কথাসাহিত্যগল্প

আগুন চেয়েছিল পতঙ্গজীবন

পৃথিবী কি ভেসে যাবে আজ? নূহের প্লাবন কি ভাসিয়ে নেবে টিনের চালার নিচের ছোট্ট সংসার? সেই যে মরার বৃষ্টি শুরু হয়েছে ভোর রাত থেকে, ঝমঝমিয়ে অবিরাম ঝরছে তো ঝরছেই। বেলা চড়তে চড়তে এখন বারোটা পেরিয়ে গেছে প্রায়। দু বছরের মেয়েটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে সেই কখন থেকে কাঁদছে। যমুনার ইচ্ছে করে গলা টিপে মেরে ফেলে হারামির বাচ্চাটাকে। হারামি লোকটা সেই যে শরীরের সুখ নিয়ে ভেগে গেছে, আর এমুখো হয়নি কোনোদিন। নির্ঘাত নতুন কোনো মাগির পেছনে লেগেছে আবার। ঘেন্নায় থু করে একদলা থুতু ফেলে যমুনা। ইদানীং যতবার লোকটাকে মনে পড়ে, ততবারই ঘেন্নায় প্রায় বমি আসে তার। আর মেয়েটা দেখতেও হয়েছে অবিকল সেই বদখত হারামজাদা লোকটার মতো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই লোকটার মুখটা মনে পড়ে যায় শত অনিচ্ছাতেও। সেই কারণেই মেজাজটা বশে রাখা যায় না কিছুতেই।

ঘরের দরজা সরিয়ে মুখ বের করে আকাশটা আরেকবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে যমুনা। মুহূর্তেই ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় তাকে। বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ঝাপসা সব। আকাশ অন্ধকার। এই বৃষ্টি আজ সারাদিনেও থামবে কি না কে জানে! কিন্তু হাঁড়ি তো শূন্য তার! খাবে কী? তিন্নিকেই বা কী খেতে দেবে? ওদিকে নায়লা সকাল থেকে ফোনের পর ফোন দিয়েই যাচ্ছে তাকে। কেন যে মানুষ নিজেকে ছাড়া, নিজের সুবিধা-অসুবিধা ছাড়া আর কিছুই ভাবে না কোনোদিন। নইলে নায়লা তো কানা নয়, সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে অনবরত, দেখছে, তবু এতবার তাকে ফোন কেন দেয় নায়লা! এই বৃষ্টির মধ্যে তিন্নিকে নিয়ে কী করে কাজে যাবে যমুনা? আর শুধু বৃষ্টিও তো নয়, ঝড় হচ্ছে প্রবল, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন, এর ভেতরে বাইরে বের হওয়া অসম্ভব। নায়লা তবু ফোন দিয়েই যাচ্ছে তাকে। মানুষগুলো এত স্বার্থপর আর আহাম্মক, ভাবতেই হারামি লোকটার মুখটা মনে পড়ে যায় আবার। লোকটা ভালোবাসার মিষ্টি কথায় ভুলিয়েছিল তাকে। অবশ্য লোকটাকেও দোষ দেয়া যায় না তেমন, যমুনা নিজেও তখন উন্মুখ ছিল অমন কোনো ভোলেবাবার জন্যই।

যমুনার তখন মনে হয়েছিল লোকটা মানুষ নয়, সাক্ষাৎ ফেরেশতা। তাকে সেই নরক থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং আল্লাহ লোকটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে সেই আশ্রমে। তাই বদমাশ লোকটাকে বিশ্বাস করতে তার তিলমাত্র সময়ও লাগেনি। এখন নিজের সেই বোকামির জন্য তিনবেলা নিজেকেই অভিশাপ দেয় যমুনা। অভিশাপ দেয় নিজের না দেখা, না চেনা বাপ-মাকেও। হারামিদুটো যমুনাকে জন্ম দিয়ে রাস্তায় ফেলে গিয়ে নিজেরা কোন নরকে পচে মরছে কে জানে! মরুক সব! জ্বলেপুড়ে খাক হোক তারা নরকের আগুনে! বিড়বিড় বকে যমুনা।

দুই

সবে পনেরোয় পা দিয়েছে তখন যমুনা, জ্ঞান হওয়ার ঢের আগেই যার ঠাঁই হয়েছিল বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত এক এনজিওর শিশু আশ্রমে। পথশিশুদের কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দিত তারা। লেখাপড়া শিখিয়ে, হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে অতঃপর ছেড়ে দিত জীবন নামক যুদ্ধের ময়দানে। এর পরেও যে কোনো প্রয়োজনে নানান সহায়তাও করত তারা। কিন্তু যমুনার কপালে শনি হয়ে এল ওই বদমাশ লোকটা। পনেরোয় পা দেয়া যমুনার তখন উড়ুউড়ু মন, দুরুদুরু বুক, পালাব পালাব দশা, মনে সবে ফুটতে শুরু করেছে পিরিতির কুসুম। ঠিক তখন, কোত্থেকে ঠিক ঝড়ের মতন উদয় হলো লোকটা যমুনার জীবনে, তাদের আশ্রমে। আশ্রমের নিয়ম-কানুন ছিল বেজায় কড়া। বড় আপামণি ছিলেন যাকে বলে রাই-বাঘিনী। পান থেকে চুন খসলেই কঠিন শাস্তি দেয়া হত যমুনাদের। যখন এনজিওর বড়কর্তারা আশ্রম পরিদর্শনে আসতেন, বড় আপামণিকে তখন দেখাত ভীষণ হাসিখুশি, দারুণ বন্ধুসুলভ। তখন যমুনাদের সঙ্গে ভীষণ ভালো ব্যবহার করতেন তিনি, কী যে স্নেহ ঝরত তখন তার কণ্ঠে! কিন্তু পরিদর্শন শেষে কর্তাবাবুরা চলে যেতেই আবার ফিরতেন তিনি তার রণচণ্ডীরূপে। পরিদর্শকেরা যমুনাদের নানান প্রশ্ন করতেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানতে চাইতেন। সব প্রশ্নের উত্তর বড় আপামণির মনমত শিখিয়ে রাখা হতো তাদের, আগে থেকেই। তাতে কোনো হের-ফের হলে কিংবা কেউ আপামণির প্রতিকূলে কোনো জবাব দিলে তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতেন তিনি পরে। এমন-কি নানা অজুহাতে আশ্রম থেকে বের করে দেয়ার নজিরও ছিল ভুরি ভুরি। ফলে তাকে যমের মত ভয় পেত সবাই। যমুনা তাই সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল মনে মনে। স্রেফ তার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না বলে তখনো সে পড়েছিল আশ্রমে, নইলে বহু আগেই সে পালিয়ে বাঁচত সেখান থেকে। ঠিক তেমন সময়েই কোত্থেকে উড়ে এসেছিল লোকটা, ত্রাতার ভূমিকা নিয়েছিল তার। যমুনার তখন মনে হয়েছিল লোকটা মানুষ নয়, সাক্ষাৎ ফেরেশতা। তাকে সেই নরক থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং আল্লাহ লোকটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে সেই আশ্রমে। তাই বদমাশ লোকটাকে বিশ্বাস করতে তার তিলমাত্র সময়ও লাগেনি। এখন নিজের সেই বোকামির জন্য তিনবেলা নিজেকেই অভিশাপ দেয় যমুনা। অভিশাপ দেয় নিজের না দেখা, না চেনা বাপ-মাকেও। হারামিদুটো যমুনাকে জন্ম দিয়ে রাস্তায় ফেলে গিয়ে নিজেরা কোন নরকে পচে মরছে কে জানে! মরুক সব! জ্বলেপুড়ে খাক হোক তারা নরকের আগুনে! বিড়বিড় বকে যমুনা। খিদেয় পেট জ্বলে তার। বৃষ্টি থামে না। একটানা ঝরতে থাকে। ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা তার পলকা টিনের চালা উড়িয়ে নিতে চায়। আষাঢ়ের এই বাদলা কদিন থাকবে কে জানে! শঙ্কায় তার পেটের খিদেটা মোচড় দিতে থাকে আরো। মরচে পড়া টিনের কৌটার তলানিতে পড়ে থাকা, মিইয়ে যাওয়া দুটো বিস্কুট খাইয়ে তিন্নিকে আপাতত শান্ত করে যমুনা। ফোনটা বন্ধ করে দেয়। নায়লা ফোন বন্ধ দেখলে কী ভাববে? যা ভাবে ভাবুক। কী এসে যায় তাতে! ঢাকা শহরে কাজ গেলে কাজের অভাব নাই, বরং বিশ্বস্ত কাজের লোক চলে গেলে কোটি টাকায়ও আর না পাওয়ার শঙ্কা আছে বিস্তর।

