প্রবন্ধ

মুহূর্ত

মুহূর্ত। শুধু একটি শব্দ নয়-একটি উপলব্ধি, একটি পাত, এতটুকুন উন্মীলন। মুহূর্ত অপরিমেয়, অপরিজ্ঞেয়। এটি একটি মানসিক ধারণা কি! মানবের পলাতকা অস্তিত্বের রূপকে মুহূর্ত জুঝে নিতে চায় যেন। বস্তুর যে পরিবর্তন অস্তিত্বগামী, তার বিশেষকে অধিকার করতে চায় মুহূর্ত। ক্ষণও কি তাই! ক্ষণ হল নিমেষ।

মুহূর্ত সময় নয়, সময়ের স্তব্ধতা, যেন একটি বিন্দুর সমগ্রতা। শমে এসে যেন চকিতের ভাবনাবিমূঢ়তা। মুহূর্ত যেন গতিশীলতার অচকিত রহস্যবিন্দুটি, যেখানে সময় দম নেয়। ‘থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি’-এর মানেই হল একটি মুহূর্তের আবির্ভাব তার সমূহ উন্মীলনসহ। চিন্তার ক্ষেত্রে মুহূর্ত যেন মোড়ফেরাবিন্দু। এই মুহূর্ত যেন কাউন্টার এক্সপোজিশনের জন্ম দেয়।

মুহূর্ত তো ছবিরও জন্ম দেয়। প্রত্যেক নাস্তিকের মধ্যে থাকে এক আস্তিক, আর আস্তিকের মধ্যে নাস্তিক। এদের মধ্যে সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিক বলা যায় না, বরং কাউন্টারপয়েন্টের মতো। একটি সরব হলে অন্যটি একদম নীরব না থেকেই মৃদুভাষ করে। ঈশ্বর এক রূপক যা একই সাথে পূর্ণতা ও শূন্যতার, আছে ও নাই-এর রূপমঞ্জরিকে প্রতিভাস দান করে। আস্তিক যেমন সন্দেহমুক্ত থাকেন না, তেমনই নাস্তিকও সন্দেহযুক্ত থাকেন না। এই সন্দেহের অবকাশ মেলে মুহূর্তের টানে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অহিংসা উপন্যাসের আশ্রমের ভণ্ডসাধু সদানন্দ বিপদে পড়ে চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে ঈশ্বরের উদ্দেশে তাই বলে ওঠে: ‘হে ঈশ্বর দয়া কর। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাক, এ সময় আমায় দয়া কর। তুমি তো জান আমি স্বীকার করি না তুমি আছ, তবু যদি থাক, দয়া কর। তুমি তো সব জান-তুমি তো জান কি উদ্দেশ্যে আমি এখন মেনে নিচ্ছি যে তোমায় আমি স্বীকার করি না-তোমায় স্বীকার করি না মেনে নেওয়ার উদ্দেশ্যটা কেন মেনে নিচ্ছি তাও তো তুমি জান-’। আমরা দেখি বিশ্বাসের প্রতি সদানন্দের মুহূর্তের টান যা তার সন্দেহের তিলপরিমাণ ছিদ্র দিয়ে সজোরে বেরিয়ে আসে। তাই তো মুহূর্তের খেলা।

শেষের কবিতায়ও এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন কবিতা আবৃত্তি শেষ হতে-না-হতেই অমিত লাবণ্যর হাত চেপে ধরে, তখন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ল আর ঘড়ির দিকে চাইতেও ভুলে গেল লাবণ্য। এ মুহূর্তটি আসলে বিহ্বলিত একটি বিলোপনবিন্দু যখন আর-সব লুপ্ত হয়ে বাহ্য সময়কেও যেন থামিয়ে দেয়।

মানিকের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস চতুষ্কোণ-এ একটি অপত্যাশিত মুহূর্ত উন্মিলিত হয়;-যখন রাজকুমার, দেহের গঠনের সঙ্গে মেয়েদের মনের গঠনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধসূত্র আবিষ্কারের মোহতাড়নায় সরসীর নগ্নশরীর দেখার অভিলাষ ব্যক্ত করে এবং কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে সরসী-উন্মোচিত তার বিবসনা দেহটি অবলোকন করে। মুহূর্তটি ছিল চিত্রবৎ এবং এই ক্ষণদর্শনে তার মনে ‘নিরবসন্ন সক্রিয় শান্তির মতো এক অপূর্ব অনুভূতি’জাগ্রত হয়। এবং মুহূর্তদর্শনেই সে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখে, মুহূর্তটিই যেন তাকে প্রতীতি জোগায় তার সূত্রের নিশ্চয়তার জন্য, সূত্রটির ধ্যানের জন্যও নয়কি! শেষের কবিতায়ও এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন কবিতা আবৃত্তি শেষ হতে-না-হতেই অমিত লাবণ্যর হাত চেপে ধরে, তখন কথা বলা নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ল আর ঘড়ির দিকে চাইতেও ভুলে গেল লাবণ্য। এ মুহূর্তটি আসলে বিহ্বলিত একটি বিলোপনবিন্দু যখন আর-সব লুপ্ত হয়ে বাহ্য সময়কেও যেন থামিয়ে দেয়। সময় এখানে ক্ষণিকের জন্য যেন থেমে যায় ঠিক সরোদিয়ার শমে এসে পৌঁছনোর মুহূর্তটির মতো।

একবার জোড়াসাঁকোয় রাতের বেলায় কাঁকড়াবিছে কামরে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে, মাটিতে বিছানা পেতে তিনি শুয়েছিলেন সেই সুযোগ সদ্ব্যবহার করল পোকাটি। তীব্র ব্যথায় তিনি মুহ্যমান কিন্তু কারও ঘুমের ব্যাঘাত করতে চাইলেন না। যন্ত্রণার উতস শরীর কিন্তু তার অনুভব মন। অসহ্য ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে অবশেষে তিনি মনকে শরীর থেকে মুক্ত করে দিলেন, লাঘব হল যন্ত্রণার। মনকে শরীর থেকে মুক্ত করার ওই মুহূর্তটি আসলে কী? হয়তো তা ছিল অবস্তু আর বস্তুর আলাদা-হওয়ার ‘ব্রেকইভেন পয়েন্ট’-টি। ওই বিন্দুটিতে বস্তু আর ভাবের সকল সম্বন্ধ একাকার হয়েই পরক্ষণে একে অপরকে হারায়।

যেন কোনো লেনদেন আর রইল না।

লেখাটি শেয়ার করুন :

কুমার চক্রবর্তী

কুমার চক্রবর্তী। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। জন্ম ২ চৈত্র ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, কুমিল্লা। কাব্যগ্রন্থ : লগপুস্তকের পাতা [১৯৯৮], আয়না ও প্রতিবিম্ব [২০০৩], সমুদ্র, বিষণ্নতা ও অলীক বাতিঘর [২০০৭], পাখিদের নির্মিত সাঁকো [২০১০], হারানো ফোনোগ্রাফের গান [২০১২], তবে এসো, হে হাওয়া, হে হর্ষনাদ [২০১৪] ইত্যাদি। প্রবন্ধগ্রন্থ : ভাবনাবিন্দু [২০০২], ভাবনা ও নির্মিতি [২০০৪],  শূন্যপ্রতীক্ষার ওতপ্রোতে আমি আমি, আছে ইউলিসিস [২০০৯], মৃত্যুর সমান অভিজ্ঞতা [২০০৯], কবিতার অন্ধনন্দন [২০১০], আত্মধ্বনি [২০১৬], অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা [২০১৭, শয়নঘরের দর্শন [২০২৩]। অনুবাদগ্রন্থ : আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত : টোমাস ট্রান্সটোমারের কবিতা [২০১২], নির্বাচিত কবিতা : ইয়েহুদা আমিচাই [২০১৩], মেঘ বৃক্ষ আর নৈঃশব্দ্যের কবিতা : চেসোয়াভ মিউশ [২০১৪], বহু হও ব্রহ্মাণ্ডের মতো : ফের্নান্দো পেসোয়া ও তাঁর কবিতা [২০১৬]।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!