ভালোবেসে নাম রেখেছি যার মখমলি ছন্দ
‘এ আমার
সাধনার
কমনীয় প্রিয়তম ছন্দ’
আমি নিজের ভেতর বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক চিন্তা ও অনুভব ধ্বনির প্রবাহমানতার যে বিচিত্র তাল, সুর, চঞ্চলতা-ধীরতা, উচ্ছলতা-বিমর্ষতা, হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনার রোদ-ঝড়-বৃষ্টি অনুভব করি তাকে রূপায়িত করার জন্যই না আমাকে বাংলা ভাষার কবিতায় ব্যবহৃত ধ্বনি শাস্ত্রের ইতিহাস ও তার বিবিধ চাল, তাল, ছাঁচ সম্পর্কে জানতে হয়েছে, জানতে হয়েছে বাংলা ভাষার ধ্বনির প্রকৃতি, রঙ ও ঢঙ। আমি তো আমার অনুভবের, আমার ব্যক্তি সমগ্রতার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটাবার অভিপ্রায়েই জানছি, শিখছি, দীক্ষিত হচ্ছি কবিতার অন্যান্য উপাদান ও ছন্দ-শাস্ত্রের বিবিধ দিক বিষয়ে। শুধুমাত্র শাস্ত্রবিদ হবার কোনো অভিপ্রায় আমার প্রথম থেকেই ছিল না, ছিল না শাস্ত্রের একান্ত অনুকার হবার ইচ্ছেও কোনো কালে। আমার ভেতর যে অসংখ্য রূপকথা বাস করে, বাস করে অনুভবের ভায়োলিন, পিয়ানো ও সেতারের বিচিত্র সুর তাকে অভিনব শৈল্পিক রঙে ও ঢঙে প্রকাশের জন্যই আমি বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের ধারাকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করে চলেছি; অন্ধের মতো অনুসরণ ও অনুকরণ করে ১০০ ভাগ পুরাতন ছাঁচে নিজেকে প্রকাশের জন্য নয়।
তাই, আমি আমার সেই নিজস্ব ছন্দকে আবিস্কারের সাধনায় নিজেকে অদ্যাবধি ব্যাপৃত রেখেছি, রসিকতা করে নিজস্ব সে ছন্দের নাম দিয়েছি ‘মখমলি ছন্দ’, যে ছন্দ আমার নিজের ভেতরই পুনঃপুন জন্মে, মরে এবং বয়ে ও বেজে চলে। তাই, বাংলা কবিতার নয় বরং বাংলা ভাষার যে ধ্বনি আছে, তার বয়ে চলার যে বেগমাত্রা আছে, তার মসৃণতা ও সুষমতা রক্ষা করা ছাড়া, কবিতা সৃজনের ক্ষেত্রে প্রচলিত ছন্দ-শাস্ত্রের আর কোনো নিয়ম বা রীতি এক শতভাগ (১০০%) রক্ষা করার দায় বর্তমানে আমি নিজের ভেতর অনুভব করি না। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা শব্দের মাঝে যে সূক্ষ্ম ভেদটি আছে, আছে এর অর্থ অনুভবের ব্যাপার তা আমি অনুভবের নিরন্তর চেষ্টা করি এবং মেনে চলি। আশা করি ছন্দ-শাস্ত্র সম্পর্কে উন্নাসিক কিংবা অজ্ঞ এবং এর ব্যবহারে অদক্ষ, অল্প দক্ষ ও ব্যর্থ কাব্যকর্মীর সাথে প্রাজ্ঞ ও সুদক্ষ কাব্যকর্মীর তুলনা করে কেউ নিজেকে অভিনব পথ সন্ধানী কাব্যকর্মীদের কাছে খেলো করবেন না।
বাংলা কবিতার ভবিষ্যতের কবিগণ তাদের কবিতায় যে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাবিহারীতার সুবিধা গ্রহনের মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে ভাবরস প্রকাশের ক্ষেত্রে যে যথাযথ শব্দ বা ভাষা বা উপমা ব্যবহার করার মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে অভূতপূর্ব বা অভিনব রূপ দিতে চান তাদের জন্য মিশ্রছন্দ প্রকৃত অর্থেই একটি আদর্শ ছন্দ। যে ছন্দ অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও গদ্যছন্দের নির্ভুল মিশ্রণে সৃষ্ট।
আমরা সকলেই জানি রেসের ঘোড়াদের মাঝে প্রথম স্থান অধিকারী ঘোড়ার লক্ষ্যে পৌঁছাবার সময়ের সাথে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ঘোড়াদের লক্ষ্যে পৌঁছাবার সময়ের পার্থক্য থাকে ন্যানো সেকেন্ডের মাত্র। এমন সূক্ষ্ম, অনুভবযোগ্য পার্থকের জন্যই একজন সর্বচ্চো মাত্রায় সমাদৃত ও পুরস্কৃত হয় আর অন্যেরা নয়। বাংলা ভাষার প্রতিটি ধ্বনিকে সূক্ষ্মভাবে অনুভব করতে পারায় অক্ষম ব্যক্তির পক্ষে বাংলা কবিতার প্রচলিত ছন্দ-শাস্ত্রের নিয়ম রীতির বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন কোনো ছন্দ পথ আবিস্কার করা যেমন অতি দুরূহ এক ব্যাপার, এই প্রবন্ধে নিহিত যথাযথ বার্তাটি সেইসব ব্যক্তির পক্ষে অনুভব করাও তেমনি দুরূহ এক ব্যাপার; যারা প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ছন্দ সমূহের ব্যবহারে অদ্যাবধি দক্ষতা অর্জন ও প্রদর্শন করতে চাননি, পারেননি এবং চাননি ও পারেননি এর ব্যবহারের ভাষাগত যথাযথ ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ জানতে ও অনুধাবন করতে; বিশেষ করে তাদের পক্ষে যারা এক মাত্রার ঘাটতি/ছাড়কে সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে কীভাবে কবিতায় নিপুণ ও শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করতে হয় এবং কীভাবে একটি পংক্তির ভেতর কোন পর্ব অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, কোন পর্ব মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এবং কোন পর্ব গদ্যছন্দে ব্যবহার করেও ছন্দ মসৃণতা বা ধ্বনির লয়ের মসৃণতা নিখুঁতভাবে বজায় রাখতে হয় তা অনুশীলন করেননি তাদের পক্ষে এই প্রবন্ধের অন্তর্নিহিত বার্তাটি অনুভব করা আদতেই অসম্ভব প্রায়। এই জাতীয় কাজগুলো এতোটাই সূক্ষ্ম যে শুধুমাত্র অতিমাত্রায় দক্ষ কাব্যকর্মীর পক্ষেই এমন দুরূহ কাজ করা সম্ভব, অন্য কারো পক্ষে নয়।
মখমলি-ছন্দ বলতে প্রকৃতে আমি মিশ্রছন্দের সবচেয়ে নিখুঁত, সূক্ষ্ম ও চূড়ান্ত রূপটিকেই বোঝাতে চেয়েছি। যেসকল কাব্যকর্মী প্রচলিত ছন্দ, যথা- অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও গদ্য ছন্দে কবিতা সৃজনের পাশাপাশি দীর্ঘদিন নিজস্ব ছন্দের খোঁজ করেন, পাশাপাশি ভাঙতে চান প্রচলিত ছন্দের ধারণা, পরিশেষে হয়তো তারাই খুঁজে নেন কিংবা থিতু হন এমন এক বৈচিত্রপূর্ণ ও জটিল ছন্দে যা গুণে হোঁচটহীন/মসৃণ এবং রূপে/বৈশিষ্টে অপ্রচলিত। বাংলা কবিতার ভবিষ্যতের কবিগণ তাদের কবিতায় যে স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাবিহারীতার সুবিধা গ্রহনের মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে ভাবরস প্রকাশের ক্ষেত্রে যে যথাযথ শব্দ বা ভাষা বা উপমা ব্যবহার করার মাধ্যমে বাংলা কবিতাকে অভূতপূর্ব বা অভিনব রূপ দিতে চান তাদের জন্য মিশ্রছন্দ প্রকৃত অর্থেই একটি আদর্শ ছন্দ। যে ছন্দ অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও গদ্যছন্দের নির্ভুল মিশ্রণে সৃষ্ট। অর্থাৎ যে কবিতায় বিভিন্ন পংক্তিতে মিশোল থাকে বিভিন্ন ছন্দের কিংবা যে কবিতায় একাধিক রকমের ছন্দ স্থান পায় কিংবা গদ্য পদ্য মিশানো থাকে; যে ছন্দ, ‘ছন্দে থেকেও ছন্দে না থাকার স্বাধীনতা ও স্বচ্ছাবিহারীতা’ উপভোগের ছন্দ, অভিনব আনন্দে ভাসিয়ে দেবার বৈচিত্র্যময় ছন্দ।
মিশ্রছন্দে সৃজিত কবিতা কেমন হতে পারে তার নমুনা হিসাবে নিম্নের কয়েকটি কবিতা উল্লেখ করা হল:
সমুচিত কৃষ্ণ কালে
সমুচিত কৃষ্ণ ক্ষণে
হায়, কাউকে পাবে না তুমি পাশে!
ক্রূর-গুপ্ত-শর, চক্রী পামর,নিমেষেই টেনে দেবে নিকরের ইতি।
সমুচিত কৃষ্ণ দিনে
পাবে টের, নিঃস্বের কোনো মিত্র নেই
পাবে টের, নিঃস্বের কোনো রাষ্ট্র নেই
পাবে টের, নিঃস্ব কতটা আয়ুধহীন!
সমুচিত কৃষ্ণ কালে
তবু কিছু সূর্যমুখী, মুক্ত কলম, প্রশ্ন তুলেই চলে।
চেকনাই
মানবিক সাকোগুলো ভেঙে দিয়ে, মেধা
হীরক কাঠিন্যে গড়ে তোলে নির্মম ভেদরেখা
মানুষে মানুষে; হয়তো একারণেই
ভলতেয়ার, হৃদয়ের পর মেধাকে বসতে দিতেন;
মেধা তো মেধাই,তার সাথে পারে কী হৃদয়!
তাই বুঝি গ্রহজুড়ে
সিল্কি ভেল্কি ফাঁদ, বিষম পিছল বাক, সাদাকালো খুন;
তাই বুঝি গ্রহজুড়ে
বিভেদ কুহকে বাঁচে, বেড়ে চলে, সৌভিক ফড়িয়ার চেকনাই।
দেহভাষা
গৎবাঁধা বিশ্বাস ভ্রান্ত স্বভাবী; ছালচোখে সবকিছু পড়ে বুঝি ধরা?
ছয় নয় বুঝ নিয়েও ঘুমাতে চাও?
ভালো; অসম চাতালে দেখ ভরে গেছে সাম্যের মেলা!
দেহভাষা বোঝো যদি
কপালে নির্ঘাত জুটবেই নির্ঘুম রাত;
সরল দৃশ্যপট খেল্, গরলের খোলস কেবল!
ফিউজিটিভ
পালাতেই চাইছ তুমি, তাই
দিগ্বিদিক ছুটছ;
নিজেও তো জান তুমি—
এই ছোটা অর্থহীন
তবু হায় গতির ভেতর স্থিতির বাগান খুঁজছ!
পালাতে চাইছ বলেই মরচে অতীত উবছে কই
আগুনে চুলোর গর্ভে বুঝি, ছায়ার উঠান খুঁজছ?
পালাতে চাইছ বলেই, আঁচল মনন চাবুক এখন, গোখরা হয়ে ফুঁসছ।
যে পথে রূপকথা দেয় দেখা
মসলিন বোধ আর
মেধাবী ভজনে, ফোটে যে নতুন
অজ্ঞাত, ফোটে যে সুশীল
অর্কিড, অপ্রত বুনোফুল,
সে পথেই হাঁটাহাঁটি, করি নিত্য চলাচল;
এই মেঘ-মন
খাল-বিল হাওড়-বাওড়ে
এই বন-ঘুম
ঝোপ-ঝাড় পাহাড়-শিখরে
বাঁচি, আমোদ গ্রহণ করি হর্ষে বিলাই;
এই পথ
নিগুঢ়ে স্বাধীন
আলতো ঢঙে শুধু প্রকাশ্যে বাঁধা
এই পথ
অভূতপূর্বের খোঁজে সীমার সূত্রে গাঁথা;
এ পথ চলে না গড়ের হিসেব মেনে
এ পথ বলে না শাস্ত্র-বিরোধী কথা
এ পথ লড়ে না শাস্ত্র-পক্ষে কভু
এ পথ রচে না বিশেষ দৃষ্টি বীজে
এই পথ
গাছেদের পাখিদের ফুলেদের
মানবের মানবীর আত্মার নির্যাসে গাথা;
এই পথ
অবিরাম বুনে চলে নতুনের মুগ্ধ-রূপকথা …

সৈয়দ ওয়ালী।
জন্ম : ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৭। পুরানো ঢাকায়। ভাব, ভাষা, ছন্দ ও শৈলী নিয়ে বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং এসব উপাদানের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে সৃজন করে চলেছেন কবিতার জগৎ। প্রকাশিত কবিতার বই : বিনত খসড়া [২০১৪], জলজ স্বাক্ষর [২০১৭], প্রণয়পুরাণ [২০১৮], ছাইরঙা নথির বয়ান [২০২৩]।