কথাসাহিত্যগল্প

সমান্তরালে

কবিতা লিখে কখনো কবিরাজ হওয়া যায় না।

আমি কবিতা লিখি। পুরো জীবনে আমি বহু কবিতা লিখেছি। আমার কবিতা পাঠ করে পাঠকেরা পুলকিত হয়, আমার কবিতার আবৃত্তি শুনে শ্রোতারা বিস্ময়ে হাততালি দেয়, আমার কবিতা বিশ্লেষণ করে দেশ-বিদেশের বহু গুণিজন সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। যে শহরে যাই সেখানে সুধীরা আমাকে কবি বলে ডাকেন, আমার কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। শুনেছি, আমাকে নিয়ে নোবেল কমিটির বিশেষ ভাবনা রয়েছে। যেকোনো বছর হঠাৎ করে আমাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হতে পারে।

তবে আমার খ্যাতি কোনোভাবেই আমাদের এই মফস্বল শহরে বসবাসরত একজন নামধন্য কবিরাজের চেয়ে বেশি নয়। বিষয়খানা আমি উপলব্ধি করতে পারি নাজিরের চায়ের দোকানে বসে ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে। আমি হঠাৎ শুনতে পাই কারা যেন ‘কবি কবি’ করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছে। একজন কবিতা শ্রমিক হিসেবে আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়। একটু ভালো করে লক্ষ করলে আবিষ্কৃত হয়, আমার থেকে কয়েক হাত দূরে বসা দুইজন পড়ন্তবয়সী চুলপক্ক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির কথোপকথনের মধ্য হতেই অস্পষ্ট খণ্ডিত ‘কবি… কবি…’ স্বর ভেসে আসছে।

আমি ভাবনায় সাগরে হাবুডুবু খাই। লুঙি-পরা দুইজন পড়ন্তবয়সী অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত লোক কবি ও কবিতার কী বোঝেন! আমার ভাবনা ভুল নয়। কারণ, কবি কখনো ভুল করে না।

কবি একজন রূপান্তরক। কবি তার কলমের খোঁচায় হৃদয়কে পাহাড়, বক্ষকে জমিন, মেঘকে তুলো বানিয়ে দেন। আমরা কবির সেই সুউচ্চ পাহাড়ে চড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি, কবির উর্বর জমিনে ধানের চারা লাগাই, রাত্রিবেলা কবির কার্পাস তুলোর বালিশে মাথা রেখে ঘুমরত হই।
মনোযোগের তীর আরেকটু তীক্ষ্ণ করতেই আমার কাছে তাদের আলাপচারিতার বিষয়বস্তু স্বচ্ছ ঝর্ণার জলের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তাদের আলাপচারিতা কবি কিংবা কবিতা নিয়ে নয়। তারা বরঞ্চ শহরের একজন জাঁদরেল কবিরাজকে নিয়ে আলাপে মশগুল।

কবিরাজের নাম ড. মফেজ উদ্দিন।

শহরের সর্বস্তরের মানুষ তাকে মফেজ হুজুর নামে চেনে। স্বদেশে পদার্থে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে সুদূর আমেরিকাতে ছিলেন পঁচিশ বছর। উচ্চতর গবেষণায় তার পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি রয়েছে বলে যে জনশ্রুতি রয়েছে, তার বিস্তারিত জনতা জানে না। আমি অবশ্য অল্প বিস্তর জানি। মূলত কবিদের অনেক কিছু জানতে হয়, না জানলে কবিত্ব থাকে না। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ড. মফেজ উদ্দিনের বিশেষ গবেষণা রয়েছে।

তবে পদার্থবিদ হবার কারণে তার যে খ্যাতি তার চেয়ে কবিরাজ হিসেবে তার নাম-ডাক শতগুণ বেশি। শহরের মুটে থেকে ঘুটে সবাই তাকে চেনে। দেশের উপরতলার রাঘব বোয়ালেরা তাকে সমীহ করে চলেন। মাঝে মাঝে রাজধানী থেকে মানুষ আসে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে। তাদের বেশভূষায় বিশিষ্ট মানুষ বলে মনে হয়। তারা কেউ কেউ দেশের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কেউ কেউ সমস্যাগ্রস্ত উচ্চবিত্ত ব্যক্তি।

সেই দুজন পড়ন্তবয়সী লোকের আলাপচারিতা থেকে নাজিরের চায়ের দোকানে বসে আমি ড. মফেজ উদ্দিন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারি। তিনি সম্প্রতি কবিরাজি বিদ্যার সাথে পদার্থ বিদ্যার বিশেষ সংযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছেন। তিনি অন্য কবিরাজের মতো ফুঁৎকার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বের করে আনতে চান। এজন্য তিনি একজন সাগরেদ খুঁজছেন। এই মুহূর্তে একজন উচ্চ শিক্ষিত সাগরেদ তার প্রয়োজন।

আমি কথাটি জেনে মফেজ হুজুরের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।

শহরের সকলের একচ্ছত্র ধারণা, মফেজ হুজুরের কাছে মানবজীবনের যে কোনো সমস্যার প্রতিকার রয়েছে। তার দাওয়াই অব্যর্থ ও অকল্পনীয়। তিনি সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের এমন প্রতিকার বাতলে দেন যার ওছিলায় সব মুশকিল বাপ বাপ করে জানালার ফাঁক গলে পালিয়ে যায়। তাদের জীবনে আর সেই সমস্যার স্থান থাকে না।

এই যেমন আমার পাড়ার ছমিরউদ্দিনের বউ—তার কোনো বাচ্চা হত না। দুনিয়ার বহু নামী-দামী ডাক্তারের কাছে তিনি চিকিৎসা নেন, তবে কোনো ফল পাওয়া যায় না। মফেজ হুজুরের কাছে যাবার পর তিনি তাকে তিনটি শস্য দানা দেন। সেই তিন শস্যদানা খাওয়ার দিনকতক পরেই অলৌকিকভাবে ছমিরউদ্দিনের বউ আলেয়ার পেট ফুলে ওঠে, তিনি গর্ভবতী হন। অতঃপর পরপর তিন বছরে তিন তিনটা পুত্র সন্তানের মুখ দেখেন তিনি। তবে সেই তিন পুত্র সন্তানকে এলাকার মানুষেরা ছমিরউদ্দিনের সন্তান বলতে নারাজ। তারা বলেন, তারা মফেজ হুজুরের অলৌকিক সন্তান। অনেকের ধারণা, মফেজ হুজুরের বীর্য ওই তিনটি শস্যদানার মধ্যে নিহিত ছিল।

শহরবাসী আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। আমরা রয়েছি সময়ের একটি বিশেষ শাখায়। গাছের যেমন শাখা থাকে সময়েরও শাখা-প্রশাখা থাকে। সময়বৃক্ষের একটি শাখায় আমাদের বর্তমান অবস্থান।

আর আমার বাড়ির সীমানার পশ্চিম পাশের ভবঘুরে কুদ্দুসের কথাই ধরুন। দিন আনতে পান্তা ফুরাত। মফেজের কাছে যাবার পর কী যে গুপ্তধন হাতে পেয়েছে সেটা কুদ্দুসই ভালো জানে! এখন সে দামী ব্র্যান্ডের পোশাক ছাড়া পরে না, মাথায় সুগন্ধী তেল লাগিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে বসে থাকে খোশ মেজাজে, মনে হয় তার জীবনে আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কেউ তার পরিবর্তন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বলে—সবই মফেজ হুজুরের ক্যালমা। তার কাছে এসব নস্যি ব্যাপার।

প্রকৃতপক্ষে মফেজ হুজুরকে ভেবে আমি আমার জীবনের মহামূল্য সময় অপচয় করার যৌক্তিক কারণ পাই না। ডক্টরেট সম্পন্ন করে কোনো ব্যক্তি কবিরাজি পেশা বেছে নিয়েছে ব্যাপারটা আমার কাছে বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্য নয়। তবু তাকে নিয়ে ভাবনার প্রবাহ কেন যে বারংবার আমার মস্তিষ্কের মধ্যে চলে আসছে বিষয়টি বোধগম্য হচ্ছে না।

সাধারণত আমার ভাবনায় থাকে শুধু কবিতা। সামনে বছর আমার আরেকটি নতুন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার কথা। সেই কাব্যগ্রন্থে আমি এমন কিছু সংযোজন করতে চাই যা বিশ্বের সব জ্ঞানীদের ধ্যানধারণা পাল্টে দেবে। থমাস মুরের ‘ইউটোপিয়া’ থেকেও আশ্চর্য এক সমাজব্যবস্থার ধারণা আমি সেখানে দেব। যে সমাজ ব্যবস্থার সূচনা হয় মিথ্যের উপর ভিত্তি করে। কোনো সত্য সেই সমাজে থাকে না। ভুল করে যে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়, তার জীবনটা পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। তাকে নিক্ষিপ্ত করা হয় মিথ্যের পুকুরে। সেখানে স্নান করার পর সে আর কোনোদিন সত্য ভাবনা ভাবতে পারে না। তার সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কোনো অধিকার থাকে না। তবে হুট করে সেই সমাজ ব্যবস্থার আইন উল্টে যায়। মানুষকে তখন শুধু সত্য বলতে হবে। যে মিথ্যে বলবে তাকে নিক্ষিপ্ত করা হবে সত্যের পুকুরে। সেখানে স্নান করার পর সে আর কোনোদিন মিথ্যা ভাবনা ভাবতে পারবে না। সমাজের কল্যাণে সে নিজের জীবন, নিজের পরিবার বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হবে। তবে মানুষ সত্য মেনে নিতে পারে না। বহুকালের মিথ্যের অভ্যাস থেকে বেরুতে পারে না। শুরু হয় মহাবিপর্যয়। সেই মহাবিপর্যয়ের মুহূর্তের অনুভূতি নিয়েই আসিতেছে আমার নতুন কাব্যগ্রন্থ।

আমার নয়া কাব্য ভাবনায় ছেদ পড়ে একজন ব্যক্তির কথায়। চোখ তুলে দেখি নাজির আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিরক্তিসূচক চাহনিতে। সে আমাকে বেশ কড়া ভাষায় বলে, ‘স্যার, আপনার বাকি দুই হাজার তিনশত বিয়াল্লিশ টাকা!’

