নারীবাদ: প্রবাহ ও তত্ত্ব
নারীর অধিকার আদায়ের প্রয়াসই নারীবাদ। এই অধিকার রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত। অনেক ক্ষেত্রেই নারী তার উপর অর্পিত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নারীবাদ সে অধিকার আদায়ের সংস্থা বা সংগঠন [agency] হিসাবে ভূমিকা পালন করে। এই সাংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গে অর্থাৎ অধিকার আদায়ের প্রক্রিয়ার সাথে যারা সক্রিয় বা নিষ্ক্রীয়ভাবে জড়িত থাকে তারা সবাই নারীবাদী। সে ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ নারীবাদী হতে পারে।
নারী-পুরুষের যেসব পার্থক্য প্রকৃতি প্রদত্ত তা হচ্ছে লিঙ্গ বা লৈঙ্গিক বিভাজন। যেমন: সন্তান উৎপাদন, তাকে দুগ্ধ (স্তন) পান করানো, তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। প্রাকৃতিক এ পার্থক্য নারী পুরুষের জৈবিক বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন এবং নির্দিষ্ট কিছু ভূমিকা বা পরিচিতি নির্ধারণ করে দেয় যা লিঙ্গ বা লৈঙ্গিক বিভাজন নামে পরিচিত। অপরদিকে সামাজিকভাবেও নারী-পুরুষের পার্থক্য, পরিচয় এবং ভূমিকা নির্ধারণ করা হয় যা জেন্ডার বা জেন্ডার বিভাজান নামে পরিচিত। যেমন কোনো কোনো সমাজ মনে করে রান্নাবান্না, ঘর-গেরস্থালি সামলানো, বাচ্চাদের লালন-পালন করা ইত্যাদি মেয়েদের কাজ। উপার্জন করা, অবাধে বাইরে যাতায়াত ও অবস্থান, নীতি নির্ধারণ, যেকোনো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হওয়া পুরুষের কাজ।
জেন্ডার ও লৈঙ্গিক পার্থকের সুযোগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে নানারকম অসমতা জিইয়ে রাখা হয়। এ অসমতার ফলেই নারীরা অধিকারবঞ্চিত এবং নানারকম নির্যাতন ও বৈষম্যর শিকার। সব ধরণের নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনা প্রতিরোধ এবং পরিবার-কর্মক্ষেত্র-সমাজ-রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই নারীবাদ।
মাতৃতান্ত্রিক পরিবারপ্রথা ভেঙে যখন সমাজে পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই নারীরা পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এ ব্যবস্থা ক্রমেই নারীকে সমাজ কাঠামোর পিছনের সারিতে ফেলে দেয় । বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় এক পক্ষ এগিয়ে গেলে অপর পক্ষ অবশ্যই পিছিয়ে পড়বে। এই পিছিয়ে পড়ার নমুনা হিসেবে দেখা যায়, নারী-পুরুষ দুজন মিলে সংসার গঠন করলেও নারীকে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দেওয়া, সন্তানের পরিচয় পিতার দিক থেকে নির্ধারিত হওয়া ইত্যাদি। এর সঙ্গে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় সম্পদে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে এমনকি সন্তান ধারণের আগ্রহের ক্ষেত্রেও পুরুষের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেতে থাকে। ফলে নারী সব ক্ষেত্র থেকেই হয়ে পড়ে প্রান্তিক।
কোনো কোনো পরিবারে এখনও স্বামী বা পিতার কাছে স্ত্রী বা কন্যা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এভাবে পিতৃতন্ত্র নারীকে পুরুষের দাসী ও লালসার বস্তুতে পরিণত করেছে। ফলে পরিবার , সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষের কর্তৃত্ব জোরদার হয়েছে। ফলে খাদ্য , বাসস্থান , প্রতিকূলতা মোকাবেলা, জীবনযাপনে নারীকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এছাড়া ঋতুস্রাব, গর্ভধারণ, প্রসবোত্তর স্পর্শকাতরতা, সন্তানের লালনপালন ও শারীরিক গঠন নারীকে পুরুষের অধীনতায় সমর্পিত করেছে। অথচ আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে, সমাজ গঠনের শুরুর দিকে নারী-পুরুষের এই বৈষম্য ছিল না। ফলে নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা এবং সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করলেও এক সময় নানাভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে। শুরু হয় নারীবাদী আন্দোলনের যাত্রা।
নারীবাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা পঞ্চদশ শতাব্দীতে শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়। আধুনিক নারীবাদের জন্ম হয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে।
নারীবাদ প্রত্যয়টি ১৮৩৭ সালে ফরাসি দার্শনিক কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক চার্লস ফুরিয়ার সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। উনিশ শতকের আশির দশকে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডে শব্দ দুটির প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে গ্রেট ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদ ও নারীবাদী প্রত্যয়ের বহুলব্যবহার দেখা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় নারীবাদ ধীরে ধীরে নারীর স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার্থে একটি মতবাদ বা আদর্শ হিসাবে সন্মুখবর্তী হতে থাকে।
বলা দরকার নারীর অধিকার আদায়ের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে পরিবারে ও সমাজে গোপনে লালিত হচ্ছিল। কোথাও কোথাও তা প্রকাশ্যে এসেছিল। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, মানুষ হিসেবে তার অধিকারের কথাবার্তাগুলো ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। বিভিন্ন সময় সেই প্রবাহ এবং সেগুলোর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নারীবাদী তত্ত্বের পরিচয় দেওয়াই আমাদের এই রচনার উদ্দেশ্য।
আধুনিক নারীবাদ বা নারীমুক্তির প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেরি ওলস্টোনক্রাফটের [Marry Wollstonecraft] A Vindication of the rights of women বইটি। অনেকে বইটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাথে তুলনা করেন। আবার কেউ কেউ একে “নারীমুক্তির ঘোষণা বা মহাইশতেহার” বলে অভিহিত করেছেন। মেরিই প্রথম নারীবাদী, যিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন, নারী বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ; সে যৌনপ্রাণী নয়। সুতরাং নারীকে তার প্রাপ্য স্বাধীকার দিতে হবে। এরপর নারীবাদী আন্দোলন ক্রমশ পরিকল্পিত এবং সংগঠিতভাবে পরিচালিত হতে থাকে। কালক্রমে আধুনিক পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলন ৩টি (তিনটি) ধারায় প্রবাহিত হয়। এখানে স্বল্প পরিসরে ধারা বা প্রবাহ তিনটির পরিচয় দেওয়া হল :
প্রথম প্রবাহ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদের প্রথম প্রবাহ পরিলক্ষিত হয়। অনেকে এ পর্বকে প্রারম্ভিক নারীবাদী আন্দোলন নামেও অভিহিত করেন। এ পর্বের আন্দোলন মূলত নারীদের নানা দুঃখ কষ্ট, ভোগান্তি ও হয়রানির প্রতিকারে সোচ্চার ছিল। নানা রকম চুক্তি-সমঝোতা, বিয়ে, সন্তান জন্মদান, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ইত্যাদি বহুলউচ্চারিত দাবি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। দাসব্যবস্থার বিলোপ এবং নারীর ভোটাধিকারের দাবিতেও নারী আন্দোলনের প্রথম পর্ব স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিল। ধারণা করা হয়, এই আন্দোলনের ফল স্বরূপ ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে এবং ১৮৯৫ সালে সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার নারীরা ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন। ১৯১৮ সালে ৩০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীর ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ব্রিটেনে আইন পাশ হয়। নারীবাদী আন্দোলনের এই স্তরে যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্ত্ব দিয়েছেন লুক্রিসিয়া মট [Lucretia Mott], এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন [Elizabeth cady stanton], সুসান বি এন্থনি [Susan B. Anthony] প্রমুখ। ব্রিটেনে নারীবাদী আন্দোলনের এই স্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জন স্টুয়ার্ট মিল [Jhon Stuart Mill]।
দ্বিতীয় প্রবাহ
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে নারীবাদের দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হয়। এ পর্বটি মূলত নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমতা বিধানের দাবিতে পরিচালিত হয়। নারী-পুরুষের সমান বেতন, সমান শিক্ষার সুযোগ, জন্মনিয়ন্ত্রণে নারীর স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়গুলো এ পর্বে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে আসে। ১৯৬৩ সালে বেটি ফ্রাইডেন তাঁর The Feminine Mystique গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে তৎকালীন শিক্ষিত নারীদের অসন্তোষ ও স্বপ্নভঙ্গ উপস্থাপন করা হয়েছে। যেসব শিক্ষিত নারী আশানুরূপ চাকরি পাননি তাদের এককভাবে গৃহের কাজে (রান্না করা ও ঘরগোছানোর কাজ) বাধ্য করা হয়েছে। বেটি ফ্রাইডেন নারীর জীবনে পরিপূর্ণতা আসে ‘সন্তান প্রতিপালনে এবং গৃহকর্ম সম্পাদনে’—এ মতাদর্শের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। তাঁর মতে নারী একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ব্যবস্থার শিকার, যে ব্যবস্থা নারীকে স্বামী ও সন্তানের মাঝে নিজ জীবনের পরিচয় ও অর্থ খুঁজতে এবং নারীকে পরিবারের পরিচিতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজের পরিচিতি বিসর্জন দিতে বাধ্য করে। সমাজে নারীর ভূমিকার এই নতুন ব্যাখ্যা নারীমুক্তি আন্দোলনের পথ দেখায় এবং ‘মুক্তি’ নারীর আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ হিসেবে পরিগণিত (বাংলাপিডিয়া) হয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নারী অধিকারের বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন, আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, জাতিসংঘের নারী অধিকার দশক ঘোষণা ইত্যাদি উদ্যোগ নারী অধিকারের পক্ষে জনসচেতনতা এবং জনমত গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। যা বর্তমানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তৃতীয় প্রবাহ
বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে নারীবাদের তৃতীয় প্রবাহ বা পর্ব শুরু হয়। তৃতীয় প্রবাহের নারীবাদীরা মূলত সেই নারী যারা নারীবাদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে বেড়ে উঠেছেন, সম্ভবত নারীবাদী মা দ্বারা এবং নারীবাদী পারিবারিক আবহে। এবং যাদের ‘জাতি’ এবং ‘শ্রেণি’ সম্পর্ক সন্মন্ধে একাডেমিক ধারণা আছে বা ‘জেন্ডার অধ্যয়ন’ বিষয়ে পড়াশুনা আছে। এই তরুণ-তরুণী ও বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষিত মহিলারা পোস্ট-স্ট্রাকচারালিস্ট এবং পোস্ট-মডার্নিস্ট তত্ত্বের মুখোমুখি হয়ে নারীবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। যেমন রেবেকা ওয়াকারের (লেখক অ্যালিস ওয়াকারের কন্যা) এই তৃতীয় ধারাকে কেউ কেউ ‘পোস্ট-ফেমিনিজম’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। আবার নারীবাদী আন্দোলনের এ পর্বটিকে সমসাময়িক নারীবাদ বলেও অভিহিত করা হয়। এ স্তরে এসে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীদের সাথে সাথে ক্রমশ নিম্নবিত্তদেরও অধিকার সচেতন হয়ে উঠতে ভূমিকা রেখেছে। শিক্ষা ও পেশাগত সমতা এবং উন্নয়নের পাশাপাশি তারা অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, রাষ্ট্র এবং স্থানীয় সরকার পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য তারা ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠেন। নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন ফোরামে নারীর অংশগ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়।
নারীবাদোত্তর আন্দোলন
নারী অধিকার ও নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় একবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সমাজে পরিচালিত কার্যক্রমকে নারীবাদোত্তর আন্দোলন বলা হয়। এ পর্বের নারীরা মনে করেন ইতোমধ্যে সমাজে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিজীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শিক্ষা ও পেশায় অভিগম্যতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এই অগ্রগতি একটি নির্দিষ্ট সীমায় আটকে আছে। কোনো কোম্পানির মালিকানা, প্রধান নির্বাহীর পদে আসীন হওয়া, রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। একবিংশ শতাব্দীর নারীবাদোত্তর আন্দোলনে এগুলো গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে (ইকবাল,হু:২০২২;)।
উল্লেখ্য, নারী অধিকার রক্ষার্থে প্রথম সংগঠিত আন্দোলন সেনেকা ফলস কনভেনশন। এটি নারীরা নিজেকে “সামাজিক, নাগরিক এবং ধর্মীয় অবস্থা এবং মহিলাদের অধিকার নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি কনভেনশন” হিসাবে প্রচার করেছিলেন। কনভেনশনটি ১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস শহরের ওয়েলসিয়ান চ্যাপেলে অনুষ্ঠিত হয় ও এটি ১৯-২০ জুলাই দুই দিন ধরে চলেছিল। সেসময় এই কনভেনশনটি সবার মধ্যে ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং দুই সপ্তাহ পরে নিউইয়র্কের রচেস্টারে রচেস্টার মহিলা অধিকার কনভেনশনসহ অন্যান্য মহিলা অধিকার কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ১৮৫০ সালে ম্যাসাচুসেটসের রচেস্টারে বার্ষিক জাতীয় নারী অধিকার কনভেনশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেনেকা ফলস কনভেনশনের নেতৃত্বে ছিলেন এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন ও তার বন্ধু লুক্রেসিয়া মট। সেনেকা ফলস কনভেনশনের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দেশে নারীর ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করে বহু জাতীয় মহিলা অধিকার সম্মেলন প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৮৯৬ সালে এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ত্ব পালন করেন। সেনেকা ফলসে মহিলাদের ভোটাধিকার আন্দোলন শুরু হওয়ার ৭০ বছরেরও বেশি পরে কংগ্রেস ১৯তম সংশোধনী পাশ করে যা ১৯০৫ সালে মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছিল। এই যুগান্তকারী বিজয় আমেরিকান নারীদের জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে নারীবাদের নতুন ক্ষেত্র সূচনা করেছিল এবং প্রজনন অধিকার, যৌনতা, পরিবার, কর্মক্ষেত্র, অভিবাসন এবং লিঙ্গ সমতায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। এ পর্যায়ে বিশ্বের দেশে দেশে যেসব নারীবাদী তত্ত্ব বিকশিত হয়েছে সেগুলোর পরিচয় দেওয়া হল।
উদারপন্থী নারীবাদ: ব্রিটিশ লেখিকা মেরি ওলস্টোনক্রাফট তার A Vindication of the rights of women (১৭৯২) গ্রন্থের মাধ্যমে উদারপন্থী নারীবাদের প্রবর্তন করেন। এ তত্ত্বে সামাজিকীকরণ ও লিঙ্গের ভূমিকা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হয়, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, পুরুষ ও নারীর ভূমিকা জৈবিকভাবে নির্ধারিত হয় না। উদারপন্থায় বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই নারী-পুরুষের সমতা বিধানের প্রয়াস চালানো হয়। সমাজ কাঠামো কিংবা উৎপাদনযন্ত্রের পরিবর্তন ছাড়াই সমাজে নারী অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা উদারপন্থী নারীবাদের মূল লক্ষ্য। এ মতবাদেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার, মর্যাদা (যা রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার কর্তৃক অর্পিত) ও ভূমিকার উপর গুরুত্ত্বারোপ করা হয়েছে। এ ধারণার ভিত্তিতে এ মতবাদকে মানবতাবাদী ও ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ বলেও অভিহিত করা হয় (আজাদ, হুমায়ুন : ২০০০:৩৭৩)। ব্রিটিশ দার্শনিক John Stuart Mill এবং তার সহধর্মিনী Harriet Taylor Mill এর The subject of women (১৮৬৯) গ্রন্থের মাধ্যমে ধারাটি আরো বেশি পরিপূর্ণতা লাভ করে।
কট্ররপন্থি নারীবাদ: বোভেয়ার (Simone de Beauvoir), মিলেট (Kate Millet), গ্রিয়ার (Germine Greer) প্রমুখ কট্ররপন্থী নারীবাদের প্রবক্তা ও পৃষ্ঠপোষক। প্রবক্তারা এ তত্ত্বের যাত্রা শুরু করেন এই বলে যে, সকল নারীনির্যাতনের উৎস হচ্ছে পুরুষ। জৈবিক কারণেই নারী-পুরুষ পরিবার গঠন করে। গর্ভধারণ ও শিশু পালন করতে গিয়েই নারী বৈষম্যের শিকার হয় ও পুরুষের বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এর মূল বক্তব্য হচ্ছে, নারী নির্যাতন, নারীর অধিকারহীনতা কিংবা অসমতার মূলে রয়েছে লৈঙ্গিক পীড়ন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা উচ্ছেদের মাধ্যমে নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করাই কট্ররপন্থী নারীবাদের মূল লক্ষ্য।
মার্কসবাদী বা সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ: এঙ্গেলস [Friedric Engles] তাঁর The Origin of the Family, Private Property and Ownership বইতে মার্কসবাদী বা সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী নির্যাতন কেবল পুঁজিবাদী সমাজেই দেখা যায়। মার্কসবাদে মনে করা হয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারী নির্যাতন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের মতে নারীর প্রতি শোষণ, বৈষম্য ও নির্যাতনের মূলে রয়েছে ব্যাক্তিগত মালিকানা। সম্পদে ব্যাক্তিগত মালিকানা বিলুপ্তির মাধ্যমেই নারীমুক্তি সম্ভব বলে এ মতবাদে মনে করা হয়।
পপুলার নারীবাদ: গত শতকের সত্তর-এর দশকে ল্যাতিন আমেরিকায় পপুলার নারীবাদের চর্চা শুরু হয়। দারিদ্র্য থেকে মুক্তির লক্ষে শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই হচ্ছে পপুলার নারীবাদ । এখানে নারী তার চিরায়ত ভূমিকাকেই কাজে লাগিয়ে নারীমুক্তির সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে।
লেসবিয়ান নারীবাদ: নারীমুক্তির জন্য সর্বশক্তি নিয়ে নারীকেই নারীর পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণাই হচ্ছে লেসবিয়ান নারীবাদ। শেলা জেফ্রি ও আরও কতিপয় নারীবাদী গত শতকের আশির দশকে এ নারীবাদের সূচনা করেন। নারীবাদী আন্দোলনের এ ধারায় মনে করা হয়, নারীর শক্তি, সামর্থ্য, প্রচেষ্টা সবকিছু পুরুষের পরিবর্তে নারীদের জন্যই নিয়োজিত করা উচিত।
মনঃবিশ্লেষণাত্মক নারীবাদ: মনঃবিশ্লেষণাত্মক নারীবাদ হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব যেখানে মনে করা হয়, বংশগত বা উত্তরাধিকার সুত্রেই পুরুষরা নারীদের উপর আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা পালন করেন। মনঃসমীক্ষকরা মানুষের মন বিশ্লেষণ করে মানসিক রোগের চিকিৎসা করেন। এই তত্ত্বে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণকে অবচেতন মনের প্রকাশ মনে করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, এর সঙ্গে নারীবাদের যোগাযোগ কি ধরনের? নারীর অবদমনের কারণ অনুসন্ধানে মনঃসমীক্ষণে ১৯৭০-এর দশক থেকে নারীবাদে বেশ আলোচিত হয়ে আসছে। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণে যৌনতার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের বিকাশের সম্পর্ক আলোচনা করেন। ব্যক্তির মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াতে মানুষ কীভাবে নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠে, ফ্রয়েড তা দেখিয়েছেন। পরে ফরাসি মনঃসমীক্ষক জাক লাঁকা এ নিয়ে কাজ করেছেন। নারীবাদীরা এই দুই তাত্ত্বিকের আলোচনা থেকে মনে করেন, যৌনতার রাজনীতি আসলে নারীকে অবদমিত করে রাখার একটা কৌশল। এ কারণে মনঃবিশ্লেষণী নারীবাদীরা বৈষম্য দূর করার জন্য নারীর মনের অবচেতন অবস্থাকে সচেতন করার উপর জোর দেন।
কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ: কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আফ্রো নারীবাদ নামে পরিচিত। এটি নারীবাদের এমন একটি শাখা যা অন্য বর্ণের নারীদের (সাদা হিসেবে বিবেচিত নয় এমন কোন) কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ দর্শন এই ধারণার উপর কেন্দ্রীভূত যে “কৃষ্ণাঙ্গ মহিলারা সহজাতভাবে মূল্যবান। দাসত্ব হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের বীজতলা। এই অদ্ভুত প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং অন্যান্য নারীবাদী নারীদের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, যা কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান ডায়াসপোরার বাইরে চিহ্নিত সকল নারীর মধ্যে প্রাথমিক আধিপত্যবিস্তারকারী পার্থক্য। দাসপ্রথা এবং মার্কিন আইনের নীতিশাস্ত্রের মধ্যে চ্যাটেলের মতাদর্শে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা এবং তাদের দেহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা ধর্ষণের মতো লিঙ্গ সহিংসতা নিয়ন্ত্রিত এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। দাসত্ব-পরবর্তী সময়ে, সোজর্নার ট্রুথ, আনা জুলিয়া কুপার, ইডা বি ওয়েলস, মেরি চার্চ টেরেল ও ফ্রান্সেস হার্পারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বুদ্ধিজীবী এবং অ্যাক্টিভিস্টরা কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদের ভিত্তি হয়ে উঠবে এমন নীতিগুলো চালু করেছিলেন। এই মহিলারা এমন বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন যা আগে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের জন্য শোনা যায়নি, যেমন জনসাধারাণের মধ্যে বক্তৃতা দেওয়া, ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করা এবং পুনর্গঠনের পরে যাদের সাহায্যের প্রয়োজন তাদের সহয়তা করা।
নতুন শতাব্দী “ঐতিহ্যবাহী” নারীবাদ থেকে দূরে চিন্তাভাবনায় একটি পরিবর্তন এনেছে। তৃতীয় ধারার নারীবাদ নারীবাদী সক্রিয়তা ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আরও আন্তঃসংযোগের প্রয়োজনীয়তা দাবি করে। তদুপরি, প্রযুক্তির অগ্রগতি একটি নতুন ডিজিটাল নারীবাদের বিকাশকে উৎসাহিত করেছে যা চতুথ শিল্প বিপ্লবের উত্থানকে আরও টেকসই করবে এবং আধুনিক সমাজব্যাবস্হাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. আলম খুরশিদ: ২০১৩, সমাজবিজ্ঞানের ধ্রুপদী ও আধুনিক তত্ত্ব, পৃঃ ২০৩-২১৩,
২. আজাদ হুমায়ুন: ২০০০, নারী, পৃঃ ২০০,
৩. হুসাইন ইকবাল: ২০২২, সামাজিক আন্দোলন, প্রত্যয় তত্ত্ব বাস্তবতা, পৃঃ ২৩২-২৫৫
৪. আলম খুরশিদ: উন্নয়নমূলক সমাজবিজ্ঞান
মহিলাদের অধিকার আন্দোলন এবং সেনেকা জলপ্রপাতের মহিলা—জীবনী—2023 (cril17.org)
৫। Ami S Wharton (1988), The Sociology of Gender: An Introduction to Theory and Research (Key Themes in Sociology),Blackwell Publishing.
৬। বাংলাপিডিয়া
Seneca Falls Convention—Wikipedia
Women’s suffrage—Wikipedia
Women’s Liberation Movement—Definition and Overview (thoughtco.com)
Women’s liberation movement—Wikipedia
MeToo movement—Wikipedia
International Women’s Strike—Wikipedia
Feminist art movement—Wikipedia
Women’s Strike for Equality—Wikipedia
Women’s Pentagon Action (wloe.org)
A Yellow Rose Project | Boston University Art Galleries (bu.edu)
Women’s health movement in the United States—Wikipedia
Feminist Majority Foundation—Wikipedia
Women’s Strike for Equality—Wikipedia

আরিফাতুল কিবরিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। চীনের Renmin University থেকে ‘social structure and inequality in modern Bangladesh; A Quantitative analysis’ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। সেজন্য শিখেছেন চীনা ভাষা। ঢাকার একটি খ্যাতনামা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। লেখালেখি করেন নারীবাদ নিয়ে। গবেষক হিসেবে তাত্ত্বিক দিক থেকে ডিকলোনিয়াল ও ইনডিজিনাস দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা করেন।