প্রবন্ধসাহিত্য

কবিতার কালাকালে আমাদের জাগ্রত সত্তা

বাংলাদেশের কবিতাভূমিতে একটা পালাবদল ঘটে চলেছে খুব সন্তর্পণে। যারা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন, তারা কাজ করছেন নিভৃতে নিরন্তর, নতুন-নতুন বিষয়ের স্পন্দনের আনন্দে, আবেগে। আর যারা নানা ধরনের প্রসিদ্ধির টুপি-টোপর নিয়ে বিভিন্ন পুরস্কার-পদক ও তকমায় নিজেদের বেশ সজ্জিত ও ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন, তারা রয়েছেন আপনমুগ্ধ এবং একধরনের রাজনীতিময় ঘেরাটোপে স্তাবক পরিবেষ্টিত ক্লাউনের মতো। এ তো গেল সমসাময়িককালের বাংলাদেশের কবিতা-পরিস্থিতির এক চিলতে দৃশ্যপটের বর্ণন মাত্র। অন্যদিকে এ নিয়ে কিঞ্চিত ভাবতে-ভাবতে অনতি অতীতের দিকে একটু দৃকপাত করলে অনেকের স্মৃতিতে দোলা দিয়ে যাবে যে, বাংলাদেশের দুই প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ও আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) তাঁদের জীবদ্দশায় কবিতার নতুন প্রণোদনার জন্যে তেমন শাণদার সত্তা হয়ে থাকতে পারেননি শেষতক। ততদিনে অবশ্য তাঁরা মানবভাগ্যের অনিবার্য পরিণতি বার্ধক্যের দশায় উপনীত হয়েছিলেন। বলছি, এই শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের দিককার কথা। ওই সময়টাতে কবি রাহমান ও কবি মাহমুদ নতুন প্রজন্মের জন্যে প্রত্যাশা ও স্বপ্নের আর কোনো ফুল, নতুন চারা, যৌবন ও জীবনের দেশীয় যাপনকালের সংকটে তাঁদের শেষ দিককার বিচিত্র অভিজ্ঞতার পুঞ্জিভূত লব্ধিসমূহের প্রকাশে অনিচ্ছুক বা অপারগ ছিলেন। লক্ষ করা গেছে, বিগত শতকের নব্বই ও একুশ শতকের প্রথম দিকে তাঁদের কবিতার আশয়-বিষয় ছিল প্রায়শই বিগতযৌবনা বারবনিতার নিজেকে অহেতুক হাস্যলাস্যময় পৌনঃপুনিকতায় রূপলোকের নাগরীরূপে উপস্থাপনের মতো। এ সময়ে তাঁদের শ্লথ ও গতানুগতিক কিসিমের কবিতাগুলো দৈনিকের সাহিত্যের পাতায় তবুও বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হতো। এর প্রধান কারণ, তাঁরা উভয়ে এদেশের সবিশেষ খ্যাতিমান কবি ছিলেন। আরও লক্ষণীয় ছিল যে, আশির দশকে এরশাদ স্বৈরশাসনের আমলেই দু-কবির পথ স্পষ্টতই দুদিকে বেঁকে গিয়েছিল। সেটি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, এ গদ্যে আপাতত সে প্রসঙ্গে যাবার অবকাশ নেই। অথবা বলা যায়, চলমান গদ্যের অভিমুখ রচনার সুবিধার্থে ওই দুই পথে শক্ত ব্যারিকেড দিয়ে সোজাপথে চলার নীতি গ্রহণ করা হল।

হ্যাঁ, আশির দশকের প্রথম দিকে আমাদের প্রস্ফুটনকালে শামসুর রাহমান-এর প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪) ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪) প্রভৃতি আর আল মাহমুদ-এর লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৭৩) কিংবা মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬) ইত্যাদি কাব্য পাঠ করছি আর ব্যক্তিগত নহলি কাব্য-এষণার সঙ্গে ওসবের নৈকট্যে, চেতনার চাঞ্চল্যে, প্রেমে ও দ্রোহে দুলছি—সে কথা মোটেও ভুলে যাবার মতো নয়। পাশাপাশি ঢাকায় দলা হয়ে থাকা প্রবীণ আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুবী রহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, সুরাইয়া খানম, দাউদ হায়দার, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, তসলিমা নাসরিন, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ; ত্রিশের কলকাতা শহরের ‘আধুনিকতা’অভিসন্দর্ভের বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী; চল্লিশের বাংলা প্রগতি কবিতা আন্দোলনের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ অমিতাভ দাশগুপ্ত, হাংরি’র মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবী রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, কবিতা সিংহ, শঙ্খ ঘোষ, বিশ্বজিৎ পাণ্ডের কবিতা এবং বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকের ঢাকার তরুণকবিদের কবিতাও একযোগে গিলছি ক্ষুধার্ত মাতালের ডালে মোড়া পোড়ামাংসের ভাতের লোলুপ লোকমার মতো, সেও বেশ মনে পড়ে। সেই পাঠে আরও অন্তর্ভূত ছিলেন ঢাকার বাইরের অর্থাৎ স্বদেশেরই বিভিন্ন জনপদে অবস্থান বা বসবাসরত কবি আবুবকর সিদ্দিক, জুলফিকার মতিন, ওমর আলী, অনীক মাহমুদ, ময়ুখ চৌধুরীসহ আরও অনেকেই।