তিন

আশ্রমে নিত্যপণ্যের যোগান দিতে আসা লোকটা পরপর দুদিন লাপাত্তা থাকার পর তৃতীয় দিন নতুন এক সাঙাৎ সঙ্গে এনে সোজা বড় আপামণির রুমে ঢুকে গেল, দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল যমুনা। সেদিন তার আশ্রমের সামনের বাগান ঝাঁট দেয়ার পালা। বাগানে ঝরে পড়া রাশি রাশি ঝরা পাতা ঝাঁট দিয়ে জড়ো করে বড় এক ডাঁই বানিয়ে যমুনা তখন বাগানের উঁচু শিশুগাছটির নিচে বসে সবে জিরিয়ে নিচ্ছে খানিক। শীতের শেষ তখন, গাছের পাতাগুলো অবিরাম ঝরছে আর তাদের শরীরে উঁকি দিতে শুরু করেছে কচি পাতাদের সবুজ মুখ। বসন্ত আসি আসি সময়টাতে প্রকৃতিতে বইছে উতল হাওয়া আর চারপাশটা ক্রমশ উদাস আকুল হতে শুরু করেছে সবে। ঠিক যমুনার মনের মতো, প্রকৃতিতেও তখন বসন্তের আগমনী গান বাজতে শুরু করেছে মৃদু লয়ে তার কোমল কুঁড়িটি নিয়ে। যমুনার মনটা ভীষণ খারাপ ছিল সেদিন। সাত-সকালে উঠেই কাজে লেগে পড়ার ফিরিস্তি শুনে মেজাজ বিগড়ে গেছিল তার, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাড়তি কাজ করতে আপত্তি করায় বড় আপামণির ধমক আর শাস্তি হিসেবে সেদিনের দুপুরের মিল বন্ধ করে দেয়ার হুমকি। ফলে নিজের মন আর প্রকৃতিতে বইতে থাকা বাউল বাতাস তাকে উদাস আর আনমনা করেছিল খানিক। কাজ বন্ধ রেখে সে তাই অন্যমনস্কভাবে লোকদুটোকে বড় আপামণির রুমের ভেতর হারিয়ে যাওয়া দেখেছিল, আর মুহূর্ত পরেই নিজের ভাবনায় ডুবে গেছিল আবার। তার অপরিণত কিশোরী মন তখনো পৃথিবীর খানাখন্দ চেনেনি, সে ভাবছিল এই আশ্রম নামক নরক থেকে বের হলেই বাইরের উদার পৃথিবী তাকে লুফে নেবে, দেবে মুক্তি, দেবে স্বাধীনতা। সে পাবে স্বপ্নময় এক সুখি জীবনের সন্ধান। ফলে শিশুগাছটির ছায়ায় বসে ঝরাপাতার সুরে নিমগ্ন যমুনা স্বপ্ন বুনতে ব্যস্ত ছিল একান্ত গোপনে। হঠাৎ ধ্যান ভাঙল তার। নিত্যপণ্য দিতে আসা লোকটা আর তার সাঙাতের পদশব্দে ধ্যান ভেঙে চমকে তাকাল সে। দেখল নিত্যপণ্য দিতে আসা চেনা লোকটা সোজা তাদের ভাঁড়ার ঘরের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে আর সাঙাৎ লোকটা যাচ্ছে তার পিছু পিছু। চলতে চলতেই সাঙাৎটা কী মনে করে ফিরে তাকাল যমুনার দিকে। হঠাৎই। না তাকালেও ক্ষতি ছিল না কিছু। তবু তাকাল। যমুনার চোখে চোখ পড়ল লোকটার। যমুনার ভেতরটা কেঁপে উঠল ভীষণভাবে। কৈশোরের ঘুম ভাঙেনি তখনো যমুনার, তবু তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা নারীটি জেগে উঠল মুহূর্তেই। সেই নারীসত্তাটি, সহজাতভাবেই পুরুষের দৃষ্টি চেনে। চেনে সরল দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখা অনুক্ত ভাষা। যমুনা তাকাল। তাকিয়ে সে সেই চোখে দেখতে পেল প্রশংসা, প্রণতি আর কাম, দেখতে পেল নির্ভেজাল আত্মনিবেদন। যমুনা চোখ সরিয়ে নিল। ত্বরিতে উঠে গিয়ে মন দিল নিজের কাজে। লোকটার কামুক চোখ তখনো যমুনাকে চাটছে। ভেতরে ভেতরে আহ্লাদে গলে গেল যমুনা। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সতর্ক করতে চাইল তাকে। তাকে সমূহবিপদ থেকে দূরে থাকার বার্তা দিতে চাইল। সে সতর্কবার্তাকে অগ্রাহ্য করল যমুনা। তার কানের কাছে গুনগুনিয়ে উঠল হঠাৎ প্রণয়ের মৌমাছি। লোকটার দিকে চোরাচোখে তাকিয়ে যমুনা যেন পেল কোনো আসন্ন মুক্তির বার্তা।

চার

বৃষ্টির কোনো বিরাম নাই। মনে হচ্ছে আকাশের হাতে থাকা জলের পাত্রটাকে সহসা উল্টে দিয়েছে কেউ। আশ্রমের আয়া হাছনা খালা বলতেন ‘গবগবায়া বিষ্টি হচ্চে’। আজকের বৃষ্টি যেন হাসনা খালার বলা সেই ‘গবগবানো’ বৃষ্টি। তবে ঝড়ো হাওয়া আর মেঘের গর্জন কমে এসেছে অনেকটা। দরজা সরিয়ে আরেকবার আকাশটা দেখল যমুনা। এই বৃষ্টি থামবে না আজ। কথাটা নিজেকেই শোনাল সে। তিন্নি এখনো ঘুমে। উঠেই আবার শুরু করবে ট্যাঁ ট্যাঁ। গতরাত থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি যমুনার। বুকে একফোঁটা দুধ নেই। তিন্নি বুকে মুখ লাগালেই বিষম জ্বলছে স্তন, মনে হচ্ছে কেউ মরিচ বেঁটে লাগিয়ে দিয়েছে সেখানে। কী করবে ভেবে পায় না যমুনা। শেষে তিন্নিকে ঘুমন্ত রেখেই ছেঁড়া ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দরজাটা বাইরে থেকে টেনে পাশের ঘরের বউটার দরজায় অনেক ধাক্কাধাক্কি করে ডেকে তুলে তিন্নির দিকে নজর রাখার অনুরোধ করে বেরিয়ে পড়ে অতঃপর। রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে বাকিতে কিছু চাল-ডাল কিনবে আপাতত। এ বেলাটা অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি ধরলে ও বেলায় সম্ভব হলে নায়লার বাসায় যাবে। নিজের বাসায় তেমন একটা রান্না করে না যমুনা। নায়লার বাসায় সে রান্নাসহ বাকি কাজ করে, তিনবেলা খাবার আর পাঁচহাজার টাকা পায়, সেইসঙ্গে অবসরমত কিছু টুকটাক হাতের কাজ করে। তাতেই দিন চলে কোনোমতে। তিন্নিটা বড় না হওয়া অব্দি নিজের পছন্দসই কোনো কাজেই যোগ দিতে পারবে না সে। হারামজাদা লোকটা তাকে আচ্ছা এক ফাঁদে আটকে দিয়ে সটকে পড়েছে মওকা বুঝে। রাগে ব্রম্মতালু জ্বলে যায় যমুনার। থু করে আরেকদলা থুতু ফেলে সে। রাস্তায় একহাঁটু জল। নোংরা ভাসছে তাতে। ঘেন্নায় গা গুলোয় তার। বৃষ্টি ছাতা মানে না, ভিজিয়ে দেয় তাকে। পরনের সালোয়ার-কামিজ ভিজে প্রায় লেপটে যায় শরীরের সঙ্গে। বুক-মাথা ঢাকা ওড়নাটা ভিজে চুপসে যায়। রাস্তার খানাখন্দ এড়িয়ে, নোংরা জল পেরিয়ে মোড়ের দোকানটায় যখন পোঁছায় যমুনা, বৃষ্টি তখন বাঁধভাঙা বন্যা হয়ে নেমেছে প্রায়। জনশূন্য রাস্তাঘাট। মানুষজনের চিহ্নটিও নেই, যানবাহনেরও কোনো বালাই নেই কোথাও। অচেনা লোকের পক্ষে রাস্তা আর ড্রেন আলাদা করে চেনা শক্ত। দোকানের ঝাঁপ অর্ধেকটা নামানো। জলের তোড়ে পাছে ভিজে যায় ভেতরের সব সাজানো পণ্য, তাই এ ব্যবস্থা। তবু ভিজে যাওয়া কতটা ঠেকানো গেছে কে জানে! যমুনা অনেকটা নিচু হয়ে দোকানের ঝাঁপের মধ্যে মাথা গলিয়ে দেয়, গলা তুলে বলে, কাকা, দোকানে আছেন?

বৃষ্টির জলে ঝাপসা চোখ মুছে সে তাকায় আবার। ভেতরে জুলজুলে চোখের বুড়োটাকে ঢুলতে দেখে আশ্বস্ত হয় মনে মনে। যাক বাবা, বুড়োর দামড়া ছেলেটা নাই এখন। ছেলেটার নজর খারাপ। যমুনার দিকে এমন নোংরা চোখে তাকায়, যেন চোখ দিয়েই সর্বাঙ্গ চেটে নেয় যমুনার। গা ঘিনঘিন করে ছেলেটাকে দেখলেই। বুড়োটা সম্ভবত ঘুমিয়েছে। কদিনের তীব্র গরমে ঝলসে যাওয়া বুড়োর শরীরটা সম্ভবত ঝিমোচ্ছে হঠাৎ বৃষ্টিতে নামা ঠান্ডা পেয়ে।

কাকা! ও কাকা!

কে? যমুনার গলা শুনে চমকে নড়েচড়ে বসল বুড়ো। বিদ্যুৎ নাই সেই ভোর রাত থেকে। চার্জারের মৃদু আলোয় যমুনাকে দেখল বুড়ো একনজর। বুড়োর চোখের মতিগতি দেখে ভেজা ওড়নাটা আরেকটু টেনেটুনে বুকের ওপর ছড়িয়ে দিল যমুনা। তাতে সেটা আরো আঁট হয়ে বসল সেখানে। স্পষ্ট হয়ে উঠল আরো শরীরের নানা খাঁজ-প্রতিখাঁজ।

ক্যাডা রে? যমুনা সুন্দরী? এই বিষ্টিত কই যাও?

এখানেই আসলাম কাকা। আধা কেজি চাল আর দুটো আলু দ্যান। এক তারিখে টাকা দিয়ে যাব কাকা। বৃষ্টির জন্য কাজে যেতে পারি নাই। ঘরে কোনো খাবার নাই, বাচ্চাটা খিদেয় কাঁদছে।

বাকিতে তো সদাই দেওন যাইব না রে যমুনা। বৌনি হয় নাই অহনো। বাদলার দিন, কাস্টমার নাই।

দ্যান না কাকা। বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে, কাঁদছে খুব।

তোর খিদে পায় নাই? বলেই বুড়ো জুলজুলে চোখে অর্থপূর্ণ টিপ দেয় যমুনার চোখে তাকিয়ে, উঠে এসে দোকানের ভেতরে ঢোকার দরজাটা সামান্য খুলে দিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, ভিইজা তো চুপসায়া গেছস দেহি, শইল দেহা যায় পুরা। ভিত্রে আয়, কেউ নাই এহন। সদাই যা লাগে নিয়া যা, আয়। তোরে একটু মন ভইরা সোহাগ করি যমুনা, আয়।

পনেরো বছরের সেই ছোট্ট জীবনে অমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি তার, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আগুনে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তখন ভীষণ অস্থির তার পতঙ্গ মন। লোকটা না হয়ে অন্য যে কেউ হলেও তখন চলত যমুনার, তার তখন আগুনের নেশা। তখনও জানত না যমুনা, বদমাশ লোকটা আশলে আগুনও নয়, নিতান্তই কয়লা কোনো, তবু তার পতঙ্গের নেশা কাটেনি তখনো, পতঙ্গ শিকারে সে তখনো দারুণ পারঙ্গম।

ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে যমুনার। হাড্ডিচর্মসার লিকলিকে বুড়ো, বয়স আশি ছুঁইছুঁই, সে কাকা ডাকে লোকটাকে, অথচ! নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে যমুনা, লোকটার মুখে যেন শয়তান ভর করে, লোভে কেমন চকচক করে মুখ, যেন যমুনাকে ছিঁড়ে খাবে বুড়ো হায়েনাটা। লালা গড়ায় মুখ বেয়ে। বলে, জলদি আয়! দেরি করস ক্যান!

হারামজাদা বুড়ো! তিন পা কবরে গেছে এখনো লুচ্চামি যায় নাই!

বলেই হনহন করে বাসার পথ ধরে যমুনা। শুয়োরের বাচ্চার জীবন। নিজেকেই নিজে গালি দেয় যমুনা। শুয়োরের বাচ্চা বজ্জাত লোকটার মুখটা মনে পড়ে যায় আবার। পেছনে তাকায় না যমুনা। অমন বহু হারামজাদা বুড়োর মুখ মাড়িয়ে এ পর্যন্ত এসেছে সে, আরো বহু হারামির মুখ মাড়াতে হবে তাকে সামনে, জানে সে।

পাঁচ

আগের লোকটা আর মাল সাপ্লাই দেবে না আশ্রমে, নতুন লোক ঠিক করে দিয়ে গেছে সে, যে এখন থেকে আশ্রমের নিত্য দরকারী সব পন্য সরবরাহ করবে, কথাটা রাতে খাওয়ার টেবিলে শুনল যমুনা। সবাই বলাবলি করছিল বিষয়টা নিয়ে। চুপ থাকল যমুনা, কোনো প্রত্যুত্তরই করল না সে। সচরাচর বাচাল সে, প্রগলভ। কিন্তু সাপ্লায়ার পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা খবরেও সে আশ্চর্যজনকভাবে চুপ থাকল, বিষয়টা অন্যদেরও নজরে পড়ল, তারা এ নিয়ে তাকে দুয়েকবার প্রশ্নও করল, কিন্তু যমুনা কোনো উত্তর দিল না। অন্যমনস্কভাবে সে নিজের খাবারটা নাড়াচাড়া করতে থাকল শুধু। তার মনের মধ্যে তখন নতুন লোকটার সেই অদ্ভুত দৃষ্টি, যা তাকে সেই উদাস একলা দুপুরে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বরশিতে গেঁথে ফেলেছিল প্রায়, নাড়িয়ে দিয়েছিল তার ভেতরটাকে। সারাদিনে বহুবার সেই দৃষ্টিটা আনমনা, উদাস করে দিয়েছে তাকে, করে দিয়েছে উচাটন। অথচ অমনটা হওয়ার কথা নয়। নিতান্তই শেয়াল-চেহারার লোকটা, হনু উঁচু, গালভাঙা, রুখুসুখু একটা লোক। বয়সও চল্লিশের বেশি ছাড়া কম নয়, যমুনার তিনগুণ বড় লোকটা, তবু কেন যে লোকটা অমন ডাকাত চোখে তাকাল তার দিকে! কী কামুক দৃষ্টি লোকটার! স্রেফ লম্পটের চোখ! ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল যমুনা। ঘেন্না জাগল। তবু কেমন একটা রোমাঞ্চও টের পেল সে নিজের শরীরে, মনে। এই ভয়ানক স্ববিরোধীতা নিজের ভেতর আবিষ্কার করে হঠাৎ ভারি দিশেহারা বোধ করল যমুনা। অস্থির, চঞ্চল হয়ে উঠল তার মন। প্লেটে খাবার ফেলেই হাত ধুয়ে উঠে পড়ল সে তাড়াতাড়ি। নিজের জন্য বরাদ্দ কাজটুকু দম দেয়া পুতুলের মতো কোনোক্রমে শেষ করে সে শুয়ে পড়ল নিজের মাথার কাছের লাইটটা নিভিয়ে। মাথার ভেতর হাজাররকম ভাবনা এসে ভর করল তার। লোকটার সেই দৃষ্টিটা তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকল বড়শি হয়ে, তাকে ঘুমুতে দিল না সারারাত। পনেরো বছরের সেই ছোট্ট জীবনে অমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি তার, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আগুনে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তখন ভীষণ অস্থির তার পতঙ্গ মন। লোকটা না হয়ে অন্য যে কেউ হলেও তখন চলত যমুনার, তার তখন আগুনের নেশা। তখনও জানত না যমুনা, বদমাশ লোকটা আশলে আগুনও নয়, নিতান্তই কয়লা কোনো, তবু তার পতঙ্গের নেশা কাটেনি তখনো, পতঙ্গ শিকারে সে তখনো দারুণ পারঙ্গম।

পরদিন ভোরে নিত্যপণ্যের ভ্যান নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করল লোকটা। পথেই দেখা হয়ে গেল যমুনার সঙ্গে। সেই একই দৃষ্টিতে লোকটা আবার তাকিয়ে থাকল তার চোখে, মুখে বিদঘুটে ফিচেল হাসি। যমুনা লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে। লোকটার মুখের হাসিটা তার মনের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধল, কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা তাকে আটকে রাখল লোকটার চোখে। কাছাকাছি হতেই লোকটা হঠাৎ কথা বলে উঠল তার সঙ্গে। ভ্রু নাচিয়ে, যতটা সম্ভব কোমল আর মিহিকণ্ঠে তাকে বলল, কী নাম গো তুমার?

যমুনা। লোকটার চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিল যমুনা।

য-মু-না! প্রায় সুর করে কথাগুলো উচ্চারণ করল লোকটা। ফিচেল হাসিটাকে আরো খানিকটা বিস্তৃত করে বলল, নদীর নামে নাম গো তুমার!

উত্তর না দিয়ে সরে গেল যমুনা। লোকটার শেয়ালমুখ সেদিনের মতো বিদায় নিল চোখের সামনে থেকে।

দুদিন পর আবার দেখা। যমুনা হয়ত মনে মনে অপেক্ষা করছিল লোকটার, নিজের অজান্তেই। লোকটা তাকে দেখেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে, কেউ তাদের কথা শুনছে না, নিশ্চিত হয়ে একগাল হেসে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, কী গো যমুনা! তুমি তো নদী! আমারে সাঁতরাইতে দিবা?

থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল যমুনা। কোনো কথা সরলো না তার মুখে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে সেখানেই। চোখ তখনো লোকটার চোখে। ধূর্ত লোকটা ততক্ষণে বুঝে গেছে শিকার বরশি গিলেছে, এখন শুধু টেনে তোলা বাকি। তার দুদিন পরেই আশ্রম থেকে পালাল যমুনা লোকটার হাত ধরে। মুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নেয়ার তৃষ্ণায় সে প্রবল গতিতে বেরিয়ে গেল আশ্রমের বাইরে। গিয়েই দেখল, ভুল। কোথাও মুক্তি নেই। কোথাও নেই খোলা হাওয়া। তুমুল অন্ধকারে ছেয়ে আছে মুক্তি নামক লাল সূর্যটার মুখ।

ছয়

লোকটা যমুনাকে নিয়ে তুলল বস্তি এলাকার নিতান্তই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এক খুপরি ঘরে। শিশুকাল থেকে আশ্রমে বড় হওয়া যমুনা অমন পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত ছিল না একেবারেই। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গেও তার তখনো তেমন পরিচয় ঘটেনি। ফলে সেই পরিবেশে দমবন্ধ লাগল তার। কষ্ট হলো মানিয়ে নিতে। তবু সে চুপ থাকল। সামান্য কদিনের পরিচয়, ঠিক পরিচয়ও নয়, কথা হয়েছে সামান্যই, কথা যা বলার লোকটাই বলেছে এ কদিন, যমুনা শুধু হু হ্যাঁ করেছে, তাকিয়ে থেকেছে নির্ণিমেষ। বদমাশ লোকটার চোখে যেন আগুন ছিল, যমুনাকে আটকে রেখেছিল তাতে। ফলে লোকটাকে সে কিছু বলতেও পারল না আড়ষ্টতায়। কিন্তু রাতে, অন্ধকার নেমে এলে, লোকটা যখন তাকে নিয়ে বিছানায় যাওয়ার উদ্যোগ নিল, তখন মুখ খুলল যমুনা। বিয়ে ছাড়া কিছুতেই লোকটাকে বিছানায় নিতে রাজি হল না সে। লোকটা হাসল। অন্ধকারে লোকটার মুখটা দেখতে পেল না যমুনা। কিন্তু লোকটার খিকখিক হাসির কুৎসিত শব্দ যমুনার কানে বিষ হয়ে ঢুকে গেল। গা ঘিনঘিন করে উঠল তার। আশ্রমের পরিবেশে থেকে মোটামুটি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলায় অভ্যস্ত যমুনা সজোরে লোকটাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টারত অবস্থায় বলে উঠল, খবরদার! ছোঁবেন না আমাকে! সরেন, সরে যান!

যমুনাকে হাসির তুবড়িতে উড়িয়ে দিল লোকটা। ঘিনঘিনে সরু গলায় বলল, চুপ! খানকি মাগি! এতিমখানার জারজ মাগি, আবার সতীপনা দেহায়! বেশ্যা কুনহানকার!

লোকটার শরীরে তখন অসুরের শক্তি। যমুনার কোনো বাধাই ধোপে টিকল না। কুমারীত্ব হারাল সে সেই রাতেই। লোকটা তাকে কোনোদিনই বিয়ে করবে না, সেই রাতেই কথাটা স্পষ্ট বুঝে গেল যমুনা।

জীবনটাকে নরক মনে হত তখন যমুনার। লুকিয়ে সে একদিন আশ্রমে চলে গেল। বড়আপামণির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল। আশ্রয় চাইল আবার। কিন্তু আপামণি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। যমুনাকে আশ্রয় দিলে আশ্রমের অন্য মেয়েরা তাতে যমুনার মতো ভ্রষ্টাচার করতে ভয় পাবে না আর, তাতে আশ্রমের পরিবেশ নষ্ট হবে, শৃঙ্খলাভঙ্গ হবে। সেটি কিছুতেই হতে দেবেন না তিনি, সাফ জানিয়ে দিলেন যমুনাকে।

বছরখানেক লোকটার সঙ্গে ছিল যমুনা। কিংবা লোকটাই ছিল যমুনার সঙ্গে। ঠিক থাকাও নয়। মাঝে মাঝে আসত লোকটা। বাজার-সদাই করে দিত, এটা-ওটা কিনে দিত, শরীরের সুখ নিত ইচ্ছেমতো। বেশিরভাগ সময়েই লোকটা আসত গভীর রাতে। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই চলে যেত আবার। নেশাগ্রস্ত থাকত লোকটা। যমুনার শরীর খুবলে খেয়েই তলিয়ে যেত গভীর ঘুমে। যমুনার সঙ্গে কথা হত অতি সামান্যই। জীবনটাকে নরক মনে হত তখন যমুনার। লুকিয়ে সে একদিন আশ্রমে চলে গেল। বড়আপামণির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল। আশ্রয় চাইল আবার। কিন্তু আপামণি তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন তৎক্ষণাৎ। যমুনাকে আশ্রয় দিলে আশ্রমের অন্য মেয়েরা তাতে যমুনার মতো ভ্রষ্টাচার করতে ভয় পাবে না আর, তাতে আশ্রমের পরিবেশ নষ্ট হবে, শৃঙ্খলাভঙ্গ হবে। সেটি কিছুতেই হতে দেবেন না তিনি, সাফ জানিয়ে দিলেন যমুনাকে। যমুনা কী করবে ভেবে পেল না কিছুতেই। পৃথিবীটা তার কাছে বিশাল এক গোলকধাঁধা মনে হল, জট পাকিয়ে গেল তার সব চিন্তা। তবু সে হয়ত পালিয়েই যেত দূরে কোথাও। কিন্তু তার আগেই শরীরের পরিবর্তনটা টের পেল যমুনা। তার শরীরের মধ্যে অন্য একটা শরীর বেড়ে উঠছে, টের পেয়ে নিজেকে পাগল পাগল লাগল তার। দিশেহারা বোধ করল সে। লোকটাকে কীভাবে সে বলবে এই সন্তানের কথা? আর ওই বদমাশ লোকটার সন্তানের মা হতে হবে তাকে? ভেবেই গা গুলাল তার ঘেন্নায়। কিন্তু এ অবস্থায় সে যাবেই বা কোথায়? গর্ভের সন্তানটাকে নষ্ট করতে হলেও লোকটার সাহায্য দরকার হবে তার, ভেবে সে আপাতত সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল। লোকটা ফিরলে তাকে সব বলে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করবে যমুনা, ভাবল অগত্যা। কিন্তু পরপর এক সপ্তাহ আর এমুখো হল না লোকটা। চিন্তায় পড়ল যমুনা। হল কী লোকটার? কোনো বিপদ হল না তো? যত খারাপই হোক, আপাতত এই লোকটাই তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন, লোকটার অমন আকস্মিক অন্তর্ধানে তাই প্রমাদ গুনল যমুনা।

ঠিক সপ্তাহ পরের এক বিকেলে যমুনার ঝুপড়ি ঘরের দরজায় জোরে ধাক্কা দিল কেউ। যমুনা চমকাল। লোকটা কখনো এই সময়ে আসে না, এত জোরে দরজায় ধাক্কাও দেয় না। তাহলে কে এল এই অসময়ে? আলতো করে দরজা খুলল সে। খুলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। বিশ-বাইশ বছরের একটা দামড়া ছেলে আর বছর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের এক নারী। কিন্তু এরা কেন যমুনার দরজায় ধাক্কা দেবে? বিশেষত কাউকেই যখন চেনে না যমুনা!

আপনারা কারা? বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল অবশেষে যমুনা।

তর নাম যমুনা? এতিমখানাত্থন ভাগছস তুই?

হিংস্রগলায় নারীটি প্রশ্ন করল যমুনাকে। যমুনা কী উত্তর দেবে ভেবেই পেল না প্রথমটায়। নারীটি একই প্রশ্ন প্রবল ধমকের সঙ্গে আবার করায় সে শুধু বলতে পারল যে, তার নাম যমুনা। তারপর আর কিছু মনে নাই তার। যখন জ্ঞান ফিরল, সে আবিষ্কার করল তার অন্ধকার খুপড়ি ঘরটাতে পড়ে আছে সে, সারা শরীরে খামচির দাগ, শরীর ফোলা, প্রচণ্ড ব্যথা। মাথার চুল অর্ধেক ছেঁড়া। বদমাশ লোকটার বউ আর ছেলে ছিল আগন্তকেরা, সম্ভবত। যমুনাকে হাতের সুখ মিটিয়ে মেরেছে, আর বলে গেছে এ তল্লাট ছেড়ে মানে মানে বিদায় হতে। লোকটার ত্রিসীমানায় আবার যমুনাকে দেখা গেলেই তাকে একেবারে কতল করে ফেলা হবে, জানিয়ে গেছে সে কথাও। সেই রাতেই লোকটা আবার কোত্থেকে উদয় হল যমুনার কাছে। যমুনার অবস্থা দেখে আর দুপুরের ঘটনা শুনে রাতের অন্ধকারেই তাকে নিয়ে আবার পালাল লোকটা, অন্য এক বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে তুলল সেখানে। দিনকতক বাদে খানিকটা ধাতস্থ হল যমুনা। এবার লোকটা ফিরলে তাকে নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা ভ্রুণটার কথা জানাবে, ভাবল মনে মনে। কিন্তু লোকটা সেই যে তাকে নতুন বস্তিতে এনে তুলে পরদিন সকালে ভেগেছে, আর তার দেখা নেই। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে এবার। দিন পনেরো গেল, তবু দেখা নেই লোকটার। এদিকে পেটের মধ্যে ভ্রুণটা বাড়ছে দ্রুত। অবশেষে এক রাতে মদ্যপ অবস্থায় এল লোকটা। তখন তাকে কিছু বলা আর না বলা সমান, বুঝে চুপ থাকল যমুনা। সকালে লোকটা হুঁশে ফিরলে বলবে, ভাবল মনে মনে। কিন্তু যমুনার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে মাঝরাত্তিরে লোকটার গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেদিনের সেই দামড়া ছেলেটা হামলে পড়ল এসে। সঙ্গে তার এক বন্ধু। বাপকে মেরে হাত-পা বেঁধে বন্ধুর রিকশায় তুলে দিয়ে ফিরে এল ছেলেটা আবার যমুনার ঘরে। যমুনাকে সেই অন্ধকার রাত্তিরে লোকটার দামড়া ছেলেটা দখলে নিল অতঃপর। পরপর বেশ কদিন ঘটল ব্যাপারটা। বস্তিতে এসব ঘটনা নস্যি, কেউ উঁকি দিয়েও দেখল না এসে। যমুনাও মেনে নিল চুপচাপ। হারামজাদা লোকটার চেয়ে বড় দামড়াটা ভালো, ভেবে মনকে প্রবোধ দিল সে। এরমধ্যেই এক রাতে বদমাশ লোকটা আবার এসে হাজির হল যমুনার ডেরায়। জানত না তার সুযোগ্য ছেলে ততদিনে দখল করে নিয়েছে তার অধিকৃত যমুনাকে। বাপ-বেটায় তুমুল মারামারি হল সে রাতে। অতঃপর ছেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে তখনকার মতো শেয়ালমুখো বাপের কাছ থেকে পালাল। দূরে বসে চুপচাপ দৃশ্যটা দেখল যমুনা। ঘেন্নায় বমি পেল তার। ওয়াক তুলে বমিও করল সে খোলা কলপাড়ে গিয়ে। তারপর বদমাশ লোকটার নাগালে গেল সে, যেতে হল। মওকা পেয়ে ফট করে সে বলে বসল তখন, আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলেন। আমার পেটে আপনার সন্তান।

তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল লোকটা। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জিগ্যেস করল, কী কইলি হারামজাদি?

আগের কথাটারই পুনরুক্তি করল যমুনা। লোকটা মুহূর্তেই পাল্টে গেল। হিংস্র গলায় সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, বেশ্যা মাগি! জারজ! তুই যেমন জারজ, তর প্যাটেরডাও জারজ। এতদিন আমার পোলার লগে শুইচোছ, আল্লা জানে আরো কার কার লগে শুইচোছ তুই, নটি মাগি। তাইলে তর প্যাটেরডা আমার সন্তান ক্যামনে অইল, এ্যাঁ?

আচ্ছা। জারজ বাচ্চা আমিও রাখতে চাই না। আপনি শুধু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে বাচ্চাটা নষ্ট করার ব্যবস্থা করে দেন।

আমার কিয়ের দায় পড়ছে তরে ডাক্তারের কাছে নেওনের? যার লগে প্যাট বাঁধাইচোস তারে ক গিয়া তরে ডাক্তারের কাছে লইতে! আমি আর তর লগে নাই।

সেই যে গেল হারামি লোকটা, আর কোনোদিন ফেরেনি। তার ছেলেটা সুযোগ বুঝে এসেছিল আরো বেশ কদিন। যমুনার পেটে সন্তান বুঝতে পেরে সে-ও কেটে পড়ল অল্প কদিন বাদেই। যমুনাও অবশেষে সেই বস্তি ছেড়ে এখনকার বস্তিতে এসে উঠল, ছুটা কাজ নিল নায়লার বাসায়। নায়লা চাকরিজীবী। তার ছোট্ট বাচ্চাটাকে দেখাশোনা আর রান্নার কাজ নিয়ে যমুনা চেষ্টা করল নিজের অন্ধকারতম অতীতটাকে মুছে ফেলার। কিন্তু তিন্নি তাতে একমাত্র বাধা। হারামি লোকটা তার জীবন থেকে মুছে গিয়েও মুছল না, তাকে ছেড়ে গিয়েও অষ্টপ্রহর সেঁটে রইল তার সঙ্গেই। অসহ্য। লোকটাকে ছাড়াও চলতে পারে যমুনা, এই সহজ সত্যটা যদি আরো কিছুদিন আগে বুঝত সে, তাহলে ঢের সহজ হত তার পথচলা, ভেবে আফসোসে আজকাল নিজের চুল নিজেই ছেঁড়ে সে তিনবেলা।

সাত

বৃষ্টি-কাদা মাড়িয়ে, ভিজে চুপসে একাকার হয়ে যমুনা ঘরে ফিরে এসে দেখল তিন্নি তখনো ঘুমে। খিদেয় পেট জ্বলছে তখন যমুনার। নায়লার বাসায় এই বৃষ্টি-কাদা ডিঙিয়ে তিন্নিকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু তিন্নি ঘুম থেকে উঠেই শুরু করবে চিল-চিৎকার। কী খেতে দেবে সে তিন্নিকে তখন? বুড়ো দোকানদারটার কাছেই ফিরে যাবে আবার? ভাবতেই ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে যমুনার। থু করে থুতু ফেলে আবার দূরে। বৃষ্টির জলে সেটা ধুয়ে যায় মুহূর্তেই। পাশের বউটার কাছে যাবে? ধার চাইবে একবেলা খাওয়ার মতো চাল? ভাবনাটা আগে কেন মাথায় আসেনি ভেবে খানিকটা আফসোস হয় যমুনার। দরজায় গিয়ে বউটার নাম ধরে ডাকে। বউটা দরজা সরিয়ে মুখ বের করে খানিক বাদেই। ঝুম বৃষ্টিতে সে আরাম করে শুয়েছিল হয়ত, তাকে বিরক্ত করায় নিজের কাছেই খারাপ লাগে যমুনার। সঙ্কোচে নিজের প্রয়োজনের কথাটা জানায় তবুও। বউটা ভালো, গতকালই এই বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে উঠেছে এসে, তার মরদটাকে এখনো চোখে দেখেনি কেউ। যমুনাকে দাঁড়াতে বলে ভেতরে চাল আনতে যায় বউটা, বাতাসে দরজাটা সরে যায় একদিকে। ঘরের ভেতরটা উন্মুক্ত হয়ে যায় হঠাৎ। মরদটা শুয়ে আছে চৌকিতে। হঠাৎই পাশ ফিরে শোয় লোকটা, তাকায় চোখ খুলে। যমুনা তাকিয়েই ছিল। হঠাৎ পাগলের মতো খিলখিল হেসে ওঠে যমুনা। হারামজাদা, বদমাশ লোকটার চোখে চোখ পড়তেই বাঁধভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ে সে। অতি চেনা সেই চোখে চোখ রেখে এক আকাশ বৃষ্টির নিচে দাঁড়ানো যমুনার খিলখিল হাসি বৃষ্টিটাকে চমকে দেয় ভীষণ। বউটাকেও। সে অবাক চোখে চালের পাত্র হাতে একবার যমুনা আরেকবার তার সদ্যজোটা মরদাটাকে দেখে। বৃষ্টি আরো ঘন হয়ে নেমেছে ততক্ষণে। পৃথিবীটাকে ভাসিয়ে দিতে অবিশ্রাম বইছে তখন নূহের প্লাবন।

লেখাটি শেয়ার করুন :

শিল্পী নাজনীন

শিল্পী নাজনীন। জন্ম ১৪ জুলাই ১৯৮১, কুষ্টিয়ায়। শিক্ষক, কথাচিত্রী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিযয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!