নষ্ট জোছনার স্রোত
‘তিন বছর হলো স্বামী মর্গের ফ্রিজে। কয়েক মাস আগে একবার দেখতে গিয়েছিলাম, লাশ গুকিয়ে গেছে। বিকৃত হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যাবেই তো, আর কত দিন ভালো থাকবে?…এখন লাশের একটা গতি হওয়া জরুরি।’ কয়দিন আগে কথাগুলো এক সাংবাদিককে বলেছিলেন হাবিবা খানম। আজ তিনি পত্রিকায় কথাগুলো পড়ে ভাবছেন এই ঘটনা পড়ে আত্মীয়-স্বজনরা কী ভাবছে, পাড়াপ্রতিবেশীরা কী ভাবছে, মানুষ কী ভাবছে। যদিও এইসব ভাবাভাবিকে কখনও পাত্তা দেননি তিনি। তার এইসব ভাবাভাবির ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে ফিরে যেতে হবে পাঁচ বছর আগে।
যেদিন বাতির আযানের সময় পশ্চিম আসমানে হাসান-হোসেনের রক্ত দেখা গিয়েছিল, যেদিন ধুলোর সাগরে ছেয়ে গিয়েছিল গ্রামের পথ-ঘাট-মাঠ, সেদিন ইন্টারসিটি ট্রেন থেকে এক লোক পড়ে গিয়েছিল। হাবিবা খানমের বাবা সুলেমান খান মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হয়ে দেখেন একটা লোক গোঙাচ্ছে, পাশে বিশাল এক লাগেজ পড়ে আছে, সুলেমান খান হায় হায় করে ডাক দিলে গমগম করে মানুষ দলা হয়ে যায় এবং ধরাধরি করে দুলেনার বাপের দোকানের বেঞ্চিতে শুয়ায়া মাথায় পানি দেয়। ততক্ষণে জোছনায় ছেয়ে যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইন ও তার গায়ে গায়ে লেগে থাকা পিচঢালা রাস্তা। কৌতূহলী জনতাকে লোকটা শুধু বলে তার নাম খোকন, তিনি ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন, কীভাবে ট্রেন থেকে পড়ে গেছেন বলতে পারছেন না।
যাদের বাড়ি রেললাইনের পাশে তারা অনুধাবন করতে পারবেন যেদিন ট্রেনের মস্তক পর্যন্ত কানায় কানায় ভরে যায়, যেদিন ছাদের আনাচে-কানাচে তিল ধরার ঠাঁই থাকে না, সেটা ইদের আগে হোক বা পরে হোক কিংবা এস্তেমার আগে হোক বা পরে হোক কিংবা কোনো বৃহস্পতিবার-শনিবার হোক, সেদিন ট্রেন থেকে মানুষ পড়ে যায়, আর তখন রেললাইনের পাশে যাদের বাড়ি তারা টের পেয়ে মানুষগুলোকে পানিটানি খাইয়ে হাসপাতালে পাঠায় অথবা বাড়িতে রেখে সেবাশুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলে অথবা পকেট থেকে টাকা-পয়সা, মোবাইল, মানিব্যাগ, ঘড়িটড়ি নিয়ে ভেগে যায়। এই গল্পের খোকন সাহেবও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইন্টারসিটি ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে সুলেমান খানের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন।
পাড়ার লোকেদের কাছে সুলেমান খান অবস্থাসম্পন্ন সরল মনের মানুষ হিসেবেই পরিচিত; রাস্তার পাশেই তার পাকা বাড়ি, ছেলেরা বিদেশে থাকে, একমাত্র মেয়ে হাবিবা খানম স্বামী মারা যাওয়ার পরে বাপের বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। তার স্ত্রী কোমরের ব্যথায় বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, প্রবাসী ছেলের স্ত্রী-সন্তানেরা বাড়িতে থাকেন না, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার জন্য জয়দেবপুর থাকেন। আর এই সুযোগে বাবা-মায়ের সংসারে হাবিবা খানম অনিবার্য হয়ে উঠেছেন।
