প্রবন্ধসাহিত্য

কবি অথবা প্রজ্ঞার জাদুকর

কবিতা হল প্রজ্ঞার জাদু। কবি, যে তার সমূহ যন্ত্রণা প্রজ্ঞার মোড়কে পুরে জাদু দেখিয়ে চলেছে একের পর এক। এই সব জাদু দেখে এ পৃথিবী কখনো হেসে ওঠে, কখনো দুঃখ পায়, কখনো বা কেঁদেও ওঠে। আবার কখনো মস্তিষ্কে ভাবনারা ভর করে। এই যে হাসায়-কাঁদায়, কবি কি তাহলে সার্কাসের জোকার? এই যে মস্তিষ্কে ভাবনা জন্ম দেয়, কবি কি তাহলে স্রষ্টা? মূলত জোকার থেকে স্রষ্টা হয়ে ওঠার যে দীর্ঘ এই যাত্রা, দীর্ঘ এই পথপরিক্রমা, এটাই কবিত্ব। তাই কবিতা হল সেই দক্ষ জাদুকরের প্রজ্ঞাযন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ।

কবিতার এই জাদুকরের কাজ শুধুই আপনার অনুভূতিকে মুগ্ধতার কাশবনের মতো নাড়ানোই নয়, শব্দের খেলা দেখিয়ে আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দেওয়াই নয়। বরং ভাবনার দর্শন শৈল্পিক রেখেই কবিতায় পাঠকের সাথে কথা বলতে হয়। এটাই হচ্ছে জাদুকর থেকে স্রষ্টা হয়ে ওঠার পথপরিক্রমা। এই পথ পাড়ি দেওয়ার পরই মূলত একজন মানুষ কবি হয়ে ওঠেন, নতুবা তাকে ভেলকিবাজ জাদুকরই থেকে যেতে হয় আজীবন। এজন্য আমরা দেখি, কেউ কেউ মুগ্ধকর লেখার পরও একজন জাদুকরই থেকে যান, আর কেউ কেউ শেষমেশ কবিতে উত্তীর্ণ হন। মনে রাখা জরুরি, এ খেলায় আপনাকে জাদুর সাথে প্রজ্ঞাটা মেশাতেই হবে। কারণ যে কোনো স্রষ্টা যতটা জাদুকর, তারও অধীক প্রজ্ঞাবান।

কবিতার কলাকৌশল নিয়ে কথার অবতারণা হলে একটা বিষয় খুব বিতর্কের স্থান দখলে নিয়ে নেয়, তা হল—কবিতা কী শেখার বিষয়? ছন্দ কী শেখার বিষয়? আমি বলি, মোটেও না। কবিতা হল সঙ্গমের মতো। প্রত্যেক সঙ্গমেই ছন্দ থাকে। ছন্দহীন কখোনোই সঙ্গম হয় না। ছন্দ মেনেই সঙ্গম হয়। তবে কথা হল ছন্দ শিখে কেউ সঙ্গমে আসে না। সঙ্গম শেখার বিষয় না। শরীর ও মনের শৈল্পিক প্রয়োজনেই তা খেলে যায় বিছানায়। কবিতাও তাই। শরীর ও মনকে কবিতার জন্য বাড়তে দিলে শৈল্পিক প্রয়োজনেই নব নব ছন্দ এসে ধরা দেয় কবিতায়। বৈয়াকরণিকরা যা আবিষ্কার করতে পেরেছেন কিছুটা এবং ভবিষ্যতে আরও আবিষ্কার করবেন হয়তো। সুতরাং ছন্দ মেনেই কবিতা হয়। তবে ছন্দ কাঠামোর ধ্রুবক জ্ঞান, একজন বৈয়াকরণিকের জন্য তেমন ক্ষতি না হলেও একজন কবির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

কবি থাকে এক মানবিক পৃথিবীতে। কবির যে পৃথিবী তা মোটেও কাল্পনিক পৃথিবী নয়, তা মূলত মানবিক পৃথিবী।

সারাটি জীবন ধরে এক পরাবাস্তব সুদূর কবিকে ডাকে। যে ডাক শুধু কবিই শুনতে পায়। পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীতেই বাস করে, এই পৃথিবীতেই সে এক অধ্যাত্ম জীবন যাপন করে যায়। তখন কান বন্ধ করেও শোনা যায়, চোখ বন্ধ করেও দেখা যায়, নাক বন্ধ করে ঘ্রাণ নেওয়া যায়। এটা এক সক্ষমতা। যা একজন কবির থাকে। থাকতে হয়। এ সক্ষমতার এক বেদনাতুর অক্ষমতা আছে। সেটি হল অনন্য হতে যেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া। আলাদা হতে হতে একসময় ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। তবে এই ব্যর্থতাকে আমি কেন সক্ষমতা হিসেবে জাহির করছি। করতে চাচ্ছি। কারণটি হল কবি এই পৃথিবীতে বাস করেও পৃথিবীতে থাকে না। তাহলে কোথায় থাকে কবি? আমি কি তাহলে এখন সকলকে এক অতিলৌকিক গল্প শোনাতে চাচ্ছি? মোটেও না। কবি থাকে এক মানবিক পৃথিবীতে। কবির যে পৃথিবী তা মোটেও কাল্পনিক পৃথিবী নয়, তা মূলত মানবিক পৃথিবী। অথচ এই পৃথিবী মানবিক না হতে পারার ব্যর্থতা মানুষ বা কবির পারিপার্শ্বিক স্বজন সভ্যতা নিজের কাঁধে না নিয়ে ‘কবি কল্পনার জগতে বাস করে’ এই বলে তা চাপিয়ে দেয় একজন কবির কাঁধে। আর কবি তখন সারাটা জীবন ধরে এই ভার বহন করে একা একাই, অনেকটা যিশুর মতো।

এখন সাধারণ একটা প্রশ্ন আপনাদের মনোজগতে ঘুরতেই পারে। তা হল—পৃথিবী আর আমার উল্লিখিত মানবিক পৃথিবীর মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তর হল—পৃথিবী অর্জনের গ্রহ; পাবার স্থান; তাই পৃথিবী ভালোবাসে গতি। আর মানবিক পৃথিবী শিল্পীত, দেবার স্থান। যে কোনো শিল্প বা আর্ট যতটা সম্ভব গতিকে এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসে। প্রজ্ঞাবান ঋষি ধ্যানস্থ হতে পছন্দ করে, চঞ্চলতা নয়। এভাবেই অনন্যতার দায়ে আলাদা হয়ে যাওয়া, ধ্যানস্থতার দায়ে গতিহীন হয়ে পড়া এবং প্রাজ্ঞতার প্রজ্জ্বলনে ঋষভ বনে যাওয়া এক ব্যক্তি আত্মাহুতি দেয় প্রকৃতির কাছে, প্রেমের কাছে; কেউ তার রাখে না খবর।

বিষাদ ও বেদনায় দগ্ধ হতে হতে বাস্তবতার এই গতির পৃথিবীতে টলতে টলতে কবি এক সময় আভরণের ভেতরের সত্যটি আবিষ্কার করে ফেলে। সে তখন দুপুরের রোদের ঔজ্জ্বল্য অথবা গোধূলির স্নিগ্ধতা, জলের স্বচ্ছতা, ফুলের কোমলতা, প্রেমের মাধুর্য সবই নন্দনের পেয়ালা হাতে পান করতে থাকে আমৃত্যু। কবির এই পানকৃত নন্দনই হল কবিতা। প্রেমিকার বুকে শুয়ে কবি কখনোই প্রেমিকাকে আবিষ্কার করতে চায় না, আবিষ্কার করতে চায় প্রেমকে। মায়ের কোলে শুয়ে মাকে সে আবিষ্কার করতে চায় না, আবিষ্কার করতে চায় মাতৃত্বকে। অথচ প্রেমিকা চায় কবি তাকেই আবিষ্কার করুক, মা চায় সন্তান তাকেই বুঝুক। এভাবেই কবির সাথে বাকিদের চাওয়ার এক ভিন্নতা রচিত হয়ে যায় এ পৃথিবীতে। তখনই কবি, মানবিক পৃথিবীর এক তুমুল প্রেমিক অপ্রেমিক বনে যায় প্রিয়ার কাছে, মনুষ্যত্বের সন্ধানরত এক প্রাজ্ঞ ঋষভ টলকে যায় গতির কাছে। এই বিষাদ ও বেদনা কবিকে যতটা বিছিন্ন করে দেয় সমাজ থেকে কবি ব্যথা ভুলতে ততটাই পান করতে থাকে তার সেই প্রিয় ও স্নিগ্ধ নন্দনবনের দ্রাক্ষারস।

