গল্প

প্রত্যাবৃত্ত

গত সাতবছর ধরে কানা সোলায়মানের চোখটা যে পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে গেছে আজকাল তার সে-কথা মনেও থাকে না। মাঝে মাঝে অন্যের মুখে সে যখন তার পরিবর্তিত নামটিকে ডাকতে শোনে, ‘কানা সোলায়মান’ তখন হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও মনে পড়ে, তার দুটো চোখই একসময় ভালো ছিল। দুটো চোখ দিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে পেত। তখন তার নামের সঙ্গে ‘কানা’ শব্দটির যোগ ছিল না। যে আচানক কারণে তার দুই চোখের একটি নাই হয়ে গেছে, সেসব নিয়ে মোটেই ভাবিত নয় আজকের সোলায়মান। কিন্তু ওর সামনেই যখন চোখ হারানোর গল্পটা চেনা-জানা লোকেরা বিকৃতভাবে বলতে থাকে, বলতেই থাকে, তখন সোলায়মান নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে এক দলা থুথু ফেলে। তারপর সেই থুথুটাকে পা দিয়ে কিছুক্ষণ ঘষে ঘষে ভিতরে ভিতরে গুমরায়। তার ইচ্ছে করে এই গুমরানোর নিশ্চুপ শব্দগুলো চোখ বুজেই পলকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় খুব তীব্রভাবে—যেন বিদ্যুতের শকের মতো, চারপাশের মানুষদের বকবকানির ভিতর। এসব পুঁজের মতো কথা তার চারপাশের মানুষেরা তাকে এক ঝলক দেখার পর, তার সামনে অবলীলায় বলতেই থাকে। চারপাশে যেন তাদের জ্বালা ধরানো খিকখিক হাসি! যেন হাসিগুলো ক্রমেই রূপান্তরিত হয়ে যায় অজস্র নখে, আর তাকে খামচাতে থাকে অনবরত।

তার শৈশবের সময়কার মানুষেরা এত অসভ্য ছিল না। অন্যের দুঃখ-কষ্টে, সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু আজকের চারপাশের মানুষেরা! অন্যকে নানাভাবে আঘাত করে, ব্যথায়, অপমানে একেবারে নিঃস্ব করে দিতে চায়। সোলায়মান ভাবে, ‘দুনিয়া এত তাড়াতাড়ি বদলাইয়া গ্যালো কেমনে! কোনো হদিস পাই না।’

প্রথম প্রথম সে পরম ধৈর্যের সঙ্গে এসব জ্বালাময় কথাবার্তা সহ্য করে নিত। তারপর সে ব্যথায় আর অপমানে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। এখন তার প্রচণ্ড ক্রোধ হয়। শুধুই ক্রোধ। ইচ্ছে করে ঘুষি দিয়ে সবকটা মানুষের মাথা উড়িয়ে দেয়। সাত বছর আগে হলে সে তাই করত। কিন্তু এখন সে অনেকটাই সংযত। তবু সংযত হলেও মাঝে মাঝে ক্রোধ তাকে নিস্কৃতি দেয় না। জগতের উপর এক প্রচণ্ড ক্রোধ তিন মাথা রাক্ষসের মতো তাকেই গিলে খেতে আসে। সোলায়মান পালাতে চায়—নিজেকে ছেড়ে, মরিয়া হয়ে ক্রোধ নিবারনের উপায় খোঁজে। তবে তার হাতের কাছে উপায় সবসময় থাকে না। তবে, ইদানীংকালে সে একটা উপায় বের করেছে—ভেবে ভেবে। যখনিই এই জাতীয় কথার সুর তার কানে আসে, সে জায়গাটি ছেড়ে একটু দূরে সরকারি ভূমি অফিসের কাছের পুকুরটির পাড়ে চলে যায়। জলের ভিতর নিজের মুখটি দেখে নিজের মনকে শান্ত করার প্রয়াস চালায়। জলের ভিতর দিয়ে সে দেখে অন্য এক সোলায়মানের মুখ! না কী সোলায়মানের কঙ্কাল!

