অটোমান সাম্রাজ্যে গ্রিক গণহত্যা
‘গ্রিক জেনোসাইড’ প্রশ্নটি এখনো বিতর্কিত। কিন্তু সত্য হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে, অটোমান তুর্কিরা গ্রিকদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছিল। জোরপূর্বক নির্বাসন, নির্বিচারে হত্যা, এবং সম্পদের ধ্বংসের মাধ্যমে তারা সেটি সংগঠিত করে। ১৯০৮ সালের বিপ্লবের পর, তরুণ তুর্কিদের পরিকল্পনা ছিল বহুজাতি-ধর্মীয় অটোমান সাম্রাজ্যের পরিবর্তে একটি ‘আধুনিক তুর্কি মুসলিম রাষ্ট্র’ গঠনের। তরুণ তুর্কি বিপ্লব ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের একটি সাংবিধানিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। প্রথম মহাযুদ্ধের লড়াই-কালে এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমতের মোকাবিলা করার সময়, সাম্রাজ্যের আদিবাসী খ্রিস্টান জনগণ, যেমন আর্মেনীয়, সিরিয়ান এবং গ্রিকরা, বড় আকারের নৃশংসতার সম্মুখীন হয়েছিল।
এই গণহত্যা বিষয়ক তর্কের আগের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ওসমান প্রথম, আনাতোলিয়ার একজন তুর্কি উপজাতীয় নেতা, উত্তর-পশ্চিম এশিয়া মাইনরে ১২৯৯ সালে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ওসমান প্রথম, মুরাদ প্রথম, ওরহান এবং বায়েজিদ প্রথমের অধীনে ওসমানীয় অঞ্চলগুলি প্রসারিত হয় এবং একটি আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন করে। দীর্ঘ এক হাজার বছরের শাসনের পর, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে যখন ১৪৫৩ সালে বিজয়ী নেতা, সুলতান মেহমেদ দ্বিতীয়, ওসমানীয় তুর্কিদের সঙ্গে নিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করেন। সুলতান মেহমেদ কনস্টান্টিনোপলের নাম পরিবর্তন করে ইস্তাম্বুল রাখেন। শহরটি দ্রুত বাণিজ্য ও সংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের গভীরে বিস্তৃত হয়। সুলতান সেলিম প্রথম অটোমান সাম্রাজ্য প্রসারিত করতে থাকেন এবং তাঁর রাজত্বকালে বিশ্বের বৃহত্তম এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যের একটিতে রূপান্তরিত হয়।
সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের সময় অটোমান একটি ‘পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য’ হয়ে ওঠে। অনেকে তার শাসনকালকে ‘মহান শক্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির’ আমল হিসেবে চিহ্নিত করে। সুলেমানের শাসনামলে, অটোমান সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং রাজনৈতিক আধিপত্য চরমে পৌঁছায়। বিজ্ঞান ও চিকিৎসায় উন্নতি লাভ করে- অটোমানরা অস্ত্রোপাচারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রের উদ্ভাবন করে, যেগুলো চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আজও ব্যবহার করেন।
১২৯৯ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে ছত্রিশটি সুলতান এই সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেছিলেন। বেশিরভাগ পণ্ডিত একমত যে অটোমান তুর্কি শাসকরা অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিলেন। তারা মিলেট পদ্ধতির মাধ্যমে অমুসলিমদের তাদের শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। সাম্রাজ্যের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নিয়ে মিলেট ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো তাদের দৈনন্দিন বিষয়াবলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সীমিত ক্ষমতা উপভোগ করত। অটোমানরা খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল, যেহেতু তারা এব্রাহামিক ধর্মের অনুসারী ছিল। প্রদত্ত অধিকার মুসলমানদের সমান ছিল না। চৌদ্দ শতাব্দীতে ওসমানীয়রা একটি নতুন ‘devshirme system’ তৈরি করে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পরাজিত খ্রিস্টানদেও ২০% অল্প বয়স্ক ছেলে সন্তানদের সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করেছিল। জোরপূর্বক শিশুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে এবং দাসে পরিণত হতে হয়েছিল। কিছু ক্রীতদাস সরকারি চাকরি বা অটোমান আর্মিতে প্রশাসনিক কাজের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতেন। জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা প্রধানত অভিজাত সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
সতেরো শতকের শেষের দিকে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়, বিশেষ করে ভিয়েনার যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর। পরবর্তী শতাব্দীতে তুর্কিরা একটি উদীয়মান ইউরোপীয় শক্তির কাছে বিভিন্ন অঞ্চল হারাতে থাকে। দুর্বল নেতৃত্ব এবং আমেরিকা ও ভারতের সাথে বাণিজ্য সমস্যা সাম্রাজ্যকে ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। ১৮২১ সালে গ্রিক বিদ্রোহ, ১৮৭৮ সালে রোমানিয়া, সার্বিয়া এবং বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা এবং ১৯১২ এবং ১৯১৩ সালে বলকান যুদ্ধগুলি সাম্রাজ্যের দুর্বলতাকে আরও উন্মোচিত করে। ২৯ অক্টোবর, ১৯২৩ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনের অবসান ঘটে। এ সময় মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তরুণ তুর্কিদের লক্ষ্য ছিল ১৮৭৬ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়কে একটি সংসদীয় সরকারের অধীনে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মাধ্যমে সমজাতীয় রাষ্ট্রে একত্রিত করা।
অটোমান তুর্কিরা পনেরো শতকে গ্রিসকে তাদের শাসনের অধীনে নিয়ে আসে। ১৪৫৩ সালে অটোমানদের কাছে কনস্টান্টিনোপল পতনের পর, মোরিয়ারা ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ অবশিষ্টাংশ, যারা অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে ছিলেন। ১৪৬০ সালে গ্রিসের মূল ভূখণ্ড অটোমানদের দখলে আসে। কয়েকশ বছর পর, ব্রিটিশ, ফ্রান্স এবং রাশিয়ানদের সহায়তায়, গ্রিক ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে নয় বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভ করে ১৮৩০ সালে। এটি ১৮২১ সালের গ্রিক বিপ্লব নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের দমন-নিপীড়ন নীতি, তুর্কির তরুণ পশ্চিমা-শিক্ষিত শ্রেণিকে ক্ষুব্ধ করে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তার দল এবং অন্যান্য সংস্কারপন্থী জাতীয়তাবাদী সংগঠনের সমন্বয়ে ‘কমিটি অব ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেস (সি ইউ পি)’ গঠন করে, যা ইয়াং টার্কস নামেও পরিচিত। তরুণ তুর্কিদের লক্ষ্য ছিল ১৮৭৬ সালের সংবিধানকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়কে একটি সংসদীয় সরকারের অধীনে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার মাধ্যমে সমজাতীয় রাষ্ট্রে একত্রিত করা। ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে, মেসিডোনিয়া থেকে অটোমান সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট সুলতানের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সাংবিধানিক সরকারে ফিরে যাওয়ার শর্ত দেয়। দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। সি ইউ পি একটি আসন ছাড়া সবকটি আসনে বিজয়ী হয়। তবে ওই একটি আসনে জয়ীরা মিলেট সিস্টেমের সংখ্যালঘু সব জাতির সুষম প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। জাতীয়তাবাদী, উদারপন্থী সংস্কারক এবং ঐতিহ্যবাহী মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির কারণে, তরুণ তুর্কি সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অমুসলিম দলগুলি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। এসময়ে চাপের মুখে দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে সিংহাসন ছাড়তে হয়। তার ভাই মেহমেত পঞ্চম ১৯০৯ সালে ক্ষমতায় আসেন। বিদেশী শক্তি সাম্রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে- গ্রিস, বুলগেরিয়া, মন্টিনিগ্রো এবং সার্বিয়া একটি গোপন জোটে একত্রিত হয়ে, ১৯১২ সালের অক্টোবরে, অটোমান-অধিকৃত মেসিডোনিয়া এবং থ্রেস আক্রমণ করে। ইউরোপীয়দের হাতে পতিত অটোমান অঞ্চলগুলো ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে একটি সঙ্কটের জন্ম দেয় যা সরাসরি প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে প্ররোচিত করেছিল।
এশিয়া মাইনরে (আজকের দিনে তুর্কি) গ্রিকদের উপস্থিতি প্রাচীনকাল থেকেই ঘটেছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর, গ্রিক-ভাষী পূর্ব রোমানদের অধীনে খ্রিস্টীয় চার থেকে পনেরো শতকের মধ্যে গ্রিক সংস্কৃতি এবং ভাষা বিকাশ লাভ করে। গ্রিকরা এই অঞ্চলে শহর, স্কুল এবং রাস্তা নির্মাণ করেছিল এবং শতাব্দী ধরে এশিয়া মাইনরের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছিল। অটোমান তুর্কিরা ১৪৬১ সালে এশিয়া মাইনর অঞ্চলকে সাম্রাজ্যের মধ্যে শুষে নেয়। অমুসলিম প্রজারা মিলেট ব্যবস্থার অংশ ছিল এবং মুসলমানদের থেকে নিম্নতর মর্যাদায় গৃহীত হয়েছিলো। যদিও অটোমানরা সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি সহনশীল ছিলেন তবে সমান শর্তে নয়। খ্রিস্টান গ্রিকরা ছিল সাম্রাজ্যের অন্যতম জনবহুল অমুসলিম গোষ্ঠী। এশিয়া মাইনর এবং ইস্টার্ন থ্রেসে দুই মিলিয়নেরও বেশি গ্রিক বসবাস করত। তারা একটি শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী জাতি ছিল। গ্রিক সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য অটোমান সরকার এবং তাদের অভিজাত সেনা বাহিনীতে কাজ করতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি, আর্মেনিয়ান এবং গ্রিকদের ধ্বংস ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। কেবল তাই নয়, গণহত্যার অপরাধের পাশাপাশি জাতিগত নির্মূল ধারণার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপলব্ধি, বোঝাপড়া এবং আইনি সংজ্ঞাকে আকার দেয়।’ ৫ জানুয়ারি, ১৯৪৭ সালের নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে: ‘যদি জাতিসংঘের সদস্যরা উপযুক্ত আইন পাস করে, তাহলে জারিশ রাশিয়ার সুসংগঠিত হত্যাসাধন ও লুন্ঠন এবং তুরস্ক দ্বারা আর্মেনীয় ও গ্রিকদের গণহত্যার মতো ঘটনাগুলো গণহত্যা হিসাবে শাস্তিযোগ্য হবে।’
পোলিশ ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন, যিনি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি তৈরি করেছিলেন এবং যিনি জাতিসংঘের গণহত্যার কনভেনশন লিখতে সাহায্য করেছিলেন, তিনি গ্রিক গণহত্যার উপর তার অপ্রকাশিত লেখায় লিখেছেন, গ্রিক গণহত্যা ঐতিহাসিক একটি বইয়ের নির্দিষ্ট পয়েন্টের বিশদ আলোচনা। পাশাপাশি তিনি গণহত্যার জন্য দায়ী শক্তিকে চিহ্নিত এবং মূল্যায়নমূলক রায় প্রদান করেন। জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ কমিশনের ইতিহাসে বলা হয়েছে যে অটোমান খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের গণহত্যা ১৯৪৫ সালের লন্ডন সনদের লেখকদের মনে ছিল: “সেভার্সের শান্তি চুক্তির ২৩০ অনুচ্ছেদের বিধানগুলো আবরণ করার উদ্দেশ্যে ছিল। ১৯১৫ সালের অ্যালাইড নোটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অপরাধ যা তুর্কি ভূখণ্ডে তুর্কি নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল … এই নিবন্ধটি তাই, নুরেমবার্গের আর্টিকেল ৬ (সি) ও ৫ (সি) এর নজির গঠন করে এবং টোকিও চার্টার্স ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ এর একটি বিভাগের উদাহরণ দেয় যা এই আইন দ্বারা বোঝা যায়।” ওসমানীয় খ্রিস্টানদের ধ্বংস যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনের ধারণা ও প্রণয়নে এর প্রভাব প্রদর্শন করে।
