জাফরুল্লাহ চৌধুরী
সূর্যকরোজ্জ্বল অনন্তলোক
নির্লোভ, নির্মোহ এবং নিশঙ্কচিত্তের একজন মানুষ, নিষ্প্রদীপ অন্ধকারে আলো জ্বেলেছিলেন। স্বেদ, রক্তে বয়ে বেড়িয়েছেন দেশ-মাটি-মানুষের মঙ্গলবোধ। তিনি জাফরুল্লাহ চৌধুরী (২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১-১১ এপ্রিল ২০২৩)।
তাঁর বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ওই উদ্দামতা রক্তস্রোতে বহন করে চলেছিলেন। তিনি প্রয়াত হলেন, অনন্তলোকে নক্ষত্রপ্রতিম তাঁর অভিযাত্রা।
জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারে নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরই মধ্যে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চিকিৎসাবিদ্যার চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে লন্ডন থেকে ভারতে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আগরতলা মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। এর পর ডা. এম এ মবিনের সঙ্গে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যজ্ঞান দান করেন; যা দিয়ে তাঁরা রোগীদের সেবা করতেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
দেশ স্বাধীন হলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল। পরবর্তীকালে তা চিকিৎসাশিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন গণবিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর তৈরি ওষুধ নীতি আন্তর্জাতিক পরিসরে অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেবল চিকিৎসাবিদ্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে তিনি এগিয়ে এসেছেন, দাঁড়িয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
এই মহান মুক্তিযোদ্ধা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ফিলিপাইনের রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসেবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডার সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান।
এসব স্বীকৃতি তাঁর চিন্তা ও কাজের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা, যে জীবন তিনি যাপন করেছেন- নিতান্তই সাধারণ, বিলাসের সবকিছু ত্যাগ করার অভাবিত ব্রত এবং দেশ ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা-এসবই পুরস্কার বা সম্মাননার অনেক উপরে।
উপরে নীল আকাশ, অন্তহীন নক্ষত্রলোকে এই তবে তাঁর অভিযাত্রা।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দুটি চিঠি নিবেদিত হলো।
মওলানা ভাসানী সমীপে
২৮ এপ্রিল, ১৯৭১
শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেব,
বিলেতস্থ পূর্ববাংলার প্রবাসী ডাক্তারদের পক্ষ থেকে আমি এ চিঠি লিখছি।
আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের জাতীয় সরকার এবং আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন সফল হবেই। বিদেশ থেকে আমরা আপনাদেরকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি, তৎসম্পর্কে কিছু আলোকপাত করলে বিশেষ বাধিত হবো। মুক্তি-সেনানীদেরকে আমরা আর্থিক এবং অন্যান্য ব্যাপারে সাহায্য করতে ইচ্ছুক।
আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
আপনাকে এবং আমাদের সব মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আপনার স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনান্তে-
ইতি
জাফরুল্লাহ চৌধুরী
যুগ্ম-আহ্বায়ক, বাংলাদেশ
মেডিকেল এসোসিয়েশন।
ভাসানী সমীপে নিবেদন ইতি : মওলানা ভাসানীকে লেখা চিঠিপত্র : ১৯৬৯-১৯৭৬, সৈয়দ ইরফানুল বারী সম্পাদিত, ২য় সংস্করণ, প্যাপিরাস, ২০১৯ ঢাকা। পত্র নম্বর ১৮, পৃষ্ঠা ৬৫
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান
মন্দবাগ, কুমিল্লা।
বাংলাদেশ
১৮ই অক্টোবর, ১৯৭১ইং
বন্ধুগণ,
কঠোর কাঠফাটা রোদ আর কাক-ডাকা দুপুর। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণপ্রান্তর ঘুরে আমি আবার ফিরে এসেছি মন্দবাগে। মন্দবাগের সঙ্গে আমাদের আত্মার সংযোগ রয়েছে। মন্দবাগের যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছে সতের বছরের ছেলে জাকের এবং আরও অনেকে। ভবিষ্যতে মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের নাম হবে ‘জাকের ষ্টেশন’। এর অদূরে শালদা’র কূলে এক ছোট পাহাড়ের ঢালে গত মাসে সমাহিত করেছি আমাদের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর সেনানীকে। ভদ্রলোক বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দখলীকৃত বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসের ব্যাপারে তিনি সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন ম্যাপ, চার্ট ইত্যাদি দিয়ে। ইয়াহিয়ার জঙ্গিবাহিনী তাঁকে ধরার চেষ্টা করলে, মুক্তিবাহিনী তাঁকে ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় নিয়ে আসে নিরাপত্তার জন্য। মুক্তবাংলায় এসে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার মবিন ও নাজিমের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মারা গেলেন উপযুক্ত ওষুধপত্রের অভাবে।
অদূরে আমাদের ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। এটাই বাংলাদেশের মুক্তিসেনানীর প্রথম হাসপাতাল। এর স্থাপনে আমাদের বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ অবদান রয়েছে। তবে ঐ হাসপাতাল তৈরির সব কৃতিত্ব ডাক্তার মবিনের। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মবিন আমাদের সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক। গত মে মাস থেকে মবিন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করছেন। তার অপূর্ব ত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতিরেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র চিকিৎসালয় স্থাপন সম্ভব হতো না। হাসপাতালে বর্তমানে একশতজন অসুস্থ মুক্তিসেনানী রয়েছে। ত্রিশজন গ্যাসট্রো এনট্রাইটিস, পেপটিক আলসার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও নিউমোনিয়ায় ভুগছে। বাকি সব আহত মুক্তিযোদ্ধা। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডস্থ সিএন্ডবি ব্রিজ সন্নিকটস্থ এক সংঘর্ষে আহত হয়ে আসা মুক্তিসেনানী আজও ভর্তি হয়েছে। এ সংঘর্ষে আমরা চারজন নির্ভীক বীরকে হারিয়েছি কিন্তু খতম করেছি পনের জন দস্যুসৈন্য ও ৭ জন রাজাকার। হাসপাতালে ফিরতে আমার সংকোচ হচ্ছে। একটুকু এনালজেসিক নেই, নেই সামান্যতম ড্রেসিং। দু’সপ্তাহ যাবৎ থান কাপড় কেটে ড্রেসিং হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। এখন তাও ফুরিয়ে গিয়েছে- আশপাশের অঞ্চলে থান কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে না। যথাযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা নেই। হানিফের woundটা ইনফেকটেড (Infected) হয়েছে। ষোল বছরের ছেলে হানিফ ঢাকার গুলবাগ বৈদ্যুতিক সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দিয়ে ফেরার পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে আহত হয়। Compound Tibia-Fibula Fracture নিয়ে, সাত দিন পরে আমাদের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়।
চারদিকে অভাব আর অনটন। প্রয়োজন আর প্রয়োজন। প্রয়োজনের তাগিদ যেন আহ্ববান জানাচ্ছে প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের কাছে-তোমরা আস, কাজ কর, মুক্ত কর বাংলাদেশকে। আমার নিজের মনে আজ প্রশ্ন জাগছে-আমরা যাঁরা বিদেশে আছি, তাঁরা সবাই চেষ্টা করলে কি প্রয়োজনীয় Analgesics, Antibiotics, Dressing Preventive Drugs-এর ব্যবস্থা করতে পারি না?
২৮ শে সেপ্টেম্বর ‘৭১ ইং। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী আমাদের হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। কর্নেল ওসমানী অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী। তাঁর সঙ্গে বিশ বছর আগেও যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের সবার নাম তাঁর মনে আছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিটি সৈনিককে তিনি চিনেন। তিনি আহার-নিদ্রা ভুলে থেকে ঝড়-বৃষ্টি, শত্রুপক্ষের অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে তিনি পরিদর্শন করছেন বিভিন্ন রণাঙ্গন-উৎসাহিত করছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। হাসপাতাল দেখে তিনি খুশি হলেন। কিন্তু ওষুধপত্রের অভাব দেখে তাঁর চোখে-মুখে যে বেদনার উদ্রেক হয়েছিল, তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
হাসপাতাল দেখে কর্নেল ওসমানী বললেন-‘আমি এরূপ আরও দশটি হাসপাতাল চাই। আপনি চলুন আমার সাথে। হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচন করবেন। বিলেত থেকে আরও দশজন সার্জন, ও দশজন এনাসথেটিককে আসার জন্য লিখে দিন। মনে মনে ভাবলাম মাসিক ২০০/২৫০ পাউন্ডের মায়া ছেড়ে বিশজন ডাক্তার কি বাংলাদেশের এ কঠোর ও প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করতে আসবেন?
কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের সেক্রেটারি ডা. টি. হোসেন এবং অসমসাহসী সেনাপতি (কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিলেন জঙ্গিশাহী ইয়াহিয়া-নরপশুদের মনে। দলের সঙ্গে আমি ‘কোণারন’ গেলাম। সেখানে দেখা হলো ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যুবক। উপযুক্ত অর্থ নেই, উপযুক্ত খাদ্য নেই, তবু উৎসাহের শেষ নেই ক্যাপ্টেন গাফফারের। তিনি আমাকে দেখালেন সদাধৃত তিনজন পাঞ্জাবি সৈন্যকে।
সেক্টর হেডকোয়ার্টারে, বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের এক রুদ্রমূর্তি দেখলাম। আমাকে দেখে, সমস্বরে ‘জয়বাংলা’ বলে জড়িয়ে ধরলো বাদল, আলম, জিয়া, খোকন, মায়া, বাসার, কাজী, সাইদ ও আরও অনেকে। এদের প্রত্যেকের নাম ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন বিজয় অভিযানের সঙ্গে জড়িত। ১৪ আগস্ট। তথাকথিত পাকিস্তানের জন্ম দিবস। পাশবিক আনন্দে মেতে উঠেছে নরপশুরা। এ দিনে চারজন তরুণ প্রবেশ করলো ঢাকায় অভিজাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তারা নরপশুদের সঙ্গে মিলে হৈ-হল্লায় মেতে উঠলো। কে বলবে তারা মুক্তিবাহিনীর লোক। রাত যখন গভীর হলো, যুবকগুলো হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। আর অল্প কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধসে পড়লো হোটেলের এক বিরাট অংশ। চার যুবকের একজন কাজী। ১৯ আগস্ট। আগে থেকেই ঢাকার নাগরিকদের মুক্তিবাহিনী জানিয়ে দিয়েছিল, যে কোনো সময়ে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঢাকার নাগরিকরা মোমবাতি ও হারিকেন নিয়ে প্রতিদিন প্রস্তুত থাকতো। ১৯ আগস্ট রাতে সে মুহূর্তটি এলো। ঢাকা শহর ও উপকণ্ঠের বৈদ্যুতিক আলো নিভে গেল। অসুবিধার মধ্যেও ঢাকার নাগরিকদের মুখে হাসি ফুটলো। ২৯ আগস্ট। কাজীদের দলের কয়েকজন ধরা পড়েছে। তাদেরই একজন অত্যাচার সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করে দিয়েছে সকলের নাম। গভীর রাতে কাজীর বাসা অবরোধ করলো পাঞ্জাবি নরপশুরা। কাজী ও তার তিন বন্ধু মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিল। বাড়ি সার্চ করে, পাকিস্তানি সৈন্যরা একটা চাইনিজ অটোমেটিক পিস্তল পেলো। কাজীদের দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করালো শেষ করে দেবার জন্য। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন অন্যরকম ছিল। কাজীর পায়ের কাছে একটা বালিশ ছিল। সে পা দিয়ে সেটা ঠেলে দিল সামনের দিকে। ক্ষাণিকের জন্য শক্রদের দৃষ্টিচ্যুত হলো। কাজী ক্ষিপ্রতার সাথে হাবিলদার থেকে স্টেনগানটা ছিনিয়ে নিয়ে খতম করলো চারটি নরপশুকে। কাজী যখন স্টেনগান নিয়ে বেরিয়ে এলো, তখন আরও তিনজন নরপশু একযোগে তাকে আক্রমণ করলো। সে ক্ষিপ্রতার সাথে তাদেরও খতম করলো। ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকার বড় মগবাজারে। কাজীর দিকে তাকালাম। বাংলাদেশের সাধারণ এক যুবক। গর্বে আমার মন ভরে উঠলো। কাজী আবার প্রস্তুত হচ্ছে নরপশুদের হত্যার জন্য।
পশ্চিম সীমান্তে দেখা হলো মেজর মনযুরের সঙ্গে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজপুতনার মরুভূমি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেবার জন্য। দিনাজপুরের তেতুলিয়া, রংপুরের পাটগ্রাম, ময়মনসিংহের তারাটিয়া থানা, রুমারী (বর্তমান রৌমারী), কোদালকাটি, চিলমারী ও হালুয়াঘাটের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুকবলমুক্ত। ময়মনসিংহ এলাকার মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কর্নেল জিয়াউর রহমান। ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে তিনিই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এক পর্যায়ে কর্নেল শফিউল্লাহ ও মেজর নুরুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। গত পরশু মুক্তিবাহিনী ‘ছাতক’ আক্রমণ করে বাংলাদেশের জয় পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলেছে। এন্টি-এয়ারক্রাফট গানের অভাব আমাদের মনোবল ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি।
স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গত ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ৫,০০০ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী ২,০০০ টাকা মঞ্জুর করেন। তাঁরা আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করেন এবং মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রবাসী উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তারদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। আমাদের শরণার্থীদের (Refuges) সম্পর্কে কিছু না লিখলে আমার এ চিঠি অসম্পূর্ণ থাকবে। মুজিবনগরের পথে বহু শরণার্থী শিবির দেখেছি। জঙ্গিশাহী ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের চিহ্ন বহন করে এনেছে প্রায় প্রতিটি বাস্তুহারা গৃহহীন মানুষের দল। ভারত সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এ যে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। হাজার হাজার শিশু, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর পথে। চারিদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের দেশবাসী হাসিমুখে এত কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে। আর আমরা বাংলাদেশের ডাক্তাররা কি নির্বিকার, অথর্ব হয়ে থাকবো জাতির দুর্দিনে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পাকিস্তানিদের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মুক্তিবাহিনী। জয় আমাদের হবেই। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের সম্মুখে বাধার প্রাচীর হয়ে থাকতে পারবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে আজ অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ- নিজের সম্পদ-শক্তি দিয়ে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। প্রবাসী বাঙালিদের কী ভূমিকা হবে? আমরা কি আমাদের আয়ের শতকরা দশ ভাগের মায়া ত্যাগ করতে পারি না? শালদার তীরে শহীদ জাকের, জব্বার, আশরাফ, ইসলাম ও আরও অনেক নাম না জানা অমর সৈনিকদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ বিদীর্ণ অপরাহ্নে আমি সব প্রবাসী বাঙালিকে বিশেষত ডাক্তার বন্ধুদের আহ্বান করছি আরও সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য।
শুভেচ্ছা রইল।
ইতি
আপনাদের প্রীতিধন্য
জাফরুল্লাহ চৌধুরী