হাসিনা মুরগি বিতান
হাসিনার আগুন দপ করেই জ্বলে ওঠে। তাকে মাড়িয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের এই খ্যাতি শহরে ছড়ায় বলেই হয়তো মানুষের কৌতূহলের সীমা থাকে না। তারপর থেকে তার ব্যস্ততা আচমকাই ভোজনরসিক মানুষের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
পোড়া মাংসের গন্ধে রাষ্ট্র ও মানুষের কেন তবে এত লোভ?
আদতে হাসিনা এখন মুরগি পোড়ার দৃশ্য তদারকি করছে। পোড়া গন্ধের ভেতর তার আম্মার কথা মনে পড়ে। আম্মা পেছন থেকে যেন ডেকে উঠে বলছে, কাল রাতে তোমার আব্বা আইছিল। তোমার কথা জানতে চাইল। অনেক নালিশ কইরা গেল। মা রে, তুমি আমাদের খোঁজখবর রাখা বাদ দিইলা কেমন কইরা?
রেস্তোরাঁর এই উজ্জ্বল আলোতে কোলাহলের কমতি নেই। তপ্ত রোদের মাতো গরম ছড়িয়ে পড়ছে তার মগজে।
একটা তেলাপোকা কোত্থেকে উড়ে এসে হাসিনার নাকের পাশ দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। তার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার এই মুহূর্তটা তেলাপোকার নিরাপদ আশ্রয় হওয়ার কথা নয়। তবু এই সুশীল আবহাওয়া ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে কেন তেলাপোকাটার হলো সে বুঝতে পারে না। তার বিরক্তির রেশ কাটার আগেই তেলাপোকাটা স্বভাবজাত উপায়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথায় যেন আড়াল হয়ে গেল।
মায়ের কথার পিঠে হাসিনার মুখে কোনো উত্তর আসে না। তার মগজে তখন তপ্ত রাস্তার জ্যামের ভেতর থেকে উড়ে আসে পোড়া মুরগির মাংসের গন্ধ। মাকে তবু মনে মনে সে একটা উত্তর দিয়ে বসে। বলে, তোমাদের কথা সত্যিই মনে পড়ে না, আম্মা। ব্যস্ত শহরের ভিড়ে কারও কথা নিয়ে ভাবার মতো সময় হয় না। আর আব্বাকে সেই কবেই তো তাড়িয়ে দিয়েছি বুকের ভেতর থেকে।
এসব কথা বলে তার ভেতর হালকা অনুভব হয়। দিনরাত পরিশ্রমের ফলে শরীরের ওপর বড্ড দখল যাচ্ছে। রেস্তোরাঁর ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে প্রতিনিয়ত ভিড় করে কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে নানান শ্রেণিপেশার নারী-পুরুষ। তাদের শরীর থেকে ভেসে আসা দামি পারফিউমের ঘ্রাণ কিংবা গাড়ির হর্নের সাথে পোড়া মুরগির মাংসের গন্ধ ঠোকাঠুকি করে।
মুরগি পোড়ার সময় সে মন থেকে মানুষের শরীর সরাতে পারে না। তার মনে হতে থাকে একেকটি মুরগির সাথে পুড়তে থাকে এক-একজন মানুষ
তাদের ব্যস্ত আবদার মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাদেরকে। চারপাশ থেকে কেবল ভেসে আসে হইচই… একটু তাড়াতাড়ি দিন… আরেকটু পোড়ানো হলে ভালো হত… একটু তুলতুলে হওয়া চাই…
যেন মুরগিগুলো সাক্ষাৎ নারীর লোভনীয় শরীর হয়ে বেজে ওঠে নগরীর মুরগিখেকো মানুষের কাছে।
হাসিনা অতিকষ্টে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। একটু অপেক্ষা করুন… আমরা দেখছি বিষয়টা… একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ…
এমন সীমাহীন ব্যস্ততার ভেতর একটু স্বস্তি খোঁজে তার মন। তবু নিশ্বাস নেওয়ার ফুরসত সে পায় না।
তারপর অদৃশ্য এক দেয়াল ভেদ করে থেকে ছুটে আসে একটা ঘোড়া… অশ্বারোহীকে সে চিনতে পারে না। তাকে ফিসফিস করে বলে, চালিয়ে যাও হাসিনা। তুমি পারবে। তোমার শরীরে লক্ষ্মী ভর করেছে।
তখনই তার ধ্যান ভেঙে দিয়ে বশির নামের ব্যস্ত কারিগরটি প্রশ্ন করে, আপা কত পিচ লাগাব?
‘লাগাতে থাকো।’ হাসিনা উত্তর দেয়।
বশির মুরগির পোড়ায় নগরের সবচেয়ে করিৎকর্মা কারিগর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। হাসিনা আপার সাথে কাজের অভিজ্ঞতাও তার অনেকদিনের।
এত মুরগি কেন খায় মানুষ? বশিরের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রতিদিন ভোরে অসংখ্য মরা মুরগি তার হেফাজতে দিয়ে যায় সাপ্লায়ার। কাটা। রসালো। রক্তে ভরপুর।
মুরগির শরীরের এত রক্ত থাকে কে জানত। একদিন বিরোধীদলের মিছিলের সামনে পড়ে যাওয়ার পর এমন বিভৎস দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিল সে। বিরোধীদলের হুইপের হাড্ডিগুড্ডি সমানে পিটিয়ে গুঁড়ো করে দেওয়ার পর হাত-পা ধরে চ্যাংদোলা করে যেভাবে পুলিশের লোকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই দৃশ্য এরপর থেকে সে আর ভুলতে পারে না।
এরপর থেকে মুরগি পোড়ার সময় সে মন থেকে মানুষের শরীর সরাতে পারে না। তার মনে হতে থাকে একেকটি মুরগির সাথে পুড়তে থাকে এক-একজন মানুষ।
কিন্তু হাসিনার মাথা থেকে তখনও মায়ের আহাজারি কিংবা বাবার আক্ষেপ-অনুযোগগুলো হারিয়ে যায় না। মায়ের নিরীহ শরীরটা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে তার। বাবার জন্য কয়েক পদের ফল ও কিছু পরনের জামা-কাপড় কেনার সাধ জাগে। তারা এখন কোথায়? হাসিনার চোখের কোণে দু-ফোঁটা জল জমা হয়।
বশির তাড়া দেয়, ‘আপনি বাসায় যান আপা। শহরের অবস্থা ভালো না। আপনার শরীরও আজকাল বিশেষ ভালো যাচ্ছে না মনে হইতেছে। এখানে এত মানুষের রক্ত দেখে আপনার মন খারাপ হয়ে গেছে মনে হয়।’
হাসিনা চরম বিরক্তি নিয়ে বশিরের দিকে তাকায়, ‘মানুষের রক্ত কোথায় পেলে?’
পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে হাসিনা। বশিরের এই সমস্যা ধীরে ধীরে জটিল হচ্ছে।
তাদের দুজনের মধ্যকার এক জটিল ও অমীমাংসিত ব্যবসায়িক বন্ধনের ভেতর দিয়ে বেশ ক’টি বছর পেরিয়ে গেল। শূন্য থেকে দুজনের এই যাত্রা খানিকটা বিস্তৃত হয়ে এখন ফুলে-ফলে ভরে ওঠার পর্ব পার করছে।
হাসিনার মা-বাপের কথা মনে নেই। সরাকারি শিশু পরিবারে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে কেবল মা-বাবাকেই তার খুঁজতে মন চাইত। তার কোনো দুরন্ত বিকেল নেই। খালবিল-নদীনালায় ছুটোছুটির স্মৃতি নেই। কেবল এই আত্মবিশ্বাস ও শেখানো বুলি নিয়ে বেড়ে উঠেছে যে, খোদ রাষ্ট্রই তাদের অভিভাবক। কোনোকিছুর অভাব ও শূন্যতা তাদের নেই।
তবু তার বুকের ভেতরের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিটা ব্যস্ততা ও অদম্য জেদের কাছে বারবার পরাস্ত হয়। বশিরের জন্য তার মায়া হয়।
মুগদার বস্তিতুল্য আবাসে বাবা-মায়ের সাথে থাকাকালীন তার বয়স নেহায়েত অল্পই ছিল। সেই সময়ের উত্থাল রাজনীতির বলি হয়ে পুড়ে মরতে হয়েছিল বাবা-মা দুজনকে। ভাগ্যগুণে তার বেঁচে ফেরা হলেও বাবা-মায়ের মুখ দেখার সুযোগ আর হয়নি।
আগুনে কেড়ে নিয়েছে তার শৈশব, যে আগুনে পুড়ে মরেছে তার প্রিয় স্মৃতিগুলো, সেসবের আঘাত সয়ে কীভাবে সে এখনও টিকে আছে আর দশটা মানুষের মতো? আগুনকেই কীভাবে সে বেছে নিল টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে?
সরকারি অনাথ আশ্রমে তার যে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেই সৌভাগ্যই হয়তো তাকে একটা সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
এরপর থেকে আগুন ও পোড়া মুরগির কারবার তার আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। কোনোকিছুই সে পরোয়া করে না। জীবনের অসহ্য বেদনাকে বুকে পেতে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে, ‘হাসিনা মুরগি বিতান’।
এটি নগরের ভোজনরসিক মানুষের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি ভিন্নধর্মী খাবারের দোকান।
কিন্তু যে আগুনে কেড়ে নিয়েছে তার শৈশব, যে আগুনে পুড়ে মরেছে তার প্রিয় স্মৃতিগুলো, সেসবের আঘাত সয়ে কীভাবে সে এখনও টিকে আছে আর দশটা মানুষের মতো? আগুনকেই কীভাবে সে বেছে নিল টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে?
বশিরের কথার উত্তরে আর কিছু না বলে জীবনের জটিল হিসাব-নিকাশগুলো থেকে এক মুহূর্তের জন্য তার বিরতি নিতে ইচ্ছে করে।
সেই অশ্বারোহী পুনরায় ফিরে আসে। অশ্বারোহীকে আগের মতেই সে চিনতে ব্যর্থ হয়।
তার কানে ফিসফিস করে বলে, পেছনে ফিরে তাকিও না হাসিনা। ওখানে কিছু নেই। মৃত লাশের গন্ধ, পুড়ে যাওয়া নগরের স্মৃতি আর হাহাকার তোমার শরীরে পুশ করে ওরা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তুমি এসব বিভ্রম থেকে পালিয়ে যাও।
কিন্তু আজকের এই আগুন ভিন্ন। হাসিনার বুকের ভেতর একটা আতঙ্ক সজোরে ধাক্কা মারে। নগরীতে আচমকা ফিরে এসেছে মানুষের বিক্ষোভ, পুলিশের টিয়ারশেল ও আগুনের হল্কা। আবার কি পুড়তে শুরু করবে সবকিছু?
সত্যিই তো। কেন সে এসব বয়ে বেড়ায়? এত ক্ষত ও বিদ্রোহ বুকে নিয়ে, এতদূর এসে কেন সে পিছিয়ে পড়বে?
লোহার শিকে ঢুকিয়ে চ্যাংদোলা করে আগুনে পোড়াতে থাকা বশিরের মুরগিগুলো থেকে ভেসে আসে পুলিশ ভ্যানে তুলে ফেলা মানুষের আর্তনাদ। তাদের শরীর থেকে টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে মাখানো মসলার রস।

ফজলুল কবিরী। জন্ম ১৯৮১। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : বারুদের মুখোশ [২০১৫], ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া গল্প [২০১৮], ডোরাকাটা ক্যাডবেরি [২০২২]। উপন্যাস : ঔরসমঙ্গল [২০১৭]। প্রবন্ধগ্রন্থ : লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে [২০২৩]।