একবার ভাবুন, কী বজ্জাত ব্যাটা! একজন কবির কাছে চায়ের বিল চায়! চাইবি তো চাইবি সকলের সম্মুখে এভাবে!

লুঙি-পরা পড়ন্তবয়সী দুজন ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। নাজিরের উদ্ধত আচরণ কিংবা আমার বাকিতে চা পান করা নিয়ে তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে নানা ভাবনার জাল বিস্তার লাভ করে।

গত কয়েক মাস না হয় আমি বড় অর্থকষ্টে রয়েছি। তাই বলে, নাজির আমাকে এভাবে অপমান করল! বিষয়টি আমি মন থেকে মেনে নিতে পারি না। সকালবেলা করে নাজির আমার মেজাজটা বিগড়ে দেয়। আমার পকেটে এখন টাকা থাকলে নাজিরের মুখের ওপর পাঁচটি এক হাজার টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে বলতাম, ‘নাজির, এই নে তোর চায়ের বকেয়া বিল। খাতা কেটে রাখ। বাকিটা অগ্রিম।’

তবে বাস্তবতা ভিন্ন, তাই মনকে একটু থিতু করতে বাধ্য হই। আমার পকেট প্রায় শূন্য। সালেহার প্রচণ্ড জ্বর। গত সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জ্বরের কোনো কারণ জানাতে পারেননি। শুধু বলেছেন, এমন ব্যতিক্রমী জ্বর তিনি কোনোকালে দেখেননি। ক্ষণে ক্ষণে সালেহার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, আবার কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রার এই উত্থান-পতন সালেহাকে মুষড়ে ফেলছে। ডাক্তার মহাশয় আমাকে পরামর্শ দেন, যেন রাজধানীতে নিয়ে আরও অভিজ্ঞ ডাক্তার দেখাই। সালেহার জ্বরের ওষুধ কেনার টাকাটা ব্যতীত আমার সাদা ফতুয়ার পকেটের এখন অন্য কোনো টাকা অবশিষ্ট নেই।

অবশ্য আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝিতে আমার একটা বিল পাবার কথা রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের এক স্বনামধন্য সাহিত্য সম্পাদকের কাছ থেকে বিলটা পাবার কথা। তবে তিনি তিন সপ্তাহ ধরে আমাকে চর্কির মতো ঘুরাচ্ছেন। আসলে তিনি বিলটা দেবেন নাকি খেয়ে ফেলবেন বিষয়টি আমার কাছে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার এই দুর্দিনে তিনি যদি বিলটা না দেন—তাহলে আর কখনো সেই পত্রিকায় লেখা পাঠাব না। আমার নতুন কাব্য ভাবনা থেকে বঞ্চিত হবে তাদের পত্রিকা।

হ্যাঁ, সালেহার কথা বলছিলাম। ওর প্রচণ্ড জ্বর। আমার একমাত্র মেয়ে। বয়স চৌদ্দ বছর। দেখতে অবিকল তার মায়ের মতো। টানা টানা চোখ। ফর্সা মুখশ্রী। বাদামি ঠোঁট। আর ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট তিল। সালেহা আমার কাছে শুভ্রতা আর পবিত্রতার প্রতিচ্ছবি। সে ছাড়া এই জগতে আমার আপনজন বলতে কেউ নেই। ওর ভালো-খারাপ, চাওয়া-পাওয়া, আবেগ-অনুভূতিই আমার জীবন।

তাই আমি সালেহার অসুস্থতার কথা নাজিরকে জানাতে দ্বিধা করি না। আমার মাথার কালো রঙের বেরেট ক্যাপটা খুলে নিচুস্বরে তাকে বলি, ‘টাকাটা সামনে মাসে নিস। সালেহা প্রচণ্ড অসুস্থ। ওর জন্য অনেক টাকা যাচ্ছে।’

সালেহার কথা শুনে নাজির আর কিছু বলে না। বিড়বিড় করতে করতে সে দ্রুত পায়ে তার চা বানানোর টোঙে চলে যায়।

