কবিতা

মনোবিকলনের অন্ধযাত্রা

হে কাদা কাদা দৃশ্যের দাস, হে বিস্মৃতির ডুবুরি

ফাঁকা লোকাল বাসের অপেক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
এ শহরের ভিড়ের খাদে, তাহলে একদিন আমরাও একেকজন
সেই ছানি-পড়া ধূসর চোখ—
বিস্মৃতি থেকে ডুবে ডুবে তুলে আনা
কাদা কাদা দৃশ্যের দাস

হায়, এখনও শীতের কুয়াশা ভোর ভোর
ভেসে আসছে ভাজা ইলিশের গন্ধ
জাহাজ ঘাটের সস্তা হোটেলের টিনের বাসনে
উড়ছে বালাম চালের গরম ভাতের ধোঁয়া…

বুক কাঁপানো সাইরেন বাজাতে বাজাতে
পল্টনে ভিড়ছে স্টিমার, প্যাসেঞ্জাররা নিজেদের সমস্ত শক্তিতে
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চাইছে ডেকে—যে যার মতো

বারবার, বারবার টানছে কে যেন পেছন থেকে
মেঠোপথ, চেনা পুকুরঘাট, শনি-মঙ্গলবারের হাট, চেনা সব মুখ…

ছাড়তে ছাড়তে স্টিমার—সমস্তটা ঘাট থমথমে শোকের শ্মশান…

আগুনমুখা, মেঘনা, পদ্মার ধু ধু কালো জলে ভাসতে ভাসতে
সেই জাহাজ আর ফেরেনি পুরোনো ঘাটে

হে কাদা কাদা দৃশ্যের দাস, হে বিস্মৃতির ডুবুরি
পুরোনো জাহাজ পুরোনো ঘাটে না ভিড়তে ভিড়তে
তুমিও হয়ত একদিন জেনে যাবে
সকল গন্তব্যেরই থাকে না ফেরার নিয়তি…

এ শহর খননের ইতিহাস

যার আঙুলের তুড়িতে বদলে যেত দৃশ্যপট
সংলাপ উচ্চারণের স্বরগ্রামের তারতম্যে
থমকে যেত দর্শকের সমস্ত কোলাহল
রঙিন পর্দার নায়ক ক্রমশই যেন
হয়ে উঠেছিল রহস্যময় এক জাদুকর…

কোনো এক হিম হিম শীতের বিমর্ষ বিকেলে
কপর্দক শূন্য ঘোরাঘুরি শুরু ফুটপাতে—ভাঙা চায়ের দোকানে
পার করে দেওয়া ক্রমশ চাঞ্চল্য হারানো মধ্যরাত অবধি
তার করুণ দৃষ্টি আর উশকোখুশকো চুলে… আমরাও জানতে পারি
নায়ককেও একদিন ফিরতে হয়
পতনের দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে ফিরতে হয়
লোহা পোড়ানো কর্কশ বাস্তবতায়…

আর এই-সকল খণ্ড খণ্ড দৃশ্যের ডানা মেলতে থাকে
ভাঙতে থাকে আমাদেরই চোখের সম্মুখে—
কোনো ধ্রুপদি রাগ কিংবা গীতল সুর না বেজেই
আশ্রয় না নিয়েই কোনো আড়ালের…

সেদিন থেকেই যেন মরে যেতে থাকল শহরের
সবকটা দেবদারু সবার অলক্ষে
হয়ত এ শহরের খননের ইতিহাস
সেদিনই শুরু, আমরা কেবল আগন্তুক
হেঁয়ালির চক্রে হাঁটছি আর হাঁটছি
কোনো প্রত্ন দিনের খোঁজে…

হে উষ্ণ হৃদয়ের মানুষেরা

দিগন্ত ছোঁয়া হলুদ শর্ষেখেত থেকে ভোরের কুয়াশায় ভিজতে ভিজতে
উড়ে এসছিল বেনেবউটি
সরল চাহনি আর অস্থির ডানায় কেবল ওড়া ডাল থেকে ডালে
রেলের কুউ ঝিক ঝিক শব্দে মিশে যেতে যেতে
আমরা ফেলে আসি হিম বাতাস আর কনকনে শীতের মাঝেও
উষ্ণ হৃদয়ের সব মানুষের মুখ
ফেলে আসি পৌঢ় আঙুলে মমতার স্পর্শ
ফেলে আসি অকৃত্রিম আলিঙ্গন…
ক্রমশ দেখা যায় শহরের কালো ধোঁয়া
ক্রমশ পচা নালা নর্দমা, ক্রমশ নির্জলা নৃশংসতার প্যাঁচ…
শহরের চূড়ায় খুপচি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমরা
মানুষের অবয়ব হারাতে হারাতে হয়ে উঠি কিম্ভুত জীব
হে হিম বাতাস, হে কনকনে শীতেও উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ
হে হলুদ শর্ষেখেত, হে ছোট ছোট নদী
এ জীবন আর কি মিলবে তোমাদের সোজাসাপটা জীবনে…

কোনো প্রাচীন সময়ের কুহরে

এমন পৌষের বিকেলে ধূলিওড়া পথে হাঁটতে হাঁটতে
আমরা পৌঁছে যাই বীরপাশা, শিমুলতলা কিংবা আয়লার গমগমে হাটে
কামারের দোকানটিই নিয়ে যেত টেনে,
লোহাপোড়া গন্ধে তবে কি ছিল আদি কোনো
মন্ত্রের অবশেষ, পুড়তে পুড়তে পেত অদেখা অবয়ব?

আর কৃষ্ণ ও শীর্ণ বাহুর পৌঢ় কামার
লাল টকটকে লোহা
নেহাই হাতুড়ি, গরম লোহা ডোবাবার ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ…

ধার করাবার অপেক্ষায় থাকা কাস্তের স্তূপ
জানান দেয় পেকে উঠছে ধান
জানান দেয় আমরা কেউ জল আর কাদার কৃষক, আমরা কেউ জেলে…

সন্ধ্যা গাঢ় হতে হতে আমাদের চাড়াল দেহ
ফিরে যায় কোনো প্রাচীন সময়ের কুহরে
যেখান থেকে আমরা ঘুরতে থাকি আর ঘুরতে থাকি
অতীত আর খল বাস্তবতার অমীমাংসিত জালের গিটে…

মনোবিকলনের অন্ধযাত্রা

গোরস্থানের শোকার্দ্র মাটি চিরে ফোটা আকন্দ ফুল
তুমি থমকে দিলে পা, ফিরিয়ি আনলে—
পেলব পাতায় হাঁটা ছোট্ট সবুজ পতঙ্গ স্মৃতি…

অথচ জানোনি আমাদের সেইসব দিনের সরলতা
লুপ্ত হয়ে গেছে কবে—
লুপ্ত হয়ে গেছে গুঁড়ি গুঁড়ি অক্ষরে লেখা চিঠি
চিঠির কৌশলী ভাঁজে রাখা গোলাপের পাপড়ি
লুপ্ত হয়ে গেছে জিগার কষে খাম আটকানো দিন
লুপ্ত হয়ে গেছে মাকড়সার জালে ফাঁদ পেতে ধরা রঙিন ফড়িং দিন…

লোহা পোড়া গন্ধে ক্রমশ শুকিয়ে নির্জলা মানুষের মন
রোজ মনোবিকলনের অন্ধযাত্রা—পুণ্যের লোভে
রোজ আততায়ীর পিছু ছায়া, আচমকা চাপাতির কোপ
রক্তে ভাসান মুখ, কান্নার আহাজারি…

মর্গের টেবিলে রোজ প্রশ্ন রেখে যায়,
ধর্ম আর জিরাফের জয় পরাজয়ে—মানুষ কতটা হলো অমানুষ…

লেখাটি শেয়ার করুন :

নায়েম লিটু

নায়েম লিটু জন্ম ৩ জুলাই ১৯৭৭। কবি ও লেখক। প্রিন্ট পত্রিকা সাপ্তাহিক সময়ের বিবর্তনে সম্পাদনা বিভাগে কর্মরত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : অর্ধযতি, কাচপোকা, মান্দার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!