বুদ্ধিমতী হাবিবা খানম আহত খোকন সাহেবের সেবাশুশ্রুষা করতে থাকেন, ক্ষতস্থানগুলোতে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দেন, স্যুপ রান্না করে খাওয়ান, কিন্তু এতে কাজ হয় না, রাত নিশুতি হলে খোকন সাহেবের গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে।
অসুস্থ খোকন সাহেবকে সুস্থ করার জন্য হাবিবা খান চেষ্টার ত্রুটি করেন না। ডাক্তার জানান যে ভয় পেয়েছেন বলে এমন হয়েছে, প্রেশার লো, শরীর দুর্বল, রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে, তবে একটু সময় লাগবে। কথা সত্যি, এক সপ্তাহের মধ্যে খোকন সাহেব সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং হাবিবা খানমের সাথে দারুণ এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আপন মনে নৈসর্গিকতা উপভোগ করতে থাকেন, তার ভিতরের শিশুটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এমন নিশ্চুপ নিরালা জোছনা রাতে হাবিবা খানমের মতো মেয়ে থাকার পরেও খোকন সাহেবের আচরণে কামনা-বাসনা জেগে ওঠার ভাষা কিংবা ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয় না।
এক রাতে টগবগ করে জোছনা ওঠে, হাবিবা খানম জোছনা সহ্য করতে পারেন না, জোছনা রাতে গোছল করে সাজুগুজু করে জানালায় বসে থাকেন, কিন্তু জানালায় চোখ রাখতেই তিনি খেয়াল করেন খোকন সাহেব রেললাইনের পাতে উঠে হাঁটার চেষ্টা করছেন। হাবিবা এক মুহূর্ত দেরি করেন না, বাহিরে এসে দেখেন, জোছনার আলোতে রেললাইনের পাতগুলো চিকচিক করে ওঠে। তাকে দেখে খোকন সাহেব একটুও অবাক হলেন না, বরং আপন মনে নৈসর্গিকতা উপভোগ করতে থাকেন, তার ভিতরের শিশুটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এমন নিশ্চুপ নিরালা জোছনা রাতে হাবিবা খানমের মতো মেয়ে থাকার পরেও খোকন সাহেবের আচরণে কামনা-বাসনা জেগে ওঠার ভাষা কিংবা ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয় না। হাবিবা খানম বিষয়টি খেয়াল করেন। কারণ, পুরুষ মানুষকে তিনি খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি জানেন যে, এই তল্লাটে পুরুষ মানুষের সমস্ত চিন্তা নারীর শরীর কেন্দ্রিক, এই তল্লাটে এমন পুরুষ কমই পাওয়া যাবে যে সুযোগ পাওয়ার পরেও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেনি। কিন্তু আজ সুযোগ পেয়ে খোকন সাহেব অন্য এক আনন্দে মেতে উঠেছেন; খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া পাখির মতো দুই ডানা প্রসারিত করে রেললাইনের পাতে হাঁটতে গিয়ে দীর্ঘদেহী পাটগাছের মতো এদিক-ওদিক পড়ে যান। তখন হাবিবা খানম বলেন, ‘দেখেন, আমি ক্যামনে হাঁটি।’ অভিজ্ঞ হাবিবা খানম তরতর করে হাঁটতে থাকেন।
হাবিবা খানম খেয়াল করেন অদ্ভুত নিবিড় রাত, দিনের আলোর মতো আলো ঝলমল করছে। খোকন সাহেব হাবিবা খানমেরর মতো দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করে ভারসাম্য রাখতে না পেরে স্লিপারে লেগে আঘাত পান, হাবিবা খানম ‘আল্লারে’ বলে কাছে আসেন, পাগলের মতো পায়ে হাতরে বেড়ান। তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো কিছু একটা খোঁজেন এবং মুহূর্তের দূর্বাঘাসের পাতা চিবিয়ে পায়ে ঠেসে ধরেন; এতে অবশ্য খোকন