কিছু মৃদঙ্গ পাখি
ঠিক দুপুরের আগে ছন্দোবদ্ধ তন্দ্রা তাকে আক্রমন করে। আদুরে আর নরম ভঙ্গিতে প্রতিদিন। বিভা বোঝে এসবের কারণ। ক্লান্তিটা শরীরিক নয়, মানসিক। সুতরাং এটাকে বাঁধা দেবার শক্তি তার সামান্য। মধ্য দুপুরের আগে এই সময়টা তন্দ্রা পরাক্রমশালী। সেপ্টেম্বরের আঠারো তারিখের দুপুরে তখন সে পরাক্রমশালী তন্দ্রা সামলাতে হিমশিম খায়। তার উপর দক্ষিণ দুয়ার দিয়ে অকৃত্তিম বাতাস এসে গায়ে লাগে। আর সেই মুহূর্তে চারিদিক এত শুনশান যে, তন্দ্রা যেন দিগুণ পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। তখন লম্বা এক বিরতির পর সাতাত্তর বছর বয়সী ঘড়ঘড়ে কণ্ঠটা সক্রিয় হয় ।
বলতে পারো রাতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বড় হয় কখন?
বিভা ঘুম কাটানো কণ্ঠে বলে, সম্ভবত ডিসেম্বরের কোনো এক শীতের রাতে।
ওসব তো জ্ঞানের কথা, বুড়ো শাহ মুয়ায বলে। আমার জিজ্ঞাসাটা জ্ঞানের না, রসের। বলে সে দিলখোলা এক হাসি মারে। পরক্ষণে মুখ-ভঙ্গি যথাযথ স্বাভাবিক করে আনে। তারপর বলে, ঘুম না এলে সে রাতের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বড় হয়। সূর্যটাও গড়িমসি করে উঠতে। ঘুমের সাথে আসলে আপোস চলে না কোনো কিছুর। আমার সাতাত্তর বছর বয়সে বহু রাত ঘুমহীন কেটে গেছে। সম্ভবত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তবু ঘুম না হওয়াটা কখনো অভ্যাস হয়ে উঠতে পারে নাই।
দুটো দিনের কর্মযজ্ঞে নার্সকে মনে হয়েছিল কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার নিখুঁত কোনো শরীর। মুখে হাসি অথবা কৌতুকের কোনো লেশ মাত্র দেখা যায় না। প্রশ্নের উত্তর সোজাসাপ্টা ও সংক্ষিপ্ত। কিন্তু ভঙ্গিটা নিরলস। যদিও এখানে হাসির মতো কিছু ঘটে না। ভূতে পাওয়া বাড়ির মতো ঘাপটি মেরে থাকে নীরবতা। এখানে শুধু উৎপাদন হয় থৈ থৈ ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্তি কাটানোর মতো কোনো হাওয়া উৎপাদন এখানে হয় না।
এসব গল্প শুনতে শুনতে বিভা পুনরায় কিঞ্চিৎ তন্দ্রার দেখা পায়। চোখদুটো ঢুলু ঢুলু করে। তার ভেতরে সে জাগরণ ও স্বপ্নের মিশেলে কর্মঘণ্টা হিসেব করে। হিসেবে কি বারবার গড়মিল হচ্ছে? আজকের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার সিংহভাগ এখনো পড়ে আছে। এখানে কাজের বয়স সবে দুদিন আর তার জীবনের মাত্র সাতাশ। এই সাতাশ বছর থেকে দুটো দিন যদি মুছে ফেলা যায়, তবে তার ফলাফল ফুলেল কিছু হয় না। তবু মানসিক ক্লান্তির এই বাড়বাড়ন্ত পরিণতিও হয়তো মেনে নিতে হত না। আগের জীবনের প্রধান অনুসঙ্গ ছিল অর্থনৈতিক সংকট। আর এই জীবনে শুধু জমা হচ্ছে ক্লেদ। মানুষ আসলে শেষ পর্যন্ত কী চায়? সম্ভবত মানুষের জন্য যা প্রাপ্য নয় মানুষ তাহাই প্রার্থনা করে।
বরাবরের মত, নির্বিকার শ্রোতা হয়ে সে কান পেতে রাখে বুড়ো শাহ মুয়াযের ঘড়ঘড়ে কণ্ঠের দিকে। বুড়ো তখন আধশোয়া থেকে উঠে বসতে সচেষ্ট হয়। কিছু একটা শব্দ হয়, মনে হয় বুড়োর শরীরের হাড় মড়মড় করে ওঠে। মধ্যবয়সী নার্স তাকে যথাযথভাবে বসাতে হিমশিম খায়। সবুজ এপ্রোনের নীচে তার শরীরের কোথাও কোথাও ঘামের চিহ্ন ফুটে ওঠে। তার শরীরে ঘামের দেখা পাওয়াটা বিভার মনে অহেতুক স্বস্তি আনে। দুটো দিনের কর্মযজ্ঞে নার্সকে মনে হয়েছিল কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার নিখুঁত কোনো শরীর। মুখে হাসি অথবা কৌতুকের কোনো লেশ মাত্র দেখা যায় না। প্রশ্নের উত্তর সোজাসাপ্টা ও সংক্ষিপ্ত। কিন্তু ভঙ্গিটা নিরলস। যদিও এখানে হাসির মতো কিছু ঘটে না। ভূতে পাওয়া বাড়ির মতো ঘাপটি মেরে থাকে নীরবতা। এখানে শুধু উৎপাদন হয় থৈ থৈ ক্লান্তি। কিন্তু ক্লান্তি কাটানোর মতো কোনো হাওয়া উৎপাদন এখানে হয় না।
তখন সোজা হয়ে বসে শাহ মুয়ায কণ্ঠ সচল করার চেষ্টা করে। প্রথম দফায় সংক্ষিপ্ত আকারে ঘড়ঘড়ে শব্দ হয় শুধু। তারপর পৃথিবীর গভীর ও গোপন কোনো অনুসঙ্গ সে তুলে আনে। সে এখনো প্রজননে সক্ষম, এমন ইংগিত সে দেয় মুখে হেসে, আর বিভার শরীরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ভেদ করে। প্রথম দিনেই সে ঝুলন্ত ও ফ্যাকাশে শিশ্ন বিভিন্ন কৌশলে বারকয়েক দেখানোর চেষ্টা করেছে। বিভা সেসব ভেবেছিল বয়সজনিত অসতর্কতা। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেক কিছু পরিষ্কার হয় তার কাছে। সেসব মুহূর্ত সংকটকালের মতো, শরীরটা ঘৃণায় রি রি করে। দ্বিতীয়বার তার মুখ-দর্শনের কোনো ইচ্ছে করে না। কিন্তু দুর্নিবার অভাব তার ইচ্ছেগুলোর গলা টিপে ধরে। তখন তার ভাবনাসমূহের ধারা বদল হয়।
সে ততোটাই বিদঘুটে যতোটা সে বিত্তবান।
এমন একটা বাক্য বিভা মনে মনে আওড়ায়। এবং আরো ভাবে, সে বিদঘুটে বলেই কি বিত্তবান, নাকি বিত্তবান বলে সে বিদঘুটে। হয়ত-বা এই দুইয়ের ভেতরে নিবিড় কোনো যোগাযোগ আছে। তখন বিভা দেখে টেবিলের উপর ফলকাটা ছুরিটা অহেতুক চকচক করে। ছুরির ভেতর দিয়ে চোখে রোদের আলো ঝিলিক মারে দফায় দফায়। তবু সে একবার ছুরিটার দিকে তাকায় এবং বুড়োর চামড়া জড়ানো শিশ্নের কথা ভাবে। ফলকাটা ছুরি নিশ্চয় ভিন্ন কিছু কাটতেও সক্ষম।
এসব হয়তো সুখকর মন্ত্রণা। কারণ এসব ভাবনায় মনের প্রবোধ ও চাঞ্চল্য বাড়ে। আর তার ফোনে টুং করে নোটিশ আসে তখন, প্রায় নিঃশব্দে। কয়েকটি দিন তাকে শুধু দ্বিধা তাড়া করে গেল। হঠাৎ আজ সমস্ত অর্গল খুলে গেলে সে সত্যটা বলার কথা ভাবে। ফলকাটা ছুরিটা তখনো তার চোখে উষ্কানি দেয়। জানালায় সাদা পর্দাটা অস্থির। আজকে বাতাসের উৎপাদন সত্যিই চমৎকার। তখন বিভার বৃদ্ধাঙ্গুলি তৎপর। সে স্ক্রিনে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখে আবার মুছে ফেলে। তারপর সংক্ষেপে লেখে, নিঃসঙ্গ এক বুড়োকে সঙ্গ দিই, এটাই আমার চাকরি।
কত উর্বর স্বপ্ন বসন্ত বিলাপে পরিণত হল। বিভা এখন এসব বাস্তবতা বোঝে, এবং মনে মনে চূড়ান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গি চর্চা করে। যাতে জীবনের উপর দিয়ে অনেক আঘাত বয়ে গেলেও সে যেন পাথুরে পাহাড়ের মতো স্থির থাকতে পারে। এভাবে সে নিজেই নিজের পথের দিশা হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
চিঠিটা পাঠিয়ে বিভা মন খারাপের সংকেত পায়। তার বুকে যেন সাদা পেজা তুলো আটকে থাকে। অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া আসে না তখন। এমনি থমথমে যে, বিভা যেন ঝড়ের মেঘ দেখে। সে ফোনটা হাত থেকে সরিয়ে ব্যাগের ভেতর রাখে। হাতের উপর থেকে অহেতুক একটা ভার যেন নামে। তখন ব্যাগের ভেতরে ফোনটা অনবরত টুংটাং করে আর কাঁপে, প্রায় নিঃশব্দে। অন্তরগত যাতনার মতো শুধু বিভা এসব ঘটনাপ্রবাহ বোঝে। কিন্তু ততোক্ষণে হাওয়া বদলেছে। বুক থেকে উড়ে গেছে অহেতুক তুলোর ভাণ্ডার। কোনো সফেদ কোমলতা সে আর টের পায় না। হঠাৎ রপ্ত করা নির্লিপ্ত ভঙ্গি সে গোপনে উদযাপন করে।
দুপুর বেলার রোদ ক্রমশ নরম হয়। নিরীহ ফলকাটা ছুরিটা নির্বিকার পড়ে থাকে টেবিলে। বাইরে হাওয়ার উৎপাদন কমে আসে। জানালার সাদা পর্দাটা সামান্যই দোলে। নার্সকে তখন কোথাও দেখা যায় না। শাহ মুয়ায ভাতঘুম শেষে নতুন উদ্দীপনায় বিভাকে ইশারা করে। বিভা গোপন প্রেমিকার মতো নিঃশব্দ পায়ে কাছে আসে তখন। তারপর মুখের উপরে হাসি ধরে রেখে বুড়োর পায়ের কাছে বসে পড়ে। আর বুড়ো যেন অকারণে দীর্ঘক্ষণ হাসে। ততোক্ষণে বিভাকে অভ্যস্ততায় পেয়ে বসেছে। সে আর সংকোচে সলজ্জ্ব হাসে না। শাহ মুয়ায বলে, তোমার জীবনের কিছু অধ্যায় আমি জেনেছিলাম ইন্টারভিউয়ে। খুবই টাচি মোমেন্ট ছিল সেটা। তোমার জন্য কিছু করতে পারার দায়টা আমার ছিল। অনেক বড় বড় প্রতিযোগীকে নাকচ করে দিয়েছি তোমার জন্য। সে আমি দিতেই পারি। এখানে আমি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই রাজ্য সাজাই নাই। আমি আমার রাজ্যের অধিপতি হয়েছি আমার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্য। আমার এমন ইচ্ছা হল যে, তোমার জন্য একটা দুয়ার খুলে যাক। মনে রেখো, তুমি যত বড় সেবী হবে তোমার সৌভাগ্যের দুয়ার ততোটাই খুলে যাবে। আমার রাজ্যে এই-ই নিয়ম।
তারপর বুড়ো কুচকানো গাল টেনে টেনে হসে, যেন অভ্যাসের হাসি নয়, কেমন কুৎসিত দেখায়। এবং কুৎসিত হাসি মুখে ধরে রেখে বলে, আমি এখনো প্রজননে সক্ষম।
কুৎসিত হাসিটা তার সারামুখে ছড়িয়ে গেলে সহসা সে হাসি আর থামে না। বিভার শরীরে ঘামের রেখা ফুটে ওঠে। রাগে আর অপমানে, মাত্রা ছাড়ানো ঘৃণায়। সে থরথর করে কাঁপে। সে কি তবে সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিতে এসেছে কিছু অর্থের বিনিময়ে! এ কেমন এক জীবন তার যে, শুধু গভীর খাদের কিনারে এনে দাঁড় করায়। তার ভাগ্যের দুয়ার তবে এমনি পতন পিয়াসি।
বিভা মুষড়ে পড়লে অভিজ্ঞ জীবনযোদ্ধা শাহ মুয়ায এসব সংকট বোঝে। কিন্তু সে তার শক্তির জায়গাটাও জানে বলে হাসিমুখে সে বিভাকে সেদিনের মতো ছুটি দেয়। কিছু সিদ্ধান্ত নিতে তার যে স্থিরতা দরকার, সে সুযোগে কোনো ঘাটতি রাখে না।
বিভার ফোনে অনবরত টুংটাং নোটিশ আসে দিনভর। তার প্রেমিক ক্রোধে অন্ধ এবং যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে যায়। সে এসব দেখেও যেন দেখে না। কারণ তার প্রেমিক কখনো পথের দিশা হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায় না। অথচ কতো ঝড় বয়ে গেল ছোটো একটা জীবনের উপর দিয়ে। কত উর্বর স্বপ্ন বসন্ত বিলাপে পরিণত হল। বিভা এখন এসব বাস্তবতা বোঝে, এবং মনে মনে চূড়ান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গি চর্চা করে। যাতে জীবনের উপর দিয়ে অনেক আঘাত বয়ে গেলেও সে যেন পাথুরে পাহাড়ের মতো স্থির থাকতে পারে। এভাবে সে নিজেই নিজের পথের দিশা হয়ে সামনে দাঁড়ায়। ফোনের সমস্ত অধ্যায় থেকে তার প্রেমিকের চিহ্ন মুছে ফেলে। সে রাতে তার ফোনটাও যেন অবসর পায়, এবং তারা দারুণ স্বস্তির সাথে রাতে ঘুমাতে যায়। সে রাতে মেঘের মতো শুধু উড়ে আসে শান্তির ঘুম। ভীষণ আদুরে ও কোমল। এমনি শান্তির ঘুম যে, এই ঘুম থেকে কখনো জেগে না উঠলেও এক বিন্দু আফসোস থাকে না। অথচ জীবনের প্রতি সহস্র অভিযোগ, তবুও।
একটি ছোটো ডানাভাঙ্গা দুঃখী পাখির মতো। এমন বেদনার্ত শিহরনের ভেতরে জীবনের সমাপ্তি ঘটে গেলে বোধ হয় দারুণ হবে। এই ভেবে সে একটি বৃষ্টিধোয়া চকচকে ট্রেনের অপেক্ষা করল। কিন্তু স্টেশনমুখী কোনো ট্রেনের দেখা গেল না। তারপর সন্ধ্যানাগাদ বৃষ্টি থামল আর সমস্ত হলুদ আলো অন্ধকারের আকার নিল।
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার প্রাক্কালে সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে সে জেগে ওঠে। জীবন এই রাতের মতোই নির্বিঘ্ন হোক, এমন এক নির্জন প্রার্থনা সে করে। সকালের সময়টাও যে বেশ লম্বা, বহুদিন পর ভোরবেলা জেগে উঠে সে আবিষ্কার করে। এছাড়াও সে কাঁচা রোদের নরম ঝলক ও কয়েকটি পাখির কর্মচঞ্চল হতে দেখে। বেলকনিতে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেও সে সকালে কেবল মানুষ দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় মানুষের বসবাসের বিবিধ সংকেত ও চিহ্ন। বিভা সে সকালে স্বাচ্ছন্দ্যেই ঘরের কাজ করে বের হয়। তারপর মেট্রোতে চেপে বসে নির্লিপ্ত চোখে শহরের অসংখ্য অনুষঙ্গ দেখে। মেট্রোর উঁচু থেকে শুধু বোঝা যায় দালানকোঠা, আর যানবাহন। মানুষ বোঝা যায় না ভালোভাবে। দীর্ঘ সার ধরে শুধু যানবাহন চলে। যেন শহরের সমস্ত প্রাণ ধারণ করেছে যানগুলো। আর মানব বরাবরই বোঝা না যাবার মতো অস্পষ্ট। সে নিজেও মানবের শরীর ও মন নিয়ে শাহ মুয়াযের একান্ত বাসভবনে আসে। বিভাকে দেখে শাহ মুয়ায বাসি পেপারটা টেবিলে রাখে।
আমি কি পেপারের থেকেও বেশি টাটকা? বিভা নিজের সঙ্গে গোপন রসিকতা করে।
এক কাপ কফি হলে সকালের সেশনটা জমত, বলে শাহ মুয়ায গল্প শুরু করে। জীবনে আমার সকল ঘাটতি পুরন করেছে অর্থ। জীবনে আমি অভিজ্ঞতা ছাড়া সব কিছুই অর্থ দিয়ে কিনেছি। এমনকি সুখও। সারাজীবন আমি একলা মানুষ, কিন্তু কখনো আমি নিঃসঙ্গ হই নাই। বলে সে দীর্ঘক্ষণ হাসে। এমন হাসি যে, বিভা বিচলিত হয়। ভড়কে যাবার মতো সে চারিদিকে তাকায়, কিন্তু কারো দেখা পাওয়া যায় না সে সকালে। এদিকটায় অনুমতি ছাড়া কারো আসার সাধ্য অবশ্য নাই। তাই সে নিজেকে সুস্থিরভাবে প্রস্তুত করে রাখে। তখন হাসি থেমে গেছে পুরোপুরি। শাহ মুয়ায আবার শুরু করে। তখন সে মূলত দক্ষিণে ইশারা করে তার ফুলবাগানের কথা বলে। এই বাগানের পেছনে জীবনের বড় একটা শ্রম গেছে। বহু দেশ থেকে আমার ফুলের চারাগুলো এসেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মালি আমার বাগানের পরিচর্যা করে। তুমি যদি দেখো তাহলে বুঝবে, পৃথিবীতে এমন গোছানো ফুল বাগান আর হয় না। সম্ভবত তোমার স্বর্গের ধারণা তৈরি হবে বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে।
শাহ মুয়ায একটু বিরতি নেয়, মূলত সে বিভার মুখে বিস্মিত হবার চিহ্ন পরখ করে। তারপর বিভার দিকে মুখ এগিয়ে নিচু গলায় বলে, ধরো তোমার জীবন এইরকম গোছানো হয়ে গেল। মরুভূমির মতো খটখটে মাটিতে সবুজের বিপ্লব ঘটে গেল। একটু ভেবে দেখে বলো কী দারুণ ঘটনা হবে এমন হলে। কিন্তু এটা কি স্বপ্নের মতো মনে হয়? আমি কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখছি, তুমি যদি চাও। মাঝে মাঝে শুধু আমার লুজ ইন্দ্রিয়গুলোকে জাগিয়ে দাও। আমি এখনো যৌবনের মতো শিহরণ ভালোবাসি। এবং এটাও জেনে রাখো, আমি এখনো প্রজননে সক্ষম।
শাহ মুয়ায ক্ষান্ত হয়। আর বিভা নতুন করে চমৎকৃত হয় শাহ মুয়াযের কাম নিবেদন দেখে। সত্যিই কী চমৎকার তার নিবেদন। অথচ সে চাইলেই তার চারপাশে দানার মতো অসংখ্য অপ্সরি এসে ছড়িয়ে থাকবে। সে সামান্য এক তরুণী অথচ তাকে কতটা বিশেষ করে তুলছে। নাকি কামার্ত পুরুষের চোখে প্রতিটি নারীই বিশেষ? এমন একটা কথা বিভার মনে আসে বটে, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে পাত্তা দেয় না।
বিকেলে নার্সকে জানালার ওপারে দেখা যায়। সে শক্তমুখে গন্ধবাগানের দিকে মুখ করে সমস্ত বিকেল বসে থাকে। মৌসুমী ঝড়ের অন্ধকার মেঘের মতো মুখভঙ্গি সে রপ্ত করেছে। তাতে করে জীবনের কিছু ভঙ্গুর পথ সাবলিল হয় কিনা বিভা এমন একটা সম্ভাবনা যাচাই করে। কিংবা তার জীবন হয়ত তাকে এখানে ছুঁড়ে ফেলে গেছে। অনেক ভেঙ্গে-চুরে যাবার পর জীবনের সহজাত ভঙ্গি বদলে গেছে। তার নিজের জীবনও কি ভেঙ্গে-চুরে যায় নাই! দিনে দিনে সে নিঃসঙ্গ পাথর হয়ে গেছে। অথচ সে মানুষের নিঃসঙ্গ কাটাতে কত ব্যাকুল। তার পিতা-মাতা তাকে শুধু জন্মই দিয়েছে কিন্তু কোনো কর্তব্য নিয়ে তারা ভাবে নাই। সে সব সময় বিপন্ন-মুখে তার পিতা-মাতার এমন ছবি কল্পনা করে যে, তারা সর্বদাই শহরের উৎসবমূখর পার্টিগুলোতে নেচে-গেয়ে দিব্যি কাটাচ্ছে। জীবন সত্যিই ভীষণ সুখ ও উপভোগের। কিন্তু সেসব সে চোখে দেখছে কই।
সে শুধু বিষাদগ্রস্ত মেঘ দেখে। পৃথিবীতে বারো মাস যেন বর্ষা। সকাল-সন্ধ্যা শুধু বিষাদের মেঘ ভেসে আসে। আর গা ঝলসানো এসিড বৃষ্টি নামে। এমনি এক বিকেলের কথা মনে পড়ে। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো রেলস্টেশনে। কোনো যাত্রির ছিটেফোঁটা নাই। বিভা একা একা রেললাইনে নেমে পড়লো। আকাশ ক্রমশ হলুদ হচ্ছিল। সেই সাথে পুরো পৃথিবী হলুদ হচ্ছিল সমানতালে। বিভার মনে হল এসিডের রঙ হলুদ। তাই সারা বিকেল সে এসিড বৃষ্টিতে ভিজল। একটি ছোটো ডানাভাঙ্গা দুঃখী পাখির মতো। এমন বেদনার্ত শিহরনের ভেতরে জীবনের সমাপ্তি ঘটে গেলে বোধ হয় দারুণ হবে। এই ভেবে সে একটি বৃষ্টিধোয়া চকচকে ট্রেনের অপেক্ষা করল। কিন্তু স্টেশনমুখী কোনো ট্রেনের দেখা গেল না। তারপর সন্ধ্যানাগাদ বৃষ্টি থামল আর সমস্ত হলুদ আলো অন্ধকারের আকার নিল। তারপর বিভা জরাক্রান্ত হলে তার চোখে শুধু হলুদ মেঘ উড়ে বেড়াল। তুমুল এসিড বৃষ্টি হল। এবং এই দৃশ্য যেন তার জীবনজুড়ে ছড়িয়ে গেল। তারপর থেকে বিভা শুধু বিষাদগ্রস্ত মেঘ দেখে। তার চোখে পৃথিবীতে বারো মাস যেন বর্ষা।
বিভা মূলত টের পায় নাই কখন চরাচরে সন্ধ্যা নেমেছে। সে যেন স্বর্গীয় ফুলের বিবিধ সুবাস মেখে বাগান থেকে বের হয়। তারপর বিভার অদ্ভুত নেশাতুর স্বপ্ন তৈরি হয় মনে। জীবনের এই স্তরটা সত্যিই দারুণ। সম্ভবত মানুষ স্বপ্নের এই স্তরটা লালন করতেও শেখে নাই। শাহ মুয়ায সত্যিই চমৎকার একটি মনের অধিকারী।
শাহ মুয়াযের ইশারায় পড়তি রোদের আলোয় বিভার জন্য বাগানের সমস্ত দরজা খুলে যায়। বিভা একা একাই শাহ মুয়াযের স্বর্গসমান বাগানে পায়চারি করে। সে এতোটাই অভিভূত হয় যে, তার কৌতুহলের সমাপ্তি ঘটে না। যেন স্বপ্নের ভেতরে কোনো দৃশ্যয়ন চলছে। মহাবিস্ময়ে সে যখন বাগান পরিদর্শন শেষ করে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। বিভা মূলত টের পায় নাই কখন চরাচরে সন্ধ্যা নেমেছে। সে যেন স্বর্গীয় ফুলের বিবিধ সুবাস মেখে বাগান থেকে বের হয়। তারপর বিভার অদ্ভুত নেশাতুর স্বপ্ন তৈরি হয় মনে। জীবনের এই স্তরটা সত্যিই দারুণ। সম্ভবত মানুষ স্বপ্নের এই স্তরটা লালন করতেও শেখে নাই। শাহ মুয়ায সত্যিই চমৎকার একটি মনের অধিকারী। সে এতোটাই নান্দনিক যে তাকে নিয়ে ভাবলে মিথের মতো মনে হয়। এভাবে, অজান্তেই বিভা তার মনের আসনে বুড়ো শাহ মুয়াযকে নায়কের আসনে বসায়। এবং তার ব্যাপারে সে প্রচ্ছন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আরো একটা কারণে। তার অগোছালো বিভৎস জীবনটা নিশ্চয়ই স্বর্গসমান বাগানটার মতো গোছালো হয়ে যাবে। জীবনে তার এই শান্তিটুকুই আরাধ্য ছিল চিরকাল।
তখন শাহ মুয়াযের ঘর কিঞ্চিৎ অন্ধকার। সম্ভবত অধিক আলো তাকে স্বস্তি দেয় না। বেডসাইড টেবিলে লাল রঙের মৃদু আলো জ্বলছে শুধু। বিভা কি বোঝে এসব কিসের প্রস্তুতি! সম্ভবত বোঝে গোপনে কিসের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। শাহ মুয়ায তখন সমস্ত কাপড় ছেড়ে দিয়েছে। বিভাও সমস্ত সংকোচ কাটিয়ে অদ্ভুত নেশাতুর স্বপ্নসহ শাহ মুয়াযের কাম নিবেদনে সাড়া দেয়। বিভা সম্ভবত ভাবে, শতাব্দীর নক্ষত্রখচিত এ রাত তার কপাল বরাবর উঠে এসেছে।
চাকুরিটা ছিল এমন, একজন ধনকুবের বৃদ্ধের নিঃসঙ্গ অবসরের কিছু কিছু গল্পের সঙ্গী হওয়া। অথচ সে বাঁধা পড়ে গেল একান্ত মুহূর্তসমূহে। জীবন তাহলে এমনি বিস্ময়কর কিছু অধ্যায়ের নাম। বিভা একান্তে শুরুর দিনগুলোর কথাও ভাবে যখন সে শাহ মুয়াযের কাম নিবেদনে আতঙ্কিত ছিল। অথচ এখন সেটাই জীবনের বড় স্বপ্নের পথ তৈরি করেছে। এভাবে বিভা একদিন লক্ষ্য করে তার পিরিয়ডের