বিপ্লবী ফ্রাঞ্জ ফানোঁ
ইব্রাহিম ফ্রঁৎস ফানোঁ বা ফ্রাঞ্জ ওমর ফানন অথবা ফ্রাঞ্জ ফানোঁ [Frantz Omar Fanon]- যে নামেই পরিচিত হোন না কেন এই উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২০ জুলাই ১৯২৫ সালে। তাঁর জন্মস্থান ছিল ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকে। ফানোঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন আফ্রিকান। পূর্বপরুষরা আফ্রিকান ভাষায় কথা বললেও দাস হিসেবে মার্তিনিকে আসার পর স্থানীয় ভাষা এবং আফ্রিকান ভাষা মিলে ফানোঁর মাতৃভাষা হয়ে ওঠে ক্রেয়ল ভাষা। ফানোঁ একজন রাজনৈতিক দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, মনোবিজ্ঞানী এবং সর্বাফ্রিকানবাদী। তিনি মার্কসীয় মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কাজ করেছেন বি-উপনিবেশায়নের মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিণতি বিষয়ে। ফ্রান্সে চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষাগ্রহণের পর তিনি মনোরোগবিদ্যায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। ফরাসিদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময় তাঁকে একটি হাসপাতালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানকার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তাঁকে বিদ্রোহীদের সহকর্মী করে তোলে এবং তিনি সোচ্চার মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। প্যারিসে একজন তরুণ শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি ছিলেন আলজেরিয়া ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, আলজেরিয়ার অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে ঘানা বা আফ্রিকা জুড়ে সম্মেলনে বিপ্লবী অংশগ্রহণকারী। মনোবিশ্লেষণ,অস্তিত্ববাদ, ঘটনাবিদ্যা, দ্বান্দ্বিকতা, নেগ্রিচুড আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকলেও তিনি সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। তিনি বর্ণবাদী সমস্যা, কালো আফ্রিকা এবং পৃথিবীর হতভাগ্যদের অর্থাৎ উপনিবেশিতদের পক্ষে বিপ্লবী কর্মী।
আফ্রিকা, আমেরিকার জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে পৃথিবীর যেসব স্থানে কালো মানুষ রয়েছে তারা সবাই দাসত্ব আর বর্ণবাদের শিকার হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষ যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য লড়াই করে সেখানে এখনো কৃষ্ণাঙ্গরা আন্দোলন করে নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করার জন্য।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে : ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক’ (১৯৫২), ‘এ ডায়িং কলোনিয়ালিজম’ (১৯৫৯), ‘দ্যা রেচেড অফ দ্যা আর্থ’ (১৯৬১), ‘ট্যুওয়ার্ডস দ্যা আফ্রিকান রেভুলুশন।’
ফ্রাঞ্জ ফানোঁ উপনিবেশত অঞ্চলের অর্থাৎ নির্যাতিত শ্রেণির মানুষ হওয়ায় সবসময় শোষিতের পক্ষে কথা বলেছেন। উপনিবেশমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন। হেঁটেছেন বি-উপনিবেশায়নের পথে। শাসকের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনীতির আগ্রাসী আধিপত্য থেকে বের হয়ে এক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর।
শেতাঙ্গরা নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়ের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠ এবং অপরকে (কৃষ্ণাঙ্গদের) কুৎসিৎ, নৃ-তাত্ত্বিকভাবে নীচ প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করেছে। ‘গায়ের রং কালো হওয়া স্রষ্টার অভিশাপ’- শেতাঙ্গরা এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে কালো মানুষের উপর প্রভুত্ব চালিয়েছে। আফ্রিকা, আমেরিকার জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে পৃথিবীর যেসব স্থানে কালো মানুষ রয়েছে তারা সবাই দাসত্ব আর বর্ণবাদের শিকার হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষ যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য লড়াই করে সেখানে এখনো কৃষ্ণাঙ্গরা আন্দোলন করে নিজেদেরকে মানুষ প্রমাণ করার জন্য। ‘সবাই জন্মসূত্রেই মানুষ’ এই বিষয়টি মানবিকতার বুলি আওড়ানো শেতাঙ্গ-বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন ফ্রাঞ্জ ফানোঁ।
তাঁর সাহিত্যকর্ম যেন শেতাঙ্গদের (শোষকের) বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন। ফানোঁর সাহিত্যকর্ম বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক, কেননা একুশ শতকের শ্বেতাঙ্গ মানুষের রক্তে এখনো বইছে বর্ণবাদ। মুখে কৃষ্ণাঙ্গদের স্বীকার করে নিলেও অন্তর থেকে তারা বর্ণবাদী, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই সাম্প্রতিক সময়ের ব্রাজিলের ফুটবল খেলোয়াড় ভিনিসিয়াস জুনিয়রের ক্ষেত্রে। একুশ শতকে এসেও মানবিকতার বুলি ফোটানো ইউরোপের কাছ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ভিনিসিয়াসকে খেলার মাঠের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে শুনতে হয় “ভিনিসিয়াস তুমি বানর” আর এসব ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন বিপ্লবী ফানোঁ।
তাঁর রচনাগুলোর মাধ্যমে উপনিবেশিত আফ্রিকার নির্যাতন ও সহিংসতার বর্ণনা পাওয়া যায়। উপনিবেশিক বিশ্বকে ফানোঁ দুইভাগে ভাগ করেছেন। আর তা হল বসতকার ও ভূমিপুত্র। ফানোঁ মনে করেন যে, এই দুই গোষ্ঠীর বিভক্তির সীমান্ত রেখা হল ব্যারাক ও পুলিশ সৈন্যরা। উপনিবেশে পুলিশ এবং তার সৈন্যরা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সংযোগ রক্ষাকারী এবং অত্যাচারী শাসনের মুখপাত্র। উপনিবেশিত দেশে পুলিশ এবং সৈন্যবাহিনী তাদের উপস্থিতি দ্বারা ঘন ঘন এবং সরাসরি সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে ভূমিপুত্রদের সাথে সংযোগ রক্ষা করে রাইফেলের বাট আর নাপাম বোমার নৃশংসতা দ্বারা, তাদের শাসায় যেন তারা উচ্চবাচ্য না করে। ফানোঁর মতে, এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে সরকারি এজেন্টরা নির্ভেজাল শক্তির ভাষায় কথা বলে। ঔপনিবেশিক বিশ্বকে চরম অবস্থাপন্ন বিশ্ব বলেই আখ্যায়িত করেছেন ফানোঁ।
শাসক তার নিজের মতো করে তার শাসনের ইতিহাস রচনা করে। আর সেই রচিত ইতিহাসকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে শাসকের জায়গায় শোষিতের অবস্থান তৈরি করতে ফানোঁ যেন কাজী নজরুল ইসলামের মতো সহিংস বিপ্লবী হয়ে ওঠেন।
বসতকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফানোঁ বলেন, এই বিশ্বে বসতকার বাহ্যিকভাবে সীমানা নির্ধারণ করে। তাদের দৃষ্টিতে ভূমিপুত্রের সমাজ মূল্যবোধহীন, আর নীতিবিদ্যার প্রতি অচেতন ভূমিপুত্ররা ক্ষয়কারক এক বস্তু। তাই কোনো সভ্য জাতিগোষ্ঠী ভূমিপুত্রকে গ্রহণ করে না। শাসক তার নিজের মতো করে তার শাসনের ইতিহাস রচনা করে। আর সেই রচিত ইতিহাসকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে শাসকের জায়গায় শোষিতের অবস্থান তৈরি করতে ফানোঁ যেন কাজী নজরুল ইসলামের মতো সহিংস বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। তিনি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, তপ্ত বুলেট আর খঞ্জরের মধ্যে দিয়েই অর্জন করতে চান নিজের অধিকার। শাসকের সহিংসতার জবাব তিনি সহিংস হয়েই দিতে চান। তিনি পাশ্চাত্য মূল্যবোধের নীতিকে অবলীলায় পরিহাস করেন। তিনি বুঝতে পারেন শাসকের চামড়া তার চামড়া থেকে কোনো অংশেই মূল্যবান নয়। তাই তিনি কারো আধিপত্য মেনে নিতে রাজি না হয়ে কাজী নজরুল ইসলামের মতো ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চান। ফানোঁর মতে জাতীয় মুক্তি, রেনেসাঁ জনগণের মাঝে জাতিসত্তার পুনঃপ্রতিষ্ঠা যাই বলি না কেন তা সহিংসতা ছাড়া অসম্ভব। শাসক তখনই তার থাবা গুটাবে যখন তার গলায় ছুরি ধরা হবে।
তিনি আফ্রিকার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আফ্রিকান জনগণকে নিজস্ব সংস্কৃতি অবলম্বন করে সর্বাফ্রিকানবাদী জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে বলেছেন।
ফানোঁ বলেন, জাতীয় সংস্কৃতির অতীত অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্য একটি জাতিকে যেমন পুনর্বাসিত করতে পারে ঠিক তেমনি সেই দেশের জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। তিনি মনে করতেন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর যতদিন জাতীয় সংস্কৃতির প্রভাব থাকবে ঠিক ততদিন কোনো শাসকগোষ্ঠী ঐ জাতিকে পুরোপুরি কব্জা করতে পারবে না, কারণ কোনো জাতিগোষ্ঠীকে পুরোপুরি কব্জা করতে হলে তার মস্তিষ্কে কলোনি স্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ নগুগি ওয়াথিয়োঙ্গার মতে ‘ডি-কলোনাইজেশন ইন মাইন্ড’। ব্যক্তির সেই মস্তিষ্ক হল তার সংস্কৃতি। উপনিবেশকালে উপনিবেশিতের সংস্কৃতির এক বেহাল দশা তৈরি হয় আর এই পরিস্থিতি থেকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারেন দেশীয় বুদ্ধিজীবী। তাই তিনি জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাদেরকে নিজের শরীরের ইতিহাস নিজেকেই জানান দিতে হবে। নিজস্ব ইতিহাস, অতীত ঐতিহ্য সংগ্রহ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে বিশ্বজুড়ে। গড়ে তুলতে হবে জাতীয় সংস্কৃতি। জাতীয় সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও মুক্তি পারস্পরিক সূত্রে গাঁথা বলেই মনে করতেন ফানোঁ।
আধুনিক সাম্যবাদী রাষ্ট্র বলতে আমরা যা বুঝি ফানোঁ সেই স্বপ্ন দেখতেন। জাতীয় চেতনার চোরাফাঁদে জাতীয়তাবাদ যখন একটি পরিবেশনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তখন সাধারণ মানুষ কল্পনায় ডুব দেয় ফানোঁর সেই পরিকল্পিত রাষ্ট্রে। যেখানে তিনি চেয়েছিলেন, একটি দেশের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক দল থাকবে। পার্টি সরকারের হাতিয়ার না হয়ে জনগণের হাতিয়ার হবে। জনগণ নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে আর সরকার তা কার্যকর করবে।
দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ফানোঁ বলেছিলেন, অনুন্নত দেশের পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যরা রাজধানী এড়িয়ে চলবে। যে রাজধানী ইতিমধ্যেই জনাকীর্ণ এবং দশ ভাগের নয় ভাগের তুলনায় উন্নত তার বাড়তি উন্নতির জন্য নতুন কিছু করা উচিত নয়। পার্টিকে বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত মৃত অঞ্চলগুলোতে প্রাণ সঞ্চারের জন্য।
দক্ষ জনশক্তিকে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভেবেই তিনি বলছেন, স্বাধীনতার পর এমন সব আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও এমন সব কর্মকর্তা নিয়োগ করা প্রয়োজন যাদের রয়েছে নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করার পুরোপুরি কর্তৃত্ব। যাদের রয়েছে অনুন্নত অঞ্চলকে জাগিয়ে তোলার, উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার শক্তি।
রাজধানী সম্পর্কে ফানোঁর ভাবনা ছিল কিছুটা ব্যাতিক্রম, এ ব্যাপারে তিনি মনে করতেন, প্রতিটি নাগরিকের নজর থাকে শহরের দিকে। গ্রামের অশিক্ষিত ভূখণ্ডের উপর কেউ নজর দেয় না, যে কারণে সবাই দলে দলে শহরমুখী হয়ে লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতের সংখ্যা বাড়িয়ে চলে। তাই পশ্চাৎপদ গ্রামাঞ্চলকে সুবিধাভোগী অংশে পরিণত করতে হবে। রাজধানীকে রাজকীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং তাদেরকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন এই তাত্ত্বিক।
সার্বিক উন্নয়নে ফানোঁ গ্রামের জনসাধারণের সাথে যোগাযোগের সম্ভাব্য পথ খুঁজতে এবং জাতীয় নীতি ও সাধারণের জন্য নীতিমালা তৈরি করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দেশীয় সিভিল সার্ভেন্ট এবং টেকনিশিয়ানরা শুধু নকশা নিয়েই ডুবে থাকলে হবে না তাদের উচিত জনগণের কাছে যাওয়া। তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের নিয়োগ হলে তাদের পরিবারে যেন অশান্তি না লেগে যায় সে বিষয়ে ফানোঁ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের প্রতি সবিনয় আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারি দলকে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সংসদ সদস্যগণ রাজধানীতে অবস্থান করবেন না, নিজ নিজ এলাকায় থেকে যাবতীয় সমস্যা দূরীকরণের চেষ্টা করবেন বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ফানোঁ। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে কৃষককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আধুনিকায়ন করা, জাতীয় রাজস্ব বাড়ানো, যেসব জিনিস অপ্রয়োজনীয় তার আমদানি কমানো, অশিক্ষা কমানো, সরকারের উদ্দেশ্য জনগণকে বোঝানো জরুরি বলে মনে করেছেন তিনি। এবং তা করতে পারলেই একটি রাষ্ট্র কল্যাণমূলক হতে পারবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এছাড়া পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব থেকে জনগণকে রক্ষা করা এবং তাদেরকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন এই তাত্ত্বিক।
তিনি মনে করেন, অত্যন্ত বাস্তবিকভাবে ব্যক্তির সাথে মন্ত্রণালয়ের এবং মন্ত্রণালয়ের সাথে মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক থাকবে। মন্ত্রণালয় থাকবে সক্রিয়। মন্ত্রীদের উচিত মন্ত্রণালয় বসে না থেকে মাঠ পর্যায়ে সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধান করা আর তাতেই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন ফানোঁ।
রাজনৈতিক শিক্ষার উপর দৃষ্টিপাত করে তিনি বলছেন, বিখ্যাত ব্যক্তি বা বীরপুরুষ তৈরি করা রাষ্ট্রের কাজ না। রাষ্ট্রের উচিত জনগণকে জনস্বার্থে কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করে তোলা। অনুন্নত রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণপ পদ অধিকার করতে হলে ব্যক্তির রাজনৈতিক শিক্ষা এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে অবহিত থাকতে হবে। রাজনৈতিক শিক্ষার মানে গদগদভাবে বক্তৃতা দেওয়া নয়, এর মানে হচ্ছে জনগণের চিন্তাভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া, জনগণকে জাগ্রত করা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে বেড়ে উঠতে দেওয়া। জনগণকে বোঝাতে হবে সবকিছু তাদের উপর নির্ভরশীল। যদি আমরা তলিয়ে যাই তাও তাদের কারণে, আবার যদি আমরা এগিয়ে যাই তাও তাদের জন্যই। জনগণই ‘পরম’; জনগণের হাতই জাদুকরি। নিয়ম নীতির কঠোরতা নয় বরং জনগণ এবং নেতাদের উচিত নিয়ম-নীতির প্রতি সম্মান তৈরির মনোভাব সৃষ্টি করা আর তাতেই মিলবে একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র।
ফানোঁ একটি মানবিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তাঁর সেই স্বপ্নের বীজ বপন করে রেখে যেতে চেয়েছেন প্রতিটি উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের মাঝে। তাঁর বিশ্বাস ছিল হয়তো সেই বীজ থেকেই একদিন স্বপ্নের মানবিক বিশ্বের মহীরুহ গড়ে উঠবে।
ফানোঁ তার পরিকল্পিত রাষ্ট্রে ইউরোপকে অনুকরণ না করে পরিত্যাগ করার কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন তাদের কন্ঠে মানুষের কথা থাকলেও যেখানেই তারা মানুষের দেখা পায় সেখানেই তারা হত্যা করে। তথাকথিত স্পিরিচুয়ালিটির কথা বলে মানবতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে তারা। তাই আজকে তারা নিজেরাই আণবিক আর স্পিরিচুয়াল-এর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। তারা সমস্ত বিনয় সমস্ত স্বাধীনতাকে পদদলিত করেছে। তারা মানবিকতার কথা বলে কিন্তু তাদের মনের প্রতিটি বিজয়ের জন্য নিপীড়িত মানবতাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। মানবজাতির পাঁচভাগের চারভাগকে তারা দাসে পরিণত করেছে।
তাই ফানোঁর চূড়ান্ত আবেদন উপনিবেশিত বিশ্বের কাছে : “চলুন আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি ইউরোপকে অনুকরণ না করার। আমরা আমাদের পেশী আর মস্তিষ্ককে ঐক্যবদ্ধ করি নতুন দিগন্তের পানে। চলুন আমরা প্রচেষ্টা চালাই নতুন মানুষ সৃষ্টির যার জয়দীপ্ত জন্মদানে ইউরোপ ব্যর্থ হয়েছে।”
ইউরোপের চিন্তা ও মতাদর্শকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে ফানোঁ একটি মানবিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তাঁর সেই স্বপ্নের বীজ বপন করে রেখে যেতে চেয়েছেন প্রতিটি উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের মাঝে। তাঁর বিশ্বাস ছিল হয়তো সেই বীজ থেকেই একদিন স্বপ্নের মানবিক বিশ্বের মহীরুহ গড়ে উঠবে। ফানোঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা প্রতিটি উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষের দায়িত্ব।
২০২৫ সালের ২০ জুলাই ফ্রাঞ্জ ফানোঁর জন্ম শতবর্ষ পালিত হবে। শাসক-শাসিত পরিচয় ভুলে একটি মানবিক বিশ্ব তৈরির যে স্বপ্ন ফানোঁ দেখেছিলেন, তাঁর জন্মশতবর্ষের দোরগোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা কি পারি না তেমনই মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অঙ্গীকার করতে?

সামিয়া রহমান বৃষ্টি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিরোধের সাহিত্য এবং বিপ্লবী লেখকদের রচনা পড়েন। লেখালেখিও করেন এসব বিষয়ে।