সাহেবের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, দূর্বার রস লাগার পরে ‘আ’ করে শব্দ করার কথা থাকলেও তিনি অন্যমনস্ক হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকেন; যৌবনপ্রাপ্ত বাঘ শিকারকে বাগে এনে যেভাবে উদাসীন হয়ে যায়, শিকারি বিড়াল ইঁদুকে কাবু করে যেভাবে নিরাসক্ত হয়ে যায় তেমনি খোকন সাহেবও হাবিবা খানমকে বাগে এনে কিংবা কাবু করে উদাসীন ও নিরাসক্ত হয়ে যান। তখন মেঘের খণ্ড ক্ষণকালের জন্য জোছনাকে ঢেকে দেয়, অন্ধকারের ঢেউ ধাক্কা দিয়ে জোছনার সাগরে মিলিয়ে যায়। আর তখন হঠাৎ উঠে দাঁড়ান খোকন সাহেব, ‘কিচ্ছু হয় নাই’ বলে আবারও হাঁটতে থাকেন, তখন হাবিবা খানম কাতর কণ্ঠে বলেন :
আরে, কী করেন, কী করেন।
: হাঁটতে ভালো লাগতেছিল।
: আপনে পায়ে ব্যথা পাইছেন তো।
: সমস্যা নাই, আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছে।
: আচ্ছা ঠিক আছে, আমার হাত ধরেন, আমরা হাত ধরাধরি করে হাঁটি।
যখন রেললাইন ছিল কিন্তু রেললাইনের পাশে সড়ক ছিল না, যখন রেললাইনের পাশে হাঁটার পথ ছিল, কিন্তু সেই পথে হাঁটা যেত না, যখন পথ কাঁদায় কিংবা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যেত তখন কাওরাইদের হাটের দিনে কিংবা সাতখামাইরের হাটের দিন দোস্তাদোস্তিরা যেভাবে হাতে হাত পেঁচিয়ে রেললাইনের দুই পাতে উঠে হেঁটে যেত সেভাবে হাতে হাত পেঁচিয়ে নেন হাবিবা খানম ও খোকন সাহেব। তারা হাঁটতে হাঁটতে গোলাঘাট পুলের কাছে পৌঁছান। তখন হাবিবা খানমের মাথায় এক খেয়াল ভর করে, তিনি বলেন, পুলের পাশেই গড়ে ওঠা কনক্রিটের ব্রিজে বসে থাকবেন বাকি রাতটুকু, যদিও রাতের আর বেশি বাকি নেই; তখন সাপের মতো পিলপিল করতে থাকা গাঙের বুকে টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজে ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে যায়, আর রেললাইনের পুলে ভাদ্র মাসের পানি বাড়ি খায় আর ভূতের মতো হিসহিস শব্দ হয়।
স্বপ্নের মতো লাগে হাবিবা খানমের, তিনি জীবনের গল্প করেন, কীভাবে স্বামী মারা গেলেন, স্বামী কত ভালোবাসতেন তাকে। এসব শুনে কিংবা হাবিবা খানমের চোখের পানি দেখে খোকন সাহেবের আহা উঁহু করার কথা থাকলেও তিনি তা করেন না, পূর্বের ন্যায় নির্মোহ ও নিরাসক্ত হয়ে গাঙের পানি দেখার চেষ্টা করেন, তারপর কী মনে করে হাবিবা খানমের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন; তাকে দেখে মনে হয় এই আলোছায়ায় তিনি হাবিবা খানমের চোখের পানি নয়, যেন গাঙের উথালপাতাল ঢেউয়ের দিকে কিংবা কলকল করা ঝরনা ধারার দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছেন। আসলে নারীর কান্না ও চোখের পানির আলাদা সৌন্দর্য আছে একটা, নারীর চোখের পানির সৌন্দর্য যে পুরুষ খুঁজে পায় সে পুরুষ বারবার সেই সৌন্দর্য খুঁজে ফেরে।
গোলাঘাট থেকে ফেরার পথে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়া কলিমুদ্দিন ও সোজা মুনশি দেখেন দুইজন মানুষ হাসতে হাসতে আসছে এবং হাসির শব্দ শুনে স্পষ্ট বোঝা যায় এদের একজন মেয়েমানুষ এবং মেয়েমানুষের হাসির শব্দটাও পরিচিত লাগে; মানুষ দুইটা আরেকটু কাছে চলে এলে দেখা যায় তারা হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, কলিমুদ্দিন ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে সোজা মুনশিকে চুপ করার ইশারা করে দুলেনার বাপের দোকানের পাশে লুকিয়ে পড়েন এবং তাদের সন্দেহ সত্যি হয়, তারা দেখেন, খোকন সাহেব ও হাবিবা খানম আসছেন।
এইটা জুম্মাবারের ভোরের ঘটনা, তাই জুম্মার আগেই মসজিদের আশেপাশে সমালোচনা চলে, পশ্চিম বাড়ির আমজাদ বলেন, ‘১৫/২০ দিন যাবত লোকটা সুলেমান চাচার বাড়িতে আছে, বাড়ির পাশে মসজিদ, কই লোকটা তো কোনোদিন মসজিদে আসে নাই।’
আমজাদের কথার সঙ্গে দোহার ধরে কাঁইয়া বাড়ির মোতালেব বলেন, ‘ঠিক কইছেন, বাড়িতে যুবতি মাইয়া, তাও আবার বিধবা, একটা ভিনদেশি পুরুষ মানুষ এতদিন যাবত থাকতাছে, এইখানে সেইখানে ফস্টিনষ্টি কইরা বেড়াইতাছে, সমাজ বলে তো একটা কথা আছে।’
সুলেমান খানের কানে আসে কথাগুলো, তাকে শুনিয়েই যেন কথাগুলো বলা হয়েছে; তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন, না-শোনার ভান করে মসজিদের ভিতরে চলে যান, কিন্তু ইবাদতে মন দিতে পারেন না, কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে, সিজদার সময়ও মনে পড়ে কথাগুলো। কিন্তু নামাজ শেষ হওয়ার পরে যে আরও বড়ো ঘটনা বাকি ছিল তা অনুধাবন করতে পারেননি তিনি।
সুলেমান খান নামাজ শেষে মসজিদের আশেপাশে দাঁড়াননি, দ্রুত বাসার দিকে পা চালান, কিন্তু দুলেনার বাপের দোকানের সামনে এলেই এলাকার পাতিনেতা আনারুল বলে, ‘চাচা, একটা কথা ছিল।’ তিনি বুঝতে পারেন ফরজ নামাজ পড়েই মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল এরা। তিনি ইতস্তত হয়ে বলেন, ‘বলো বাবা, কী বলবা।’
: কী আর বলব, বাড়িতে আপনার এমন একটা মাইয়া, অথচ…
: যা বলার স্পষ্ট কইরা বলো।
: না, বলতেছিলাম কী, হাবিবা আপা কার সাথে মিশব, কার সাথে ঘুরব, আপনার বাড়িতে কে থাকব সেইটা আপনাদের বিষয়, কিন্তু চাচা, পোলাপাইন তো ক্ষেইপা গেছে, আমার কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে, কয়, হাবিবা আপাকে নাকি লোকটার সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। তাই কইতেছিলাম, একটা অপরিচিত লোকরে বাসায় রাইখা ঠিক করতাছেন কি? আমি যদি না সামলাইতাম তাইলে পোলাপান তো আপনার বাড়িতেই হামলা করত, কিন্তু আপনে এই সমাজের সম্মানী ব্যক্তি, তাই কইতাছি বিষয়টা দেখেন, আমি আর কতবার সামলায়া রাখমু কন, বলা তো যায় না কখন কোন অঘটন ঘইটা যায়।
সুলেমান খান কোনও কথা বলতে পারেন না, তার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরতে থাকে। অবস্থা বুঝে আনারুল বলে, ‘চাচা, চিন্তা কইরেন না, আমি কিন্তু আপনাদের ভালাই চাই, আপনি বাড়ি যান, দরকার পড়লে আমারে কল দিয়েন, আমরা সময়মতো চইলা যামু নে।’
সুলেমান খান হনহন করে বাসায় গিয়ে দেখেন খোকন সাহেব ও হাবিবা খানম কী একটা বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছেন। তখন তিনি ভাদ্র মাসের আসমানের মতো হুংকার দিয়ে হাবিবা খানের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেন। মেয়ের যা স্বভাব তাতে চিৎকার চেঁচামেচি করার কথা ছিল কিংবা হাউমাউ করে কান্না করার কথা ছিল, কিন্তু মেয়ে তা করে না, নিশ্চুপ ভ্রমরার বোল্লার টুপের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সুলেমান খান খোকন সাহেবকে বলেন, ‘দেখেন বাবা, আপনার বয়স হয়েছে, আপনি কম করে হইলেও আমার মেয়ের চেয়ে ১৫ বছরের বড়ো হইবেন, আপনি সুস্থ হইছেন, এখন আপনি বিদায় হোন, সমাজে আমি মুখ দেখাইতে পারতেছি না, আপনি সুস্থ হওয়ার পরেও একটা দিন মসজিদে যান নাই, নামাজ কালাম পড়তে দেখি নাই আপনারে।’
তখন হাবিবা খানম সমাজের মানুষকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করে বাবাকে বলেন, ‘আব্বা, কে নামাজ পড়ব কে পড়ব না সেটাও সমাজের লোকেরা ঠিকই কইরা দিব, এইটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার, সবচেয়ে বড়ো কথা হইল উনি মুসলমান না, উনি হিন্দু, কোনো হিন্দুরে কি নামাজ পড়তে দেখছেন?’
খোকন সাহেব একজন নিঃসঙ্গ, সরল মনের মানুষ, একজন দুঃখী মানুষ, ওইদিন ট্রেন থেকে খোকন সাহেব পড়ে যাননি, তিনি ইচ্ছে করেই লাফ দিয়েছিলেন
মেয়ের কথা শুনে সুলেমান খান স্তব্ধ হয়ে যান। কী বলবেন, কী করবেন, কী বলা উচিত কিংবা কী করা উচিত বুঝতে পারছেন না। তখন হাবিবা খানম জানান যে, খোকন সাহেব একজন নিঃসঙ্গ, সরল মনের মানুষ, একজন দুঃখী মানুষ, ওইদিন ট্রেন থেকে খোকন সাহেব পড়ে যাননি, তিনি ইচ্ছে করেই লাফ দিয়েছিলেন, আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, এখন তিনি বাঁচতে চান, নতুন করে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন, জীবনের মানে বুঝতে পেরেছেন, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চান এবং এইখানে বাকি জীবন কাটায়া দিতে চান।
হাবিবা খানমের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে খোকন সাহেব জানান যে, তিনি একা মানুষ, বউ পোলাপান নেই, আত্মীয়-স্বজনরা তার মৃত্যু কামনা করে, তিনি মারা গেলেই সব সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে নিবে, তিনি জীবনে কিছুই পাননি, জীবনভর টাকা ইনকাম করেছেন, কিন্তু সেই টাকা ভোগ করতে পারেননি, কখনও কারো ভালোবাসা পাননি, এখন তিনি নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চান, আর হাবিবা খানমকে বিয়ে করতে চান, দেনমোহরানার টাকা নগদে দিয়ে দ্রুত কাজটা শেষ করতে চান।
এরপর আর কোনও কথা থাকে না, মুহূর্তের মধ্যে সুলেমান খানের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ ঝরনার শীতল পানি হয়ে যায় এবং খুব দ্রুত সব হয়ে যায়।
কয়েকদিনের মধ্যে ঘটনাটা জানাজানি হয়, পাড়ার মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সুলেমান খানের পরিবার প্রশংসায় ভাসতে থাকে। খোকন সাহেব ইমাম সাহেবের কাছে আরবি শিখছেন, নিয়ম করে সুরা-কেরাত শিখছেন, নামাজ-কালাম শিখছেন এবং জুম্মাবারে মসজিদের উন্নয়ন ফান্ডে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করেছেন এবং পরের জুম্মাবারে ইমাম সাহেব খোকন সাহেবকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে তিনি তার নতুন জীবনের অনুভূতি ব্যক্ত করেন, কয়েকটা সুরা পড়ে শোনান, তখন উপস্থিত মুসল্লিরা সুবাহানআল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ বলতে থাকেন এবং আহা উহু করতে থাকেন।
সুলেমান খানের বাড়িতেও সুখের হাওয়া বইতে থাকে। খোকন সাহেবের সঙ্গে যে লাগেজ ছিল সেই লাগেজে ব্যাংকের চেকবই, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ও নগদ টাকার অভাব ছিল না। হাবিবা খানম এইসব দেখে বিস্মিত হন, লোকটাকে যতটা উঁচুধরের মানুষ মনে করেছিলেন লোকটা আসলে তার চেয়েও বেশি কিছু। লোকটা যে এইভাবে টাকা খরচ করবেন, দান-খয়রাত করবেন কিংবা সম্পত্তির অর্ধেকটা হাবিবা খানমকে লিখে দেবেন তাতে হাবিবা খানম কী বলবেন কী করবেন বুঝে উঠে পারেন না, আসলে লোকটার বয়স হলেও এখনও বেশ রোমান্টিক, শারীরিকভাবেও মারাত্মক শক্তিশালী, সবদিকে পূর্ণ করে দিয়েছেন তাকে, আল্লাহ যে কপালে এত সুখ লিখে রেখেছেন তা কে জানত।
কিন্তু সুখের সময় তো গেল না এইভাবে, কিছুদিনের মধ্যে খোকন সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন, সামান্য কিছুতেই হাঁপিয়ে যান। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার জানান যে, খোকন সাহেব নিয়মিত যৌনবর্ধক মেডিসিন নিতেন, তার অবস্থা বেশি ভালো না, যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। হাবিবা খানম ডাক্তারের কথার সত্যতা বুঝতে পারেন এবং একটুও দেরি করেন না, কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর খোকন সাহেবের অবস্থা খারাপ হতে থাকে, ডাক্তার জানান ফুসফুস ফুলে গেছে, পানি জমা হয়েছে এবং দেখতে দেখতে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে আইসিওতে নেওয়া হয় তাকে, হাবিবা খানম ও সুলেমান খান আইসিওর পাশে বসে থাকেন। সুলেমান খান লক্ষ করে প্রার্থনার জন্য জায়গা আছে, একটা মুসলমানের জন্য, আরেকটা হিন্দুদের জন্য, সুলেমান খান দোয়া দুরুত পড়তে থাকেন। হঠাৎ তার কানে আসে হাবিবা খানমের চিৎকারের শব্দ, উৎকণ্ঠিত সুলেমান খান এসে দেখেন একটা মহিলা ও দুইটা মেয়ের সঙ্গে চুলাচুলি করছেন হাবিবা খানম। তিনি স্তম্ভিত হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মহিলা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘শয়তান মহিলা, আমার সহজ-সরল জামাইকে জাদু করে নিজের কাছে রাইখা দিছস, ডাইনি, আমার সংসারে দুইটা মেয়ে আছে, আর তুই কিনা আমার জামাইরে কাবু করে রাখছস, এখন জামাই আমার মরতে বসছে।’
হাবিবা খানমও চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘জামাইরে খাইতে খাইতে শেষ করছস, দুইটা ডাইনি জন্ম দিছস, তুইও তো একটা ডাইনি, তোরা তিন ডাইনি মিলে লোকটারে খাইতে খাইতে শেষ কইরা দিছস, তোদের অত্যাচার সহ্য করতে না পাইরা আত্মহত্যা করতে চাইছিল লোকটা, পরে আমরা বাঁচাইছি, আমার কাছে শান্তি পাইছে দেইখা তোদের কাছে আর যায় নাই।’
সুলেমান খান এই প্রথম জানতে পারেন যে খোকন সাহেবের প্রথম ঘরের স্ত্রীর দুইটা মেয়ে আছে এবং এই ব্যাপারটা হাবিবা খানম আগে থেকেই জানতেন। তার বিশ্বাস কাচের মতো টুকরো হয়ে যায়, যে মেয়েকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতেন সেই মেয়েও বিষয়টা গোপন রেখেছে, অথচ তাকে বলা হয়েছিল, খোকন সাহেব বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বউ টাকা-পয়সা নিয়ে এক লোকের সঙ্গে ভেগে গেছে, পরে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেন, আর বিয়েশাদি করেননি।
তখন মহিলা ও মেয়ে দুইটা হাবিবা খানকে চুলে ধরে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালের গেটের দিকে নিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু তখন সুলেমান খান ও ওয়ার্ড বয়দের তৎপরতায় হাবিবা খান রক্ষা পান; তখন আইসিওর ভিতর থেকে একজন এসে জানান যে খোকন সাহেব আর নেই।
খোকন সাহেবের লাশ গ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার কাছে লাশ হস্তান্তর করবে ভেবে পাই না, তাই তারা পুলিশকে খবর দেয়, পুলিশ এলেও বিষয়টি সুরায়া হয় না, প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও মেয়েরা এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী লাশের দাবি করলে কাউকে না দিয়ে মর্গে রাখা হয় লাশ।
মৃত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, মানুষটার চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার, আর তখন তিনি পত্রিকা অফিসে গিয়ে একজন সাংবাদিককে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। তারপর পত্রিকায় রিপোর্টের পর রিপোর্ট হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাটা।
প্রথম পক্ষের স্ত্রীর নাম জবা রায় চৌধুরি। দুই মেয়ে কণা রায় চৌধুরি ও বীণা রায় চৌধুরি। লাশ চেয়ে কোর্টে মামলা করেন জবা রায় চৌধুরি। মামলার ডেট পড়ে একটার পর একটা, এই কাগজ চাওয়া হয়, ওইটা চাওয়া হয়, এইদিকে লাশ মর্গের ফ্রিজে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে থাকে। কয়েক মাস পর পর উভয় পক্ষের লোকজন দেখে যায়। হাবিবা খানম মৃত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, মানুষটার চেহারা বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার, আর তখন তিনি পত্রিকা অফিসে গিয়ে একজন সাংবাদিককে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। তারপর পত্রিকায় রিপোর্টের পর রিপোর্ট হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাটা। পত্রিকায় হাবিবা খানের অভিমত প্রকাশিত হলে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা ভাইরাল হলে ওপর মহলের কারো নির্দেশে অথবা স্বাভাবিক নিয়মে কোর্ট রায় ঘোষণা করে, এই রায়ে বলা হয় প্রথম স্ত্রী জবা রায় চৌধুরি ও দুই মেয়ে কণা রায় চৌধুরি ও বীণা রায় চৌধুরির কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে এবং লাশ হস্তান্তর করার পূর্বে হাবিবা খানম শেষবারের মতো লাশ দেখার সুযোগ পাবেন।
আসলে খোকন সাহেব যে মুসলমান হয়েছিলেন তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই, কোনো হলফনামা নেই, মসজিদের ইমাম সাহেব কয়েকজন সাক্ষীর সামনে কলেমা পড়িয়ে মুসলমান করে নিয়েছিলেন। যদিও হাবিবা খানম একটা নকল হলফনামা বানিয়ে কোর্টে জমা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তাই ধর্মের দিক চিন্তা করে, মেয়েদের দিক চিন্তা করে কোর্ট প্রথম স্ত্রী জবা রায় চৌধুরি পক্ষে রায় দেয়। কোর্ট জানায় যে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইনের লোকের উপস্থিতিতে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
কিন্তু এর মধ্যে খবর প্রকাশিত হয় যে ঋণ খেলাপি, ভুয়া এলসি খোলা, শেয়ার জালিয়াতি, কেসিনু ব্যবসা ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত এসকে হালদারই হলেন মর্গের ফ্রিজে শুকিয়ে যাওয়া খোকন সাহেব। দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে গ্রামে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন; ওইদিন হাবিবা খানম যদি সাংবাদিকদের কাছে বিচার না দিতেন আর যদি সাংবাদিকরা অনুসন্ধান না করতেন তবে বিষয়টা হয়ত কোনোদিন প্রকাশ পেত না, সবাই ভাবত এসকে হালদার রাতের আঁধারে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
হাবিবা খানমের কাছে খবরটা পৌঁছায়, আসলে যে খবর ভাইরাল হয়ে যায় তা না-জানা বা না-শোনার কোনো কারণ নেই। তিনি বুঝতে পারছেন কেন জবা রায় চৌধুরি ও তার মেয়েরা লাশ নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন, আসলে লাশ সৎকার করতে পারলে হয়ত একটা অধিকার জন্মাবে, অথবা অন্য কোনো গোপনীয় ব্যাপার আছে তিনি বুঝতে পারছেন না।
১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে হাবিবা খানম দ্বিধাকে এক পাশে সরিয়ে মর্গের সামনে চলে আসেন। তার বারবার মনে হতে থাকে, এতকিছুর পরেও কেন এলেন? তিনি কি এখনও লোকটাকে ভালোবাসেন? এখনও কি খোকন সাহেবের বৈধ ওয়ারিশ দাবি করেন? পত্রিকার খবর যদি সত্যি হয় তবে সম্পত্তির সবকিছুই বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা, তাকেও কি কিছু জিজ্ঞেস করবে পুলিশ?
হাবিবা খানম অপেক্ষা করতে থাকেন, পায়চারি করতে থাকেন, কিন্তু আইনের লোক কিংবা জবা রায় চৌধুরি কাউকে দেখা যায় না। দুপুর ঘনিয়ে বিকেল হয়ে গেলে মর্গের দায়িত্বে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলে লোকটা জানায় যে, লাশ হস্তান্তরের রায় স্থগিত হয়েছে।
হাবিবা খানমের বুকটা টিকটিক করে ওঠে, হয়ত জবা রায় চৌধুরিকে পুলিশ আটক করেছে, হয়ত আরও ভয়ংকর কিছু বেরিয়ে আসবে। আচ্ছা, তখন কি তাকেরও পুলিশ ধরবে? জেরা করবে? রিমান্ডে নিবে? না, আর ভাবতে পারছেন না। তবে কি এইখান থেকে সটকে পড়া উচিত? পালানো উচিত?
হাবিবা খানম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন, বাবা সুলেমান খানকে কল দেওয়ার চেষ্টা করেন, মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন চব্বিশটা মিসডকল; সুলেমান খান এগোরোটা দিয়েছেন, আর তেরোটা আসছে আননোন নম্বর থেকে।
তখন পাঁচ-ছয় জন পুলিশ মর্গের দিকে ধেয়ে আসে, আর হাবিবা খানমের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

মেহেদী ধ্রুব
জন্ম : ৩ ফেব্রুয়ারি, শ্রীপুর, গাজীপুর। পড়াশুনা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : মেঘ ও মানুষের গল্প (২০১৯), সাধারণ মৃত্যুর জীবনচক্র (২০২২)। প্রকাশিত উপন্যাস : পশ্চিমের হাওয়ায় প্রাণ (২০২৪)। সম্পাদনা : শিল্প-সাহিত্যের অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রাতিস্বিক’।