কাজী আনোয়ারুল কাদীরের প্রবন্ধ : সৌন্দর্যের সংজ্ঞা
১৯২৬ সালে ঢাকা (ইন্টারমিডিয়েট) কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে যে সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে বাংলার জাগরণ পূর্ণতা পায় বলে অনেকের মত। কারণ এবারে বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায় মুসলমানদের একটি অংশও ইহজাগতিকতা, যুক্তিবাদ, উদারতা ও আধুনিক সাহিত্যমনস্কতা নিয়ে যুক্ত হল। সংগঠনটি স্বল্পায়ু হলেও বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হতে পেরেছে। এর উদ্যোক্তা ও সদস্যদের অনেকের নাম আজ বহুলভাবেই উচ্চারিত হয়ে থাকে, কিন্তু জ্যেষ্ঠতমজনের নামটিই সবচেয়ে কম শ্রুত হয়। তিনি কাজী আনোয়ারুল কাদীর (১৮৮৭-১৯৪৮), যিনি কিনা সংগঠনের অন্যতম প্রধান সদস্য আবুল হুসেনেরও (১৮৯৬-১৯৩৮) শিক্ষক। অবশ্য বিষয়য়টি ঠিক অভিযোগের নয়, আফসোসের। কারণ এই চিন্তক-শিক্ষাবিদ ছিলেন পাঁড়-পাঠক, সাংগঠনিক কর্মে ছিলেন দক্ষ, আলাপ-আলোচনায়ও ছিলেন আকর্ষক, কিন্তু সেই অনুপাতে লেখালেখিতে সময় দেননি। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তৎকালিক ও আন্তরালিক হলেও এখানে একটি সূত্রে তা স্পষ্ট করা যেতে পারে। ‘সাহিত্য-সমাজে’র ১ম বার্ষিক অধিবেশনের ২য় দিনে (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯২৭) বক্তব্য দিতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) শ্লেষাত্মক ভাষায় বলেছিলেন: “এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌলভী আনোয়ারুল কাদীর প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে, এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।” ‘কতকগুলি গুণী ব্যক্তি’র মধ্যে যখন একজনের নামোল্লেখ হল, তখনই বোঝা গেল, মেহমান নজরুলের কাছে কোন মেজবান বিশেষভাবে ধরা পড়েছিলেন।
আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদের (১৮৯৪-১৯৭০) একটি প্রবন্ধ স্মরণ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথকে (১৮৬১-১৯৪১) নিয়ে একশ্রেণির বড়ো অভিযোগ যে, তিনি বাঙালি মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে কিছু করেননি। ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ প্রবন্ধে ওদুদ এই অভিযোগের মোক্ষম জবাবটি নিয়েছেন আনোয়ারুল কাদীরের কাছ থেকে। প্রশ্নাঙ্গিকে সেই উত্তরটি হল : “আকাশের সূর্য মুসলমানদের জন্য বিশেষ কী করেছে?” এসময়ে ফুটনোটে কথকের পরিচিতি দিয়েছেন : আমাদের দুঃখ প্রণেতা।
আনোয়ারুল কাদীরের এই একটি গ্রন্থই বেরিয়েছিল। ১৩৪১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত আমাদের দুঃখ আটটি প্রবন্ধের সংকলন। এছাড়া অসুস্থতার কারণে অকালে মৃত্যুবরণকারী কাজী ইমদাদুল হকের (১৮৮২-১৯২৬) বিখ্যাত উপন্যাস আবদুল্লাহ (১৯৩২)-এর ৩১ থেকে ৪১ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত আনোয়ারুল কাদীরের রচনা বলে অধিকাংশজনের মত। এই শেষের এগারটি পরিচ্ছেদে আনোয়ারুল কাদীরের সৃজনশীল শিল্পীসত্তার অনুশীলন হয়েছিল বলা যায়। তবে এর বেশি আর কিছু নয়। কোনো পূর্ণ সৃজনশীল রচনা আমরা পাইনি তাঁর কাছ থেকে।
খোন্দকার সিরাজুল হক (১৯৪১-২০১৬) আনোয়ারুল কাদীরের পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা আরো তিনটি প্রবন্ধের সন্ধান দিয়েছেন (মুসলিম সাহিত্য-সমাজ : সমাজচিন্তা ও সাহিত্যকর্ম, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃ. ৩০১)। সেগুলো হল : ‘ইংরাজী সাহিত্যে রোমান্টিক যুগ’ (শিখা, ২য় বর্ষ ১৩৩৫ ও জাগরণ, কার্তিক ১৩৩৫), ‘বাইরণ’ (কার্তিক-পৌষ ১৩৩৮) এবং ‘উর্দু, বাংলা ও বাঙালী মুসলমান’ (মাঘ-চৈত্র ১৩৪১)। এগুলো নিয়ে তিনি সামান্য আলোচনাও করেছিলেন। ওই তিনটির বাইরে ‘সৌন্দর্য্যরে সংজ্ঞা’ শিরোনামে আমরা আরেকটি প্রবন্ধ পেলাম ঢাকা ইন্টারমিডিট কলেজ-ছাত্রাবাসের মুখপত্র-বার্ষিকী অস্ফুট-এর ২য় সংখ্যায়।
পৌষ ১৩৩৪ সনে প্রকাশিত এই সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন আশুতোষ ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৮৪) ও আব্দুল ওয়াহাব মাহমুদ্। প্রকাশক হিসেবে শুধু আশুতোষ ভট্টাচার্যের নাম ছিল। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক, ফোকলোরিস্ট আশুতোষ ভট্টাচার্য এসময় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। পত্রিকাটির কার্যনির্বাহক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক বঙ্কিমদাস বন্দ্যোপাধ্যায়; সহ-সভাপতি ছিলেন আনোয়ারুল কাদীর। ‘আমাদের কথা’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে:
“…অতীব দুঃখের সহিত জানাইতে হইতেছে যে আমাদের এতৎকর্ম্মের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী ও নিয়ত উৎসাহদাতা শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মৌলবী আনোয়ারুল কাদের সাহেব পদবৃদ্ধি লাভ করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া গিয়াছেন, তবে তিনি যোগ্য উচ্চতর পদলাভ করিয়াছেন ইহাই আমাদের একমাত্র সান্ত্বনা।”
উল্লেখ্য, কাদীর সাহেব স্কুল-পরিদর্শক হিসেবে ১৯২৮ সালে নোয়াখালী গমন করেন।
উদ্ধারকৃত ক্ষুদ্রকায় প্রবন্ধটি শিল্পসাহিত্য বিষয়ক। এরকম আরো দুটো অগ্রন্থিত প্রবন্ধের কথা আমরা একটু আগে জেনেছি। কিন্তু এসব প্রবন্ধ লেখক তাঁর একমাত্র প্রকাশিত প্রবন্ধ-সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেননি। সেখানে সবগুলো প্রবন্ধই (‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’সহ) ছিল সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি সম্পর্কিত। দেখা যাচ্ছে, কাদীর সাহেব এক-দুটি করে বিশুদ্ধ শিল্পতত্ত্ব ও সমালোচনামূলক রচনার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। বর্তমান প্রবন্ধে শেষত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নির্মাণের দীর্ঘকাল ধরে দেশে-দেশে চলে আসা অমীমাংসেয় কূটচালতর্কে যাননি। সৌন্দর্যকে প্রাকৃতিক পদার্থের মতোই একটি শক্তির আধার হিসেবে গণ্য করেছেন। অনুভূতির সাহায্যে তাকে উপভোগ করতে হয়। যার সে শক্তি কম বা নেই, তার পক্ষে সংজ্ঞা ও তত্ত্বের সাহায্যে সৌন্দর্য উপভোগ করার আনন্দ পাওয়া অসম্ভব বলেই মনে করেন তিনি।
প্রবন্ধটি একালের পাঠকের কাছে আমরা বর্তমানে প্রচলিত বানানরীতিতে উপস্থাপন করলাম। যেমন, ‘সৌন্দর্য্য’, ‘কর্ত্তব্য’, ‘জিনিষ’ প্রভৃতির পরিবর্তে যথাক্রমে ‘সৌন্দর্য’, ‘কর্তব্য’, ‘জিনিস’ ইত্যাদি ব্যবহৃত। আবশ্যিক বিরামচিহ্ন কিছু বসেছে। এছাড়া কোনোরূপ সংশোধন আমাদের পক্ষে সম্ভব ও সঙ্গত মনে করিনি। আনোয়ারুল কাদীর অধিক লেখেননি, এ নিয়ে আর আফসোসে ফল নেই, তবে পত্রপত্রিকায় তাঁর আরও কিছু লেখা ছড়িয়ে থাকা সম্ভব, সেগুলোর সন্ধানই জরুরি।
সংগ্রহ ও ভূমিকা : মাসুদ রহমান
আর্ট এবং কবিতা যাঁরা সমালোচনা করেছেন তাঁরা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন সৌন্দর্য কাকে বলে, তার সুন্দর যে বস্তু তাকে স্বতন্ত্র ভাবে ব্যাখ্যা করার অর্থাৎ সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিরূপণের। সৌন্দর্য সম্বন্ধে কিছু কিছু ইঙ্গিত এসব থেকে পাওয়া যায় কিন্তু এসব আলোচনায় সৌন্দর্য বাস্তবিকই উপভোগ করার কোনো সহায়তা করে কিনা ঠিক বলা যায় না। কোনো কবিতার বা কোনো শিল্পের কোন্ টুকু সুন্দর কত সুন্দর তা বুঝতে হলে সেই কবিতা বা শিল্পের মধ্যেই সেটাকে খুঁজতে হবে।
অন্যান্য গুণের ন্যায় সৌন্দর্যও আপেক্ষিক অর্থাৎ একটি জিনিসের সৌন্দর্য আর একটি জিনিসের সৌন্দর্য অপেক্ষা কম বা বেশি। তাই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন। সৌন্দর্যতত্ত্ববিলাসীর উদ্দেশ্য সংজ্ঞা নিরূপণ নয়; যেখানে সৌন্দর্যের বিকাশ সেইখানকার সৌন্দর্যের ধার বা বিশেষত্ব নিরূপণ করাই তার কাজ।
কোনো কিছুর দোষ গুণ বিচার করতে হলে প্রথমে তার পরিচয় লাভ করা সমালোচকের প্রধান এবং প্রথম কর্তব্য। সৌন্দর্য সম্বন্ধে দোষ গুণ বিচার করতে হলে যে বস্তুর দোষ বিচার করা হবে সেই বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিচারকের মনে যে ভাবের উদয় হয় সেই ভাবটাকে ভাল করে বুঝতে বা চিনতে হবে।
গান কবিতা সুচিত্রিত বা সুন্দর জীবনের ভঙ্গিমা এই গুলির সঙ্গেই রুচিতত্ত্বানুসন্ধানীর সম্বন্ধ; এ গুলি কতকগুলি শক্তির আধার অর্থাৎ সৌকর্যের আকর। বিশ্বের রচিত প্রাকৃতিক পদার্থ মাত্রই যেমন কতকগুলি শক্তির আধার, গায়কের গান, কবির কবিতা প্রভৃতি মধ্যেও সেইরূপ কিছু কিছু গুণ বা শক্তি আছে।
একটি ছবি বা একটি গান কি কোনো পুস্তকে চিত্রিত বা আমার কাছে সুপরিচিত কোনও সুন্দর জীবনের (মানব চরিত্রের) ভঙ্গিমা আমার কাছে কেমন লাগে? আমার মনে কী ভাবের উদয় হয়? আমার জীবনের উপর কীভাবে কার্যকর হয়? এ সবে আমি কোনো আনন্দ পাই কি না? যদি পাই তবে কতটুকু এবং কী প্রকারের? এই সব তত্ত্বের মীমাংসা, সৌন্দর্যবিলাসী চান? তা না হলে তাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ পূর্ণ হয় না। আর্ট এর সৃষ্টি, প্রকৃতির সৌন্দর্য মানব জীবনের উৎকৃষ্ট ভঙ্গিমা এই গুলি সৌন্দর্যবিলাসীর কাছে আনন্দের উৎস। যার অনুভূতি যে পরিমাণে প্রখর তিনি সেই পরিমাণে সৌন্দর্য উপভোগ করতে সক্ষম। যার সেই অনুভূতির অভাব, কোনো সংজ্ঞা দিয়ে তাকে সৌন্দর্য উপভোগ করার আনন্দ দান অসম্ভব।

মাসুদ রহমান। জন্ম ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭০। কুষ্টিয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। শিক্ষকতা করেন নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থ- হুমায়ুন কবির : জীবন ও সাহিত্য; রবীন্দ্রনাথের সংসার, রবীন্দ্রনাথ : ছিন্নপত্র; রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়; আহমদ শরীফ : জীবন ও কর্ম; ছোটগল্পের দর্শন ও নিদর্শন ইত্যাদি।