মধ্যশিক্ষা ও অর্থকরী বিদ্যা
মোতাহের হোসেন চৌধুরী
শিক্ষা আমাদের জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। বিদ্যায়তনিকেই যে কেবল মানুষ সেই সক্ষমতা অর্জন করে তেমন নয়। নানানভাবেই কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জিত হতে পারে। প্রচলিত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার পাঠ চলে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের বাইরেও কৃষক বা বিভিন্ন পেশাজীবীদের কাজের দক্ষতা অর্জন এবং অভিজ্ঞতাও জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
উত্তরপর্বের শিক্ষা বিভাগে থাকবে এসব ভাবনা অথবা জিজ্ঞাসা। এ বিষয়ে নতুন বা পুরোনো রচনা, যা-ই হোক, প্রাসঙ্গিকতাই মুখ্য। এমনকি স্থানিক, আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের শিক্ষা-ভাবনাও আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। সূচনা সংখ্যায় উত্তরপর্বে থাকছে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধ। এটি নেওয়া হয়েছে লেখকের ‘সংস্কৃতি-কথা’ বই থেকে।
উল্লেখ্য, মোতাহের হোসেন চৌধুরী এই অঞ্চলের মুসলিম সমোজের জাগরণ ও অগ্রসর চিন্তার পাটাতন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লিখেছেন ‘শিখা’ পত্রিকায়। ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রথম প্রকাশ হয় ফাল্গুন ১৩৬৫ বঙ্গাব্দে। সমকাল প্রকাশনী থেকে।
দিব্যি আরামে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া কাল কাটাইবার দিন আর নাই। এখন আমরা প্রায় সকলেই কম-বেশী আত্মসচেতন হইয়া উঠিয়াছি। এই আত্মসচেতনতার পেছনে রহিয়াছে আমাদের শিক্ষা। শিক্ষা আর যা’ই না করুক, জীবনযাত্রার আদর্শ সম্বন্ধে যে আমাদের দৃষ্টিকোণ বদলাইয়া দিয়াছে তা’তে সন্দেহ নাই । এখন আমরা কেহই আর জীবনকে মায়া বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাই না, সকলেই বাঁচিতে চাই—জগত ও জীবনকে উপভোগ করিতে চাই।
কিন্তু বাঁচিতে চাহিলেই তো বাঁচা সম্ভব হয় না, পথে বিস্তর বাধা। সেই বাধা অতিক্রম করিয়া নির্ঝরিণীর মত নাচিয়া নাচিয়া দুলিয়া দুলিয়া ছুটিতে পারিতেছি না বলিয়াই আমাদের চেহারায় অতৃপ্তির আভাস সু-পরিস্ফুট—কেমন এক বিতৃষ্ণায় আমাদের ললাট ও নাসিকা কুঞ্চিত। আমরা সকলেই মুখে, না হউক, অন্ততঃ চেহারা দিয়া যেন বলিতেছি— না মশাই, কিছুই ভালো লাগিতেছে না, যেমনটি হইতে চাহিয়াছিলাম তেমনটি আর হইতে পারিলাম কই? এই দুঃখ আবার তাহারই বেশি যে হতভাগা শিক্ষাকে শুধু মস্তিষ্কে গ্রহণ না করিয়া জীবনে প্রয়োগ করিতে উৎসুক। জ্ঞানবৃক্ষের ফল গ্রহণ করিয়াছে বলিয়া সে বেচারী চিরদিনের জন্য শান্তিস্বর্গ হইতে বিচ্যুত।
এই অতৃপ্তি ন্যায় কি অন্যায়, ভালো কি মন্দ সেই বিষয়ে বিশেষ যুক্তি-তর্ক খরচ না করিয়া শুধু এই মাত্র বলিতে চাই যে, অতৃপ্তি থেকেই যখন নবসৃষ্টির সম্ভাবনা, তখন যতই তিক্ত হউক না কেন, তাহাকে জীবনে গ্রহণ না করিয়া উপায় নাই।