কবিতা তো কবির স্নিগ্ধ নন্দনবনের সেই দ্রাক্ষারস, যা কবি বিষাদ ও বেদনা ভুলতে আমৃত্যু পান করে যায়।

কবি জানে, জলের যেমন নদীর কাছে কোনো ঋণ নেই। বৃক্ষের যেমন অরণ্যের কাছে ঋণ নেই। কবির তেমনই পৃথিবীর কাছে কোনো ঋণ নেই। বৃক্ষ আছে বলেই অরণ্য, জল আছে বলেই নদী। কবি ও কবিতা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর।

এখন প্রশ্ন হল, কবিতা কি পৃথিবীর মুক্তি এনে দিতে পারে? কবিতা কি এ পৃথিবীকে এক মানবিক পৃথিবীতে রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম? এ এক গভীরতর প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আমাদেরকে আরো কিছু সূক্ষ্ম বিষয় মীমাংসায় আসতে হবে।

লৌকিক পৃথিবীর মানুষের কাছে কবির জীবন হাস্যকর হয়ে উঠছে; তারা হাসে, তারা ঠাট্টা করে। যেমন, ব্যর্থ প্রেমিক দেখলে রঙিন ফুলেরাও ঠাট্টা করে। অথচ ফুল জানে না ব্যর্থ প্রেমিকের হাতেই সে গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর মানুষেরও এই বোধ হয়; যখন কবির শরীরিক উপস্থিতি আর থাকে না এই পৃথিবীতে। তখন পৃথিবীর সমস্ত ফুল আর মানুষ এসে লুটিয়ে পড়ে কবির কাছে; বলে, হে ব্যর্থ প্রেমিক, আমাদের ক্ষমা করো, আমরা তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি।

সেসব সূক্ষ্ম বিষয়ে যাওয়ারও আগে, কবিতা হল কবির কল্পনা—মানুষের এই কল্পিত চিন্তাটিকে আমি প্রথমেই অস্বীকার করব। কবিতা সবসময়ই সুন্দর। পৃথিবীতে একটিও অসুন্দর কবিতা আমাকে কেউ দেখাতে পারবেন না। কারণ যা অসুন্দর তা কবিতাই নয়। আর সুন্দর সব সময়ই সত্য। মিথ্যা কখনো সুন্দর হতে পারে না। কবিতার শরীরে লেপ্টে থাকে কবির বাস্তবতার প্রাজ্ঞতা; হ্যাঁ, কখনো কখনো এইসব বাস্তবতার প্রকাশ কবিতা আকারে আসে বটে, আর তখনই আমরা ধারণা করি কবিতা বোধহয় কবির কল্পপ্রতিভাজাত। মূলত মোটেও তা নয়। কবিতা হল সূক্ষ্ম বাস্তবের এক নান্দনিক কারু। কবিতায় বাস্তবতার প্রকটতা এতটাই সূক্ষ্ম যে তা মানুষের মস্তিষ্কের ইমাজিনেশন ক্ষমতা নিয়ে খেলা করে। কবিতাকে শুধু জাদু ভাবলে ভুল করবেন। আমি আপনাদেরকে আমার বলা সেই প্রথম বাক্যটি আবার মনে করিয়ে দিতে চাই—কবিতা হল প্রজ্ঞার জাদু।


কবি মূলত বেহশত-বিতাড়িত এক ব্যর্থ প্রেমিকের নাম। এজন্য পুনরায় প্রেমে ফেরা, তার লক্ষ্য; পৃথিবীতে স্বর্গ রচনা করা, তার তৃষ্ণা। আমৃত্যু সে ফেরি করতে থাকে সেই সব নতুন বাণী, যা প্রকৃতিকে সুরভিত করে; সিনাই পর্বতের ওপর থেকে সে ঘোষণা করতে থাকে মানুষের মাহাত্ম্য। পৃথিবীর মানুষকে কবি বলতে চায়, শোনাতে চায় সেই স্বর্গের কথা, যা সে অন্তরাত্মা দিয়ে দেখেছে হৃদস্বর্গে; যেখানে সে ছিল; যেখানে সে ফিরতে চায়; এক নয়, বহুতে। বহু মানুষের সম্মিলনে রচিত হবে এক প্রেমের পৃথিবী, প্রজ্ঞার পৃথিবী; যা কবি বিশ্বাস করে। কারণ কবি জানে, এই সৌরজগতে পৃথিবীই একমাত্র আশ্চর্য গ্রহ, যেখানে একটি ফুলের শরীরের দিকে তাকিয়ে, শিশুর মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে নিজেকে পবিত্র করা যায়, কাটিয়ে দেওয়া যায় একটি জীবনও।

এই জেনে কবি তখন মাতালের মতো ছুটতে থাকে; সুরের মোহে, ছন্দের মোহে, কবিতার মোহে৷ তখন আমাদের মনে হয়, কবি মূলত একজন প্রসিদ্ধ মাতাল। সুরের জন্য সে পাখির কাছে যায়, ছন্দের জন্য সে জলের কাছে যায়, কবিতার জন্য সে প্রার্থনা করে, সাধনা করে।

লৌকিক পৃথিবীর সাধারণের কাছে কবির জীবন তখন অতিলৌকিক মনে হয়। কারণ, তারা যেখানে বাস করছে; সেখানকেই তারা গন্তব্য ধরে নিয়েছে; তারা যে সব সম্পর্কের মাঝে বেঁচে থাকে, সে সব সম্পর্ককেই তারা বন্ধন ভাবে। কবির এই গন্তব্যে স্থির নয়, কবি ছুটছে ভবিষ্যতের দিকে। কবি এই বন্ধনে থিতু নয়, কবি ছুটছে মানুষের অনাবিষ্কৃত মায়ার দিকে। এখানে কবি আলাদা হয়ে যাচ্ছে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে। তবে কবি থামে না, অন্তত মৃত্যুর আগে কোনো কবিই থামতে পারে না; কখনো কখনো তো মৃত্যুর পরেও থামে না কবি। তাই সে মানুষের অদেখা সত্য; মানুষের না শোনা সুর; অনাবিষ্কৃত মায়ার ভূবন সবই জড়ো করতে থাকে তার কবিতায়, কবিতার মাঝে এসব কবি লুকিয়ে রাখে; এই তার অন্তরের খেলা। বলা যায়—এ খেলায় কবির কোনো প্রতিপক্ষ নেই। দাবা খেলার বোর্ডের এপাশেও কবি; অপাশেও কবি। কবির মস্তিষ্কে একটার পর একটা অবিরাম চলতে থাকে বোধের সূক্ষ্ম চাল। খেলতে খেলতে এভাবেই কেটে যায় কবির জীবন।

এ জীবন সাধারণেরা নিচ্ছে না; লৌকিক পৃথিবীর মানুষের কাছে কবির জীবন হাস্যকর হয়ে উঠছে; তারা হাসে, তারা ঠাট্টা করে। যেমন, ব্যর্থ প্রেমিক দেখলে রঙিন ফুলেরাও ঠাট্টা করে। অথচ ফুল জানে না ব্যর্থ প্রেমিকের হাতেই সে গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর মানুষেরও এই বোধ হয়; যখন কবির শরীরিক উপস্থিতি আর থাকে না এই পৃথিবীতে। তখন পৃথিবীর সমস্ত ফুল আর মানুষ এসে লুটিয়ে পড়ে কবির কাছে; বলে, হে ব্যর্থ প্রেমিক, আমাদের ক্ষমা করো, আমরা তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি। তারা তখন খুঁজতে থাকে কবির সেসব বাণীসমৃদ্ধ নথি, যা আমরা কবিতা বলে চিনি; খুঁজে বের করে, পড়তে থাকে; আর একে অপরকে বলতে থাকে, দেখো আর একটু ভালো করে দেখো, নতুন কোন মায়ার কথা, নতুন কোন বন্ধনের কথা, নতুন কোন মুক্তির কথা লেখা আছে এই নথিতে; দেখো নতুন কোন পৃথিবীর সন্ধান কবি আমাদের জন্য রেখে গেলেন।

মূলত কবি হল একজন সৌন্দর্য প্রকৌশলী। সকল সুন্দরকে সে আমন্ত্রণ জানাতে থাকে এ পৃথিবীতে। বোধের সূক্ষ্মতায় সে এক স্বতন্ত্র যোগী। স্বর্গের প্রোফেট না হলেও একজন কবি নিশ্চিতভাবে আমাদের মানবিক পৃথিবীর প্রোফেট, যে পৃথিবীর সন্ধান আমরা আজও পাইনি।

খুঁজতে খুঁজতে হৃদপুর গ্রামের চঞ্চল কিশোরটি, উদাসীন যুবকটি একদা হয়তো বা পেয়েও যায় তার সন্ধান। সে তখন আশ্চর্য হয়ে ওঠে! আশ্চর্য হয়ে পুকুরপাড়ে বসে বসে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে সকালের মিষ্টি রোদটা জলের ওপর কীভাবে খেলা করছে। সে তখন বুঝে ফেলে গরম ভাত থেকে যে ভাপ ওঠে, তার ঘ্রাণের সাথে পথের ধারে ফুটে থাকা বনোফুলের ঘ্রাণের কী অসাধারণ মিল! মাঠের গরুগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে সে আবিষ্কার করে ফেলে, গরুর চোখে কী আশ্চর্য রকম মায়া! এই মায়া সে আগে কখনোই দেখেনি। সে আশ্চর্য হয়। এই আশ্চর্য হওয়াই হল কবিত্বের প্রথম ও প্রধান শর্ত। কবিকে আশ্চর্য হতে হয়। কবিতা লিখতে হলে আপনাকে প্রথমে আশ্চর্য হওয়া শিখতেই হবে। এই আশ্চর্য হতে যেয়েই সে তখন হৃদপুর গ্রামের অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেও তখন কবি হয়ে যায়। হৃদপুর গ্রামের বাকি লোকেরা তখন ধারণা করে, এই কিশোরটি অথবা এই যুবকটি কেমন যেন আলাদা; সবার মতো না, তাদের মতো না। গ্রামের লোকেদের ধারণা এক সময় সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। গ্রামের অসংখ্য ‘কেউ’-এর মধ্যে সে তখন জীবন ও যাপনে এক ভিন্নতর কেউ, সে তখন কবি।

এবার কবির পথচলা শুরু। সে এক নির্জন পথিক। সে দারুণভাবে একা। দীর্ঘ জীবনব্যাপী তার একা একা হেঁটে চলা। তবে তার এই একাকীত্ব গ্রহণ মূলত পৃথিবীর মানুষকে একাকীত্ব ভোলানোর জন্য। তার এই স্বেচ্ছা সন্ন্যাস গ্রহণ মূলত মানুষের এক আনন্দমুখর সংসার-ছন্দের নিমিত্তে। বেদনার ভেতর যে কত সুধা, কবি তা জীবন দিয়ে পর্ববেক্ষণ করে। প্রেমের কুয়োর ভেতর যে কত গভীরতা, তা কবি হৃদয়ে দড়ি বেঁধে কুয়োর ভেতর নামিয়ে আবিস্কার করতে চায়। আর তখনই তার কবিতায় এসে ধরা দিতে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, দ্রোহ। মূলত নিজের জীবনকে শিল্পিত করেই কবিকে শিল্পী হয়ে উঠতে হয়।

এখন আমি একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, অনেকটা কঠিন মনে হবে সেসব কথা—যাপনে যার কবিত্ব নেই, সে কবি নয়। সূর্য জ্বলে ওঠে, তা দীপ্তিমান; চাঁদ জেগে ওঠে, তা মধুর। অন্তরের বহিঃপ্রকাশ স্বভাব ও শরীরে পড়েই; তা লুকিয়ে রাখা যায় না।


কবিতা কি নাজেল হয়? এ নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সুযোগ আছে। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আত্মা ও শরীর সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। পবিত্র চেতনার জল পেয়ে কবির শরীর বেড়ে ওঠে। আর কবির আত্মা তৈরি হয় শুদ্ধতার মেশিনে। এ দুইয়ের মিশ্রণে কবিকে হয়ে উঠতে হয় একজন প্রলম্বিত হৃদয়ের অধিকারী। এই তৈরি পথে কবিতা এসে হাজির হয় কবির মস্তিষ্কে। আমরা তাকে অনেকে নাজেল বলছি। আমিও বলছি। কিন্তু এই যে ভাব এসে ধরা দিল মস্তিষ্কে, তখনই কবি ওটা লিখে ফেলে না। এরপরও কবির কাজ আছে। তা হল মস্তিষ্কের ব্যবহার। কবিতা তো মস্তিষ্ক তথা প্রজ্ঞা দিয়ে লিখতে হয়। এ সম্পর্কে আমি আগেই বলেছি। জাদুর সাথে প্রজ্ঞা মেশানোটাই হল কবির কারিকুরি। এ মেশানোর প্রক্রিয়াটায় কবি এক জীবন ব্যয় করে ফেলে। কবি উদাসীন হয়ে পড়ে। অন্য আর যা কিছু পার্থিব ও গুরুত্বপূর্ণ, কবির কাছে তা গুরুত্বহীন হয়ে যায়।

বলা যায়, কবিতা তো কবির এক প্রিয়তম অসুখ, এক মনোমুগ্ধকর ব্যাধি। যা কবি স্বযত্নে তার শরীরে পুষে রাখে আজীবন । নিজেকে ক্ষয় করে সে মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য রেখে যায় সুখ ও সুস্থতা। মানুষের জন্য হতে হতে, সমাজের জন্য হতে হতে, দেশের জন্য হতে হতে কবি একসময় আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। ধর্ম-রাষ্ট্র-মানচিত্র কোনো কিছুতেই কবির আর তখন সীমানা থাকে না। সে হয়ে ওঠে সকল ধর্মের জন্য, সকল রাষ্ট্রের জন্য, সকল মানচিত্রের জন্য।

মূলত কবি হল একজন সৌন্দর্য প্রকৌশলী। সকল সুন্দরকে সে আমন্ত্রণ জানাতে থাকে এ পৃথিবীতে। বোধের সূক্ষ্মতায় সে এক স্বতন্ত্র যোগী। স্বর্গের প্রোফেট না হলেও একজন কবি নিশ্চিতভাবে আমাদের মানবিক পৃথিবীর প্রোফেট, যে পৃথিবীর সন্ধান আমরা আজও পাইনি। মূলত এভাবেই—প্রত্যেক প্রকৃত কবিই শেষমেশ মিথ হয়ে যায়।

লেখাটি শেয়ার করুন :

রিগ্যান এসকান্দার

রিগ্যান এসকান্দার। জন্ম ১২ জুন ১৯৮৩, কুষ্টিয়ায়, বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলায়। বর্তমানে তিনি চুয়াডাঙ্গার শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশে চিন্তা ও চর্চার দর্শন 'চর্চায়ন' নিয়ে কাজ করছেন। সম্পাদনা করেন সাহিত্য পত্রিকা 'চর্চায়ন'। সেই সাথে মুক্তচিন্তা ও গবেষণামূলক সাহিত্য পত্রিকা 'দর্পণ'-এর উপদেষ্টা ও কবিতাবিষয়ক সম্পাদক তিনি। এসকান্দারের প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: পেরেকপুস্তক (২০২২), দর্শনপুস্তক (২০২২), সুফিয়াতন্ত্র (২০২১), দ্রোহশাস্ত্রবুলি (২০২০), প্রেম কবলিত প্রসব (২০১৪০, নারীগদ্য (২০০৭)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!