অধিবাস ও অভিনিবেশের সাঁকো
অনন্ত সময়ের বিমূর্ততা, ঘন অন্ধকার আর ভাসমান ধূলিকুয়াশাদূষণের স্বেদগুঁড়ো ছড়িয়ে পড়েছিল, বিশ্বব্যাপী। সেসবের তীব্র তির এজরা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট, মালার্মে, বোদলেয়রের দিগন্ত পেরিয়ে পৌঁছেছিল বাংলা কবিতার চৌকাঠে। অন্যদিকে ছিলেন প্রুস্ত, ফকনার, জয়েস, দস্তইয়েভস্কি, তলস্তয়, কাফকা, ক্যামু—যাঁরা পৌঁছুতে চাইছেন লেলিহান রক্ত আর নিশ্বাস বেয়ে। সেই ভাসমান আলো-অন্ধকারমথিত অক্ষরের রহস্য হাতড়ে বড় হওয়া কেউ কেউ। সবাই নয়। হয়ে উঠেছিলেন মাটির ভাস্কর্য। হয়েছিলেন নিসর্গ ও নারী, নিভৃতি ও নৈঃশব্দ্যময় অস্ফুট আত্মার অন্ধকার থেকে স্নিগ্ধ আলোর দিকে—উন্মুখ।
গ্রামীণ উঠোনের নিস্তব্ধতার ভেতর লেবুগাছের সবুজ ছায়ায় গার্হস্থ্যপ্রায় টুনটুনি-ফিঙের সুর আর আদর মেখে তিনি নীরবে; অনন্ত সুদূর পানে চোখের লন্ঠন জ্বেলে দেখে নিয়েছিলেন সরল, মধুর, অনাবিল শ্যামল রমণী। তাঁর খোলা জানালায় প্রাচ্যের আকাশ, মাটির স্বেদগন্ধ, নদীর সাদা রেখার চুম্বনচিহ্ন। তিনি ওমর আলী।
প্রথম বই এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি। ১৯৬০ সালে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কবিতার সৌরমণ্ডলে একজন কালপুরুষের পদচিহ্ন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল এদেশের আরো কয়েকটি জ্যোতিষ্কময় কাব্যগ্রন্থ—সৈয়দ আলী আহসানের অনেক আকাশ; শামসুর রাহমানের প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে; আল মাহমুদের লোক লোকান্তর। আর, জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর প্রকাশিত রূপসী বাংলা [১৯৫৭, কবি যেটির নাম রেখেছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’]। সময়ের ক্যাকটাস আর রক্তগুঁড়ো সরিয়ে আমরা ওমর আলীর শ্যামল মাটির সোঁদাগন্ধমাখা অক্ষরগুচ্ছ পড়ি। এবং তখন আমাদের স্মরণমালায় জেগে থাকে উল্লিখিত চারজনের কবিতাসমগ্র। প্রবল প্রভাব বিস্তারী জীবনানন্দ; তথাপি, এত স্বচ্ছ, এত নিমগ্ন এবং অনুচ্চ, ভুগর্ভলীন; একইসঙ্গে আমর্ম শিল্পের উৎকণ্ঠা ওমর আলী দীপিত করেছিলেন। এও আমাদের অপার বিস্ময়। কোথাও আলস্যমন্থরতা নেই; নিটোল, অঘ্রাণের ঝলমলে শিশিরে যেন সেই মেদুর রূপরেখা একটু একটু করে জাগিয়ে তুলছে সৌরভমথিত কবির মনোলোক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে জন্ম এবং দেশবিভাগ-পরবর্তী পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত, পদ্মাতীরবর্তী পাবনা জেলার চর কোমরপুরের গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ওমর আলী। এবং প্রায় সারা জীবনই তিনি ওই গেঁয়ো [তথাকথিত] প্রকৃতির মুখোশহীনতার মধ্যে বাস করেছেন। আর ওই দশকটি, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়েও এই দেশ নিষ্প্রদীপ সামরিক অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল।
তবে, কেবল নাম-কবিতার শব্দমেদুরতা এবং রহস্যের নীল গ্রন্থির ভেতর বোধ ও বোধি বন্দি হলে, সম্ভবত, ওমর আলীর চৈতন্য ও দৃষ্টিবিন্দু আবিষ্কার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে—এই আমাদের অভিমত। কেননা, যে পূর্ববাংলার নিসর্গবেষ্টিত প্রাণ ও জীবনপ্রবাহের ছবি তিনি এঁকেছেন, সেটি তাঁর সচেতন কবি-ব্যক্তিত্বের দার্শনিক অভিপ্রায়। মনে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে জন্ম এবং দেশবিভাগ-পরবর্তী পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত, পদ্মাতীরবর্তী পাবনা জেলার চর কোমরপুরের গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ওমর আলী। এবং প্রায় সারা জীবনই তিনি ওই গেঁয়ো [তথাকথিত] প্রকৃতির মুখোশহীনতার মধ্যে বাস করেছেন। আর ওই দশকটি, ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়েও এই দেশ নিষ্প্রদীপ সামরিক অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। ফলে ওমর আলী যৌবনের শুরুতেই জেনে গিয়েছিলেন, তাঁর নৈসর্গিক আলপথ পরিবৃত পূর্ববাংলা আসলেই ঔপনিবেশিকতামথিত প্রাচ্যবাদের ছায়াজালে ঢাকা। [আমরা দেখব পরবর্তীকালে, ১৯৭৮ সালে প্রকাশ হচ্ছে এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম। যে বইতে তিনি পশ্চিমের আধুনিকতাকে চ্যলেঞ্জ করেন, প্রাচ্য সম্পর্কে যাদের অভিমত—এখানকার মানুষেরা অবাস্তব, রোমান্টিক, অনান্দনিক, শিক্ষাবোধশূন্য, যান্ত্রিক, পশ্চাদপদ, হীনম্মন্য] ফলে জ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, আর্থরাজনৈতিকের সব শুভবোধ তখন থেকেই কেন্দ্রচ্যুত, বিপন্ন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী যেমন ঔপনিবেশিক বন্ধ্যাত্বের বিপরীতে শৈল্পিক প্রতিবাদ। একইভাবে এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছিও ব্যক্তির সামূহিক বিপন্নতা, বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে এক প্রশান্ত স্নিগ্ধ নিসর্গনিবিড় সংসারকাঠামোর মধ্য দিয়ে কবির অন্তর্গত স্বস্থ ও তীব্র উপস্থিতি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এটি মূলত তাঁর সমকালীন অন্ধকারময় স্থবিরতা অস্বীকারেরই অভিজ্ঞান। তাই এই বইয়ে, দ্বিতীয় কবিতায়, ‘আর এক রাত্রিতে’, পেয়ে যাই তাঁর সরল অথচ প্রবল মেরুদণ্ডি, আমর্মবিদ্ধ শব্দাবলি:
আমার চোখের দ্যুতি নিভে যাবে, প্রত্যহ যদিও
সকালে সূর্যরশ্মি দেখা যাবে প্রাচ্যের আকাশে।
[আর এক রাত্রিতে]
ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু নৈসর্গিক-প্রাচ্য অমলিন স্বাতন্ত্র্যের ঊর্ধ্বলোকে, চিরকালীন। সে-কারণেই কি ‘ঘরের লোকের মন্দ আশংকায়’ যে শ্যামল রং রমণী বড় করুণ, যন্ত্রণাবিদ্ধ, বিষাদময়; তার সংসারের চারপাশে অনন্ত এক প্রহরী ‘কর্মঠ পুরুষ’? গ্রন্থনাম, প্রথম কবিতার শিরোনাম এবং সূচনাপঙ্ক্তিতে একই বাক্যের দ্যোতনা। এই যে পুনঃপুন উচ্চারণ—তা তো আকস্মিক নয়, উণ্মীলীয়মান চৈতন্যের অভিপ্রায়টিই কি সুনিশ্চিত ও নির্দিষ্টতা দেওয়ার সচেতন আগ্রহ?