আর্মেনিয়ান গণহত্যা সম্প্রতি স্বীকৃতি পেয়েছে। এর দালিলিক প্রমাণ নথিভুক্ত করা হয়েছে। এটি এখন আন্তর্জাতিক যৌথস্মৃতির একটি অংশ। গ্রিক গণহত্যা এবং অ্যাসিরিয়ান গণহত্যা, যা প্রায় একই সময়ে সংঘটিত হয়েছিল, যা মানবতা ধ্বংসের একই বৈশিষ্ট্য বহন করে। অথচ গণহত্যার মতো এমন বর্বরোচিত ইতিহাস পৃথিবী একরকম ভুলে গেছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অংশীদারদের জটিল প্রকৃতি হল মূল কারণ যা অপরাধীদের জবাবদিহি করতে বা এই ধরনের নৃশংসতার স্বীকৃতি পেতে বাধা দেয়। আশার কথা হল, গ্রিক গণহত্যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেয়েছে এবং অধ্যয়নের বিষয় হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের মৌলিক সিদ্ধান্ত- একটি গোষ্ঠীকে আংশিক বা সামগ্রিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ই হল গণহত্যা। গণহত্যার অভিপ্রায়ে মামলা করা সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। লেমকিন, যিনি ‘জেনোসাইড’ শব্দটি সৃষ্টি করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বলকান যুদ্ধের আগে তরুণ তুর্কিদের উত্থান একটি সূচনা বিন্দু হতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘…ইয়ং টার্কস [sic] আন্দোলন বলকান যুদ্ধের চার বছর আগে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবকিছু, বিশেষ করে গ্রিকদের বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক আঘাত করার চেষ্টা করেছিল যা প্রচলিত বিভিন্ন আইনের দিকে নজর দিয়ে প্রমাণ করা যেতে পারে, যেগুলো ১৯১০ সালে তুর্কি সংসদে গ্রিক ডেপুটিদের দ্বারা তুর্কি সরকারের কাছে উপস্থাপিত একটি স্মারক (অর্থাৎ, স্মারকলিপি) চিত্রিত হয়েছিল।’
লেমকিন ‘জেনোসাইডাল’ Intent নিয়ে আরেকটি উদাহরণ দেখিয়েছেন। অনেক গবেষণায় দেখা যায় যে তুর্কি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তরুণ তুর্কিদের ধারণা ছিল উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। Emmanouelides এর মতে, তরুণ তুর্কিরা পশ্চিম এশিয়া মাইনরে শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত গ্রিকদের আধিপত্যকে ভয় করত। সমানভাবে জনবহুল এবং উন্নত, আর্মেনিয়ানরা পূর্বে তুর্কি রাষ্ট্রকে হুমকি দেয়। আর্মেনিয়ানদের মতো, ‘গ্রিকের প্রশ্ন’-এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে খ্রিস্টান গ্রিকদের সম্পত্তি যেকোনো উপায়ে তুর্কিদের দখলে আসতে হবে এবং অমুসলিম সবকিছু বাদ দিতে হবে।
তুর্কিকরণ ছিল তরুণ তুর্কিদের প্রধান লক্ষ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের ভয়ঙ্কর কর্মের জন্য, আর্মেনীয়দের মতো, খ্রিস্টান গ্রিকদের ধ্বংস ছিল অনিবার্য। আলেপ্পোতে আর্মেনিয়ানদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার একজন প্রত্যক্ষদর্শী, ড. মার্টিন নিপেজ (১৮৮৬-১৯৬৩),ব্যাখ্যা করেছেন যে তরুণ তুর্কিরা ইউরোপীয় আদর্শে কুরদিস্তান, পার্সিয়ান ও আরব মুসলিমদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় রাষ্ট্র চেয়েছিল এবং মুসলিমদের ‘তুর্কিকরণ’-এর মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করার আশা করেছিল। খ্রিস্টান, আর্মেনিয়ান, অ্যাসিরিয়ান ও গ্রিকদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে হুমকি মনে করত। তাদের ধর্মকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তুর্কিকরণে বাধা হিসেবে দেখা হতো। তাদের হয় নিশ্চিহ্ন করতে হবে অথবা জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে। উল্লেখ করা দরকার, দুটি বলকান যুদ্ধ, অঞ্চল হারানো এবং তাদের পূর্ববর্তী প্রদেশ থেকে মুসলমানদের বাস্তুচ্যুত তরুণ তুর্কিদের উগ্র আদর্শ ও ধারণার নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সি ইউ পি অনেক অটোমান-গ্রিককে হত্যা করেছিল। ১৯১৯ ও ১৯২৩ সালের মধ্যে গণহত্যামূলক আইনের আরও উল্লেখযোগ্য তরঙ্গ সংঘটিত হয়েছিল। অ্যাডিলেড ক্রনিকল ২৬ জুন, ১৯২২-এ কেমালিস্টের গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে রিপোর্ট করেছিল – ‘আজ কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না যে তুরস্কের মাটিতে খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন সম্পূর্ণভাবে তুর্কি পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে […] সেই দিন বেশি দূরে নয় যখন খ্রিস্টানরা এশিয়া মাইনরের ডোডোর (পাখিদের একটি প্রজাতি) মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ অন্যান্য পর্যবেক্ষক ছিলেন যারা ওসমানীয় গ্রিকদের বিরুদ্ধে একই ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ডা. ওয়ার্ড এবং এম. জি. আর. আমেরিকান কমিটি ফর রিলিফের ফরেস্ট ইওয়েল নিশ্চিত করেছেন, ‘তুর্কি কর্তৃপক্ষ অকপটে বলেছে যে সমস্ত গ্রিকদের হত্যা করা তাদের ইচ্ছাকৃত উদ্দেশ্য এবং তাদের কর্ম তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে।’
জার্মানরা গ্রিস যুদ্ধে প্রবেশ করতে চায়নি। গ্রিস এবং জার্মানরা একমত হয়েছিল যে গ্রিস নিরপেক্ষ থাকবে এবং বিনিময়ে ওসমানীয়রা অটোমান গ্রিকদের উপর নিপীড়ন বন্ধ করবে। কিন্তু রাজনৈতিক মৌখিক চুক্তিটি শীঘ্রই ভুলে গিয়েছিল
১৯০৮ সালের বিপ্লবের পর, ‘অটোম্যানাইজেশন প্রোগ্রাম’ শুরু হয়। তারা প্রথমে বিভিন্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নাগরিকদের নির্মূল করতে শুরু করে এবং পরে, তারা পূর্ব থ্রেস ও পশ্চিম এশিয়া মাইনর পর্যন্ত অভিযানকে প্রসারিত করে। ১৯০৯ থেকে ১৯১১ সালে, বিশিষ্ট খ্রিস্টান গ্রিক, বুলগেরিয়ান ও সার্বরা অদৃশ্য হতে শুরু করে এবং মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। গোপন হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে আসে যখন তারা অভিযানকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যায় এবং তাদের ‘নিরস্ত্রীকরণ’ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছদ্মবেশে হত্যা অভিযান পূর্ব থ্রেস থেকে সমগ্র এশিয়া মাইনরে ছড়িয়ে পড়ে।
তুর্কিরা আশঙ্কা করেছিল যে যদি এই অঞ্চলগুলো ‘স্বায়ত্তশাসিত’ হয় তবে জনবহুল গ্রিকরা মুসলমানদের ছাড়িয়ে যেতে পারে, সেকারণে এলাকাটি জনাকীর্ণ করার জন্য মুসলিম উদ্বাস্তুদের নিয়মিত ‘প্রেরণ’ করা হয়েছিল। যুদ্ধের পর পূর্ব থ্রেস থেকে খ্রিস্টান গ্রিকদের জোরপূর্বক নির্বাসন শুরু হয়। জার্মান প্রভাবের কারণে তুর্কিদের নির্বাসন বন্ধ করতে হয়েছিল। জার্মানরা গ্রিস যুদ্ধে প্রবেশ করতে চায়নি। গ্রিস এবং জার্মানরা একমত হয়েছিল যে গ্রিস নিরপেক্ষ থাকবে এবং বিনিময়ে ওসমানীয়রা অটোমান গ্রিকদের উপর নিপীড়ন বন্ধ করবে। কিন্তু রাজনৈতিক মৌখিক চুক্তিটি শীঘ্রই ভুলে গিয়েছিল, এবং একটি ‘নতুন তুরস্ক’ গঠনের জন্য ওসমানীয়দের দ্বারা জোরপূর্বক নির্বাসন নতুন করে শুরু হয়।
