ওয়ালীউল্লাহ্-র উপন্যাস : প্রেক্ষিত সামাজিক সংকট
জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [১৫ অগাস্ট ১৯২২-১০ অক্টোবর ১৯৭১]
শতবর্ষে ও নক্ষত্রমথিত রাত্রির শিশির নির্বাপিত হলেও, আমাদের সঘন চৈতন্যের সামনে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন অনম্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ । আমাদের জানা আছে, খুব বেশি লেখেননি তিনি, অথচ তাঁর শিল্প-অন্বেষা ও অভিপ্রায় এবং সৃষ্টি অমোচনীয় রক্ত ও নিশ্বাস অতিক্রম করে গেছে। তাঁর জন্মশতবর্ষ আমরা পার করেছি সম্প্রতি। সেটি উপলক্ষ হলেও, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সবসময় আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতা ও পরিসর বাড়িয়ে চলেছেন। তাঁর স্মরণে প্রকাশ হলো দুইটি রচনা এবং এই লেখকের একটি দুষপ্রাপ্ত গল্প।
সাহিত্য সমালোচক এ-বিষয়ে একমত যে, কোনো দেশের সাহিত্যই সমাজকে বাদ দিয়ে হয়নি, তা কথাসাহিত্য কিংবা কাব্য যাই হোক না কেন। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও বলা যায়, উদ্ভবকাল থেকেই তা সমাজের নানা তরঙ্গ, ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘটনার উপস্থাপনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে সেই সময়কার সামন্ত-সমাজ কাঠামোর ভেতরে দ্বন্দ্বের প্রধান দিকগুলো চিত্রিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যে যতই কল্পনা বিলাসী হন না কেন উপন্যাসে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তব প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাসের কথা বলা যায় যেখানে সমকালীন জীবন প্রায় ইতিহাসের ধরনে উপস্থিত। প্রসঙ্গক্রমে ‘ঘরে-বাইরে’র (১৯১৬) নাম নেওয়া যেতে পারে। স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার ঘটনা এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। তখনকার ব্যক্তি ও সমাজ মানসে স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবের চিত্রটি নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে। এভাবে দেখা যায় বাংলা উপন্যাস অন্তত সমাজ প্রতিফলনের ক্ষেত্রে সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
দেশবিভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশের উপন্যাস বস্তুত কথাসাহিত্যের সমাজবাস্তবতার ধারাকে বিশেষভাবে অনুসরণ করেছে। সমালোচক জানান, ‘উপন্যাসের একমাত্র কাজ রূপায়ণ, বহিরঙ্গ বাস্তবতাকে, কখনো বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে বাস্তবের নিহিত নির্যাসকে’ (অশ্রুকুমার সিকদার ১৯৮৮ : ১২)। বাংলাদেশের ঐ সময়কার ঔপন্যাসিকগণ মূলত বাস্তবতার বিমূর্ত নয় মূর্ত রূপায়ণের দিকেই অধিক মনোযোগী ছিলেন। নগরজীবন কিংবা গ্রামনির্ভর জীবন কিংবা অন্য বিষয়বস্তুনির্ভর উপন্যাস– বিষয় যা-ই হোক না কেন, তাঁরা প্রত্যক্ষ জীবনের উপস্থাপনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বিভাগ পরবর্তীকালে দেশে যেহেতু গ্রামীণ সমাজ কাঠামো প্রধান ছিল, সেহেতু অধিকাংশ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। তা সত্ত্বেও সমালোচকের বিশ্লেষণে তখনকার উপন্যাসে, ‘পাকিস্তান শাসনাধীন রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের রূপ প্রকাশ পেতে থাকে দৈনন্দিনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতার স্বপ্নসঞ্জাত, মোহভঙ্গ এবং বিপুল সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে’ (মহীবুল আজিজ ২০০২ : ২২)। এই যে উপন্যাসের বাস্তবতা এটা কেবলই সমাজের স্থির ছবি নয় এতে সমাজের সংকটগ্রস্ততার পরিপ্রেক্ষিতটাও প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে।
বিভাগপরবর্তীকালে অর্থাৎ পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসকে রিদ্ধ করেছেন তাঁদের কয়েকজনের উপন্যাস এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করলে দেখা যাবে যে প্রায় সব ঔপন্যাসিকই সমকালীন সমাজের সমস্যাপীড়িত অবস্থার চিত্র এঁকেছেন। পার্থক্য হচ্ছে কোনো-কোনো ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে তা এসেছে বর্ণনার আধিক্যে, আবার কারও কারও উপন্যাসে এসেছে বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সবমিলিয়ে সমগ্র বাংলা উপন্যাসের নিরিখেই এই সময়কার বাংলাদেশের উপন্যাস-পরিধি অহংকারী ভূমিকার দাবিদার। শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শহীদুল্লাহ কায়সার, সরদার জয়েনউদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম আজাদ, আবু ইসহাক– এঁদের উপন্যাস গ্রামপ্রধান এবং গ্রামীন জীবনের সমস্যা বিচিত্রভাবে তাঁদের উপন্যাসে স্থান করে নিল। দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, অভাব, বঞ্চনা, সামাজিক শোষণ প্রভৃতি বিষয়ে এত নিখুঁতভাবে আর কোনো কালেই চিত্রিত হয়নি। বাংলা উপন্যাস কখনোই গ্রামীণ জীবনের এতটা গভীরে প্রবেশের সার্থকতা অর্জন করেনি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র উপন্যাসে কৃষিজীবী নিঃস্ব মানুষের যে-ছবি তা অনেক বেশি নিখুঁত ও বাস্তব। একইভাবে শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটনির্ভর বাংলাদেশের উপন্যাসও সামাজিক সমস্যা ও সংকটের প্রকৃত চিত্রকে উন্মোচনের চেষ্টা করে। রশীদ করিম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু রুশদ, জহির রায়হান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসে একদিকে ব্যক্তির অন্তর্জগৎ, অন্যদিকে সামাজিক জটিলতার বৃত্তান্ত পাওয়া গেল। এঁদের রচনায় বাস্তবতার প্রতিরূপ অধিকাংশই সরাসরি ও প্রতীকবিহীন রূপে প্রকাশ পায়। সমালোচক তাই এঁদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন, ‘১৯৪৭-৫৭ পর্বের ঔপন্যাসিকগণ একালে ছিলেন সত্যসন্ধ।’ (সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৮৫ : ২২) তবে এ-সত্যানুসন্ধিৎসার মূল্য কোনো অংশেই কম ছিল না। ষাটের দশকে বাংলাদেশের উপন্যাস ক্রমশ বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের অনুসন্ধানী এবং ভঙ্গির ক্ষেত্রে বর্ণিল হতে থাকে।
ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সেই ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিকদের একজন যিনি ১৯৪৮-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাসেই একজন ক্ষমতাধর কথাশিল্পীর আবির্ভাব ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর অন্য দুটি উপন্যাসে তাঁর ক্ষমতার আরও বিস্তার ঘটে এবং তিনি সমগ্র বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসেই একজন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র সর্বমোট উপন্যাস তিনটি- ‘লাল সালু’ (১৯৪৮), ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) এবং ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮)। উপন্যাসের প্রকাশকালের হিসেবে কুড়ি বছরের সামাজিক কালের পটভূমি তাঁর রচনায় পাওয়া যায়। তবে উপন্যাসের চিত্রিত কালগত বিস্তার মূলত অর্ধশতাব্দীর কালের অধিক। গবেষকের মতে তা প্রায় ষাট বছর (মহীবুল আজিজ ২০০২ : ৫২)। কাজেই ষাট বছরের সামাজিক প্রবাহ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র উপন্যাসসাহিত্যে প্রমূর্ত। সেই সামাজিক প্রবাহের মধ্যে আবার সামাজিক সংকটের চিত্রণই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকটি প্রধান বিষয় তাঁর উপন্যাসের মূল লক্ষবিন্দু হলেও উল্লেখকৃত কালের সমগ্র সামাজিক চরিত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ একজন দক্ষ সমাজবিজ্ঞানীর মত এঁকে গেছেন। ফলে তাঁর উপন্যাসের সামাজিক সংকট কেবল উপন্যাসের জগতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা হয়ে ওঠে সমকালীন জীবনের ভাষ্য। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র জীবনবোধ এবং দর্শন তাঁর এই সমাজ-জিজ্ঞাসাকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। ওয়ালীউল্লাহ্-বিশেষজ্ঞের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে স্মরণীয়, ‘শিল্প প্রমূর্তির প্রশ্নে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তপস্যাশুদ্ধ, অতিক্রমণের প্রশ্নে পরীক্ষাপ্রিয়। সমাজ মর্মমূলে শিকড়ঞ্চার করে তাঁর উদ্ভব’ (সৈয়দ আকরাম হোসেন ১৯৮৮ : ১২)। তাঁর তিনটি উপন্যাসের বিধৃত সামাজিক সংকট পরস্পর-পৃথক। যদিও পৃথক-পৃথক কালসীমা পুনরায় একটি ঐক্যের সূত্রে নিহিত। ওয়ালীউল্লাহ্-র উপন্যাসে বিধৃত সেই সামাজিক সংকটের এবং সংকট রূপায়ণে তাঁর কৃতিত্বের দিকগুলো আমাদের ব্যাখ্যেয়।
অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন সমাজে ব্যক্তি কেমন দানবিক ও অসভ্য হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ ‘লালসালু’। আমরা ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলি প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, যেখানে দেখা যায় ভারসাম্যহীন সমাজের প্রবল শক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে ব্যক্তি এবং সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ার মতো শক্তি সমাজের নেই।
প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’র মাধ্যমেই একটা প্রবল সামাজিক সংকটের চেহারা উন্মোচিত হয় ঔপন্যাসিকের হাতে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার ধর্মীয় ভণ্ডামী– এক বিপুল সংকটের ছবি ‘লাল সালু’। এই ছবি কিন্তু লেখকের তৈরি করা নয়। এটা তাঁর দেখা বাস্তব সমাজ ও জীবনের ছবি-ই। এই উপন্যাস সম্পর্কে শওকত আলী লিখেছেন, ‘ক্ষুধা, লাঞ্ছনা ও দাসত্বের ভারে প্রত্যহ যে-জীবন পিষ্ট এবং ন্যূব্জ, সেই জীবনের আবয়বিক চেহারাটিকে কি পাশ কাটানো যায়? অবশ্যই যায় না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ও পাশ কাটাননি, অন্তত তাঁর প্রথম উপন্যাসে তো নয়ই’ (শওকত আলী ২০০৩ : ৩১)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র আগের উপন্যাসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখানেই যে সংকটের এমন নিখুঁত, বিস্তৃত ও বিজ্ঞানসম্মত উপস্থাপনা তাঁরা করেননি। অন্তত পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন বৃত্তান্ত তো নয়ই।
‘লাল সালু’ উপন্যাসের সামাজিক সংকট এবং সেখানে ব্যক্তির অবস্থান, আবার সংকটকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্রগুলিও এটিকে এক নতুন ধরনের শিল্পরূপলাভে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সমাজ ও জীবনের সংকটকে উপন্যাসের সংকটে রূপান্তরিত করার দক্ষতা প্রদর্শনে লেখক সফল। ‘লাল সালু’র সামাজিক সংকট রচয়িতার বর্ণনা নয়, চরিত্রসমূহ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অর্থবহ হয়েছে। একইসঙ্গে সামাজিক সীমানার মধ্যে ব্যক্তির অন্তর্জগতের গভীর প্রদেশকে আবিষ্কার– সেটাও ঘটেছে। এর ফলে সংকটের ভাষার বিস্তৃতি একঘেয়ে ও পুনরুক্তিমূলক না হয়ে আকর্ষণীয় নাটকীয় রূপ পেয়েছে।
প্রথমে ‘লালসালু’র সামাজিক সংকটের সমাজ-কেন্দ্রিক আয়তনটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। মহব্বতনগর গ্রামের প্রতীকে পূর্ব বাংলাকে এঁকেছেন ওয়ালীউল্লাহ্। জোতজমির মালিকানাই এই গ্রামীণ সমাজকাঠামোর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠি। সেই শ্রেণিটি সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ হলেও শতকরা নিরানব্বই ভাগ কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত। এক বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের অস্তিত্ব তাই সেখানে মূল্যহীন। তাদের জীবনের অসহায়তা ও শক্তিহীনতার চিত্রটি মুনশিয়ানার সঙ্গে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। জোতজমির সমান্তরালে ধর্মীয় প্রভাব ও প্রতিপত্তির নিয়ন্ত্রণও অনস্বীকার্য নয়। বরং কখনো কখনো ধর্মীয় প্রভাব জোতজমির প্রভাবকে অতিক্রম করে যায়। ভণ্ড পীর মজিদের হাতে গ্রামের প্রভাবশালী জমিদার খালেক ব্যাপারীর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় ঘটনাটিতে সে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে। সংকটের রূপ আরও ঘনীভূত হয় অসহায় জনগোষ্ঠীর অদৃষ্টবাদের প্রতি চেষ্টাহীন আত্মসমর্পণ থেকে। এর জন্য মজিদ বা খালেক ব্যাপারী বা অন্য কোনো শক্তি নয়, তাদের শত শত বছরের অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও কুসংস্কার দায়ী। উপন্যাসের শুরুর দিকে অনবদ্য বর্ণনায় সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় ঔপন্যাসিকের পর্যবেক্ষণশক্তির, ‘সত্যি শস্য নেই। যা আছে তা যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি’ (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৮৬ : ৪)। এর ফলে এক উদ্ধারহীন পরিত্রাণহীন জীবনের বৃত্তে বন্দি মহব্বতনগরে কৃষি সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। উদ্ধারহীন জনগোষ্ঠীর উদ্ধারের চেষ্টা যে হয় না তা নয়। সেই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীদের জীবনের গভীরতর গ্লানি ও দুরবস্থার বার্তাই পাঠকের নিকটে এসে পৌঁছায়।
গ্রামের দরিদ্র যুবক আক্কাস কলকাতা গিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গ্রামে ফিরে এবং নিজেকে সে নিয়োজিত করতে চায় গ্রামবাসীদের সংকট দূর করবার কাজে। সে চায় শিক্ষার আলো দিয়ে অন্ধকারের বিদূরণ। কিন্তু সংকটের এমনই বিস্তৃতি যে আক্কাসের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা বয়ে আনে ব্যর্থতা আর নৈরাশ্য। শুধু তা-ই নয়, তার সংকট-উপলব্ধির চেতনাকে কালিমালিপ্ত করে মজিদ তাকে জনসম্মুক্ষে চরমভাবে অপমানিত করে। যে-জনগণের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আক্কাস, সে-জনগণের কাছে তার চেতনার দিকটি সম্পূর্ণ মূল্যহীন। উল্টো তারা মসজিদের শেখানো বুলি আউড়িয়ে আক্কাসকে ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে। এর মধ্য দিয়ে সংকটের একটা পরিব্যাপ্ত অবস্থা প্রকাশিত হয় এ-উপন্যাসে। অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন সমাজে ব্যক্তি কেমন দানবিক ও অসভ্য হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ ‘লালসালু’। আমরা ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলি প্রসঙ্গত স্মরণ করতে পারি, যেখানে দেখা যায় ভারসাম্যহীন সমাজের প্রবল শক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠেছে ব্যক্তি এবং সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ার মতো শক্তি সমাজের নেই। ডিকেন্স তাঁর সেই ব্যক্তি-চরিত্রের অসঙ্গতি বোঝাবার জন্য চরিত্রগুলিকে নানা ধরনের শারীরিক সীমাবদ্ধতা বিশিষ্ট করে তোলেন। ‘লাল সালু’তে মজিদ সেরকম একজন ব্যক্তি যাকে দানবে পরিণত করেছে সংকটাপন্ন সমাজের জড়ত্ব। মজিদ যে অশুভের প্রতিনিধি সেটা বারবার বর্ণিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের বিশ্লেষণে। কখনো সামাজিক চরিত্ররা তার অসঙ্গতিকে বিদ্রুপ করেছে, কখনো তার নিজের সংলাপেই ধরা পড়েছে তার মধ্যকার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা অসঙ্গতির বিশেষত্ব।
‘লালসালু’তে মজিদ এককভাবে ক্ষমতাবান এবং সর্বশক্তিমান। প্রতিপক্ষতার সম্ভাবনা দৃশ্যমান হলেও অচিরেই তা নস্যাৎ হয়ে যায় দুর্বৃত্তিপরায়ণ মজিদের কুশলী পরিচালনায়। মহব্বতনগর গ্রামে মজিদ-প্রতিষ্ঠিত ‘মোদাচ্ছের পীরের মাজার’ একদিকে মজিদের শক্তির প্রচারক এবং অন্যদিকে জনগোষ্ঠীর অসহায়তার প্রতীক। মজিদ শক্তিমান– কারণ, মাজার তার অর্থ, প্রতিপত্তি এবং নিয়ন্ত্রণের অবলম্বন। জনগোষ্ঠি অসহায়– কারণ, নিজেদের হাজারো সমস্যায় তারা মাজারের কাছে এসে নিজেদেরকে সমর্পিত করে। নিজেদের অসহায় নিশ্চেষ্টতা নিয়ে তারা পড়ে থাকে মাজারে। সংকটের এই দ্বিপাক্ষিক বাস্তবতা উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়ানো।
প্রশ্ন উঠতে পারে ‘লালসালু’তে চিত্রিত সামাজিক সংকট আসলে কার! তা কি মজিদ, খালেক ব্যাপারী প্রভৃতি নিপীড়নকারী এবং শোষকের সংকট? তা নয়– সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংকট। সেই সংকট সমাজের ভিত্তি নষ্ট করে দিয়েছে, সমাজকে একটা স্থির-জড় পদার্থে পরিণত করেছে। তাই উপন্যাসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত মজিদ চরিত্রটি অপরিবর্তনীয়ই থেকে যায়। ঘনীভূত সংকটমুক্তি মহব্বতনগরবাসীদের জীবনে প্রত্যাসন্ন নয় বলেই মজিদ চরিত্রটি বিপন্নতায় আক্রান্ত হয় না। পূর্ববাংলার জোতজমিদার ও ধর্মব্যাবসায়ীশাসিত সামাজিক গণ্ডির বাস্তব পরিস্থিতি ওয়ালীউল্লাহ্ এভাবেই মজিদ এবং গ্রামবাসীদের প্রতীকের চিহ্নিত করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬)-এর কথা বলা যায়, দীর্ঘকালের অভাব-বঞ্চনায় পড়ে-থাকা কেতুপুর গোটা উপন্যাসে আগাগোড়া এক। সংকট থেকে যখন মুক্তি আর সম্ভব হয়না তখন কেতুপুরের জেলে-মাঝি কুবের গ্রাম ছেড়ে চলে যায় দুর্গম ময়নাদ্বীপে। মানিক-চিত্রিত সমাজ বাস্তবে সংকটমুক্ত নয় বলেই ঔপন্যাসিকের পক্ষে কল্পিত মুক্তি রচনা সম্ভব হয়না। লালসালু উপন্যাসও তাই এক হতাশা থেকে আরেক হতাশার দিকে ধাবিত হয়। যে-হতাশার শুরু মহব্বতনগরে গ্রামে ভণ্ড মজিদের প্রবেশ ও তার প্রভাব বিস্তাতারের মাধ্যমে, তার শেষ মজিদের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হওয়ার প্রক্রিয়ায় নিষ্পন্ন। মূলত ‘লাল সালু হচ্ছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র তিনটি উপন্যাসের যোগফলে যে- সামাজিক বাস্তবতা তারই একটি সুপরিসর ভূমিকা’ ( শওকত আলী ২০০৩ : ৩৫)। এতে সমস্যার মূল দিকগুলি চিহ্নিত হয়েছে, যা ব্যাপ্ত হয়েছে পরের দুটি উপন্যাসে। নায়কেরা সেই গণ্ডিতে জিজ্ঞাসা অন্বেষণ এবং প্রশ্নের অবকাশ সৃষ্টি করেছে। তাই বলা যায়, যেহেতু তাঁর পুর্বে আর কোনো ঔপন্যাসিক এত বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনের মৌল সমস্যাসমূহকে এভাবে উপন্যাসে তুলে আনেননি, সে দিক থেকে ওয়ালিউল্লাহ্-র এই নির্মাণ বা সমাধান প্রদর্শন করাটাই বড় কথা নয়, সমস্যা বা সংকটকে চিহ্নিত করতে পারাটাও একটা বড় সাফল্য। সেই সাফল্য অর্জনে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ দ্বিতীয়রহিত।
উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে দুটি সমান্তরাল রেখার উপস্থিতি আঁচ করা যায়। একটি রেখা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুহাম্মদ মুস্তাফার চেতনার উন্মেষ ও পরিচর্যাকেন্দ্রিক এবং অন্য রেখা গ্রামীণ মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের চেতনার নির্দেশক।
তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ও সামাজিক সংকটের গভীরে যাত্রার প্রত্যয়। সংকটকে বাইরে থেকে আপাতদৃষ্টি অবলোকন না করে তার কারণ ও ফল অনুসন্ধানে তৎপর ঔপন্যাসিক। উপন্যাসটি ওয়ালীউল্লাহ্-র প্রথম উপন্যাস ‘লাল সালু’র চাইতে অনেক জটিল এবং হয়তো সে কারণে অনেক বিশ্লেষণধর্মীও। এতে পূর্ববর্তী সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের অনুরণন পাওয়া যায়। অর্থাৎ চরিত্রের দিক থেকে সময়ের অতিক্রমণ সত্বেও দুটি উপন্যাস একই সমাজ পরিধির মধ্যে গাঁথা। ফলে প্রথম উপন্যাসের বর্ণন-অনুষঙ্গগুলি এতে নেই। তাছাড়া সমাজের বড় চৌহদ্দি নয়, ব্যক্তির চেতনার মধ্যে অবস্থিতির ফলে যেটুকু পরিসর মেলে ঠিক ততটুকুই মধ্যেই অবস্থান নেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসে লেখকের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তরালে থাকা আত্মচৈতন্যের উন্মোচন (অ্যানে নিন ১৯৬৯ : ৪৪)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘চাঁদের অমাবস্যা’র প্রধান চরিত্র যুবক শিক্ষকের অন্তর্চৈতন্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। তাঁর কৃতিত্ব এখানে যে, তিনি যুবক শিক্ষকের চেতনাকে বিচ্ছিন্ন-সম্পর্কহীন সত্তায় পরিণত করেননি। বরং সমগ্র সমাজ চৈতন্যের সমান্তরালে স্থাপিত হয়েছে যুবক শিক্ষকের চৈতন্য। সে-অর্থে তার ব্যক্তি-চেতনায় পারিপার্শ্বিক সমাজের অবয়ব প্রতিফলিত হয়েছে এবং সেই অবয়বে সংকটটাই সবচেয়ে গণ্য বিষয়।
কালগত বিচারে ‘লাল সালু’র প্রায় অর্ধশতাধিক কাল পরের সমাজ-পরিপ্রেক্ষিত ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় চিত্রিত। কাজেই অনুমান অসঙ্গগত নয় যে সামাজিক প্রগতির মানদণ্ডে ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় অপেক্ষাকৃত অগ্রসর পরিস্থিতির দেখা মিলবে। উপন্যাসের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘লাল সালু’ উপন্যাসের আক্কাস বাংলার সমাজ-মানসকে তার অর্জিত শিক্ষার চেতনায় অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। কিন্তু পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে সমাজ-মানস শিক্ষা গ্রহণ করেছে। যদিও সব ধরনের শিক্ষার প্রতি আনুকূল্যের বাস্তবতা তখনও তৈরি হয়নি। বড়বাড়ির দাদাসাহেব খুবই ধার্মিক এবং গোঁড়া। নিজে ব্রিটিশ আমলের সরকারি চাকুরি ছিলেন তিনি, কিন্তু সন্তানদের ধর্মীয় অনুশাসননির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত করার দিকেই তার অধিক মনোযোগ। সময়ের বিবর্তন ঘটলেও সামাজিক চেতনার অগ্রগতির যে সর্বতোভাবে ঘটেনি এটা তারই প্রকাশ।
‘লাল সালু’ উপন্যাসের মূল সামাজিক সংকটের কারণ ছিল ধর্মীয় শোষণ। ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় তার সাথে যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা। সংকট হয়েছে পূর্বের চেয়ে জটিল ও ঘনীভূত। আগে একা মজিদের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে অতিবাহিত হতো গ্রামবাসীদের জীবন। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র সমকালে অর্থাৎ পঞ্চাশ-ষাট দশকের পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ পেক্ষাপটে সামন্ত জমিদার শ্রেণির শাসন ও শোষণ নতুনতর সংকটের হেতু। যদিও দেখা যায় যে শিক্ষার বিস্তার পূর্বের চেয়ে অধিক; যুবক শিক্ষক মাদ্রাসা নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তখনও প্রভাবশালী শ্রেণি হয়ে উঠতে পারেনি। বাঁশঝাড়ে অপমৃত্যুর সাক্ষী আরেফ আলী হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে জানল যে হত্যাকারী ধার্মিক বলে কথিত গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু আরিফ আলী মুখ বুঁজে তা সহ্য করতে বাধ্য। সে যখন উপন্যাসের শেষে থানায় যায় আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের কাছে সত্য প্রকাশ করবার জন্য, তখনও দেখা যায় কারও পক্ষেই খুনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ থানা-প্রশাসন সমাজের জোতদার-মহাজন শ্রেণির প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত। ফলে সেখানে সমাজের নিয়ন্ত্রক শ্রেণির স্বার্থই শুধু সংরক্ষিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাসে এই অসম সামাজিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। যুবক শিক্ষক আরেক আলীর চেতনাকে তিনি অস্তিত্ববাদী জীবনদর্শনের সহায়তায় উদঘাটন করেছেন। এতে সামাজিক সংকটের সমাধান না হলেও সংকট চিহ্নিত হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পাশ্চাত্যের আঙ্গিকের সহায়তা নিয়েছেন উপন্যাসটিতে, কিন্তু তিনি বিষয়ের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব সমাজজীবনসংলগ্ন।
‘চাঁদের অমাবস্যা’র সামাজিক সংকটের মূল অন্বেষণ একটি অঞ্চলের এক বিপুল জনগোষ্ঠীর অসহায়ও প্রবঞ্চিত জীবন। যুগ যুগ ধরে নানা ধরনের শৃঙ্খলায় তাদের অবস্থা উত্তরণহীন। যুবক শিক্ষকের চেতনার চোখ দিয়ে দীর্ঘদিনের সংকটের ওপর আলোকসম্পাতের কাজ করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। পরবর্তী উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে সে জনগোষ্ঠীর সংকটের আরও জটিল ও বহুস্তর রূপটাই উন্মোচিত হতে দেখা যায়। ঔপন্যাসিক শওকত আলী তাঁর একটি প্রবন্ধের লিখেছেন, ‘একজন লেখক জনগণের সঙ্গে কীভাবে থাকতে পারেন?… উত্তর একটাই – আর তা হলো ভালোবাসার সম্পর্ক’ (২০০৩ : ৩১)। মানব-সম্পর্ক সমূহের প্রতিবেদনই শুধু নয় অম্লমধুর, দ্বন্দ্বসংক্ষুব্ধ, বিরোধ-মিলনাত্মক অবস্থার বিশ্লেষণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। ওয়ালিউল্লাহ্ তাঁর সুদীর্ঘ প্রবাসজীবন প্রথম বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে অতিবাহিত করলেও তাঁর প্রকৃত ভালবাসার কেন্দ্র– বাংলার জীবন থেকে কোনোভাবেই সরে যান না তিনি । সর্বশেষ উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে তাঁর সমাজনিষ্ঠতা আরও বহুমাত্রিক রূপ পায়। তাছাড়া সামাজিক সংকট রূপায়ণে সমকাল ও অতীতকালের মধ্যে চেতনার বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে একটি অবিচ্ছেদ্য সেতু গড়েন ওয়ালীউল্লাহ্। তাঁর স্বকীয়তার ছাপ নিয়ে সেতুটি বিদ্যমান থাকে।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে সামাজিক সংকটকে উপস্থিত করেছে। এতে ব্যক্তি ও সমাজ দুয়ের চেতনাই পেয়েছে সমান গুরুত্ব। ফলে উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে দুটি সমান্তরাল রেখার উপস্থিতি আঁচ করা যায়। একটি রেখা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুহাম্মদ মুস্তাফার চেতনার উন্মেষ ও পরিচর্যাকেন্দ্রিক এবং অন্য রেখা গ্রামীণ মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের চেতনার নির্দেশক। উপন্যাসটি পাশ্চাত্যের চেতনা-প্রবাহ রীতির আঙ্গিকে রচিত। এই রীতি একসময় পশ্চিমা উপন্যাসে খুবই সাড়া জাগায়। বিশেষ করে জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, ডরোথি রিচার্ডসন প্রমূখ এ-ধারাকে সার্থক শিল্পমাধ্যমে পরিণত করেন। রবার্ট হাম্ফ্রে তাঁর ‘স্ট্রিম অফ কনশাসনেস ইন দ্য মডার্ন নভেল’ গ্রন্থে এ রীতি সম্পর্কে বলেন যে, ব্যাক্তি স্বত্তার গভীরে স্থিত চেতন-অবচেতনের বিচিত্র স্রোত এবং তার সঙ্গে পৃথিবীর জটিল সম্পর্কের বুনন এই ধরনের উপন্যাসের লক্ষ্য (১৯৫৪ : ৬৩)। সে দিক থেকে বলা যায় ওয়ালীউল্লাহ্-র ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস তাঁর পূর্বের উপন্যাস দুটির চাইতে সর্ব অর্থেই পৃথক। প্রথমত এটি ব্যক্তির চেতনার সবগুলো স্তরকে স্পর্শ করেছে– চেতন, অবচেতন ও অর্ধচেতন এবং দ্বিতীয়ত এটি সময় চেতনার আঙ্গিক সমূহকে গ্রহণ করেছে — অতীত, বর্তমান এবং অদূর ভবিষ্যতের সময়গ্রন্থির আলোকে সামাজিক মানুষের সত্তার আলো-আঁধার নিয়ে ঔপন্যাসিক সাজিয়েছেন তাঁর কাহিনিবৃত্ত।
ওয়ালীউল্লাহ্ সমাজের এবং জীবনের সামাজিকতার সংকটকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের নিরিখে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী, আবেগের আবিলতা দিয়ে সেই দৃষ্টিকে কোনোভাবেই আচ্ছন্ন করেননি তিনি। আধুনিক বস্তুতান্ত্রিক উপন্যাসের দর্শনকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজের উপন্যাসের জগতকে তিনি এক সমান্তরাল সামাজিক জগতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
উপন্যাসটি পূর্বাপর সংকটের বৃত্তান্ত। প্রথমত ব্যক্তির সংকট। উপন্যাসের নায়ক মুহাম্মদ মুস্তাফা এমন এক সমাজ প্রবাহের মধ্যে বিকশিত হয়, যেখানে অদৃষ্টই মানুষের মূল চালিকাশক্তি। মানুষ অদৃষ্টের ওপর প্রগাঢ় আস্থাশীল। নিজেদের কার্যকারিতার চেয়েও অদৃশ্য অলৌকিকতার প্রত্যাশায় কাল অতিবাহিত হয় তাদের। কুমুরডাঙ্গার ছোট মফস্বল-এলাকায় স্টিমার ঘাট বন্ধ হয়ে তাদের জীবন যখন বদ্ধ জলাশয় এর মতো হয়ে যায়, সেখানে তাদের মধ্যকার সব ধরনের তৎপরতাও নিমেষে জড়তাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মুহাম্মদ মুস্তাফার ব্যক্তিগত চেতনাও আর পৃথকভাবে উজ্জীবনের মন্ত্রে মোড় নিতে পারে না। কেননা তার চেতনাও অতীতের এক আচ্ছন্নতায় আবৃত ছিল। মুহাম্মদ মুস্তাফা তাকে তার নিজের চেষ্টায় আচ্ছন্ন মুক্ত করতে পারলেও পরীক্ষার মুহূর্তে সে চেতনাকে উত্তীর্ণ করতে ব্যর্থ হয়। কুমুরডাঙ্গার সঙ্ঘবদ্ধ চেতনার কাছে পরাজিত হয় তার চেতনা। অর্থাৎ ওয়ালীউল্লাহ্ দেখান যে মুহাম্মদ মুস্তাফাদের মতো অল্প কয়েকটি সত্তা পৃথকভাবে গড়ে উঠলেও সার্বিক সংকটের পটভূমিতে তাদের আলাদা মূল্য থাকে না। যে-সমাজে মুহাম্মদ মুস্তাফাদের উন্মেষ ও বিকাশ, শেষ পর্যন্ত তাদের মতো চেতনাকে ধরে রাখবার মতো শক্তির যোগান দিতে ব্যর্থ হয় সে সমাজ। সেজন্য মুহাম্মদ মুস্তাফার ব্যক্তি চেতনার সংকটের সমাধান পরিলক্ষিত হয় না। বরং তার আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে এই ধারণাই প্রতিষ্ঠা পায় যে, সঙ্ঘবদ্ধ সামাজিক সংকটের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তি-চেতনার মুক্তি সম্ভব নয়।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’য় সামাজিক সংকট সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র তিনটি উপন্যাসের প্রান্তিকতা একটি বিশেষ তাৎপর্যে পরিণতি পেয়েছে। যে-সংকট ‘লাল সালু’তে একটি গ্রামের প্রতীকে প্রকাশ পায়, ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় অন্য একটি গ্রামের প্রতীকে তা-ই ক্রম-ঘনীভূত রূপ নিয়ে অবরুদ্ধ জনপদের প্রতীকে এসে দাঁড়ায়। লক্ষ করার বিষয়, এই জনপদ তাঁর পূর্বেকার উপন্যাস দুটির চাইতে কালের বিচারে বিবর্তমান- অগ্রসর, পেশাগত বিচারে বিচিত্রতর, কিন্তু সামাজিকতার সংকটের বিচারে উদ্ধারহীন। মুহাম্মদ মুস্তাফার চেতনার সূত্রে ঔপন্যাসিক যে-অতীতকে স্থাপন করেন তা প্রচণ্ড সংকটজনক, অমঙ্গলজনক এবং অভিশপ্ত। সেরকম এক ভয়ঙ্কর সামাজিকতার আধারে বেড়ে-ওঠা মুহাম্মদ মুস্তাফা তার চেতনাকে বহু প্রতিষ্ঠায় অবমুক্ত করে কুমুরডাঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু তার অতীতের সংকটের পুনর্জাগরণ ঘটে কুমুরডাঙ্গার সমাজবদ্ধ জীবনেও। ফলে মুস্তাফার চূড়ান্ত সংকটমুক্তি বাস্তবে স্বপ্নই থেকে যায়। শুধু ওই শহরের ছোট হাকিমের পদে যোগ দিতে আসা মুহাম্মদ মুস্তাফাই নয় আরও যারা ছিল– উকিল, ডাক্তার, কেরানি, টিকেট-ম্যানেজার, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, শিক্ষক সকলেই সহসা সংকটের আবর্তে পড়ে। সেই সংকট নিয়তির মতো গ্রাস করে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের। উপন্যাসে চৈতন্য-প্রবাহ রীতির আশ্রয়ে অতীত-বর্তমানের কালযাপন প্রকৃতপক্ষে সামাজিক সংকটের দীর্ঘ-প্রলম্বিত পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করা। বাস্তবে সেই সামাজিক সংকটের প্রতিবিধান হয় না বলে ঔপন্যাসিকের পক্ষেও সমাধান দাঁড় করানো সম্ভব হয়না। সেখানে অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত সব ধরনের ব্যক্তি চেতনায় সম্মিলিতভাবে গ্রাসিত হয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র উপন্যাসে সামাজিক সংকট এভাবেই এক অমোচনীয় অন্ধকার নগরীর রূপকে ধরা দেয়; যে-নগর দুঃস্বপ্নের, যে-নগর স্বপ্নহীনতার এবং যে-নগর ভবিতব্যহীনতার। ফলে সমস্ত অবলম্বনশূন্য হয়ে এক প্রকার জীবনবিযুক্তির বোধ সঙ্গে নিয়ে জীবন থেকে বিদায় নেয় মুহাম্মদ মুস্তাফা। এটা একদিক থেকে কুমুরডাঙাবাসীদের অস্তিত্বের অসহায়তা এবং অন্য দিক থেকে ঔপন্যাসিক ওয়ালীউল্লাহ্-র হতাশ অবলম্বনহীনতারও দৃষ্টান্ত।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর তিনটি উপন্যাসে প্রায় এক শতাব্দীকালের বাংলাদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের কাহিনিকে সাজিয়েছেন। কেবল জীবনের গল্প বলার জন্য নয়, এর সংকট ও সমস্ত সমস্যার উপাদানকে বিন্যস্ত করার জন্যও কাহিনির বিশেষ আঙ্গিককে গ্রহণ করেন তিনি। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে তা অনুসরণ করা হয়েছে। ঔপন্যাসিকের নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রই বহিরাগত মানুষ। ‘লাল সালুতে’ মজিদ ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় আরেফ আলী এবং ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ মুহাম্মদ মুস্তাফা- এরা প্রত্যেকেই জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছে সতর্ক দৃষ্টিতে। ‘লাল সালু’তে মজিদ জীবনের অশুভ বার্তার বাহক হলেও তার সূত্রে ঔপন্যাসিক মহব্বতনগরের অধিবাসীদের বিপন্ন অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। এতে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও গ্রাম থেকে বাইরে গিয়ে পরিবর্তিত দৃষ্টি নিয়ে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে এবং সেই দৃষ্টিতে সে গ্রামকে পর্যবেক্ষণ করে। গ্রামের মানুষদের অসহায়তা ও অসম্পূর্ণ বিকাশের অবস্থাটা তার চোখে ফুটে ওঠে। মোটকথা ওয়ালীউল্লাহ্ সমাজের এবং জীবনের সামাজিকতার সংকটকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের নিরিখে উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী, আবেগের আবিলতা দিয়ে সেই দৃষ্টিকে কোনোভাবেই আচ্ছন্ন করেননি তিনি। আধুনিক বস্তুতান্ত্রিক উপন্যাসের দর্শনকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজের উপন্যাসের জগতকে তিনি এক সমান্তরাল সামাজিক জগতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ‘যুগচৈতন্যের দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ সমাজ মর্মমূলে শিকড় সঞ্চার করে তাঁর উদ্ভব। শিল্পবোধ ও শিল্পপতি প্রশ্নে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ছিলেন পূর্বাপর সপ্রতিভ, সতর্ক ও বিশ্বপ্রসারিত। জীবন অনুধাবন ও শিল্পের প্রকরণে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ স্বতন্ত্র এবং ক্রমাগত সুক্ষ্মতর দৃষ্টি-সাফল্যের অভিযাত্রী’ (সৈয়দ আকরাম হোসেন ১৯৮৫ : ২২)। যুগচৈতন্যের সমাজমর্ম বিশ্লেষণকারী ওয়ালীউল্লাহ্ সংকটের যে-চিত্র এঁকে গেছেন তার শিল্পিত রূপ তাঁর প্রয়াণের পাঁচ দশককাল পরেও অম্লান এবং সমধিক উজ্জ্বল বলে সাহিত্য সমালোচকদের নিকটে পরিগৃহীত।
সহায়ক পঞ্জি
অশ্রুকুমার সিকদার (১৯৮৮), আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা।
মহীবুল আজিজ (২০০২), বাংলাদেশের উপন্যাসে গ্রামীণ নিম্নবর্গ, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা।
শওকত আলী (২০০৩), ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস’, শওকত আলীর প্রবন্ধ, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।
শওকত আলী (২০০৩), ‘লেখকের দায়িত্ব’, পূর্বোক্ত।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯৮৬), ‘লাল সালু’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯৮৬), ‘চাঁদের অমাবস্যা’, পূর্বোক্ত।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯৮৬), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, পূর্বোক্ত।
সৈয়দ আকরাম হোসেন (১৯৮৫), বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
নিন, অ্যানে (১৯৬৯), ‘দ্যা নভেল অফ দ্য ফিউচার’, পিটার ওয়েন, লন্ডন।
হাম্ফ্রে, রবার্ট (১৯৫৪), স্ট্রিম অফ কনশাসনেস ইন দ্য মর্ডান নভেল, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ইউএসএ।

কামরুন নাহার শীলা
জন্ম ২৯ জুন, ১৯৮১; সোনাগাজী, ফেনী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাহমুদুল হকের উপন্যাস নিয়ে এমফিল করেছেন, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিশেবে কর্মরত। গল্পের জন্য পেয়েছেন ‘কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার (২০১৯)’। প্রকাশিত বই– গল্প : লালবেজি [২০১৯], জলভ্রমি [২০২২]। সম্পাদিত গ্রন্থ : শালবনের গান [২০১৯]।