প্রবন্ধসাহিত্য

কাজী নজরুল ইসলাম : কয়েকটি প্রতিক্রিয়া

কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম এবং সবচেয়ে আলোকঅভিসারী, কালদীপিত কাব্যগ্রন্থ অগ্নি-বীণা প্রকাশের শতবর্ষ পার হল। বলা যায়, প্রকাশ-পরবর্তীকাল থেকে সম্প্রতিও বইটি সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনার উত্তুঙ্গ তরঙ্গ স্তিমিত হয়নি। নজরুল এবং অগ্নি-বীণার শতবর্ষে আমাদের স্মরণালেখ্য।

‘কবি কে?’—এই প্রশ্নের উত্তরে খুবই সংক্ষেপে অথচ তাৎপর্যপূর্ণভাবে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘কবি তো সেই মানুষই যিনি সত্যকে অনুভব করতে পারেন এবং ভাষার আবেগ-প্রদীপ্তির সাহায্যে আমাদের হৃদয়ের ভিতর পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। অর্থাৎ কবির সত্য হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করলাম।’

নজরুলের কবিতা বিষয়ে আলোচনার করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ মনে রেখেছিলেন যে, ‘কোনও এক যুগে মহৎ কবিতা বেশি লেখা হয় না। তাঁর মনে হয়েছে, ‘নজরুল ইসলাম-এর লেখায় মহাকবিতার গভীর প্রসাদ নেই, তাঁর প্রতিশ্রুতিও কম।’ কিন্তু সেইসঙ্গে তিনিই আবার এমন প্রশ্ন উত্থাপন করতে দ্বিধা করেননি যে, ‘কোনও এক যুগে ক’জনের কবিতায়ই-বা তা থাকে?’

কবি-সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ জানিয়েছিলেন, ‘১৯২২ সালে প্রথম নজরুল গ্রন্থকার হিশেবে আবির্ভূত হন, আবার ওই বছরেই তাঁর গ্রন্থ প্রথমবারের মতন বাজেয়াপ্ত হয়―যার স্বাদ উত্তরকালে তিনি পাবেন আরো বারবার।’ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ১৯২২ সালে [কার্তিক ১৩২৯ বঙ্গাব্দ]।
আমরা বলতে পারি, অগ্নি-বীণা সামনে রেখেই বাংলা সাহিত্যে নজরুল-সমালোচনার একটা বড়ো অংশ আবর্তিত হয়েছে। এইটি নজরুলের এমন একটি গ্রন্থ, যা কিনা যুবক বয়সের প্রথম পর্যায়ের রচনা হলেও পরবর্তী সময়ের সমস্ত কাব্যপ্রয়াসকে যেন ছাপিয়ে গিয়েছে। যে-কারণে নজরুলের কাব্য-প্রতিভা আর অগ্নি-বীণা সমার্থক বলা হলেও খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না।

নজরুলের সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমি আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘মিন্টো-মর্লি রিফর্মের দৌলতে (১৯১০) শাসন ও বিচার বিভাগীয় উচ্চতম চাকরিতে নিতান্ত দুই-চারজন যোগ্য উচ্চশিক্ষিতেরই স্থান হইতে লাগিল। ওকালতি ও শিক্ষকতার দিকে আকর্ষণ না থাকায় এই দুই ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তির অভাব দেখা দিল। বাঙ্গালীর জেদ যখন জয়ী হইল, বঙ্গভঙ্গ রদ হইল, শাসন-কর্তৃপক্ষ ভাবিয়াছিলেন ইহাতে বাঙ্গালী শান্ত হইবে। তাহা হইল না, পূর্ব-পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবপ্রচেষ্টার অবসান ঘটাইতে পারিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সে প্রচেষ্টায় বাহিরে-চাপা আগুন নিভিল না, ধূম ছাড়িতে লাগিল।’

নজরুলের কাব্যের প্রথম এবং যথাযথ শৈল্পিক সমালোচনা আমরা পেয়েছি, কবি-সমালোচক-অধ্যাপক মোহিতলাল মজুমদারের কাছ থেকে। শুধু সত্যের খাতিরে নয়; তথ্যের খাতিরে এবং নজরুলের কাব্যকর্মকে বুঝে নিতে পারার স্বার্থেও এই তথ্যটি আমাদের স্বীকার করা উচিত। মোসলেম ভারত-সম্পাদককে লিখিত পত্রে [ভাদ্র ১৩২৭] মোহিতলালের প্রেক্ষণবিন্দু ছিল নজরুলের কবিতার শিল্প-সৌকর্যের দিকেই। সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘মুসলমান লেখকের সমস্ত রচনাই চমৎকার। কিন্তু যাহা আমাকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত ও আশান্বিত করিয়াছে, তাহা আপনার পত্রিকার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিলেখক হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের কবিতা। বহুদিন কবিতা পড়িয়া এত আনন্দ পাই নাই, এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করি নাই। বাঙ্গালা ভাষা যে এই কবির প্রাণের ভাষা হইতে পারিয়াছে…তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ তাঁহার ভাষা ও ছন্দ।’

একজন সমালোচকের কর্তব্য বিষয়ে মোহিতলাল কতটা সচেতন ছিলেন, এই চিঠির মধ্যে দিয়েই সেটির একটি বিশিষ্ট নমুনা আমরা দেখি। নজরুলের কবিতা কেন তাঁকে এই ‘সুখের কর্তব্য সম্পাদনে’ প্ররোচিত করেছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোহিতলাল জানিয়েছিলেন, ‘কাজী সাহেবের কবিতা পড়িয়া সেই ছন্দঝঙ্কারে আবার আস্থা হইয়াছে।…কাজী সাহেবের ছন্দ তাঁহার স্বতঃ-উৎসারিত ভাব-কল্লোলিনীর অবশ্যম্ভাবী গমনভঙ্গী।’

আমাদের সাহিত্যে নজরুল-সমালোচনায় উল্লেখযোগ্য একটি সংযোজন হচ্ছে বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা। ‘নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধের শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, “ক্বচিৎ এমন ঘটনাও দেশে ঘটে, যার ধাক্কায় স্তিমিততম মফস্বলও থরথর করে কেঁপে জেগে ওঠে। গান্ধিজির প্রথম অসহযোগ আন্দোলন তেমনি একটি ঘটনা।…ঠিক এই উন্মাদনারই সুর নিয়ে এই সময় নজরুল ইসলামের কবিতা প্রথম আমার কাছে এলো। ‘বিদ্রোহী’ পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে―মনে হলো এমন কখনো পড়িনি।”

শুধুই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি নয়, বুদ্ধদেব বসু তাঁর আলোচনায় নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘কামাল পাশা’, ‘কোরবানি’ কবিতাটির সূত্র ধরেই নিজের স্মৃতিচারণ করেছিলেন এইভাবে, ‘নোয়াখালির রাক্ষসী নদীর আগাছা-কণ্টকিত কর্দমাক্ত নদীতীরে বসে [কলকাতা-ফেরত এক মুসলমান যুবকের কাছে পাওয়া বাঁধানো খাতা] সেই খাতাখানা আদ্যোপান্ত পড়ে ফেললুম।… সে-সব কবিতা অচিরেই ছাপার অক্ষরে দেখা যেতে লাগলো, তাদের দুরন্ত অভিনবত্ব আমাদের প্রশংসা করবার ভাষাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিলে।’ নিজের আবেগ-যুক্তি আর ভাষার মাধুর্য দিয়ে সমালোচনার এই রীতি যে একান্তভাবেই বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব, সেটি বুঝতে বেগ পেতে হয় না।

নজরুলের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর কবি-ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করতেও বুদ্ধদেব বসু কোনোরকম দ্বিধা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবচেয়ে বড়ো কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের।’

কাব্যরচনায় নজরুলের কৃতিত্ব ঠিক কোথায়, সেটি দেখাতে গিয়ে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ―এবং প্রধান দোষ। পড়েই বোঝা যায় যে যা-কিছু তিনি লিখেছেন, হু-হু করে লিখেছেন; ভাবতে বুঝতে মাজা-ঘষা করতে করতে কখনো থামেননি, কোথায় থামতে হবে দিশে পাননি।’ আবার এরইসঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন, ‘এই ক্ষমতা চমকপ্রদ কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়। এ-দিক থেকে বায়রনের সঙ্গে নজরুলের সাদৃশ্য ধরা পড়ে— সেই কাঁচা, কড়া, উদ্দাম-শক্তি, সেই চিন্তাহীন অনর্গলতা, কাব্যের কলকব্জার উপর সেই সহজ নিশ্চিত দখল, সেই উচ্ছৃঙ্খলতা, আতিশয্য, শৈথিল্য, সেই রসের ক্ষীণতা, রূপের হীনতা, রুচির স্খলন।’ বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনার পুরোটা যেমন গ্রহণ করা যায় না, আবার তাঁর বক্তব্য পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারাটাও কঠিন।

বুদ্ধদেব বসুর পরে আমরা অখণ্ড নজরুলের পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা পেয়েছি আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছ থেকে। তাঁর সমালোচনার একটা বড়ো অংশকে আমরা বলতে পারি প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। যথাযথভাবে বলা হলে এটিকে বলা যায়, পূর্ববর্তী সমালোচকদের বক্তব্যের একটি প্রত্যুত্তর। যেমন মান্নান সৈয়দ যখন বলেন, ‘বিবর্তনহীন? পরিণতিরিক্ত? প্রতিভাবান বালক? নজরুল-প্রাসঙ্গিক এইসব উক্তির একটি কারণ নজরুল-সমকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনঘোর উপস্থিতি। নানারকম চেতনাপ্রসারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের বিস্তর সাযুজ্য থাকলেও, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ। নজরুলকে সর্বাংশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ ও সমান্তরাল মনে করলে ভুল করব আমরা; কিন্তু ও-রকম তুলনামূলকতার এ-রকম বদভ্যাস তৈরি করেছি আমরা, যে, হয় নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিশেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করি, অথবা তাঁকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিই। কিন্তু রবীন্দ্রোচিত বিবর্তন—বাংলা কাব্যেতিহাসে—আর কই?’

একইসঙ্গে এই কথাটিও এখানে বলতে হয় যে, আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে ‘নজরুল-মানসের চৈতন্যের পরমতা দেখতে পেয়েছিলেন।’ তাঁর মতে, “বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে ‘রেনেসাঁসী প্রমূল্যসমূহ তার সবগুলি পাপড়ি মেলেছিলো। ব্যক্তিসত্তার জয়গান পরিপূর্ণ উন্মোচনে ময়ূরের মতো চীৎকার করে উঠেছিলো। উনিশ শতাব্দীর বাংলা দেশেই জয়ী হয়েছিলো দেবত্বের উপর মানবত্বের সাধনার ধারা। মানবজাতির প্রবাহে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি মূল্যবান। এই বোধ মাইকেলের মতো রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুলেও আর একবার তীব্র প্রজ্জ্বলিত।’ নজরুল-সাহিত্যের যথাযথ পর্যালোচনার জন্য আবদুল মান্নান সৈয়দের এই দেখার দৃষ্টিকে বিশ্লেষণ করতে পারাটাও খুব জরুরি।

আমরা খানিকটা অবাক হয়ে দেখতে পাই যে, গোলাম মোস্তফা তাঁর প্রবন্ধে নজরুল সম্বন্ধে বলেছেন, “ইকবাল যে খুদির প্রতিষ্ঠা ও স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেছেন, ‘বিদ্রোহী’ ঠিক সেই আদর্শের নয়।” মোস্তফার মতে, ‘বিদ্রোহী’ রচনার মূল প্রেরণা হচ্ছে, ‘জ্ঞানের অহমিকা’। শুধু তা-ই নয়, গোলাম মোস্তফা তাঁর কথাকে সবিস্তারে বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রেমের কমনীয়তা নেই। গোলাম মোস্তফা এমনও মন্তব্য করেছিলেন, ‘শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তো মানুষ হিসাবে কর্তব্য। বিদ্রোহের কোনো কথা নয়, তার সঙ্গে করতে হবে আমাদের জেহাদ। বিদ্রোহের কথা উঠলে তো মিতালীর কথা আগেই স্বীকার করা হয়ে যায়। কাজেই বিদ্রোহের কথা অবান্তর। ইসলামে তাই কোনো বিদ্রোহের কথা নেই, আছে দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা।’ এইভাবে সাহিত্যের আলোচনার গতিমুখকে তিনি ধর্মের আলোচনার দিকে ফিরিয়ে রাখলেন।

অন্যসব সমালোচকের মতো গোলাম মোস্তফাও আমাদের জানাচ্ছেন, “অগ্নিবীণা’ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৩২৯ সালে ইহা প্রথম প্রকাশিত হয়। ইহাতে মোট ১২টি কবিতা আছে।… এর ভিতরে ৭টি ইসলামী ভাবাপন্ন, বাকী ৫টি ইসলাম ও পাকিস্তানী আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী।’ নজরুলকে এইভাবে প্রত্যাখ্যান করতে গোলাম মোস্তফা নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইসলামী দর্শন এবং পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের আলোকেই আমরা নজরুল কাব্যের বিচার করিয়াছি। আমরা আজ নূতন পথে জয়যাত্রা করিতেছি। প্রথমেই তাই আমাদের লক্ষ্য ও আদর্শের নির্দেশ একান্ত প্রয়োজন।’

আবার অন্যদিকে দেখতে পাই, পরবর্তীকালে সাহিত্যসমালোচক হুমায়ুন আজাদ কোনো-এক অজানা কারণে খানিকটা ‘বিব্রত’ হয়ে লেখেন, ‘বাঙলা লেখকদের লেখা পড়ার সময় বিব্রত বোধ করি বারবার। আমাদের প্রধান লেখকদের মধ্যেও মৌলিকত্ব শোচনীয়রূপে কম, যখন তাঁরা চিন্তা করেন তখন তাঁরা অনেকটা শিশু।’

আজাদের এই ‘বিব্রত’ প্রবণতার প্রধান শিকার সম্ভবত কাজী নজরুল ইসলাম। কেননা, আজাদ জানিয়েছিলেন, ‘তরুণ বয়স থেকেই অস্বস্তি বোধ করি আমি নজরুলের লেখা পড়ার সময়; তিনি মাঝারি লেখক বলে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভ্রান্ত লেখক বলে। তিনি ভারী বোঝার মতো চেপে বসে আছেন বাঙালি মুসলমানের ওপর।’ তাঁর ভাষায় নজরুল হচ্ছেন, ‘বাঙলা ভাষার বিভ্রান্ত কুসংস্কার-উদ্দীপ্ত লেখকদের মধ্যে প্রধান।’

১০

‘রবীন্দ্রনাথ ও পরবর্তী কাব্যধারা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্র-পরবর্তীদের মধ্যে জনগণের কবি প্রকৃতপক্ষে নজরুল ইসলামকেই বলা চলে। জনগণের নাড়ী কোনখান দিয়ে বয়, সে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অব্যর্থ।’ আবার আইয়ুব এ-ও বলেছেন যে, ‘সাহিত্যকে যদি জীবনের সমালোচনা বলা হয়, তা হলে নজরুল ইসলাম বড় সাহিত্যিক বলে গণ্য হতে পারেন না।’ এটি বলার পরেও নজরুল-সাহিত্যের আরেকটি প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করে আইয়ুব জানিয়েছিলেন, ‘সাহিত্যিক তো শুধু সমালোচক নয়, সমাজের অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তির সে প্রতিফলকও বটে। এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক বাংলা কাব্যে নজরুলের তুলনা নেই।’ আর এরপরই আইয়ুব সিদ্ধান্ত টানেন এই বলে, ‘বাংলার বুকে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিদ্রোহের যে-আগুন জ্বলে উঠেছিল, সেই আগুনের স্পর্শে তাঁর বীণা হল অগ্নিবীণা। জাতীয় বিপ্লবের তিনিই সার্থক সাহিত্যিক প্রতিভূ।’

১১

রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসু কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে স্বীকার করে জানিয়েছিলেন, ‘নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়—এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী, তা স্পষ্ট বুঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব—তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান গাইব।’ নজরুলের কাব্যে যে-সাবলীল বেগের কথা বলা হয়ে থাকে, সেটি আমাদের শিল্প-চৈতন্যে নতুন কাব্যবোধের জন্ম দিক, জন্ম দিক নতুন-নতুন সমালোচনার রীতি-পদ্ধতিরও ।

১২

কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বাস করতেন, ‘একজন কবিকে… তাঁর প্রতিভার কাছে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনও একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্ত প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্যে।’ আবার সেইসঙ্গে তিনি এটিও বলতে ভোলেননি যে, ‘মানুষের শিল্প-সাধনার…বহুমুখিনতার বৈচিত্র্যকে…আমাদের স্বীকার করতে হবে।’ আমাদের সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ত্রুটি এই যে কথাগুলোকে আমরা বেশিরভাগ সময়ই ভুলে থাকি। সে-কারণেই আমাদের সমালোচনা-সাহিত্য খুব বড়ো একটা পরিধিজুড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এটি কারো একার নয়, আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। লেখাই বাহুল্য, সেই ব্যর্থতার হাত থেকে নজরুল ইসলামের মতো কবিকেও আমরা রেহাই দিতে পারিনি।

লেখাটি শেয়ার করুন :

সৌভিক রেজা

সৌভিক রেজা। জন্ম ১৯৭০। লেখাপড়া ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা অধ্যাপনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!