২৭ মে, ১৯১৫-এ, অটোমান কর্তৃপক্ষ আর্মেনিয়ান এবং গ্রিক জনসংখ্যার ব্যাপক নির্বাসন অনুমোদনের জন্য একটি বন্দোবস্ত আইন তৈরি করে। বিতাড়িত ব্যক্তিদের নির্মূলের উদ্দেশে সংস্থাটিকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য আইনকে নির্দিষ্ট মেজাজসম্পন্ন (টেম্পারড) করা হয়েছিল। লুইস আইনস্টাইন (১৮৭৭-১৯৬৭), কনস্টান্টিনোপলের একজন আমেরিকান কূটনীতিক, লিখেছেন যে ‘গ্রিকদের প্রতি অত্যাচার অপ্রত্যাশিত অনুপাতে বেড়েছে […] এখন মনে হচ্ছে দুঃখকষ্টের মধ্যে সমতা আছে, সেই উদ্দেশ্যটি উপড়ে ফেলা এবং ধ্বংস করার জন্য বিদ্যমান ছিল”। গ্রিক জনগণকে তাদের বাড়িঘর থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। খাবার পানি এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছাড়াই তাদের পথ চলতে হয়ছে দিনরাত, বৃষ্টিতে, শীতে। তুর্কিদের কাছে জোরপূর্বক নির্বাসন ছিল একটি হাতিয়ার যা তারা গণ ধ্বংসের একটি নিষ্ক্রিয় রূপ হিসাবে ব্যবহার করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ওসমানীয়দের অটোমান গ্রিকদের উপর নিপীড়ন বন্ধ করতে বাধা হয়নি। গণহত্যার সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়টি ঘটে এই সময়ে। নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছে যে “খ্রিস্টানদের, বিশেষ করে গ্রিকদের নতুন গণহত্যার জন্য তুর্কিদের মধ্যে সংগঠিত হওয়ার অনেক লক্ষণ আজ নথি হিসাবে সংরক্ষিত।” গ্রিস এবং তুর্কিদের মধ্যে যুদ্ধ ‘সংখ্যালঘু প্রশ্ন’ মোকাবেলার একটি অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। রেন্ডেল রেকর্ড করেছেন, ‘১৯১৯ সালের মে মাসের প্রথম দিকে, সমগ্র আনাতোলিয়া এবং পন্টাস জুড়ে আর্মেনিয়ান ও গ্রিকদের উপর নতুন করে নিপীড়নের রিপোর্ট আসতে শুরু করে।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে, চলাকালীন এবং পরে, অটোমান তুর্কিরা গ্রাম, মানুষের ঘরবাড়ি, গীর্জা পুড়িয়ে দিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। খ্রিস্টান গ্রিকদের শীতকালে জোরপূর্বক নির্বাসন দিয়ে, খাবার ও পানি ছাড়া পথে মারা যেতে দিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে তাদের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষতি করা হয়েছিল। রেন্ডেল রিপোর্ট করেছেন, ‘১৯২০ সালের বসন্ত গ্রিকদের বিরুদ্ধে তীব্র নিপীড়নের প্রাদুর্ভাবের সাক্ষী ছিল… ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতিগত হত্যা অভিযান চলতে থাকে।’ রেন্ডেল আরও নিশ্চিত করেছেন যে ‘১৯২১ সালের হত্যা অভিযান ১৯২০ সালের তুলনায় বৃহত্তর এবং আরও নৃশংস ছিল।’ এসময় খ্রিস্টান গ্রিকদের উপর আক্রমণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায় যেন তুর্কি ‘সংখ্যালঘু সমস্যা’ বা সাম্রাজ্যের অমুসলিম উপাদানগুলোর পরিষ্কার অভিযান তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে চেয়েছিল।
যখন জোরপূর্বক নির্বাসন, হত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এবং পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের নিজেদের বাড়িতে বা চার্চে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা বন্ধ হয়ে যায়, ততদিনে আনুমানিক ৩ থেকে ৯ লাখ খ্রিস্টান গ্রিক অকারণে তাদের জীবন হারিয়েছিল। হয়তো তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক মানুষ জানতেন কেন তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। শুধু খ্রিস্টান গ্রিক এবং আর্মেনিয়ানদের জীবনই ধ্বংস হয়নি, হাজার হাজার আরব ও ইহুদিও প্রাণ হারিয়েছিল তুরস্কের, ওসমানীয় সেই ‘পরিষ্কার’ প্রক্রিয়ায়।

অনিন্দ্য আতিক। জন্ম কুষ্টিয়া শহরে। এখন আমেরিকা প্রবাসী। চলচ্চিত্র নির্মাতা। নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রূপান্তরের রূপকার’, ‘ব্যাটেল অব কুষ্টিয়া’। কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে রয়েছে অসমাপ্ত একটি চলচ্চিত্র।