কথাসাহিত্যগল্প

ডানা ও বেদনা

আমাদের বাড়িটা বনের ধারে। বাড়ির পেছনে বন। বনের বিস্তার উঠে গেছে উঁচা উঁচা পাহাড়ে। তার মানে বলা যায় আমাদের বাড়িটা আসলে বনপাহাড়ের ধারে। বাড়ির সামনে উঠান। উঠান পার হয়ে একটা মাঠ। মাঠ পার হলে নদীর চর। নদীর চর পার হলে ঘাট। আর ঘাটে বাঁধা আছে একটা দীর্ঘ নদী।

আমাদের সেই বাড়িতে মায়ের কাছে আমাদের রেখে বাবা একদিন হারিয়ে গেল। সকালে কাজে বের হয়ে রাতে আর ফিরল না। রাতে ফিরল না মানে তার পরদিনও ফিরল না। এগারো বছর হয়ে গেছে। বাবা কেন কোথায় হারিয়ে গেল তা কেউ জানে না, মা জানে না আমি জানি না, রেণু জানে না, দাদিও জানে না। আমার কেবল আবছা মনে আছে হারিয়ে যাবার আগের দিন রাতে বাবা উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। আর আমি তার খোলা পিঠের ওপর এপাড়-ওপাড় হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। বাবার শরীরটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

বাবা হারিয়ে যাবার পর মা কেমন করে ঘরসংসার সামাল দিয়ে চলেছে তা আমি আর রেণু ছাড়া কেউই জানে না। এমনকি দাদিও বুঝতে পারেনি কখনো। দাদি মাঝে মাঝে অনেকটা নিজের সঙ্গেই যেন বলে, ‘আঁর পুতিন্না হেদিন বেইন্না হাল পারাইয়েরে যে গেইলগই আর ন আইলো রে…।’ মানে ছেলেটা সেদিন সকালে নদী পার হয়ে যে চলে গেল আর ফিরল না। বলেই উঁ উঁ করে কাঁদে কয়েক মিনিট।

আর কোনোদিনও বাবা ফিরবে কি ফিরবে না এইসব ভাবনা যখন আমাদের মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে তখন নিচের গল্পের ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে একের পর এক। আমরা মানে আমি, মা, রেণু আর দাদি।

এই গল্পটা একার্থে আমাদের সকলের হলেও মূলত রেণুর বলা যায়। গল্পের ঘটনাগুলি গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষের দিকে আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল, এখনো স্পষ্ট মনে আছে। গল্পটা বলার জন্যে আমি সেই সময়ে ফিরে যাচ্ছি।

তিনি ছিলেন অনেক মেয়ের সাজগোজের মডেল। অনেকে আবার তার মতো ভ্রু ফেলে দিয়ে চিকন করে ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রু এঁকে নিত কাজলের পেনসিল দিয়ে। আর গাল সাদা করে পাউডার দিত। সকলের কাছে সুন্দর লাগলেও আমার কাছে এদের ডাইনির মতো লাগত।

রেণু আমার বয়সে এক বছরের বড়। কিন্তু তাকে আমি নাম ধরে ডাকতাম। সে ম্যাট্রিক পাস করে গ্রামের কলেজে ভর্তি হয়েছে। তার প্রথম দিন কলেজে যাওয়ার ঘটনাটা থেকেই গল্পটার মূল কাহিনি শুরু।

রেণুর পরনে সিল্কের একটা কামিজ, হালকা নীল, শরতের আকাশে যে রং থাকে তেমন। তারওপর সাদা ওড়না আর সাদা সালোয়ার। এইসব মা নিজ হাতে বানিয়েছে। কামিজটা বানিয়েছে মায়ের সিল্কের একটা শাড়ি ছিল, সেইটা কেটে।