মাস্টার রোলের এই চাকরি কোনদিন স্থায়ী হবে কিনা, সোলায়মান জানে না। তবে আশা রাখে, কোনোদিন হয়তো সুদিন আসবে। এই অফিসে ঘুষের টাকার দারুণ তেলেসমাতি চলে। সোলায়মানও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো বাড়তি কয়েকটা টাকা পেয়েও যায়।

ছোটবেলায় তার মাছধরার নেশা ছিল খুব। পড়াশোনায় মগজের শক্তিটা ভালো থাকলেও সে তার পুরো সময়টাই খরচ করে ফেলত মাছ ধরার পিছনে। একমনে নিবিড়ভাবে অপেক্ষা করত জলের উপরে মাছেদের তৈরি করা বুদবুদ দেখার জন্য। আর একটা বড়—সর মাছকে বড়শিতে আটকে ফেলতে পারার পর সীমাহীন আনন্দে সে পুকুরের জলে সাঁতার দিত।

স্কুলের শিক্ষকরা চেষ্টা করেছিল তাকে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে। একটু মনোযোগ দিলেই তার ভালো ফল করার দারুণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কে তাকে বোঝাবে! নিজেকে নিয়ে চির অশান্তিময় ভবিষ্যৎই যে তার গন্তব্য!

সোলায়মান অবশেষে মফম্বল শহরের সরকারি ভূমি অফিসের পিওন। মাস্টার রোলের এই চাকরি কোনদিন স্থায়ী হবে কিনা, সোলায়মান জানে না। তবে আশা রাখে, কোনোদিন হয়তো সুদিন আসবে। এই অফিসে ঘুষের টাকার দারুণ তেলেসমাতি চলে। সোলায়মানও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় কখনো কখনো বাড়তি কয়েকটা টাকা পেয়েও যায়। বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাবের সংসারে হঠাৎ বাড়তি টাকা পাওয়ার সুখটাতে, তার তেমন কিছু না যায় আসলেও তার পরিবারের মানুষগুলো ভালো থাকে। সংসারে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা কেউ কোনোদিন কোনো কথা না বললেও তার একমাত্র নানী (যে বছরের বেশিরভাগ সময় তার সংসারেই থাকে), সেই মাঝে মাঝে গলা কাঁপাতে কাঁপাতে বলে—আইজ এত বাজার করলি—ট্যাহা পাইলি কই! হালাল ট্যাহাতো!

সোলায়মান স্বভাবত মিথ্যা কথা বলতে পারে না। নানীই তাকে বড় করেছে পেলে-পুষে। নানীর সঙ্গে তো কস্মিনকালেও মিথ্যা বলেনি! সে গলা খাকারী দিয়ে বলে—এসব কথা জিগ্যাইতাছো কেন! তোমার সমস্যা থাকলে খাওন নিয়া পুষ্কুনিতে ফালাও। কাম নাই, খালি প্যাঁচাল পারে! নানী সব বোঝে। সোলায়মানের যন্ত্রণা দেখে তার খুব কষ্ট হয়, তাই একটু চুপ করে থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। সোলায়মান আবার কতগুলো থুথু ফেলে মাটির দিকে চেয়ে থেকে। যেন প্রতিটি যন্ত্রণার একই উত্তর—‘থুথু ফেলা’।

তিন বছর বয়সে সোলায়মানের বাবা-মা দুজনেই ট্রেন একসিডেন্টে একসঙ্গে কাটা গেলে সোলায়মান অদৃষ্টের বিস্ময় হয়ে বেঁচে থাকে। তাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের পর, সেই থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ হয়। মামারা অর্থনৈতিকভাবে সামান্য সচ্ছল ছিল, সঙ্গে ছিল তাদের আত্মমর্যাদাবোধ। নানীর সঙ্গে থেকে সোলায়মান অর্জন করেছিল নিজের উপর স্থির বিশ্বাস, ধীরে ধীরে রপ্ত করেছিল সৎ ধার্মিক জীবন। তবুও শেষপর্যন্ত তার ভাগ্যে অবাক হবার মতো ঘটনাগুলি কেবল ঘটেই চলল। কেন যে তার সাথেই! সোলায়মান মাঝে মাঝে উদাস হয়ে ভাবে!

সারাদিন নানীর সঙ্গে থেকে থেকে জ্বীন-পরির গল্প, দিনের বেশিরভাগ সময় মাছ ধরার নেশা— আর গ্রামের স্কুলে কোনোরকমে এইট পাস দেওয়া সোলায়মান শেষপর্যন্ত মামাদের গ্রামেও টিকতে পারল না। না টিকার কারণ, তার প্রতিবাদী স্বভাব। যেখানে সবাই চুপ করে থাকে, সোলায়মান সেখানেও কথা বলে। কারণ, সে স্পষ্ট চোখে দেখতে পায়, যারা চুপ করে আছে, তারা কয়দিন পরেই নানা সুবিধা নেবে। এই সুবিধাবাদী মানুষগুলোই যেসব কিছুর হিসাবটাকে গোলমাল করে, নিজেরাই শেষপর্যন্ত আখের গুছায়, সোলায়মান তা ভালোভাবেই জানে। তাই ছোটবেলা থেকেই নিজের ভাগ্যদোষে সোলায়মানের প্রতিবাদী স্বভাব! তো কী আর করা! একবার গ্রামের পুকুরে মাছধরা নিয়ে এমন সব কাণ্ড ঘটল! সব কাণ্ডের পর মামলা-মোকাদ্দমা হলে সোলায়মান মামাদের অমতে কোর্টে যেয়ে সাক্ষী দেয়। ব্যাপারটা নিয়ে ঝামেলা গড়াতেই থাকলে, সোলায়মানের মামারা বিরক্ত হয়ে তাকে গ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যদিও মামারা জানত, সোলায়মান ঠিক কাজটিই করেছে। কিন্তু গ্রামের প্রভাবশালী লোকদের বিরুদ্ধে যেয়ে জমি জমা হারিয়ে পথে বসা ছাড়া দ্বিতীয় পথ থাকবে না ভেবে, মামারা গাজীপুরের এক কসমেটিকসের দোকানে ওকে কাজে ঢুকিয়ে দেয়।

দোকানের কাজটা সোলায়মানের ঠিকই ভালো লাগল। যত্ন করে দোকান সাজানো, কাস্টমারের সঙ্গে দারুণ ব্যবহার সবমিলিয়ে সোলায়মান তাক লাগিয়ে দিল। দোকানের মালিক ওর কাজকর্ম দেখে তাকে খুব পছন্দ করত, নিজের বাড়ির সদস্যের মতোই তাকে ভালোবাসত। নানী ও মামারাও নিশ্চিত হয়েছিল সোলায়মানের একটা গতি হওয়ায়। আগোছালো, অস্থির, সত্যবাদী সোলায়মানের বিভ্রান্ত জীবনটা এখানে এসে বেশ কিছুদিনের জন্য হয়তো স্থির হয়ে যেতে পারত।


কিন্তু সোলায়মান তো ভিতরে ভিতরে অন্যদের মতো নয়। তার কেবল সমস্ত জীবনভর আগুনে পোড়ার শখ। জন্ম থেকেই তার ভালো লাগে অনিশ্চয়তাকে চ্যালেঞ্জ করতে। দোকানে একটি মেয়ে আসত, তার বান্ধবীদের সঙ্গে। মেয়েটির নাম শারমিন। বান্ধবীদের কথাবার্তা থেকে সোলায়মান বুঝত, মেয়েটি অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কী তার রূপ!

প্রথম দিন শারমিনকে সে দ্যাখে শীত শেষের এক অপার্থিব আলোতে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল তার বান্ধবীদের সঙ্গে। বিকেলের আলোটা এসে পড়েছিল তার মুখের উপর। সোলায়মানের মনে হচ্ছিল ওই আলো যেন শারমিনের শরীরের নিজস্ব আলো, যা মিশে গিয়েছিল বাইরের অপার্থিব আলোর সঙ্গে। ঢিলেঢালা একটা লাল রঙের ফ্রককোটের উপর বাদামি রংয়ের পাতলা ওড়নাটা ছড়িয়ে ছিল। ফ্রককোটের বোতামগুলো স্থিরভাবে বসে ছিল ওর বুকের উপর। সোলায়মান বিশেষভাবে খেয়াল করেছিল তার ডান হাতের আঙুলের নীল পাথরটিকে। নীল পাথর সমেত সে ছিল যেন স্বপ্নের মতো সুন্দর। তাকে যেন কিছুতেই ছোঁয়া যায় না।

সোলায়মান দোকানদারি করতে করতে শারমিন আর তার বান্ধবীদের উচ্ছলতাকে অনুভব করত। মনে হতো এক অপরূপ ঘূর্ণির মধ্যে সে দোল খাচ্ছে। বুঝতে পারত না, আশপাশের যা কিছু সত্য না স্বপ্ন!

এক পর্যায়ে সোলায়মান দেখে, দশ থেকে পনেরো মিনিট অনেক কথাবার্তা আর হাসাহাসির পর, ছেলে চারটি জোরজবরদস্তি করে শারমিনকে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে! আর অন্য মেয়েগুলো সন্ধ্যার অন্ধকারে শারমিনকে রেখেই এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে!


প্রতিবছরের মতো সেবারও জয়দেবপুরের রথখোলায় রথের মেলা বসে। মেলা চলতে থাকে বেশ কয়েকদিন। দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসতে থাকে সেই মেলাকে কেন্দ্র করে। মেলার শেষের দিকে একদিন শারমিন আর তার চার বান্ধবী তাদের ছায়াবিথীর এলাকা থেকে বের হয়ে মেলার মাঠের ভিতর ঘুরতে আসে। মেলা সেদিন প্রায় ভেঙেই গেছে। সন্ধ্যার আগে আগে ওরা ভাবল আরেকটু বেড়িয়ে তারপর বাসায় যাবে। ওরা মেলার মাঠ পার হয়ে একটু সামনের দিকে চা বাগান এলাকার রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। জায়গাটা খুব নিরিবিলি। সার্কিট-হাউস এলাকা। সার্কিট হাউসের পিছনে এক বিরাট খোলা মাঠের মাঝে দূরে দূরে ছড়ানো কিছু বড় বড় বট গাছ। নিরিবিলি সন্ধ্যায় ওই দিকটায় তেমন লোকজন নেই। সোলায়মান সুযোগ পেলেই ওই এলাকায় ঘুরতে যায়। দোকানে তেমন বেচাকেনা না থাকলে সে সুযোগ পেলে নিরালায় মাঠে যেয়ে বসে থাকে প্রায়ই। সেদিনও মেলার কারণে দোকানে বেচাকেনা কম ছিল। আর সেদিন সে আচানক শারমিন আর তার বান্ধবীদের সেখানে দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু নিজেকে আড়াল করে লুকিয়ে থাকে গাছের আড়ালে। সে দেখে, কোয়ার্টারের ভিতরের চারটি ছেলে ওই সময় ওদের কাছে আসে। কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হল, ছেলেগুলো ওদের পরিচিত। হয়তো একসঙ্গে পড়ে ওরা! ওদের ক্লাশের বন্ধু নাকি! সোলায়মান আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাবে। ‘এই হানে তো ডিসি সাবের পোলায় থাহে। হেই পোলার বন্ধুরা লগে!’ এক পর্যায়ে সোলায়মান দেখে, দশ থেকে পনেরো মিনিট অনেক কথাবার্তা আর হাসাহাসির পর, ছেলে চারটি জোরজবরদস্তি করে শারমিনকে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছে! আর অন্য মেয়েগুলো সন্ধ্যার অন্ধকারে শারমিনকে রেখেই এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাচ্ছে! মুহূর্তেই ঘটে যায় এইসব চাপ চাপ অন্ধকারের ভিতর। ঘটনা ঠিকঠাক বুঝবার চেষ্টা করে সোলায়মান। কিন্তু তখন অন্ধকার কালো হয়ে ঘন হয়ে আসছে। স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলেনি তখনও। শেষে অস্থির হয়ে আগুপিছু না ভেবে সোলায়মান প্রাণ হাতে নিয়ে মেয়েটির ইজ্জত বাঁচাবার জন্য দৌড়ে যায়। তার মনেই থাকে না ছেলেগুলো কোন এলাকার! কী তাদের পরিচয়! তার কী করা উচিত! শারমিন ততক্ষণে পড়ে থাকে ঘাসে-রক্তে মাখামাখি হয়ে। অন্য তিনটি ছেলে পরস্পর ঘের তৈরি করে ঘিরে রাখে ওদের! সোলায়মান তাৎক্ষণিকভাবে উপর্যুপরি ঘুষি মারতে থাকে চারটি ছেলেকেই। সাহায্যকারী দুটি ছেলে পালাতে উদ্যত হয়। কিন্তু যে ছেলেটি শারমিনকে রক্তাক্ত করেছিল, সে ঘুরে দাঁড়ায় সোলায়মানের দিকে। তার পকেটে থাকা ছোট্ট ছুরিটা এক পলকেই সরাসরি ঢুকিয়ে দেয় সোলায়মানের ডান চোখের ভিতর! এর পরের ঘটনা সোলায়মান জানে না। দু’দিন পরে, সোলায়মানের যখন জ্ঞান ফিরে, তখন সে হাসপাতালে।

স্থানীয় পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে খবরটি চাপা পড়ে যায়। সোলায়মানকে চোখের চিকিৎসা করানোর জন্য গাজীপুর থেকে ঢাকায় আনা হয়। দীর্ঘ কয়েক মাস ঢাকায় চিকিৎসা হয়, এবং সোলায়মানকে জানানো হয়, তার চিকিৎসার খরছ দিচ্ছে তার দোকানের মালিক। সোলায়মান ভাবে, ‘তার দোকানের মালিক তাইলে এত বড় মনের মানুষ! দুনিয়াটা তাইলে ঠিক তালেই চলতাছে!’ সে আরও ভাবে, এই ঘটনা সে বাড়িতে যেয়ে নানুকে বিস্তারিত বলবে! দুনিয়ায় খারাপ-ভালা মিলাইয়াই আছে, নানু! আমার লাইগ্যা চিন্তা কইরো না। চোখটা নাইলে গেলই! কিন্তু লড়াই করার সাহসটা অহনতরি যায় নাই!’ সে নিজের মনে ঠিক করে নেয় সেরে উঠার পর মালিকের দোকানে যথেষ্ট শ্রম দিয়ে চিকিৎসার খরচের কিছুটা ঋণ শোধ করে দেবে। তার ভিতর থেকে এক প্রবল কান্নার স্রোত নিঃসরিত হতে থাকে! এ এক অন্য অনুভব! সে কী কাঁদছিল তার চোখ হারানোর বেদনায়! অথবা শারমিনের জন্য সত্যিকারের সাহস দেখানোর আভিজ্ঞতায়! যাই হোক, তা যে কোনটি তা সঠিকভাবে চিহ্নিত না করতে পারলেও এই চোখের জল যে ভিন্নমাত্রার, তা সে বুঝতে পেরেছিল। আর তা চিবুক বেয়ে নেমে যেয়ে তার বুক ভিজিয়ে প্রাণে দিয়েছিল আস্থার নীরব শান্তি!

কিন্তু চিকিৎসা শেষের দিকে একদিন মালিক এসে তাকে রীতিমতো বিস্মিত করে দেয়। মালিক তার হাতে কয়েকটা টাকা গুজে দিয়ে বলে, ‘যে তোমার চোখের চিকিৎসা দিছে, হে হইল গিয়া শারমিনের বাপ। তুমি আর ওই এলাকায় যাবা না। আমি তুমারে আর দোকানে রাখতে পারুম না। বুঝলা বাবা!’

কেন! বিস্মিত হয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করে সোলায়মান।

শারমিনের বাপ আর তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চায় না, তুমি ওই এলাকায় থাহো, ওরা আমারে বলছে, তোমারে কাজ থেইকা ছাড়ান দিবার লাইগ্যা।

সোলায়মান হঠাৎ বুঝে উঠতে পারে না, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে। মালিকের কথায় স্তম্ভিত হয়ে থাকে। পরে সে জানতে পারে, ধর্ষণকারী ছেলেটির সঙ্গেই শারমিনের বিয়ে হয়, পারিবারিক ভাবে, উভয় পরিবারের সম্মতিতে। তাজ্জব বনে যায় সে। ‘শারমিন রাজি হইল এই বিয়াতে! হায় আল্লাহ!’
তার জন্য ভূমি অফিসের পিওনের চাকরিটিও দেওয়া হয়, শারমিনের বাবার সুপারিশে।

সোলায়মান শুনতে থাকে, মালিকের আদেশ। এই চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় সিদ্ধান্তের ভিতর নিজেকে একটা অক্ষম মাংসপিণ্ডের মতো মনে হয় তার। একটা আদিম নিষ্ঠুরতায় সোলায়মানের হাত দুটি মুঠিবদ্ধ হয়, এইসব কথা মালিকের মুখ থেকে শোনার সঙ্গে সঙ্গেই। আবার পরক্ষণেই খুলে অবশের মতো ঝুলে পড়ে। বরং চারদিক থেকে সঙ্গে সঙ্গেই ঝেঁপে আসা কালান্তক ভয়েরা, তার উপর ভর করে। ঘটে যাওয়া অতীতে তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে ট্রেন একসিডেন্টের তীব্র শব্দ ও রক্তগুলো হঠাৎ দীর্ঘদিন পর অবচেতনের ভিতরে প্রচণ্ডভাবে সমবেত হতে থাকে। পৃথিবীর সব লাল রংগুলো গর্জন করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে, তার দিকে।

লেখাটি শেয়ার করুন :

মণিকা চক্রবর্তী

মণিকা চক্রবর্তী। জন্ম ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারোটি। সাতটি নভেলা, তিনটি গল্পগ্রন্থ ও একটি কাব্যগ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই: যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক (নভেলা); বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরী (গল্পগ্রন্থ); অ্যাম্ফিথিয়েটার (নভেলা); হাওয়ার সংকেত ও অন্যান্য (গল্পগ্রন্থ); অপার্থিব গান (কাব্যগ্রন্থ); ছায়ান্ধকার (গল্পগ্রন্থ)। লেখার পাশাপাশি তিনি সংগীত চর্চা করেন। রেডিও ও টিভিতে প্রায় তার গান প্রচার হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!