অতৃপ্তির বিশেষত্ব এই যে তাহা প্রশ্নকারী ও বিশ্লেষক। সমাজনীতি ত ধর্ম্মনীতি, শিক্ষানীতি সমস্ত কিছুকেই তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া তন্ন-তন্ন করিয়া দেখিতে চায়, কোন কিছুকেই অমনি বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ করিত অতৃপ্তির বিশেষত্ব এই যে তাহা প্রশ্নকারী ও বিশ্লেষক। সমাজনীতি ত ধর্ম্মনীতি, শিক্ষানীতি সমস্ত কিছুকেই তাহা ভাঙ্গিয়া চুরিয়া তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে চায়, কোন কিছুকেই অমনি বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ করিতে চায় না। সুতরাং এতদিন শিক্ষালাভের পরেও যখন আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও সুশৃঙ্খলা দেখা দিল না, তখন আমাদের অতৃপ্ত চিত্তের দৃষ্টি যে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির ত্রুটি উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হইবে তাহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। শিক্ষা জীবনের গোড়ার কথা ; সুতরাং আগায় জল না দিয়া যে আমরা গোড়ায় জল দিতে চাহিতেছি তাহাতে সুবুদ্ধিরই পরিচয় দেওয়া হইতেছে। বস্তুতঃ আমাদের জীবনের বিফলতার জন্য শিক্ষা যতটা দায়ী আর কিছুই ততটা নয়। শিক্ষা আমাদিগকে দস্তুর মতো প্রবঞ্চিত করিয়াছে।
আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির ত্রুটি কত। প্রথমেই মনে হয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য যে মননশক্তি ও বিচারবোধের উন্মেষসাধন, বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি তাহা করিতে সক্ষম হয় নাই। অন্ধতা, কুসংস্কার, দলীয় মনোভাব (herd instinct), ইত্যাদি অশিক্ষিতজনোচিত মানসিকতার প্রভাব আমাদের জীবনে এখনো পুরামাত্রায় বিদ্যমান। সত্য বলিতে কি, শিক্ষা আমাদিগকে পরিবর্ত্তিত করিতে সক্ষম হয় নাই, যাহা ছিলাম তাহারই উপর কিছুটা রঙ্ ফলাইয়াছে মাত্র। কিছু ইংরাজি বলা ও একটু চট্পটে হইয়া চলা, এই যেন আমরা মনে করিতেছি শিক্ষার উদ্দেশ্য।
কিন্তু অতৃপ্তিবানবিদ্ধ হইয়া আমরা এতটা ছট্ফট্ করিতেছি যে আমাদের দৃষ্টি যেখানে পড়া উচিত সেখানে পড়িতে না দিয়া অন্যত্র পড়িতে দিতেছি। শিক্ষার এতসব প্রধান প্রধান ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দৃষ্টি পড়িল কিনা তাহার আহার-সংস্থানের অক্ষমতার উপর! আমাদের ভাবখানা এই রকম যে, শিক্ষা হইতে মনের আহার যাহা লাভ করিবার তাহা আমরা করিয়াছি, এখন পেটের আহার হইলেই বাস্। (এই মনোভাব নিন্দনীয় নয়; বরং এক হিসেবে প্রশংসনীয়। কারণ তাহা আমাদিগকে এক বিরাট কপটতা ও মিথ্যাচার হইতে মুক্তি দিতে সক্ষম হইয়াছে। বড় বড় আধ্যাত্মিক কথার আড়ালে আমরা যে সাধারণ বুভুক্ষ মানুষটিকে লুকাইয়া রাখি তাহা এই মনোভাবের মধ্য দিয়াই প্রথম সুস্পষ্ট আলোকে মুখ বাহির করিল । আর আমরাও নিজদিগকে সত্য ভাবে চিনিবার সুযোগ লাভ করিলাম।) সুতরাং রব উঠিয়াছে, শিক্ষাকে অর্থকরী করিয়া তোল— বিশ্ব-বিদ্যালয়কে বৈশ্য-বিদ্যালয়ে পরিণত না করিলে আর আমাদের নিষ্কৃতি নাই। শুধু কলমবাজ হইলে চলিবে না, দস্তুরমতো তুরপুন ও মাকু-চালনাতে দক্ষ হওয়া চাই।
কথাটা ভাবিয়া দেখিবার মতো। এই বৈশ্যযুগে সকলকেই কিছুটা বৈশ্যবৃত্তি অবলম্বন করিতে হইবে, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। যুগের ছাপ যাঁহার গায়ে না লাগে তিনি হয়তো মহাপুরুষ, কিন্তু শিক্ষার্থীমাত্রকেই যে অসাধারণ মহাপুরুষ হইতে হইবে তাহার কোন হেতু নাই। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে আমরা যে-পথে চলিতে চাই— সেই পথ আমাদিগকে লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাইয়া দিবে কিনা।
শিক্ষিতের সংখ্যা অতিরিক্ত বাড়িয়া যাওয়ার দরুণ এখন তাহার ‘ভোকেশানালত্ব’ দূরীভূত হইয়াছে, অর্থাৎ শিক্ষিত হইলেই এখন আর কেরাণীগিরী সহজলভ্য হয় না। টেকনিক্যাল বিদ্যা-জানা লোকদের বেলাও অনুরূপ ব্যাপার ঘটা অসম্ভব নয়। অতএব শিল্পী-সৃষ্টির দিকে বিশেষ নজর না দিয়া শিল্পকার- সৃষ্টির দিকে নজর দেওয়াই বৰ্ত্তমানে আমাদের কর্তব্য।
বলাবাহুল্য পেটের আহার আমরা চাই । তাহা ছাড়া আনাদের পক্ষে বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব। কিন্তু স্কুলের ছেলেদের কিছু মিস্ত্রিবিদ্যা, বয়নবিদ্যা শিক্ষা দিলেই যে দৈন্যদুর্দশা দূরীভূত হইয়া আমরা রাতারাতি ফাঁপিয়া উঠিব এমন তো মনে হয় না। আমাদের দেশের তাঁতি, সুতার ও অন্যান্য কুটীরশিল্পীগণ যখন অৰ্দ্ধাহারে ও অনাহারে কালাতিপাত করিতেছে তখন উক্ত পন্থাকে কিছুতেই সুচিন্তিত পন্থা বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না। বরং মনে হয়, তাহাতে বেকারসমস্যা আরো ঘোরতর রূপ ধারণ করিবে। কারণ তাহাতে শিল্পীর সংখ্যা কর্মের অনুপাতে অনেক বাড়িয়া যাইবে বলিয়া তাহাদের প্রাপ্তি অনেক কমিয়া যাইবে, এবং অনেকের ভাগ্যে কাজ না জোটার দরুণ প্রাপ্তির ঘরে শূন্য থাকিবে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশী হইলে যে-অবস্থা হয় তাহাই হইবে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়া ব্যাপারটা পরিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতেছি : আমরা বর্তমানে টেকনিক্যাল ও ভোকেশ্যান্যাল শিক্ষার জন্য চীৎকার করিতেছি। কিন্তু ভুলিয়া যাইতেছি যে, আমাদের বর্ত্তমান শিক্ষাপদ্ধতিও এক সময়ে বৃত্তিসূচক* শিক্ষার অনুরূপই ছিল—তখন কেরাণী-সৃষ্টি করাই ছিল তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু শিক্ষিতের সংখ্যা অতিরিক্ত বাড়িয়া যাওয়ার দরুণ এখন তাহার ‘ভোকেশানালত্ব’ দূরীভূত হইয়াছে, অর্থাৎ শিক্ষিত হইলেই এখন আর কেরাণীগিরী সহজলভ্য হয় না। টেকনিক্যাল বিদ্যা-জানা লোকদের বেলাও অনুরূপ ব্যাপার ঘটা অসম্ভব নয়। অতএব শিল্পী-সৃষ্টির দিকে বিশেষ নজর না দিয়া শিল্পকার- সৃষ্টির দিকে নজর দেওয়াই বৰ্ত্তমানে আমাদের কর্তব্য। দেশের বুকে শত শত কলকারখানা স্থাপনের ভিতর দিয়া যাহাতে অসংখ্য কর্মের সৃষ্টি করা যায়, সেই দিকেই যেন আমাদের সকল ইচ্ছা ও উদ্যম ধাবিত হয়। কর্ম্মের সৃষ্টি হইলে কর্ম্মী আপনা হইতেই দেখা দিবে, কর্ম্মীর সৃষ্টি হইলে কৰ্ম্ম নাও দেখা দিতে পারে। য়ুরোপে যে টেকনিক্যাল স্কুলের ছড়াছড়ি তাহারও হেতু এইখানে যে, সেখানে অসংখ্য কলকারখানার সৃষ্টি হইয়াছে। সেগুলির পেট পুরাইবার জন্যই ঐ টেকনিক্যাল বিদ্যালয়গুলি প্রতি বৎসর অজস্র কর্ম্মী সৃষ্টি করিতেছে। কলকারখানা বা ফ্যাক্টরী স্থাপনে কোন রাষ্ট্রিক অসুবিধা আছে কি না জানি না । থাকিলে তাহা দূরীভূত করিতে হইবে। রাষ্ট্রের কৃপা ব্যতীত কখনো আর্থিক সমস্যার সমাধান হইতে পারে না। যে-প্রকারেই হোক, রাষ্ট্রের কৃপাদৃষ্টি আমাদের লাভ করিতেই হইবে। নইলে মুশ্কিল আসান অসম্ভব ।
তবে বিদ্যালয়ে যে টেকনিক্যাল এডুকেশনের কোন প্রয়োজন নাই তাহা নয়। মানস গঠনের জন্য তাহার যথেষ্ট প্রয়োজন। বুদ্ধিকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য কেজো জ্ঞানের নিতান্ত আবশ্যক। পৃথিবীর নবতীর্থস্থান রাশিয়াতেও এই উদ্দেশ্যেই বিদ্যালয়ে টেকনিক্যাল এডুকেশন প্রবর্ত্তিত হইয়াছে—শিক্ষার্থীকে সুপটু ব্যবসায়ী করিয়া তুলিবার জন্য নয় । নানারূপ যন্ত্রপাতির সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া শিক্ষার্থী নিজের সৃজনীশক্তির সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারে এবং বুদ্ধিকে নানাদিক দিয়া খেলাইয়া তুলিতে পারে। তাহাতে অভিজ্ঞতার আনন্দময় উপলব্ধির ভিতর দিয়া সে নিজের সামর্থ্য সম্বন্ধে সচেতন হয়। শুধু পুঁথির বিদ্যায় তাহা অসম্ভব। পুঁথির বিদ্যা আমাদিগকে শুধু বাহিরের জ্ঞান দিতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতার আনন্দময় উপলব্ধি নয়। তাই শিশুর চিত্ত যন্ত্রপাতির প্রতি যতটা ধাবিত হয় পুঁথির প্রতি ততটা হয় না। বুদ্ধিকে সক্রিয় রাখিবার জন্য যন্ত্রপাতি সত্যই এক কল্যাণকর অবদান।
শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া মনীষী রাসেল বলিয়াছেন : শিক্ষার উদ্দেশ্য হইতেছে শিক্ষার্থীর মধ্যে vitality, courage, intelligence ও sensitiveness এই চারিটি গুণ সৃষ্টি করা। এই চারিটি গুণ সৃষ্টি হইলেই শিক্ষার উদ্দেশ্য পূর্ণ হইল, কেননা তাহা হইলেই শিক্ষার্থী জগত ও জীবনকে উপভোগ করিবার সামর্থ অর্জ্জন করিল। তাহার পর সেই গুণরাজি সম্বল করিয়া সে যাহাই করুক না কেন, তাহাতে শিক্ষকের বা শিক্ষাপদ্ধতির কিছুই আসিয়া যায় না। তাহার পর হইতেই রাষ্ট্রের কর্তব্য শুরু হইল। রাষ্ট্রকে সহায় করিয়া সে জীবনে সার্থক হইল তো ভালোই, না হইলে শিক্ষার ত্রুটি ধরিতে যাওয়া ন্যায়সঙ্গত হইবে না।
পরিশেষে আমার বক্তব্য এই যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীকে successful করিয়া তোলা নয়, মানুষ করিয়া তোলা— অন্য কথায়, বুদ্ধি, বিচারবোধ ও কল্যাণানুরাগে শিক্ষার্থীর চিত্ত ঐশ্বর্যশালী করিয়া তোলা ।** একথা অস্বীকার করিয়া successকেই বড় করিয়া দেখিলে শিক্ষার্থীকে নীতির দিক দিয়া অনেকখানি নীচে নামিয়া যাইতে হয়। কারণ তাহা হইলে তাহাকে এমন কতগুলি জঘন্য মনোবৃত্তির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয় যাহা ব্যতীত সংসারে কৃতকার্য্যতা লাভ করা অসম্ভব । তোষামোদ, আত্মপ্রচার, গায়ে-পড়া ভাব, বেহায়াপনা, চালিয়াতি ইত্যাদি ব্যতীত যে আজিকার দিনে কৃতকার্য্যতার মুখ দেখা মুশকিল, দৃষ্টিমান মাত্রই তাহা স্বীকার করিতে বাধ্য। অথচ আত্মার অকল্যাণ সাধনের শক্তিতে ইহারা প্রবল—মানুষকে দিন দিন নীচে নামাইয়া অনুভূতিহীন পশুতে পরিণত করিতে ইহাদের মতো দ্বিতীয়টি আর নাই। এই সব জানিয়া শুনিয়াও যদি success-এর bitch goddess-কেই আমরা আরাধ্যা করিয়া তুলি, তবে আধ্যাত্মিকতা, নীতি, চরিত্র ইত্যাদি বড় বড় কথাগুলি পাঠ্যপুস্তক হইতে সরাইয়া দিয়া তাহাদের স্থানে উপযুক্ত মনোবৃত্তিগুলির জয়ঘোষণা করাই বাঞ্ছনীয়; অথবা বিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ঐসব বিষয়ের শিক্ষার জন্যও ট্রেনিং ক্লাস খুলিয়া দেওয়া উচিত। তাহা হইলে, আর যাই না হোক্, দেখিতে বেশ সুন্দর হইবে! দুই বিপরীত ধরণের শিক্ষা দুই দিকে থাকিয়া একে অন্যকে ঠাট্টা করিতে থাকিবে। শিক্ষাতত্ত্ববিদগণ ঝোঁকের বশে তাহাও সমর্থন করিবেন কি না জানি না।
—————————————————
* Vocational education-এর বাংলা সাধারণত বৃত্তিমূলক শিক্ষা করা হয়। কিন্তু তাহা ভুল। কারণ বৃত্তি শিক্ষার মূলে থাকে না, বরং শিক্ষা বৃত্তির সূচনা করে——লেখক।
** পৃথিবী যে দিন দিন বিশ্রী হইয়া যাইতেছে তাহার হেতুও এইখানে যে, এই সত্যযুগেও মানসিক সৌন্দর্যের বিশেষ মূল্য দেওয়া হয় না। মানসিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যেখানে গৌরব মিশ্রিত, সেখানেই আমাদের নজর, অন্যত্র না। এইজন্য নামের লোভে অনেক সময় আমরা আত্মহত্যা করিয়া বসি। নামের নেশায় মশ্গুল হইয়া এমনভাবে কাজে লাগিয়া যাই যে, পরিণামে বড় কাজ করিতে সক্ষম হইলেও মনের সূক্ষ্ম ও সুন্দর বৃত্তিগুলি নষ্ট হইয়া যায়। এইজন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্ত্তন আবশ্যক। বড় বড় কাজের পরিবর্ত্তে, আত্মাসৃষ্টিকে বড় করিয়া দেখিলে আমরা এই দুর্দশা হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারি। এ সম্পর্কে A. C. Benson-এর উক্তিটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন : ‘Our belief in sheer tangible performance is a rather uncivilized thing, or rather our disdainful neglect of what is merely beautiful delightful is a dull and barbarous thing.’