রেণুর কাঁধে কালো রং ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর খাতা, ফাউন্টেন পেন, আর ছোট্ট একটা কসমেটিক্স বক্স। চুলটা মাথার ওপর কেমন ফুলিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকে পেছনে দুটো বেণি করা। এমন চুল ফুলিয়ে বাঁধার কারণ এমন করে চুল বাঁধতেন খালেদা জিয়া। আমাদের গ্রামের লোকজন বলত খালদা জিয়া। তিনি ছিলেন অনেক মেয়ের সাজগোজের মডেল। অনেকে আবার তার মতো ভ্রু ফেলে দিয়ে চিকন করে ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রু এঁকে নিত কাজলের পেনসিল দিয়ে। আর গাল সাদা করে পাউডার দিত। সকলের কাছে সুন্দর লাগলেও আমার কাছে এদের ডাইনির মতো লাগত। রেণুও সাজগোজ করত, কিন্তু অত কড়া করে নয়। তাই তাকে ডাইনির মতো লাগত না। যাইহোক, সেদিন সকালে সে যখন এইভাবে কলেজে যাবার জন্যে উঠান পার হয়ে গেইট খুলে বের হতে যাবে ওই সময় মা দৌড়ে এল। মার হাতে কালো সানগ্লাস। সানগ্লাসটা মা রেণুর চোখে পরিয়ে দিল। রেণু বলল, ‘আঁরে এঙ্গরি বলাজুরিমিয়া বানাই দিলে অইবনে অমা!’ সে বলতে চাইল যে তাকে এইভাবে সাজিয়ে সে যা নয়, তা বানিয়ে দিলে তো হবে না।

কলেজে প্রথম ক্লাস বাংলা প্রথমপত্র। ক্লাস নিচ্ছেন তরুণ এক শিক্ষক। নতুন জয়েন করেছেন ক্লাসে। খুব নাটকীয়ভাবে তিনি ক্লাসে নিজের নাম বললেন। বললেন, ‘আমার নাম পদ্মলোচন দাশ। কানাছেলের নাম পদ্মলোচন বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আমি কানা মানে অন্ধ নই। পদ্ম মানে পদ্মফুল। এই ফুল তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ। কলেজের পেছনের বিলেও ফুটে আছে। আর লোচন মানে চোখ। তাহলে পদ্মলোচন মানে কী দাঁড়ায়? পদ্মের ন্যায় লোচন। এটা সমস্যমান পদ, এর সমস্তপদ হল পদ্মলোচন। সমাস নিশ্চয়ই ইশকুলে পড়েছ তোমরা। আমি অবশ্য তোমাদের ব্যাকরণ পড়াব না, ব্যাকরণ পড়াবেন অনিল স্যার। আমি তোমাদের পড়াব, বাংলা প্রথম পত্র মানে সাহিত্যের গদ্যাংশ মানে গল্প-প্রবন্ধ ইত্যাদি। তাহলে পদ্মফুলের মতো চোখ যার তার নাম হয় পদ্মলোচন। আমার চোখ পদ্মফুলের মতো সুন্দর তাই মা আমার এই নাম রেখেছে। তবে অনেকেই আবার কানাছেলের নামও পদ্মলোচন রাখে, জন্মান্ধ ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখা একপ্রকার সান্ত্বনা-পুরস্কারের মতোই ব্যাপার…।’

পদ্মস্যার ক্লাসে আরো নানা কথা বললেন। কাল থেকে কোন গল্পটা দিয়ে শুরু করবেন ইত্যাদি বললেন। গল্পের নাম হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। ক্লাস শেষে সকলে হুড়মুড় করে বের হয়ে গেল। ছেলেরা মাঠের দিকে গেল। মেয়েরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় কমনরুমে।

কমনরুমে ঢুকেই কয়েকজন মেয়ে রেণুকে ঘিরে ধরল। তার সিল্কের কামিজটা ধরে দেখল। সানগ্লানটা একজন খুলে দিয়ে দেখে আবার রেণুর হাতে দিল। আয়শা, সুমি, রাশেদা ওকে টেনে দিয়ে একটা বেঞ্চে বসল। পরের ক্লাস চল্লিশ মিনিট পরে। আয়শা রেণুকে বলে, ‘আজকে কী দিয়ে ভাত খেয়েছে?’

‘মুরগির গোশতের সালুন দিয়ে।’

‘কই দেখি তোমার হাতে সালুনের গন্ধ আছে কি না?’

রেণু হাত গুটিয়ে নেয়। আয়শা রেণুর ডানহাত টান দিয়ে নিয়ে গন্ধ শুঁকে, ‘কই তোমার হাতে তো শুটকির গন্ধ!’ আয়শা তার নিজের ডানহাতের তালু রেণুর নাকের কাছে ধরে বলে, শুঁকে দেখো, মুরগির সালুনের গন্ধ এমন হয়।’

রেণু কিছু বলতে পারে না। একটুখানি নতমুখে চুপচাপ থেকে আয়শার পাশ থেকে ছিটকে সরে যায়। বাথরুমে গিয়ে কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলে।

আগামীকাল কলেজে যাবে কেমন করে! মুরগির ঝোলটা তো পড়ে গেল। তার কেমন মাথা ঝিম ঝিম করছে। মা-ও ঘরে নেই, শাক তুলতে গেছে বিলে। এমন সময় সে উঠানের কোনায় আলো-আঁধারিতে বনজ্যোৎস্নার ঝোপটার ধারে ময়ূরটাকে দেখতে পেল।  

বাড়ি ফিরে মাকে পাশ কাটিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে রেণু। কিন্তু মাকে এড়াতে পারে না। মাও তার পেছন পেছন তার ঘরে আসে, মাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আর সব বলে দেয়। তারপর বলে, ‘গোস্ত ন রান্ধিলে অমা, কাইল্লা বেইন্না আর কলজত ন যাইয়ুম।’ বলে যে মাংস রান্না না করলে সে আগামীকাল সকালে কলেজে যাবে না।

রেণুর কথা শুনে মা চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু মুহূর্তেই সমাধান পেয়ে যায়। রেণুকে শক্ত করে ধরে বলে, ‘না, তুই হামাকা কলজত যাবি আইয়েদ্দে কাইল্লা।’

এরপর দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে। মা আমাদের ডিমপাড়া মুরগিটা জবাই করে রান্না করে ফেলে। পরদিন রেণু কলেজে যায়। হাসিমুখে কলেজ থেকে ফেরে।

অল্প অল্প খেয়েও তিন দিনে মুরগির সালুন শেষ হয়ে যায়। রেণু ভাবে এইবার কী হবে! মা হাসে। মা রেণুর হাত ধরে পাকঘরে নিয়ে যায়। মাঝারি পাতিলটার ঢাকনা খুলে দেখায়। রেণু দেখে লাল হয়ে আছে মুরগির সালুন। মুহূর্তেই খুশিতে তার চোখ ঝলমল করে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার চোখমুখ আবার মলিন হয়ে যায়, ভাবে এ কেমন করে সম্ভব! মুরগি তো একটাই ছিল। তাহলে এত সালুন এল কোথা থেকে। মা তার ভাবনার উত্তর দিয়ে দেয়। ব্যাপার হল মা প্রথমদিনই মুরগির সালুন থেকে অর্ধেক ঝোল আলাদা পাতিলে ঢেলে রেখেছিল, সঙ্গে কয়েক টুকরো ডানা, পা, গলা এইসবও রেখেছিল। রেণু ভাবে এই ঝোলও তো একদিনে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার সমাধানও মা ভেবে রেখেছিল।

প্রতিদিন আমরা ভাত খাই শাকসবজি, যা পাই তাই দিয়ে। কিন্তু কলেজে যাবার আগে রেণু মুরগির মাংসের ঝোলে ডান হাতটা ডোবায়। আর না ধুয়ে ন্যাকড়া দিয়ে ভালো করে মুছে ফেলে। তার সেই হাত কলেজের বান্ধবীরা শুঁকে দেখে।

এইভাবে বেশ কেটে যাচ্ছিল দিন। সেদিন দাওয়ায় একটা পিঁড়ি পেতে বসে আছে রেণু। আকাশের পাড় থেকে লাল রং ফিকে ধূসর হয়ে যাচ্ছে ধীরে দেখছে। আর ভাবছে এলোমেলো সব ভাবনা। এর মধ্যে মাগরিবের আজান হয়ে গেল, তার কোনো বিকার নেই। কিন্তু সহসা ঝনঝন শব্দে তার ভাবনাজাল ছিঁড়ে গেল। সে দৌড়ে পাকঘরে ঢুকে দেখে মেঝেটা লাল হয়ে আছে মুরগির সালুনের ঝোলে। আর তাদের বেড়ালটা ঝোলটা মাড়িয়ে একটা ইঁদুরের পেছনে ধাওয়া করছে। ঝোলের রঙে বেড়ালের পায়ের ছাপ মাটির মেঝেতে লেগে সুন্দর আলপনা হয়ে যাচ্ছে।

রেণুর কাছে এই দৃশ্য মুহূর্তে স্বপ্নের মতো মনে হলেও পরক্ষণেরই সর্বনাশটা বুঝতে পারল। ‘হারামি বিলাই!’ বলে বেড়ালটাকে সে একটা লাথি মারতে গেল। আর বেড়াল উলটা তার পায়ে আঁচড় কেটে দিল। সে ছিটকে দাওয়ায় চলে এল। আবার বসে পড়ল। ভাবতে লাগল আগামীকাল কলেজে যাবে কেমন করে! মুরগির ঝোলটা তো পড়ে গেল। তার কেমন মাথা ঝিম ঝিম করছে। মা-ও ঘরে নেই, শাক তুলতে গেছে বিলে। এমন সময় সে উঠানের কোনায় আলো-আঁধারিতে বনজ্যোৎস্নার ঝোপটার ধারে ময়ূরটাকে দেখতে পেল। আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা কাজ করতে শুরু করল।

ময়ূরটাকে দুহাতে ঝাপটে ধরতে গেল রেণু। পাখিটা হাতের ভাঁজে ধরা পড়েই পিছলে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ফলে উপুড় হয়ে উঠানের ঘাসে পড়ে গেল সে। কিন্তু উঠেই পাখিটাকে আবার ধরবার জন্যে তাড়া করে তার পেছন পেছন দৌড়ে গেল। দৌড়ে যেতে যেতে রেণু ভাবছে এই পাখিটা যদি আজ উড়তে পারত তবে ধরতেই পারত না। তার কষ্ট হল মনে, ডানা আছে কিন্তু মনে হয় ডানার ভারেই উড়তে পারে না। কী বেদনা পাখিটার! গানের মতো, অনেকটা তার নিজের মতো, তার মনেরও তো আকাশব্যাপী ডানা অথচ আকাশে গিয়ে উড়তে পারে না বাস্তবে, মনে মনেই উড়তে হয়। কিন্তু এইসব ভাবলে তার চলবে না। পাখিটা আজ তাকে ধরতেই হবে না হয় কাল কলেজে যেতে পারবে না। কলেজে যেতে না পারলে পদ্মস্যারের লেকচার শুনতে পাবে না। স্যার কালকের ক্লাসে বলেছিলেন, ‘পাখিই মূলত মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কারণ। পৃথিবীতে পাখির জন্ম না হলে মানুষের উড়ার বাসনা তৈরি হত না। তার মানে পাখিকে উড়তে দেখেই মানুষেরও উড়তে মন চায়। কিন্তু উড়তে পারে না। আর উড়তে পারে না বলেই মানুষের মনে এত যন্ত্রণা, তাই মানুষ মনে মনে ওড়ে…’।

চাঁদের আলো সরের মতো গড়িয়ে পড়ছে পাখিটার পালকে, নীল পাখিটার গায়ের রং হয়ে যাচ্ছে জোছনার মতো হলদেটে সাদা। পাখিটা নদীর চর পেরিয়ে ঘাটে গিয়ে স্থির হয়ে ঘুরে দাঁড়াল, তার পেছনের ঘাটে বাঁধা দিঘল নদী কোথায় বহুদূর দিগন্তে কত দিক দীর্ণ করে চলে গেছে!

এইসব ভেবে রেণু আরো দৌড়তে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে আরো ভাবতে লাগল কিন্তু আরো অনেক পাখিরও তো মানুষের মতোই যন্ত্রণা, ডানা আছে কিন্তু উড়তে পারে না। এই যে ময়ূরপাখিটা, কী সুন্দর ঝলমলে ডানা, নাচলে মনে হয় চারপাশে আনন্দ ঝরে। এই পাখি তো উড়তে পারে না। তারপর হাঁস, মুরগি, আর সবচেয়ে বড়পাখি উটপাখি, এরাও তো উড়তে পারে না। তাহলে? গতকাল পদ্মস্যার ময়ূরপাখির কথাও বলেছে। কী সুন্দর করে যে বলেছে! বলেছে, ‘যে-ময়ূর নাচে, সেই ময়ূর পুরুষপাখি। কেবল পুরুষ-ময়ূরের সুন্দর ঝলমলে পেখম থাকে। সে নারী-ময়ূরকে নাচ দেখিয়ে খুশি করে…’। তবে একটা বিষয়ে রেণু এখনো লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। আর নিজেকে মারতে মন করছে। পদ্মস্যার তার কাছে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল, তার উত্তরটা সে জানত, কিন্তু মুখে এসেও মুখ থেকে বের হল না। বলল, ‘পারি না স্যার’। অথচ স্যার প্রশ্নটা করার পর কেউ হাত তুলছে না দেখে নিজেই বলেছিল, ক্লাসের একজন এই উত্তরটা দিতে পারবে, তার নাম রেণু। পদ্মস্যার লেকচারের এক পর্যায়ে বলছিল, ‘যখন কলম আবিষ্কার হয়নি তখন মানুষ খাগের নল, বাঁশের কঞ্চি ইত্যাদি কালিতে ডুবিয়ে লিখত। আর রাজা, জমিদাররা লিখত শিকিপাখা দিয়ে। এই যে শিকিপাখা বললাম। শিকিপাখা মানে কি তোমরা জানো?’

রেণু জানত শিকিপাখা মানে ময়ূরের পালক। বাবার কাছে কত গল্প শুনেছে শৈশবে। তারপরে রূপকথার বইয়ে পড়েছে কতবার! আর ভাবতে পারে না। তাকে ময়ূরটা ধরতেই হবে।

এইবার একটু ময়ূর পাখিটার কথা বলি। এই পাখিটা বেশিদিন হয় না আমাদের উঠানে আসে। মনে হয় বনের ভেতর থেকে আসে। কেন যে আসে আমরা কেউ জানি না। প্রতি শুক্রবার বিকেলের দিকে আসে। এদিক-ওদিক ঘোরে। পেখম মেলে নাচ দেখায়, তারপর সন্ধ্যায় বনের দিকে চলে যায়। আমি আর রেণু মিলে নানা রকম ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে এনে খেতে দিই। আর সেই পাখিটাকেই আজ রেণু তাড়া করছে ধরার জন্যে। না হয় কাল তার কলেজ যাওয়া হবে না।

পাখিটা ছুটতে ছুটতে উঠান পেরিয়ে বনের দিকে না গিয়ে মাঠে নামল। নেমে ছুটছে তো ছুটছে, পেছন পেছন রেণুও। আর মাঠ যেন মাইলের পর মাইল দীর্ঘ হচ্ছে, যেন বা তেপান্তর। আর সন্ধ্যা ঢুকে যাচ্ছে রাত্রির পেটের ভেতর।

মাঠ পেরিয়ে পাখিটা নদীর চরে গিয়ে নামল যখন, আকাশে তখন ক্রমে আলো হয়ে জ্বলে ওঠছে চাঁদ। চাঁদের আলো সরের মতো গড়িয়ে পড়ছে পাখিটার পালকে, নীল পাখিটার গায়ের রং হয়ে যাচ্ছে জোছনার মতো হলদেটে সাদা। পাখিটা নদীর চর পেরিয়ে ঘাটে গিয়ে স্থির হয়ে ঘুরে দাঁড়াল, তার পেছনের ঘাটে বাঁধা দিঘল নদী কোথায় বহুদূর দিগন্তে কত দিক দীর্ণ করে চলে গেছে! কেউ জানে না। পাখিটা রেণুর দিকে তাকিয়ে নাচের ভঙ্গিতে পেখম মেলল।

হঠাৎ রেণুর চোখে ভ্রম, কিংবা কেটে গেল সকল বিভ্রম। সে চাঁদের তীব্র আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল তার সামনে যে-পাখিটা অন্ধকার দিগন্তকে ছুঁতে গিয়ে নদীর ঘাটে এসে পেখম মেলে দাঁড়িয়েছে, সে আসলে ময়ূরপাখি নয়, এগারো বছর আগে তার হারিয়ে যাওয়া বাবা।

লেখাটি শেয়ার করুন :

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। জন্ম ২৪ অগাস্ট ১৯৮১, চকরিয়া, কক্সবাজার, বাংলাদেশ। লেখালেখি আর ছবি আঁকাই মূল কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই ২০টি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!