নাজিরের চায়ের দোকান অত্র শহরের এক নাম্বার। দূর-দূরান্ত থেকে নাজিরের চায়ের কাপে চুমুক দিতে মানুষেরা ভিড় জমায়। তার টোঙের আশে পাশে কাঠের বেঞ্চি ও প্লাস্টিকের টুলের সমাহার। এত এত চা প্রেমীদের চা সরবারহ করতে হিমশিম খায় নাজির। তাই আমার সাথে বেশি কথা বলতে পারে না সে। তবে সামনে মাসে তার চায়ের বিলটা না দিতে পারলে আমার নামে যে কেলেঙ্কারি রটার সম্ভাবনা রয়েছে যাবার সময় খিস্তি কেটে সে কথাটি বুঝিয়ে দেয় নাজির।

অবশ্য কোনোক্রমে এই বছর নোবেল পুরস্কারটা পেয়ে গেলে আমার অর্থকষ্টের কিছুটা লাঘব হত। বিশেষ করে আমার বর্তমান জীবনের দুটি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হত। নাজিরের চায়ের বিলটা চুকিয়ে দেওয়া যেত। সালেহাকে ভালো চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে নেয়া যেত।

সামনে অক্টোবর মাস। নোবেল কমিটি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করবে। তারা আমার নামটা নির্বাচিত করে ফেললে আমার ভাগ্যটা পাল্টে যাবে। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ততদিনে অনেক কিছু ঘটতে পারে আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। সালেহার শরীর আরও ভেঙে পড়তে পারে, আমার নামে কেলেঙ্কারি রটে যেতে পারে, আমি শূন্য হয়ে মহাশূন্যে পাড়ি জমাতে পারি। সময় বড্ড কম। সময়ের স্বল্পতা আমাকে অস্থির করে তোলে।

গতকাল রাতের কথা বলি। জরাজীর্ণ টেবিলের ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বের করে মেয়েটাকে বললাম, ‘সালেহা! মুখটা হা কর তো। দেখি তোর জ্বর কত!’

সালেহা ককিয়ে ওঠে বলে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘বাবা! জ্বর বেড়ে যাচ্ছে, আবার মাঝে মাঝে শরীর হিম হয়ে আসছে। আমি আর পারছি না। আমাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নাও।’

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল ছলছল করে ওঠে। আমার চোখের সম্মুখে অগুনিত সালেহার মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। ভাবি এই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অসুখে পড়েছে, আর তাদের আপনজনেরা আমার মতো অস্থির হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এই ঘটনার পর থেকে আমি স্বার্থপর হয়ে উঠি। কারণ কবিদের স্বার্থপর হতে হয়। জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে আমি ভাষা উগরে দিতে থাকি অনবরত। এতে করেই বিশ্বব্যাপী আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।

মুহূর্তের মধ্যে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন আসতে পারে। অনেক সমস্যার সমাধান মাথায় খেলে যেতে পারে। নাজিরের চায়ের দোকানে বসে সালেহার কথা বারবার মনে আসতেই ড. মফেজ উদ্দিনের কবিরাজির হাকিকত নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কী হুজুরের কাছে গেলে কাজ হয়! অনেকের ক্ষেত্রেই তো হয়েছে, তবে সালেহার বেলায় হবে না কেন!

আড়চোখে আমি পড়ন্তবয়সী দুজনের দিকে তাকাই। আমার তাকানো দেখে তারা একটু ইতস্তত বোধ করে। আমি আমার প্লাস্টিকের টুলটা সরিয়ে তাদের কাঠের বেঞ্চের কাছে নিয়ে যাই, তাদের দিকে একটু ঝুঁকে উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনারা একটু বলবেন, মফেজ হুজুর কয়টায় সাক্ষাৎ দেন।’

পড়ন্তবয়সী লুঙি-পরা লোক দুজন আমাকে নিঃসন্দেহে চেনে। কারণ আমি জগৎ বিখ্যাত একজন কবি। তারা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। আমার মতো একজন ব্যক্তি হুজুরের কাছে যেতে পারে তা তাদের ভাবনার বাইরে। তাদের মধ্যে নীল পাঞ্জাবি পরা লোকটি আমাকে বলেন, ‘প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মফেজ হুজুর সাক্ষাৎ দেন। কিন্তু আমার একখান প্রশ্ন, আপনি কী কারণে?’

আমি তাদেরকে বলি, ‘মেয়েটার অসুখ, তাই হুজুরের সাথে পরামর্শের ইচ্ছে।’

তারা আমার কথা গিলতে পারে না। কারণ গতবছর শহরে মফেজ হুজুর-বিরোধী যে সমাবেশ হয়েছিল, তার প্রধান বক্তা ছিলাম আমি। সেখানে আমি মফেজ হুজুরকে একজন ভণ্ড কবিরাজ হিসেবে উল্লেখ করি। তখন আমার ছমিরউদ্দিনের বউ কিংবা ভবঘুরে কুদ্দুসের কথা জানা ছিল না এমনটি নয়। কবিদের মূলত কবিরাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। কবিরাজির মতো মন্দ শক্তি সমাজকে গ্রাস করে নিলে কবিদের অস্তিত্ব থাকে না।

পড়ন্তবয়সী দুজনের চোখে আমি সংশয় লক্ষ করি। কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে আমার মফেজ হুজুরের খোঁজ-খবর নেয়া কিনা তারা বিষয়টি অনুধাবন করতে চান। বিশেষ করে সাদা পাঞ্জাবি পরা অন্য পড়ন্তবয়সী লোকটি আমাকে নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকেন। আমি কৌশলে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকি।

কিছুক্ষণ পর আমি নাজিরের চায়ের দোকান থেকে বাড়ি ফিরে যাই।

সালেহার দিকে তাকানো যায় না। তার চোখের কোণে কালশিটে দাগ পড়েছে। শরীরের তাপমাত্রা কমে হিম হয়ে আসছে, কয়েক সেকেন্ড পর আবার তাপমাত্রা বেড়ে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আমি কিছুই করতে পারছি না। নিজের দারিদ্র্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি আমি। কিন্তু এজন্য কাকে দোষ দেব সেই বিষয়টি নিয়ে আমি এখনও দ্বিধান্বিত। নিজেকে নাকি রাষ্ট্রের উপর চেপে বসা দীর্ঘমেয়াদী জগদ্দল পাথরকে অভিযুক্ত করব সেই সিদ্ধান্ত নিতে মাথার মধ্যে মস্তিষ্কঝড়ের সৃষ্টি হয়!

জগদ্দল পাথরের কথা যেহেতু বলছি তাহলে তার ইতিহাসে আসা যাক। বিশ বছর আগে এক গ্রীষ্মের দুপুরে হুট করে এক বিশাল পাথরের আবির্ভাব হয় রাজধানীর মধ্যিখানে। দৈর্ঘ্যে ২৩ ফিট, প্রস্থে ১৮ ফিট, রঙ কালো। দিনে দুপুরে কীভাবে পাথরটি রাজধানীর প্রধান উদ্যানের মাঝখানে আসলো তা রাষ্ট্রের কেউ টের পায়নি। ঐশী কোনো শক্তির বলে পাথরটির আগমন নাকি কেউ উদ্যোগী হয়ে পাথরটি নিয়ে এসেছে সে বিষয়ে কেউ শতভাগ নিশ্চিত নয়। প্রথমে পার্কের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা পাথরটিকে দেখতে পায়। তারা কর্তৃপক্ষকে জানায়। এরপর দিন দশেক পর পাথরটির কথা রাষ্ট্রশুদ্ধ মানুষ সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারে। সেই জগদ্দল পাথরের রয়েছে অমিত শক্তি। যে পাথরকে স্পর্শ করছে, সেই পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

মাস দেড়েকের মাথায় বিশ্বজুড়ে পাথরটি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়, যা এখনো চলমান। যেদিন থেকে এই জগদ্দল পাথরের আবির্ভাব হয় সেদিন থেকে রাষ্ট্রশুদ্ধ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। সেই পাথরের অভিশাপে আমি আজ একজন স্কুল শিক্ষক থেকে বেকার কবি। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে আমাকে আমার স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেবার কারণ—আমি একজন কবি। পাঁচ বছর পূর্বে আমি জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে একটি বাক্য রচনা করেছিলাম। তারপর মুক্ত মঞ্চে জনতার সম্মুখে আমি সেই লাইন পাঠ করি। জগদ্দল পাথর বিষয়টি টের পেয়ে যায়। তাই ধীরে ধীরে সে আমাকে নিঃস্ব করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সুযোগ বুঝে সে আমার স্ত্রীকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মেরে ফেলে চারতলার গলির মুখে।

এই ঘটনার পর থেকে আমি স্বার্থপর হয়ে উঠি। কারণ কবিদের স্বার্থপর হতে হয়। জগদ্দল পাথরের বিরুদ্ধে আমি ভাষা উগরে দিতে থাকি অনবরত। এতে করেই বিশ্বব্যাপী আমার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। এখন আমার ধারণা হচ্ছে, সালেহার জ্বর স্বাভাবিক ঘটনা নাও হতে পারে। জগদ্দল পাথর সালেহার মধ্যে জ্বর ঢুকিয়ে দিল কি না, বিষয়টি নিয়ে বিস্তর সন্দেহ দানা বাঁধছে আমার মধ্যে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিই, মফেজ হুজুরের কাছে আমাকে যেতে হবে, তাকে সব কথা বলতে হবে।

বিকেল তিনটায় আমি মফেজ হুজুরের কাছে যাবার জন্য বের হই। মফেজ হুজুরের আস্তানায় যেয়ে আমি যা দেখি তা বিশ্বাস করার মতো নয়।

মফেজ হুজুর অন্য সব হুজুরের মতো নয়। খুব সাদাসিদে পোশাকে তিনি একটা সোফার উপর বসে আছেন। গায়ে সাদা শার্ট, আর পরনে ঢিলেঢালা সাদা প্যান্ট। তার পাশে বসে আছেন ড. রুবার্ট হুলিয়ান। তিনি গতবছর পদার্থে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

গতবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার কে পেয়েছে জানার আগ্রহে টিভি সেটের সামনে বসে ছিলাম। সেই সময় রুবার্ট হুলিয়ানের নাম এবং ছবি স্ক্রিনে ভেসে উঠে স্লাইডিং করে। আমার স্মৃতি শক্তি প্রখর। তাই তার মুখখানি ভুলি নাই। একজন জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিদ এদেশে এসে একজন কবিরাজের সাথে আলাপচারিতা করছে দেখে আমার মাথাটা ঘুরপাক খায়।

তাহলে কী ড. মফেজ উদ্দিন পদার্থ বিজ্ঞানের এমন কোনো তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন যা পুরো বিশ্বের পদার্থ বিজ্ঞানীদের আগ্রহের বিষয়। রুবার্ট হুলিয়ান মফেজ হুজুরের সাথে কথা বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। দেশের মিডিয়ার চোখ ফাঁকি দিয়ে যেখানে একটা মাছিও ভোঁ-ভোঁ করতে পারে না সেখানে নীরবে রুবার্ট হুলিয়ানের আগমন ও প্রস্থান আমার মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। কানাঘুষোয় জানতে পারি, রুবার্ট হুলিয়ান বাংলাদেশে এসেছেন সরকারি আমন্ত্রণে। সম্প্রতি তিনি মফেজ হুজুরের সাগরেদ হবার জন্য আবেদন করেছেন।

রুবার্ট হুলিয়ানের সাথে কথা শেষ করেই মফেজ হুজুর আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। আমরা সাক্ষাৎকার প্রত্যাশীরা মফেজ হুজুরের সম্মুখে কিছুটা দূরে সারিবদ্ধ চেয়ারে বসে ছিলাম। আমি চেয়ার থেকে উঠে তার কাছে যাই। তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে তার পাশে আমাকে বসতে বলেন।

আমি মফেজ হুজুরের দিকে তাকাই। একদমই সহজ সরল তার চেহারা, কোনো অহংকারের রেখা তার মুখাবয়বে নেই। তিনি আমাকে কাছে টেনে নেন। আমার কপালের মাঝখানে হাত দিয়ে যে কথাটি তিনি বলেন তাতে আমি চমকিত হই, তিনি বলেন, ‘তোর কপালে নোবেল পুরস্কার নেই!’

এভাবে আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে পারে না। আমি একরকম লাফ দিয়ে মফেজ হুজুরের সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ি। ভাবতে থাকি, কী রকম বিটকেল কবিরাজ! একবার আমার কপালে হাত রেখেই আমার দুর্ভাগ্যের গণনা করে ফেলল! নাকি আমি যাতে নোবেল পুরস্কার না পাই সেই ফন্দি ফিকির বহুদিন ধরে করে যাচ্ছিল মফেজ উদ্দিন। তার পক্ষে অবশ্য এটি অসম্ভবও নয়। তার হাত আদতে কতটা লম্বা তা বুঝতে এখন আমার সাত খণ্ড রামায়ণ পড়ার প্রয়োজন নেই। কোবরেজখানায় রুবার্ট হুলিয়ানের উপস্থিতি ড. মফেজ সম্পর্কে আমার চোখ খুলে দিয়েছে।

সালেহার অসুস্থতার কথাটা বলব কি না দ্বিধায় পড়ে যাই। যে ব্যক্তি আমার নোবেল পুরস্কারের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎবাণী করেছে তার কাছ থেকে মেয়ের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো পরামর্শ নেয়া যুক্তিযুক্ত কিনা সেটা নিয়ে সংশয় জাগ্রত হয় আমার মানসপটে। আবার তার কথার প্রতিবাদ কীভাবে করা যায় সেটিও বোধগম্য হচ্ছে না। ভাবছি, কবিরাজ মফেজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে একটা কবিতা লিখে ফেলব এখান থেকে বের হবার পরপরই।

অবশ্য আমাকে কিছু বলতে হয় না। মফেজ হুজুর সম্ভবত অন্তর্যামী। তা না হলে সালেহার কথা তিনি জানলেন কীভাবে! আমি তো এখানে আসার পর তাকে কিছু বলিনি। তিনিই আমাকে বলেন, ‘উত্তেজিত হইয়ো না কবি। সময় হলে তুমি সব বুঝতে পারবে। তোমার মেয়ের অবস্থা বলো।’

মফেজ হুজুরের মুখে সালেহার কথা শুনে তার অসহায় মুখাবয়ব আমার সম্মুখে ভেসে ওঠে। আমি ড. মফেজ উদ্দিনের সোফায় আবার বসে পড়ি অবচেতনমনে। আমি হুজুরকে গড়গড় করে জগদ্দল পাথরের কথা বলি। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর কথা বলি। সালেহার আজব জ্বরের কথা বলি।

মফেজ হুজুর আমার হৃদয় নিংড়ানো সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি তার সাদা প্যান্টের পকেট থেকে একটি কাঁচের শিশি বের করে আমার হাতে তুলে দেন। তারপর আমার মাথাটাকে তার কানের কাছে টেনে নীচুস্বরে বলেন, ‘নে, এই শিশিটা নে। এই শিশির মধ্যে রয়েছে একটি ক্ষুদ্র বীজ। তুই তোর বাড়িতে গিয়ে উঠোনে কাঁচের শিশিটি পুতে দিবি। তোর সকল দুঃখ কষ্ট লাঘব হবে। তোর জমিনে গজিয়ে উঠবে বিশতলা এক অট্টালিকা। পাল্টে যাবে তোর জীবন।’

আমি কবিরাজ মফেজ উদ্দিনের কথা বিশ্বাস করি না। তবে আমার হাতে আর কোনো পথ খোলা নেই। আমি কোবরেজখানা থেকে সোজা আমার বাড়িতে যাই। আমার জীর্ণশীর্ণ টিনের ছাউনি দেওয়া দুই কক্ষ ও এক বৈঠকখানা বিশিষ্ট বাড়ি। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনিতে তৈরি। দুই বছর আগে রঙ করায় বাইরের অনেক জায়গায় রঙ চটে গেছে। বাড়ির চারপাশটা বাঁশের কাবাড়ি দিয়ে ঘেরা। আর পশ্চিমকোনায় একটা কদম গাছ। আমি সেই কদম গাছের তলায় শিশিখানা পুতে দিই ভরা সন্ধ্যায়।

আমি কী নতুন পরিচয়ে পৃথিবীর কোনো নতুন সময়ে আবির্ভূত হয়েছি! যে বিশতলা অট্টালিকার আবির্ভাব হয়েছে, সেটি ড. মফেজের কারিশমা নাকি তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল! ন্যানো টেকনোলজি দিয়ে তিনি যদি বিশতলা অট্টালিকাকে একটি ক্ষুদ্র বীজে পরিণত করে আমার কাছে সরবরাহ করে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

ঘরে ঢুকে দেখি সালেহা শুয়ে রয়েছে। অপলকভাবে আমাদের টিনঘরের টিনের দিকে তাকিয়ে সে কী যেন ভাবছে! আমি তার কপালে হাত দিই। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার শরীর। কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি, তার জ্বরের বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেছে, তার শরীরের তাপমাত্রা এখন আর কমছে না। আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি না। রাাতের মধ্যে কী হয়ে যায় তার সেটার ঠিক নেই। তাই তার মাথার কাছে একটা বালিশ নিয়ে আমি আস্তানা গড়ি। তাকে ঘরে থাকা মুড়ি আর সন্দেশ খাওয়ায়। তারপর তার মাথায় হাত বুলাতে থাকি।

সালেহা কিছু বলে না, সে আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকায়। এভাবে কিছুসময় যেতেই তার চোখ বুজে আসে। রাত যত গভীর হয় তার শরীরের তাপমাত্রা তত উর্ধ্বগামী হয়। আমি সালেহার মায়ের শাড়ির আঁচলছেঁড়া কাপড় দিয়ে সালেহার মাথায় জলপট্টি দিতে থাকি। আমারও চোখ বুজে আসে। আমি ও সালেহা, মানে আমরা ঘুমিয়ে যাই। তারপর কী ঘটে যায় তা আমরা জানি না।

সকালে আমার ঘুম ভাঙে হাজারো মানুষের কথার শব্দে।

বাইরে প্রচণ্ড হট্টগোল। সালেহা আমার পাশে শুয়ে রয়েছে। জলপট্টিটা ঘরের মেঝেতে পড়ে শুকিয়ে গেছে। আমি সালেহার কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারি তার আর জ্বর নেই। তার বুক স্পর্শ করে জানতে পারি তার শ্বাস-প্রশ্বাসের অস্থিরতা কমে এসেছে।

নিশ্চিন্ত হয়ে আমি বাইরের চিল্লাচিল্লির কারণ অন্বেষণে আমার জীর্ণ শীর্ণ ঘরের রঙচটা পুরনো কাঠের দরজা খুলি। আমি অবাক হই। বাহিরটা দেখতে পাই না। আমার সম্মুখে কিছুটা দূরে আরেকটি বিশাল কাঠের দরজা। বহু মানুষের কথাবার্তা আমার কানে ভেসে আসে। আমি আমার রাতে পরে থাকা কুঁচকানো সাদা প্যান্ট আর লাল ফতুয়া পরেই বিশাল কাঠের দরজা খুলে বাইরে বের হই। যা ভেবেছিলাম তা নয়। যা ভাবিনি তাই সত্য হয়েছে। ড. মফেজে উদ্দিনের বীজ থেকে একটা বিশতলা অট্টালিকা গজিয়ে উঠেছে আমার জমিতে। আমার জীর্ণ শীর্ণ ঘরটা অট্টালিকার তৃতীয় তলার পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে। এই শহরের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো আবির্ভাব ঘটেছে একটি বিশতলা অট্টালিকার।

আমি বিশাল কাঠের দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াতেই হাজির হই অট্টালিকার তৃতীয় তলার বেলকনিতে। নিচে জনতার ভীড়। কী ঘটছে আমার জীবনে আমি বুঝে উঠতে পারি না।

আমার মাথায় নানান প্রশ্ন, সময়টা কী পাল্টে গেছে? আমি কী নতুন পরিচয়ে পৃথিবীর কোনো নতুন সময়ে আবির্ভূত হয়েছি! যে বিশতলা অট্টালিকার আবির্ভাব হয়েছে, সেটি ড. মফেজের কারিশমা নাকি তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল! ন্যানো টেকনোলজি দিয়ে তিনি যদি বিশতলা অট্টালিকাকে একটি ক্ষুদ্র বীজে পরিণত করে আমার কাছে সরবরাহ করে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আজকাল এই জগতের লীলাখেলা বোঝা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে।

তবে আমার অট্টালিকার সামনে এত মানুষের জমায়েত কেন?

হবেই না কেন, মাটি ফুঁড়ে রাতারাতি একটি বিশতলা ভবনের আবির্ভাব হলে শহরবাসী তা দেখতে আসবেই।

তবে রহস্যময় বিষয় হচ্ছে, সকলে আমার নামে স্লোগান দিচ্ছে। আমাকে নিয়ে স্লোগান দেবার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। তাহলে কী আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছি! আচ্ছা! নোবেল পুরস্কার পেলে কী মানুষ এভাবে স্লোগান দিয়ে অভিবাদন জানায়!

এ সকল অযাচিত ভাবনা যখন আমাকে কুরেকুরে খাচ্ছিল, এমন সময় বেলকনির বামপাশের ছোট্ট দরজা খুলে স্যুট পরা একজন বিদেশি ব্যক্তি একটা নোটবুক হাতে এসে আমাকে কুর্নিশ করেন। আমি লোকটাকে চিনতে পারি। তিনি আর কেউ নন। তিনি নোবেলবিজয়ী পদার্থবিদ রুবার্ট হুলিয়ান। কিন্তু কী কারণে তিনি আমাকে কুর্নিশ করছেন আমি বুঝতে পারি না। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে রুবার্ট হুলিয়ান আমাকে যা বললেন তাতে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বললেন, তিনি আর এখন পদার্থবিদ নন, আমি আর এখন কবি নই। তিনি ড. মফেজ উদ্দিনের সাগরেদ, আর আমি একজন প্রাক্তন মন্ত্রী। তিনি জানান, গতকাল হয়ে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে আমি জিতে গেছি। তাই শহরবাসী আমাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। আমরা রয়েছি সময়ের একটি বিশেষ শাখায়। গাছের যেমন শাখা থাকে সময়েরও শাখা-প্রশাখা থাকে। সময়বৃক্ষের একটি শাখায় আমাদের বর্তমান অবস্থান। রুবার্ট হুলিয়ানকে ড. মফেজ উদ্দিন আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করেছেন। সময়ের হিসাব আমি মেলাতে পারি না। একজন কবির পক্ষে এই হিসাব মেলানো সম্ভব নয়। ড. মফেজ উদ্দিনের খেলাটা আমি ধরতে চাই, তবে ধরতে পারি না। তারপরও আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি।

সব জেনে আমি নিজেকে থিতু করি, নিজেকে সামলে নিই। বেলকনি থেকে ভালো করে নিচের দিকে তাকাই। আমি হাত নেড়ে সবার অভিনন্দনের উত্তর দিই। নিচে হাজারো হাতের মধ্যে, হাজারো মুখের মধ্যে আমি একটি পরিচিত মুখ দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই, চায়ের দোকানদার নাজির তার হাত নেড়ে আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এই নাজির গতকাল আমাকে দুই হাজার তিনশত বিয়াল্লিশ টাকার জন্য অপমান করেছিল। আজ সেই নাজির আমার নামে স্লোগান তুলছে। তবে নাজিরকে দেখে আমার এখন শুধুমাত্র তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললে চলবে না। গতকালের অপমানের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না। আমি এখন জগদ্দল পাথরের মন্ত্রী।

আমি আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি রুবার্ট হুলিয়ানকে আঙুলের ইশারায় নাজিরকে দেখিয়ে দিই।

রুবার্ট হুলিয়ান আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘What do you want?’

দিগন্তপুর শহরে যে বিখ্যাত চায়ের দোকানদার বসবাস করতেন, তিনি উধাও হয়ে যান।

লেখাটি শেয়ার করুন :

মোস্তাফিজ ফরায়েজী

মোস্তাফিজ ফরায়েজী ১৯৯১ সালের ১৩ মে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নওদাবন্ডবিল গ্রামে জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। সম্পাদনা : সাহিত্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা ‘দর্পণ’। 'পয়গম্বর' প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!