নির্দিষ্ট দিবস পেরিয়ে গেছে। সকাল বিকেল গা গুলিয়ে ওঠে আর বমির উদ্রেক হয়। বিভা প্রথমত চিন্তা করে তার আতঙ্কিত হওয়া উচিত নাকি আনন্দিত। সে দুয়েকটা দিন বিচ্ছিন্নভাবে এসব চিন্তাই করে। এই চিন্তার মৌসুমে তার সমস্ত জীবন ধাপে ধাপে উঠে আসে। কিছু কিছু সুখের বিনিময়ে জীবনটা অগাধ বেদনার নাম। তবু অতীত স্মৃতি বলে সে নানাবিধ স্মৃতিবেদনায় ভোগে। তারপর একটি সিদ্ধান্তে আসে। সে মূলত গর্ব অনুভব করে এসব ভেবে যে, দেশের অন্যতম ধনকুবের তার অনাগত সন্তানের পিতা। স্বর্গসমান এইসব সম্পদের প্রধান অধিকারী হবে সেই-ই।
এমন পুলকিত দিন অতিবাহিত হয় তার। তারপর যখন সে সিদ্ধান্ত নেয় বিষয়টা শাহ মুয়াযকে জানাবে, তখন হৈমন্তী বাগানে গন্ধ ছড়িয়ে পড়া মোহনীয় এক বিকেল। এমন বিকেলে কিছু পাখি তার মনে অস্থির বিহঙ্গ হয়ে ঢুকে পড়ে। তারা ইতস্তত ওড়ে, অকারণ ডানা ঝাপটায়। বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে দেয় অনেক তিক্ততা। রোদ ক্রমশ ম্লান হচ্ছে হৈমন্তী বাগানের ওপারে। বনেদি ও ঘরমুখো পাখিদের ঘরে ফেরার তোড়জোড় শুরু হয় তখন। বিভার মনে কেমন এক দ্বিধা এসে জমা হয়। কিন্তু অকারণ সেসব দ্বিধা কেটে যায় খানিক পরেই। সম্ভবত আরাম চেয়ারে চোখ বুঁজে সে আয়েশে দোল খেতে খেতে একটি শিশুর কলরব শোনে। তারপর কিঞ্চিৎ চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে তার দিকেই কৌতুহলী চোখে ফুটফুটে এক শিশু তাকিয়ে আছে। আর তার পেছনেই অপ্রস্তুত নার্স, শিশুটাকে কোলে নিয়ে বলে, সুযোগ পেয়ে আমার ছেলে এদিকটাতে চলে এসেছে।
বিভা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্ময়ে ফেটে পড়ে। শিশুটির মুখখানা যেন হুবহু শাহ মুয়াযের প্রতিচ্ছবি।
বিভা মুহূর্তেই বিষয়টা ধরে ফেলে এবং তার শরীর বেয়ে বেগতিকভাবে ঘাম ছোটে। তার ভাবনাগুলো তখন ঝড়ের বাতাসের মতো ঝঞ্ঝাট, এলোমেলো। শিকারির টোপ গেলা বোকা পাখিটার মতো বেপথু। তার মনে হয়, মায়াচোখে তাকিয়ে থাকা এই সন্তানটি যেন তারও। পেট ফুঁড়ে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মতো অগণিত তিনজনের সমান্তরালে। তখন তাদের জীবনের প্রতীক হয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড বিষাদের মেঘ ভেসে আসে। আকাশ ক্রমশ হলুদ হয়। তাদের মনে হয় এসিডের রঙ হলুদ। ছোটো কয়েকটি ডানাভাঙ্গা দুঃখী পাখির মতো সারা বিকেল তারা এসিড বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।

সুবন্ত যায়েদ। গল্পলেখক। জন্মস্থান: কুষ্টিয়া। প্রকাশিত বই : কতিপয় মৃত্যুপ্রকল্পের প্রাণ; মনোদৈহিক স্মৃতিবেদনারা।