হাসান হাফিজুর রহমানের একটি কবিতা
তোমার আপন পতাকা
এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়।
ক্রুর পদাতিক যতো যুগে যুগে
…………….উদ্ধত পায়ের দাগ রেখে গেছে কোমল পলির ত্বকে,
বিভিন্ন মুখের কোটি অশ্বারোহী এসে
…………….খুরে খুরে ক্ষতময় করে গেছে সহনীয়া মাটি,
লালসার লালামাখা ক্রোধে বন্দুক কামান কতো
…………….অসুর গর্জনে চিরেছে আকাশ পরিপাটি,
বিদীর্ণ বুক নীল বর্ণ হয়ে গেছ তুমি, বাংলাভূমি
…………….নত হয়ে গেছে মুখ ক্ষোভে ও লজ্জায়।
এবার মোছাব সেই মুখ শোকাক্রান্ত, তোমার আপন পাতাকায়।
কে আসে সঙ্গে দেখ দেখ চেয়ে আজ :
কারখানার রাজা, লাঙ্গলের নাবিক,
উত্তাল ঢেউয়ের শাসক উদ্যত বৈঠা হাতে মাল্লা দল,
এবং কামার কুমোর তাঁতি। এরাতো সবাই সেই
………………………………………..মেহনতের প্রভু, আনুগত্যে
শাণিত রক্তে ঢল হয়ে যায় বয়ে তোমার শিরাময় সারা পথে পথে।
দুহাতে সরায় দ্রুত শহরের জটিল পঙ্কিল,
মধ্যবিত্ত অনড় আবিল। একে একে সকলকে নামায় মিছিলে।
ডাকে আপামর ভাই বোন। একসাথে মিলে নিশ্ছিদ্র
…………………………………….বিশাল শিলাদৃঢ় পাহাড় বানায়।
সেই কোটি হাত এক হাত হয়ে
মোছাবে তোমার মুখ তোমার আপন পতাকায়।
সমস্ত শূন্যতায় আজ বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে যায়
আকাশ চাঁদোয়া জ্বলে রাহুমুক্ত ঘন নীলিমায়।
অকলুষ বাংলাভূমি হয়ে ওঠো রাতারাতি আদিগন্ত তীর্থভূমি।
অন্তহীন মিছিলের দেশ,
সারি সারি মানুষের আকারে হলে মূর্তিময়ী
সমস্ত স্বদেশ আজ রাঙা রাজপথে।
দিবালোক হয়ে ফোটে প্রাঞ্জল বিপ্লব
সাত কোটি মুখ হাসে মৃত্যুর রঙিন তীর হাতে নিয়ে।
শ্রেণিবদ্ধ এই ভিড়ে সকলেই সবার আগে
…………….একবার শত্রুকে শেষ দেখা দেখে নিতে চায়।
দুঃসাহস চমকায় বরাভয় হিল্লেলিত তোমার আপন পতাকায়॥
তুমি আছো কাজল দীঘির পাড়ে, কোকিলের মধুক্ষরা স্বরে,
হরিৎ স্বপ্নে ফুলে-ওঠা প্রান্তরের উর্বর আদরে
সিংহপ্রাণ গিরিবর্ত্মে এবং বঙ্গোপসাগর
………….নামক আকুল ঐ অস্থিরতার তুমুল গভীরে
আছো দিন-রাত্রি অগ্নিমুখ অশনির অশেষ অধীরে।
তুমি আছো আজো, ছিলে চিরকাল।
বিশ্বের সেরা সুন্দরী বলে লুটেছ প্রবাদের খ্যাতি
যদিও রত্নখচা তোমার সৌন্দর্য সেই অবিরত তোমারই হয়েছে কাল।
তোমাকে মুঠোতে ভ’রে আনন্দের ঝুমঝুমি
……………বাজাতে এসেছে যারা
সুকালের ভোজসভার ক্ষুধার্ত অতিথি
রক্ত নিয়ে মুখে ধিক্কারে ধিক্কারে পলাতক তারা,
আবহমান বাংলার বর্বরতম দখলদারও দেখ আজ
…………কুৎসিততম আঁধারে নির্ঘাৎ হবে লীন।
তুমি ছিলে অমলিন, আজো আছো অমলিন।
শত কোটি লাঞ্ছনার তিক্ত দাগ সারা দেহে সয়ে
আজো তুমি মাতা, শুচিশুদ্ধ মাতা সাত কোটি সংশপ্তক
সন্তানের অকাতর তুমি মাতা।
প্রেম অবারিত হবে বিজয়ের ধারাজলে, রৌদ্রে, জোছনায়।
শত শতাব্দীর অবগুণ্ঠিত আশা পূর্ণ করে
……………মোছাব তোমার মুখ তোমারই আপন পতাকায়॥
প্রতিপক্ষের ভয়াবহ নৃশংসতা, স্বদেশিদের অকল্পনীয় বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধের সময় নানাশ্রেণির মানুষের দুর্দশা, আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদ ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সমবেদনা―সাধারণত এইসব বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা পড়ে আমরা অভ্যস্ত। এই কবিতাটি তার চেয়ে আলাদা। দেশে বিজয় এসেছে, মুক্ত স্বাধীন দেশের একটি অনন্য পতাকাও পেয়ে গেছি আমরা, এখন সারা দেহে শতকোটি লাঞ্ছনার তিক্ত দাগ নিয়ে থাকা সর্বংসহা প্রিয়তমাকে লক্ষ্য করে এই কবিতাটি লিখেছেন হাসান হাফিজুর রহমান। প্রিয়তমা এখানে মা, মাটি ও মাতৃভৃমির সর্বনাম, আর পতাকা―প্রতীক, প্রাপ্তি আর মানুষ ও মাতৃভৃমির নিরাময়। পুরো কবিতাটি এইসব মূর্ত ও বিমূর্ত প্রতিবেশের আবহাওয়া নিয়ে গড়ে উঠেছে।
‘তোমার আপন পতাকা’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি থেকে শেষ পঙ্ক্তি পর্যন্ত রয়েছে এরকম এক গতিময় সরবতা যা একবার পড়া শুরু করলে আর শেষ না করে থামা যায় না। কবিতা লেখার আগে, ইতঃপূবের্, মাতৃভূমিতে যে-রণরক্ত কোলাহল ঘটে গেছে, তার পরিণতি আমাদের জন্য শেষমেশ স্বস্তিকর হলেও তা নিয়ে কাছাকাছি সময়ে যখন কবিতা লেখা হবে, তখন, তাতে, সেই সরবতা থাকাটাই স্বাভাবিক। এখানেও তা-ই ঘটেছে। এমন না যে, নয় মাসের যুদ্ধের তাণ্ডব দাহন শেষ হল, বহুদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত বিজয়ও এসে গেল, আর এই কবি সেই সুসময়ের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ঘরে কবিতা লিখতে বসে গেলেন। যারা তাঁর ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবিম্ব বইটি পড়েছেন, তারা জানেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে কী নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কলম হাতে নিয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। উনিশ শো সত্তর সালের ৯ জুলাই তারিখে লিখিত একটি কলামে তিনি স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন, পূর্ববাংলার নিজেদের অধিকারের কথা উঠলে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু চিহ্নিত মোড়ল কীভাবে ‘গলা মিলিয়ে কান ঝালাপালা করা ডাক’ তুলতে শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা একথাটিও বোঝাতে চান যে, কেন্দ্রকে সবল রাখার মধ্যেই ‘দেশপ্রেম’ এবং ‘পাকিস্তানের অস্তিত’ নিহিত; আর কেন্দ্রের ক্ষমতা সীমিত করে ফেলার অর্থই হলো ‘দেশদ্রোহিতা’, ‘পাকিস্তানের রসাতল’-এ চলে-যাওয়া এবং সামনে ‘সমূহ বিপদ’। এ কারণেই কেন্দ্রের সর্বশক্তি কুক্ষীগত রাখার প্রশ্নটিকে বিলকুল প্রশ্নাতীত করে রাখার ব্যাপারে তারা সকলেই একাট্টা। হাসান হাফিজুর রহমানের নিজের ভাষায় :
বিগত বাইশ বছর ধরে এমনিভাবেই এই মূল প্রশ্নটিকে তাঁরা সকলের হাতের বাইরে রেখেছেন আজো যখন সমগ্র পাকিস্তান অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতা বণ্টনের বিষয়টি নানা কারণে অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে তখনও তাঁরা একই সুরে একই কণ্ঠে ঝড় তুলতে উঠে পড়ে লেগেছেন সেই অচলায়তনে আঁচড়টিও লাগতে দেবেন না, এই করেছেন পণ।
‘তোমার আপন পতাকা’, যে পতাকা তোমারই অর্থাৎ মা, মাটি এবং মাতৃভূমির পতাকা, হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিয়ে রক্তিম সূর্যের অধিকারী হয়ে আজ শ্যামকান্ত ফুলে পরিণত, সেই পতাকা আজ নিঃশঙ্ক হাওয়ায় পতপত করে ওড়ে এবং দুঃখভোলানিয়া গান গায়
এই পণ ও অচলায়তন ভেঙে যাওয়ার পর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন কবিতা লিখতে বসবেন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণকারী কোনো কবি, তখন এটা আশা করা যায় যে তাঁর কবিতায় সেই মননভাবনা আর ইতিহাসের সেই ঘটনাপ্রবাহ যুক্ত হবে। কার্যত, এখানে, তাঁর কবিতার প্রথম স্তবকেই, আমরা তা লক্ষ করছি।
কবিতার শিরোনাম ‘তোমার আপন পতাকা’, যে পতাকা তোমারই অর্থাৎ মা, মাটি এবং মাতৃভূমির পতাকা, হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিয়ে রক্তিম সূর্যের অধিকারী হয়ে আজ শ্যামকান্ত ফুলে পরিণত, সেই পতাকা আজ নিঃশঙ্ক হাওয়ায় পতপত করে ওড়ে এবং দুঃখভোলানিয়া গান গায়―আজ সেই পতাকা দিয়েই স্বদেশের মুখ মোছাতে চান কবি, কারণ আজ আনন্দের দিন, আজ বিজয়ের দিন।
কিন্তু আমরা জানি লাল সবুজের এই পতাকা এমনি এমনি তৈরি হয়নি, প্রথম স্তবকে উল্লিখিত হাজার বছরে সেই বেদনা কি আর এমনি এমনি জমাট হয়েছে? তাই দ্বিতীয় স্তবকে ব্যক্ত হতে দেখি বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের বিবরণ :
ক্রুর পদাতিক যতো যুগে যুগে
………………উদ্ধত পায়ের দাগ রেখে গেছে কোমল পলির ত্বকে,
বিভিন্ন মুখের কোটি অশ্বারোহী এসে
……………..খুরে খুরে ক্ষতময় করে গেছে সহনীয়া মাটি,
লালসার লালামাখা ক্রোধে বন্দুক কামান কতো
……………..অসুর গর্জনে চিরেছে আকাশ পরিপাটি,
বিদীর্ণ বুক নীল বর্ণ হয়ে গেছ তুমি, বাংলাভূমি
……………..নত হয়ে গেছে মুখ ক্ষোভে ও লজ্জায়।
‘পৌণ্ড্র-বরেন্দ্র, গৌড়-কর্ণ-সুবর্ণ, রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি, বঙ্গ-সমতট হরিকেল―এইসব জনপদ সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল’ যে-অতীতের বঙ্গভূমি, সেখানে অনেকেই তো বাইরে থেকে শাসন করে গেছে। সপ্তম শতকে সমতট অঞ্চলে রাজত্ব করে গেছে খড়্গ রাজবংশ, দশম শতকে গৌড়ে শাসন করে গেছে কন্বোজাখ্য রাজবংশ, একাদশ শতকে অন্ধ্র থেকে এসেছিল বর্মণ রাজারা আর দ্বাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের কর্নাট থেকে এসেছিল সেন রাজারা, এর পরের কথা তো আমাদের সকলেরই জানা। অনেকেই হয়ত বলবেন, বাইরে থেকে যেসব আক্রমণ ও আগ্রাসন হয়েছে, তাতে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি ঠিকই কিন্তু এতে আমাদের অর্জনও তো কম হয়নি, জাতি-সংস্কৃতি ঋদ্ধও তো হয়েছে; কিন্তু মনে রাখা জরুরি, এই সবকিছুই বক্র-পরিণামের উদাহরণ ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে যদি কোনো কোনো বিশেষ প্রাপ্তি ও অর্জনের কথা স্বীকারও করি, তবু এ-কথাটি বলতে হয় যে, এখানে কাউকে আসার জন্য কখনো স্বাগত জানানো হয়নি এবং কেউ কখনো কারও দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার জন্য কোনোদিন বসেও থাকে না। কবিতাটি একটি যুদ্ধপরবর্তী বিজয়ের আনন্দ থেকে উৎসারিত হলেও, সেই শুরু থেকে যারা বাংলার ‘কোমল পলির ত্বকে’ উদ্ধত পা রেখেছে, যাদের অশ্বক্ষুরে ক্ষতময় হয়েছে বাংলার মাটি, যাদের লালসার লালামাখা ক্রোধে গর্জে উঠেছে কামান ও বন্দুক, তাদের নির্যাতনের কথা এখানে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় স্তবকে।
তৃতীয় স্তবকে এসে আমরা পাচ্ছি, অধিকার আদায়ের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের আগে সর্বস্তরের বাঙালিদের মধ্যে যে-অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার বিবরণ। ‘কারখানার রাজা, ‘লাঙ্গলের নাবিক, উত্তাল ঢেউয়ের শাসক উদ্যত বৈঠা হাতে মাল্লা দল, এবং কামার কুমোর তাঁতি’―এই বর্ণনায় এরা কেউই যেন আর সাধারণ শক্তির অধিকারী নয়, এরা সবাই অমিত শক্তির অধিকারী তো বটেই, বিপুল সম্ভাবনাময়ও; এই সূত্রে আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে শিল্পী এস এম সুলতানের ছবির সেই পেশল শক্তিধর চরিত্রগুলোর কথা। এরা, অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষ, অনড় আবিল দ্বিধাগ্রস্ত মধ্যবিত্তদেরকে পর্যন্ত মিছিলে নামায় এবং সকলে ‘একসাথে মিলে নিশ্ছিদ্র বিশাল শিলাদৃঢ় পাহাড় বানায়।’
গভীর দেশ-চেতনাই হাসান হাফিজুর রহমানকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘তোমার আপন পতাকা’র মতো অনবদ্য কবিতাটি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেখানে বঙ্গ ও বঙ্গভাষায় বিবিধ রত্নের খোঁজ পেয়েছিলেন, জীবনানন্দে যে বাংলার রূপ দেখেছেন বলে পৃথিবীর রূপ আর খোঁজ করতে চান না বলে জানিয়েছিলেন,
চতুর্থ স্তবকে রয়েছে যুদ্ধের বর্ণনা।
‘তোমার আপন পতাকা’ কবিতার পঞ্চম স্তবক পড়তে পড়তে আমাদের সহজেই মনে পড়বে, উনিশ শো বায়ান্নো সালের ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা হাসান হাফিজুর রহমানের সেই বহুলপঠিত কবিতাটির কথা যেটি সন্তানহারা শহিদ আবুল বরকতের মার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হলেও শেষে মা আর দেশ সম অর্থে পৌঁছে গিয়েছিল। ‘কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?’ আবুল বরকতের মাকে লক্ষ্য করে লেখা এই বাক্যের পর সালাম, রফিক ও জব্বারের কথা উল্লেখ করে লিখলেন, ‘যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল/দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কণা ছড়িয়ে দিয়ে গেল/দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।’…তারও পরে এসে লিখলেন, ‘হে আমার দেশ, বন্যার মতো/সমস্ত অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে গড়িয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি’। এই গভীর দেশ-চেতনাই হাসান হাফিজুর রহমানকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে ‘তোমার আপন পতাকা’র মতো অনবদ্য কবিতাটি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেখানে বঙ্গ ও বঙ্গভাষায় বিবিধ রত্নের খোঁজ পেয়েছিলেন, জীবনানন্দে যে বাংলার রূপ দেখেছেন বলে পৃথিবীর রূপ আর খোঁজ করতে চান না বলে জানিয়েছিলেন, এখানে লক্ষ করছি সেই স্থানেরই আরেক রকম বর্ণনা : ‘কাজল দীঘির পাড়’, ‘কোকিলের মধুক্ষরা স্বর’, হরিৎ স্বপ্নে ফুলে-ওঠা প্রান্তরের উর্বর আদর, সিংহপ্রাণ গিরিবর্ত্ম আর আকুল অস্থির তুমুল গভীর বঙ্গোপসাগর প্রভৃতি। তবে, এই সৌন্দর্যের শুধু শুধু বর্ণনার মধ্যেই এই স্তবক শেষ হয়ে যায়নি, বরং যে-কথাটি বলবার জন্য এই বর্ণনা, তা হলো এই :
বিশ্বের সেরা সুন্দরী বলে লুটেছ প্রবাদের খ্যাতি
যদিও রত্নখচা তোমার সৌন্দর্য সেই অবিরত তোমারই হয়েছে কাল।
এই প্রবাদপ্রতিম সৌন্দর্য আর অতুল ঐশ্বর্যের কারণেই যুগে যুগে, বিভিন্ন সময়ে আক্রমণ হয়েছে বাংলায়, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আশার কথাই এই যে, যারা এই দেশটাকে মুঠোতে ভরে নিয়ে আনন্দের ঝুমঝুমি বাজাতে বাজাতে এখানে এসেছিল তারা আজ পলাতক এবং কুৎসিত অন্ধকারে লীন হয়ে গেছে। ফলে দেশমাতাকে লক্ষ্য করে লেখা তাঁর ভাষ্যটি এরকম :
তুমি ছিলে অমলিন, আজো আছো অমলিন।
শত কোটি লাঞ্ছনার তিক্ত দাগ সারা দেহে সয়ে
আজো তুমি মাতা, শুচিশুদ্ধ মাতা সাত কোটি সংশপ্তক
সন্তানের অকাতর তুমি মাতা।
কবি এই মাতার মুখ আপন পতাকায় মুছিয়ে দিতে চান আর এজন্য ধুয়াপদের মতোই এই পাতাকাও বারবার ঘুরে আসে তাঁর কবিতায়। কিন্তু কথা হলো, পতাকা দিয়েই-বা কেন মুখ মোছাতে চান কবি? এই পতাকা―হোক সে প্রতীকী―শেষপর্যন্ত সেই মাতারই তো প্রতিচ্ছবি? কবিতাটি যে-সরব গতিতে বিবৃত হয়েছে তাতে এই প্রতীক টমাস কার্লাইল-কথিত ‘অলৌকিক দিব্যোদ্ভাস’ বা নৈঃশব্দ্য ও বাণীর প্রভাবে উৎসারিত কোনো কিছু নয়, বরং এই প্রতীক সেই বাস্তব কথাটাই তীব্রভাবে বলতে চেয়েছে―তোমার লাল রক্ত তোমারই আবহমান বাংলার সবুজ ঘাস-মাটির সঙ্গে মিশে যে-অন্য আরেক ‘তোমাকে’ তৈরি করেছে, সেই পতাকা দিয়েই আমি তোমার মুখ মোছাব, শোক মুছে দিয়ে সবাই মিলে আজ বিজয়ের অশোক আনন্দ উদ্যাপন করব। তাই, ‘তোমার আপন পতাকা’ কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লিখিত হলেও সেটি একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার বিজয়গাথার মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা দীর্ঘকালের বঞ্চনার পর আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয়গাথায় পরিণত হয়েছে।

মোস্তাক আহমাদ দীন। কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে গদ্য লেখেন। পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক, বর্তমানে লিডিং ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন। কাব্যগ্রন্থ : কথা ও হাড়ের বেদনা, জল ও ত্রিকালদর্শী, জল ও শ্রীমতী, ভিখিরিও রাজস্থানে যায়, বানপ্রস্থের আগে। প্রবন্ধ : কবিতাযাপন, আটকুঠুরি, মাটির রসে ভেজা গান, কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব। সম্পাদনা : পরার জমিন, মকদ্দস আলম উদাসী, আবদুল গফ্ফার দত্ত চৌধুরী : তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান, অকূল নদীর ঢেউ, শাহ সুন্দর আলী, মাসিং নদীর তীরে, ফকির সমছুল, নূরে মারিফত, শাহ ছাবাল আলী, ছহি ফকির বিলাশ অর্থাৎ মারফতি ভেদ, মুন্সী মোহাম্মদ আশ্রফউদ্দিন, কামালগীতি, কামাল উদ্দিন, আশিকের রত্ন সমগ্র, ফকির সমছুল, এ, জেড, আব্দুল্লাহ রচনাসমগ্র, নির্বাচিত গান, মকদ্দস আলম উদাসী ইত্যাদি। ভিখিরিও রাজস্থানে যায় কাব্যের জন্য পেয়েছেন এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার, কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন চিহ্ন পুরস্কার ও লোক সাহিত্য পুরস্কার।