নিরাপদ তন্দ্রা : নারীর জীবনযুদ্ধ ও সমাজবাস্তবতা
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘরাত্রি একা জেগে আছি।
. . .
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
(ফররুখ আহমেদ)
—ইদ্রিস ভাই আমাকে উদ্ধার করো, জ্বলে-পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেলাম আমি এই জাহান্নামে, … এতো অত্যাচার আমি সইতে পারবো না, আমি পাগল হয়ে যাবো এখানে, আমাকে শেষ করে ফেলেছে কাঞ্চন, আমার আর কিছুই নেই, ধুক ধুক করে কোনোমতে শুধু প্রাণটুকু টিকে আছে! দাঁতে দড়ি দিয়ে আছি, দোহাই, আমাকে উদ্ধার করো!
এই আর্তনাদ হিরনের। হিরন মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮)-এর নিরাপদ তন্দ্রা (রচনাকাল : ১৯৬৮) উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যে স্বল্পপ্রজ কথাকার মাহমুদুল হক। জীবনের গল্প রূপায়ণে তাঁর ছিল এক বিশিষ্ট ভঙ্গী। অন্যদিকে তাঁর দেখার চোখও ছিল অন্তর্ভেদী। তাঁর কলমে জয়পাড়া গ্রামের বয়াতি বাড়ির মেয়ে হিরনের একলা জীবনের লড়াইয়ের গল্পটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। একজন নারীর জন্য সমাজ পদে পদে কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে এবং শেষ অবধি মানুষটি কোথায় পৌঁছায়—সেটাই এই উপন্যাসের আখ্যান। গল্পটা এক অর্থে পুরোনোই। কেননা নারী তো বারবারই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। তার স্বপ্ন আর অযুথ আকাঙ্ক্ষার অপমৃত্যু ঘটেছে পুরুষতন্ত্রের হাতে। হিরনও ঘর ও স্বজনদের ছাড়ে মনের মানুষ কেরামত আলীর জন্য। জয়পাড়ার হিরন জলেশ্বর মাঝির নৌকায় করে রাতের অন্ধকারে আজন্ম চেনা সবকিছু ছেড়ে এক অজানার পথে পা বাড়ায়।
কেরামত তাকে প্রথমে হোটেল নাইল ভ্যালিতে তোলে। পরের দিন ফকিরচাঁদ সর্দারের বস্তিতে ইদ্রিস কম্পোজিটরের ঘরে এনে রাখে। বিয়ে করবে বলে ব্যবস্থা করার নাম করে সারা জীবনের মতো গা ঢাকা দেয়। এবার অথৈ সাগরে পড়ে হিরন। ইট, কাঠ আর কংক্রিটে মোড়ানো শহরে সতেরো বছরের ‘চাঁদপানা’ মুখের হিরনের জন্য এক কঠিন সংগ্রাম অপেক্ষা করে। হিরন হারিয়ে যেতে চায়নি বরং বাঁচতে চেয়েছে সেটাই তার অপরাধ। যাকেই অবলম্বন করেছে সেই তাকে ব্যবহার করেছে আর এভাবে ক্রমাগত হাতবদল হতে হয়েছে হিরনকে। কেউ হিরনের দিক থেকে তাকে নিয়ে ভাবেনি। সবাই একটা প্রথাগত চিন্তায় আটকে থেকেছে। যা সবসময় হয়ে থাকে।
এই উপন্যাসে অনেকগুলো বিষয় এসেছে। তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো নিচু তলার মানুষদের জীবনসংগ্রাম সঙ্গে মানুষের জীবনের বিচিত্র সব দিক। কিন্তু মূল বিষয় হিরনের অন্ধকারে আচ্ছন্ন পিচ্ছিল পথে একা হেঁটে চলার বিবরণ। হিরনের এই পথচলার গল্পটা কামরান রসুলকে বলে ইদ্রিস কম্পোজিটর আর জলিল বুকি অনেকটা পালাক্রমে। লেখক যেন একটু আয়োজন করে একলা নারীর জীবনের কঠিন আর মর্মন্তুদ আখ্যানকে তুলে ধরতে চান। করাতিটোলার ফকিরচাঁদ সর্দারের বস্তিতে কামরান রসুল থাকতে আসে। সেখানে একটা তক্তপোশ কেনে পাঁচ টাকায়। যার গায়ে লেখা ছিল ‘আমার সোনা মানিক দালহাপ্পু দালহাপ্পু বলে কাঁদে।’ এই কান্নার সঙ্গে আখ্যাানের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ইদ্রিস কম্পোজিটরের নিরাসক্তি আর নির্মোহভাব হিরনকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। বস্তির কোবাত আলীকে বিয়ে করে তার তিন নম্বর বউ হবে বলে ঠিক করে। ইদ্রিস বাধা দিলেও হিরন অনড় থাকে। বলে, ‘আমার জীবন নষ্ট হতে কিছু বাকি আছে নাকি? যদি কিছুটা থেকেও থাকে সেটা আমি নিজের হাতেই পুরো করতে চাই।’ কথাগুলো বলার সময় তার মুখে ছিল বিচিত্র এক হাসি। আসলে ঐ হাসিতে লুকিয়ে ছিল একজন একলা নারীর অসহায়ত্ব। জলিল বুকির প্ররোচনায় হিরন তার জীবনে আরেকটা অন্ধকারকে অঙ্গীকৃত করে। যক্ষ্মারোগী কোবাত আলী হিরনকে ফকিরচাঁদ সর্দারের কাছে ব্যবহৃত হতে দেয়। ওদিকে আছে সতীন মরিয়মের অত্যাচার। এই ঘর তার ভেঙে যায়।
জলিল বুকি এবার হিরনকে কৌশল করে দেঁতো আকদ্দসের ঘরের বউ বানায়। অবশ্য এর বিনিময়ে জলিল বুকি ওষুধের ক্যানভাসার আকদ্দসের কাছ থেকে দুইশ টাকা চাইলে সে বলে, ‘মোটামুটি পঁচিশ টাকা দিতে পারি, এর চেয়ে বেশি এক পয়সাও না। তিন হাতে লগড়ানো মেয়েমানুষ। পঁচিশ টাকাই অনেক বেশি। আমি বলে তাই, না হলে জেনে-শুনে কেউ কড়ি দিয়ে কানা গরু কেনে না!’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর শ্রীকান্ত উপন্যাসে সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মীর বিয়ের সময় এমন দরদাম হয়েছিল। দুটো ষাঁড়ের দামে দুই বোনকে বিয়ে করতে রাজি হয় কুলীন দোজবরে পাত্র। মেয়েদের নিয়ে গল্পগুলো অনেক সময় বয়ে গেলেও প্রায় একইরকম রয়ে যায়। এ এক চরম বাস্তবতা। পরিত্রাণের উপায়হীন এক নগ্ন বাস্তবতা। উদ্ধৃতির চিহ্নিত অংশটুকু নিয়ে কথা আছে। জলিল বুকি আকদ্দসকে সংশোধন করে দিয়ে বলে, ‘তিন হাতে নয়, বলো আড়াই হাতে লগড়ানো মেয়েমানুষ।’ মানে ইদ্রিস তাকে ব্যবহার করেনি তাই। কীভাবে মেয়েদেরকে দেখে সমাজ—ভাবতে অবাক লাগে!
হিরন এখানে ক্ষুধার যন্ত্রণায় দিন কাটায়। আকদ্দসের অভ্যেস ছিল টাকা জমানোর। ফলে সংসারের প্রয়োজনটুকুও মেটাত না। হিরনের সন্তান ক্ষুধার তাড়নায় বছর না ঘুরতেই মারা যায়। হিরনের বাড়িতে কাঞ্চন নামে একটি ছেলে থাকত। হিরন তাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখত। সে বস্তির যাত্রাপালায় অভিনয় করত। এই ছেলেটিকে নিয়ে যাচ্ছেতাই ঝগড়া বাধে তাদের মধ্যে, সঙ্গে দাম্পত্যলড়াই। ফলে হিরন ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। সুস্থ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আর আকদ্দসের সঙ্গে নয়। আকদ্দস হিরনের জীবনে কাঙ্ক্ষিত সুখ দূরের কথা সামান্য স্বস্তিও দেয়নি। ইদ্রিস বলে, ‘হিরন চেয়েছিল জীবনের আলো দেখতে, আর আকদ্দস জানতোই না জীবনের আলো কাকে বলে।’
হিরন কাঞ্চনের রোজগারে জীবন কাটাতে থাকে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কাঞ্চন অন্ধকার জীবনের সব দিক আয়ত্ত করে ফেলে। বাংলা মদ, জুয়া, মেয়ে পটানো সব রপ্ত করে একরাতে মাতাল অবস্থায় হিরনের সম্ভ্রম হরণ করে। হিরন যাকে মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো দেখত এখন তার রক্ষিতা হতে হয় তাকে। হিরন বাসাবাড়িতে কাজের লোক হতে চেয়েছিল কিন্তু জলিল বুকি তাকে বলে, ‘মরতে চাঁদপানা মুখ নিয়ে জন্মেছো, যেখানেই যাবে একটা না একটা ফ্যাকড়া বাধবেই।’ সব দোষ যেন তারই। অবশ্য তারই হওয়ার কথা। কেননা সে নারী। একবার খুব দুঃখ করে হিরন বলেছিল :
সবকিছুর জন্য তোমরা সবাই একা আমাকেই দুষবে। আমার যে দোষ নেই তা বলছি না, কিন্তু তোমরা সবাই যদি আমার মতো একজন মেয়েমানুষ হতে, যার পায়ের তলার কোনো মাটি নেই, যার কখনো অবলম্বন বলে কিছু ছিল না, তাহলে হয়তো কতকটা আন্দাজ করতে পারতে আমার দশাটা।
হিরনের অবস্থা কেউ আন্দাজ করতে চায়নি। এই সমাজের সে সময় বা ইচ্ছা কোথায়? সবাই লুটের মালের মতো হিরনকে ব্যবহার করেছে। এবং পাল্টা তাকে নিয়ে ভেবেছে— ‘শক্ত ধাতুতে গড়া না হলে কোনো মেয়ে ঘরপালানি হয় না।’ কিন্তু যে পুরুষটি ভরসা আর আস্থা দিয়ে তাকে ঘরছাড়া করল তাকে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। হিরন পেটের দায়ে বস্তির আখড়ায় গাইয়ে হয়। বয়াতি বাড়ির মেয়ে হওয়ায় গলায় সুরও ছিল। খুব অল্প সময়ে নামডাক হয়। কিন্তু আখড়ার গুন্ডা হাবুল হিরনের দখল চাইলে কাঞ্চনের সঙ্গে তার ঠান্ডা লড়াই বাধে। কাঞ্চন তার একটা হাত হারিয়ে আখড়া এবং বস্তি থেকে বিদায় নেয়। আর হিরনের অধিকার নেয় আখড়ার আরেক গুন্ডা কাশেম। সে বলে, ‘আজ থেকে তুই কারো মাগী নস। তুই আখড়ার মাল, যতো ঝক্কি তোকে নিয়ে। যা শালী, আজ থেকে কারো হক নেই তোর ওপর। আমার কাছে থাকবি তুই।’ এভাবে হাতবদল হতে থাকে হিরন। তার কোনো কথা নেই। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক যে বলেন পুরুষতন্ত্র নারীকে ‘অপর’ করে রাখে। আসলেই তাই। কথা বললেও কে-ই বা শুনবে। হিরনদের কণ্ঠস্বর তাই কারো কানেই পৌঁছায় না। কেবল ইথারে ইথারে ভেসে বেড়ায়। এক সময় কাশেম গুন্ডার আস্তানা থেকে রাতের অন্ধকারে হিরন উধাও হয়ে যায়। পরে ইদ্রিস তাকে দেখতে পায় নারায়ণগঞ্জের খরপট্টিতে। এখানে কাঞ্চন হাতকাটা কাঞ্চন হয়ে নারীদের নিয়ে দেহব্যাবসা ফেঁদেছে। হিরনকে দিয়ে ব্যাবসা করায়। হিরন হাতবদল হতে হতে শেষ পর্যন্ত বাজারে এসে পড়ে। ইদ্রিস বড় দুঃখ করে বলে :
জয়পাড়ার সচ্ছল এক বয়াতি পরিবারের মেয়ে, ভালোবেসেছিল একজনকে, ভালোবেসে মা বাবা ভাইবোনের মায়া ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল তার কাছে—শুরুটা তো এই। প্রথমে কেরামত আলী, কেরামত আলী থেকে কোবাত আলী, কোবাত আলী থেকে আকদ্দস, আকদ্দস থেকে কাঞ্চন, কাঞ্চন থেকে কাশেম গুণ্ডা, হিরন একটা লুটের মাল! কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন? প্রায় সকলের নামই ক প্রধান। এক ক থেকে আর এক ক, এই হলো হিরন। এই ক কখনো অগ্নি, কখনো সুখ, এই ক কখনো মন, কখনো রোগ, কখনো পানি, কখনো দেহ, কখনো দীপ্তি, কখনো ময়ূর। বোধহয় তাই ক-এর বাইরে কোনোদিন যেতে পারলো না সে।
হিরন ক-এর চক্করে পড়ে তার জীবনের পথ চলাকে কঠিন করে ফেলে নাকি ক-ই কঠিন করে দেয়? যেভাবেই হোক শুরুতেই হিরন পাঁকে জড়িয়ে যায়। এই ক সেই পাঁকের নাম। হিরন বেরুতে পারে না। আসলে হিরনরা এভাবে পাঁকে পড়ে বা জলে পড়ে তলিয়ে যায়। তাদের হারিয়ে যেতে হয়। এই সমাজব্যবস্থা তাদের ব্যবহার করে ছিবড়া করে ছুড়ে ফেলে দেয়। ইদ্রিস কম্পোজিটর একবার বর্তমান সময়ের লেখকদের লেখা সম্পর্কে একটা মন্তব্য করে। বলে, ‘অক্ষরগুলোর দিকে তাকানো যায় না, ন্যাংটো ন্যাংটো লাগে…’ কেবল অক্ষর নয় অক্ষরের প্রতীকে হয়তো সে পুরো সমাজটাকেই তুলে ধরতে চেয়েছে। সমাজে মানুষের দুঃখ-কষ্টগুলো এত খোলামেলা হয়ে গেছে, জেতার প্রতিযোগিতায় এত নিমগ্ন সকলে যে তারা মানুষ এটাই ভুলে যাচ্ছে। আর এই ভুলটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটছে নরীদের বেলায়। সমাজ তথা পুরুষতন্ত্র এখনও দ্বিধাগ্রস্ত—নারীরা মানুষ কিনা? কিংবা কতভাগ মানুষ আর কতভাগ নারী? এই সত্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অথচ সভ্যতাগর্বী সমাজ কিছু বলে না। এসব ক্ষেত্রে চুপ। যেন কিছুই ঘটছে না কিংবা একইরকম ঘটনা চিরজীবন ঘটতে দেখে চোখসওয়া হয়ে গেছে সব। এসব অনিয়মকে প্রথা ভেবে বসে আছে। নারীকেন্দ্রিক ইস্যুতে সমাজের এই নির্লিপ্ততা সত্যিই ক্লান্তি এনে দেয়।
ইদ্রিস পতিতাপল্লির মেয়েদের বিষয়ে বলে ওখানে বেশিরভাগ মেয়েই আসে প্রিয় পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে। হিরনের মতো ভুল করে যারা। কিন্তু হিরন কি কেরামত আলীকে বিশ্বাস করে ভুল করেছিল? এসব গল্প যেন একইরকম হয়ে বয়ে চলেছে কালের পর কাল। তবে মাহমুদুল হক-এর নিরাপদ তন্দ্রার হিরনের গল্পে কিছুটা অভিনবত্ব রয়েছে। হিরনের যে আর্তি দিয়ে আমরা লেখা শুরু করেছিলাম, অর্থাৎ সে বাঁচার জন্য, কাঞ্চনের হাত থেকে বেরুবার জন্য, পতিতাপল্লির নরকসদৃশ জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ইদ্রিসকে বলে তাকে উদ্ধার করতে। ইদ্রিস চেষ্টা করেও পারে না। গল্পটা এখানে শেষ হলেও পারত। কিন্তু লেখক দেখান হিরন বর্ষায় ভেসে যাওয়া বস্তির সেই ঘরে ফিরে আসে। ইদ্রিসের ঘর। যেখানে কেরামত তাকে এনে তুলেছিল। ইদ্রিস জেলে থাকলেও কামরান রসুল সেখানে ছিল। হিরন কামরান রসুলকে কেরামত ভেবে একনাগাড়ে কথা বলে যায়। তার কথার বিন্যাসকে অক্ষরের রূপ দিতে ছয় পৃষ্ঠা লাগে লেখকের।
তার কথা শুরু হয় জলেশ্বর মাঝির সময় অর্থাৎ ঢাকায় এসে হোটেলে ওঠা এবং পরে বস্তির এই ঘরে এসে তার কথা শেষ করে। একটানা পূর্ণচ্ছেদ ছাড়া সে কথা বলে চলে। শেষে কেবল একটা বিস্ময়সূচক চিহ্ন আছে। এখানে সে বলে বাড়ির কথা, স্বজনদের কথা, ভালোলাগার কথা, কষ্টের কথা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কোথাও তার ছয়-সাত পুরুষের হাতবদল হওয়ার কথা নেই। তার জীবনের এই কঠিন সংগ্রামের কথা নেই। নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলার নির্মম গল্পটা নেই। সে মানসিক শৃঙ্খলা হারিয়ে মনের সেই স্তরে পৌঁছে যায় যেখান থেকে তার এই জীবন শুরু হয়েছিল। যেখানে সে একজন প্রেমিকা নারী কেবল। ভালোবাসার মানুষের জন্য যে সবকিছু ছাড়তে পারে। মাহমুদুল হক হিরনের পরিণতি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন :
হিরনকে আমি প্রেমের প্রতিমূর্তি হিসেবে গড়তে চেয়েছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল একমাত্র নারীই জানে প্রেম কী।… হিরন সব বিস্মৃত হয়ে ফিরে এসেছিল বলেই সে মহান, তখন সে আর সাধারণ মানবী নয়, তখন সে নিজেই রূপান্তরিত প্রেমে, আর প্রেম, প্রেমের কখনো মৃত্যু হয় না। নানাভাবে তা রূপান্তরিত হয়। মাংস ব্যবসায়ী বা অপ্রেমিকেরা এই রূপান্তরকে সাধারণ পাগলামি হিসেবেই দেখে থাকে। আমি যে প্রেমকে হামানদিস্তায় ফেলে ঠুকে ঠুকে মাথার মুকুট করেছি, তার নাম হিরন।
আমরা মাংস ব্যবসায়ী বা অপ্রেমিকদের দলে পড়ি না। তাই হিরনের প্রেমের প্রতি আমাদের কোমল অনুভব কাজ করে। হিরন জীবনকে ভালোবেসেছিল, আলোর প্রত্যশী ছিল কিন্তু তাকে অনুভব করার জন্য একজন মানুষও অবশিষ্ট ছিল না এই ইট, কাঠ, কংক্রিটের শহরে। দুঃখবোধ এখানেই। হিরনের মনের সঙ্গী হওয়ার কেউ চেষ্টা করেনি। সতেরো বছরের অজপাড়াগাঁর ‘চাঁদপানা’ মুখের মিষ্টি মেয়েটিকে সবাই মিলে খুবলে খুবলে খেয়েছে। কেউ একবারও মমতার দৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখেনি। ইদ্রিস তার ভালো করতে গিয়ে তাকে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। জীবন অদ্ভুত; নির্মম তার গতিবিধি। কোথাও শুশ্রুষার এক ফোঁটা জল অবশিষ্ট নেই যেন। হিরন বস্তির ঐ ঘরে ফিরে এসে যখন একনাগাড়ে নিজের কথা বলে যায় তখন আমাদের নির্বাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কষ্টটা তার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। মেয়ে হয়ে জন্মানোর কষ্ট। মা তাকে ‘বাপ-ভাতারী’ বলে গালি দেয় জামার বোতাম টেকে দেওয়ার জন্য। এভাবেই আপনজনরা অপরিচিত হয়ে ওঠে মেয়েদের কাছে। জীবন পদে পদে পরীক্ষা নেয়। জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে এ পরীক্ষা। দু-একজন পাস করলেও বেশিরভাগই উত্তীর্ণ হয় না। একটা কারাগারসদৃশ ঘেরাটোপের মধ্যে কয়েদির জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। অথচ কী সম্ভাবনার আধার এক একটা জীবন!
হিরনের সেই একনাগাড়ে বলা কথাগুলোর শেষ অংশটা এমন :
মাত্র দুটো দিন বই তো নয়, মনে হচ্ছে যেন এক যুগ, জয়পাড়ার আমি আর কেউ নই, দু’দিন এতো বদলে যায় মানুষ, চুপ করে আছো কেন, কথা বলো, আমার জীবন আমার নয়নের মণি, কথা বলো, আমাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেবার মতো কি একটি কথাও তোমার জানা নেই কেরামত ভাই!
হিরনের এই কাতরোক্তি আমাদের মনকে দ্রবীভূত করে। আমরা বিষাদাক্রান্ত হই। কোথাও যেন কিছু ভেঙে পড়ে। নিরাপদ তন্দ্রাচ্ছন্ন সমাজের শেকড় ধরে টান মারে হিরন। কিন্তু ঘুম ভাঙে না। সবকিছু ঠিক আগের মতোই চলে। মানুষের সমাজে মানুষের এই আর্তনাদ কোনোই ভূমিকা রাখে না। কেবল বাতাসটা একটু ভারি হয়। দু-চারটে পাতাও ঝরে। একরাশ বাউল বাতাস এলোমেলো বয়ে যায়। হিরনদের জন্য হিরনদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, কষ্ট কমিয়ে দেওয়ার জন্য একটা কথাও কেউ বলে না।
মাহমুদুল হকের নিরাপদ তন্দ্রা একজন একলা নারীর জীবনের আখ্যান। পুরুষতন্ত্র যে নারীটিকে অতি ব্যবহারে জীর্ণ করে ফেলেছে অনেকটা পোশাকের মতো। কিন্তু সে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়নি। ফিরে এসেছে সমস্ত প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে। হ্যাঁ, এই দীর্ঘ লড়াইয়ে সে তার মানসিক শৃঙ্খলা হারিয়েছে। কিন্তু প্রেমের প্রতিমূর্তি হয়ে ফিরে এসেছে সেই মানুষটির কাছে যার জন্য সে নিশ্চিত জীবন ছেড়ে একলা পথে নেমেছিল। হিরনের লড়াইটাকে লেখক একটা ভিন্ন মর্যাদায় উপস্থাপন করেন। তবে তার বারবার হাতবদল হওয়ার গল্পটা এই পৃথিবীর মতো প্রাচীন। নারী এভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। পুরুষতন্ত্র তাকে পণ্য বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বস্তুর মর্যাদাও তাকে অনেক সময় দেওয়া হয় না। হিরনের পথ চলার গল্পটা আমাদের সমাজের সেই আদিকালের নির্মম বাস্তবতাকে নতুন করে স্মরণ করার। হিরন এ দিক থেকে বিবেচনা করলে জিতে গেছে। সমস্ত উপেক্ষাকে জবাব দিয়েছে। কিন্তু এভাবে জিতে যাওয়া কি কাম্য? নিরাপদ তন্দ্রাচ্ছন্ন সমাজে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হিরনের আকুতি আমাদের অনুভবকে অসাড় করে দেয়। হিরনের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি বয়ে চলা চিরন্তন মর্মন্তুদ অন্যায়কেই উপস্থাপন করা হয়েছে এক অর্থে। এ যেন আবহমান কালের এক অমোঘ সত্য। নারীর জীবনযুদ্ধ আর সমাজবাস্তবতার এক অনুপম প্রকাশ মাহমুদুল হকের নিরাপদ তন্দ্রা লেখাটি।

নূর সালমা জুলি
জন্ম রাজশাহীতে ৭ আগস্ট, ১৯৮১ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষা বিষয়েও পড়েছেন। বর্তমানে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। ‘মাহমুদুল হক : একজন কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি’ গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের।