কবিতা

একগুচ্ছ শিরোনামহীন

কেন যে কাটো কোমল পা, পচা শামুকে? শামুক পচে কেন? বিক্ষিপ্ত পাখির পালক থাকবে উস্কোখুস্কো, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে উঠোন যদি অগোছালো হয় কখনো – সেদিন পাখি, পালক ও পরিবেশ, তিনজনই দায়ী হবে। হওয়া উচিত। তবে আমি কেনো একক, অনন্ত কাঠগড়ায় আজও

আরেকদিন কখনো আসে না। আরেকদিন কখনো আসেনি। আর মানুষ বাঁচে মুহূর্তে শুধু। মুহূর্ত নষ্ট করো না। প্লিজ।
বদলাচ্ছে সবকিছুই। সময় ও শহর। মানুষ ও হৃদয়। একেক সময় বিষণ্ণ একক রঙে ধূসর হচ্ছে ঘুম।

ঘুমের কাধে ঠোঁট রেখে দেখেছি। ঘুম মূলত অন্য কারো জীবনে ভুল করে ঢুকে পড়া অনন্ত জাগরণ। আর জেগে থাকতে থাকতে এখন এই তিনটা বাজে। কী যে অদ্ভুতভাবে সমুদ্রটা ভেঙে যাচ্ছে অবিরাম। শোঁ শোঁ আর্তনাদে বধির যেন একটা সমস্ত মধ্যরাত।

সমুদ্র ভাঙে ভাঙুক। ওর অধিকার আছে। কিন্তু – মানুষ ভাঙে কেন? মানুষ কেন চুরমার হয়ে যায়?

এখন আমিই নেই কোথাও আর আমার পৃথিবীতে! আর তুমি ভয় দেখাও হারিয়ে যাবে। বোকা মেয়েটা।

জানো, আমার আর কিছুই ভালো লাগে না আজকাল। যা-ই করি, মনে হয়, এ আর নতুন কী। এত বেশি বেঁচেছি এই এক জীবনে। এত বেশি করেছি ক্ষয় নিজেকে। এত বেশি অপচয়!

কেন যে কাটো কোমল পা, পচা শামুকে? শামুক পচবে কেন অযথা? একমাত্র মানুষেরই প্রকৃত পচে যাবার অধিকার আছে। কিন্তু পচতে পচতে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছে একটা সময় ! কখনো দুপুর তিনটা। কখনো রাত দশটা পঁয়ত্রিশ। মানুষ, ভাঙে কেন? মানুষ কেন চুরমার হয়ে যায়?

তোমার রজনীগন্ধা ভালো লাগত। কিন্তু তুমি নিজে ছিলে একজন ঘুমঘুম শিউলি ফুল। এত কোমল (যদিও ছুঁয়ে দেখিনি কখনো, তবে ধারণা করা হয়)।

কিছু বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকতে হয়। নাহলে মলিন হতে পারে বেদখল মন। তাই যদিও বলেছিলে খুঁজে দিতে একমুঠো শিউলির মতো সন্ধ্যাবেলা, আমি কাজে অকাজে ভয়ে বাড়াইনি হাত। কেননা রক্ত লেগে ছিল দুহাতে ভীষণ।

রোদে মেঘে কী যে সাঙ্ঘাতিক লাগে তোমাকে। যদি জানতে? আমি হাভাতের মতো দেখতে থাকি রোজ, সুযোগ পেলেই। মানে যতটুকু পড়ে নেয়া যায় এই দুর্ভিক্ষের দুঃসময়ে – গান, গল্প, কবিতা।

তুমি বারান্দায়। আমি দরজার পাশে। মাঝখানে একঘর উৎসব। মানে এটলিস্ট উৎসবের মতো হাহাকার হয়ে ঘুরঘুর করছে যেসব দীর্ঘশ্বাস। দেখতে, ভালো লাগে ? তুমি না, কি করো না করো! কিচ্ছু ঠিক ঠিকানা নেই তোমার। এতো মুডসুইং?

কখন যেন নিজের আগুনে নিজেই পুড়ে গেছি, পাইনি টের। তাই সব শেষ হয়ে গেলে, তারপরও। সব শেষ হওয়ার জন্য বসে থাকি আমি। অবেলায়।

এই ‘প্রেম ভালোবাসা আবেগ অনুভূতি’ বিষয়গুলোয় মাইরি এক আজব চিজ। মানে ধরো আমাকে যে ভালোবাসে (হয়তো বা), তাকে আমি জাস্ট ফ্রেন্ডের চোখে দেখি। আমি যাকে ভালোবাসি, সে আমাকে বন্ধু ভাবে শুধুই। আবার সে যাকে বন্ধু ভাবে / ভালোবাসে, আমার জানা হয়নি, সে কি চাই, সে তোমাকে বন্ধু ভাবে / ভালোবাসে? গান, গল্প, কবিতা পড়ে নেয় সূযোগ পেলে ? ভালোবাসা কী আসলে? জানো তুমি?

হোয়াটেভার ইট ইজ। তোমাকে প্রাণখুলে হাসতে দেখে ভালো লাগে আজকাল। আমি ছিলাম কেবলই তোমার বিষণ্ণ দিনের সঙ্গী। দুঃখ শোনার লোক। অবশ্য কোনো প্রত্যাশা রাখিনি কখনো যে আশাভঙ্গের ঝুঁকি থাকবে। তারপরও। না, থাক। অপ্রত্যাশিত মন ভাঙলে সে দায়ভার একান্তই মনের, তোমার নয়। কারোরই নয়। যা হওয়ার ছিল না কখনোই, তা হয়নি। যা হওয়ার ছিল, তাই হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সত্য। সুন্দর।

মাঝখান থেকে অযৌক্তিকভাবে ঘুম ঘুম শিউলিফুল হয়ে গেল এক অনন্ত বিষণ্নতার অপর নাম। আর রজনীগন্ধা? কিছু কিছু বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকতে হয়, কবিতারা। কিছু বিষয় শেষ হতে হয় শুরুর আগেই।

কেননা তৃষ্ণা যখন প্রবল হয়, উৎস তখন দেবে যায়। রক্ত হয়, গভীর এক রক্তক্ষরণ।

যে আসেনি কখনো কোনোদিন, তাকে হারানোর ভয় কিসের? কিংবা কোনটাকে মূলত আসা আর যাওয়া বলে? আর চাইলেই কি হুট করে চলে যাওয়া যায়? তুমি কি একটা পাখি না এরোপ্লেন? ডানা আছে? অথবা ঝুপঝাপ বন্ধ করে ফেলবে ল্যাপটপ শাট ডাউনের মতো করে? অবশ্য খুলেছিলামই বা কবে নিজেদের আমরা দুজন, যে বন্ধ করব কখনো?

আমি উৎসবকে জন্ম নিতে দেখেছি, সন্ধ্যার বীভৎস ডানায় ভর করে, মরে যেতে দেখেছি নির্লজ্জ ভদ্রতার মুখোশ মুখে। হেমন্তে যেভাবে শরীর জাগে, মরে যায় মন। আমারও জন্ম নিতে ইচ্ছে হয়, অন্তত একবার। তোমার অনেক গহীনে। ঘুমের ভান করে।

যদি আকন্ঠ কোনো শস্য হতে পারতাম, যদি খেয়ালি ঘুঘুর মতো একবুক নরম মাংস হতে পারতাম আমি? সঙ্গ দিতে পারতাম যদি এভাবে অনন্ত তোমাদের কালো অথচ উজ্জ্বল ক্যান্ডেল লাইট ডিনার জুড়ে। তোমার রক্তকণাতে বসতি তুলে গড়ে দিতাম ভালোবাসার বিরল শহর। কীভাবে বাধা দিতে তুমি?

তুমি কি বোঝো না কিছুই? জ্ঞান বুদ্ধির মাথা খেয়েছ? কেন বারবার অতল উপেক্ষাকে উপেক্ষা করে ছুটে যাই। কেন বিমূঢ় চেয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল। জেনো, তোমারই স্নিগ্ধতায় রিক্ত হয়েছি আরো। তোমারই অবহেলায় মুখর হয়েছে মধু ও মননের বিষণ্ণ বিউগল।

কত দূরে চলে গেছ। কত দূরে??? মানুষ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বদলে গেলে?

তবু। যদি পারতাম। একটি রাত, অন্তত একটি রাত ঘুম এনে দিতাম! যেদিন সব শস্য নিয়ে গেল ওরা! কালো কয়লা হয়ে ঝুপ করে নেমে এল দমবন্ধ অক্সিজেন! আহ মৃত্যু! আমার কোমল উষ্ণ বরফের মতো তীব্রতারা!

আয়নায় শুধু নিজের মুখ কেন দেখতে হয়? এই ঘোর মধ্যরাতে একটা কমলা দুপুর এসে দাঁড়িয়েছে তোমাদের উঠোনে, ওকে বসতে দাও ভালোবাসার রকিং চেয়ার। শহরে মরে আছে একদল বিষণ্ণ মানুষ। যারা উৎসবের জ্বালানী হয়ে বেঁচে থাকবে।

তুমি কি বোঝো না কিছুই? যে আসেনি কখনো কোনোদিন, তাকে হারানোর ভয় কিসের? আর মানুষ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বদলে গেলে?

শহরের ভিতরেও শহর থাকে প্রিয় উপেক্ষারা। মানুষের ভিতরেও থেকে যায় কতশত মানুষ।

অভিমান বড় খুনি হয়। দুজনকেই ছিঁড়ে ফেলে খুব। এর চেয়ে বরং উপেক্ষা অনেক ভালো। অন্তত একজন বেঁচে থাকে। জয়ী হয় প্রবল, অসাধারণ।

ধন্যবাদ তোমাকে। এভাবে ব্যাক টু ব্যাক তোমার শহরে পা রাখার জন্য।

আমি এক বৃহস্পতি থেকে আরেক বৃহস্পতি বার কী দিকবিদিক ছুটে মরি অযথা। মুহূর্তের পর মুহূর্ত জুড়ে বসে থাকি ঠায়। কোথাও তুমি নেই। শুধু লাল শাড়ি সোনালি পাড়জুড়ে মুহূর্ত হয়ে মরে থাকে অপেক্ষারা।

শোনো তোমাকে চাইনি কখনোই। জাস্ট কবিতার স্বার্থে এক পলক দেখার আর্তি। যেমন কন্ট্র্যাক্ট রিনিউ করতে পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল লাগে মাঝে মাঝে। আমরা চাই না বা চাই। ডাজেন্ট ম্যাটার এট অল।

তোমাকে ভালোবাসি কিনা ঠিক জানি না আমি আজও। ভালোবাসা আসলে কী? তবে নিজেকে আমার মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে মন চায় খুব। তোমাদের এই শহরে। এই মানে যেন হাঁটতে গিয়ে বালি বা কঙ্কর না লাগে তোমার কোমল পায়ে।

এটা খুবই সত্যি যে, যারা সবখানে থাকে, তারা আসলে কোথাও থাকে না। যাদের জীবনে অনেক মানুষের আনাগোনা, যাদের অনেকেই চেনে খুব, উঠতে বসতে হাই, হেলো, হোয়াটস আপ! দিনশেষে তারা আসলে অনেক বেশি একা, নিঃসঙ্গ। নির্বাসিত ভেজা কাকের মতো কার্নিশে ঝুলে থাকা একজন ঘুম।

যে ঘুম অনন্ত জেগে থাকে নির্মোহ সবুজ আলো হয়ে।

জেনে রেখো, যে কবিতা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে অলরেডি, তার কাছে ছাতা বা মেঘ, কোনোটারই আবেদন থাকবে না আর আগের মতো। এটাই আধুনিকতা। এটাই বাস্তব ও পূর্ব-নির্ধারিত।

ভালোবাসা কী আসলে? তবে সব হিপোক্রেসি বা সাপ্রেশন ভুলে নিজেকে আমার মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে মন চায় খুব। এই মানে যেন হাঁটতে গিয়ে ভেজা কাদা বা ঝিনুক না লাগে কোমল পায়ে।

আসলে দুঃখের থেকে এমন পরম আর বিশ্বস্ত নন-জাজমেন্টাল বন্ধু আর কেই বা আছে আমাদের প্রতিটি বিষণ্ন মুখর জীবনজুড়ে? ধন্যবাদ তোমাকে।

আমার এক জীবনের দুঃখ হয়ে একলা করে রাখার জন্য। এক মানুষে মুগ্ধ হয়ে একলা বেঁচে থাকার জন্য। তারপরও, একাকী নির্বাসিত জীবন বেছে নেয়া সত্ত্বেও মানুষের ভিতরে এসে থেকে যায় যেমন কতশত মানুষ। নদীদের ভিতর একাকী পলল। আকাশে নরম নীল মেঘ। এটাই বাস্তবতা ও পূর্ব-নির্ধারিত। ধন্যবাদ তোমাকে, প্রিয় উপেক্ষারা।

ক্রমশ অস্তিত্বহীনতা গ্রাস করে চলেছে আমাদের। অস্তিত্ব আসলে কী? অস্তিত্ব মূলত পাশের বাড়ির বালিকা বধূ। মধ্যপ্রাচ্য ফেরত আকাশ দেখার আগেই যাকে দেখতে হয়েছে বিষণ্ণ ছাদ ও সিলিং ফ্যান।

এই কবিতার নামে অহেতুক বাঁচালতার মতোই রিপিট হচ্ছে সময়, সম্পর্ক ও শহরেরা। অনর্থক। একচুয়ালি, লাভ অ্যান্ড পোয়েট্রি আর ওভাররেটেড।

তবু। আমার ভীষণ রাতের মতন রাত নেমেছে। চোখ কপালে উঠল বলে, চোখের মাথা খাবে ভেবে, নরম তুলো মেঘের মতন, দুই চোখে দুই চোখ জমেছে। থাক। এ শহর কতটুকু চিনেছে আমাদের? কতটুকু নিঙড়ে নিয়েছে যার থেকে যা পেরেছে?

এ সময় বড় অদ্ভুতরকম তরল আর গভীরতাহীন। এইসব সম্পর্কেরা অনেক বেশি বায়বীয় আর ক্ষীণ। আর দিন শেষে আমরা সবাই কত একা, তাই না?

আমাদের এইসব হাসিগুলো কি হাসি হয় আদৌ? এইসব শুভকামনাগুলো আসলেই শুভকামনা? এই হাততালি, বাহবা, অভিনন্দন, মন থেকে আসলেই?

এই শতকে যাদের প্রিয় পোশাক মুখোশ, প্রিয় খেলনা কেবল মানুষের মন, ইমেজের জুতো যার পায়, তারাই নির্ভেজাল সুখী হবার অধিকার রাখে এখনো।

তবু। এক বিষণ্ন সবুজ আলোর প্রেমে পরে বেঁচে আছে একদল মৃত কিন্তু সুখী (!) মানুষ। কখনো রাত আর দিন এক করে ভালোবেসে, কীভাবে যেন হুট করে নেই। দেখা নেই। কথা নেই। রেস্টুরেন্ট বা সুপার শপে দেখা হয়ে গেলে একজন ব্যস্ত খোঁজে মেনু। আরেকজন কি যেন কিনতে এসে কি যেন হাতে নিয়ে কাউন্টারে। লিফটের কারাগারে, একজন খোঁজে মাটিতে কিসের ছাপ? অন্যজন ছাদে মাকড়সা? ভরসা কেবল, নামের পাশে শ্যাওলার মতো জ্বলন্ত সবুজ আলোর একমুখী গন্তব্যহীন পথে চলা। ভরসা কেবল, রেস্ট্রিকটেড টাইমলাইন ঘুরে এসে, থেমে থাকা সময়ের আক্ষেপ। তাও তাদের ভাগ্যবানই বলা চলে। বিচ্ছিন্ন, তবুও বেঁচে থাকা!

ধুকে ধুকে মরে গিয়েও মানুষ কী যে বিপুল বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যায়। আহারে জীবন আমাদের!

ক্রমশ অস্তিত্বহীনতা গ্রাস করে চলেছে। আমরা বুঝতেও পারছি না। কখন যেন সময়ের জ্বালানী হয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি সবার থেকেই।

রিপিট হচ্ছে সময়, সম্পর্ক ও শহরেরা। অনর্থক। একচুয়ালি, লাভ অ্যান্ড পোয়েট্রি আর ওভাররেটেড।

লেখাটি শেয়ার করুন :

নাইম আহমেদ

নাইম আহমেদ জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। এখন মানবিক সহায়তা কর্মী হিসেবে কক্সবাজারে কাজ করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!