দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার দিনে
নেপালি লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সুষমা যোশির জন্ম ১৯৭৫ সালের ২৬ মে কাঠমান্ডুতে। তাঁর লেখা গল্পের বই ‘অ্যান্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড ২০০৯ সালে ফ্রান্স ও’কনোর ইন্টারন্যাশনাল সর্ট অ্যাওয়ার্ডের দীর্ঘ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বৃটিশ মিশনারিদের পরিচালিত স্কুলে ছোট বেলায় লেখাপড়া করেছেন সুষমা। সেখানেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। লেখক হওয়ার সিদ্ধান্তও নেন তখনই। মাত্র ১৯ বছর বয়সে উচ্চ শিক্ষার জন্য নিউইয়র্ক যান ও নিউইয়র্কের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ভেরমেন্ট ব্রেডলোফ স্কুল অব ইংলিশ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেন। ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশন থেকে একটা রাইটিং ফেলোশিপও পেয়েছিলেন সুষমা।
তিনি ইংরেজিতে লেখেন বলে বিশ্বব্যাপী তাঁর পাঠক আছে। তাঁর লেখা ইতালীয়, স্প্যানিস ও ভিয়েতনামি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নেপালের এই গুরুত্বপূর্ণ লেখক গল্প ছাড়াও প্রবন্ধ ও নাটক লেখেন। তিনি একজন ফ্রিলান্স সাংবাদিক। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন নেপালের রাজনৈতিক সাপ্তাহিক ‘দ্য ন্যাশন উইকলিতে।’
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি হারভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথে কাজ করেন। উদ্দেশ্য ছিল গ্লোবাল রিপ্রডাক্টিভ হেলথ ফোরামের স্বাস্থ্য ও অধিকার কর্মসূচি বাস্তবায়ন। সে সময় মুম্বাই, দিল্লি ও ঢাকা সফর করেন তিনি।
তাঁর লেখা নাটক ‘আই কিল্ড মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস্ ফাদার’ লন্ডনে আরকোলা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছে। তিনি ছবিও আঁকেন। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্প থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়ে এই পটভূমিতে ‘দ্য কোয়েক’শীর্ষক পেইন্টিং আঁকেন যা ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রদর্শিত হয়। এর বেশ কিছুদিন আগে কাঠমান্ডুতে ‘ব্লু নেপাল’নামে তাঁর একক চিত্র প্রর্দশনীটি হয়েছিল। ওখানে নেপালের গৃহবিবাদের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছিল। তার উল্লেখযোগ্য বই: দ্য ডিসকাভারি অব হাই লামা, দ্য অ্যান্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড, চিজ ও আর্ট ম্যাটার। তিনি বর্তমানে কাঠমান্ডুতে বসবাস করছেন।
অনুবাদ: দিলওয়ার হাসান
একদিন এক বিরাট সাধু ও পণ্ডিত ভবিষ্যৎবাণী করলেন এমন এক মাত্রার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে যে, পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি লোক মারা যাবে। ব্যপারটা খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল আর তা নিয়ে লোকজন আলোচনা করেছিল।
