কথাসাহিত্যগল্প

হসপিটাল

তখনো সুদীপের মাথায় অবিরাম অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ বেজে চলছে।

‘রুগি আপনার কি হন?’

উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাদা এপ্রোনের ওপর কালো কোর্ট পরা নার্স সুদীপের হাত থেকে ভর্তির রশিদটা এক প্রকার টেনে নিয়ে ভ্রু কুচকে কি যেন পরীক্ষা করে। সুদীপ নিচু গলায় যে উত্তর দেয় তা কোলাহলের মধ্যে হারিয়ে যায়। এবার চড়া গলায় নার্স বলে, ‘রুগি আপনার কি হন?’

‘আমাকে বলছেন?’

‘জি, আপনাকে বলছি।’

‘আমার বাবা।’

‘কি হয়েছে ওনার?’

‘বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছেন।’

‘কীভাবে বুঝলেন স্ট্রোক করেছেন?’

‘পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছেন, বাম পা বাম হাত নাড়াতে পারছেন না।’

‘আপনি এই স্লিপটা নিয়ে সোজা সামনের ডক্টরস কেবিনে চলে যান, সেখানে ডক্টররা আছেন, তাঁরা বলে দেবেন কী করতে হবে।’

‘রুগি এই ট্রলিতে থাকবে?’

‘ডক্টর না বললে বেড পাবেন না। আপাতত ট্রলিতে থাক।’

‘রুমের সামনে দেখছি লম্বা লাইন, লাইন ধরতে হবে সিস্টার?’

‘লাইন তো ধরতে হবে। বন্ধের দিন কোত্থেকে যে এত রুগি এসে হাজির হয় আল্লাই জানে।’—বলে নার্স পুরুষ ওয়ার্ডের দিকে চলে যায়।

নারী-পুরুষ উভয় ওয়ার্ডে পা ফেলার স্থান নেই, পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দার বাম দিকে ৪৮, ৪৯, ৫০ তিনটা বেড পরপর, ৪৮ ও ৫০ নং বেডে রুগি আছে, মাঝখানের বেড খালি। ডান দিক থেকে কয়েকটা বেড এখনো খালি আছে, কিন্তু ওই দিক থেকে হুহু করে কলিজা কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। সুদীপ চিন্তা করে ডাক্তারকে ৪৯ নং বেডের কথাই বলবে। ৫০ নম্বর বেডের ওপর কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ হাঁটুজোড়া বুকের মধ্যে দুই হাতে চেপে ধরে ঘাটে বাঁধা খেয়া নৌকার দোল খাওয়ার মতো সামনে পিছনে দুলে দুলে হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে; প্রতিবার নিশ্বাস ছাড়ার সময় ‘ও আল্লাহ’ ‘ও আল্লাহ’ শব্দ করছে, যেন নিশ্বাসের সঙ্গে এই শব্দটা অনিবার্য। তার মতোই চিমটেলাগা এক মহিলা ময়লা সোয়েটারের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পিঠ মালিশ করে চলছে। আঠারো-উনিশ বছরের একটা মেয়ে বৃদ্ধের বুকের মধ্যে সরু হাত ঢুকিয়ে মালিশ করছে সামনে থেকে। গলায় ঝুলে থাকা তিন রকমের তিনটা লোহার ঘুঁটি দুলুনিতে টুংটুং শব্দ করছে। ঢেউয়ের গর্জনের উঠা নামার মতো কোলাহলেরও উঠা-নামা আছে, আর এই উঠা-নামার ফাঁকে ঢুকে পড়ে ঘুঁটির ঠোকাঠুকির শব্দ। মোটামতো এক নার্স এসে বলে ‘এভাবে শব্দ করবেন না, অন্য রুগির সমস্যা হয়, দেখছেন না আশপাশে কত রুগি আছে।’ নার্সের কথায় কর্ণপাত না করেই বৃদ্ধ দুলে দুলে ‘ও-আল্লাহ’ ‘ও-আল্লাহ’ করছে।

৪৮ নং বেডটা বাথরুমের খুব কাছে, বাথরুম থেকে মাঝে মাঝে ইউরিনের গন্ধ এসে নাকে লাগে; সেই বেডে এক বৃদ্ধ ঘুমাচ্ছে। তার পায়ের কাছে বোরকাপরিহিত এক তরুণী পা তুলে বসে মোবাইলে কি যেন দেখছে। তার দিকে চোখ পড়তেই তরুণী সুদীপকে বলে, ‘ভাই সিটের মধ্যে ব্যাগগুলো রাখেন, না হলে অন্য কেউ দখলে নিয়ে যাবে। দেখছেন না স্রোতের মতো রুগি আসছে। আপনি ব্যাগ রেখে লাইনে দাঁড়ান, আমি চাচাকে দেখছি।’

চেহারা দেখে বুঝেন না পুলিশ অফিসারের বউ, এদের ক্ষমতা অনেক, এদের পরিবারে সমস্যাও অনেক। পুলিশ অফিসারের মুখ দেখেননি শুকনা বেগুন, মানুষকে বিপদে ফেলতে কত মজা এখন অফিসার টের পাবে।

সুদীপ তরুণীর কথা মতো সিটের ওপর ব্যাগ রেখে লাইনে দাঁড়ায়। ভিড়ে ঢুকে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শরীরে আরাম বোধ করে। এর মধ্যে রুগি বহনের ট্রলির বিরক্তিকর ঘর ঘর শব্দ আর হৈহুল্লোড়ে বুঝা যায় আরো রুগি এসেছে। সুদীপের সামনে আরো তিন জন, ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে ভেতরে কী হচ্ছে। টেবিলের এক দিকে পর পর তিন জন ডক্টর মনোযোগ দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন। টেবিলের অপরদিকে এক নারী, এক যুবক, এক মাঝবয়সী লোক দাঁড়িয়ে আছে আসামীর মতো অসহায় ভঙ্গীতে। সামনের জনের জামাকাপড় থেকে খুনখুনে গন্ধ নাকে লাগে সুদীপের, কিছুক্ষণ পর মনে হচ্ছে গন্ধটা একেবারে খারাপ না, হাসপাতালের গন্ধের চাইতে ঢের ভালো। একজন সামনের জনকে সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিতেই তরুণী ডক্টর তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, ‘লাইন ভাঙবেন না, আমাদের কাজ করতে দেন, সবাই একসঙ্গে ঢুকলে আমরা কাজ করতে পারব না।’

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে একজন লাফ দিয়ে গিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া লোকটাকে টেনে পিছনে নিয়ে এলে অন্যরা বাহবা দেয়। লোকটা বলে, ‘আমি কি ঢুকছি, দেখছি ভিতরে কী করছে?’

পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘দেখাদেখির কিছু নাই, লাইনে দাঁড়ান, সবার রুগিই সিরিয়াস।’

কেউ একজন বলে, ‘বিপদে না পড়লে এখানে কেউ আসে?’

সুদীপের দেওয়া ভর্তির স্লিপের দিকে তাকিয়ে তরুণী ডাক্তার বলে, রুগি আপনার কী হন? রুগির বয়স কত? কী সমস্যা বলেন?’

‘রুগি আমার বাবা, বয়স ৭৩, বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছেন।’

‘বারান্দায় কয়েকটা বেড খালি আছে, যে কোনো একটাতে উঠিয়ে দেন, তারপর আমি এসে দেখছি।’

‘সামনের বেডগুলোতে ঠান্ডা বাতাস লাগছে, স্ট্রোকের রুগি ঠান্ডায় সমস্যা হবে। ৪৯ নং বেড হলে ভালো হয়।’

‘আপনার পিছনে দেয়ালে লাগানো যে বোর্ড আছে সেটা দেখেন, দেখেন ৪৯ নাম্বার আছে কি না?’

সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ৪৯ নাম্বারটা আছে।

‘আছে ডক্টর, আছে।’

‘তা হলে এই পেন দিয়ে ওটার ওপর ক্রস দেন, আর রুগিকে বেডে উঠিয়ে দেন।’

সুদীপ ট্রলিটা টেনে ৪৯ নং বেডের কাছে নিয়ে কিছুটা অসহায়ের মতো চারদিকে তাকায়।

বোরকাপরা তরুণী এগিয়ে এসে বলে, ‘ভাই একজন ওয়ার্ড বয়কে ডাকেন, আপনি মাথার দিক ধরবেন, ওয়ার্ড বয় মাঝখানে আর আমি পায়ের দিক ধরব।’

কিছুক্ষণ পর তরুণী ডাক্তার এসে প্রেসার মাপতে মাপতে বলে, ‘আপনি বলছেন বাথরুমে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেছেন, বাম হাত বাম পা নাড়াতে পারেন না।’

সুদীপ মাথা নেড়ে উত্তর দেয়।

‘ডায়াবেটিকস, প্রেসার আগে থেকে ছিল?’

‘ছিল, দুটোই ছিল।’

‘পড়ে গিয়ে হাত-পা অবশ হয়েছে কতদিন আগে?’

‘এই ধরেন দশ-বারো দিন হবে।’

‘এতদিন রুগি কোথায় ছিল, হসপিটালে নেননি?’

‘ছয়-সাত দিন বাসায় ছিল, পরে সদরে ভর্তি করেছি, সদর থেকে বলে রুগি নিয়ে যান, তখন এখানে নিয়ে এসেছি।’

‘ছয়-সাত দিন বাসায় ফেলে রেখেছেন কেন?’

