নৈসর্গিক মানুষ : কামরুল ইসলামের কবিতা
ডব্লিউ বি ইয়েটসের কবিচৈতন্যকে বাস্তবতার নিদারুণ হৃদয়বত্তা দিয়েছিল তাঁর স্বদেশ, আয়ারল্যান্ডের বীরত্ব ও ঐতিহ্যের অনুরঞ্জন। ইয়েটসের প্রজ্ঞা ও প্রতিভা-অন্তর্গত নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নতার অন্তর্লীন শক্তির উৎসও ছিল স্বদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণের লোকায়ত অনুষঙ্গ। এই সমস্ত সম্ভবপরতাকেই তিনি রূপায়িত করেছিলেন আধুনিক কবিসত্তার প্রবল আবেগ ও মনীষায়। স্বদেশের কোমল মাটির লোকায়ত সেই আবেগ—চিরন্তন, স্বাধীন শক্তি ও চৈতন্যের বিমুগ্ধ অস্তিত্বের নিবিড় উৎসকে চিহ্নায়িত করে বাংলা আধুনিক কবিতার বীজ ত্রিশেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। কালের অনিবার্য নির্ঘোষ ও সংক্রামে তা এক অপরাক্রান্ত মহীরুহ। এবং তার বিস্তার ও বিকাশ সাম্প্রতিকের নানা উপাচারে, অনুষঙ্গে হয়ে উঠেছে দিগন্ত-অনুসন্ধানী। সেই মহীরুহের শিকড় একদিকে যেমন প্রোথিত বাংলার সুপ্রাচীন প্রত্ন ইতিহাস-ঐতিহ্যের গভীরে, অন্যদিকে তার শাখা-প্রশাখা নীলাভ্রের কলুষ বিষবাষ্পে ম্রিয়মাণ ও যন্ত্রণাদগ্ধ। জীবন ও অস্তিত্বের এই যৌথচেতনা কবির সচেতন সত্তার অন্তঃপুরে ছড়িয়ে দেয় বিবমিষা ও বিষ। জীবনের এই বিষ পান করে কবি নীলকণ্ঠ, তিনি কবি কামরুল ইসলাম :
অসহ্য দহনের নিচে নিঃসঙ্গ মাছের দিনপঞ্জি ধরে
আর কতদূর যেতে পারি আমি?
মেধাবী দেওয়ালগুলো ভরে গেছে ভুল বানানের পোস্টারে
আমি সে পোস্টারগুলো শোধরাতে এসে বিফলতায় জড়িয়ে
ফেলি মন; লাল মোরগের ঝুঁটির আলোয় শুরু হচ্ছে
উৎসব—আমি এ উৎসবের তলায় বুনে দিই কবিতার বীজ
কামরুল ইসলামের সেইসব ঝড়ের মন্দিরা কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশই আমাদের জানিয়ে দেয় ব্রাত্য ঘরানার নিঃসঙ্গ, বিষণ্ন এই কবির স্মৃতিসত্তা ও চৈতন্যের অন্তগূঢ় আকাঙ্ক্ষা। কবির সমস্ত সত্তার চৌকাঠে বেজে ওঠে ঝড়ের নিনাদ। এইসব ঝড়ের অভিজ্ঞান ‘নিঃসঙ্গ দুপুর কিংবা চৈতি হাওয়ায়… চৈতন্যের শিরায় শিরায়’ কবির মর্মে ‘জাগিয়ে তোলে বিমূর্ত সন্ধ্যার আঁধার’; কবিকে ফিরে আসতে হয় শৈশবের স্মৃতিময় রুমাল উড়িয়ে। কিন্তু শৈশবে ফেরা যায় কি? আমরা কি করতল মেলে ঝরা শেফালির মতো কুড়িয়ে নিতে পারি আমাদের কোমল কৈশোর? তুলে নিতে পারি কি তার ঘ্রাণ ও অতুল ঐশ্বর্য আপন ওষ্ঠে? কৈশোর তো কেবলই আমাদের করতল থেকে হারিয়ে যায়, আর চৈতন্যের কুটিরে জ্বেলে দেয় দুঃখের প্রদীপ। ফেরার এই অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা কেবল অন্তর্গত নিঃসঙ্গতাই বাড়িয়ে দেয়। কামরুল ইসলামের কবিতায় কোমল কৈশোর এবং নিসর্গ এক আশ্চর্য অদৃশ্য সুতোয় আমাদের চেতনা ও অস্তিত্বকে বিমুগ্ধ করে, করে বিবসিত। জীবনের পরতে পরতে বেজে ওঠে কৈশোরের আবেগ ও স্মৃতির সিম্ফনি। একইভাবে লক্ষণীয়, এই স্মৃতির পদাবলি তিনি রচনা করেন বাংলাদেশের গ্রামজীবন ও প্রকৃতির নিবিড় শুশ্রূষায়। এবং তাঁর স্মৃতিপদাবলির কেন্দ্রে বিচরণ করে মানুষ, মানুষের মনোজগৎ, ‘মানুষের একাকিত্বের বিদ্যা ও দর্শন’। এ কারণে, কবিতার বিষয় ও বিন্যাসের বৈচিত্র্যে, কামরুল ইসলামের কবিতা আধুনিক। গ্রামজীবনের অনুষঙ্গের সঙ্গে করপোরেট পৃথিবীর আক্রান্ত মানুষের করুণ নিয়তি, গ্লানি; বহুজাতিক আগ্রাসনের যন্ত্রণা ও অবদমিত মানবাত্মার কান্না তাঁর কবিতার অন্তর্স্রোতে প্রবহমান। বিশ্বগ্রাসী রক্তলোলুপতার বিরামহীন বিষোদ্গারের মধ্যে তিনি অনুসন্ধান করেছেন মানবিকতার শক্তি। তাঁর এই বোধ ও অভিজ্ঞানের আশ্রয় নৈসর্গিক বাংলার চিরন্তন জীবন ও সংস্কৃতি। একই সঙ্গে কবিতার জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র একটি ভাষা, যা অগ্রজ বা সমকালীনদের চাইতে পৃথক। তাঁর প্রকৃতির চিত্র ও চিত্রকল্প জীবনানন্দীয় নয়, বিভূতিভূষণের নিশ্চিন্দিপুরেরও নয়; তাঁর মানবিকতার বয়ান বিষ্ণু দে বা অমীয় চক্রবর্তীর নয়। চৈতন্যের গহন আলোয় ও গূঢ়ার্থে কবিতার শব্দ ও শরীরে কামরুল ইসলাম যে মানবীয় বোধ ও স্নিগ্ধতার চর্চা করেছেন, তাঁর এই মানবিক চৈতন্যের উন্মীলন, দৃষ্টিভঙ্গির নতুনত্ব এবং স্বতন্ত্র ভাষাবিন্যাসেই তাঁর কবিতা সকলের চাইতে পৃথক ও ব্যঞ্জনাময়।