দিল যাচ্ছিল নির্মাণকাজ যেখানে চলছিল সেখানে কাজ করতে। রাস্তার পাশে মজমা জমিয়ে একটা লোক পুরুষত্বহীনতা সারায় এমন একটা গাছড়ার গুণকীর্তন করছিল। দিল ওখানে একটুখানি দাঁড়াল। তখন তার চোখ পড়ল সবুজ মাঠে সার বেঁধে দাঁড় করানো একপাল ছাগলের দিকে। ছাগলগুলো একই দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল।
দিল একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘এইখানে কী হইতাছে?’ লোকজনের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘সবাই ছাগলের মাংস কিনছে যাতে মরবার আগে আশা মিটিয়ে একটুখানি ভালো-মন্দ খেতে পারে।’
পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির নিদর্শন হিসেবে সবার দেখাদেখি দিলও এক কেজি ছাগলের মাংস কিনল। বাড়ি ফেরার পথে সে গোপাল ভক্তের দোকানে একটু দাঁড়াল। ওখানে সবাই তার হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো রক্তের ছোপলাগা মাংসের প্যাকেটটা দেখল। তারা ঠাট্টা করে বলল, ‘তা বড়দা আপনার বাড়িতে বড় কী অনুষ্ঠান আজ? এবার দাশাইন উৎসব আগেভাগে পালন করছেন নাকি?’ সে তখন জানাল, কেমন করে বিপুল পরিমাণ ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে আর কসাইরা তুড়িখোল এলাকায় রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। আনন্দ-উসৎব করার মওকা পেয়ে লোকজন শেষ খাবার খাওয়ার জন্য খানিকটা মাংস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গলির দুধ বিক্রেতা সানুকাঞ্চা, ‘কাল সকালে যখন আকাশে সাতটি তাতানো সূর্য উঠে পৃথিবীর সব মানুষ পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে তখন তাদের ১১৬ জনের বিশাল পরিবারের সবাই বাড়িতে একসাথে থাকবার পরিকল্পনা করছে। নিষ্কর্মা-বাউন্ডুলে থেকে ডিজনে ইংলিশ স্কুলের শিক্ষক বনে বিকাশ জানালেন, তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী এই সুযোগে কার্যত একটা ছুটি ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। গোপাল ভক্ত জানালেন, এয়ারপোর্টে কাজ করে তার যে বোন সে বলছে— এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার আশায় লোকজন ‘রয়াল নেপাল এয়ারলাইন্স’এর সব টিকেট বুক করে ফেলেছে।
দিল শাল পাতার ঠোঙায় করে মাংস নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরে কোনো কথাটথা না-বলে ঠোঙাটা কাঞ্চির হাতে দিলো।
‘মাংস আনছো ভালো কথা। ঘরে কিন্তু একমুঠ চাইল নাই, এক ফোটা তেল নাই, এক চিমটি হলদি নাই, এই খবর তোমার আছে? এক কেজি মাংস লইয়া আইছো ড্যাং ড্যাং কইরা। ওই ট্যাকা দিয়া সাতদিন চালান যাইত।’ ক্রুদ্ধ কাঞ্চি বলল।
দুই
‘চুপ কর খানকি মাগি’, দিল বলল, ‘কাইল-ই তো মইরা যাইতে পারোস। মাংসডা মজা কইরা খা-না আইজ’।
‘কিন্তু মাংস আমি রান্দুম কী দিয়া, শরিলের তাপে? বাড়িতে একটুও কেরোসিন নাই।’ দিল আয়েশ করে শুয়ে রইল। তখনও তার শরীরে নির্মাণ এলাকার ধুলোবালি, সিমেন্টের ধূসর গুড়ো আর সদ্য পোড়ানো লাল ইটের গুড়ো লেগে আছে। শুয়ে থেকেই সে সিলিংয়ের দিকে তাকাল। কাজ থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা তার অভ্যাস। কোনো উত্তর না-পেয়ে কাঞ্চি বলল, ‘তা কোন বিরাট একখান উৎসব উপলক্ষে মাংস আনা হইলো?’
কাঠের থামের ওপর লেগে থাকা জলের দাগের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দিল বলল, ‘এইটা হইতাছে দুনিয়া ধ্বংস হইয়া যাওনের দিন।’
আর এভাবেই কাঞ্চি জানল, বিশাল লেজবিশিষ্ট একটা তারকা বৃহস্পতি গ্রহের ওপর ভেঙে পড়বে আর তাতে পৃথিবী ভেঙে টুকরো-টুকরো হবে। এবার কিন্তু কথাটা সত্য, কেননা খোদ টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়েছে। এটা নিছক কোনো গুজব নয়। আরও কিছু খবর অবশ্য আছে যেগুলোর সত্যতা রেডিও যাচাই করেনি। ওই ঘটনার পর অনেকগুলো সূর্য উঠবে—কারও মতে সংখ্যাটা সাত, কারও মতে ৩২ হাজার।
কাঞ্চি কিছু চাল আনার জন্য তার পরিচিত দোকানদার গোপাল ভক্তের দোকানে যাওয়ার জন্য যেই পা বাড়াল, (গোপাল তাকে প্রায়ই ধারে জিনিসপত্র দেয়) ঠিক তখনই একটা পলিথিনের ব্যাগে করে কিছু কমলা নিয়ে তার ছেলে ওখানে এসে দাঁড়াল। কাঞ্চি ঝাঁটা দিয়ে তাকে একটা বাড়ি মেরে বলল, ‘তোরা বাপা-ব্যাটা দুইজনেই পাগল। ঘরে একমুঠ চাইল নাই, আর তুই কিনা কমলা কিনা লইয়া আইলি? মাথায় যদি এক ফোঁটা ঘিলু থাকতো!’ ছেলে দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়ল।
ছেলে ও ছেলের বাবা কিছুই বলল না। এইসব লোককে কিছু বলে লাভ নেই ভেবে কাঞ্চি গজর-গজর করতে করতে ওখান থেকে চলে গেল—‘দুনিয়াদারি ধ্বংস হইয়া যাউক, আমি তোমাগো মতন বেকুবগো লাইয়া ভাত রানতে যামু না।’
সেই রাতে তারা মাংস খেয়েছিল। তবে মাংস রান্না করা হয়নি। বাচ্চারা কিছুটা ঝলসে নিয়েছিল আর সমান করে মাংসগুলোর টুকরো টুকরো কাঠিতে ঢুকিয়ে কয়লার আঁচে সেঁকে নিয়েছিল কাঞ্চি। তার মনে হয়েছিল দুনিয়াদারি তো আর হররোজ ধ্বংস হয় না। মাংসগুলো পরিপাটি করে পরিবেশন করার জন্য সে পাশের ক্ষেত থেকে কিছু ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ তুলে এনেছিল।
তিন
তারপর সবাই একটা করে কমলালেবু খেয়েছিল। ওগুলো আকারে ছিল বড়। খোসা ছাড়ানো মাত্রই কমলার সুঘ্রাণ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোয়াগুলোও ছিল বেশ রসালো। সাধারণত গ্রাম থেকে যে-টক কমলাগুলো আসে সেগুলোর চেয়ে এর স্বাদ ছিল বেশি ভালো। খাওয়া শেষ হলে দিল বলল, ‘কাইল তুমার হাতে যতই কামকাইজ থাকুক, খেয়াল রাখবা পোলাপান যাতে বাইরে না যায়।’
পরে যখন তাদের পাশের বাড়ির কজন মানুষ তাদের মাদল নিয়ে ওদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল আর গ্রাম থেকে এসেছিল কজন অতিথি, কাঞ্চি সবকিছু ভুলে গিয়েছিল। তারা খুব জনপ্রিয় আর পরিচিত কটা গান গাইলেও এ যুগে তা অদ্ভুত শুনিয়েছিল। তারা গেয়েছিল ক্ষেতের ধান আর ঘাসকাটা নিয়ে বাঁধা কটা গান। ওই জীবন সম্পর্কে ছেলে-মেয়েদের কোনো ধারণা ছিল না। তাদের কাছে ওগুলো পুরুত মশাইয়ের কাছে শোনা পবিত্র পরাণের দূরাগত কাহিনি বলে মনে হয়েছিল। বাড়ির ছেলেটা গানের তালে-তালে নাচতে শুরু করে দিলে সবাই উৎফুল্ল হয়ে হৈ হৈ করে উঠেছিল। বাড়িওয়ালি দরজায় উঁকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এতো চিৎকার-চেঁচামিচি কিসের, হয়েছে কী এখানে? মনে হচ্ছে দুনিয়াটা এখনই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