তরুণী ডাক্তার তির্যকভাবে তাকিয়ে থাকলে সুদীপ অসহায় বোধ করে। চারতলা বাড়ির তিন তলার ছাদ ঢালাই চলছে, সেজন্য সময় করতে পারিনি, তাছাড়া এতটা সিরিয়াস সেটাও বুঝতে পারেনি—এই কথাটা বলতে পারত, কিন্তু ডাক্তারকে কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগে না।

‘রুগির বারোটা বাজিয়ে নিয়ে এসেছেন, রুগির হার্টের কন্ডিশান ভালো নয়, এনেছেন যখন রাতটা থাকুক, ভালো কার্ডিয়াক বিভাগ আছে এমন হাসপাতালে নিয়ে যাবেন সকালে।’

সুদীপ তার বাবার অর্ধনির্মিলিত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তার হাতে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে ডাক্তার বলেন, ‘বুঝেছেন? রক্তের এই টেস্টগুলো এখনই করাবেন। টেস্টের রেজাল্ট এলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দেখাবেন।’

তরুণী ডাক্তার চলে যাচ্ছিল, আবার থমকে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ক্যাথেটার কে লাগিয়েছে, ইউরিনে ব্লাড যাচ্ছে।’

‘সদরে লাগিয়েছে।’

‘আহা, ঠিক মতো লাগানো হয়নি, লাগিয়ে নেন।’

৪৮ নং বেডের বৃদ্ধ এখনো ঘুমাচ্ছে, ৫০ নং বেডের হাঁপানির রুগিকে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আরো কয়েকটা ট্রলি এসে গেছে, সবগুলো ট্রলি মহিলা ওয়ার্ডে ঢুকানো হয়েছে ঘর ঘর শব্দ করে।

তরুণী ডাক্তার চলে যাওয়ার পরপর ৪৮ নং বেডের বৃদ্ধ উঠে বসে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কি যেন বলতে থাকে।

‘এতক্ষণ শান্তিতে ছিলাম, আবার বকবক শুরু হয়ে গেছে’ বলতে বলতে বোরকাপরা তরুণী সুদীপের সামনে একটা স্লিপ মেলে ধরে সেখানে কী লেখা আছে দেখতে ইশারা করে।

‘ডায়াবেটিকস মাপার যন্ত্র আনতে বলেছে?’

‘এটার দাম কি বেশি?’

‘এটা আপনার কিনতে হবে না, আমার কাছে আছে। আমি নিচ থেকে এসে আপনাকে দেব। উনি আপনার আব্বা?’

‘জি, স্ট্রোক করেছে, কোনো সমস্যা নাই কেবল বেশি কথা বলেন, ঘুম থেকে উঠে বলেন মুরগি ডিম দিছে, গরুর বাছুর কই গেছে। বলেন তো, জান নিয়ে টানাটানি মুরগির ডিম দিয়ে কী করবেন?’

‘কখন স্ট্রোক করেছেন?’

‘ভোরে করেছেন, আজ বন্ধের দিন, সদরে কোনো ডাক্তার থাকে না, তাই ঢাকা নিয়ে এসেছি। এখানেও দেখি রুগি আর রুগি। আপনি নিচে যাবেন, এখানে দেখেন কী ওষুধ লিখেছে, ওষুধগুলো একটু এনে দেবেন?’

‘নিশ্চয় এনে দেব’ বলে সুদীপ প্রেসক্রিপশনটা পকেটে ঢুকাবে এমন সময় দুই জন নার্স এসে বলে, ‘৪৯ বেডের রুগির লোক কে?’

‘এই তো আমি।’

‘ব্লাড নিতে হবে, একটু শক্ত করে হাতটা ধরেন। পরপর তিন বার চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর মোটামতো নার্স বলে, ‘রক্ত নিতে পারছি না, ভেইন খুঁজে পাচ্ছি না, ওনাকে বেশি করে পানি খাওয়ান। এক ঘন্টা পর আবার চেষ্টা করব।’

‘আপনারা চেষ্টা করেছেন প্যরালাইসিস হওয়া বাম হাতে, প্যরালাইসিস হওয়া হাত থেকে কি রক্ত নেয়া যায়?’

সুদীপের দিকে কয়েক মুহূর্ত কটমট করে তাকিয়ে থেকে নার্সরা দ্রুত চলে গেলে ঝুলে থাকা বাম হাতটা তুলে দেয় যত্ন করে।