আল মাহমুদ-এর জাতিস্মরবোধে জারিত ও আলোকিত সোনালি কাবিন-এর সনেটগুচ্ছের সুঘ্রাণ মাঝেমধ্যে খুঁজে ফিরেছি তাঁর পরবর্তীকালের কাব্যসম্ভারের অরণ্যে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতার পরিপ্রেক্ষায় বদল এসেছিল, তা বেশ বোঝা গেলেও সেই অন্যরকমের ভেতরেও কাঙ্ক্ষিত দুলুনি, দাপট ও ধাবমানতা বা স্নিগ্ধ একাকিত্বটুকু কেন যে পেলেন না আর তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকেরা, সেও এক মনস্তাপ বটে। সামগ্রিকভাবে বা প্রত্যাশিত পর্যায়ে তা পাওয়া হলো না বলেই এ কথা বলা হচ্ছে। আশির দশকের উপান্তে বিশিষ্ট মৌলমানবতন্ত্রী দার্শনিক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত কলকাতার ‘জিজ্ঞাসা’ ত্রৈমাসিকের একটি সংখ্যায় মুদ্রিত আল মাহমুদ-এর একগুচ্ছ কবিতায় তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিকভাবে প্রপীড়িত মানবাত্মার অন্তর্গত ক্রন্দনকে যে-শব্দমালায় গেঁথেছিলেন, সেই ধমনি কাঁপানো শব্দদ্রোণ নেতিয়ে পড়তে দেখা গেল তাঁর অন্তিমপর্বের কাব্যিকতায়। ধর্মের অনুষঙ্গে বাঙালি মুসলমান মানসের যে-সহজিয়া সংরাগ তিনি ‘কবিতা এমন’, ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ প্রভৃতি কবিতায় অনন্যসাধারণ মুনশিয়ানায় ধারণ-উন্মোচন করেন, তা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। ভূমিজ বাস্তবতা থেকে এ স্বীকার করতেই হয়। তবে এও উল্লেখনীয় ঘটনা যে, লোক লোকান্তর থেকে সোনালি কাবিন পর্যন্ত আল মাহমুদ-এর উত্থান ও বিকাশে কাজ করেছিল মার্কসবাদ বা সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি তাঁর ঝোঁক এবং সেই ঝোঁকের অনুপম বয়ানে : ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি’…। সেই সময়ে আল মাহমুদ নিমজ্জিত ছিলেন সাম্যবাদের নানামুখী পঠনপাঠনের ভুবনে আর জনজীবনের সম্পৃক্ততায়।

প্রকৃতি-পরিবেশ ও প্রতিবেশের ধারাবাহিকতার সাবলীলতা অবহেলিত ও বিনষ্ট হয়েছে কর্কশ, জড় মস্তিষ্কের ক্ষমতাদর্পী নগরস্রষ্টাদের একতরফা ও অপরিণামদর্শী দানবীয় ‘পরিকল্পনা’নামক কালো পরাশাস্ত্রের বদৌলতে। আবার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তার দর্শনধারী পশ্চিমা সভ্যতা মানুষের বিকাশের সম্ভাবনাময় বহু প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শীতের অসহায় পরিযায়ী পক্ষিসম মুঠোয় পুরে অবলীলায় জবাই করেছে তাদের ঔদরিক চাহিদা ও উদ্বাহু উল্লাস চরিতার্থে।

সাধারণত নির্মল, উদাত্ত আধ্যাত্মিকতার অপার উদারতা ও প্রলিপ্ত ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের মধ্যে একটা বেশ মৌল পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কবিতায় সেই আধ্যাত্মিকতা আসতে পারে আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে বিরহ-মিলনের ভাবানুভূতিময় কোনো এক অলৌকিকের সান্নিধ্যম্পর্শী অনুরণনরূপে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, নজরুলের ‘শ্যামা সঙ্গীত’ বা ইসলামি গীতিগুচ্ছ। যেমন পারসিক (ইরানি) সুফিধারার কবিবৃন্দ কিংবা সেইন্ট টেরেসা’র কবিতাবলি। এই কবিতা ও গীতিসমূহ কোনো বিশেষ ধর্মের মাহাত্ম্যকে সামনে এনে বা না এনেও এক অতীন্দ্রিয়বোধের স্নিগ্ধতা দিয়ে সংবেদী সত্তাকে অনন্তকাল বেষ্টন করে রাখতে পারে। যেখানে কোনো এক ঈশ্বর বা পরম করুণাময়ের প্রতি আত্মার ঔৎসুক্য বা প্রণিপাতও মোটেই দুর্লক্ষ হয়ে থাকে না। যেমন : ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে …।’ আল মাহমুদ-এর কবিতা তাঁর লুব্ধ লোকগন্ধবহ নন্দন থেকে ধীরে রিক্ত বা বিযুক্ত হলো, আবার সার্বজনীন স্নিগ্ধ ও মেঠো আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে ঘনিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসংলগ্নতায় নিমজ্জিত হলো—যা দর্শনীয়ভাবেই পরিচিত মাহমুদীয় ঘরানায় বেশ ছেদ ঘটিয়েছিল। তাঁর নিজস্বতাখচিত কবিতার দীপ্তি এভাবে ধীরে সরে গেল যেন তাঁর শেষদিককার রচনানিলয় থেকে।

অন্যদিকে শামসুর রাহমানও অন্য আরেকভাবে কবিতবহির্ভূত এলাকায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন সুবিধাবাদী এদেশীয় নাগরিক দায়-দায়িত্বের ‘সিভিল’পাঁকে-পুঁজে বিপুল ও প্রত্যক্ষভাবে। অথচ এই দুই প্রধান কবি থেকে আমরা পেতে পারতাম এই দুর্দৈবের দেশে একজন ভূমিপুত্রের কবিরূপে বেড়ে ওঠার স্বপ্ন-দ্বন্দ্বময়, রাঙা গল্পগাথার গহন মর্মরতা। হয়তো তা ঠিক আত্মজীবনী নয়, শুধু কবিতার মৌন-মৃদুল দেশের সেই এক প্রকার অব্যক্ত অনুপঙ্খই, যা স্বপ্ন আনে, মায়া জাগায় জীবন ও পৃথিবীর প্রতিটি ধুলোকণার প্রতি। দুরন্ত প্রেমময় কৈশোর-যৌবনের ঝকঝকে ও কাঁপা-কাঁপা মনোসংকটের কথকতাও যাতে লেপ্টে থাকে। বিশেষ করে যদি তাঁরা আমাদের শোনাতেন তাঁদের কৈশোর-প্রাকযৌবনের সেই ঔপনিবেশিত পূর্ববাঙলার সান্দ্র, সবুজ জনপদ, জলাঙ্গীঘেরা বসতভূমের অতীব প্রাকৃত মানুষেগুলোর কথা—আমাদের যারা খাস পূর্বগামী, নিপাট সারল্যে মোড়া অথচ শ্রমশীল নরনারী, তাদের যৌথজীবনের পাঁচালি, যার ভেতরে শুয়ে আছে এই ভূভাগের ‘বাঙাল’ মানুষের জীবন ও জীবন-পরবর্তী ধ্যানধারণার যৌক্তিক-অযৌক্তিক কান্না-হাসি, বিহ্বল যত কথকতা। যদি তাঁরা আমাদের শোনাতেন তাঁদের পূর্ববর্তী কবি ও তাঁদের কবিতার সফেন ঢেউয়ে-ঢেউয়ে একাকার হয়ে আবার স্বকীয়তায় প্রত্যাবর্তন করে নতুন কবিতার বসতনির্মাণের স্মৃতি ও প্রণোদনার যত সব ক্রোয়েৎজার সোনাতা ! সেই সঙ্গে আমরা তো তাঁদের কাছে পেতে পারতাম নতুন রঙ্গরসের ঝলমলে পাখায় উড্ডীন নতুনকালের বাংলাদেশের কবিদের প্রতি তাঁদের মনোযোগ বা তাঁদের ছাড়িয়ে যাবার উৎকণ্ঠাভরা যত সব সরস সমাচার! তার বদলে তাঁরা কাটিয়ে গেলেন সমকালের ততধিক জনবিচ্ছিন্ন কতিপয় ভুল রাজনীতিক ধর্মধ্বজী ব্যবহারজীবী সাহিত্যের কারবারি বাচাল অধ্যাপক আর তকমা-আঁটা বুদ্ধিজীবীদের বল্গাহারা ‘বাকবিভূতি’র নীরব-সহাস্য শ্রোতা, মুগ্ধ প্রশংসাকারী ও পৃষ্ঠপোষক হয়ে। অথচ তাঁদের জীবদ্দশাতেই আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায়, এমনকি পাশের বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও দূরের ইউরোপের দেশগুলোতে অভ্যস্ততার একরৈখিক মূল্যবোধঘেঁষা জীবনাচার ও চলন-বলনের প্রতি তাকানোর সনাতনী ভঙ্গিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। ওসব দেশের সাহিত্যব্রতীদের কেউই আর শুধুমাত্র খল বাস্তবতার একরৈখিক ক্ষমতা-অন্বেষী রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরের রাংতায় জাতীয় গৌরব আর প্রত্ন-স্মৃতিকোষের যশোগাথার নামে আর পিছলে যেতে রাজি হলেন না। তাই বলে ওটাকে ঠিক কেজো ভাষায় জাতীয়তাবাদী জাগরণের নয়া প্রেক্ষাপটও বলা যায়নি তখনও। বরং এটি এমন এক নস্টালজিয়া, প্রণোদনা ও অধ্যয়নকে সামনে আনে, যেখানে মানবিক চেতনার জগতে শীলিত ও শাণিত মানুষেরা শতাব্দীর শেষপাদে এসে আত্মমূল্যায়নে জারিত হতে চাইলেন বিপুলভাবে। কল্যাণের জন্যে উদ্ভাবিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা মানুষকে যেভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্যের কাছে নিরঙ্কুশ একাকিত্বের হাহাকারে নিমজ্জিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিল, এটি ছিল তা থেকে উদ্ধারিত হয়ে নতুনবোধে, নতুনকালের যৌথজীবনে প্রাণের শান্তি ও আরাম অন্বেষায় বেরিয়ে পড়বার দূরযাত্রার অভিযান।

দুই
ওই প্রোথিত চেতনার বিন্যাসে তরুণতরদের রচনা বেয়ে বাংলা কবিতার ভেতরেও বাঙালি জাতির ইতিহাস, ইতিহাসের শিক্ষা ও ব্যঞ্জনা, সাংগ্রামিক জীবনের চিরায়তবোধ ও বেদনা, আদিবাসী ও নিম্নবর্গীয় আচার-আচরণের ভূমিজ প্রতিন্যাস জাতীয় সংস্কৃতির আদল নিয়ে কলকলিয়ে উঠতে চাইছিল বলে টলে পড়ার ভীতি থেকে পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের পরিত্যক্ত সকল সহবতে সর্বথা আমুণ্ডু অবনত তথা আধুনিকতার ছাঁচে গড়া এখানকার শিক্ষাভিমানীরা বিচলিত হচ্ছিলেন তলে-তলে। ধরে নিলাম, এই বিচলনও অস্বাভাবিক নয় কায়েমি শেকড় ধরে রাখার স্বার্থবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে! কেননা জীবনবোধের রকমফের, মূল্যবোধ ও তজ্জাত চাওয়া-পাওয়া সব সময়, সকল অবস্থায় একভাবে, একই মানদণ্ডে হয়তো দাঁড়িয়ে থাকে না। সেখানে জানা-বোঝা, স্বার্থচিন্তা ও নীতিনৈতিকতার দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথ থাকে, থাকতেই পারে। সে মানবিক হোক, কিবা অমানবিক। আবার তা থাকে বলেই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত থেকে জগৎ ব্যাখ্যা করবার নতুন রকমের জীবন-অন্বেষী কাব্য ও কথনশৈলী, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার রসায়ন স্থবির বা অকার্যকর হয়ে যায় না মোটেই। বরং নতুন পৃথিবীর চেতনার দিক থেকে ওই জীবনাচার নান্দনিক সৌকর্যময় ও মহিমামণ্ডিত হতে পারে আরও, হতেই তো পারে, সেটি ভ্রুকুটির অধীনে অবহেলিত হবার বা এড়িয়ে যাবার মতো বিষয় নয় বলেই! তবে সেটি প্রচলিত গাড্ডামারা নন্দনতত্ত্বের সালিশি বিচার নয়। সে এক অতীব মনোরম, গভীরতর ও উচ্চায়তন, একেবারে নিজের শেকড়ের ভেতরেই তা হতে পারে।

সালিশি বিচার বলতে পরের চোখে, পরের মেধা ও মননে ব্যাপটাইজড হয়ে নিজের আঙিনাকে, পূর্বগামী পিতৃপুরুষের গেরস্তালিকে, তাদের মৃত্তিকালগ্ন জীবনধারাকে নির্বিকার উদাসীনতায় এক প্রকার হেলা করবার ব্যাপারটাকে বুঝতে চাইছি। ভূমিজ মানুষের বহুকালের আচরিত জীবনধারা, সেই জীবনের জিজ্ঞাসা ও অনুরাগ, তাদের যাপিত প্রকৃতি ও তার স্বভাবের অবিকলরূপ নিশ্চয়ই আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই বলে সেই নব্যভাব ও ভঙ্গিতে জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা সেই প্রয়োজনীয়তা রক্ষার নয়া উদ্ভাবনী লড়াই তো ফুরিয়ে যায় না কখনোই, কোনোকালেই, কোনোভাবেই। বরং মানুষের অন্তরধৌত, সত্যসন্ধ উপলব্ধি ও আকাঙ্ক্ষা যেন সেদিকেই তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় বারংবার নবীন বেগে, নতুনতর সাহসে, নতুন জীবন-উল্লাসে। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই প্রবুদ্ধ উচ্চারণকে স্মরণ করিয়ে দেয় :

কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে
ছুটেছে মন মাটির পানে॥
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে
ভাবনা ভাসে পুব বাতাসে
মল্লার গান প্লাবন জাগায়
মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে॥

লাগল যে দোল বনের মাঝে
অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।
যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে
আকুল হল অঙ্কুরেতে
আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়
সেই বাণী মোর সুরে আনে॥

আজকের এই নগরশাসিত ও নগরপোষিত মানবকুল একটুখানি খোলা দিগন্তরেখা, সবুজ-শ্যামল প্রশান্তি ও প্রশস্তি পাবার জন্যে, আরণ্যজীবন ও আরণ্য মানুষের প্রকৃতিময় সান্দ্র সংস্কৃতির সান্নিধ্য যাবার জন্যে তৃষ্ণার্ত ও তিতিক্ষাপ্রবণ হয়ে উঠছে দিন-দিন। এককালে এই মানবকুলের পূর্বগামীরাও তো ছিল প্রকৃতির কোলে লালিত-পালিত। খেত-খামারে, কলকারখানায় প্রয়োজনীয় শ্রমদান শেষে মন্থর আশ্লেষের পালায়-পার্বণে গীতিকায় নাটমঞ্চে, সেই এক ‘সোহম্’ ভাবনায় বিশ্ববিধাতার পরিকীর্তনে তারা ছিলেন মশগুল। প্রকৃত প্রস্তাবে সেই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারার ভেতর দিয়েই এই ভূমিজ সভ্যতার আদিরূপটি গঠিত, প্রস্ফুটিত ও সম্প্রসারিত হয়েছিল। তাই পরিবেশচিন্তা ও প্রতিবেশরক্ষায় তার জোর গলার আওয়াজ ও আবদার এই যে, ওটার চিরকালীন ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য অবশ্যই সংরক্ষিত হোক যথাযথ প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, রাষ্ট্রিক উদ্যোগ ও সামাজিক চুক্তির আয়োজনে, নবায়নে। তাতেই ভাবনা ও কল্পনা নিবদ্ধ হলে সেই পথের জাজিমে নব নটনটীর হাস্য ও সংগীতের মুদ্রাও মিলবে।

লোকায়ত গ্রামীণতা, অরণ্য ও আরণ্যজনতার জীবনধারার নিবিড় মমতা-মিষ্টতা বিনষ্ট হচ্ছে বলেই আমাদের জীবনের ওপর অজানা অগুন্তি প্রাকৃতিক বালা-মুসিবত বা সমস্যার পাহাড় তেড়ে আসছে আগ্রাসী একচক্ষু দানবের মতো। জলবায়ু বিপর্যয় বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ইত্যাদি দানবীয়তার পরিণাম বন্যা-খরা, অযাচিত দাবদাহ, ভূমিকম্পসহ নানারকম অসুখ-বিসুখ, ভাইরাস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হয়ে ঝেঁপে আসছে প্রকৃতি ও প্রাকৃত মানুষের নির্যাসকে অবহেলার খেসারত হিশেবেই তো! দেখা যাচ্ছে, ‘সুনামি’নামধারণ করে সমুদ্র লাফিয়ে জনপদ গ্রাস করছে নিমিষেই। তা-বড় তা-বড় হিমশৈল গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াতে-বাড়াতে ঘরহারা-শস্যসম্পদহারা হচ্ছে অজস্র-সহস্র নিরীহ মানবসন্তান, বৈনাশিক দাবানলে ছিত্তিছান হয়ে যাচ্ছে বনের পরতের পর পরত। এসবের অলক্ষুণে ও নেতিবাচক প্রভাবে গৃহবাসী, শরণার্থী ও অভিবাসী মানুষের শারীরিক-মানসিক বৈকল্যে তার স্বভাবগত আচরণকলায় বিকৃতি ও বিবমিষা পরিলক্ষিত হচ্ছে দেদার। ধর্ষণ-হনন, ‘অ্যাবসারডিটি’বা অস্বাভাবিকতা, আত্মলুপ্তির ব্যামো বেড়ে যাচ্ছে জ্যামিতিকহারে। এই প্রকৃতি-পরিবেশ ও প্রতিবেশের ধারাবাহিকতার সাবলীলতা অবহেলিত ও বিনষ্ট হয়েছে কর্কশ, জড় মস্তিষ্কের ক্ষমতাদর্পী নগরস্রষ্টাদের একতরফা ও অপরিণামদর্শী দানবীয় ‘পরিকল্পনা’নামক কালো পরাশাস্ত্রের বদৌলতে। আবার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তার দর্শনধারী পশ্চিমা সভ্যতা মানুষের বিকাশের সম্ভাবনাময় বহু প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে শীতের অসহায় পরিযায়ী পক্ষিসম মুঠোয় পুরে অবলীলায় জবাই করেছে তাদের ঔদরিক চাহিদা ও উদ্বাহু উল্লাস চরিতার্থে। তারা বিশ্বময় লোকসভ্যতার সোনার সন্তানদের সেবাদাস-বেতনদাস ও তাদের প্রিয়ভূমিকে উপনিবেশ বানিয়ে অত্যাচার আর বলাৎকার, খুন আর তাদের অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়েছে। কাজেই পশ্চিম থেকে আগত সকল ‘উচ্চবর্গীয়’ও বায়ুমার্গীয় সুবচনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে কান পাততেই হবে, তার জজবাসমূহে নতজানু হতেই হবে—এমন কোনো ধ্রুপদি কিবা বাস্তবিক কারণ আর অবশিষ্ট নেই এই নয়া সভ্যতার প্রস্তুয়মান পাণ্ডুলিপিতে।

মানুষের ইতিহাস কারো বেঁধে ধরা নিয়মের ফাঁদে কিছুকাল আটকে থাকলেও, চিরকাল থাকে না। সময়ের ধারাপাতে মানুষের ভেতর থেকে প্রকৃত প্রবল মানববুদ্ধির উত্থান ঘটেই। তাদের ডাকে ঘুম ভাঙে আপাত অভিভূত আমজনতার, আত্মলোকের প্রকৃত স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বজ্রধ্বনি শোনা যায় দিকে-দিকে।

এই উপলব্ধির প্রগাঢ় উদ্ভাসনে উপনিবেশ-উত্তর স্বাধীন দেশগুলো তাদের শেকড়ের মৌল অনুভূতি, ঐতিহ্যের গরিমা, ধর্মজীবনের উদাত্ত কিবা কুণ্ডলিত সৌন্দর্য, জাতিস্মরতার তাবৎ অহংকার নিয়ে নিজেদের মতো করেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাচ্ছে। ভারতরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে বলা হলেও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী রমিলা থাপার-এর একটি উচ্চারণ এখানে আমাদের চিন্তার সঙ্গে কিঞ্চিত সাযুজ্যপূর্ণ, তিনি বলছেন : ‘কেউ যদি জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলে, তাহলে এর মধ্যে অবশ্যই তাবৎ সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তাই ভারতবর্ষীয় পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নানারকম সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে এবং আদিবাসী, দলিত, মধ্যবিত্তশ্রেণি, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি ও অন্যান্য, যাদেরকে জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক পর্যায়ের পূর্ব পর্যন্ত যথাযথ সামাজিক মর্যাদা দেওয়া হয়নি তাদেরকে সামাজিক মর্যাদা দিতে হবে। তাছাড়া একটা জাতীয় সংস্কৃতিগঠনের ক্ষেত্রে একাধিকত্বকে (Multiplicity) ও বহুত্বকে (Pluracity) স্বীকার করতে হবে। এবং সেখানে একটি বিভাজিত ইতিহাস থাকতে হবে।’

নব্যকালের অনুধ্যানে উল্লিখিত চেতনার ইতিবাচকতা প্রশ্নাতীত বলেই দেশে-দেশে এখন রাজনৈতিক ধর্মসাম্প্রদায়িকতার প্রগাঢ় কুয়োদর্শন, সীমান্ত বিরোধ, জাতিবৈর, স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসন-ত্রাসন অথবা গণতান্ত্রিক সাংবিধানিকতার আবরণে এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর বিস্তার ঘটাতে নানাভাবেই তৎপরতা চালাচ্ছে একদা ঔপনিবেশিক প্রভুরাষ্ট্রসমূহের চতুর কৌঁসুলী, কূটনীতিক আর তাদের সেবাদাসেরা। তারা ভণ্ড তপস্বীর মতো ক্রন্দনরোল তুলে মানবতা হেফাজতের নানা তথ্য ও তত্ত্বকথা বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরছে হরহামেশা নানা কিসিমের বিধি-নিষেধের ঘেরাবেড়াসহ। অন্যদিকে তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতাধর্মী সাহায্য-সহায়তা ও তথাকথিত মানবিক আচার-আচরণের আড়ালে পৃথিবীর উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোতে স্বৈরমনস্ক শাসকেরা দমন-পীড়নের সঙ্গে সেসব ভূখণ্ডের দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীকে দলিত-পীড়িত ও স্বদেশেই নির্বাসিত করে রাখতে নতুন-নতুন উপায় ও পথ খুঁজে বের করে তা প্রয়োগ করে চলেছে বেশুমার মাত্রায়। এভাবেই দেখা যাচ্ছে, যেসব জাতি ও জাতিসত্তা নিজেদের দিকে পরিপূর্ণরূপে চোখ মেলে তাকাবার তাগদ অর্জনে সমর্থ হয়েছে এবং নিজেদের জাতীয় মেধা ও সম্পদ, মৌরুসি শিক্ষা ও সংস্কৃতির শিরদাঁড়ার ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চায়, পশ্চিমী সভ্যেরা তাদের এই বলিষ্ঠ উত্থানকে ভালো চোখে দেখছে না মোটেই। তাহলে যে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে আরও অনেক জাতি ও জাতিসত্তার নাম গৌরবভরে ওঠে আসে পৃথিবীর নয়াকালের ইতিহাসের বালাম খাতায়! যে-পৃথিবী অনাবশ্যকভাবে কতিপয় ধনিক-বণিক, বৃহৎ রাষ্ট্র ও তাদের করপোরেট স্তাবকদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের একধরনের বারামখানা হয়ে আছে। যেসব ধনিক ও বৃহৎ রাষ্ট্র চাইলেই একত্র হয়ে একটি উদীয়মান লিবিয়া, ইরাক, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, ইরান, প্যালেস্টাইন, একটি ইউক্রেন, উদীয়মান লাতিন আমেরিকাকে ছল-কৌশল ও মানবতাবিধ্বংসী সমরশক্তির ঔদ্ধত্যে দাবিয়ে কিংবা ভূমিস্যাৎ করতে কসুর করে না। এ শক্তিমত্ততা ও দানবীয় জোটবদ্ধতা প্রদর্শনের পেছনের সমৃদ্ধি ওরা লুণ্ঠন করেছিল আজকের উপনিবেশমুক্ত ভূখণ্ডগুলোর ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী অপশাসন ও ব্যাপক শোষণ-ত্রাসন তথা ঔপনিবেশিক বর্বরতা জারি রেখে। এই প্রক্রিয়াকে আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও এটিই পৃথিবীর ইতিহাসের সত্যঘটনা বা ‘প্যারাডক্স’। তাই এর আরও গভীরে পৌঁছুনো দরকার।

একদিকে ছোট ও দরিদ্র দেশগুলো, ইতিহাসের সরণিতে একদা যারা তথাকথিত পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির নাগপাশ ব্যতিরেকেই সেক্যুলার ও লোকায়ত সমৃদ্ধ-সংস্কৃতি এবং গরীয়ান কৃষিজ আর্থব্যবস্থার জন্ম দিয়ে নিজেদের ইহ ও ভাবজাগতিক চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল সভ্যতার শিরোনামে, দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক পীড়নের যাঁতাকলে সেই দেশগুলোই ধীরে-ধীরে গৌরব ও শ্রী হারিয়ে হতদরিদ্র বেশ ধারণে বাধ্য হয়েছে। আর বলদর্পী ঔপনিবেশিকেরা বিদায়কালে তাদের শিক্ষা ও জীবনাচার, রুচি-সংস্কৃতি ও সহবত, আইনকানুনের আদলে গড়ে তোলা একটি ‘দেশীয়’কুলাঙ্গার অভিজাত শ্রেণির হাতে ক্ষমতাভার অর্পণ করে গেছে। যাদের কাজ ছিল ওই উপনিবেশিকতার পরবর্তী দায় ও জের বিশ্বস্ততার সঙ্গে বয়ে চলা ও আরোপণ অব্যাহত রাখা। এই আরোপণও কোথাও-কোথাও শত-শত বছরের ব্যাপ্তি ধারণ করেছিল। এই নব্যক্ষমতাবানেরা তাদের বিদেশি পূর্বগামীদের ধারা অনুসরণ-অনুকরণে দেশজ সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির ওপর অকার্যকর, পশ্চাৎপদ তকমা এঁটে দমিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করেছে নানাভাবে এবং সেই সংস্থানকে তছনছ করেছে উন্মত্ত কাপালিকের মতো। কিন্তু মানুষের ইতিহাস কারো বেঁধে ধরা নিয়মের ফাঁদে কিছুকাল আটকে থাকলেও, চিরকাল থাকে না। সময়ের ধারাপাতে মানুষের ভেতর থেকে প্রকৃত প্রবল মানববুদ্ধির উত্থান ঘটেই। তাদের ডাকে ঘুম ভাঙে আপাত অভিভূত আমজনতার, আত্মলোকের প্রকৃত স্বাধিকার ও স্বাধীনতার বজ্রধ্বনি শোনা যায় দিকে-দিকে। এভাবেই কালের পরিক্রমায় ওই দেশগুলোতেই মাটি ফুঁড়ে জন্ম নেয় ঋদ্ধ ভূমিজচেতনা।

পরিতাপের বিষয় হলেও এটা সত্য যে, ওই চেতনা ও জাগরণের পরিণতি রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে অর্জিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার কলকোলাহলে নয়াপদ্ধতিতে পূর্বোক্ত উপনিবেশবাদী শিল্পায়িত বড় পণ্য উৎপাদনে সক্ষম দেশগুলোর পণ্যবাহিত হয়ে, গণমাধ্যমবাহিত হয়ে নয়াধরনের অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিও আমদানি হতে দেখা যায় এবং তা হাস্যমুখেই গ্রহণ করে সেই স্বাধীন দেশগুলোরই ক্ষমতালোভী, আত্মবিস্মৃত, নগ্ন ও বশংবদ শাসক সম্প্রদায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের এই দূরবর্তী বা অদৃশ্য কর্তৃত্বকেই পণ্ডিতেরা ‘নব্য উপনিবেশবাদ’বলছেন। সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণবাদ আধিপত্যবাদ বিশ্বায়ন—এ সবই হলো স্বর্ণাভ নির্মোকধারী ওই ভূজঙ্গম বই নয়। আমরাও এই নতুন নির্মোকধারী রাজনৈতিকভাবে ‘স্বাধীন জাতি’ই বটে! এখানে একদিকে অবারিত রয়েছে তথাকথিত মুক্তবাজার নীতি বা বিশ্বায়নকালের অরক্ষিত দেশজ সম্পদরাশি—এ যেমন মেধাবী ও শ্রমশীল জনশক্তি, অন্যদিকে তা বস্তুগত ও অপার সম্ভাবনার প্রাকৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদও। বিভিন্ন এজেন্সি ও গোষ্ঠীবিশেষের মধ্যস্থতায় পরসম্পদ লিপ্সু রাষ্ট্রগুলোতে এই দেশজ সম্পদ স্থানান্তরিত হচ্ছে বৈধ-অবৈধভাবে পরবশ রাষ্ট্রনীতিরই সিলমোহরে। অন্যদিকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ স্পৃহাকে জাগিয়ে রেখে বিভিন্ন অর্থসংস্থা ও সংগঠনের মাধ্যমে অঢেল খয়রাতি-সহায়তা প্রকল্পও চালু আছে দেশে-দেশে, এখানেও। আবার সেই অর্থ মোটেই শর্তহীন বা সুদমুক্ত নয়। অর্থাৎ একভাবে অর্থের আগাম সাহায্য আসছে বটে কিন্তু আরেকভাবে তারও বেশি প্রাকৃতিক ও মানসক্ষমতা সম্পদ সেই সব উন্নয়নপ্রয়াসী দেশগুলো থেকে ‘দাতা’দেশ ও করপোরেট সংস্থাগুলোর জেবে অবাধে পুঞ্জিভূত হচ্ছে আর ফিরে আসছে নতুন পেকেটে, নতুন সিলমোহরে। যেখানে উৎসের কোনো দায়স্বীকার আর অবশিষ্ট থাকে না। বিভিন্ন অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে যেসব বড় বড় প্রকল্প আপাতদৃষ্টিতে গড়ে উঠছে বা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে—তারও বেলায় একই পর্যবেক্ষণ প্রযোজ্য বইকি।

বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন (২০২১) করা এই জাতির নেতৃস্থানীয় কি রাজনীতিবিদ কি সিভিল সমাজের প্রবণতার ভেতর এখনও ভূমিকেন্দ্রিক আর্থ-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সংকট প্রকটতর। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এদেশের শাসকদের তুষ্টিদায়ী কাজই হলো বিদেশি সামগ্রীর সহজতর আমদানি বাড়ানো, এখানে তার ততধিক সহজ বাজারজাতকরণের পথ সৃষ্টি করা, চোখধাঁধানো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন আর নগদ অর্থপ্রাপ্তির হাতছানিভরা শেয়ার মার্কেটের ভেতর দেউলিয়া মানুষের কাফেলা দীর্ঘতর করা। অন্যদিকে নানা দোদুল্যমানতার কাসুন্দিভরা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের (রেমিটেন্স) প্রবাহে দেশের অর্থনীতির শরীর কিছুটা তাজা ও স্বস্তিদায়ী হচ্ছে বলে জানানো হলেও যথাযথ বিন্যাস বা দিনানুদিনের বাজার ব্যবস্থায় তার সুফলদায়ী প্রভাব পরিদৃষ্ট নয়। লাগাম বা দামশাসনহীন মূল্যস্ফীতি তারই একটি নমুনা। একই তালে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের কাঙ্ক্ষিত সেবাদান ও সদাচরণের ঘাটতি নিয়েও প্রায়শ প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কলকারখানার উদ্যোক্তা ও মালিক হয়ে উঠতে চাইছে যারা, তাদের বেশির ভাগই বিনিয়োগকারী দেশ ও এদেশের লুটেরা ধনিকবণিক-লুটেরা শ্রেণির সমন্বিত প্রতিনিধি বই নয়। বিভিন্ন ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ও ‘রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা’নামে এ প্রক্রিয়া চলছে। এই অবস্থা নতুন ধরনের উপনিবেশিকতাকে নিঃসন্দেহে দ্যোতিত করে।

বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভেতর থেকে নতুন কথা-কবিতার সম্ভাবনার বীজ অনুসন্ধানই আমাদের মূল লক্ষ। কবিতা যেহেতু ‘একোমাবো দ্বিতীয়ম’রূপে কেবল ‘মায়াবনবিহারিনী হরিণী’র সন্ধানেই ব্যাপৃত থাকে না, জীবনের ঘামগন্ধের ভেতরেও তার সাবলীল বসবাস রয়েছে, তাই এই পরিভ্রমণ কাঙ্ক্ষিত বটে। এই প্রসঙ্গেই স্বাধীনতাপূর্বকালে আবির্ভূত হয়েও উত্তরকালে সর্বাধিক উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে বিকশিত কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদকে কেন্দ্রে রেখে পুরো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে কিঞ্চিত অবলোকন উত্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে এখানে

আমাদের বিশ্লেষণের মর্মে উপনিবেশিকতা বিষয়ে একটি দেশ বা ভূখণ্ডের শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক প্রত্যয় নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই হয় না, বরং সেই সূত্রের আলোকে তার প্রত্নীয় আর্থসামাজিক কৌলিন্যের বাস্তবতাও বিশ্লেষিত হওয়া দরকার যথেষ্ট মনস্বিতা সহকারে। কারণ সংস্কৃতির মনোজাগতিক অবস্থান একটি সমাজের মূল আর্থব্যবস্থার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত থাকলেও তার প্রভাব বিস্তারের ফল প্রত্যক্ষত তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নাও হতে পারে। কেননা বেনো অর্থের বিকট জোয়ারে ভেসে যেতে পারে, ভেসে যেতে থাকে প্রকৃত প্রত্ন-ইতিহাসকথা, সাংস্কৃতিক সুকৃতিসমূহ, মূল্যবোধ, লোকায়ত সংহত জীবনের নন্দিত ন্যায়নীতি, সামাজিক বন্ধন, প্রীতি ও প্রতীতিগুলো। কাজেই গুরুত্বের খাতিরে উদ্ভাবিত দেশজ সুষম রাষ্ট্রনীতি, তার প্রখর ও বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবায়নের জন্যে আইনকানুন ও বিধিবিধানসমূহ একটি দেশ ও জাতির দূরপ্রসারী মঙ্গল-অমঙ্গলে কী ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া রাখতে পারে, তা জরুরি ও মনোযোগ আকর্ষী বিষয় বটে।