আমাদের মনে সংশয়ের অবকাশ কিছুটা ফিকে হয় বৈকি! বরং বলা যায়, এ তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা—কোমলে কঠোরে মেশানো, যেমন ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই’ তিনি দেখেন অসম্ভব ঋজুতায়। তাঁর এই দেখার দৃষ্টি সম্পূর্ণই আলাদা, সারল্যমাখা। কিন্তু তা যেমন শিল্পকলার বিচারে আধুনিক, অন্যদিকে প্রায় প্রভাবশূন্য এবং সংহত মাধুর্যে অকুণ্ঠিত। সেটি সম্ভব হয়েছিল এজন্য যে, তাঁর জীবন-সংস্কৃতি ও চিন্তার সংযোগ সাঁকোটির অন্তর্গত শূন্যতা তিনি কপটতা দিয়ে পূরণ করেননি। গ্রামীণ জীবনাচার ও নিসর্গমগ্নতা তাঁর কবিতার স্নায়ু ও মজ্জার ভেতর যে বয়ে চলে, তারই সমান্তরালে চলেছিল কবির ব্যক্তিগত জীবনচর্যা। চাইলেই, হয়তো, সম্ভব ছিল বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ভাবাবেগনিমগ্ন শিক্ষার্থীটির পক্ষে আলোকোজ্জ্বল নাগরিক পরিমণ্ডলে কাটিয়ে দেবার সুযোগ। তা ওমর আলী করেননি। হয়তো সেই চেষ্টাই ছিল না তাঁর। কোনো এক অকথিত গোপন জাড্যতা তাড়িত করেছিল তাঁকে। ফলে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সাহিত্যে আমাদের স্বীকৃত অভিভাবক আহসান হাবীবের নিগুঢ় সান্নিধ্য পেলেও অচিরেই তাঁকে সেই আশ্রয় থেকে চ্যুত হতে হয়েছিল। এ কি কেবলই কোনো অজানা দূরভিসন্ধির বিড়ম্বনা, না কি ‘লোকটা সুতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’—এই সোঁদাগন্ধ, স্বেদচিহ্ন অগ্নিচুম্বনের মতো তাঁর সত্তা ও অস্তিত্বে মিশে ছিল বলেই স্বেচ্ছায় তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন?
অন্তর্গত কারণ যেটিই হোক, তিনি অধ্যাপনা করেছেন মফস্বলে—বগুড়ার নন্দীগ্রাম কলেজ, ভেড়ামারা কলেজ এবং শেষে পাবনা শহরের বুলবুল কলেজে। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। তার আগে ঢাকায় দৈনিক ইত্তেহাদ, সংবাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন। পেশা বদলে চলে গেছেন গ্রামে। আবার ফিরে এসেছেন, মিউনিসিপ্যালিটির চাকরি নিয়ে। ভালো লাগেনি। প্রত্যাবর্তন করেছেন গ্রামে। স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এই অস্থিরতা কি অনিশ্চয়তা? না কি নিছক খেয়ালী মনোজগতের বিলাস? অবসর পর্যন্ত বুলবুল কলেজেই ছিলেন। শ্রেণিকক্ষে ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। আর কলেজের নিকটে একটি ছোট্ট ভাড়াটে ঘরে দুপুরে বিশ্রাম, খাওয়া, টিউশনি এবং ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কদাচিৎ আড্ডা। লিখতেনও এখানে বসে। তারপর ফিরে যেতেন শহর থেকে দূরে, রাতের নিস্তব্ধতার ভেতর আঁধারমথিত বাড়িতে। নড়বড়ে কাঠের দরজা, একখানি চৌকি, চেয়ার-টেবিল, ভাঙা বেঞ্চ আর চারদিকে ছড়ানো রাশি রাশি বই। চুম্বনচিহ্নিত অধিকাংশ বই বাঁশের মাচার উপর এবং পাটের বস্তায় বন্দি করে চাতালের অন্ধকারে পাঠানো।
বিলম্বিত পঞ্চাশে কোথায় ছিলেন ওমর আলী? যৌবনের শিশিরস্তোত্রে কাতর দিনগুলো! যখন কেঁপে উঠেছিল তাঁর কোমল মোচের কুয়াশাময় রেখা, এক শ্যামল রং রমণীর রূপে-রূপকে! পত্রিকায় কাজের সূত্রে সান্নিধ্য পেয়েছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, হাসান হাফিজুর রহমান, সানাউল্লাহ নূরী, সৈয়দ নুরুদ্দীন, রনেশ দাশগুপ্তর মতো ব্যক্তিত্বের। কোথাও তাঁর অধিবাস আর অভিনিবেসের সাঁকো গড়ে ওঠেনি কি?
জসীম উদ্দীনেও আমরা পাই রূপজ মোহ ও স্নিগ্ধ তাপের আলোকমালা—রূপাই-সাজু এবং এমন আরো আখ্যানিক নর-নারী। তারা গ্রামীণ জীবন ও রূপের পসরা সাজিয়ে উপস্থিত হয়েছিল ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার মহাসড়কে। সেসব কাহিনির সূত্রমুখ পুথি ও লোকসাহিত্যের দিকে ছিল ফেরানো। কেননা, জসীম উদ্দীন নিজেও ছিলেন বাংলা অঞ্চলের লোকসাহিত্য সংগ্রাহকের দায়িত্বে, দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্ববধানে। ফলে গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতিঘেঁষা আখ্যানগুলোই তাঁর স্বভাবগত পদ্য-রচনার শিল্পগুণে রূপায়ণ করেন। অবশ্য, তাঁর সম্পর্কে এ আলোচনা এতটুকুই এখানে প্রাসঙ্গিক, এই কারণে যে, ওমর আলীর কোনো কোনো কবিতার, বিশেষত এদেশে শ্যামল রঙ রমণী সুনাম শুনেছির, পটভূমি ও প্রেক্ষাপট একই হলেও তাঁর দৃষ্টি ও দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণই আলাদা—এই কথাগুলোর নেপথ্য যৌক্তিকতার প্রয়োজনে। অন্যদিকে, ওমর আলী হাঁটেননি, সমকালীন অনেকের মতো, সাত সাগরের ওপারের মিথমথিত কোনো আলপথে।
পূর্ববর্তী কবিদের পঙ্ক্তি অথবা কবিতার ক্ষুদ্রাংশ উদ্ধৃতি প্রথাগতের বাইরে নিয়ে কীভাবে তা নতুন নির্মাণ হয়ে উঠতে পারে, এলিয়ট সেটি আমাদের দেখিয়েছেন। একইভাবে ওমর আলীর অভিনিবেশিত সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের রোমাঞ্চিত হতে হয় যে, তিনি এমন পরাগায়নে হয়ে উঠতে পেরেছেন কতটা স্বতন্ত্র ও স্তোত্রময়।
বরং প্রগাঢ় ও দৃশ্যমান এই যে, এদেশে শ্যামল রঙ রমণী সুনাম শুনেছির যে নারী-নিসর্গের ভাব-ব্যঞ্জনা তারই স্বতন্ত্র এক কাব্যিক রূপ আমরা পেলাম সৈয়দ আলী আহসানের কবিতায়। ‘আমার পূর্ব বাংলা’ তিন পর্বের অসামান্য এই কবিতা তাঁর একক সন্ধ্যায় বসন্ত কাব্যে রয়েছে, এটি প্রকাশ হয় ১৯৬২ সালে, সামরিক সরকারের নিষেধের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হয়ে গেছে, তার এক বছর পর। আর সোনালি কাবিন প্রকাশ হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে, দেশ বিভাগোত্তর গ্রামীণ বাংলার রূপ, নিসর্গ, নারী ইত্যাদি অনুষঙ্গবাহী কবিতাবলির চর্চায়—জীবনানন্দের অসম্ভব উদ্ভাস স্মরণে রেখেও—ওমর আলী যেন সেই পথের শুরুতে বিস্ময়বিদীর্ণ নিরঞ্জন বালকের মতো দাঁড়িয়ে—একাকী, নিঃসঙ্গতম।
প্রসঙ্গত, জীবনানন্দ দাশ দীর্ঘকাল ছিলেন কলকাতায়, মৃত্যু-অবধি। স্মৃতিচিহ্নবাহী মনের অন্তর্কোণে জাগিয়ে রেখেছিলেন বরিশাল, ধানসিড়ির প্রকৃতিপ্রতিমা। তাঁর কথাসাহিত্যের নিস্তব্ধ পরিসরে বারবার উৎকীর্ণ হয়েছে প্রত্যাবর্তনের সেই অশ্রুদীর্ণ ব্যাকুলতা। নগরের জটিল দূষণ স্নায়ুশিরার ভেতর বহন করেই তিনি লিখে চলেছিলেন, তীব্রতর গোপন অভীপ্সায়, বাংলার ত্রস্ত নীলিমার কবিতাগুচ্ছ। অভিজ্ঞতার চাইতে তিনি স্পর্শিত ছিলেন ‘কল্পনামনীষা’র স্বাদসৌগন্ধে, ইতিহাসচেতনা ও পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞানের সারবত্তায়।
ওমর আলীও কি তেমনই! কখনো বাস্তব অধিবাস, কখনো দূর কল্পচেতনার অভিনিবেশিত সাঁকো! ফলে তিনি যখন লেখেন ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই’; অথবা রচনা করেন ‘নীল গ্রাম’ কবিতার ‘দূর’ ধ্বনির বহুবাচনিকতা তখন অধিবাস এবং অভিনিবেশের দূরত্ব মুছে যায়; জ্বলে ওঠে শিল্পের স্বরচিত জাদুলন্ঠন। তারই মৃদু, স্নিগ্ধ, মন্থর আলোয় ওমর আলীর কোনো কোনো কবিতার কয়েকটি লাইন পড়া যাক:
১
ওইখানে চলো শুয়ে থাকি সারাদিন, সারারাত
যেখানে সুন্দর নদী। শিয়াল কাঁটার ঘনবন।
বকুলের পাতাঝরা মাঠ। কিংবা হাওয়ার আঘাত
তৃণশীর্ষে। ঝুমকোলতার বুকে আনে শিহরণ।
ওইখানে চলো শুয়ে থাকি সারারাত, সারাদিন।
[গ্রামে]
২
নীল গ্রাম কতদূরে বহুদূর দিগন্ত রেখায়।
সে-গ্রামে পুরুষ আর তার নারী সংসার সাজায়।
[নীল গ্রাম]
৩
ছাদ থেকে জল পড়ে। চারদিকে ছড়ায় গুঁড়ো হয়ে।
রূপালী জলের ঝর্ণা। ভেজায় উঠোন,
ফুলের টবের পাশে, জলময় বুদ্বুদের হালকা কাঁপন
ফেটে যায় হৃৎপিণ্ড সিঁড়ি ছুঁয়ে।
বারান্দায় মেঝে ভেজে জলে,
শুকনো মাটির টুকরো গলে।
ঘরে আমি একা। খড়খড়িতে এক চড়ুই আশ্রিত সভয়ে
তাকায় আমার দিকে। আমি শুয়ে আছি চুপচাপ।
[বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই]
যেন, ওমর আলীর কবিতার ডিকশনে, শব্দের চোরাস্রোতে, মুছে যাওয়া মানবসম্পর্কের উৎপ্রেক্ষায় খেলা করে জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু সেসব চিহ্ন অনেকটাই দূরবর্তী। বিপুল প্রকৃতির বিবিধ অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়—ঘাস, শস্যক্ষেত, নদী, ঝরাপাতা, সবুজ পাতা, নীল রাত্রি, ভীরু অন্ধকার, চড়ুই, আম-কাঁঠালের ছায়াময় বাগান, স্থলপদ্ম, বুনো ঝাউ, বকুল, ঝুমকোলতা, পলাশ, নিম, হিজল, চিল—এমন আরও বিচিত্র নৈসর্গিক উপস্থিতি। আর নারীদের সমাবেশ। জীবনানন্দ দাশের যেমন বনলতা সেন, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা বিশেষ হয়েও নির্বিশেষ; ওমর আলীর নারীরা শ্যামল রং রমণী অথবা হাসিনা, শিরীণ, নীলুফার কিংবা কেবলই নামপরিচয়শূন্য—তারা এদেশের মাটি আর নিসর্গের নিস্তব্ধতা হৃদয়ে নিয়ে উজ্জ্বল রূপক। নারীকে তিনি রূপায়ণ করেন নিসর্গের রং ও রেখায়।
চৈতন্যের যন্ত্রণা আর উৎকণ্ঠার আবিলতা ওমর আলী রূপময় করেছেন নিজস্ব নৈর্ব্যক্তিকতায়, পূর্ব বাংলার নৈসর্গিক সূক্ষ্মতার ছন্দে। জীবনানন্দ দাশ যেমন চিত্রকল্পময়, রহস্যমেদুর; ওমর আলী সেখানে অনেকাংশে চিত্রময় এবং স্পষ্ট। উন্মুক্ত। এমনকি উপমার অজস্রতাও এড়িয়ে গেছেন, বরং বিশেষণের প্রতিই তাঁর ঝোঁক বেশি।
ওমর আলী যখন লেখেন ‘কতোদূর হেঁটে তার পথ শেষ হয়ে এসেছিলো’; তখন ‘বনলতা সেন’ কবিতার হাজার বছরের অতিশয়োক্তি মনে পড়ে। কিন্তু ওমর আলী ইতিহাসের ধ্রুপদি সভ্যতার স্রোতে পরিভ্রমণ করে ক্লান্ত হননি, শুশ্রুষা প্রত্যাশা করেননি; তিনি পরের পঙ্ক্তিতে পূর্বসূরীকে এড়িয়ে উপনীত হন স্মৃতির অন্তর্লীন অনুভবে:
কতোদূর হেঁটে তার পথ শেষ হয়ে এসেছিলো,
হয়নি আমার জানা, আমি শুধু দেখেছি, সে একা
হেঁটে গিয়েছিলো কবে গ্রামের বকুলতলা দিয়ে,
এই ছবি দেয়ালের স্থির ছবি, এই চির দেখা।
[ছবি]
অথবা এমন আরও পঙ্ক্তির দেখা মেলে, যেগুলো আমাদের স্মরণের দরজা খুলে জীবনানন্দের কবিতায় কাছে নীত করে। যেমন: ‘দূরের আকাশে/কয়েকটি কালো রেখার মতো চিল ওড়ে। নূপুরের/অস্পষ্ট আওয়াজ যেন বাতাসে গাছের চারিদিকে’ [চলার পথে]—জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতার পঙ্ক্তি মিলিয়ে পড়ি : ‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে।’—তার কান্নার সুরে কবির স্মৃতিপটে বিম্বিত হয় ম্লান চোখের অনামা এক নারী। ওমর আলী দূরে চলে যাবার আগে শেষবারের মতো যাকে দেখে যেতে চান সে ‘নতমুখ সুশ্রী মেয়ে।’ কিংবা জীবনানন্দের ‘শ্যামলী’ এবং ওমর আলীর ‘হাসিনা’ কবিতার অংশবিশেষ পড়ি :
শ্যামলী
শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;
যখন জাহাজে চ’ড়ে যুবকের দল
সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে ব’লে
মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল
টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে
সকালের রূঢ় রৌদ্রে ডুবে যেতো কোথায় অকূলে।
হাসিনা
হাসিনা তোমার মুখ কাঁঠালি-চাঁপার স্নিগ্ধতায়,
উজ্জ্বল সুন্দর। তুমি পূর্ব বাংলার সুশ্রী মেয়ে।
তোমার পায়ের চিহ্ন যে ধূলির শান্ত আঙিনায়
পড়ে, তা স্বর্ণ। সবি জীবন্ত, তোমার স্পর্শ পেয়ে।
… যে নদীটি বহমানতায়,
সে তো আমাদের নদী। আমাদের রৌদ্র, অন্ধকার।
হাসিনা তুমি ও আমি কিছুদিন এই পৃথিবীতে
বেঁচে রবো। উজ্জ্বল বসন্তে আর অনুজ্জ্বল শীতে।
এমন সাদৃশ্য হঠাৎ দৃশ্যায়িত হয় বটে, কিন্তু অভাবিত যে, ওমর আলী জীবনানন্দ থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর কবিতার নতুন ও সৃষ্টিশীল পরাগায়ন ঘটিয়েছেন। এই সৃজনক্রিয়ায় টি এস এলিয়ট তুলনাহীন। পূর্ববর্তী কবিদের পঙ্ক্তি অথবা কবিতার ক্ষুদ্রাংশ উদ্ধৃতি প্রথাগতের বাইরে নিয়ে কীভাবে তা নতুন নির্মাণ হয়ে উঠতে পারে, এলিয়ট সেটি আমাদের দেখিয়েছেন। একইভাবে ওমর আলীর অভিনিবেশিত সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের রোমাঞ্চিত হতে হয় যে, তিনি এমন পরাগায়নে হয়ে উঠতে পেরেছেন কতটা স্বতন্ত্র ও স্তোত্রময়।
তাঁর আরও কয়েকটি শিশিরার্দ্র কবিতার অংশ পড়ি:
১
এক ঝাঁক চড়ুইয়ের কণ্ঠে মুগ্ধ, ওদের দেহের হাওয়া শুঁকে;
রাত হলে কিছুক্ষণ অতল আঁধারে ডুবে খেলা করি
স্তন নিয়ে আযৌবনা সুন্দরীর বুকে।
[যৌবনে প্রার্থনা এই]
২
কয়েকটি শাদা তারা শেষরাত্রে দূরের আকাশে
স্নিগ্ধ দীপ জ্বেলে রাখে। প্রবাহিত বিষণ্ন বাতাস
গাছেদের মধ্যে, যেন কাহাদের ক্লিষ্ট দীর্ঘশ্বাসে।
জ্যোৎস্নালোকে কি সুন্দর পৃথিবীর মাঠ, নদী, ঘাস।
শিরীণ, তোমার মুখ মনে আসে: কতো যে মধুর
আমাকে শোনাতে পারো শুধু তুমি আনন্দের সুর।
[শিরীণের প্রতি ফরহাদ]
৩
দূরের আকাশে কোনো নক্ষত্রের অলৌকিক দেশ
অলৌকিক সোনালী-রূপালী আর হীরের ফুলের
মুক্তোর ফলের দেশ মিথ্যে হয়, মর্তের মাটির
মানুষের ঘর স্বর্গ হয় তার সুরভি চুলের;
পরীর সুরভি চুল ভেঙে পড়ে মানুষের হাতে,
পরীও সান্নিধ্যে আসে, সে পরী রাত্রির মতো নীল,
এদেশে গৃহিণীর মতো তাকে বুকে রাখা যায়—
বাঙালি বধূর মতো সরল, মধুর অনাবিল।
[পরীও সান্নিধ্যে আসে]
কোনো গিমিক নয়, চৈতন্যের যন্ত্রণা আর উৎকণ্ঠার আবিলতা ওমর আলী রূপময় করেছেন নিজস্ব নৈর্ব্যক্তিকতায়, পূর্ব বাংলার নৈসর্গিক সূক্ষ্মতার ছন্দে। জীবনানন্দ দাশ যেমন চিত্রকল্পময়, রহস্যমেদুর; ওমর আলী সেখানে অনেকাংশে চিত্রময় এবং স্পষ্ট। উন্মুক্ত। এমনকি উপমার অজস্রতাও এড়িয়ে গেছেন, বরং বিশেষণের প্রতিই তাঁর ঝোঁক বেশি। কালের শোকার্ত মৃত্যুবিষাদচিহ্ন নয়, ভারী ধাতবের বিদীর্ণ ধ্বনিপুঞ্জও নয়; শান্ত, স্নিগ্ধ এবং ঘনায়মান মন্থর সন্ধ্যার মতো মাধুর্য নিয়ে তিনি উপস্থিত—প্রবল আত্মবিশ্বাসী, অথচ স্নায়ুশিরার ভেতর গোপন অশ্রুমথিত এক উণ্মীলীয়মান সত্তার স্বরলিপি। দৃশ্যের পর দৃশ্যে, রক্ত-স্বেদে আবহমান স্বরদ্বীপসংগীতের সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে, একাকী, নিঃসঙ্গপ্রতিম।

আবু হেনা মোস্তফা এনাম।
কথাসাহিত্যিক। ২৪ ডিসেম্বর, মেহেরপুরে জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে লেখাপড়া করেছেন।
গল্পগ্রন্থ : ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রাণালী; নির্জন প্রতিধ্বনিগণ; প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প; জোনাকিবাবুই।
উপন্যাস : ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো।