গাজা ও অন্যান্য কবিতা
গজ কাপড়ের আবরণ
গাজা তুমি জেগে থাকো সহস্র রাত
আকাশে তারার ফুল
তোমার আসমানের নিচে
ঘুমিয়ে আছে শত শত নিষ্পাপ শিশু
স্টেনগান হাতে তরুণী , টগবগে তুর্কি তরুণ
হাসপাতালের নার্স, নির্মাণ শ্রমিক, ফল বাগানের কর্মী
তারা সবাই বাঁচতে চেয়েছিল
গাজার পাথুরে ভূমিতে
বেঁধেছিল স্বপ্নের খেলাঘর
পৃথিবীর দুষ্ট চক্র, রাষ্ট্র জন্য
ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়েছে সুখের বাসর
একটা গজ কাপড়ের আবরণে ঢেকে আছে
পাথরের শহর
তাদের ক্ষত শুধু বেড়ে চলেছে
আর আরব সাগর বয়ে যাচ্ছে নীরবে
বুজুকের করুণ সুর নারীর চোখে
গাজা তুমি জেগে থাকো
তোমার চোখে দশ-দিগন্তের হাতছানি
তোমার শরীরে স্বাধীনতার উল্কি আঁকা
গাজার তরুণী
না আমার কোনো পরিচয় নেই
সহস্র বছর ধরে তৈরি
করছি ক্ষত সারানোর ঔষুধ
প্যালেস্টাইনের মাটিতে মায়ের কবর
জেরুজালেমে দাদার বসতি
ঘোড়ার খুরের ধ্বনি শুনলে টের পাই শীতের আগমনী
পথের পাশে পড়ে থাকা বেগুনি ফাকুয়া ইরিস ফুল
পুড়ে ছারখার
পরিচয় পত্র পুড়ে গেছে বহুকাল
পৃথিবীর বুকে আমি এক নাম-গোত্রহীন নারী
চোখের মনিতে যুদ্ধের স্বপ্ন
আমার লাশ বহন করছি নিজেই
কবরে বুনে দিও
কয়েকটি সবুজ জলপাই বীজ
বৃষ্টির দিনে
বৃষ্টির দিনে তোমার মন খারাপ হয়
বেশ একটা ক্লান্তি এসে ভর করে মনে
আগে বৃষ্টির দিনে তুমি রোমান্টিক হয়ে উঠতে
একটা গোলাপি স্কার্ট পরে
রাস্তার মাঝ বরাবর ভিজতে ভিজতে প্রেমিকের ঘর
সেখানে কম্বল মুড়ো হয়ে সারাটা দুপুর
পথ-ঘাট জলে ডুবুডুবু
তার মধ্যে রিক্সা ভ্রমণ
রিক্সার হুট্ খোলাই থাকে
চন্দ্রিমায় মুষল বৃষ্টি
এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না
গাছেরা সব ভিজে সপসপ
কাউকে আলাদা করে চেনা যায় না
বৃষ্টিতে বুড়িগঙ্গায় ভেসে চলা
ঘরে বাজছে
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
উনুনে খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা
এই সব রোমান্টিকতা এখনো আছে
সারাদিন ছাদের বৃষ্টিতে
বিলে-ঝিলে মাছ ধরার উৎসব চলে-
এখনো তেমন বৃষ্টি হয়
রাস্তার ওপারের মাঠ জলে থৈ থৈ
তুমি বিছানায় অর্ধ -শায়িত
হাতে মিশেল ফুকো অথবা সামির আমিন
দুনিয়াটাকে আজ তুমি ক্রিটিক্যালি দেখতে শিখেছ
জল থেকে কীভাবে মাটিকে আলাদা করা যায়
কীভাবে বাঁধ দিয়ে জল বন্ধ করে দেয়া যায়
এসব তুমি ভালোই জানো
কখনো কখনো তোমার চোখও জলে ভিজে ওঠে
কমলালেবুর চাষবাস
সারা রাত জ্বরের প্রকোপ
ঘুম থেকে জাগতেই
একরাশ বাতাবিলেবু টেবিলে এলোমেলো
সমস্ত বিছানা জুড়ে বালিশ-কাঁথার সম্ভার
এ হেন বর্ষাকালে কে তুমি এলে ঢাক বাজিয়ে?
নয় কোনো শিশিরের শব্দ
আশ্বিনের দেবীমুখ-
দুচোখে কাজল পরে
চেয়ারে হেলান দিয়ে কি ভাবছ সন্ধ্যায়?
এইভাবে কেটে যাচ্ছে
দিন ও রাত্রি
শত শত মলাটের ভাজে লেখা হচ্ছে অগ্নিদহন
আজকাল বিছানায় কমলা লেবুর চাষবাস হচ্ছে
পাহাড়ে জ্বলছে আগুন
আয়নায় দেখা চোখ
আয়নায় দেখা চোখ
বলে যায় বিগত দিনের কথা
গোলাপি ফ্রকে দৌড়ে যাওয়া সরু রাস্তা ধরে
তখন সাপের মতো ছিপছিপে পথকে
বিরাট দুনিয়া মনে হতো
দুহাতে কাশফুল জড়িয়ে
অনন্ত আকাশে ভেসে চলা
আড়িয়াল খাঁর পশ্চিম তীরে
ধু ধু একটা পথ
তুমি একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো
আটকে ছিলে নক্ষত্র হয়ে
আয়নায় সেই চোখ দুর্বিনীত চেয়ে থাকে
খুঁজে ফেরে হারানো দোকান এল দেরাদো
পৌষের রাতে কুয়াশায় ঢাকা সকাল
আস্ত একটা দুনিয়াকে খুলে দেয় চোখের সামনে
বায়োস্কোপে দেখা যায়
আবাবিল পাখি, কারবালার রক্তাক্ত ময়দান
হায় হাসান! হায় হোসেন!
রব তুলে বুকে ছুরি নিয়ে মহররমের দল
এই চোখ খুঁজে নেয় লক্ষ্মীর পেঁচা
দুর্গার ধারালো অস্ত্র
কেটে চলে শত শত কচি ঘাস
রোবটের দুনিয়া
তুমি চেয়ে দেখো আয়নায় সেই চোখ
আজ আর চেনা যায় না
ফোলা ফোলা, ভেজা চোখ
শূন্যদৃষ্টি
যেন শাপগ্রস্ত মনসা
এই চোখ তুমি আর চেনো না
টুপটাপ ঝরে পরে শীতের রাতে
আয়নার পারদ গলে ঢাকা পড়ে গেছে বিস্তৃত জীবন
কিরিচের মতো তবু সেই চোখ ঝলসে ওঠে অমাবশ্যার রাতে

নভেরা হোসেন, জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব হতেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: হারানো দোকান এল দরাদো (২০০৯), একজন আঙুল শুধু হেঁটে বেড়ায় (২০১০) আর কারনেশন ফুটলো থরে থরে (২০১৩), একটু একটু করে বোবা হয়ে যাচ্ছ তুমি (২০১৫), বারুদ লোবানের গন্ধ (২০১৭), জলে ডোবা চাঁদ (২০২০)। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : পেন্ডুলাম ও শিশুর দোলনা (২০১১), জৌলুসী বেওয়া (২০১৬) উপন্যাস: অন্তর্গত করবী (২০২১), কেউ জানতে চায় নি (২০২২ )। এছাড়া পিয়াস মজিদের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর (২০১০)। তিনি কিছুদিন নৃবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ইমেল: noverahossain@gmail.com