একটি উন্মুক্ত, স্বাধীন আর্তনাদ
‘চতুর মানুষ আর মুদি দুজনেই এক। তারা খালি মাপে, সব কিছু মাপে।’—জোরবা
নিকোস কাজানজাকিস ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার, সাংবাদিক, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ। তিনি (১৮৮৩-১৯৫৭) গ্রিসের ক্রিট দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে জার্মানিতে ফ্রেদরিখ নিৎশের ওপর পিএইচডির জন্য গবেষণা করেন। ১৯৫৭ সালে লিউকিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জার্মানির ফ্রেইবার্গে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এ ধ্রুপদী সাহিত্যিকের। তিনি ইউরোপের অনেক শহরে বাস করেছেন। জীবনকে নিজের মতো উপভোগ করেছেন। ১৯০৬ সাল থেকে আমৃত্যু লিখেছেন তিনি।
সাহিত্য বিশেষজ্ঞরা কাজানজাকিসকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে মূল্যায়ন করেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ৯ বার মনোনীত হয়। যে বছর মৃত্যু হয়েছিল, সে বছর মাত্র এক ভোটের জন্য অ্যালবার্ট কাম্যুর কাছে হেরে যান তিনি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিগুলোর মধ্যে—গ্রেকোর কাছে প্রতিবেদন : আত্মজীবনী, [অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস], দ্য লাস্ট টেম্পটেশন, ক্রাইস্ট রিক্রুসিফাইড এবং জোরবা দ্য গ্রিক, [অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস] উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৪ সালে তাঁর উপন্যাস জোরবা দ্য গ্রিক থেকে সিনেমা নির্মাণ করেন গ্রিক-সাইপ্রয়েট নির্মাতা মাইক্যালিস ক্যাকোইয়্যানিস। এর পর ১৯৮৮ সালে তার আরেক উপন্যাস দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট থেকে একই নামে সিনেমা তৈরি করেন বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেজি।
কাজানজাকিসের জোরবা দ্য গ্রিক মূল বইটি ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। এর পরই তিনি লেখেন তাঁর শেষ উপন্যাস অ্যানিফরোস। বইটিতে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথার উল্লেখ রয়েছে। এটি ক্রিট, ইংল্যান্ড, ও লোনলিনেস; এ তিন অংশে বিভক্ত। বইটি নিয়ে নানান মহলে সমালোচনা-পর্যালোচনা রয়েছে। জার্মান দখলে থাকার সময় গ্রিস যে দুর্দশার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তা জোরবা দ্য গ্রিক-এ না থাকার জন্য সমালোচনা শুনেছিলেন কাজানজাকিস। সেসব সমালোচনার উত্তরই অ্যানিফরোস-এ দিয়েছেন কাজানজাকিস।
২.
জোরবা দ্য গ্রিক গ্রন্থটি আলেক্সিস জোরবার সাধুজীবন-বৃত্তান্ত। নিকোস কাজানজাকিস যখন ১৯১৫ সালে এথোস পর্বতে গিওরগো জোরবার সঙ্গে দেখা করেন, তখন লোকটি লেখককে ব্যাপক প্রভাবিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নিকোস এ কারণেই এরকম উদ্বেগহীন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে অনুপ্রাণিত হন, যেটি হবে জীবনাপোখ্যান। তবে বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া হলেও জোরবার ‘আলেক্সিস’ নামটি লেখকের দেওয়া। জোরবার জীবনচরিত পড়তে গিয়ে বার বার পাঠকের অন্তর্জগতে ধাক্কা লাগবে। মানুষের জীবন কতই না বৈচিত্র্যেপূর্ণ!
জোরবা ১৮৬৫ সালে মেসিডোনিয়ার পিরিয়া প্রিফেকচারের লিভাদিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফোটিস এবং ইউজেনিয়া জোরবা দম্পতির সন্তান। জোরবা যখন প্রাপ্তবয়স্ক, তখন হালকিডিকির জন্য তাঁর শহর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন এবং পালেওচরি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তিনি সেখানে একজন বন্ধুর সাথে থাকতেন এবং বিভিন্ন ছোটখাট কাজে যুক্ত ছিলেন। এমনকি স্ট্র্যাটোনিকিতে একটি ফরাসি খনিতে খনিশ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
জোরবা খনির ম্যানেজার জিয়ানিস কালকাউনিসের মেয়ে এলেনিকে বিয়ে করেন। জিওরগোস এবং এলেনি প্যালিওচরিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তাদের বারোটি সন্তান ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র সাত বা সম্ভবত আটজন বেঁচেছিল। তার পরে তার স্ত্রীও মারা যায় এবং তার পর বছর ধরে পরিবারটি দুর্বিষহ অবস্থায় বাস করে। এসব চিত্র অঙ্কন করতে হলে, কতটা গভীরে ভাবতে হয়, তা এরকম সাহিত্যপাঠ করলে বুঝতে পারা যায়।
যুদ্ধ, ক্ষুধা এবং ঝামেলা থেকে দূরে সুন্দর সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামে বসবাসকারী দুটি মানুষ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন কালোগরিয়া সমুদ্র সৈকতে। তাঁরা জীবন সম্পর্কে কথা বলতেন।
এর পর ১৯১৫ সালে, জোরবার এথোস পর্বতে চলে যান এবং সন্ন্যাসী হন। সেখানেই তিনি কাজানজাকিসের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা দ্রুত বন্ধু হয়ে ওঠে। এক দৃঢ় বন্ধুত্ব এই দুই ব্যক্তিকে আবদ্ধ করে। তারা মানিতে চলে যান, যেখানে কাজানজাকিসকে মেসিনিয়ান মানির লেফকট্রো পৌরসভার সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম স্টোপার কাছে প্রস্তোভা খনি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
জোরবা তাঁর পাঁচটি এতিম শিশুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং কাজানজাকিস তাঁকে প্রধান খনি শ্রমিক বানিয়েছিলেন। যুদ্ধ, ক্ষুধা এবং ঝামেলা থেকে দূরে সুন্দর সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামে বসবাসকারী দুটি মানুষ প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন কালোগরিয়া সমুদ্র সৈকতে। তাঁরা জীবন সম্পর্কে কথা বলতেন। অবিরাম কথোপকথন, সেই সঙ্গে জোরবার উচ্ছ্বসিত ব্যক্তিত্ব ও আচরণ কাজানজাকিসকে বই এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের প্রেমময়, প্রায় পৌরাণিক ‘আলেক্সিস জোরবা’ তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
জোরবা যেভাবে জীবন, ভালোবাসা, খাবার, গতি এবং নাচ পুরোপুরি উপভোগ করেছিলেন, তার প্রশংসা করেন কাজানজাকিস। তিনি মানুষটির অস্থিরতা, দয়ালু হৃদয়, খোলা মন এবং স্থির মনোভাব দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। কাজানজাকিস পরে জোরবাকে সংক্ষিপ্তভাবে ‘একজন চমৎকার ভোজনকারী, মদ্যপানকারী, কঠোর পরিশ্রমী এবং শৌখিন মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
১৯২০ সালে কাজানজাকিসকে অনুসরণ করে জোরবা কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে যান। কারণ পন্টিয়ান গণহত্যার (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও এরপর অটোমান সাম্রাজ্য গ্রিসে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর অন্যতম একটি ক্ষেত্র ছিল কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী পন্টাস অঞ্চল। এ জাতিগত নিধনযজ্ঞে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পন্টিক গ্রিক নিহত হন। বাস্তুচ্যুত হন ১৫ লাখেরও বেশি।) শেষের দিকে লেখক সেখানে গ্রিকদের দূত নিযুক্ত হন। গ্রিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কাজানজাকিস প্রায় এক লাখ পন্টিয়ানকে উদ্ধার করে গ্রিক বন্দর নগরী থেসালোনিকিতে নিয়ে যান।
পন্টাস মিশন শেষ হওয়ার পর দুই বন্ধু আলাদা হয়ে যান। আর কখনও দেখা হয়নি তাঁদের। তবুও গিওরগো জোরবা বেঁচে থাকতে, নাচতে, পান করা, খাওয়া এবং কৌতুক বলা চালিয়ে যান। তিনি কাজানজাকিসের মনের রোদে ভাসতে থাকেন।
৩.
বই থেকে—“পাহাড়ে উঠে পাইন বনের গন্ধ পাব—এই চিন্তায় সত্যিই আনন্দ হলো। আমরা খচ্চর দুটোয় চড়ে উঠতে থাকি। পথে কিছুক্ষণ খনিতে থেমে জোরবা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। সে তাদের বলে ‘যাজিকা সুড়ঙ্গে’ গাইতি শাবল চালাতে; ‘ম্যাডাম শয্যা-ভেজা’ সুড়ঙ্গে ড্রেন খুঁড়ে জমে থাকা পানি বের করে দিতে হবে।
একটা হিরের মত ঝকঝকে দিন। যতই উঁচুতে উঠি, মনে হয় আমাদের আত্মাও উঠছে এবং পরিচ্ছন্ন হচ্ছে। নির্মল হাওয়ার, সহজ শ্বাস-প্রশ্বাসের এবং বিশাল বিস্তৃত দিগ্বলয়ের আধ্যাত্মিক মূল্য আরেকবার অনুভব করি। সেখানে উঠলে মনে হবে যেন আত্মা এক ফুসফুস এবং নাসারন্ধ্র যুক্ত প্রাণী এবং যেন এর অক্সিজেনেরই দরকার ছিল যদিও এতদিন তা ধুলায় আবদ্ধ হয়ে ছিল কিংবা ছিল হাঁসফাঁস করা নিঃশ্বাসে বন্দি।
এই উপন্যাসে কাজানজাকিস সবচেয়ে সফলভাবে বার্গসোঁর এলান ভিতাল দর্শনের প্রতিফলন ঘটান। বইটা তিনি লিখেন মাত্র দেড় মাসে কিন্তু জোরবা চরিত্র এতই প্রাণবন্ত এবং সর্বজনগ্রাহ্য হয় যে আজ পর্যন্ত অন্তত পঞ্চাশটি ভাষায় এই বই অনূদিত হয়েছে। তবে বইটির জনপ্রিয়তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এর সিনেমা সংস্করণ।
যতক্ষণে পাইন অরণ্যে প্রবেশ করলাম। সূর্য মাথার ওপরে এসে গেছে। সেখানে বাতাসে মকরন্দ সুবাস, মাথার ওপর দিয়ে বহে যায় হাওয়া—সাগরের মত শোঁ শোঁ শব্দে।”
দ্বান্দ্বিকতাকে একটি অপরিহার্য এবং ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হিসেবে র্সবত্র দেখতে পাওয়ার এই গুণ কাজানজাকিসের অভিনব কোনো দর্শন নয়। তবে তাঁর মৌলিকত্ব হয়তো এটুকুই যে, তিনি এই এই দ্বান্দ্বিক আর্বতনকে কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হতে দেননি। কাজানজাকিসের এই দর্শনকে বলা যায় ‘দ্বান্দ্বিক অধিবিদ্যা’। তেইশ বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাস শাপ ও শাপলায় জীবন সর্ম্পক, মানুষের সংগ্রাম, বস্তুজগত সর্ম্পক, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল সর্ম্পকে একজন প্রেমপাগল চরিত্রের মনে যে বীজ তিনি বপন করেছিলেন পরবর্তী জীবনে ৯টি উপন্যাস আর একটি মহাকাব্যে তা সহস্র ডালপালা মেলে বিশাল পরিসরে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্যই টমাস মান, আলবেয়ার কামু, সুইটজার, কলিন উইলসনরা তাঁকে তলস্তয়ের পর ইউরোপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক বলে অভিহিতি করেছেন।
কাজানজাকিসের অধিকাংশ বই বেস্টসেলার হলেও জনপ্রিয়তায় জোরবা দ্য গ্রিককে ছাড়াতে পারেনি কেউ। প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তা পাঠক মহলে বিপুল সাড়া ফেলে এই উপন্যাসে কাজানজাকিস সবচেয়ে সফলভাবে বার্গসোঁর এলান ভিতাল দর্শনের প্রতিফলন ঘটান। বইটা তিনি লিখেন মাত্র দেড় মাসে কিন্তু জোরবা চরিত্র এতই প্রাণবন্ত এবং সর্বজনগ্রাহ্য হয় যে আজ পর্যন্ত অন্তত পঞ্চাশটি ভাষায় এই বই অনূদিত হয়েছে। তবে বইটির জনপ্রিয়তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এর সিনেমা সংস্করণ। ১৯৬৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মিত হলে মেক্সিকান অভিনেতা অ্যান্থনি কুইনের অনবদ্য অভিনয়ে এই কাহিনি বিশ্বব্যাপী আদৃত হয়।
অনুবাদক ‘অনুবাদকের ভূমিকা’য় গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছেন–“জোরবা দ্য গ্রিক একটি জনপ্রিয় উপন্যাস এবং একই সঙ্গে ধ্রুপদী সাহিত্য পদবাচ্য। জনপ্রিয়তার সঙ্গে ধ্রুপদী মর্যাদার একটা আপাত বিরোধ থাকলেও বলা যায় শেকসপীয়রের মতো কাজানজাকিস তাঁর এই উপন্যাসে একাধারে দুটোই অর্জন করেন। ফরাসি দার্শনিক এবং কাজানজাকিসের শিক্ষক হেনরি বার্গসঁর ‘এলান ভিটাল’ বা জীবনসঞ্চারী দার্শনিক মতের একটি সার্থক শিল্পরূপ দেখতে পাওয়া যায় এই জোরবা চরিত্রে। মৃত্যুকে নৃত্যে, দেহকে আত্মায় এবং পুনর্জাগরণে রূপান্তরিত করার যে কথা কাজানজাকিস তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকর্মে ব্যক্ত করেছেন, তারই একটি জীবন্ত রূপ এই জোরবা, যাকে তিনি বলেছেন নর্তক, যোদ্ধা, বিশাল হৃদয়, সাহসী মানুষ এবং একটি উন্মুক্ত, স্বাধীন আর্তনাদ।”
জোরবা দ্য গ্রিক উপন্যাসে এত বিচিত্র রকমের সমাহার ঘটেছে, যা পাঠ করতে গেলে কখনও ছন্নছাড়া হয়ে যেতে হবে। নিজেকে পাঠমগ্ন করে তোলার জন্য যথেষ্ট ধৈর্যের খেলায় মাততে হবে। কৃষক, শ্রমিক, যোদ্ধা, ব্যবসায়ী, পাদ্রি, বিধবা, কিশোরী, প্রতিবন্ধী—গ্রন্থটিতে বিচিত্র রকম মানুষের সমাহার ঘটেছে।
জোরবার সংগ্রামী, সাহসী, দুরন্ত জীবন নিকোসকে অভিভূত করেছে। চিন্তার জগতে দোলা দিয়েছে। জোরবা দ্য গ্রিক গ্রন্থ থেকে—“তিক্ত হাসি হেসে আমি বিড়বিড় করি, ‘আরেক জনমে, হয়ত অন্য কোনো জীবনে আমার আচরণ নিশ্চয়ই এর চেয়ে উন্নত হবে। এখনকার মত, বাবা, চলতে থাক যেমন চলছ।’
যেন এক মহাপাপ করে ফেলেছি—এরকম মানসিক ভার নিয়ে আমি সবুজ গিরিখাতে নেমে পড়ি এবং হাঁটতে থাকি। শীতে দেহ হিম হয়ে আছে, দেখি কাঁপছি। বৃথাই চেষ্টা করি মাথা থেকে বিধবার চকিত চাহনি, তার চটক হাসি, তার স্তন যুগল তাড়াতে। তারা বারবার ফিরে আসে এবং আমি পালাই, যেন পেছনে কেউ ধরতে আসছে।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের অনুবাদের ধাঁচ ভিন্ন। বিষয় কঠিন, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি সহজ। দুর্বোধ্য নয় তাঁর অনুবাদ। তিনি যা এখনও অনুবাদ হয়নি, কিংবা যা নিয়ে ভাবা হয় না; তা অনুবাদ করে থাকেন।
গাছপালায় এখনো পাতা আসেনি, কিন্তু কুঁড়িগুলো রসে টইটম্বুর। তারা ইতিমধ্যে ফুলতে আর ফাটতে শুরু করেছে। প্রত্যেক কুঁড়িতে আপনি নবীন পল্লব, ফুল, অনাগত মিষ্টি ফলের উপস্থিতি টের পান পিটা পাইয়ের মতো—ওরা অপেক্ষায় আছে কখন আলোর স্পর্শে ফেটে পড়বে। মধ্য-শীতের কন্দরে বসন্তের জাদু রাতদিন বোনা হচ্ছে। শুকনো বাকলের নিচে তা নীরবে, গোপনে কাজ করছে।
হঠাৎ আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠি। আমার সামনে একটা বিচ্ছিন্ন, নিচু জমিতে এক সাহসী কাঠবাদামের গাছ এই মধ্য শীতেও ফুলে ভরে উঠেছে যেন সে অন্যসব গাছপালাকে পথ দেখাচ্ছে আর বসন্তের আগমন ঘোষণা করছে। দমবন্ধ হওয়া যে যাতনা আমার বুকে চেপে ছিল তা এখন সরে যায়। এটাই আমি চাচ্ছিলাম। লম্বা একটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে এই ফুলের কিছুটা ঝাঁঝালো গন্ধ টানি। রাস্তা থেকে নেমে এখন খুবানি গাছটার পুষ্পশোভিত শাখার নিচে অনেকক্ষণ বসে থাকি। ভাবি না কিছুই, সহজ ছন্দে সুখ অনুভব করি। মনে হলো যেন এটাই চিরায়ত কাল এবং আমি বসে রয়েছি নন্দনকাননে পুষ্পিত এক অমর বৃক্ষতলে।”
এক অভাবনীয় সুন্দরের বর্ণনা এঁকেছেন লেখক। একই সঙ্গে অনুবাদের কথা না বললেই নয়। যেখানে প্রাণ-প্রকৃতি, মানুষের বাস্তবচরিত্রকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটি আকারে বেশ দীর্ঘ। তবে মনোযোগী শ্রোতা হলে এর রূপ-রস-গন্ধ সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস মূলত প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। নিকোস কাজানজাকিসকে নিয়ে তিনি নিবিড় গবেষণা করেছেন। খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের অনুবাদের ধাঁচ ভিন্ন। বিষয় কঠিন, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি সহজ। দুর্বোধ্য নয় তাঁর অনুবাদ। তিনি যা এখনও অনুবাদ হয়নি, কিংবা যা নিয়ে ভাবা হয় না; তা অনুবাদ করে থাকেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত সব সাহিত্যিকদের রচনা। কথাপ্রকাশ থেকে জোরবা দ্য গ্রিক গ্রন্থটির অনুবাদ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। অনুবাদেও একই শিরোনাম রাখা হয়েছে। জোরবা দ্য গ্রিক গ্রন্থটি সাবলীল অনুবাদের কারণে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা যায়।
বই : জোরবা দ্য গ্রিক
মূল : নিকোস কাজানজাকিস
অনুবাদ : খালিকুজ্জামান ইলিয়াস
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ
মূল্য : ৪৫০ টাকা

লাবণী মণ্ডল। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে। দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই আলোচনা লেখেন। যৌথ সম্পাদনায় তাঁর ৫টি বই প্রকাশ হয়েছে।