সুদীপ মেডিসিন নিয়ে ফিরে দেখে ৪৯ নং ওয়ার্ডের সামনে প্রচণ্ড ভিড়। নার্স ওয়ার্ড বয়, রুগির লোকজনের দোড়াদৌড়ি। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখে যে ট্রলি ঘিরে এত তৎপরতা সে ট্রলিতে সঙ্গাহীন এক তরুণী। পাশে লম্বা ও মজবুত শরীরের এক যুবক, চোখেমুখে তার অস্থিরতা। মাথার পাশে এক মাঝবয়সী নারী যুবককে বলছেন, ‘মুখে হাত ঢুকায় দেখ বমি করে কিনা। ফাজিল মহিলা, হাত ঢুকা। জোর করে হাত ঢুকা, মরার শখ হইছে তার।’ সেই মহিলা সম্ভবত যুবকের মা, তার নির্দেশে মুখে আঙুল ঢুকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় যুবক। পায়ের কাছে একটু দূরে একটা মেয়ে; কাজের মেয়ে হবে, তার কোলে দুই-আড়াই বছরের ফুটফুটে বাচ্চা।

সুদীপ ভিড়ের মধ্যে উঁকি দিয়ে সঙ্গাহীন তরুণীকে দেখে ঘাড় ঘোরাতেই বোরকাপরা তরুণী নিচু গলায় বলে, ‘বিষ খাইছে মহিলা, মহিলার একটা বাচ্চাও আছে। কি খাইছে জানেন? হারপিক খাইছে।’

পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘হারপিক খেতে গেল কেন, আর কিছু পায়নি। এত খারাপ জিনিস খেতে ভালো লাগল!’

‘কী জন্য খাইছে?’

‘চেহারা দেখে বুঝেন না পুলিশ অফিসারের বউ, এদের ক্ষমতা অনেক, এদের পরিবারে সমস্যাও অনেক। পুলিশ অফিসারের মুখ দেখেননি শুকনা বেগুন, মানুষকে বিপদে ফেলতে কত মজা এখন অফিসার টের পাবে।’

তরুণীর কথা শেষ হতে না হতেই তাকে দ্রুত মহিলা ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। মহিলা ওয়ার্ডে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল বন্দুকটা কাঁধ বদল করতে করতে বলে, ‘হারপিক ওয়াশ করা যায় না, এটা সঙ্গে সঙ্গে পাকস্থলিতে মিশে যায়।’

সুদীপ বলে, ‘আপনি এটা কী করে জানেন?’

‘এতবছর হাসপাতালে ডিউটি করি জানব না!’

পুলিশের বন্দুক দেখে ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায় সুদীপের। ছেলেটা একটা খেলনা বন্দুকের জন্য কত কান্নাকাটি করল, সে বলে আমি ক্রিমিনালদের খুন করব। অনেক কান্নাকাটির কারণে, আসলে ছেলের মায়ের চাপের মুখে অবশেষে খেলনা বন্দুক কিনে দেয় সুদীপ। খেলনা বন্দুক পেয়ে তার বুকে তাক করে ছেলে বলে, ‘তুমি ক্রিমিনাল, তোমাকে গুলি করব, তুমি আমাকে খেলনা কিনে দাও না, খেলতে দাও না, কেবল পড়তে বলো।’

৫০ নম্বর বেডের শ্বাসকষ্টের রুগি এখন শান্ত, পরের বেডের মাঝ বয়সী পুরুষ রুগি শান্ত থাকলেও তার স্ত্রীর বিলাপ কোলাহল ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কানে এসে লাগে। এর মধ্যে তরুণ এক ডাক্তার ভিজিটে এলে ৪৮ নং বেডের রুগি তড়িঘড়ি উঠে বসে।

‘দেখি চাচা বাম হাত উপরে তোলেন, পিছনে নেন, সামনে আনেন। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।’

‘ডাক্তার সাব, আমার কোনো অসুবিধা নাই, আমাকে ছেড়ে দেন, বাড়িতে আমার অনেক কাজ।’

বোরকাপরা তরুণীর দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলে, ‘ফিজিও থেরাপির ডাক্তার আসার কথা, এসেছে? না এলে নিয়ে আসবেন।’

৪৯ নং বেডের সামনে গিয়ে বলে, ‘ব্লাড টেস্টগুলো করিয়েছেন?’

‘সিস্টার এসে চেষ্টা করে দেখেছেন, ব্লাড নিতে পারেননি, ভেইন খুঁজে পাননি।’

‘নিতে পারেনি বললে হবে না, আবার চেষ্টা করতে বলেন, ব্লাড টেস্টটা জরুরি।’

রাত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে। সুদীপ মোটা কম্বল দিয়ে তার বাবার শরীর ঢেকে দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিন অন করে দেখে রাত এগারোটা। এর মধ্যে কোলাহল অনেক কমে এসেছে, নতুন রুগি আসা সন্ধ্যার পর থেকে কমেছে। লঞ্চের ডেকে বিছানা করার মতো বেডের পাশে পাশে বিছানা পাতার আয়োজন করছে রুগির এটেনডেন্টরা। বোরকাপরা তরুণী সুদীপকে বলে, ‘আপনি মাদুর বালিশ কিনে আনেননি? রাতে ঘুমাবেন কীভাবে?’

‘ঘুমাব কোথায়? ঘুমানোর কি জায়গা আছে?’

‘ওই দেখছেন না, সবাই ঘুমানোর আয়োজন করছে। একটু পরে দেখবেন বাথরুমে যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেছে। নিচে এগুলো বিক্রি হয়।’

‘আমি তো জানি না, এখন গেলে পাব?’

‘এত রাত কে আপনার জন্য এসব নিয়ে বসে আছে?’

‘তাহলে বসে কাটিয়ে দেব।’

শীতের রাত বসে কাটিয়ে দিতে পারবেন না। আমি মাদুর বালিশ কিনেছি, একটা বাড়তি কম্বলও আছে। এই সামনে বিছিয়ে ওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকবেন।’

‘আপনার লাগবে না?’

‘আমি আব্বার পাশে শুয়ে থাকব, দেখেন না পুরো বেডটা খালি, শুকনা মানুষ তো।’

এ সময় অদ্ভূত একটা শব্দ আসে বাথরুমের দিক থেকে। তাকিয়ে দেখে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ডান হাত বাথরুমের ওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে থাকা পনের-ষোল বছরের ছেলেটা তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কি যেন আনতে গেলে হঠাৎ কোমর থেকে লুঙ্গি খুলে পড়ে যায় লোকটার। ডায়াপার পরা লোকটা বহু চেষ্টা করেও বাম হাতটা নাড়াতে পারছে না, লোকটা চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু অদ্ভূত কিছু শব্দ ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না।

বোরকাপরা তরুণী এই দৃশ্য দেখে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তকাতেই সুদীপের চোখে চোখ পড়ে এবং তরুণী লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে। ডায়াপার পরা লোকটাকে দেখতে অদ্ভূত লাগে, মনে হয় পুরো হাসপাতালের সবগুলো রুগি এভাবে ডায়াপার পরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে নিজেকে লোকটার জায়গায় কল্পনা করে, কল্পনা করতে করতে একটা ঘোরের মধে চলে যায়, মনে হয় আস্তে আস্তে তার বাম হাত পা অবশ হয়ে আসছে। তখনই ছেলেটা দৌড়ে এসে লোকটার লুঙ্গি তুলে কোমরে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করে।

বিড়াল দেখে তরুণীর কথা মনে পড়ে, সে বলেছে, গতকাল নাকি বারান্দা দিয়ে একটা ক্রস জার্মান শেফার্ড কুকুরকে হেলেদুলে হেঁটে যেতে দেখেছে। এই নিয়ে তার কী বিস্ময়, হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে, তাও চারতলায় একটা কুকুর হেঁটে যাবে এটা কি করে সম্ভব।

সুদীপ তরুণীর দেওয়া মাদুরে বসে কম্বল মুড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে বাথরুমের গন্ধ এসে লাগে, দুটোরই তীব্রতা প্রকট। ৫০ নং বেড থেকে গোঙানির শব্দ আসে থেমে থেমে। এতগুলো স্ট্রোকের রুগির মধ্যে হাঁপানির রুগি বেমানান, এই রুগিটা অন্য রুগিদের জ্বালিয়ে মারছে, একটু আগেও দম নেয়ার সময় ‘আল্লাহ গো’, ‘আল্লাহ গো’ চিৎকার করেছে। ৪৯ নং বেডের রুগি স্ট্রোকের হলেও যতক্ষণ জেগে থাকে কেবল ততক্ষণ বকবক করে। এইসব বিবেচনায় তার বাবা একেবারেই শান্ত, কোনো রকম জ্বালাচ্ছে না। মাঝে মাঝে খাবারের নলে স্যুপ দিতে হয় আর ক্যাথেটারের নল বেয়ে নামা প্রশ্রাব ফেলে দিতে হয়। সুদীপ বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়, তরুণী বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে, তবে তার মুখ থেকে নেকাব সরানো। এই প্রথম সে তরুণীর মুখ পুরোপুরি দেখে, মুখজুড়ে গ্রাম্য সারল্যের ছাপ। আলো পড়ে নাকফুলটা ভোরের তারার মতো জ্বলজ্বল করে। মেয়েটা যে এত সুন্দরী ভাবতেই পারেনি। সন্ধ্যায় বলেছে, যে করেই হোক তার আব্বাকে বাঁচিয়ে তুলবে, আব্বা ছাড়া তার কেউ নেই।

মহিলা ওয়ার্ডের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে দুই একজন এটেনডেন্ট জেগে আছে, আর সবাই ঘুমিয়ে আছে। এর পর পুরুষ ওয়ার্ডে ঢুকতেই উষ্ণতায় শীতে জমে থাকা শরীরে আরাম বোধ হয়, সম্ভবত এই উষ্ণতার দরুন নার্সবক্সে দায়িত্বরত নার্সরা ঘুমিয়ে পড়েছেন, তবে একটা স্বাস্থ্যবান কালো বিড়াল জেগে আছে।

বিড়াল দেখে তরুণীর কথা মনে পড়ে, সে বলেছে, গতকাল নাকি বারান্দা দিয়ে একটা ক্রস জার্মান শেফার্ড কুকুরকে হেলেদুলে হেঁটে যেতে দেখেছে। এই নিয়ে তার কী বিস্ময়, হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে, তাও চারতলায় একটা কুকুর হেঁটে যাবে এটা কি করে সম্ভব। তরুণী ভেবছিল এই তথ্য শুনে সে লাফিয়ে উঠে বলেবে, ‘কী বলেন এটাও কি সম্ভব?’ কিন্তু তার নিস্পৃহতা দেখে তরুণী যে মনে মনে রাগ করেছে সুদীপ তা স্পষ্ট বুঝতে পারে।

পায়ে পায়ে তার বাবার মাথার কাছে এসে দাঁড়ায়, ডান হাতটা বাড়িয়ে সুদীপের হাতটা শক্ত করে ধরে, একটু একটু করে চোখের পাতা খুলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর চোখ বন্ধ করে, একটু পরে আলতো করে হাতটা ছেড়ে দেয়।

এরপর সুদীপ বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে আবার রুগির গোঙানী, চিৎকার, নার্সদের দোড়াদৌড়ি, এটেনডেন্টদের কথাবার্তায় আবার জেগে উঠতে থাকে ওয়ার্ড, জেগে উঠে হাসপাতাল।

ক্ষুধায় তলপেটটা কেমন চিনচিন করে; কিছু খাওয়া দরকার। ক্যন্টিনটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার, সেখানে গিয়ে দেখে কয়েকজন নবিশ ডাক্তার জটলা করে চা খাচ্ছে, সুদীপ কোণের চেয়ারে বসে পরোটা আর চায়ের অর্ডার করে। চায়ের পর সিগারেট খেতে পারলে ভালো হত, সিগারেট খাওয়ার জন্য হাসপাতালের বাইরে যেতে হবে। চা খেতে খেতে বোরকাপরা তরুণীর অনাবৃত মুখটা মনে পড়ে।

***
বেডে পা ঝুলিয়ে বসে সুদীপের আনা নাস্তা খেয়ে বোরকাপরা তরুণী মুখ বাড়িয়ে নিচু গলায় বলে, ‘আপনাকে একটা কথা বলব, মনে কিছু করবেন না। আপনারা কি হিন্দু?’

সুদীপ ইতিবাচক মাথা নাড়ে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে, ‘অসুবিধা নাই।’

সুদীপের ইচ্ছা করে ‘কিসের অসুবিধা নাই’ জিজ্ঞাসা করতে, কিন্তু তা আর করে না। তরুণীকে কিছুটা বিব্রত মনে হয়। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বেডের নিচে ময়লার গামলার দিকে দৃষ্টি পড়ে সুদীপের। বেগুনি রঙের প্লাস্টিকের গামলায় কমলার কোয়া, ডিমের খোসা, বিসকিটের গুঁড়োর সঙ্গে পাউরুটি ভিজে ফুলে উঠেছে।

সুদীপ বলে, ‘পাউরুটি খাননি? ফেলে দিয়েছেন?’

‘হাসপাতালের কিছু খেতে পারি না।’

‘না খেতে পারলে অন্যদের দিয়ে দেবেন। নষ্ট করবেন না।’

ময়লাগুলো এখনো ফেলেনি, দাঁড়ান আয়াকে কল করি। ওয়ার্ডের আয়াকে কল করতেই যে রিংটোনটা বাজে তাতে সুদীপ চমকে ওঠে। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী..।’ এই যে প্রায় নিথর হয়ে পড়ে আছে যে লোকটা, তার বাবা, উনিও এই গান গাইতেন। কিশোর কুমারের মতো দরাজ গলায় গাইতেন। বলতেন, কিশোর কুমারের গলায় প্রাণ আছে। কবিতাও লিখতেন, সিন্দুকে একটা কবিতার খাতা আছে, বলেছেন আরো কিছু দিন বেঁচে থাকলে একটা কবিতার বই বের করবেন।

***
বেলা বারোটার দিকে রুটিন ভিজিটে আসা ডাক্তার সুদীপকে ভারি গলায় বলেন, ‘এই রুগিকে এক্ষুণি কার্ডিওলজির আইসিইউ আছে এমন হাসপাতালে ট্রান্সফার করতে হবে। রিলিজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে নতুন হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখনো হাসপাতালের ট্রলি পাওয়া যায়নি, কোথায় পাওয়া যায় জানেও না। অ্যাম্বুলেন্সের ট্রলিতে রেখে সিসিইউতে চিকিৎসা চলছে, চিকিৎসা বলতে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, একজন এসে ইসিজি করেছেন। একজন নার্স একটু আগে ক্যানোলাতে কয়েকটা ইনজেকশন পুশ করে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার কয়েক দফা ট্রলি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে গেছে। ট্রলিটা ছেড়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু হাসপাতালের ট্রলি কোথায় পাবে? কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করেছে, কেউ ট্রলির কথা বলতে পারে না। তখন হঠাৎ বোরকাপরা তরুণীর কথা মনে পড়ে। ষণ্ডা মার্কা ওয়ার্ডবয়কে ডেকে পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে ট্রলির কথা বলতেই সে চোখ দিয়ে যে ইশারা করে তার মানে হচ্ছে ট্রলি পেয়ে যাবেন। এর মধ্যে আরো তিন তিনটা ট্রলি ঢুকলো রুগি নিয়ে, তাদের জায়গা দিতে সুদীপ ট্রলিটাকে আরো দেওয়ালের দিকে ঠেলে দেয়, আরো একটু চাপা যেত কিন্তু দেওয়াল ঘেঁষে একটা ময়লার ড্রাম রয়েছে। একটু আগে রুগির মলমুত্রযুক্ত ডায়াপার এনে ফেলেছে একজন। একেবারে ম্যাজিকের মতো হঠাৎ ট্রলি নিয়ে হাজির ওয়ার্ড বয়, রুগি শিফট করার পর তার কানে কানে বলে ‘একটা বেডের ব্যবস্থা করা যাবে?’

‘যাবে, ২৭ নং বেডের রুগির অবস্থা ভালো নয়, যখন তখন মারা যাবে, রুগিটা মারা গেলে ওই বেডে আপনার রুগি তুলে দেব, ততক্ষণ অপেক্ষা করেন।’

‘ওই রুগি মারা না গেলে বেড পাব না?’

‘মারা যাবে, এতে কোনো ভুল নেই, একটু সময় লাগতে পারে। আপনি অপেক্ষা করেন।’

‘রুগির কন্ডিশন কি একবার গিয়ে কি দেখে আসবেন?’—এই জাতীয় কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় ওয়ার্ড বয় বলে, ‘আপনার রুগির কন্ডিশনও তো ভালো না।’

‘রুগির কন্ডিশন যাই হোক, আমার একটা বেড দরকার, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যথা করছে, আর ভালো লাগছে না।’

এর মধ্যে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে বিরাট সাইজের একটা কাগজ রুগির শরীরে রেখে গেছে।

‘এতবড় কাগজটা কিসের?’

‘এখানে রুগির সব তথ্য আছে।’

সুদীপ জিজ্ঞাসা করে ‘আমার রুগির অবস্থা কি খুব খারাপ?’

‘খারাপই তো, সিভিয়ার এ্যটার্ক হয়েছে, অনেক দেরি করে ফেলেছেন, দেখা যাক, আল্লাহ ভরসা।’

সুদীপ জ্যাকেটের পকেট থেকে চার্জার বের করে মোবাইলে চার্জ দেয়, তার দেখাদেখি আর একজন এসে চার্জ দেয়। কিছুক্ষণ পর পর দারোয়ান এসে রুগির বাড়তি এটেনডেন্টদের টেনে টেনে বের করে দিচ্ছে, আর চিৎকার করে বলছেন ‘বাড়তি লোক থাকতে পারবেন না।’

এই দৃশ্য দেখতে সুদীপের ভালো লাগে। একের পর একটা রুগি আসে, ডাক্তার নার্স দৌড়ে যায়, এই যন্ত্র সেই যন্ত্র লাগায়, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বুকে চাপতে থাকে, এমনভাবে চাপতে থাকে মনে হচ্ছে মড়মড়িয়ে পাঁজর সব ভেঙে যাচ্ছে।

চোখ ঘুরিয়ে লাল প্যান্ট পরা ওয়ার্ডবয়কে খোঁজার চেষ্টা করে। ভিতর থেকে ওয়ার্ডবয় কি একটা কাজে বেরিয়ে এলে সুদীপ এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘মরেছে?’

‘না, মরেনি, মরবে।’

সুদীপ বিরক্ত হয়ে সময় কাটানোর জন্য মোবাইলে মনোযোগ দেয়।

একজন নার্স এসে ক্যনোলাতে পর পর কয়েকটা ইনজেকশন দিয়ে শিটের মধ্যে কিসব লিখে চলে যায়। নার্স চলে যাওয়ার পর পর ওয়ার্ডবয় এসে বলে, ‘ওই রুগি মরে গেছে, ডেথ সার্টিফিকেট নেয়া হলে লাশ চলে যাবে, তখন বেডে তুলে দেব।’

বেডে তুলতে তুলতে রাত প্রায় বারেটা বেজে যায়, পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা। সিসিইউ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই চোখেমুখে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে। বাইরে যে এত ঠান্ডা এতক্ষণ বুঝতেই পারেনি। একটু এগিয়ে যেতেই ফুটপাতে দেখে পর পর কয়েকটা দোকানে পরোটা আর ডিম ভাজা হচ্ছে। ডিম ভাজার ঘ্রাণটা মগজের মধ্যে ঢুকে ভোঁ ভোঁ ঘুরতে থাকে লাটিমের মতো, আহা কত দিন ডিম ভাজা পরোটা খাওয়া হয় না। গাট্টাগোট্টা কালো একটা কুকুর চুলার পাশে শুয়েছিল; সুদীপ ডিম-পরোটার অর্ডার করে বসতেই কুকুরটা উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে থাকে। সুদীপ এক টুকরো ডিম পরোটায় পেঁচিয়ে কুকুরের সামনে দিতেই দোকানদার বলে ওঠে, ‘প্রশ্রয় দিয়েন না, প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠবে।’

‘না থাক, এদের আমরা না দিলে বাঁচবে কী করে?’

দোকানদার তর্কে না জড়িয়ে ডিম উল্টাতে লেগে যায়। ডিম-পরোটার পর চা খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দিতেই মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আর তখনই রড সিমেন্টের দাম যে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে সেই দুশ্চিন্তা এসে মাথাটা আবার জ্যাম করে দেয়।

অভ্যাসবশত পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্ক্রিন অন করতেই দেখে বেশ কয়েকটা কল, আননোন নাম্বার থেকে। সুদীপ কল করতেই অপর প্রান্ত থেকে বলে, ‘আপনি সুদীপ? আপনি কোথায়? আপনার রুগি মরে গেছেন, তাড়াতাড়ি আসেন।’

‘আসছি’—বলে কল কেটে দিয়ে সিগারেটে লম্বা একটা টান দেয়, একগাল ধোঁয়া ছাড়ে, সিগারেটের গোড়ালি ছুঁড়ে ফেলে, কুকুরের মাথায় হাত বুলায়। পরোটা উল্টে দিয়ে দোকানদার বলে ‘কী হইছে?’

‘না, কিছু হয়নি’ বলে হাসপাতালের দিকে হাঁটতে থাকে।

***
অ্যাম্বুলেন্সটা অনেক বড়, ড্রাইভারের পিছনের সিটগুলো বেশ আরামদায়ক; সেখানে বসে বেশ আরামবোধ করে সুদীপ। এতবড় অ্যাম্বুলেন্সে ড্রাইভার ছাড়া সে, আর তার বাবা; বাবা ঠিক নয়, বাবার লাশ।

তরুণীর কথা মনে পড়ে, মেয়েটা কত বোকা। আসার সময় বলেছে, কল করে তার আব্বার অবস্থা জানাবে। তার ফোন নাম্বারই নেয়নি, কল করে জানাবে কী করে!

মসৃণ রাস্তায় সাইরেন বাজাতে বাজাতে ঢাকা শহর ছেড়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলছে। নিশুতি রাতে সাইরেনের শব্দকে দানবের আর্তনাদ মনে হয়। কিছুটা তন্দ্রার মতো এসে যায়, এই সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠে। সুদীপ দেখে অপরিচিত নাম্বার। নিশ্চয় বাড়ি থেকে কল করেছে, লাশ নিয়ে কখন পৌঁছবে এই তথ্যের জন্য।

‘ড্রাইভার সাব, পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগতে পারে? মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে কল করেছে। রাতের মধ্যে কাজ সারতে হবে।’

‘ধরেন, আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট, কুয়াশার জন্য সমস্যা, না হলে কত আগে পৌঁছে যেতাম। বুঝছেন না, রাস্তাঘাট অনেক ভালো, যত কথা বলেন দেশে উন্নয়নের একটা …’

‘ভাইয়্যা, আব্বা নাই, আমার সব শেষ… আমার দুনিয়াতে কিছু নেই… এরা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে…।’ অপর প্রান্ত থেকে সেই তরুণীর কান্না।

কান্না দ্রুত সংক্রমিত হয়, তাই তরুণীর কান্নায় সুদীপের কান্না আসার কথা, কিন্তু তার কান্না আসছে না। তরুণীর সেই রাতে দেখা মুখমণ্ডল, সেই ভোরের তারার মতো নাকফুলের কথা মনে করার চেষ্টা করে, কিছুই মনে করতে পারে না।

‘…বুঝেছেন ভাই, যত কথা বলেন দেশে উন্নয়নের একটা…। ড্রাইভারের কথাটাও সুদীপের কানে যায় না।

লেখাটি শেয়ার করুন :

খোকন দাস

খোকন দাস জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭০। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিতে। প্রকাশিত বই : সাদা হাতি নীল হাতি [শিশুতোষ গল্প, ২০১৫], গল্পগ্রন্থ : কাক ও অন্যান্য গল্প [২০১৮], খড়ের মানুষ [২০২০]।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!