রক্ষণশীলতার বিপরীতে একজন আয়শা খানম
মুক্তি পথের অনিঃশেষ অভিযাত্রী: আয়শা খানম স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদনা : অধ্যাপক অনুপম সেন [সভাপতি]
সদস্য সচিব : সীমা মোসলেম
প্রকাশকাল : অগাস্ট ২০২৩
প্রকাশক : আয়শা খানম স্মারকগ্রন্থ নাগরিক কমিটি
১০/বি/১ সেগুনবাগিচা, ঢাকা
আয়শা খানম। নারীর মানবাধিকার কর্মী। যিনি দেশ নিয়ে ভাবতেন। সমাজ নিয়ে ভাবতেন। আজীবন লড়ে গেছেন সমাজের অন্যায়, বৈষম্য, রক্ষণশীলতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। এমন সংগ্রামী নারীনেত্রীর জীবনচরিত নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা-গবেষণা করাটা তরুণপ্রজন্মের জন্য ভীষণ জরুরি।
আয়শা খানমের জন্য ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর। ছায়া সুনিবিড়, সবুজ-শ্যামলে ঘেরা এক গ্রাম, নেত্রকোনা জেলার গাবরাগাতিতে তাঁর বেড়ে ওঠা। ওই গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ শেষে নেত্রকোনার গার্লস হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ময়মনসিংহ মমিনুন্নেসা গার্লস কলেজে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
গার্লস স্কুলে পড়া চলাকালীন সময় থেকেই আয়শা খানম ছিলেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পরিচিত মুখ। লড়েছেন শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে। এটিই ছিল তাঁর জীবনের বাঁক বদল। এরপর ছাত্রজীবনে বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনসহ ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে রোকেয়া হলে অবস্থানকালে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মধ্যে অনর্গল যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য প্রদানের বিশেষ গুণ ছিল। ১৯৬৯ সালে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৭০ সালে সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।
আয়শা খানমকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থ ‘মুক্তিপথের অনিঃশেষ অভিযাত্রী’ প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। গ্রন্থটির সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক অনুপম সেন এবং সদস্য-সচিব সীমা মোসলেম। সদস্য—ফওজিয়া মোসলেম, ডা. মাখদুমা নার্গিস, সুলতানা কামাল, মফিদুল হক, আবুল মোমেন, শাহরিয়ার কবীর, মালেকা বানু ও মাহবুব জামান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, রেহমান সোবহান, গোলাম মুরশিদ, সনৎকুমার সাহা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ, পরিবারের সদস্য; উন্নয়নকর্মী থেকে সাংবাদিক যারাই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও আয়শা খানমের সঙ্গে সহযোদ্ধা ছিলেন, সবাই তাদের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই স্মারকগ্রন্থে। লিখেছেন নিজেদের চিন্তার অভিব্যক্তি, মননের কথা। রয়েছে আলোচনা-পর্যালোচনা এবং স্মৃতিবিজড়িত নানান কথা।
মুক্তিযুদ্ধেও আয়শা খানমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আগরতলায় চিকিৎসাসেবায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, ক্যাম্পে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় কাজ করেন। ছাত্র-প্রতিনিধি হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ থেকে বক্তৃতা দান করে জনমত তৈরির কাজে ভূমিকা রাখেন। সেসব নানান বিষয় নিয়ে গ্রন্থটিতে লেখকরা স্মৃতিচারণ করেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর উচ্চশিক্ষা শেষে বিভিন্ন পেশায় যোগদানের সুযোগ সামনে থাকলেও নারী অধিকার আন্দোলনে সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে নিবেদন করেন। আমৃত্যু এই সংগ্রাম তিনি করে গেছেন। ১৯৭২ সালে মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত থেকে সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৮ সাল থেকে সভাপতি হিসেবে শেষদিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এসব পদে আসীন থাকা অবস্থায় তাঁর ভূমিকা খুব সাবলীলভাবে গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে। যে কারণে এটি আয়শা খানমের বাস্তবতা উঠে এসেছে।
একজন ব্যক্তির জীবন মানে শুধু তার পারিবারিক, ব্যক্তিগত ঘটনাবলি নয়। জীবন মানে সমগ্রতা। যেখাবে থাকবে শৈশবের হাসিকান্না, বংশপরম্পরার স্মৃতি। প্রিয়জনদের খুনসুটি। বন্ধু-স্বজনদের আলোচনা এবং রাজনৈতিক জীবন হলে তো তার সহকর্মীদের গুরুগম্ভীর প্রাঞ্জল আলোচনা। এই স্মারকগ্রন্থ এসব জায়গায় একেবারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঢাউস আকারের এই গ্রন্থে কোনো বাড়তি কথন নেই, নেই কোনো অতিবার্তা বা অতিভক্তির প্রকাশ।
আজীবন সংগ্রামী এই নারী নেত্রীর স্মারকগ্রন্থটি সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছে, একজন ব্যক্তিকে তুলে ধরতে হলে কোন কোন বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। আয়শা খানমের দীর্ঘ জীবন-সংগ্রাম ও বহুমাত্রিক কর্মের পরিচয় সাবলীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে গ্রন্থটিতে। রয়েছে সারল্যের বহির্প্রকাশ।
সাংবাদিক শামীম আজাদ ‘তোমার জন্য পুষ্প ও প্রণাম’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘এখন চারিদিকে কেবল হারাই হারাই। হায় হায়! একা হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ মনে হয় চলে যাচ্ছে আমার সময়ের সব গৌরব। ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে আমার সকল শক্তি ও সাহস। আর কি পাবো তাদের, আমার সময়ের এ সোনার মানুষদের…?’ এই যে আর্তনাদ, হারানোর ব্যথার প্রকাশ—তা গ্রন্থটির উপলব্ধির বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম ‘পথের সাথী: প্রিয় আয়শা’ শিরোনামে নিজের ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো যেন বাক্যের পর বাক্য দিয়ে সাজিয়েছেন। আবেগের ডালা খুলে লিখেছেন। স্মৃতির দরজায় নেই কোনো কপাট, সব কপাটই যেন খুলে ফেলেছেন এ লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে। স্মৃতিকথা তো এরকমই হওয়ার কথা, যা পাঠককে রক্ত মাংসের ওই স্মৃতিময় মানুষটির অস্তিত্বের সম্মুখীন করবে। জানাবে ওই ব্যক্তির জীবনকর্ম এবং পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন সম্পর্কে। তাঁর লেখায় শ্রমিক, কৃষক, নারী-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো দিকটাই সাবলীলভাবে উঠে এসেছে। এর সঙ্গে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। সেসময় কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩১ ডিসেম্বর আমরা সব মেয়েরা মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসি। আয়শা তখনও ছাত্র আন্দোলনে ‘এসো স্বদেশ গড়া’র ব্রত নিয়ে কর্মরত। ইতোমধ্যে আয়শা নারী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ছাত্র আন্দোলনে আয়শার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা চিন্তা করে তাঁর রাজনৈতিক অভিভাবকের মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল থেকে বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দ উচ্চতর গবেষণায় যুক্ত হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্যে স্থির আয়শা খানম নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে নারী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৭২ সালে মহিলা পরিষদের প্রথম সম্মেলনে তিনি মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। শুরু হয় নারী আন্দোলনে তাঁর অভিষেক।’ এই লক্ষ্য দৃঢ় হওয়ার কারণেই তিনি প্রাসঙ্গিক।
সেই যে যাত্রা শুরু ষাটের দশকে। সেই যাত্রাপথে হেঁটেছেন মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত। পথভ্রষ্ট হননি। কাউকে পথভ্রষ্ট হওয়ার মতো অনুপ্রেরণা জোগাননি এই ব্যক্তিত্ব। তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সংগঠন, আন্দোলন এবং নারীনেত্রীদের। যারা আজ নানাভাবে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় রচিত হয়েছে এমন একটি স্মারকগ্রন্থ।
এ গ্রন্থে লক্ষ্মী চক্রবর্তী ‘ভেঙেছো দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময়, তোমারই হোক জয়’ শিরোনামে স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখানে আয়শা খানমকে নিয়ে সহজ-সাবলীল এবং সুগঠিতভাবে নানা স্মৃতিচারণ করেছেন। লেখার মধ্যে সারল্যের ছাপ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কেমন আদর আদর। লেখাটি পড়তে গিয়ে মনে হবে, সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছেন দুজন ব্যক্তিত্ব। একে-অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক আলোচনা করছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমি আয়শা খানমকে দেখেছি সতত তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। সমাজ প্রগতির লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। অন্ধত্ব, কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। মহিলা পরিষদের অনলাইন জাতীয় পরিষদ সভায় আয়শা খানম আগামী কর্মপরিকল্পনা ব্যক্ত করছেন। আমরা মহিলা পরিষদের সকল জেলার কর্মীরা অনুপ্রাণিত হয়েছি এই বক্তব্যের ফলে। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।’
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা আজ গুঁড়েবালি। তবু হতাশার মাঝে এ মানুষগুলোই আশার পথ নির্দেশ করে। যে ব্যক্তিত্ব নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে মহিলা পরিষদের নাড়িতে বেঁধে এক অভিন্ন সত্তা হিসেবে দেখতেন, তাঁর সেই চিন্তা সমাজ সংস্কারের পথে ধাবিত করবে নতুন প্রজন্মকে। কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হবে লক্ষ্যে।
বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে আয়শা খানমের অর্জনগুলো—তিনি ১৯৯৩ সালের ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলন, চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, UNIFEM, UNESCAP, CSW, UNCEDAW, UNWOME-সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং সেসব সম্মেলনে অর্জিত অভিজ্ঞতা সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত করার প্রয়াস নেন। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন সংস্কারের আন্দোলন, UFC বাস্তবায়ন, সিডও সনদ বাস্তবায়ন আন্দোলন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের আন্দোলন জোরদার করা ও জাতীয় এজেন্ডায় পরিণত করার ক্ষেত্রে তাঁর পথনির্দেশনা ও একনিষ্ঠতা অনুসরণীয়। ২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েটের দায়িত্ব পালন করেন।
অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো উৎসারণ করার মতো মহৎ কাজ করে থাকেন সমাজের গুটিকয়েক ব্যক্তিত্ব। যাদের আজীবন লড়ে যেতে হয়, লড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি রাখতে হয়। তার সহকর্মী লক্ষ্মী চক্রবর্তী স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমাদের এই প্রিয় নেত্রীকে কীসের সাথে তুলনা করবো—যার সীমানা অতল সমুদ্রের তলদেশে সন্ধান করা যায় না, হিমালয়ের সুউচ্চ এভারেস্ট শৃঙ্গের সাথেও তুলনা করা যায় না। কী লিখবো আমাদের অভিভাবক সম্পর্কে তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে কঠিন একটা বিষয়।’ এ কটা লাইনই বুঝিয়ে দেয় তিনি আসলে তার সহকর্মী, বন্ধুদের মননে কত গভীরভাবে মিশেছিলেন।
রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্কতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার যে প্রত্যয় তিনি দেখিয়েছেন, তা সত্যিই অভিনব। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে মুক্ত মনের অধিকারী। এই ব্যক্তিত্বের ভেতর যে চিন্তা-চেতনার অগ্রসরমানতা ছিল, তাকে অনুসরণ করেই আগামীর পথযাত্রীরা মিছিলে হাঁটবে। তিনি চেয়েছিলেন নারী-পুরুষের সমঅধিকারের ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক সমাজ। যে স্বপ্নই তাকে ‘আয়শা খানম’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমৃত্যু লড়েছেন তিনি, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত পশ্চাৎপদ নারীসমাজের অধিকার আদায়ের জন্য।
এস এম এ সবুর ‘স্মৃতিতে স্মরণে আয়শা খানম’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘‘উনিশ শতকের প্রথম ভাগে, বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে জাগরণ বা রেনেসাঁসের বিকাশ ঘটেছিল, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও ছিলেন সেই বাংলা রেনেসাঁর ভগীরথ। রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মে বিশ্বস্ত হলেও তিনি প্রতিমা পূজা এবং ধর্মের নামে নানা কুসংস্কারের ঘোরবিরোধী ছিলেন। হিন্দু ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজনে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রবর্তন করেন। ধর্মীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে মৃত স্বামীর সঙ্গে জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারার ‘সতীদাহ প্রথা’ বিলুপ্তির জন্য তিনি ‘সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন’ গড়ে তোলেন এবং তৎকালীন বৃটিশ সরকারের সহযোগিতায় ‘সতীদাহ প্রথা’ বেআইনি ও বাতিল করতে সমর্থন হন। এইভাবে তিনি শত শত বিধবা নারীর জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হন।’’
২০১৯ সাল। আয়শা খানমের জীবনে চলে আসে বিভীষিকময় ঘটনা। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। যিনি আজীবন সাহস সঞ্চয় করেছেন, তিনি তো রোগের কাছে সাহস হারাতে পারেন না। শক্তি, সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়ে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। মহিয়সী এই নারী ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের ইতিহাস টানতে হলে, আলোচনায় যে দুটি নাম জ্বলজ্বল করে, তাঁরা হলেন বেগম রোকেয়া এবং আয়শা খানম। স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবাধিকারের আন্দোলনে তিনি সমভাবে সক্রিয় ছিলেন। আয়শা খানমের লিখিত গ্রন্থের মধ্যে—‘নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়নের পথে’ (২০১৫); ‘মুক্তিযুদ্ধদিনের স্মৃতি’ (২০০১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যে পথ আয়শা খানম দেখিয়ে গিয়েছেন, সে পথ নিয়ে হোক আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনা। তবেই না সঠিক পথের দিশা মিলবে। মুক্তি বহুদূর, তবে সে পথে না এগিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। যে কোনো অধিকারই লড়াই করে আদায় করতে হয়। বিশেষত, একটি রক্ষণশীল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর বিরুদ্ধে আয়শা খানমরা যে লড়াই করে দেখিয়ে গেছেন, তা এ কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, ‘মুক্তি পথের অনিঃশেষ অভিযাত্রী: আয়শা খানম স্মারকগ্রন্থ’ গ্রন্থে স্মৃতির ভেতরে লুকানো সুখ-দুঃখ এবং ব্যথা খুঁজে পাওয়া যাবে। বন্ধু-স্বজনরা শব্দমালা দিয়ে গেঁথেছেন মালা। বাক্যের পরতে পরতে স্মৃতি উছলে পড়েছে। যেন আরও কত কথা হয়নি লেখা। আগামী ২০ বছরও কেউ যদি এখানকার নারী আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাহলে এটি হতে পারে অন্যতম সহযোগী গ্রন্থ।

লাবণী মণ্ডল। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে। দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই আলোচনা লেখেন। যৌথ সম্পাদনায় তাঁর ৫টি বই প্রকাশ হয়েছে।