গুরুত্বপূর্ণ দিনটির জন্যে কাঞ্চি যত্ন করে সেজেছিল। আটপৌরে সুতি শাড়ির ওপর জড়িয়ে নিয়েছিল মোলায়েম তুলোর মতো কাশ্মিরি শাল। ওই শালটা তাকে আমেরিকা থেকে এনে দিয়েছিলেন উন্নয়নকর্মী জেনিফার। জেনিফার লম্বা, বিষণ্ন আর নেপালের ওপর সদা বিরক্ত একজন নারী। মেয়েদের ইঞ্জেকশন দিতেন আর তাদেরকে দিতেন ব্যাংকে টাকা জমানোর বুদ্ধি-পরামর্শ। কাঞ্চিকে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘নেপালিরা নিজেদের ভালো-মন্দ বুঝতে অপরাগ।’ এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে নীল ভাই শাড়িটা কাঞ্চিকে পরতে দেখলে জেনিফার খুশি হতেন।
জেনিফার শহরে এলে কাঞ্চি তাঁর অনেক কাজ করে দেয়। তার জন্য ভাত আর মশলা ছাড়া সবজি রান্না করা ছাড়াও ফালি করে কেটে দেয় লাল-লাল কাঁচামরিচ। তিনি তাঁর আঁটোসাটো চকচকে পোশাক পরে টেলিভিশন দেখতে-দেখতে অদ্ভুতভাবে নাচানাচি করার সময় ওগুলো খান। জেনফন্ডা বলতে-বলতে একা একা হাত-পা ছুড়ে নাচতে থাকেন উন্মত্ত সবুজ সাধু একটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো। সেই সময়টাতে তিনি কচমচ করে কাঁচামরিচ খেতে থাকেন। উপহারের ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ না-থাকলেও প্রতিবছর তিনি কাঞ্চিকে একটা-না-একটা পোশাক উপহার দিতেনই।
মিটঠু কাঞ্চিকে জিজ্ঞেস করেছিল, এই গরমের মধ্যে সে শাল গায়ে দিয়েছে কেন? মিটঠু শর্মাদের বাড়ির পুরনো রাঁধুনি। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য কাঞ্চি রোজ সকালে ওই বাড়িতে কাপড় ধোয়ার কাজ করত।
চার
কাঞ্চি তাকে বলেছিল, ‘তুমি শোন নাই? সব্বাই তো আলোচনা করতেছে— আইজ-ই পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইব গা। বড় এক সাধু আগাম কইছেন। স্বামী বা ছাওয়াল কেউ আমার পাশে নাই। শালডা তো অন্তত আছে।’
মিটঠু খুবই ধর্মপ্রাণ নারী। সে নিজে শোনেনি এমন ঘটনা বিশ্বাস না-করা বা মানুষের ওপর সন্দেহ করার ধাত ছিল তার। সে বলেছিল, ‘কীসব আবোল প্যাঁচাল পারতেছো তুমি?’
কাঞ্চি বলেছিল, ‘আইচ্ছা ঘটনাটা যদি ঘটেই তাহলে তুমি কী করবা কও?’ মিটঠু বলেছিল, ‘না, ওই রকম কিছুই ঘটবে না।’
হালকা এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার পর আকাশ কালো হতে শুরু করেছিল। উদ্বিগ্ন হয়ে কাঞ্চি বলেছিল, ‘দিদি, তাইলে ভাতটা খাইয়া লই?’
ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কাঞ্চি ভরাপেটে ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিল। মিটঠুকে সে বলেছিল, ‘পরে আবার খিদা লাইয়া যাইতে পারে।’ কাঞ্চির জন্য চামচ দিয়ে ভাত থালায় বাড়তে-বাড়তে মিটঠু বলেছিল, ‘এইটা কি তোমার শরিলের লাইগা, না আত্মার লাইগা?’ মিটঠু তেতোভাষিণী।
‘ছোট্ট একখান পক্ষীর মতন আত্মা উইড়া যাইবা গা। যখন খিদা লাগবো সে উইড়া গিয়া মাইনষের বাড়ির থিকা চুরি কইরা খাইবো। এই প্যাটটার লাইগা-ই মরণ হইবো আমার।’ কাঞ্চি বলেছিল।
কাঞ্চির পাতে একটুখানি টমেটোর আচার তুলে দিয়ে মিটঠু জানতে চইল, ‘তুমার ওই শালডা কোন্ জায়গায় ওম দিবো তুমারে— স্বর্গে না নরকে?’
‘স্বর্গ বা নরকে আমার শালের দরকার নাই। যদি বাঁইচা যাই এই দুনিয়াতে আমি ছাড়া আর কেউ থাকবো না। শালডা তো অন্তত আমারে ওম দিবো!’
মিটঠু তার কথা না-মানলেও মনে-মনে কাঞ্চির এই চমৎকার দূরদৃষ্টি ও কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়টি স্বীকার না-করে পারল না। ‘হ’, বলেছিল সে, তারপর চোরাচোখে সূর্যের দিকে তাকিয়েছিল। মনে হয়েছিল সূর্য বেশ উজ্জ্বল কিরণ ছড়াচ্ছে।
মিটঠু ভেবেছিল সে-ও একটা শাল নিয়ে আসতে পারে। যদি কাজে লাগে, কিন্তু তারপর নিজের অহংবোধ তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
ঝকমকে নীল আকাশে ঝলসে উঠেছিল বিদ্যুৎ, শোনা গিয়েছিল বজ্রের গর্জন। ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল কাঞ্চি। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে সে ভেবেছিল, ‘আমি একটা ভীতুর ডিম। মোটেও সাহস নাই আমার।’ কাঞ্চিকে ভয় পেতে দেখে তার পাতে একটুখানি ডাল দিয়ে মিটঠু বলেছিল, ‘আরে, এতো ডরাও ক্যান, খাও।’
‘আইজ সকালে শান্তা বাজাই-রে ঝড়ের বেগে অফিসে যাইতে দেখলাম। দুনিয়ার কেউ অফিসে না-গেলেও সে যাইবো। মরলে নিজের চেয়ারে বইসাই মরবো।’
মিটঠু বেশ সতর্কতার সাথে বলেছিল, ‘এখন কও আমারে, দুনিয়া ক্যান ধ্বংস হইয়া যাইবো?’ সে এসব একেবারেই বিশ্বাস করে না। তারপরও কৌতূহল ছিল তার।
পাঁচ
কাঞ্জি ব্যাখ্যা করে বলেছিল, সবই হইতাছে গিরিজার কারণে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ওজনের পর থিকাই সবকিছু ঘটতাছে। দিনের পর দিন তিনি খালি আম্রিকা যাইতাছেন, তখন থিকাই এইসব শুরু হইছে। আমি শুনছি তিনি অজ্ঞান হইয়া মাটিতে পইড়া গেছিলেন, আর সেইসময় আম্রিকার রাজা তাঁরে ওষুধ কিনবার লাইগা ট্যাকা দিছিলেন। সেইখান থিকা ফিরার পর সকল বিনাশ শুরু হইছে। এমুন হইতে পারে আম্রিকার রাজা ট্যাকা দেওনের কারণে প্রধানমন্ত্রী আমাগো দ্যাশ তাগো কাছে বেইচা দিছে। হয়তো অহন কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল কইরা ফালাইবো।’
‘শোনো কাঞ্চি, গেরামে থাকনের সময় আমি পেরায় কমিউনিস্ট বইনা গেছিলাম। কথাডা শুনতে ভালোই লাগে—আমরা এক লগে কাজকাম করুম, মিলাঝিলা থাকুম, বড়-ছোটর ভেদাভেদ থাকবো না। তেমন হইলে আমরা বড় লোকগো খতম করবার পারুম, আর শান্তি আসবো দ্যাশে।’
কাঞ্চি বলল, ‘খাওয়াদাওয়ার বিষয়ডা কইলা না? আমরা কি তখন একই থালায় একলগে বইসা খাইতে পারুম? কিন্তু তুমি এসবের লগে নিজেরে মানাইয়া লইবা কেমনে বাহুলি? তোমার খাওনের থালার উপরে কেউ নজর দিছে এমুন সন্দেহ করলেও তুমি খাওন ফালাইয়া দেও।’
মিটঠু খুঁতখুঁতে স্বভাবের ব্রাহ্মণ নারী। কেউ মহিষের মাংস খায় এমন সন্দেহ করলে সে তাকে তার রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয় না। সে ভেবেছিল, ওই বিষয়টা সে লক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
‘আর সেই সময় কী হইবো জানো? তুমি না-মরা পর্যন্ত তুমারে দিয়া কাম করাইবো,’ ‘কাঞ্চি, ‘আবার কইও না, এইটা লইয়া আমি ভাবি নাই। আমি বরঞ্চ এই জীবনটাই পছন্দ করি। রাইতে আমার পোলাডা অন্তত আমার লগে থাকপার পারবো।’
‘শুনছি কমিউনিস্টরা পুলাপানরে লইয়া যায় আর মায়েগো নানান জায়গায় কাম করতে পাঠায়। যে-কাম তারা দেয় তা না করবার পারলে গুল্লি কইরা মাইরা ফালায়। এই রকম কইরা বাঁইচা থাইকা কী লাভ কও?’
তারপরও মিটঠু কাঞ্চির প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পিছপা হয়নি। তার বয়স যখন নয় বছর তার স্বামী মারা যায়। এ-কারণে বাচ্চাকাচ্চচার কাছ থেকে বিছিন্ন হওয়ার ভয় নেই তার। সে বলছিল, ‘যেই সুমায় এইসব ঘটবো সেই সুমায় দেখন যাইবো।’
কাঞ্চি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তার মানে দুনিয়া ধ্বংস হওনের মতন ব্যাপার আর কী। এই ধ্বংস হওনের আগাম খবর দিছেন যে- সাধু তারে তো হনুমান ধোকার জেলে নিয়া আটকাইয়া থুইছে। তারা কইছে দুনিয়া ধ্বংস না-হইলে তারে ফাঁসিতে লটকাইবো। আবার কিছু মানুষ কইতাছে, তিনি শান্তি হোম করতেছিলেন আর আগুন এতো উপরে উঠছিল যে, তার শরিলে আগুন ধইরা গেছে। হাসপাতালে ভর্তি করা হইছে তারে। কী হইবো ক্যাডা জানে!’
ছয়
বেলা ১১টা। হঠাৎ আশ্চর্য এক নীরবতা নেমে এসেছিল পৃথিবীতে—কিছু একটা ঘটার সম্ভাবনা নিয়ে। আর তখনই মাঝ সকালের তাবৎ নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গরুগুলো হাম্বা-হাম্বা করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল; কুকুরগুলো দীর্ঘ সময় ধরে তারস্বরে ঘেউ-ঘেউ করেছিল। কানে ভেসে এসেছিল মানবকণ্ঠের ভয়ার্ত আর্তনাদ। আকাশ ধারণ করেছিল ধূসর রং। পূর্ণ তেজে দীপ্তি ছড়িয়েছিল সূর্য।
দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা পার হয়ে গেলে গোটা কাঠমান্ডু উপত্যকার সবার মনে স্বস্তি নেমে এসেছিল…

দিলওয়ার হাসান
জন্ম মানিকগঞ্জে। কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। প্রথমে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে চলে যান ব্যাংকিং পেশায়। গল্পগ্রন্থ : আদম ও ইভের গল্প, ওস্তাদ নাজাকাত আলি কর্নেলকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, সরলা এরেন্দিরা ও ডানাকাটা পরি, জনাকীর্ণ গুলিস্তানে জাদুবাস্তবতার মহলা, একটি ইঁচড়েপাকা সাক্ষাৎকারের বয়ান, হাতি নিয়ে হইচই। অনূদিত গ্রন্থ : অন্যদেশের গল্প, টু উইমেন [আলবের্তো মোরাভিয়া], আইজ্যাক সিঙ্গারের ছোটগল্প, হারুকি মুরাকামির শ্রেষ্ঠগল্প, পৃথিবীতে শেষ সন্ধ্যা ও অন্যান্য গল্প [রোবার্তো বোলানিও], তিন নভোচারী [উমবের্তো একো], লাতিন আমেরিকার গল্প : ঘুম আর জাগরণের মাঝে, আমি কেমন করে আমেরিকায় হারিয়ে গিয়েছিলাম [আইজ্যাক সিঙ্গার], তেতো স্বর্গ মিঠে পৃথিবী, অমৃতা-ইমরোজ একটি প্রেম কাহিনি ইত্যাদি।