দুই
মানুষই শেষ কথা। এই মানুষ সুখে-দুঃখে, বেদনা-বিষাদে, ক্ষুধায়-প্রেমে সর্বংসহা। স্মৃতির অনুশাসনে মানুষ নিঃসঙ্গ। কবির নিঃসঙ্গতা বিস্তৃত হয়েছে ব্যক্তিমানুষের বোধের অন্তর্গত আচ্ছন্নতা পেরিয়ে সামষ্টিক মানুষের জীবনসমগ্রে। নির্দ্বিধায় তাই তিনি বলতে পেরেছেন ‘বসন্তের ছেঁড়া ঢাক কাঁধে করেই যাবো আর নিঃসঙ্গ/পাখিদের বসিয়ে দেব জুতসই অরণ্যে কিংবা আদিম/মানবের সুখদুঃখের ভেলায়—’ [বৃষ্টি ও বণিকের গল্প ফুরিয়ে গেলে, যৌথ খামারের গালগল্প]। তাঁর দ্বিধান্বিত সুখে আছি যমজ পিরিতে [১৯৯৯], ঘাসবেলাকার কথা [২০০১], যৌথ খামারের গালগল্প [২০০৬], সেইসব ঝড়ের মন্দিরা [২০০৮], চারদিকে শব্দের লীলা [২০১০] অবগাহনের নতুন কৌশল [২০১১], মন্ত্রপড়া সুতোর দিকে [২০১৪], দীর্ঘশ্বাসের সারগাম [২০১৬], বিহঙ্গখচিত লন্ঠন [২০১৭], কিছুটা ভোর, বাতাসের গদ্যসহ [২০২০], আগাছার ইন্দ্রজাল [২০২১], গোপাল সাঁইয়ের কবিতা [২০২৩] ইত্যাদি কাব্যের কেন্দ্রীয় চিন্তার মধ্যে খেলা করে প্রাকৃতিসংলগ্ন, মাটিবর্তী, জলজগন্ধসমৃদ্ধ মানুষের সুরুচি ও অস্তিত্বের অনিঃশেষ আকাঙ্ক্ষার রং ও রেখা :
…তর্জমাহীন, নিঃস্ব; দুঃখনদী জ্বলন্ত ক্ষুধায় গ্রাস করে আমাদের গোলাবাড়ি গ্রাম-রক্তহীন নিস্পন্দ আমি যেতে থাকি—যেতে যেতে পাড়ি দিই অনেক ভোর, দুপুর ও বিকেল, পড়ে থাকা ভিটেমাটি, রাঙা দেওয়াল, বিপন্ন তেলের শিশি, পুরনো সুটকেস পার হয়ে দেখি কত ভগ্ন-হৃদয় অপেক্ষার ঢেউ ভেঙে জ্বলে উঠছে অপার শূন্যে [আমাদের গোলাবাড়ি গ্রাম, সেইসব ঝড়ের মন্দিরা]
ব্যক্তিচৈতন্যের এই নৈরাশ্য ও নিঃসঙ্গতার রূপকল্প নির্মাণে ইয়েটস যেমন পরিভ্রমণ করেছেন তাঁর স্বদেশের নানা অনুষঙ্গে, তেমনি কামরুল ইসলাম অনুসন্ধান করেছেন নিঃস্ব কৃষকের সারল্যে, পরিব্রাজক বাউলের ঘুঙুরের ধূলিধূসরধ্বনির ঔদাস্যে। কবিচৈতন্যের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞান মানুষের নিঃসঙ্গতার ‘বিদ্যা ও দর্শন’ অনুসন্ধানে তৎপর। তার অন্তর্স্রোতে মিশে থাকে ইতিহাসের বোধ, ঐতিহ্য, পুরাণ, কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজ এবং সমকালীন সভ্যতার বিচিত্র অনুরঞ্জন। স্বদেশের মাটিই তাঁর চৈতন্যের মুক্তি, তাঁর অনুশীলন ও প্রজ্ঞা-বিরোধী মন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়াবার ভূমি। অকপটে তিনি বলতে পারেন : ‘আমার মাটিমন্ত্র আবার জেগে উঠছে দ্যাখো/ঐ দেয়াল ও নেকড়ের, ঐ মুখোসের, ঐ ফতোয়ার/ছাইভস্মে বাজাবে সে ঢোলকÑজয় হে মাটি!’ [মাটিমন্ত্র, যৌথ খামারের গালগল্প]। এভাবে কবির ইতিহাসচেতনার অন্তর্বেদ নির্মিত হয়েছে এই বাংলার পলল মাটিতে; লালন, রবীন্দ্রনাথের মানবিক চিন্তায় অথবা নিঃস্ব কৃষকের দ্রোহনীল আঁখিতারায়, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, পুঁজির প্রবল প্রতাপের বিপরীতে :
প্রগতির নেভানো চুল্লি থেকে আকাশের মেটিওর শাওয়ার পর্যন্ত ঝরে গেছে অনেক অনেক আলফ্রেড সরেন—বস্তুত কালো ঘোড়ার চিঁহি ডাকে সরে যাচ্ছে পরিণত মেঘ—কতশত বিপ্লবের চুঁয়ানির তলে কতশত তত্ত্বের ফুলঝুরি মেখে এই আমরাই দ্যাখো আজ ফুল বাগানের আড়ালে সারমেয়-সঙ্গম দেখে বিমোহিত হই; [কুজ্ঝটিকা, সেইসব ঝড়ের মন্দিরা]
এই আত্মধিক্কার কবির নৈতিক বোধকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। তাঁর কৌমজীবনের কৃষিজ স্মৃতি, ভেষজ অভিজ্ঞান এবং অরণ্যের সামূহিক সংগীত নিভে আসে, কবি তখন বিপন্ন বোধ করেন। এই বিপন্নতা কবির ব্যক্তিজীবনের অস্তিত্বচেতনা থেকে বোধ ও মনীষার সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞানে সার্বজনীন। ফলে ব্যক্তি-কবির নিরাশ্রয় ও নৈঃসঙ্গচেতনা ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে বিশ্বজনীনতা ও বিশ্বমানবতার আধারে। কবি সেখানে হয়ে ওঠেন গ্লোবাল-ট্রাজেডির নায়ক :
[ক]
তীরবর্তী গ্লোবাল ট্রাজেডি—নাগরিক ফুটপাতে অসম্ভব জল-হাওয়ার
উৎপাত—চৌচির স্মৃতি—যেতে হচ্ছে এসবেরই পৃষ্ঠদেশ ছুঁয়ে।
স্বপ্নগুলো সনাতন ছকে বীজতলা খোঁজে আর অসংখ্য
কুরুক্ষেত্রের রক্তাক্ত ধুলোয় দাঁড়িয়ে থাকে বনেদি উঠোন
বিশ্বাসের দোচালায় স্ট্র্যাটেজিক দানবের সহিংস খেলায়
অহিংস দৃষ্টির ঝাঁপি ভরে ওঠে রক্ত-বমিতে!
[তন্দ্রার ভেতরে বেড়ে ওঠে বাংলাদেশ, সেইসব ঝড়ের মন্দিরা]
[খ]
আজ তুমি অশেষ হবে হে মার্মা মেয়ে, তুমি ঘুঘুপাখির আধখানা
বাসা কাঁধে লেকের ধারে জেগে থাকা উটপাখির প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে
সমস্ত বিকেল, কুড়োতে থাকবে হটডগ ছায়াদের মৌসুম
ঘুমের মধ্যে কাঁচভাঙার শব্দে, ঘুমিয়ে থাকা মুক্ত ব্রিজের হাওয়ায়
কিংবা ঝিঁঝি পোকার সান্ধ্য অপেরায়, তোমার অভিষেক হবে—
[ঠিকানা : জলমতি গ্রাম, দীর্ঘশ্বাসের সারগাম]
কামরুল ইসলামের বিশ্বজনীনতা ও বিশ্বমানবতা বোধে মানুষের মর্মমূলে অধিগমনের সূত্র কোনো আকস্মিক উদ্ভাস নয়; পূর্বাপর তাঁর কবিতার চৈতন্য ও রক্তমাংসে উচ্ছৃত হয়েছে মানুষ। বিশ্বমানবও তাঁর কবিতায় হয়ে উঠেছে বাঙালির শাশ্বত জীবনের চিত্রকল্প। লোরকা, পিকাসো, আফ্রোদিতি থেকে রামানুজন; সিলিকন মেয়ে বা নিয়ানডার্থাল যাজক থেকে লালন-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ দাশ—এভাবে বিশ্বমানব ও বিশ্বসংস্কৃতির ভেতর দিয়ে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি, নিসর্গের নিরূপম শোভা ও চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু কখনোই তা গ্রাম্যতা-দুষ্ট নয়; এমনকি এলায়িত দীর্ঘ ও ধারাবাহিক পয়ারে ধ্বনিপরম্পরাও নয়। বরং শব্দানুসন্ধান এবং প্রকৌশল ভাবনায় তিনি সমকালীন কাব্যচেতনার সতীর্থগামী। ফলে এই নির্মাণে উঠে আসে জীবনের গভীরতর আকাঙ্ক্ষা :
[ক]
না ঘুমানো নদীরা জানে জলের ব্যাসকূট কিংবা
গোধূলিতে পড়ে থাকা কিছু হলুদ পাতার
জলীয় নির্মাণ, জয়তুন তেলে গন্ধ-গাভীর কান্না;
প্রতিদিন অফুরন্ত গোলরক্ষকের ছায়ায়
প্রতিদিন লবণ-জলে
কেউ কেউ খোঁজে কারো ফেলে যাওয়া বাঁচার ঠিকানা—
[এরকম দৃশ্যের আড়ালে, চারদিকে শব্দের লীলা]
[খ]
স্বয়ংক্রিয় পতনের দিকে ঝুলে আছে লেখার টেবিল
কটি অচেনা পালক দিগন্তে উড়াচ্ছে মশাল আর আমরা
আলভাঙা স্বভাবে তাকিয়ে দেখছি বংশগতির শোবিজ
এইসব পদ্যামি আয়ুহীন জলে
কটি নীরব পালকের উৎসব দেখে
বুঝে নেয় ঘরে ঘরে বন গেছে দূরে—
[আদিমাতাভাষা, অবগাহনের নতুন কৌশল]
অস্তিত্বের অনিবার্য এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে কবি আশ্রয় খুঁজেছেন প্রকৃতির সীমাহীন সম্ভারে। দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ অন্তর্জটিলতা, নাগরিক কাল-যাপনের গ্লানি, যন্ত্রণা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমখুন, টুকরো টুকরো গলিত লাশের বীভৎস দৃশ্যাবলি, জলবায়ু সমস্যা এবং ক্রমাগত মৃত্যুফাঁদে আটকে পড়া অগণিত মানুষের বিরামহীন আর্তচিৎকারে জীবন যখন ‘সহজ গল্পের ঠিকানা’য় রূপান্তরিত তখনও নিসর্গই হতে পারে আমাদের অশেষ আশ্রয়। কেননা বিশ্বগ্রাসী, সর্বগ্রাসী রক্তলোলুপতার মধ্যে, বিরামহীন বিষোদগারের মধ্যে একমাত্র অভিযোজনক্ষম ও শুশ্রূষাকারী প্রকৃতিই-আমাদের জীবনের অবিভাজ্য নর্মস। প্রথম কাব্য যৌথ খামারের গালগল্প থেকে শুরু করে শেষাবধি তাঁর এই যাত্রা অবিরাম :
[ক]
অসম্ভব শস্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে
সূর্যাস্তের মৌলিক পথে আমরা হারিয়ে
ফেলবো দৃষ্টি, আমরা ভুলে যাবো জন্মান্তর
প্রেম ও পুরাণ, অবারিত বৃক্ষবিতানের স্মৃতিকথা
বৈনাশিক শস্যের ধারাজলে…
[বৈনাশিক শস্যের ধারাজলে, যৌথ খামারের গালগল্প]
[খ]
কিশোরবেলাকার চঞ্চলতা দ্যাখো কী সহজ তন্দ্রায়
বাঁশবাগানের মাথার ওপরে চাঁদ হয়ে ভাসে
বাঁচামরার অরবিটে ঘোরে কিছু অবিভাজ্য নর্মস
আমাদের সবজিবাগানের অভিধানে
[কিছু অভিভাজ্য নর্মস, চারদিকে শব্দের লীলা]
রক্তচিহ্নিত বিবমিষা ব্যক্তি-কবির জীবনকেই কেবল রক্তাক্ত ও বিপন্ন করে তোলেনি, বরং একদিকে নব্য দেশীয় ধনিক শ্রেণি, অন্যদিকে করপোরেট পুঁজির আগ্রাসন সামষ্টিক জবিন, সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভূমি এমনকি প্রকৃতি থেকেও বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে ক্রমাগত। সেই বিশ্বগ্রাসী লোলুপতায় আমাজান থেকে সুন্দরবন—কোনোকিছুই তার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। তাই কবি যখন বলেন, ‘আহত বনের গল্প জানে সেই ক্রিস্টাল পাখি—’ তখন প্রাণ ও প্রকৃতি তার সমস্ত মানবিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য, চাঞ্চল্য হারিয়ে আমাদের কোমল অনুভূতিরাশিকে ছুড়ে ফেলে দেয় অগ্নিকুণ্ডে, হৃদয়ে বিদ্ধ করে তীক্ষè লৌহশলাকা। কিন্তু কবি আপন চৈতন্যের কাছে; প্রকৃতি ও মানুষের কাছে, তাঁর জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, স্মৃতিকাতরতা ও প্রত্ন-ইতিহাসের কাছে বিশ্বস্ত থাকেন; গ্রহণ করেন শিল্পের নতুন পাঠ :
[ক]
আকাশের অঝোর কান্নায় তুলোপাখির অধরা মুখ দেখি
কিংবা সেই কবেকার ফেলে আসা কিশোরীর টিয়েপাখি চোখ
এমন দিনে আমি পাঠ করি সাঁঝবেলা ধোধূলির আলোয়
আর দেখি, ওপারে চুল্লি জ্বালিয়ে কীভাবে বালিকা-শ্রাবণ
রেঁধে যায় অপূর্ণ খোয়াব মেঘে ও মসলায়
[আকাশের মেলোড্রামায় কান পাতি, মন্ত্রপড়া সুতোর দিকে হাওয়া]
[খ]
কুয়াশায় যেসব নিভে যাওয়া গ্রাম জেগে ওঠে সামান্য দীপালোকে
আমি তার আদিম জঠরে জ্বেলে রাখি বনের নাব্যতা সরল প্রতীকে;
শাগালের গ্রাম হয়ে ফিরে আসা গানের পাখিদের মলিন ডানায় হে
ঈশ্বর তুমি গেঁথে দাও কিছু বিশুদ্ধ উত্তাপ—আমাদের শস্যালি মনে
এঁকে দাও অফুরন্ত রঙ ও রেখায় আলাদা কোনো নদীর স্বর…
[পলিসুখ কিংবা স্বয়ম্ভর উড়াল, সেইসব ঝড়ের মন্দিরা]
[গ]
সেখানে মানবেতিহাসের পোড়া ছাই, আমি তুলে নিই হাতে;
পার্থেনিয়াম নিয়ে ভাবতে ভাবতে বীজতলার আনুগত্যের কথা ভাবি
যেখানে তোমার তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠে পরিণত খামার
তোমার ইচ্ছেগুলো কচুরিপানার
আধো আধো বোলের ভেতর লুকিয়ে থেকে বাজাতে থাকে
তালপাতার বাঁশি, চৌপাশে পাথর ও নৈঃশব্দ্যের বেড়া—
[পার্থেনিয়াম, দীর্ঘশ্বাসের সারগাম]
কামরুল ইসলাম কবিতার পর কবিতায় গেঁথে দিয়েছেন নৈঃসঙ্গ্য, একাকিত্বের গ্লানি ও যন্ত্রণাবোধ; কিন্তু এই একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতাই চূড়ান্ত নয়, এবং হতাশার কালো কুণ্ডে নিজেকে নিমজ্জিতও করেননি। তিনি ‘পিঁপড়াদের অধুনা প্রজ্ঞায়’ অনুসন্ধান করেছেন ‘ফসলের ভাবনৃত্যকলা।’ কবির অন্তর্চৈতন্যের এই আকাঙ্ক্ষা ও প্রজ্ঞাময় অনুভাবনায় প্রতিভাত জীবনের অসীম সম্ভবপরতা ও সম্ভাবনা। এই জীবন, সম্ভবপরতা ও সম্ভাবনা কবি খুঁজে পেয়েছেন নদীমাতৃক বাংলার কোমল মাটির ঘ্রাণ, সবুজ-শস্যশ্যামল প্রকৃতি, সুলতানের অবলা কৃষাণ ও ডাকহরকরার চোখের লিরিকে, আলফ্রেড সরেন, চলেশ রিসিল, লালন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশে। নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও বিপন্নতার মাঝেও দ্রোহ ও মননের সমান্তরাল পরম্পরায় নানা বর্ণের নানা জাতির সংস্কৃতির হাজার বছরের প্রাচীন বাংলার রূপকথা, নিসর্গ এবং একই সঙ্গে বিশ্বদর্শন, বিশ্বসংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মিথিক অনুষঙ্গ ধৃত হয়েছে কামরুল ইসলামের নির্জ্ঞান চৈতন্যে। তাঁর বিহঙ্গখচিত লন্ঠন কাব্যে এই যৌথানুষঙ্গের প্রচুর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
লোকায়ত বাংলার কথকতা, লোককথা আর আলোছায়ারহস্যময় প্রকৃতির বিপুলবিচিত্র চিত্র ও চিত্রকল্প বিহঙ্গখচিত লন্ঠন কাব্যের ছোট ছোট কবিতায় যেন প্রাণ পেয়েছে; তাই সজীব, গতি-উন্মুখ। টুকরো টুকরো কবিতার মধ্যে কখনো চঞ্চল হয়ে উঠেছে রূপকথা বা মিথিক গল্পের খণ্ডাংশ, কখনো রূপময় হয়ে উঠেছে চৈতন্যের অন্তঃশীল অনুভবের স্ফুরণ, কখনো একটি চিত্রকল্পের অবভাস। যেমন :
সেই রাখালের কথা মনে হয়
যে রাখাল গোধূলির ঘাসের ভেতর
গাভিদের ছেড়ে দিয়ে কোথাও অদূরে
খুঁজতে থাকে হারানো গ্রাম
পায়ে পায়ে জড়ানো শিশির,
ঘাসের নদীর জলে ভাসে তার যতিহীন গান।
[৫৮ সংখ্যক কবিতা, বিহঙ্গখচিত লন্ঠন]
আবার প্রায়শই তাঁর কবিতায় এসে মেশে পাশ্চত্য অনুষঙ্গ—কখনো চরিত্রের ছায়াচিত্র, কখনো মিথ, কখনো চিন্তার স্পন্দন। যেমন ‘লোরকার দুয়েন্দে কিংবা মরণের ছন্দে যে মেঘ সুতোনলী/তারে বলি এসো হে শালা জীবনের তীরে—/সেইমতো ভরবেগে/ছুটি আজ নীলাঞ্জন মায়োপিক ঘোর কেটে কেটে/মধুমাস পড়ে থাকে পাশে-গলুইয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বিপন্ন জল/লোরকার কবর হয়ে কাঁপিয়ে যায় সমস্ত শহর/সেখানে বসে আমি গুনি আজ অপূর্ণ মেঘমালা, বজ্রের ধ্বনি—’ [ছিন্নমূল বেহালার দ্বৈরথ, অবগাহনের নতুন কৌশল] অর্থাৎ লোরকার দুয়েন্দের মধ্যেই কবি সীমাবদ্ধ থাকেননি, তিনি তাঁর বোধ ও চৈতন্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন গলুইয়ের বিপন্ন জলে, ‘ঘাসের স্রোতে’। এখানেই কামরুল ইসলাম স্বতন্ত্র। স্বদেশের জীবন ও সংস্কৃতিকে তিনি মিলিয়ে দেন আন্তর্জাতিকতায়। প্রাচ্যের জ্ঞানকে অঙ্গীকার করে পাশ্চাত্যের করোটি ভেতর বাজিয়ে শোনান বাউলের সহজিয়া গান, শ্যামের বাঁশির প্রাণ পাগল করা সুর। কবিতায় সেই তরঙ্গায়িত, ফেনিল : ‘শ্যামপল্লীর হাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন/আমাদের প্রতিবেশী ঈশ্বর, তিনি দুহাতে/আফ্রোদিতির নরম দুপুরে নির্মাণে যাচ্ছেন/আর রাঙিয়ে তুলছেন গ্রামের হাট-বাজার’ [১১ সংখ্যক কবিতা, বিহঙ্গখচিত লন্ঠন]
তিন
কামরুল ইসলামের অনেক কবিতায় বাউল-প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। কেবল জন্মসূত্রে কুষ্টিয়া জেলার অধিবাসী বলেই এই বাউল-প্রসঙ্গ একাধিকবার কবিতায় উঠে এসেছে, আমাদের তা মনে হয়নি; বরং তাঁর কবিতার চৈতন্যের অন্তর্লীন ভাবনার মধ্যেই একাকী, নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, যন্ত্রণাপীড়িত যে ব্যক্তিমানুষের উপস্থিতি রয়েছে তিনি নাগরিক জীবনের বিবমিষা ও বিচিত্র কোলাহলের মধ্যে সন্ধান করে চলেছেন গভীর নির্জন পথ। যে পথ নির্মিত হতে পারে বাউলের সাধন-ভজনে। তাঁর অসংখ্য কবিতায় এই চৈতন্য সন্ধানের চিহ্ন রয়েছে। তাছাড়াও ‘চোত-বোশেখের কথা’; ‘লীলাখেলা সাঙ্গ হলে’; ‘পিছিয়ে পড়া বাউলামি নিয়ে কথা’; ‘আমাদের গোলাবাড়ী গ্রাম’; ‘আদিমাতাভাষা’; ‘সাধনসঙ্গিনী’; ‘বাউলামি জেগে আছে চাঁদে’; ‘একতারা উড়ে যায় ভোরের বাতাসে’; ‘মনে পড়ে দরদিয়া গ্রাম’; ‘ইগলু সন্ধ্যায়’; ‘আঁচল পোড়ার ঘ্রাণ’; অথবা বিহঙ্গখচিত লন্ঠন কাব্যের বেশকিছু কবিতায় রয়েছে বাউল প্রসঙ্গ। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ—গোপাল সাঁইয়ের কবিতার দিকে তাকালে এ কথা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। লোকায়ত পুরাণের গল্প ও অনুষঙ্গও তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কেন কবি নিসর্গ, বাংলার বাউল, লোকায়ত পুরাণ ইত্যাদি অনুষঙ্গ কবিতায় গেঁথে তুলেছেন?
কবির সংবেদনা, যাপিত জীবনের আবেগ ও মননের সুস্থতা ক্রমাগত হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্নের আঘাতে ভঙ্গুর। একদিকে যেমন ব্যক্তিজীবন অন্যদিকে সামষ্টিক জীবন, প্রিয় নিসর্গ ভেঙেচুরে, দুমড়েমুচড়ে মুমূর্ষু, রক্তাক্ত :
[ক]
এসিড বৃষ্টিতে ভিজে যে পাখিগুলো হারিয়ে ফেলেছে উড়ার ছন্দ তাদের ডানায় ঝোলানো নীলরঙের এপিটাফ; বেরসিক হাওয়ায় কৃষকের ঘুমের পলেস্তারা খসে পড়ে; উদ্বায়ু জননির্মিতি-মুনাফার পর্যটন টানে মৃত্তিকার মৌলস্বভাবে জ্বলে উঠছে দিগম্বর স্বর্ণপ্রহর।… গ্লোবাল ওয়ার্মিং কিংবা অস্থির গ্লেসিয়ার হয়ে ফিরে যাচ্ছে অভিন্ন ধর্ষকেরা প্রভাতের জগিংয়ে।
[নিষিদ্ধ মন্ত্রের গুপ্ত নির্মাণ, চারদিকে শব্দের লীলা]
[খ]
অগ্নিদগ্ধ হৃদয়ের পাশে দাঁড়াবে কে আজ
প্রেমিকেরা কাল রাতে তৃষিত কুঠার কাঁধে
চলে গেছে বনে, আর বনের অদূরে
কারা মশাল জ্বালিয়ে বনস্পতি বিষয়ক
সংগীতের ঘেরে গলদাচিংড়ির আবাদের
কথা ভাবছে, যখন মানুষের প্রকল্পগুলো
পাখির সততা নিয়ে আলো জ্বালাতে শিখেনি—
[৬০ সংখ্যক কবিতা, বিহঙ্গখচিত লন্ঠন]
পরিত্রাণহীন এই যন্ত্রণা ও অস্তিত্ব সংকট থেকে মুক্তির জন্য কবি ‘আত্মার বিশুদ্ধ আগুনে’ পুড়তে চেয়েছেন। এই শুদ্ধতা-প্রাপ্তি সম্ভব একমাত্র প্রকৃতির সান্নিধ্যে, অর্থ-প্রাচুর্য, বিত্তহীন গৃহ-আকর্ষণশূন্য বাউল জীবনের সাধনায়—যদিও তা বৈরাগ্য সাধনের মুক্তি নয়; বরং কবির আশ্রয় প্রার্থনা বাউলদের সাধনার অন্তর্গত স্বার্থহীন সৌন্দর্যের নিকট, তাদের ভজনগীতের ধ্বনি-অর্থ-সুরের ঔদার্যে।
এবং একই আকাঙ্ক্ষায় কামরুল ইসলামের কবিতায় নিসর্গের সবুজ সারল্যের কাছে ‘কফিন থেকে বেরিয়ে যাওয়া’ একটি শবও আশ্রয় নিতে পেরেছে। এই আশ্রয় সন্ধানের আকাঙ্ক্ষা অথবা আশ্রয়-উৎস রূপেই তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে নিসর্গের নানান বৈচিত্র্য। সেখানে কদমগাছ, বকফুল, পাটক্ষেত, কার্পাসবন, নদী, চাঁদ, হাঁস, পাখি, পুঁইপাতা, শেয়ালকাঁটা, কাঁঠালপাতা, বটগাছ, ঘুমফুল, ঝাউপাতা, জয়তুন তেলের গন্ধ, জোনাকি, প্রজাপতি, ময়ূর, ফড়িং, কাশফুল থেকে শুরু করে ঘাস তাঁর কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে পত্রপুষ্পে। যেমন ঘাসের চিত্র ও চিত্রকল্পসমূহ—যদিও ‘ঘাস’-এর চিত্রকল্প চেতনায় উঁকি দিলেই জীবনানন্দের অসাধারণ পঙক্তিমালা ঝিলমিলিয়ে ওঠে—কিন্তু ‘তোমার হৃদয় আজ ঘাস’-জীবনানন্দের এই মোহময় পঙক্তির সৌন্দর্য এড়িয়ে কামরুল ইসলাম যাত্রা করেছেন সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞান-পথে। তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই ঘাসবেলাকার কথা। কবিতার শিরোনাম ‘ঘাসপুরাণের স্মৃতি’। কতিপয় ঘাসের চিত্রকল্প :
১. হাওয়ায় কুণ্ডলী পাকানো সবুজ ঘাসের নৌকো
২. সোলারিয়াম থেকে বেরিয়েই জীবনের ঘাস;
৩. নীল পাহাড়ের ঘাস হয়ে যে সব ধ্বনি ও ছন্দ
জেগে আছে বহুকাল চেতনার অচিন গুহায়
৪. ঘাসের লকলকে জিহ্বায় কাঁদে এক নবীন বেহুলা
উপরে উল্লিখিত চিত্রকল্পসমূহ বিচিত্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। ‘সবুজ ঘাসের নৌকো’; ‘জীবনের ঘাস’ অনেকাংশেই প্রথাগত ব্যবহার হলেও ধ্বনি ও ছন্দের নির্বস্তুক অস্তিত্বকে ‘নীল পাহাড়ের ঘাস’-তৃণের সঙ্গে এই তুলনার ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনা। তেমনি চতুর্থ চিত্রকল্পটিকেও নিরীহ তৃণকে রূপান্তরিত করা হয়েছে বিষধর প্রাণীর তীক্ষ্ম তীব্র একটি ইন্দ্রিয়ে। এছাড়া ঘাসের আরো কিছু প্রথাগত চিত্র ও চিত্রকল্প : ঘাসের মৃদু কম্পনে যে উষ্ণতা; ঘাসের কার্পেট; পাহাড়ি ঘাসের উৎপাত; ঘাসের বিছানা; ঘাসের নদী; ঘাসে ঘাসে উড়তে থাকে তারাদের জেলিফিশ; সবুজ ঘাসের যোনি ইত্যাদি।
চার
—শব্দেরা বিবিধ লীলায়
ঘরামির নৈঃসঙ্গ্য হয়ে ফুটপথে-শব্দেরা ঘুমুতে ঘুমুতে
খুনির পোশাকে বেয়ে যায় হাল, শব্দেরা ফ্লোরা ও ফনা—পাতা ঝরা দিন
আমাদের বীজ বপনের আদিম কৌশল পাশে এসে বসে আর
আমাদের বাহুগুলো
ঢিলভাঙা শব্দের ভেতর নবীন দোতারা
বেজে ওঠে বাবলা পাতার শৈশব দাঁড়ভাঙা রোদের খোলসে
শব্দের বিবিধ লীলায় উজানে ডিঙা বায় অচিন সাধুরা ভজনে, সাধনে
[চারদিকে শব্দের লীলা, চারদিকে শব্দের লীলা]
শব্দই ব্রহ্ম, অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। শব্দের অন্তর্স্রোতে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সর্বময় চৈতন্য। শব্দের মধ্যে সংগুপ্ত থাকে উৎসের চিহ্ন ও নিহিতার্থ। একটি শব্দ কখনো কখনো যাত্রা করতে পারে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে অনন্ত অতীতের অন্ধকারে, যেতে পারে সমাজ-সভ্যতা ও ব্যক্তির অন্তর্গত ঐতিহ্যে। কখনো একটি শব্দই হয়ে উঠতে পারে একটি চিত্রকল্পের পরিপূর্ণ অবভাস অথবা কবির জীবনদর্শনের উৎস। কিন্তু যখন ‘শব্দেরা ঘুমুতে ঘুমুতে খুনির পোশাকে বেয়ে যায় হাল’ তখন ব্রহ্ম, অদ্বিতীয় পরমেশ্বর ভয়ানক এক অন্ধকার বিবমিষার কুটিল পঙ্কস্রোতে শরীর এলিয়ে হেসে উঠে অট্টহাসি। তখন আমাদের ঐতিহ্য, প্রভাতের সুনির্মল সবুজ আলোর রেখা, ব্রাত্য জীবনের মরমি গানের উদাস সুর এবং বৃক্ষের সারল্য ডুবে যায় ‘হাইব্রিড’ অন্ধকারে। চারদিকে বিচিত্র শব্দের লীলাচাঞ্চল্যে একবিংশ শতাব্দীর সূচনাকাল অস্থির হয়ে ওঠে মুখোশের প্রপঞ্চে। ফলে দ্বিধান্বিত সুখে, ঘাসবেলাকার কথা এবং যৌথ খামারের গালগল্প যে সংবেদনশীল ব্যক্তিমানুষটির, তাঁরই করতলে বেজে ওঠে সেইসব ঝড়ের মন্দিরা। তিনি কবি কামরুল ইসলাম।
মালার্মে শব্দের অনুষঙ্গ রচনার প্রকৌশলে কবিতার অভিজ্ঞান-সূত্র অনুসন্ধানে সচেষ্ট হয়েছিলেন, শব্দের বিচ্ছিন্ন কোনো তাৎপর্য তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ; প্রধান হয়ে উঠেছিল কাব্যভাষার সূক্ষ্ম কারুকাজ ও সাংগীতিক সম্ভবপরতা। কামরুল ইসলামের কবিতায় শব্দ সংক্রামের সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয় হলেও তিনি মালার্মের মতো শব্দের সূক্ষ্মতা-সন্ধানী কেবল নন, বরং তাঁর বিন্যাসিত শব্দরাশির অন্তর্স্রোতে দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে জীবনের সারল্য ও বিবমিষা।
কামরুল ইসলাম শব্দ নির্বাচনে অনেক সচেতন ও সৃষ্টিশীল। কোনো কোনো শব্দ রীতিমতো নতুন-চিত্রকল্পে ব্যঞ্জনাময়। যেমন : চাঁদেলা; রোদসী; জলাহার, গোলাপায়ন শব্দগুলো যথাক্রমে রোদেলা, রূপসী, পানাহার ও গোলকায়নের অনুরূপ নতুন নির্মিতি। এছাড়া প্রচুর সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যে শব্দসমূহ সম্পূর্ণার্থে নতুন না হলেও পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। যেমন : বৃষ্টিমাছ; গরুকাবেলা; বিদ্যাবৃষ্টি; নিমসন্ধ্যা; স্মৃতিকাক; সুকান্তদেহী; ঝিনুকহৃদয়; হরিণ-ঘুম; যাজক-মৎস্য; জলঘুঘু; ঘুমসন্ধ্যা; বিহঙ্গখচিত; আনন্দপ্রহর; শকুনবৃক্ষ ইত্যাদি। কামরুল ইসলামের এই প্রয়াস তাঁর কবিতার ভাষা ও চৈতন্যের অন্তর্স্রােতে একটি সমন্বিত ও সঙ্গতিসূত্র রূপে ক্রিয়াশীল। তাছাড়া তাঁর কবিতাবলির অন্তর্স্রোতে রয়েছে অনুপ্রাসের আভ্যন্তরীণ মিলের আবেগ, কিন্তু অনুপ্রাস রচনার প্রথাগত ব্যাকরণ ভেঙে তিনি নির্মাণ করেছেন গতির ভিন্নতর পারম্পর্য। তাঁর কবিতায় প্রথাগত উপমা-উৎপ্রেক্ষার ‘মতো’ বা ‘যেন’ শব্দের ক্লিশে ব্যবহার নেই, বরং বৈচিত্র্য রয়েছে সুপ্রচুর বিশেষণ নির্বাচনে। যেমন : ধন্বন্তরি বাতাসের গান; সূর্যাস্তের মৌলিক পথে; নদীয়ালি মানুষ; শৈশবের সবজিমাখা ঘুম; কাঁকড়া-স্বভাবের দিন; ঝড়ের ত্রিভুজ; শ্যামকালো স্মৃতি; প্যাগান চাঁদ; লোকজ আঁধার; নুনাক্ত নিশ্বাস; লিরিক্যাল খোঁপা; সুকান্তদেহী সন্ধ্যাতারা; পরিব্রাজক মেঘগুলো; বিকেলের প্রলম্বিত করাত; কোমল আত্মা; কিশোরী মেঘ; মাংসল চিতা; অবিনাশী মেঘমন্ত্রে প্রত্নউঠোন; রূপালি টিলা; লাবণ্যের সিঁড়ি; তন্দ্রার গ্রিল; মেঘের ভেতর মেঘ আছে কান্তিময়; ডাংগুলি বিকেল; সহজিয়া ময়ূরের নাচ; মর্সিয়া পাকুড়; অসুখী ক্রিসেনথিমাম; পালাকার শীতের নদী—এরকম প্রচুর বিশেষণ কামরুল ইসলামের কবিতাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। বিশেষণগুলো কখানো বিশেষ্যর পূর্বে এবং কখনো পরে বসে ভিন্ন মেজাজ সৃষ্টি করেছে। বাংলা কবিতায় বিশেষণ ব্যবহারের প্রবলতা রবীন্দ্রনাথ থেকেই দৃষ্ট। কিন্তু শব্দ প্রয়োগের প্রচল রীতি না মেনে কামরুল ইসলাম নতুন ব্যাকরণ সৃষ্টি করেছেন, যদিও এসব বিশষণ কখনো কখনো বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু বা শামসুর রাহমানকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তবু অনেকাংশে নতুন চিন্তার উৎসারণও তাঁর কবিতায় লক্ষণীয়।
এসব বিশেষণ আবার দীর্ঘ উপমা এবং চিত্রকল্পের সৃষ্টি করেছে। আমরা কামরুল ইসলামের কবিতায় ঘাসের চিত্রকল্প উল্লেখ করেছি। তাঁর কবিতায় আরো কিছু চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত : স্তনময় রোদের আখ্যানে এই হাতে গোলাপের হাড়; পেখমহীন নাচেরও অধিক কেউটের খোলস; সোনালি মাছেরা এসে হাজির হয় ঘুমের কার্নিশে; অন্তরা ও সঞ্চারীর মধ্যে ঘুমুচ্ছে যে রাজহাঁস; হেমন্তসন্ধ্যার বাঁশপাতা মেয়েরা ধানখেতের আল ধরে হেঁটে যেতে যেতে কুড়িয়ে পায়; বিহঙ্গ শরীরে ওরা মিশে গেছে মেঘের ধুলোয়; পাহাড়ের অন্তর ছিঁড়ে যে রক্ত গোলাপেরা শ্রাবণের গান গেয়ে বলেছিল; ঢোলকলমির ঝোপের আড়ালে মৃত মৃত সময়ের দিকে ফিরে; নদী ও নারীর ঢেউমাখা চন্দ্রিলা গীতি; পাখিদের শ্বাসনালীর অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা আগুনের হরিৎ পোশাক ইত্যাদি।
পাঁচ
কামরুল ইসলামের কবিতার স্বাদ ও সৌগন্ধ, শব্দ ও চিত্রকল্পানুষঙ্গের এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে কোনো নির্দিষ্ট দশকের তকমায় বন্দি করা যায় না। তাঁর কাব্যভাষা ও বিন্যাসের প্রকৌশল যেমন সমকালীন, অর্থাৎ তাঁর সময়ের চিহ্নবাহী, আবার একইসঙ্গে দশক ও কালের বৃত্ত ভেঙে তিনি যাত্রা করেছেন সামনের দিকে। কেননা, নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের পরেও প্রকৃতি যেমন অনিঃশেষ, তেমনই মানুষ ও মানবিকতার আকাঙ্ক্ষাও চিরন্তন। কামরুল ইসলামের কবিতা প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন মানুষ—এই দ্বৈতায়নের সমবায়ী স্বরতরঙ্গ। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যেও পাওয়া যায় নিসর্গঘেঁষা শব্দ আর মানবসম্পর্কের অনুষঙ্গ।
কনক বিশ্বাস। আড্ডাবাজ। তবে নিজস্ব বৃত্তের বাইরে তাকে পাওয়া যায় না। শিল্প-সাহিত্য সমালোচক। বই প্রকাশে আগ্রহী নন।