তিন
এই গদ্যের শুরুতে আমরা কবি ও কবিতার অনিবার্য পালাবদলের কথা বলতে-বলতে প্রাসঙ্গিকভাবে অনেকটা পথ পরিভ্রমণ করে এলাম। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভেতর থেকে নতুন কথা-কবিতার সম্ভাবনার বীজ অনুসন্ধানই আমাদের মূল লক্ষ। কবিতা যেহেতু ‘একোমাবো দ্বিতীয়ম’রূপে কেবল ‘মায়াবনবিহারিনী হরিণী’র সন্ধানেই ব্যাপৃত থাকে না, জীবনের ঘামগন্ধের ভেতরেও তার সাবলীল বসবাস রয়েছে, তাই এই পরিভ্রমণ কাঙ্ক্ষিত বটে। এই প্রসঙ্গেই স্বাধীনতাপূর্বকালে আবির্ভূত হয়েও উত্তরকালে সর্বাধিক উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে বিকশিত কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদকে কেন্দ্রে রেখে পুরো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে কিঞ্চিত অবলোকন উত্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।

একজন বড় কবি একটি জনপদের জীবনঘেঁষা আটপৌরে ভাষাকে তার কবিতায় অসামান্যভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে সেই ভাষা ও জাতিকে যে-বিস্তার ও গভীরতা দান করেন, তা আমাদের চেতনা ও প্রত্ন আবেগকে নিশ্চয়ই নাড়াতে সক্ষম। মেধার এ বয়ন, অপূর্ব অনুভূতিময় নন্দনবোধের এই বিস্তারের সক্ষমতার কারণে তিনি আলোকদীপ্ত হয়ে ওঠেন জনপদের সন্তানদের মনোদেশে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় হলেও এও সুকঠিন বাস্তবতা যে, সেই কবিরও জীবনের পরতে-পরতে দুঃখসুখের নানাবিধ আখ্যান থাকে, থাকে তা জড়াজড়ি করেই একেবারে অন্য সাধারণজনের মতোই। তারও ‘যৌবন যায়, যৌবনজ্বালা যে যায় না’—প্রৌঢ়ত্ব আসে, একদিন বার্ধক্যের জরা নামক জোব্বা তাকেও ঘিরে ফেলে বিনাশী পঙ্গপালের মতো। প্রিয়-অপ্রিয়, পছন্দ-অপছন্দের ঘেরাবেড়া পেরিয়ে তিনিও একদিন দ্বিতীয় শৈশবে পদার্পণ করেন স্মৃতি-বিস্মৃতির অনিবার্য স্খলিত, অব্যবস্থিত অধ্যায় নিয়ে। বিগত সোনালি দিনগুলোতে তার সৃজনশীলসত্তা যে-সম্ভার সাজিয়ে এসেছে প্রবল আত্মজাগরণ ও আত্মদহনের হোমানলে, বার্ধক্যের কবি তাতেই বিচরণ করেন আনমনে স্মৃতি-বিস্মৃতির হেলায়ফেলায়, অনেক বিভূতিই হারিয়ে ফেলেন কালজ মৌহূর্তিক ছোবলের ঘায়ে। তাই কবি বা শিল্পীর শেষবিদায়ের সময়গুলো নানা সামাজিক-পারিবারিক ও ধর্মীয় সমঝোতামণ্ডিত বা বিরোধাত্মক, প্রপঞ্চময় হয়ে উঠলেও আমাদের দেশজরীতির ধারায় তা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয় না সাধারণত ক্ষমার কৌলিন্যে। কেননা তা ভূমিজ পরম্পরার রীতিবিরুদ্ধতাও বটে। এ যেন এ মাটি ও মানুষের জীবনধারায় প্রত্ন উত্তরাধিকারের এক অমোঘ, বিহ্বল প্রত্যাবর্তন—যা চক্রাকারে আবর্তিত হয়েই চলেছে কালে-কালে। কিন্তু মনে রাখতে হয় যে, এও তো এ ভূমিরই এক অলংঘনীয় ভূমাদর্শন!

কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদকেও সেই দৃষ্টিকোণে বিচার করে তাঁদের ‘জেগে আছি’সময়ের সৃষ্টিসম্ভারের দিকেই তবু আমাদের নজর ফেরাতে হয় এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় দীক্ষা শেষে নিজেদের নবউদ্ভাবিত সৃজনপথে বলিষ্ঠ পা বাড়াতে হবে নতুন জীবন ও নতুন কথা-কবিতার মারুলিতে। নজরুল-এর ভাষায় এ যেন সেই পরাবর্তনের আবর্তন : ‘ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবৈশাখীর ঝড় …

লেখাটি শেয়ার করুন :

হাফিজ রশিদ খান

হাফিজ রশিদ খান। জ. ২৩ জুন ১৯৬১, চট্টগ্রাম। বিগত শতকের ১৯৮২ সালে 'জোছনা কেমন ফুটেছে 'কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ। ১৯৯৭ সালে 'আদিবাসী কাব্য' প্রকাশের মাধ্যমে এ কবির আদিবাসীকেন্দ্রিক কাব্যযাত্রার শুরু। এ কাব্য তাঁকে এদেশে 'আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকার'রূপে পরিচিতি দেয়। তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর 'কবিতার রূপান্তর' (২০০৩ কলকাতা) গ্রন্থে হাফিজ রশিদ খান-এর আদিবাসীপর্বের কবিতাগুলো সম্পর্কে বলেন : 'বাঙালি সমাজের যে-সমস্ত নিকটতম প্রতিবেশীরা বাঙালির কবিতায় ও সাহিত্যে চিরকালই রয়ে যায় প্রত্যাখ্যাত অপর, তাদেরই অন্যতম বিশিষ্ট ধারাকে কবি তাঁর প্রতিবেদনের উপজীব্য করে তুলেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জীবনধারার বৈচিত্র্যপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অনুপুঙ্খগুলি হাফিজ ব্যবহারই করেননি কেবল, তাঁর বয়ানের টানাপোড়েনে অন্তর্বৃতও করে তুলেছেন। স্বভাবতই কবিতার ভাষায় দেখা গেছে সংশ্লেষণের আশ্চর্য সজীব নিদর্শন'। তাঁর এ পর্যন্ত ১৮টি কাব্য ও ১২টি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। হাফিজ রশিদ খান চট্টগ্রামের একটি দৈনিকে কর্মরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!