আবুল হোসেন ও তাঁর কবিতার সন্ধান
জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
আবুল হোসেন [১৫ অগাস্ট ১৯২২-২৯ জুন ২০১৪]
বসন্তের হাওয়ায় দুর্মর দুঃসাহসে কালের উতরোল অন্ধকার এবং ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন আঠারোর এক তরুণ। দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, সরকারি চাকরিসূত্রে। কিন্তু কৌতূহল ছিল সেসব দেশের মানুষ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি। ফলে উচ্চপদের দায়িত্ব পালনের পরও ঈর্ষণীয় বন্ধু-পরিসর গড়ে উঠেছিল তাঁর। তিনি আবুল হোসেন। বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারী বলে কথিত। সময়ের বিচারে সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পকলার তাৎক্ষণিকতার অনেককিছু ক্লিসে হয়ে উঠলেও তিনি আমাদের নমস্য। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ হলো তিনটি গদ্য।
তখন যুগ ভিন্ন, কিন্তু ভূমি এক। বৈশ্বিক রাজনীতির হিসেবটাও দাবি করছে একটি নতুন বসন্তের; যদিও সে দাবি ভাঙা-চোরাভাবেই পূরণ হবে, একটু দেরিতে। স্বদেশে ভূমি এক হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য দিনকে দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এরই ফলে স্বতন্ত্র ভূমি নির্মাণের যাত্রাও শুরু হল। আলাদা আলাদা ভূমির জন্য ধর্মের ভিত্তিতে দুটি অংশ আন্দোলনে মাত হতে শুরু করল। খুনখারাবি হল এর ফল। মানুষ মরছে, কেবল বিষয়টি এমন নয়; সাথে সাথে বহুদিনের সম্প্রীতিরও মৃত্যু হয়েছে। চল্লিশের এই সময়ে আবুল হোসেনের (১৯২২-২০১৪) প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হল, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর; কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম : নববসন্ত (১৯৪০)। এই কাব্যগ্রন্থের পরিবর্ধিত সংস্করণ পরে বের হয়েছে, সেখানে শিরোনাম : নব-বসন্ত (১৯৭৭)। কিন্তু বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত কবিতায় আলাদা আলাদা সময়ে প্রকাশিত দুটো কাব্যের শিরোনামই দেওয়া আছে এক, নববসন্ত। এই কাব্যে নতুন বসন্তের আকাঙ্ক্ষা যেমন ছিল, তেমনি ছিল তা ‘পূর্ব-বাংলার’ ‘বাঙালদের’ ‘আধুনিক’ কবি হওয়ার এক সফলতম প্রয়াসের প্রকাশ। কিন্তু কীভাবে?
এই আলোচনার আগে আবুল হোসেনের জন্ম ও বেড়ে ওঠার ইতিহাসটা জানা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ দেশ-কাল-সময় যেকোনো সাহিত্যিকের সাহিত্য বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবুল হোসেনও এর বাইরের নয়। তিনি তাঁর চাকুরে পিতার সুবাদে অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের, বিশেষত বাংলার, বিভিন্ন শহরে। বাংলার পুরোনো আমলের প্রতাপী নগর কৃষ্ণনগর; এরপর কুষ্টিয়া, কলকাতা; আর দেশভাগের পর স্থায়ীভাবে ঢাকায়। এছাড়া চাকরির সুবাদে নির্দিষ্ট সময় কাটিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কিন্তু কৃষ্ণনগর আর কুষ্টিয়া শহর তাঁর কবি হওয়ার ব্যাপারে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে কেন্দ্র কলকাতা থেকে দূরত্ব আর যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে তখন এই দুটি শহর বিশেষ হয়ে উঠেছে। কেবল উপনিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে এই দুটি শহর বহু আগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই দুটি শহরেই আবুল হোসেন কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ পেয়েছেন : একজনের সাথে সরাসরি [নজরুল], আরেকজনের সঙ্গে চিঠিতে [রবীন্দ্রনাথ]। সময়ের বিবেচনায় প্রধানতম দুই কবির সঙ্গে খুবই কম বয়সে সাক্ষাতের বিষয়টা, আর তাঁদের মাধ্যমে কবিতা লেখার বেলায় উৎসাহিত হওয়ার বিষয়টি তাঁকে কবিতা লেখার জন্য বড়ো অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
কিন্তু লিখলেই তো সব হয়ে যায় না। সাহিত্যের যুগ আর সেই নির্দিষ্ট যুগের সাহিত্যান্দোলনের সমস্ত বিষয়-আশয়কে বক্ষে ধারণ করে ভূমি; তার পাটাতনটিও নির্মাণ করে দেয় ভূমির নানা বিষয়-আশয়। তিনি ‘আধুনিক’ হিসেবে লিখলেন এই কবিতার বই। কিন্তু পূর্ব-বাংলায় তখনও ‘আধুনিক’ কবিতা লেখার ভিত্তি তৈরি হয়নি। এমনকি যে কলকাতা নগরের কথা বলে ‘আধুনিক’ কবিরা নাগরিক জীবনের বিষয় নিয়ে কবিতা লিখে ফেললেন, তাঁদের ক্ষেত্রেই অনেকাংশে কলকাতা সেই ‘আধুনিক’ কবিতার মাল-মশলা ঠিকঠাক যোগান দিতে পারেনি। বিষয়টি ত্রিশের কবিদের কবিতায় নাগরিকতার সন্ধান করতে গেলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু তাঁরা সেই বিষয়টি একটি মেকি প্রক্রিয়ায় করে ফেলেছিলেন। তাঁরা দেশে নাগরিক অনুষঙ্গের বিষয় উপস্থাপন করতে গিয়ে বিদেশেই যেন সর্বদা অবস্থান করছেন। এমন সব মেট্রোপলিটন-বৈশিষ্ট্য তাঁরা তাঁদের কবিতায় ব্যবহার করলেন, যা আদতে সেই সময়ের কলকাতার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা ধারণ করে না। যদিও একেবারেই মেট্রোপলিটন চরিত্রের বিষয় কলকাতায় ছিল না, ব্যাপারটি পুরোপুরি তেমনও নয়।
রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে বের হয়ে পূর্ব-বাংলায় যাঁরা কবিতা লিখছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল জসীমউদ্দীন আর বন্দে আলী মিয়া স্বতন্ত্রভাবে কবিতা লিখছেন
ওপরের আলাপ হল কলকাতার ত্রিশের কবিদের নিয়ে। কিন্তু পূর্ব-বাংলায় তখন কী চলছে? কেমন এখানকার বাস্তবতা? বিষয়টি কবিতার ক্ষেত্রে, তা কবিতার বিষয়-প্রকরণের বেলায়, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় আলাদা। দুটি অঞ্চলে পার্থক্য আকাশসমান। সেই বিষয় নিয়ে হুমায়ুন কবির তাঁর বাঙলার কাব্যে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। তখনও রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে বের হয়ে পূর্ব-বাংলায় যাঁরা কবিতা লিখছেন, তাঁদের মধ্যে কেবল জসীমউদ্দীন আর বন্দে আলী মিয়া স্বতন্ত্রভাবে কবিতা লিখছেন; এঁদের সাথে আরো অনেকেই ছিলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কিন্তু তাঁদের অবস্থান কিন্তু কলকাতায়ই। আরেকটা গোষ্ঠী লিখছেন পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে। যদিও তাঁদের বেড়ে উঠা আর বড়ো হয়ে উঠার ইতিহাসও স্পষ্টভাবে লুকিয়ে রয়েছে কলকাতায়ই।
কিন্তু তাঁদের দুইজনের [জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়া] কবিতা বাংলা কবিতা-নন্দনতত্ত্বের প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারা থেকে যেন সম্পূর্ণ ভিন্নতায় গড়া। কিন্তু এই হিসেবে আবুল হোসেন নতুনভাবে নতুন বিষয়-প্রকরণের ওপর সওয়ার হয়ে তাঁর প্রথম কবিতার বই নববসন্ত লিখলেন। এই বইকেই পূর্ব-বাংলার আধুনিক কবিতার প্রথম বই হিসেবে অনেকেই বিবেচনা করেন। যেমনটা কথাসাহিত্যের বেলায় বিবেচনা করা হয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও তাঁর রচনাসমূহকে। বিষয়টা আদতে অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু পূর্ববর্তী রবীন্দ্র-প্রভাব বিষয়ে বারবারই আবুল হোসেনের একটি ভয় ছিল। এবং সেই ভয়ের বহিঃপ্রকাশ তাঁর কবিতায়ও স্পষ্ট। এবং তিনি তাঁর প্রথম দিককার কবিতা আলোচনার বেলায় এই কথা বারবার স্মরণও করছেন; স্বীকারও করেছেন। এর কারণ হয়তো শৈশব ও কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ আর এই ধারার কবিতার সাথে তাঁর পরিচিতির বিষয়টি। আর শৈশব, কৈশোরের যে কোনো স্মৃতিই আমরা মুছে ফেলতে পারি না। এই সময়কার যে কোনো প্রভাব কেবল কবি ও কবিতার ক্ষেত্রে বলে নয়, যে কোনো ক্ষেত্রেই সত্য, বাস্তব।
কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনার আলাপে আসলে। তিনি এক আলাপে বলেছেন তিনি প্রেরণার তাড়নায় কবিতা লেখেন না; আবার এই আলাপে এও বলেছেন যে, তিনি এই প্রেরণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু কবিতা প্রথমদিকে লিখেছেন। তাহলে একটি ‘প্যারাডক্সিক্যাল পরিস্থিতি’ তৈরি হয় তাঁর কবিতা আলোচনা করতে গেলে। যা তাঁর কবিতা আর কবিতা-চিন্তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে। মানে তাঁর কবিতার কিছু অংশ রোমান্টিক ঘরানার প্রভাবে লেখা, কিছু কবিতা তিনি লিখেছেন কলকাতার ‘আধুনিক’ সাহিত্য আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। আবার কিছু কবিতা অনেকাংশেই বাস্তব হয়ে উঠছে। এতে কোনো দোষ যে আবুল হোসেন করেছেন, তা বলছি নে। কিন্তু এই বিভাজন রেখাটি মেনেই আবুল হোসেনের কবিতা পাঠ করতে হবে।
নববসন্ত কাব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা ‘বাংলার মেয়ে’। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা কবি এই কবিতায় নারীর অবস্থানের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করছেন। উদ্ভাসিত হচ্ছে প্রকৃত অবস্থা, সেই ভূগোলের, যে ভূগোল সম্পর্কে তিনি জানেন, বোঝেন, খোঁজ-খবর রাখেন। পুরোনো ভূমিতে নতুন কবিতা লেখার ফিরিস্তি তিনি এই কবিতায় দিচ্ছেন। ‘তোমরা তো সব সাপুড়ের দল।/তোমরা করেছ আমাদের চঞ্চল ক্ষণে ক্ষণে, তোমরা তুলেছ/কলকল্লোল পর্দার আবরণে, যুগে ও যুগান্তরে, তোমরা এসে/অন্দর অভ্যন্তরে বারবার বাজালে বাঁশী, যাদুর মন্ত্র/দিলে পথে ঢেলে;’ (‘বাংলার মেয়ে’, নববসন্ত)। কবিতার এই অংশে সাপুড়ে কারা, কীভাবে এই তকমা তাদের গায়ে লাগলো? কীভাবে জল, সাপ আর সাপুড়ের বিষয় এক হয়ে কবিতায় ধরা দিল।
কবিতা লেখার বেলায় পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ, একচেটিয়া নান্দনিক অভিব্যক্তি প্রকাশের বিষয়- অর্থাৎ একপেশে করে কবিতা লেখার বিষয়। আবুল হোসেন এই জায়গা থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। হয়েছিলেন।
হিন্টারল্যান্ড কিংবা সোয়াম্পল্যান্ডের মানুষ হিসেবে পূর্ব-বাংলার মানুষের যে বদ্ধ অবস্থা, তা এই অংশের ভেতর দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। রূপকথা থেকে শুরু করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সাহিত্যে নারীর অবস্থান যে নেই, এই বিষয়টি কেবল নারীর অবস্থান নয়, সামগ্রিকভাবে পূর্ব-বাংলার অবস্থানকেই নির্দেশ করে। এই অংশের মানুষের নানাদিক থেকে পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস স্পষ্ট হয়। কিন্তু এই একই মুদ্রার অপর পিঠে অবস্থান করেছিল দুনিয়ার নারী-পুরুষের সম্পর্কটাই। ‘যদি বলি : প্রেমে শ্রেষ্ঠতা দাবি আমরা করতে পারি;/ওরাও বলবে : মর্তে সেরা যা প্রেমের কবিতা পুরুষের দল/লিখেছে সবই তা।’ (‘বাংলার মেয়ে’, নববসন্ত) এখানেও একটা অসমতার বয়ান আছে। আছে দুই অংশের পার্থক্যের বিষয়। বাংলা সাহিত্যে কবিতার পুরোনো ইতিহাসের ভেতরে এই সত্য খুঁজে পাওয়া যায়। এই অসমতা যদিও প্রেমের ভেতরেই স্পষ্ট হয়েছে, কিন্তু আদতে ভেতরে ভেতরে আরো নানা বিষয় রযেছে সম্পৃক্ত। যেমন কবিতা লেখার বেলায় পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ, একচেটিয়া নান্দনিক অভিব্যক্তি প্রকাশের বিষয়- অর্থাৎ একপেশে করে কবিতা লেখার বিষয়। আবুল হোসেন এই জায়গা থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। হয়েছিলেন। প্রভাব যদিও নানাজনের ছিল। তা থাকবেই। থাকাটাই ভালো। এলিয়ট সে কথা কবিতা নির্মাণে ঐতিহ্যের প্রভাব বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়্যাল ট্যালেন্ট’-এ বলেছেন। সেই পূর্বের কবিতা-প্রভাবের চিহ্ন [রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রভাব] তাঁর প্রথম কাব্যের কবিতায় স্পষ্ট। বলছেন, ‘জাগিয়া রজনীগন্ধা; এলোমেলো থামগুলি সব/ভাষাশূন্য চেয়ে ছিল উদাসীন অব্যক্ত, নীরব।’ (‘অব্যক্ত’, নববসন্ত)। এই কবিতা যেন সাক্ষাৎ রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়ায় লেখা। তাঁর প্রভাবে মাজা বেঁকে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার বাস্তব উদাহরণ।
আধুনিক সাহিত্যের ‘পঞ্চপাণ্ডব’-এর প্রভাব মেনে সাহিত্য করার ব্যাপারটা, মানে এই প্রভাবটা বহু পরেও [পাকিস্তান হওয়ার পরে আর তা সক্রিয় ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত] পূর্ব-বাংলার কবিরা মেনে চলেছেন। প্রলম্বিত ‘আধুনিক’ সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাবের বিষয় নিয়েই কথা বলা হচ্ছে। যা সময়ের ব্যবধানে দীর্ঘ, কিন্তু ঘটে যাওয়া ঘটনার হিসেবে বাস্তব। এই প্রক্রিয়া বোঝার জন্য একটু পিছিয়ে যাওয়া জরুরি। বিষয়টি কলকাতায় রামমোহনের আগমন আর তার প্রেক্ষিত্রে কলকাতায় রেনেসাঁর উদ্ভব ও বিকাশ-এর সাথে ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর রেনেসাঁ আন্দোলনের বিষয়টির মধ্যে সময়ের পার্থক্য বুঝতে পারলে আরো স্পষ্ট হয়। তবে সত্য এই যে, দুই অংশের এই দুটো প্রক্রিয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য প্রায় একশ বছরের; কিন্তু শাসন-সময় এক। কিন্তু এই সময় আর স্থান বিবেচনায় ‘আধুনিক’ কবিতা আন্দোলন দুটো অংশে প্রক্রিয়াজতকরণ হতে একটু কম সময় নিলো। কিন্তু প্রভাব বা রেশ যা-ই বলা হয় না কেন, তা ছিল। ‘ডাইনামো’ এই সময়-স্থানের পার্থক্য বোঝার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। যা ত্রিশের কলকাতার ‘আধুনিক’ সাহিত্য আন্দোলন-প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ‘ডাইনামো’, ‘ট্রাম’, ‘ঘর্ঘর শব্দ’ আর ‘শহর’- এইসব শব্দ নিছকই শব্দ নয়। একটি বৃহৎ কমযজ্ঞকে এই শব্দগুলো রিপ্রেজেন্ট করে। এবং এর ভিতর দিয়েই কবিতার নন্দনতত্ত্বের বাস্তবতা তৈরি হয়। আর কবিতার প্রভাবের বেলায় ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার প্রথম লাইনের কথা মনে চলে আসে। মনে হয় যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ছি। যেন কলকাতা নগরের ভেতরে কোনো এক ‘গ্রেগর সামসা’ এইসব বাস্তবতা উপলব্ধি করছে। সত্যিই সেইরকম বাস্তব অভিজ্ঞতা আবুল হোসেনের ছিল।
চল্লিশের দশক রাজনৈতিকভাবে ভীষণ উত্তাল সময় ধারণ করেছিল। দৈশিক ও বৈদেশিক- দুদিক মিলেই এই বাস্তবতা নির্মিত হয়েছে। সেই বাস্তবতায় বড়ো ঘটনা হল বিশ্বযুদ্ধ। যদিও ভারতবর্ষে এই যুদ্ধের প্রভাব সহিংসতার হিসেবে ততোটা বৃহৎ নয়, যতোটা ইউরোপে ঘটে গেছে। কিন্তু সৈন্য-সামন্তের যোগাড়-যন্তর আর আর্থিক নানা বিষয় ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষ, আর এর চারপাশে, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিল এই যুদ্ধ। বিশেষ করে আর্থিকভাবে এই প্রভাব সবকিছুকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছে। এই সময়ের ধূসর বাস্তবতা কবিতায় শব্দ দিয়ে ধরার ব্যাপারে আবুল হোসেনের বিশেষত্ব রয়েছে। কিন্তু তা কেবলই নেতিবাচকতায় শেষ হয়ে যায় নি। তা শেষ হয়েছে ইতিবাচকতায়।
প্রথমে বলছেন, ‘কেন তবে চলেছে ওরা এমন ক’রে?/কিসের আশায়?/ঘোড়সওয়ারেরা জানে না জবাব দিতে।’ (‘ঘোড়সওয়ার’ নববসন্ত)। কিন্তু শেষের দিকে বলছেন, ‘ওদের ট্যাঙ্কগুলো যদি চষে ফেলত সমস্ত মরুভূমি,/বেয়োনেটের আগায় মাটি খুঁড়ে বুনতে পারত ধান/সবুজ কচি ধানের বীজ।/যদি পারত পারত পারত’ (‘ঘোড়সওয়ার’ নববসন্ত)। এই কবিতার প্রথমদিককার আলাপ একটি বৃহৎ সংকটকে স্পষ্ট করে, যা স্পর্শ করে অনেকাংশেই বাস্তবধর্মীতা, অনেকাংশেই যা কিনা ‘আধুনিক’ সাহিত্যের উপযোগহীনতার প্রভাবে প্রভাবিত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিমূর্ততায় ঢাকা; কিন্তু পরিশেষে রবীন্দ্র-কাব্যপ্রভাবের ছোঁয়া আর নজরুলের ‘ভাঙনের ভেতর দিয়ে নতুন নির্মাণ-প্রকল্পের’ ছাঁয়া স্পষ্ট হয়। নানা কারণে এই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্ব-বাংলার ‘বাঙাল’ কবিরা তখন চাষিদের ‘সুখ-দুখের কাহিনি’ নিয়ে পড়ে আছে। অনেকটা পুরোনো জমানার পুরোনো কাব্যধারায় লেপ্টে আছে। তবে তারও বাস্তবতা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক হিসেবে তার ভিত্তি ছিল না।
… কিন্তু দুর্ভিক্ষ সেই পরিস্থিতিকে আরো শোচনীয় করেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা দূরে থাক, সামান্য ভাতও মুখে ওঠে নাই; কেউ কেউ বলে ফেনও পায় নি অধিকাংশ মানুষ। এমন পরিস্থিতি নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছেন আবুল হোসেন। নিজের চোখে দেখা সেই রোমহর্ষক বাস্তবতাকে, অবশ্যই তা একটি সময়ের মানুষের জন্য করুণ বাস্তবতা, নিজের কবিতায় স্থান দিয়েছেন। এই বিবরণ বাস্তব, বাস্তববাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত।
নববসন্ত কাব্যে দুর্ভিক্ষ কবিতার একটি বড়ো বিষয় হিসেবে থেকেছে। ‘মন্বন্তরে’ কবিতায় আবুল হোসেন সেই বিষয়ই উপস্থাপন করেছেন। কবিতার শুরুতেই তিনি বলছেন, ‘আজ মনে পড়ে/মন্বন্তরে/আমরা এলাম এ শহরে।/গরু নেই গোয়ালে/ধান নেই খামারে/মাছ নেই নদীতে/কুমোর ও কামারে/কাজ আর পায় না/বসে আছে তাঁতিরা/পথে পথে ঘুরে মরে করাতিরা।’ (‘মন্বন্তরে’, নববসন্ত)। এই ঘুরে মরার বিষয়, কাজ না পাওয়ার বিষয়- একটি যৌক্তিক সামাজিক বিবর্তনের ফলেই ঘটে। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয় অন্য পেশার মানুষ। এই বিষয়টি ভারতীয় সমাজ, বিশেষ করে বাংলার সমাজের পরিবর্তনের ভেতরে আবদ্ধ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সে বিষয় তাঁর বিখ্যাত কালান্তরের বিভিন্ন প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু দুর্ভিক্ষ সেই পরিস্থিতিকে আরো শোচনীয় করেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা দূরে থাক, সামান্য ভাতও মুখে ওঠে নাই; কেউ কেউ বলে ফেনও পায় নি অধিকাংশ মানুষ। এমন পরিস্থিতি নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছেন আবুল হোসেন। নিজের চোখে দেখা সেই রোমহর্ষক বাস্তবতাকে, অবশ্যই তা একটি সময়ের মানুষের জন্য করুণ বাস্তবতা, নিজের কবিতায় স্থান দিয়েছেন। এই বিবরণ বাস্তব, বাস্তববাদী সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত। উদাহরণ : ‘বাজারে পণ্য হাজার হাজার/মেলে না অন্ন তবুও ক্ষুধার,/ঘর আছে তবু মেলে নাক’ ঘর।’ (‘মন্বন্তরে’, নববসন্ত)।
ভূমি আর রাজনীতির নানা বিষয় কেবল নয়, প্রেম এই কাব্যের বড়ো অংশ বেঁধে রেখেছে। আর নিখুঁত প্রেমের কবিতাও এই কাব্যে অহরহ আছে। ‘চিরকালের সেই মেয়ে’ কবিতায় কবি বলছেন, ‘গভীর রাত্রে/ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখা হল,/সমস্ত জীবন মনে মনে মূর্তি গড়েছি যার/সেই হৃদয়ের মেয়ে। (‘চিরকালের সেই মেয়ে’, নববসন্ত)। এই কবিতার এই কয়েক লাইন কবিতা পড়ার পরে আমাদের মনে হয় যে, এই কবিতা অনেকটাই অলৌকিক আবেগ আর কল্পনায় ভরা। কিন্তু তারও বাস্তবতা আছে। কারণ প্রথম কবিতা আলাপের বেলায় আমরা বলেছি নারীর একটি অবস্থা আবুল হোসেন এই কবিতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই নারী তাঁর আকাঙ্ক্ষিত নারী নয়। সেই নারী মূলত বাস্তবে পাচ্ছেন না।
কিন্তু তিনি তো চান সেই নারীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হোক। কিন্তু বাস্তবে আবার এমন নারীর কোনো অস্তিত্ব তাঁর নিজের ভূমিতে নেই। এই সমস্যা একদিক থেকে আবুল হোসেনের কবিতাকে ঠিকঠাক করে দেয়; আরেকদিক থেকে আবেগ-অনুভূতির কথা বলে এই কবিতা যে কারণে আবুল হোসেন বিশেষ [আধুনিক কবি], সেই বিষয়কে খারিজ করে দেয়। কিন্তু এই আধুনিকতার বিষয় অনেকাংশেই ইউরোপের মতো করে যে করা সম্ভব নয়, তা আবুল হোসেন নিজেও জানেন। এই কথা [রোমান্টিক কিংবা রবীন্দ্র-প্রভাব] তিনি নিজেও তাঁর বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আর কবিতায় প্রেম এমন একটি বিষয়, তা যতোই বাস্তবতার ভেতর দিয়ে নির্মিত হোক না কেন, তাতে কল্পনা থাকবেই। কিন্তু বাস্তবতা আর কল্পনার একটি ফারাক কেবল থাকতে পারে। এই যা। এই বিষয়ে শেষ উদাহরণ, ‘অহেতুক’ কবিতা থেকে। যদিও এই কবিতাটি প্রেমবিষয়ক নয়। কিন্তু প্রেম কেবল যে নারী ছাড়াও অনেকের সাথেই হতে পারে। কবিতাটি অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার সাথে মিলে যায়। প্রেক্ষাপটের হিসেব ভিন্ন। কিন্তু কবিতায় প্রকাশিত ভাবাবেগ প্রায় ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার মতো করেই প্রকাশিত।
আবুল হোসেন হঠাৎ অনেক কবিতা লিখে কবিতা লেখা ছেড়ে দেন নি। যেমনটা করেছিলেন সমর সেন। তিনি ক্রমাগতই লিখে গেছেন। বলা চলে সেই ১৮ বছর থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই যাত্রা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৪০-এ প্রথম কবিতার বই বের হল, তারপর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। ১৯৬৯ সনে এসে তিনি বের করলেন তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই। শিরোনাম : বিরস সংলাপ। রসহীন আলাপ যে করবেন এই পুরো কাব্যে, তার প্রাথমিক ফিরিস্তি তিনি কাব্যগ্রন্থের শিরোনামেই দিয়ে দিলেন। ‘ব্যাঙ্ককে গ্রীষ্ম’ এই কাব্যের একটি কবিতা। কবিতায় নাগরিক বাস্তবতার অনুভূতি প্রকাশের জন্য তাঁকে যেতে হল ব্যাঙ্ককে। ব্যাঙ্কক নগরের বাস্তবতা- তা নানা বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত; যেমন ‘চীনের নববর্ষ’, ‘নেপাম বোমা’, ‘স্কার্ট’ ‘হোটেল থেকে হোটেল’- এই সবই নাগরিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। তিনি কেমন নারীকে তাঁর চিন্তার নারীবিষয়ক চিন্তায় বসাতে চান তার একটি বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নারীকে বাঘিনীর সাথে তুলনা করছেন। এবং একটি বাস্তবতাকে স্পষ্ট করছেন। কিন্তু এই বাস্তবতার বিষয়টি পূর্ব-বাংলার নয়; এমনকি এই বিষয়টি ভারতবর্ষের বাস্তবতায় নির্মিত হয় নি। নির্মিত হল ব্যাঙ্ককে। এই বিষয়ও তাঁর বিশ্বভ্রমণের সাথে সম্পর্কিত। বিষয়টি কেবল যে একটি অঞ্চলের বিষয় তা নয়, এই বিষয়টি যে আবুল হোসেন নিজের চোখে দেখেছেন, এটাও একটি বড়ো বিষয়।
‘আমার ছেলেটা’ আর ‘আমার মেয়েকে’- এই কবিতা দুটো একেবারেই পারিবারিক অবস্থার বয়ানের ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে শৈশব আর কৈশোরের বাস্তবতা। এই কবিতার আলাপে ছেলের স্বাধীন জীবনের বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মানে জীবন-জগৎ-সংসারের বিষয়-আশয় নিয়ে এই কবিতার বিষয়ের শরীর আমাদের সামনে হাজির হয়। কিন্তু সেখানে পিতা ও সন্তানের ভেতরে বড়ো পার্থক্য বিদ্যমান। পিতা যেখানে স্বাধীনতার ভেতরেও একটি পরাধীন জীবন যাপন করছে, সেখানে পুত্রের জীবন বহুলাংশেই স্বাধীনতাপ্রাপ্ত। কিন্তু তা কতোদিন থাকবে? কিন্তু ‘আমার মেয়েকে’ কবিতায় কন্যাকে হারানোর, তা কীভাবে তা বলা নেই, শোকই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ভিন্ন আর কিছু নয়। বাস্তব জীবনের টুকরো টুকরো অংশ আবুল হোসেনের কবিতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এই দুটো কবিতা তারই উদাহরণ। কিন্তু এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয় তাঁর প্রায় সকল কাব্যে নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এবং এই ‘ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা’-এর পরিমাণ একেবারেই কম নয়।
পূর্ব-বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যে সময় মানুষের ভেতরে জেগে উঠছে, ক্রমাগত, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নও আমরা পরে হতে দেখবো। আবুল হোসেন এই কবিতায় কেবল নতুনভাবে জাগরিত চেতনা বিষয়ে কথা বলছেন।
কিন্তু এই কাব্যে এই দুটো কবিতার বিপরীতে আরেকটি কবিতার শিরোনাম : ‘দেব, সব দেব’। কবিতাটি একটি নির্দিষ্ট ভূগোলের মানুষের দীর্ঘদিনের শোষিত আর নিষ্পেষিত হওয়ার কাহিনি বিবৃত হয়েছে। এবং এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিদ্রোহ কিংবা কোনো প্রতিবাদ করার অক্ষমতার জায়গাটাও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মানুষকে ওপরে ওপরে দমিয়ে কিংবা দাবিয়ে রাখা গেলেও ভেতরে ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ জমে থাকে। জমে থাকে ঘৃণা। তা হয়তোবা ঘৃণার চেয়ে বেশি কিছু। এই কবিতা প্রকাশকালের হিসেব করলে দেখা যায় এই কবিতা ষাটের দশকের কবিতা। যে সময় পূর্ব-বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। যে সময় মানুষের ভেতরে জেগে উঠছে, ক্রমাগত, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নও আমরা পরে হতে দেখবো। আবুল হোসেন এই কবিতায় কেবল নতুনভাবে জাগরিত চেতনা বিষয়ে কথা বলছেন। উদাহরণ : ‘ঝাঁঝরা বুকের মধ্যে শুধু/জ্বলবে আগুন ধূ ধূ/থাকবে দু’চোখে ভ’রে ঘৃণা।/সে তো আর নিতে পারবে না।’ (‘দেব, সব দেব’, বিরস সংলাপ)। এই ধারণা আবার প্রকাশিত হচ্ছে ‘স্বদেশী কোরাস’ কবিতায়। ‘আমাদের দেশ আছে।/গানে গানে গল্পে ও গাথায়/ম্যাপের পাতায়।’ (‘স্বদেশী কোরাস’, বিরস সংলাপ)
হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২) আবুল হোসেনের মৌলিক কাব্যগ্রন্থ হিসেবে তৃতীয়। ৪০ থেকে ১৯৮০- মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ। সংহত কেবল তিনি ভাষার বেলায় নয়, কবিতা লেখার বেলায় নয়, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের বেলায়ও তিনি সংহত। এই কাব্যের প্রকাশ সম্পাদিত হল নতুন রাষ্ট্রে। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশে। এই রাষ্ট্র গঠন আর আরো অনেক বিষয় এই কাব্যের বিষয় হিসেবে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ আর সেই সময়কাল এই কাব্যের ‘কয়েকজন বিদেশী সংবাদদাতার উদ্দেশ্যে’ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। মিস্টার পোর্টার এবং আরো অনেক সাংবাদিকরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন, তাই আবুল হোসেন এই কবিতায় স্পষ্ট করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো বিষয় এই যে, এই কাব্যে এই সাংবাদিকদের প্রতি একটি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। সত্য সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য তিনি বিশেষভাবে দায়ী করেছেন এঁদেরকে। আরেকটি কবিতা ধারণ করেছে ভিন্ন বিষয়। বিষয়টি মধ্যবিত্তদের নিয়ে। মধ্যবিত্ত মানসিকতা পরিত্যাগ করে, নাগরিক মানুষ তাদের সীমাবদ্ধতা ত্যাগ করে তাদের সন্তানদেরকে যুদ্ধে যেতে দিয়েছে। কিন্তু এই মধ্যবিত্তরা হারিয়েছে হয়তোবা তাদের শেষ অবলম্বন; যা তাঁদের শেষ বয়সের অবলম্বনও বটে। সেই দুঃখবোধও আছে। কিন্তু যে চেতনা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই চেতনা ম্যধবিত্তকেও পলায়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হতে সাহায্য করেছে। কবিতায় প্রকাশিত বয়ান কয়েক লাইনে প্রকাশ করা যাক, তাহলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ‘তোমরা যেতে চাও। প্রশ্ন আর/করব না। চাইনে জানতে কিছু। যাবে যাও, যার/ইচ্ছে। বারণ করব না। কে শুনবে নিষেধ এখন?/একে একে সবাই তো গেছে, যাচ্ছে। যে দু’চার জন/এখনও রয়েছে বাকি তারাও যে আর বেশিদিন/থাকবে মনে হয় না।’ (‘পুত্রদের প্রতি’, হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস)। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্পর্কিত আরো কিছু কবিতা এই কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আবার কবিতার কী কোনো মূল্য এই সমাজে আছে কি না, সে বিষয়েও ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে ‘কি হবে কবিতা লিখে’ কবিতায়। এই কবিতার শেষ কয়েক লাইনে তা প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ : ‘সে কবিতা না-ই লিখলাম।/দিতে যদি না-ই পারি দাম/অন্তত হব না দায়ী তার/মর্মান্তিক অবমাননার।’ (‘কি হবে কবিতা লিখে’, হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস)
দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫) আশির দশকে প্রকাশিত দুটো কাব্যের দ্বিতীয়টি। ব্যক্তিগত আর একান্তে প্রকাশ করা যায় এমন বোধ আর চিন্তার সাথে সাথে আশির দশকের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাও বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে এই কাব্যে। ‘জন্মদিন’ কিংবা ‘না- দেখা নাটক’ কবিতা দুটিতে ব্যক্তিগত চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে। ‘পথ নেই’ কবিতা আধুনিক মানুষের চিন্তার ওপর নির্মিত অনিকেত চেতনা পরিবহণ করেছে। উদাহরণ : ‘যে দিকেই চাই/নেই, পথ নেই, নেই রে।’ (‘পথ নেই’, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে)। যে চিন্তা বোদলেয়ারের ‘আউটসাইডার’ কবিতার চিন্তার সাথে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখে। কিন্তু ‘রাবণ’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতা। ‘সারাক্ষণ/দশ মাথা দশ হাত বিকট দর্শন/ রাক্ষস শাসায়/রেডিও, টিভিতে, ধমকায়/মাইকে মাইকে,/চতুর্দিকে’ (‘রাবণ’, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে)। কবিতার এই অংশে প্রকাশিত হয়েছে স্বৈরাচার কর্তৃক পরিচালিত শাসনের প্রকৃত চিত্র। যা বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার বাস্তব চিত্র। এরপরেই, শেষের দিকে কবি প্রকাশ করেছেন ‘ছাঁ-পোষা’ মানুষের অসহায়তাকে। কিন্তু বাস্তবে দেখি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আর অসহায় মানুষকে অসহায় থাকতে দেয়নি। সফলকাম হওয়ার গল্পও আমাদের জানা।
নব্বইয়ের দশকের প্রথমেই প্রকাশিত হয় একটি কাব্য। শিরোনাম : অন্য ক্ষেতের ফসল (১৯৯০)। যে কাব্যে স্থান পেয়েছে আবুল হোসেন কর্তৃক অনূদিত বিশ্বের বিভিন্ন কবির কবিতা। যা তাঁর বৈশ্বিক কবিতা সম্পর্কে ধারণার বিষয়টি স্পষ্ট করে। আর সাথে সাথে অনুবাদ বিষয়ে তাঁর দক্ষতাও প্রকাশিত হয় এই কাব্যের অনূদিত কবিতার মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকে বের হয় তাঁর আরেকটি কাব্যগ্রন্থ, শিরোনাম : এখনও সময় আছে (১৯৯৭)। এই কাব্যের ভেতরে কবি, কবিতা, কাব্যতত্ত্ব, সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু কবিতা আছে। যেমন একটি কবিতার শিরোনাম : ‘কবিতাকে সান্ত্বনা’। এই কবিতায় কবি নব্বইয়ের দশকের কবিতা-আন্দোলন আর কবিতার নতুন ভাঙা-গড়ার সাক্ষী হয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি তো নিজে ধারণ করেন ভিন্ন ধারণা।
ফলে শুদ্ধ-অশুদ্ধতার হিসেবে তাঁর কবিতা থেকে এই সময়ের কবিতার ভেতরে বেশ বড়ো পার্থক্য নির্মিত হয়েছে। কিন্তু তিনি তা মানতে পারছেন না। কিছুই করতেও পারছেন না। কিন্তু না মেনে উপায়ও নেই। আবার ‘এক সমালোচকে’ কবিতায় কবি তাঁর কবিতার সমালোচনার বিরুদ্ধে জবাব দিয়েছেন কবিতা লিখে। বলছেন, ‘ভাষার খই/তো ফুটিয়েছেন অনেকেই,/ও যদি ধরতে চায় তার ভেতরের আগুন/মশাল না জ্বেলেই,/ব্যাপারটা অত সহজে বাতিল না-ই করলেন।’ (‘এক সমালোচককে’, এখনও সময় আছে)। আবার মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদেরকে নিয়েও লিখছেন। তাঁরা অধিকাংশই সাহিত্যিক। যেমন ‘সময়ের স্রোতে’- এই কবিতা লিখছেন শামসুর রাহমানকে নিয়ে। শামসুর রাহমানের কবিতা আর কবিতার বিষয়-আশয়ও এই একটু কবিতায় প্রকাশিত হচ্ছে। বন্ধু শওকত ওসমানকে নিয়ে লিখছেন। লিখছেন কঠিন বাস্তবতায় শওকত ওসমান কীভাবে তাঁর সাহিত্যের নৈতিকতার প্রশ্ন টিকিয়ে রেখেছেন। আর ‘কবির উত্তর’ কবিতায় কবিতা আর কথাসাহিত্যের ফারাকটা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
রাজনৈতিকভাবে তিনি কবিতাকে রাজনৈতিক হতে দেন নি। কিন্তু তিনি কবিতার রাজনৈতিক আদর্শকে খারিজ করে দিতে পারেন নি।
কবিতার আলাপ এখানেই রাখা হল। এখন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলাপ সেরে আলাপের ইতি টানা হবে। আবুল হোসেনের কবিতা মিত বাক্যের সমন্বয়, অনেকটাই সংহত আর সংযত—এমন আলাপ প্রায় সবার আলোচনাতেই এসে পড়ে। বিষয়টি নানা কারণে অগুরুত্বপূর্ণ, আবার কবি আবুল হোসেনের বেলায় তা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কবিতার এই সংহত ভাব, কবিতায় ‘কম কথা বলা বৈশিষ্ট্য’ ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে এই বৈশিষ্ট্যটা কেবলি আবুল হোসেনের কবিতায় ছিল না, তা তাঁর নিজের চরিত্রেও বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ছিল। কম কথা বলা। আগ বাড়িয়ে কথা না বলা। নিজের এবং নিজের সাহিত্য সম্পর্কে না জানানো—এই সবই তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। সেই বিষয় তিনি যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তেমনি তাঁর চারপাশের লোকজনও সে সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছে।
আবুল হোসেন কবিতার উপযোগিতাকে বাতিল করতে চেয়েছেন। আবার কবিতায় থাকা অলৌকিকতার বিষয়কে মেনে নিতে পারেন নি। রাজনৈতিকভাবে তিনি কবিতাকে রাজনৈতিক হতে দেন নি। কিন্তু তিনি কবিতার রাজনৈতিক আদর্শকে খারিজ করে দিতে পারেন নি। কিন্তু এইসব কি তিনি করতে পেরেছেন? প্রথম বিষয় নিয়ে আলাপ করা যাক। কবিতায় উপযোগিতার বিষয়। তিনি যদিও এই বিষয় পুরোপুরি স্বীকার করেন নি। কিন্তু নানাভাবে তিনি এই বিষয় পুরোপুরি মানতে পারেন নি। কিন্তু মেনেও ফেলেছেন অনেক ক্ষেত্রেই। আর রাজনৈতিক বিষয়, তাঁর কবিতায়, তিনি যদিও তা নাকচ করতে চেয়েছেন, কিন্তু শেষাবধি তিনি তা পারেন নি। কারণ বৈশ্বিক আর দৈশিক নানামাত্রিক রাজনৈতিক বিষয়-আশয় তাঁকে প্রভাবিত করেছে। তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। এবং এই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে লিখেছেন কবিতা। ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতায় যে বলা হল, কবিতা কেবল কবিতার জন্য। বুদ্ধদেব বসুরা বললেন, কবিতা হবে একটি নিটোল আপেলের মতো, তাতে আর কিছুই থাকবে না, কেবল শিল্প হয়ে উঠার প্রবণতাই ভালো কবিতার বৈশিষ্ট্য। বলবো ভালো কবিতা এভাবেই হয়ে ওঠে। কিন্তু আবুল হোসেন কি তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলেন? এক যুগ থেকে আরেক যুগের বিষয়-আশয় ভিন্নতায় গড়া হবে। যুগ বদলালে সাহিত্য বদলায়। সাহিত্যের রুচি বদলায়। সাহিত্যের ভেতরের মতবাদগত দর্শনও বদলায়। আবুল হোসেনের বেলায়ও এই বিষয়টি ঘটেছে। কবিতার রাজনৈতিক বিষয় এই ধারায়ই প্রবাহিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। আর অলৌকিকতার বিষয়ে সতর্ক থাকলেও ‘কী যেন’ একটা, যা কবিতা লিখিয়ে নেয় কবিকে দিয়ে, তা তাঁর অনেক কবিতায়ই স্পষ্ট হয়।
শেষ আলাপ। শেষ বিষয়। নাগরিকতা। এই বিষয়টিই তাঁর কবিতার বিষয়গত উপাদানের সংগ্রহের বেলায় বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। এই যে আবুল হোসেনকে এক বাক্যে ‘নাগরিক’ কবির খেতাবও দেওয়া যায়, এই বিষয়টি সম্ভব হয় তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহারের বিবেচনায়। মানে কবিতায় কীভাবে শব্দের ব্যবহার হচ্ছে- এই বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি করে কবিতায় কী শব্দ ব্যবহার হচ্ছে- এই বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দসমূহ তিনি ব্যবহার করেছেন নাগরিক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে। সেই অভিজ্ঞতাও তাঁর ছিল। তবে এই সে শব্দ ব্যবহারের বিষয়, আবুল হোসেনের কবিতায়, তা তাঁকে বিশেষভাবে নাগরিক কবি হতে সাহায্য করেছে। কারণ কবিতায় যে দৃশ্যজগৎ তৈরি হয়, তার জন্য শব্দ ব্যবহারের একটি বড়ো ভূমিকা থাকে। শব্দ দৃশ্যজগৎকে কবিতায় স্পষ্ট করে তোলে। আবুল হোসেন তাঁর কবিতায় নগর ও নাগরিকতার বিষয় উপস্থাপনের বেলায় এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট করেছেন।
ওপরে আলোচিত বিষয় ছাড়া আর কিছু যে আবুল হোসেনের কবিতায় নেই বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু আলাপের সীমানার হিসেবে তার সব যদিও শেষ করা গেল না। কিন্তু যে বিষয়সমূহ আলাপ করা গেল, এই বিষয়ই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কবিতার বিষয় এবং প্রকরণ হিসেবে জারি থেকেছে। এবং এই বিষয়ের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। এই সমস্ত বিষয়-আশয় তাঁর কবিতাকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। বিশেষ হয়েছে তাঁর কবিতা, তাঁর আগে-পরের কবিদের থেকে। আবুল হোসেন বাংলা কবিতায়, বাংলাদেশের কবিতায় বিশেষ হয়ে আছেন। থাকবেন। যদিও সীমাবদ্ধতা তো তাঁর কবিতায় আছেই।

সোহানুজ্জামান
প্রাবন্ধিক ও গবেষক। জন্ম ১৮ মে ১৯৯৪ সালে, ঝিনাইদহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লিখছেন ও অনুবাদ করছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে পঞ্চাশের অধিক প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে।