অনুবাদপ্রবন্ধ

পঠন : শব্দাবলি ও চিত্রকলা

ওরহান পামুক ইস্তাম্বুলের এক সমৃদ্ধশালী, পাশ্চাত্য-প্রভাবিত জেলা নিসানটাসিতে ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক বৃহৎ পরিবারে বড় হয়েছিলেন। তাঁর উপন্যাস Cevdet Bey and His Sons এবং The Black Book-এ ওই ধরনের পরিবারের বর্ণনা আছে। Istanbul নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে পামুক লিখেছেন শৈশব থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত তিনি শিল্পে সমর্পিত ছিলেন। কারণ তাঁর স্বপ্ন ছিল শিল্পী হবার। পামুক নিজের শহরের ধর্মনিরপেক্ষ আমেরিকান রবার্ট কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন শেষে সেখানকারই টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্য নিয়ে তিন বছর পড়াশোনা করেন। তবে শিল্পী বা স্থপতি- দুইয়ের আশাই ত্যাগ করার কারণে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির কোর্সটি আর শেষ করেননি। এরপর ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতায় গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়তে শুরু করেন বটে কিন্তু সাংবাদিকতার কাজ তিনি কখনো করেননি। তেইশ বছর বয়সে পামুক সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ঔপন্যাসিক হবেন এবং সব ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে লিখতে শুরু করেন।

তাঁর প্রথম উপন্যাস Cevdet Bey and His Sons সাত বছর পর ১৯৮২-তে প্রকাশ হয়। পামুকের নিজের শহর ইস্তাম্বুলের নিসানটাসির এক ধনাঢ্য পরিবারের তিন প্রজন্মের গল্প বিধৃত আছে এ উপন্যাসে। এটি ওরহান কেমাল ও মিলিয়েটÑ এই দু’টি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। পরের বছর The Silent House উপন্যাসটি প্রকাশ হয়। এটি ফরাসি ভাষায় অনুদিত হবার পর ১৯৯১ সালে Prix de la découverte européene লাভ করে। ১৯৮৫ সালে The White Castle উপন্যাসটি ইংরেজিতে প্রকাশ হয় এবং ১৯৯০ থেকে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। বলা যায়, তখন থেকেই পামুক আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। উপন্যাসটি ভেনিসের এক ক্রীতদাস ও অটোমান একজন পণ্ডিত ব্যক্তির বন্ধুত্ব ও বিরোধিতা নিয়ে লেখা। ১৯৮৫ সালে ওরহান নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে আমেরিকা চলে যান, সেখানে ১৯৮৮ পর্যন্ত অবস্থান করেন। The Black Book উপন্যাসের অধিকাংশই এখানে লেখেন। এটি একজন আইনজ্ঞের গল্প, যিনি হারানো স্ত্রীকে খুঁজে চলেছেন এবং এই খুঁজে বেড়ানোর মধ্য দিয়েই লেখক ইস্তাম্বুলের পথঘাট, অতীত, বিভিন্ন মিশ্রক্রিয়া ও গঠনকৌশলের বর্ণনা দিয়েছেন। উপন্যাসটি ১৯৯০ সালে তুরস্কে প্রকাশ হয়। এটির ফরাসি অনুবাদ ফ্রান্স কালচার প্রাইজ (Prix France Culture) লাভ করে। The Black Book-এর পর পামুক তুরস্কসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একজন জনপ্রিয় ও গবেষণাধর্মী লেখকের মর্যাদা লাভ করেন। কেবল তাই নয়, তিনি যে অতীত ও বর্তমানকে একই ধরনের গভীরতা/প্রাবল্য দিয়ে লিখতে পারেন সেটিও স্বীকৃত হয়। ১৯৯১ সালে তাঁর কন্যা রুইয়ার জন্ম হয়। ওই বছর Hedden Face নামক চলচ্চিত্রটি প্রয়োজিত হয়েছিল। The Black Book-এর তিন পৃষ্ঠার একটি গল্প নিয়ে সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচিত হয়।

পামুকের The New Life উপন্যাসটি ১৯৯৪ সালে তুরস্কে প্রকাশ হয়, একটি রহস্যজনক বই দ্বারা প্রভাবিত ইউনিভার্সিটির তরুণ ছাত্রদের নিয়ে লেখা। এটি তুরস্কীয় সাহিত্যের বহুল পঠিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম। অটোমান ও পারসিক শিল্পীদের ওপর রচিত My Name is Red (১৯৯৮)। উপন্যাসটিতে পামুক পাশ্চাত্য বহির্ভূত পৃথিবীকে বর্ণিত চরিত্রদের চোখে দেখার ও আঁকার কৌশল সম্পর্কিত প্রেম ও একটি পরিবারের গল্পের আবহ ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি ফরাসি du meilleurliure étranger, ইতালির Grinzane Cavoar (২০০২) এবং আন্তর্জাতিক IMPAC ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩) লাভ করে। নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ থেকে পামুক মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তার ওপর রচিত প্রবন্ধগুলোতে তুরস্ক সরকারের প্রতি সমালোচনার ভঙ্গি গ্রহণ করেন। রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না, Snow উপন্যাসটিকে তিনি প্রথম ও শেষ রাজনৈতিক রচনা বলে উল্লেখ করেছেন। নতুন ধরনের এই নিরীক্ষাধর্মী রাজনৈতিক উপন্যাসটির প্রকাশকাল ২০০২ সাল। এর পটভূমি তুরস্কের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের কারস নামক এক ছোটশহর, এখানে তিনি রাজনৈতিক মৌলবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী এবং কুর্দি ও তুরস্কের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে উত্তেজনা ও হিংসাবিদ্বেষের কথা বলেছেন। ২০০৪ সালে The New York Times এটিকে সর্বাপেক্ষা ভালো ১০০টি উপন্যাসের একটি হিসেবে নির্বাচিত করেছিল।

তুরস্কসহ বিদেশি খবরের কাগজ ও পত্রিকার জন্য লেখা সাহিত্য, কৃষ্টি সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ এবং ব্যক্তিগত নোটবুক থেকে নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়ে ১৯৯৯ সালে তাঁর Other Colours সংকলনটি প্রকাশ হয়। পামুকের পরবর্তী বই Istanbul একটি কাব্যধর্মী কাজ, একে বিশেষায়িত করা কঠিন। এখানে লেখকের শৈশব থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত জীবনের স্মৃতিকথা আছে, ইস্তাম্বুল শহরের ওপর একটি প্রবন্ধও আছে আর বইটিসাজানো হয়েছে তাঁর নিজের অ্যালবামের ছবি দিয়ে। তাতে পাশ্চাত্যের শিল্পী ও তুরস্কের ফটোগ্রাফারদের ছবিও আছে।

২০০৮ সালে পামুকের Museum of Innocence বইটি প্রকাশ হয়। এটি এক প্রেমিকের কাহিনি; সারাজীবন একটি মেয়েকে সে ভালোবেসেছে এবং তার প্রেমের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনিসপত্র দিয়ে জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে। ২০১২ সালে ওরহান এই বিশেষ জাদুঘরটি ইস্তাম্বুলের কিউকারকিউমা এলাকায় উদ্বোধন করেছেন। The Catalogue of The Museum, The Innocence of Obejects একই বছরে প্রকাশ হয়। ২০১০ সালে তুরস্কে পামুকের প্রবন্ধের দ্বিতীয় সংকলনটি প্রকাশ হয় Fragments of the Landscape নামে। উপন্যাসের কলাকৌশলের ওপর লেখা Charles Norton Eliot লেকচারস The Native and The Sentimental নামে ২০১১ সালে প্রকাশ হয়। ১৯১৪ সালে পামুক নবম উপন্যাস A strangeness in My Mind প্রকাশ করেন। অত্যন্ত দ্রুত বিক্রিত উপন্যাসগুলোর অন্যতম এ বইটি একটি প্রেমের উপাখ্যান এবং আধুনিক মহাকাব্য। এর বিষয় বোজা বিক্রেতা Mevlut নামের এক নারীকে লেখা তার তিন বছরের প্রেমপত্র এবং তাদের ইস্তাম্বুলের জীবনযাত্রা।

ওরহান পামুকের গ্রন্থগুলো তেষট্টিটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে জর্জিয়ান মালায়ান, চেক, ড্যানিশ, জাপানিজ, ক্যাটালান আর ইংরেজি; জার্মান, ফরাসি ভাষায় তো বটেই। জার্মানিতে Culture/ কৃষ্টির ক্ষেত্রে Peace Prize-কে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত মনে করা হয়। ২০০৫ সালে পামুক এই প্রাইজ লাভ করেন। একই বছরে ফ্রান্স Snow উপন্যাসটিকে শ্রেষ্ঠ বিদেশি উপন্যাস হিসেবে Médicio étranger প্রাইজটি প্রদান করে। ২০০৫ সালেই Riceharda Huck প্রাইজ প্রদান করে ওরহানকে সম্মানিত করা হয়। এ পুরস্কারটি ১৯৭৮ সাল থেকে প্রতি তিনবছর অন্তর যাঁরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করেন ও সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করেন তাঁদেরই প্রদান করা হয়। একই বছরে Prospect Magazine তাঁকে একশত বুদ্ধিজীবীর একজন হিসেবে মনোনীত করে। ২০০৬ সালে Time পত্রিকা তাঁকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা একশত প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন হিসেবে নির্বাচন করে। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে পামুক Snow উপন্যাসটির জন্য পুনরায় Mediterranée étranger পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস-এর একজন সদস্য এবং Tilburg University থেকে অনারারি ডক্টরেট লভ করেছেন। পামুক চাইনিজ অ্যাকাডেমি ফর আর্টস অ্যান্ড লেটারস-এরও একজন অনারারি সদস্য। তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বছরে একবার লেকচার দিয়ে থাকেন। ২০০৬ সালে পামুক ইতিহাসের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পান। ২০১৪ সালে পামুকের MUSEUM OF INNOCENCE European Museum of the Year Award (EMYA) লাভ করে। ইস্টোরিয়ার তালিন-এর ইউরোপীয় মিউজিয়াম ফোরাম পুরস্কারটি প্রদান করে। একই বছরে তিনি Helena Vaz Da Silva European লাভ করেন। এই পুরস্কারটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ইউরোপীয় মতবাদ পরিচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি। ২০১৫ সালে নবম উপন্যাস A Strangeness in My Mind-এর জন্য তুরস্ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার প্রদান করে; এর একটি Aydin Doğan Foundation Award এবং অপরটি Erdal Öz Literary Prize। ১৯১৬ সালে পামুক A Strangeness in My Mind-এর জন্য লিও তলস্তয়ের এস্টেট ও মিউজিয়াম থেকে বিদেশি সাহিত্যের শ্রেণিতে Yasnaya Polyana সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ওরহান পামুকের দশম উপন্যাস The Red Haired Woman (২০১৬) এক কূপ খননকারী ও তার শিক্ষানবিশের গল্প। তারা এক উষর জমিতে জলের খোঁজ করছে। ফ্রান্সের দার্শনিক গল্পের অনুসরণে লেখা একে মতবাদের উপন্যাসের বলা চলে।

ওরহান পামুক তিন বছর কেবল নিউইয়র্কে ছিলেন, তাছাড়া তিনি ইস্তাম্বুলের একই জেলায়, একই রাস্তায় পুরোটা জীবন থেকেছেন। তিনি যে বাড়িতে বড় হয়েছিলেন এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। ৪০ বছর ধরে তিনি উপন্যাস লিখছেন এবং লেখা ছাড়া জীবনে আর কোনো কাজ করেননি।

তাঁর Other Colours সংকলনটির একটি বিশেষ রচনা ‘On Reading: Words or Images’ এখানে অনূদিত হল।

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ

পঠন : শব্দাবলি ও চিত্রকলা

বিশেষভাবে মন খারাপের সময়গুলোতে আমরা যে পকেটে বা ব্যাগে বই নিয়ে চলি, সে যেন আরেকটা জগৎকে সঙ্গে রাখা, আর সে জগতে যেন আমাদের সুখের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আমার বিষণ্ন তরুণ বয়সটাতে পাঠ্যবই পড়তে পড়তে এমন হাই তুলতাম যে চোখদুটো জলে ভরে যেত, তখন আমার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল ওরকম বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা। ওভাবেই পেরিয়ে এসেছি স্কুলের দিনগুলো। পরবর্তী জীবনে দায়বদ্ধতা বা নেহাত অভদ্র হতে চাইনি বলে ক্লান্তিকর যে মিটিংগুলোতে যেতে হয়েছে তখনও ওই আকাঙ্ক্ষা আমার সহায় ছিল। আমি যেসব কারণে বই পড়ি তার একটি তালিকা এখানে দেব, তা কোনো ধরনের প্রয়োজনে নয় বা আত্মিক মঙ্গলসাধনের জন্যও নয়, কেবল আনন্দের জন্য।

১.

অন্য জগতের আকর্ষণের কথা আগেই বলেছি। একে পলাতক মনোবৃত্তিই বলা চলে। কিন্তু প্রাত্যাহিক জীবনের দুঃখবোধ থেকে কল্পিত জগতে অন্তত কিছুটা সময় কাটিয়ে আসাও তো ভালো।

২.

ষোল থেকে ছাব্বিশ— এই বয়সটাতে আমার একান্ত প্রয়াস ছিল নিজেকে যথার্থভাবে গড়ে তোলা এবং আত্মসচেতনতা উন্নত করে অন্তর্নিহিত সত্তার রূপ দেওয়া। আর এই লক্ষ্যে আমার প্রধানতম প্রচেষ্টা ছিল পড়া। আমি কী ধরনের মানুষ হব? পৃথিবীর অর্থ কী? আমার চিন্তা কতদূর প্রসারিত হতে পারে? আমার পছন্দ-অপছন্দ, আমার স্বপ্ন আর আমার মনোজগতে দেখতে পাই সে জায়গাগুলো? অন্যের জীবন, স্বপ্ন, নিজের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে তাদের অনুধ্যান যখন লক্ষ্য করেছি, অনুসরণ করেছি আমার জানাই ছিল এসব আমি আমার স্মৃতির গভীরতম নিভৃতে রেখে দেব, কখনো ভুলব না ঠিক যেমন একটি বাচ্চা তার প্রথম দেখা বৃক্ষকে, পাতাকে বা বেড়ালকে ভোলে না। নিজেকে গঠন করবার জন্য আমার কল্পনাপ্রসূত ছেলেমি আশাবাদ থেকে পড়ার মতো দুরূহ কাজটিকে একাধারে গভীরভাবে হলেও খেলাচ্ছলেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি ওভাবে তেমন পড়িই না আর সম্ভবত সেই কারণেই অনেক কম পড়ি।

৩.

আরেকটি যে কারণে পড়া আমার জন্য আনন্দদায়ক তা আত্মোপলব্ধি। পড়ার সময়ে সম্পূর্ণ মনে পাঠ্যবিষয়ে ডুবে যেতে মনেরই একটি অংশ বাধা দেয় আর সেই মনটুকুই আমাদের অভিনন্দন জানায় ওই গভীর ও প্রজ্ঞাপূর্ণ রচনাটি বেছে নিয়ে পড়ার জন্য। প্রুস্ত বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝেছিলেন। তিনি বলছেন আমাদের মনের একটা অংশ পাঠ্য বিষয়ের বাইরে থাকে এবং যে টেবিলে আমরা বসেছি, যে আলো খাবারের থালাটিকে আলোকিত করছে, আমাদের চারপাশের যে বাগান বা আরো ওদিকের যে দৃশ্য তার চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়। আমরা দেখি আর একই সঙ্গে নির্জনতার স্বাদ নিতে নিতে আমাদের চিন্তাপ্রসূত কাজগুলোর কথা মনে করি এবং যারা পড়ে না তাদের চেয়ে আমাদের গভীরতার মাত্রা যে কত বেশি তা ভেবে নিজেদের অভিনন্দন জানাই। তবে আমি জানি একজন পাঠক বিশেষ তেমন না পড়েও নিজেকে অভিনন্দিত করতে পারে যদিও বড়াই করে যারা গর্বিত বোধ করে তাদের ব্যাপারে আমাদের ধৈর্য্য রাখা কঠিন হয়।

এই জন্যই আমি যখন আমার পাঠক জীবনের কথা বলব তখন আমাকে একথাও বলতে হবে, যে আনন্দের কথা আমি ১ ও ২ নম্বর তালিকায় বলেছি তা যদি চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে পেতাম তাহলে হয়তো কম পড়তাম। হয়তো কোনো একদিন তা সম্ভব হলেও হতে পারে তবে মনে হয় কঠিন হবে। কারণ শব্দাবলি (এবং শব্দাবলি সহযোগে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়) পানি বা পিঁপড়ের মত; ফাটলে, গর্তে এবং জীবনের অদৃশ্য ফাঁকে ফাঁকে শব্দের মতো দ্রুত ও সম্পূর্ণভাবে আর কোনো কিছুই ঢুকে যেতে পারে না। জীবন সম্পর্কে, পৃথিবী সম্পর্কে যে বিষয়গুলো আমাদের কৌতূহলী করে তোলে তার নির্যাস নিশ্চিতভাবে ওইসব ফাটলেই থাকে এবং ভালো সাহিত্যই তার প্রথম উন্মোচন ঘটায়। ভালো সাহিত্য বিজ্ঞ পরামর্শের মতো যা এখনো দেওয়া হয়নি, সেজন্য সর্বশেষ খবরের মতো তার মধ্যে একটি প্রয়োজনীয়তার আভাস থাকে। সেই কারণে আমি এখনও তার ওপর নির্ভর করি।
তবে আমি মনে করি এই আনন্দকে অবলোকন করা বা দেখার আনন্দের বিপরীতে বা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে দাঁড় করানো ভুল হবে। হয়তো এর কারণ সাত থেকে বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার শিল্পী হবার আকাঙ্ক্ষা ছিল আর ওই সময়ে আমি আচ্ছন্নের মতো কেবল এঁকেছি। আমি দেখেছি পাঠ্য বিষয়টি আমার মনে ছবি বা চলচ্চিত্র রূপ ধারণ করে। পড়তে পড়তে চোখদুটোকে বিশ্রাম দেবার জন্য আমরা হয়তো মাথা তুলে দেয়ালে রাখা ছবির দিকে, জানালার বাইরের দৃশ্যে অথবা আরো দূরের কিছুর দিকে তাকাই, কিন্তু মন এদের ভেতরে গ্রহণ করে না, আমাদের সমস্ত মনটা জুড়ে চলতে থাকে বইয়ের ভেতরকার কল্পিত জগতের চিত্র নির্মাণে। লেখকের সৃষ্ট জগৎটাকে যদি দেখতে চাই তবে আমাদের অবশ্যই আপন কল্পনা বা সৃষ্টিশীলতাকে মেশাতে হবে তার সঙ্গে। আমরা কেবল এক সৃষ্ট জগতের দর্শকমাত্র যে নই, সৃষ্টিকর্তা হিসাবেও যে আমাদের অংশ আছে এই ধারণা নিয়ে বই আমাদের উপহার দেয় রচয়িতার নিভৃতের আনন্দসুখ। আর এই নিভৃত আনন্দসুখই বই পড়াকে, সাহিত্যের মহৎ সৃষ্টি পড়াকে সকলের জন্য বিমোহিতকর করে তোলে এবং লেখকের জন্য তা অপরিহার্য।

লেখাটি শেয়ার করুন :

মেহবুব আহমেদ

মেহবুব আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। অধ্যাপনা করেছেন ত্রিশ বছর। অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে হোর্হে লুইস বোরহেস-এর ডক্টর ব্রডির প্রতিবেদন ও অন্যান্য গল্প [১৯৯৪], লাতিন আমেরিকার ছোটগল্প [১৯৯৬], ভিনসেন্ট ভ্যাগ গগ-এর চিঠি [১৯৯৯], ওসমান জামালের মনোগ্রাফের অনুবাদ আমিনুল ইসলাম [২০০৪], ছড়ানো ভূগোলে গল্প [২০১৫]।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!