আবুল হোসেনের কবিতা : নস্টালজিয়ার অনুষঙ্গ
কবি আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) চল্লিশের দশকের এক শক্তিমান কবি। বাংলা বিভাজনের সুদূরপ্রসারী ক্ষয় ও ক্ষতির প্রেক্ষাপটে বাঙালি মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ, সৃজনশীল ও মননশীল চিন্তাচেতনার যে ধারা তৈরি হয়েছিল তার সুহৃদ-সহযাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। একইভাবে বিভাজিত বাঙালি হিন্দুর সকরুণ আবেগের সহমর্মীও হয়েছেন।
অনেক স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা দুচোখে ভরে, সাজিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন বাংলা কবিতার আধুনিক ধারা। সমকালীন জীবনদৃষ্টির পাশাপাশি স্বতন্ত্র কাব্যভাষাও নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্র-বিরোধিতা প্রধান অনুষঙ্গ করে কলকাতার সাহিত্যিকদের যে আধুনিকতার যাত্রা- সেখানে স্পষ্ট দুটি ধারা তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা দুটি বর্গ হল বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। মুসলমান কবিরা প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়। আবুল হোসেন এই বিভাজনের পথে না হেঁটে বরং সামগ্রিকভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন একটি জাতির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন। কবিতায় তিনি মূখ্য করে তুলেছেন উদারনৈতিক ও অসাম্প্রদায়িক বাস্তবতা। সূচনাপর্বেই সে কারণে তাঁর কবিতা প্রগতি-অভিমুখী। আমরা তাঁর কবিতায় নস্টালজিয়া-অনুষঙ্গ সন্ধানের প্রয়াস নিয়েছি।
কবি ও শিল্পীরা তাদের শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে নস্টালজিয়ার আশ্রয় নেন। একইভাবে আবুল হোসেন আত্মসচেতনতা, স্মৃতি ও সামষ্টিক বিপন্নতায় নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন তাঁর কবিতায়। কবি নিজেই বলেছেন, তাঁর কবিতায় তিনি স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা আনন্দ-বেদনারই ছবি এঁকেছেন।
নস্টালজিয়া শব্দটি গ্রিক থেকে এসেছে। এটি হল স্মৃতিসমূহের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা। নানা মানসিক সম্পর্কের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ ও অভিজ্ঞতায় ভর করে মানুষ নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তবে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে পৃথক মাধ্যমে ও তীব্রতায় এর প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। নস্টালজিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল আমাদের অতীত এবং বর্তমানের সংযোগগুলি শক্তিশালী করা। অনুষঙ্গটি আমাদের নিঃসঙ্গতার অনুভূতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। কবি ও শিল্পীরা তাদের শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে নস্টালজিয়ার আশ্রয় নেন। একইভাবে আবুল হোসেন আত্মসচেতনতা, স্মৃতি ও সামষ্টিক বিপন্নতায় নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন তাঁর কবিতায়। কবি নিজেই বলেছেন, তাঁর কবিতায় তিনি স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা আনন্দ-বেদনারই ছবি এঁকেছেন। তুলে ধরেছেন সমকালীন জীবন। ২০০০ সালে গতিধারা থেকে প্রকাশিত কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘নিজের মনে কাজ করে গেছি। ফলের জন্য অপেক্ষা করিনি। যা দেখেছি, শুনেছি, জেনেছি, চিনেছি এবং যে আনন্দ, দুঃখ, বেদনা পেয়েছি, তার নীরব সাক্ষি এইসব কবিতা।’
আবুল হেসেনের কবিতার মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। যার সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক স্বপ্নযাত্রা ও মান-অভিমানে মেতে থাকেন তিনি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত (১৯৪০) আঠার বছরের আবেগের জোরালো প্রকাশ। উৎসর্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সেই আঠার-উনিশ বছর বয়সেই শিখে নেন আধুনিক কবিতার কলাকৌশল। আশ্রয় নেন গদ্য কবিতায়, নস্টালজিয়াকে অনুপুঙ্খ রূপায়ণের তাগিদে। কালের খেয়া, ১৫০ সংখ্যায় ২৯ আগস্ট ২০০৮ সালে কবি তাঁর শিল্পকৌশল প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘আমার মনে হলো আমি কবিতা লিখবো সেই ভাষায়, সে ভাষায় মানুষ কথা বলছে হাটবাজারে, ড্রয়িংরুমে।’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নমেদুর অনুভুতি- শব্দে, ছন্দে, উপমায়, ব্যঙ্গ অবিরলভাবে তুলে ধরেছেন। সে সময়ের কঠিন বাস্তবতাকে উপজীব্য করেছেন এ গ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায়। ‘ডাইনামো’ কবিতায় একটানা দ্রুত যান্ত্রিক ধ্বনির আওয়াজের অনুষঙ্গে স্মতিকাতর হয়ে পড়েন। তিনি উল্লেখ করেছেন মর্মন্তুদ সেই অভিজ্ঞতা :
জেগে জেগে আমি শুনি নিশীথের বুকে
আর কোনো হৃদয়ের তুমুল ক্রন্দন।
একই কাব্যের ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায় ঘোড়সওয়ারের প্রতীকে দেখেছেন দুঃস্বপ্নের বর্তমান এবং জীবনের দুঃসহ বাস্তব। বন্দুক, বোমারু বিমান, কামান, গোলাগুলি, ট্যাঙ্ক এসবের মাঝেই হঠাৎ মেঘের ফাঁকে দেখেছেন চাঁদ। ‘মুমূর্ষু পাণ্ডুর মেয়ের মতো’- এই দেখায় মিশেছে মনের দূরবীনে ভেসে ওঠা ছবি। তখনই আত্মসচেতনতা ও সমকালীন সামষ্টিক বিপন্নতায় আশ্রয় নিয়েছেন স্বপ্ন কল্পনায় :
ওদের বোমাগুলি যদি পারত মরুভূমির মাটি ফাটিয়ে
জলের উৎসধারা বের করতে,
ওদের ট্যাঙ্কগুলো যদি চষে ফেলত সমস্ত মরুভূমি,
বেয়নটের আগায় মাটি খুঁড়ে বুনতে পারত ধান
সবুজ কটি ধানের বীজ।
আবুল হোসেন দুঃখ-যন্ত্রণার সঙ্গেই মেনে নেন জীবনকে। স্টিফেন স্পেন্ডারের মতো বেদনাকে অতিক্রম করতে চাননি তিনি। তাঁর কবিতায় তাই একদিকে প্রকাশিত হয়েছে নস্টালজিক আখ্যান, অন্যদিকে ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা। বিরস সংলাপ (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের ‘বাঁচব কি’ কবিতায় তের বছর আগের দুঃসহ স্মৃতি ফিরে আসে নানা বস্তুখণ্ডের দৃশ্যেসূত্রে। মাকে হারানোর এ বেদনাকে গভীরভাবে অনুভব করেন জীবনব্যাপী, তা সত্তেও দেশপ্রেমের পরম গৌরব, আশার আলো জ্বালিয়ে রাখেন হৃদয়ে। বাস্তবে যখন তার কাঙ্ক্ষিত স্বদেশের দেখা মেলে না কবি শ্লেষ ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেন সেই মনোবেদনা :
আমাদেরও দেশ আছে।
গানে গানে গল্পেও গাথায়
ম্যাপের পাতায়।
নববসন্ত (নতুন সংস্করণ : ১৯৭৭) কাব্যের ‘প্রতীক্ষা’ কাবিতায় ব্যক্তির দুর্মর প্রতীক্ষা ও উচ্ছ্বাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি তুলে ধরেছেন সমাজজীবনের মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক ভেদাভেদ। তৃষিত আত্মায় বন্ধুর জন্য, পরম পুরুষের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন, দুপুর একটা থেকে। দুইটা, তিনটা পার হয়ে গেল। তবুও এলেন না। জানালা দিয়ে তাকিয়েই তার চোখে পড়ে বিষাদময় দৃশ্যটি :
খড়খড়ি দিয়ে দেখি সামনে ঘরে ঘুমায় ওদের চাকরটি,
খালি গায়ে শুধু একফালি গামছা প’রে।
আলসের গা বেয়ে চলেছে একটি বিড়াল।
ডাস্টবিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছে অর্ধেক ভিকিরী।
বাংলা কাবিতায় আবুল হোসেনের মহৎ প্রচেষ্টা এই যে, তিনি ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা ও সামাজিক অন্ধকারকে নিভিয়ে প্রকাশের পারঙ্গমতাকে মিলেমিশে একাকার করেছেন এ কবিতায়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে তিনি অবলোকন করলেন রোমাঞ্চকর প্রতীক্ষার শুদ্ধতম মুহূর্তগুলোতেই। ভিখারির দলের ডাস্টবিনের ছেঁড়া কাগজের ঠোঙায় মাংসের হাড়গোড় ও মাছের কাঁটায় ভরা খাবার খোঁজার সহজ অথচ বেদনাময় বর্ণনা তাঁর সময়কেই চিত্ররূপ দিয়েছে।
কবিতায় তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তানদের কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, পিছনের ফেলে আসা সময় ও সামনের দিনগুলোয় বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী যেমন তারা হয়েছেন, একইভাবে ইতিহাস ও সামাজিক স্মারকচিহ্ন হিসেবেও উপস্থিত হয়েছেন।
আবুল হোসেনের কবিতা ও কবিতার ব্যক্তি-মানুষটি যুগপৎ বেড়ে উঠেছেন। কবিতায় তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তানদের কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, পিছনের ফেলে আসা সময় ও সামনের দিনগুলোয় বেঁচে থাকার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী যেমন তারা হয়েছেন, একইভাবে ইতিহাস ও সামাজিক স্মারকচিহ্ন হিসেবেও উপস্থিত হয়েছেন। পুলিশ অফিসার বাবার সাহস, সততা ও স্বদেশপ্রেমের মহৎ গুণাবলির জন্যই তিনি শহীদ হয়েছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। আবুল হোসেন তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘এক পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের অসহায় শিকার হয়েছিলেন আমার আব্বা, ২৪শে এপ্রিল সকালে খুলনা জেলায় বাগেরহাট শহরে।
… ২৪শে এপ্রিল ছিল আমাদের বিবাহবাষিকী। … সেই থেকে জীবনের দুঃসহতম দুঃখের দিনের একটি হয়ে আছে একদা খুশির এই দিনটি।’ (আবুল হোসেন, দুঃস্বপ্নের কাল)
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ধারণ করে আছে পূর্ববাংলার প্রতিটি শহর, নগর ও প্রত্যন্ত আঞ্চল। তখনকার নিঝুম নিরিবিলি এক শহর ছিল বাগেরহাট। ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রবল বিক্রমে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এসেছিল। সমস্ত শহর মুহূর্তে খালি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবুল হোসেনের বাবা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি। সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করেছিল। বাবার এ সাহসই প্রবলভাবে প্রত্যাশা করেছেন আবুল হোসেন হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২) কাব্যগ্রন্থের ‘আমরা কি পারব না’ কবিতায় :
আব্বা আমরা কি আপনার মতো হতে
পারব না কখনও।
বাবার প্রসঙ্গটি ফিরে ফিরে এসেছে আবুল হোসেনের কবিতায়। ভিন্ন ভিন্ন আবেগ ও অভিজ্ঞতায় তিনি স্মরণ করেছেন বাবাকে। জানিয়ে দেন তাঁর নীরবে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে পড়ার কারণ :
সবচেয়ে আধুনিক শহরে আমরা লাখ লাখ
লোক পুতুলের মতো ওদের হুকুমে উঠিবসি।
আব্বা বুঝি সেই শোকে দুঃখে রাগে সে অপরাধের
প্রতিবাদ জানিয়ে গেলেন তাঁর নিজের ধরনে
নিঃশব্দে আপন প্রাণ দিয়ে। শুধু যাবার সময়
ওদের গেলেন বলে তর্জনীর অব্যর্থ ভাষায় :
‘আমি দেখে গেলাম না সূর্যোদয়। দেখবে ছেলেরা।’
[আমরা কি পারব না]
কবির এ উচ্চারণে সামষ্টিক মানুষের চাওয়া পাওয়াই প্রতিফলিত হয়েছে। মা বাবাকে হারানোর নস্টালজিয়া কবিকে জীবনের দুঃসহ ভারে, যন্ত্রণায় ও একাকিত্বে কাতর করেছে :
চল্লিশ ছোঁয়ার আগেরই মা গেলেন চলে
পাঁজরের আধখানা নিয়ে।’
[জীবনের ভার, রাজকাহিনী]
বাবার স্মৃতি যা পূর্বে শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল, রাজকাহিনী কাব্যে তা করিব জীবনে হাজির হয় নিঃস্ব ও রিক্তের অনুষঙ্গে। জীবনের কোনো খুশির তাড়নাই আর তাঁকে স্বপ্নময় করতে পারে না।
বার্ধক্যে আশ্চর্য শক্ত পিতা
সে দিন শহীদ হন যুগের জল্লাদদের হাতে
দাঁড়াবার শেষ জায়গাটুকুও যেন আর রইল না
[জীবনের ভার]
স্ত্রী বিয়োগের বেদনাও কবিকে বারেবারে নস্টালজিক করেছে। ব্যক্তিক এ বিয়োগের অনুষঙ্গেই কবি সামাজিক মানুষের নিষ্ঠুর বস্তুগত জীবনের ছবি এঁকেছেন তাঁর কবিতায়। যার সমস্ত জীবন মিশে রয়েছে কবির সাথে। কবি যাকে ‘হৃদয়ের মেয়ে’ বলে জেনেছেন। জীবনে জুড়ে থাকা ‘অভিন্ন ছায়ার’ মতো সে জীবনকে এক নিষ্ঠুর নিমেষ এসে যখন কেড়ে নিয়ে গেল কবি দীপ্ত কন্ঠে ঘেষণা করেছেন :
সে থাকে প্রাণের মাঝে সুধার মতন, চিরকাল।
[যে আছে জীবন জুড়ে, এখনও সময় আছে]
কিন্তু নিজের চোখেই নিষ্ঠুর বাস্তবকে দেখে চমকে উঠেছেন। এ বাস্তবকে তিনি মানতে চাননি :
সকালে খাবার টেবিলে এসে ছেলেরা বৌমা ছোট মেয়ে
নাশতা খেয়ে ছুটল যে যার অফিসে,
যাবার মুখে বলল, আব্বা আসি।
…
আমাদের খাওয়া দাওয়া ঠিকই হচ্ছে,
টিভি ভিসিআর চলছে,
বাইরে যাই, ঘরে ফিরে আসি।
[রক্তের রেখায়, আর কিসের অপেক্ষা]
ছেলেমেয়েদের সাথে কাটানো সময় এবং অভিজ্ঞতাও কবিকে নস্টালজিক করেছে। বিরস সংলাপ (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের, ‘আমার ছেলেটা’ কবিতায় শিশুদের শৈশবকালীন সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য ও পবিত্র মনোভূমির পরিচয় তুলে ধরেছেন। সেখানে শিশুমনের খুশি ও আনন্দই প্রধান। ‘সে শিখেনি হিসাব আয় ব্যায়ের’ আপন-পরের ধারণাও মাথায় ঢোকেনি। স্থানকালপাত্রের ভেদও জানে না। বড় হতে হতে তাদেরও পরিবর্তন আসে। বিষয়বুদ্ধিতে ছেলেমেয়েরা পরিপক্ক হলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে নানা বয়ান হাজির করেন। আর কিসের অপেক্ষা কাব্যগ্রন্থের ‘ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে’ কবিতায় কবিকে বলতে শুনি মনের সৌন্দর্য নষ্ট হলেও পুরনো ‘গাছগুলো থাক, কেটো না, অযত্ন করো না।’ গাছগুলো, বাড়ির পুরনো আসবাবপত্র, সবকিছু জুড়ে রয়েছে তাদের যৌথ জীবন। হাল ফ্যাশনের নামে স্মৃতিময় এসব আসবাবপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে কবি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন এসব আসবাব বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় কাঠমিস্ত্রির শৈল্পিক সম্মান ও নকশা তৈরির শ্রম। বাতিলের এ খেলা চলতে থাকলে আমাদের যাপিত জীবনে কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট থাকে না। বদল ও বাতিলের সংস্কৃতি আসলে ভীষণভাবে বাণিজ্যিক :
ফ্যাসানের আয়ু কতদিন,জান?
ফ্যাসান তো দেখি রোজ বদলায়।
[ছেলেমেয়েদের উদ্যেশ্যে, আর কিসের অপেক্ষা]
নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও সমকালীন জীবনের নানা ঘটনা ও ভূগোল, উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল বস্তুখণ্ড তাঁর চৈতন্যের অংশ হয়ে গিয়েছিল। সেসবই আলোকরশ্মির মতো নিঃসৃত হয়েছে তাঁর কবিতায়। মানবতা, স্বাধীন সত্তা ও বীরত্ব, দুর্যোগ নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে কবির জীবনে ফিরে ফিরে আসে জন্মদিনের আনন্দ। জন্মদিনের নির্দিষ্ট সন তারিখ অতিক্রম করে এসব ঘটনাই তাঁকে প্রকৃত জন্মদিনের আনন্দে বিভোর করে তুলেছিল। কবির নস্টালজিয়ায় ধরা পড়ে জাগ্রত মুহূর্তসমূহ। কলকাতার রাস্তায় ম্যানহোলে একটা কুকুরছানা পড়ে গেলে অনেক লোক যখন ম্যানহোলের পাশে দাঁড়িয়ে হইচই করেছিল উঁকি দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ কোথা থেকে এক ‘ধাঙ্গড় ছেলে’ এসে জটলা ছাড়িয়ে, কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাততালির প্রত্যাশা না করে কুকুরছানাটি বাঁচানোর জন্য সুরুৎ করে নেমে পড়ে গর্তের ভিতরে। তাকে আর কেউ কখনো উঠে আসতে দেখেনি। এই ঘটনাই, এই মুহূর্তটির ঘেষণা করেছিল মানুষ্যত্বের :
মানুষ কখন কোথায় কি ভাবে জন্ম নেয়,
ধাঙ্গড় ছেলেটা আমাকে তা বলে গেল।
সে আমাকে মনুষ্যত্বের মুখ দেখিয়েছিল।
[জন্মদিন, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে]
একই কবিতায় পাশের খোলা বাড়ির ফাটা মেঝেতে দাঁড়িয়ে রোগা-পাতলা কিশোর ছেলেটির দু’হাত মুঠো করে গলা ছেড়ে করা সেই আবৃত্তি- ‘বল বীর/চির উন্নত মম শির।’ কবিকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল। কিংবা গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর যাওয়ার পথে স্টিমারটি একঘন্টা ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে সন্ধ্যার সময় যখন ঘাটে এসে ভিড়েছিল, বাতাস আর বৃষ্টির বাড়ি খেতে খেতে সকলে যখন স্টিমারের বিধ্বস্ত খোল থেকে বের হয়ে আসে সেই মুহূর্তটি কবির জীবনে বার বার উঁকি দিয়ে যায়।
শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের সূচনালগ্নে কোনো এক কানাগলির মোড়ে আবছা আঁধারে কোনো এক মেয়ের চুড়ির শব্দ বুকের ভেতর যে কাঁপন তুলত, শাড়ির একটুখানি খসখসানি আওয়াজে হৃদয় বেজে উঠত তা চিরকালই কবির জীবনে শুকতারা হয়ে থেকেছে।
ছোট কাঠের ব্যাট ও রবারের বলের নস্টালজিয়া কবিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবে। এসব সামান্য খেলায় উপকরণ কীভাবে কবির ছোটবেলার দিনগুলোকে আনন্দে রাঙিয়ে তুলত, আকাশ হাতে পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত করত তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ‘কেউ দেবে না ফিরিয়ে আর’ কবিতায়। শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের সূচনালগ্নে কোনো এক কানাগলির মোড়ে আবছা আঁধারে কোনো এক মেয়ের চুড়ির শব্দ বুকের ভেতর যে কাঁপন তুলত, শাড়ির একটুখানি খসখসানি আওয়াজে হৃদয় বেজে উঠত তা চিরকালই কবির জীবনে শুকতারা হয়ে থেকেছে। ফিরে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু তিনি জানেন তা অসম্ভব :
সেসব এখন কিংবদন্তি।
হৃদয় ফেটে বেরিয়ে আসার
সেই সময়টা কেউ ফিরিয়ে
দেবে না আর, দেবে না আর।
[কেউ দেবে না ফিরিয়ে আর, এখনও সময় আছে পৃষ্ঠা]
বদলে যাওয়া নগরের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতায়। জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসেও তিনি নস্টালজিক হয়ে পড়েন বৃষ্টির দৃশ্যে। ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি পড়ার যে দৃশ্য অবলোকন করেছেন তা এখনো তাকে তাড়িত করে। নগরে এখন মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়া, ঘন বন নেই, মাঠ উধাও, তবুও একই রকম আনন্দ নিয়ে আসে ছেলেবেলায় দেখা সেই তুমুল বৃষ্টি। বটগাছের তলায় ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে মার্বেল খেলার আনন্দ কবিকে নস্টালজিক করে তোলে :
মনে পড়ে সেই ছেলেবেলা
দেয়াড়ায় বটগাছের তলায়
আমাদের মার্বেল খেলা
হাসি খুশি হল্লায়
কেটে যেত বেলা।
[মনে পড়ে, কবিতা সমগ্র]
প্রায় সত্তর বছর ধরে কবিতার সাধনা করেছেন আবুল হোসেন। তাঁর কবি মনের স্পর্শে বাস্তবজীবনের সত্য ঘটনার শরীরে যুক্ত হয় এক ভিন্নতর আস্বাদন। সমাজ-রাজনীতিকে আরোপিতভাকে উপস্থাপন করেননি কবিতায়। স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার সূত্রে সাবলীলভাবে উঠে এসেছে সমকাল। চলিষ্ণু সময় ও যাপিত জীবন তাঁকে বারবার স্মৃতি, বাস্তবতা আর স্বপ্নময়তার কাছে নিয়ে গেছে।
অভিজ্ঞতা ও সংবেদনাকে মূলধন মেনেই আবুল হোসেন কবিতার জগতে ডুবে ছিলেন। সাধারণ জীবন, গাছপালা, লতাগুল্ম, পাখি, নদী, খাল, শহর, নগর- সব রং নিয়েই বর্ণময় হয়েছে তাঁর কবিতা। ব্যক্তিজীবনের নানান বিয়োগ বেদনা সত্ত্বেও বৃষ্টি-হাওয়ায় কোলাহল করতে জোছনায় মাদুর বিছিয়ে নববসন্তের দুয়ার খুলে ধরেছিলেন পাঠকের জন্য। মর্মস্পর্শী আবেগ ও প্রায় মুখের ভাষার কাছাকাছি প্রাণ-প্রাচুর্যময় কাব্যভাষাই তাঁকে সৃষ্টিশীল, স্বতন্ত্র কবিতাশৈলী নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেখানেই তাঁর নিজস্বতা।

শামিমা নাসরিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেছেন। ইডেন কলেজে অধ্যাপনা করেন। লেখেন কবিতা ও প্রবন্ধ।