তারা। কিসির শান্তি তা তারাই জানে।
আকাশে তারারা উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে। চাঁদটা অকৃপণভাবে জোছনা ঢালে পৃথিবীর বুকে। বসন্তের বাতাস দারুণ আকুল হয়ে বয়। কোথাও হাসনাহেনা ফুটেছে, দারুণ সুবাস এসে নাকে লাগে। আমি আহেদ আলীর কথা ভাবি। আচ্ছা, আহেদ আলীর কি আধ্ম্যাতিক কোনো ক্ষমতা আছে? কিংবা কোনো সম্মোহনী শক্তি? নইলে যে আমি পথে পথে ঘুরব বলে বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে, সেই আমি কেন আটকে আছি আহেদ আলীর ডেরায়? আর এইসব দুঃখী মানুষগুলো! তারা কেন এসে ভীড় করে এমন এক পাগল ভিক্ষুকের কাছে! অদ্ভুত তো!
ছার!
উম! অন্যমনস্ক আমি চমকে উত্তর দেই আহেদ আলীর ডাকে। আহেদ আলী আশ্চর্য রহস্যময় মুখে অন্ধকার বারান্দার মাচানে আমার পাশে বসে তাকিয়ে থাকে আমার দিকেই, কতক্ষণ কে জানে!
ছার, ইবার আপনে বাড়িত ফিরে যান।
মানে? অবাক, থতমত হয়ে জবাব দেই আমি।
বাড়িত ফিরে যান ছার! আপনের পরিবার মা হবি, সে খুপ কষ্টে আচে ছার। আপনের জন্যি অস্থির হয়া আচে।
আমি স্তব্ধমুখে জোছনার আলোছায়ার রহস্যঘেরা রাতে আহেদ আলীর ততধিক রহস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। আজ পর্যন্ত আহেদ আলীকে আমার ব্যক্তিগত একটি তথ্যও বলিনি, এমনকি আমার নামটাও পুরো জানে না সে। তার কথার মাথামুণ্ডু খুঁজে পাই না আমি। কী বলে সে? কেন বলে? হঠাৎ মনে পড়ে আমার, আমি ঘর ছাড়ার কদিন আগে থেকে অদিতির শরীরটা খারাপ ছিল বেশ, বমি করছিল ঘন ঘন। হুট করে কেন যেন চোখে জল জমে আমার। জলভরা চোখ তুলে আমি আকাশের দিকে তাকাই। সেখানে অজস্র তারা ঝিকমিক জ্বলে। পূর্ণিমা চাঁদটা অমলিন হাসে। পৃথিবীর কোনো জরা তাকে স্পর্শ করে না কোনোদিন।

শিল্পী নাজনীন। জন্ম ১৪ জুলাই ১৯৮১, কুষ্টিয়ায়। শিক্ষক, কথাচিত্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিযয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৬।