আবুল হোসেনের স্বপ্নভঙ্গের পালা
জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
আবুল হোসেন [১৫ অগাস্ট ১৯২২-২৯ জুন ২০১৪]
বসন্তের হাওয়ায় দুর্মর দুঃসাহসে কালের উতরোল অন্ধকার এবং ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন আঠারোর এক তরুণ। দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, সরকারি চাকরিসূত্রে। কিন্তু কৌতূহল ছিল সেসব দেশের মানুষ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি। ফলে উচ্চপদের দায়িত্ব পালনের পরও ঈর্ষণীয় বন্ধু-পরিসর গড়ে উঠেছিল তাঁর। তিনি আবুল হোসেন। বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারী বলে কথিত। সময়ের বিচারে সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পকলার তাৎক্ষণিকতার অনেককিছু ক্লিসে হয়ে উঠলেও তিনি আমাদের নমস্য। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ হলো তিনটি গদ্য।
বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত করা হয় কবি আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪)। চল্লিশের দশকে যাঁর কবিতার অঙ্গনে পথ চলা শুরু। নববসন্ত (১৯৪০) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। লিখেছেন কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা। এছাড়া অনুবাদও করেছেন। তাঁর একটি পাঠকপ্রিয় গদ্যগ্রন্থ স্বপ্ন ভঙ্গের পালা। সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য বেশকিছু পুরস্কার পান। তাঁর লেখায় দেশ-কাল-জীবন বাক্সময় হয়ে উঠেছে এমনটা বলা যায়। গদ্যগ্রন্থ স্বপ্ন ভঙ্গের পালা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সদ্য স্বাধীন একটা দেশের রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক জীবনের কিছু খণ্ডচিত্র এবং এর পাশাপাশি কয়েকটা আর্ন্তজাতিক সাহিত্য সম্মেলনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে অনেকটা স্মৃতিকথার আদলে।
আবুল হোসেন এক অর্থে ত্রিকালদর্শী লেখক। এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। ব্রিটিশ শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে উঠেন আর পাকিস্তান শাসনামলে তিনি মননশীলতার চর্চা করেন। একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে নিজের চারপাশ বিশ্লেষণ করেছেন, কবিতার আলঙ্কারিক জগতে সেই চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের বেশি সময় কাটিয়েছেন। সামাজিক মানুষ হিসেবেই তিনি চারপাশ দেখার সুযোগ পেয়েছেন তা নয়, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজকর্ম দেখার সুযোগ তাঁর ঘটেছে। বিভিন্ন সময় দেশে ও বিদেশে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার সুবাদে তাঁর দেখার জগৎ হয়েছে বিস্তৃত। ফলে একাডেমিক এবং একই সঙ্গে একজন সৃষ্টিশীল মানুষের যৌথজীবন কাটিয়েছেন তিনি। তাই তাঁর লেখা ভিন্ন এক গভীরতা ধারণ করতে সক্ষম।
স্বপ্ন ভঙ্গের পালা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় চল্লিশ বছরের জীবনের একটা প্রবাহচিত্র বলা যেতে পারে। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসনে তিনি কাজ শুরু করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ে। ফলে অনেক কিছু দেখেছেন তিনি। খুব সাদা চোখে দেখা একটা যুদ্ধাক্রান্ত দেশের মুক্ত হয়ে নিজেকে গুছিয়ে তোলার চিত্র এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রশাসনিক বিভিন্ন দিকের খণ্ড খণ্ড ছবি প্রায় সামগ্রিকতা নিয়েই এখানে ফুটে আছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থা, শাসক বদলের গল্প এবং তারপরের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন শাসকদের শাসনামলকেও তিনি উপস্থাপন করেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কখনো মিষ্টতা কখনো তিক্ততার আভাসে বেশ জীবন্ত একটা রূপ এখানে লক্ষ করা যাবে। জীবন নিয়ত প্রবহমান। এখানে পদে পদে বাঁক থাকে। যার বদল ঘটে। সেই বদলে কান্না-হাসির দোদুলদোলায় চলে মানব সংসার। এমন বহুবিধ বদলের চিত্র আবুল হোসেন তাঁর নিজস্ব চেতনার আলোকে, ভাবনার গভীরতায় ভাষারূপ দেবার চেষ্টা করেছেন।
স্বপ্ন ভঙ্গের পালার এক ধরনের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় চালচিত্র হিসেবে আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। জীবনের প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তির মনের ছায়া, চিন্তার গভীরতা এসবের ছাপ রাষ্ট্রের কার্যক্রমের উপর পড়ে। সে আলোকে লেখক এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের নিজেকে গড়ে তোলার যে লড়াই তার কথাও সংগোপনে লিখে চলেন। সঙ্গে এই নতুন দেশটার পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের বিশ্লেষণও আছে। যা একটি দেশের ভাবমূর্তিকে তুলে ধরে বিশ্বের অঙ্গনে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলার দুরূহ পথটিকে পাঠকের দেখার সুযোগ মেলে। এখানে আরেকটি বড় বিষয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চালচিত্র। লেখক মননশীলতার চর্চাকারী হওয়ায় লেখায় বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনের এবং সাহিত্যিকদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ এসেছে, যা পাঠকের সামনে এক অন্য জগৎ খুলে দেবে।
আবুল হোসেন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের একজন হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম রিপাবলিক কাজাখস্তানে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদান করেন। তাদের দলনেতা ছিলেন অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম (বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক) এবং অন্যরা হলেন মিসেস লায়লা সামাদ (লেখক ও রেডিও শিল্পী), অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (কবি ও গীতিকার), অধ্যাপক কাজী আবদুল মান্নান (গবেষক)। এছাড়া মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর হাসান হাফিজুর রহমান (কবি ও সাংবাদিক), শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কাউন্সিলর আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন (কিশোর লেখক) মস্কো ও কাজাখস্থানের রাজধানী আলমা আতায় লেখকদের সঙ্গে যোগ দেন। মস্কোয় কাটানো সময় তাদের বেশ উপভোগ্য ছিল। রুশ সাহিত্যের প্রতি লেখকের বিশেষ অনুরাগ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন—এসব মিলিয়ে লেখক বেশ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই সফরকে উপভোগ করেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কাজাখস্তানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটা দিক উন্মোচন করা হয়েছে এখানে খুব স্বল্প আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
লেখকের এই সম্মেলনে আলাপ হয় দুই সোভিয়েত কবির সঙ্গে। একজন রুশ ইয়েভগেনি ইয়েভটুশেঙ্কু—সারা পৃথিবীতে তাঁর নাম। আরেকজন দাগেস্তানবাসী রসুল গামজাতভ। লেখেন মাত্র দুই লক্ষ লোকের কথা বলার ভাষা আভার-এ। যেখানে দাগেস্তানে চল্লিশটি ভাষা রয়েছে। এই আভার ভাষার কবি দাগেস্তানই তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। তিনি মনে করেন, ‘কবির প্রাথমিক লক্ষ্য তার নিজের ভাষার পাঠক ও শ্রোতা হলেও, তিনি তো লিখছেন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য। অনুবাদ ছাড়া বাইরের বিশ্বে তিনি কী করে পৌঁছবেন।’ অন্যদিকে ইয়েভটুশেঙ্কু উল্টো কথা বলেন :
গদ্য অনুবাদ করা সহজ, কিন্তু কবিতার অনুবাদ হয় না। অস্বীকার করব না, আমিও অনুবাদের মাধ্যমে বাইরের বিশ্বে পরিচিত হয়েছি, তবু বলি আমার কবিতার অনুবাদ আমার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। রুশ কবিতার ছন্দ ও মিল যে আবহ সৃষ্টি করে, ইংরেজি অনুবাদে তা খুব কমই দেখেছি।
এখানে লেখকের আলাপ হয় প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দরবিশ-এর সঙ্গে। আরব বিশ্বের অন্যতম সেরা এই কবি অনুবাদ নিয়ে বলেন, ‘তর্জমা, আমার মনে হয়, আয়নার মধ্য দিয়ে চুমো খাওয়ার মতো।’ এভাবে সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণও উঠে আসে এ লেখায়। আসে কাজাখ কবি মোজাফফর আলিমবায়েভের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের এলাহি কারবারের চিত্রও। লেখকের এখানে এক ভক্তের সঙ্গে আলাপ হয়। আর্মেনিয়ার মেয়ে তাতিয়ানা। যিনি বাংলাদেশ পর্যন্ত লেখককে কার্ড পাঠিয়ে স্মরণে রেখেছিলেন। আর সেই প্রসঙ্গে ঢাকার আরমানিটোলা, পগোজ স্কুল, গির্জা এই লেখায় সযতনে জায়গা পেয়ে যায়।
লেখক এবং এই সমাজের ব্যক্তিমানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আবুল হোসেনের পর্যবেক্ষণ থেকে তুলে ধরা হলো :
আলমা আতায় আফ্রো-এশীয় সম্মেলনে বিদেশি অতিথি আমরা ছিলাম একশ’-দেড়শ’জন। সম্মেলনে যোগদানকারী সোভিয়েত লেখকদের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হবে। তাদের সঙ্গে মেলামেশায়, আলাপ-আলোচনায় এ দেশে লেখকদের বিশেষ সম্মানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বেশিরভাগ লেখকদের মতো সোভিয়েত ভূমির লেখকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিন্ন বৃত্তি খুঁজতে হয় না, তারা লেখক হিসেবেই সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারেন। এক সন্ধায় জনৈক কবি বললেন সেদিন সকালে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে এবং এই মাত্র খবর পেয়েছেন প্রথম সংস্করণের সব কপি ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। তার কথা শুনে আমি এমন স্তম্ভিত হই যে, তাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই প্রথম সংস্করণ কত কপির ছিল।
১৯৭৩ সালের যে চিত্র লেখক আমাদের দেখান অর্থাৎ যে তুলনা তিনি করেন সোভিয়েত লেখক এবং আমাদের দেশের লেখকদের সঙ্গে তার বাস্তবতা এখনও বিরাজমান। প্রাসঙ্গিকতার নিরিখেই বলছি এখনও আমাদের দেশের বেশিরভাগ লেখককে ভিন্ন একটি পেশা বেছে নিতে হয় জীবনযাপনের জন্য। লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ পঞ্চাশ বছরেও এদেশে হয়নি। মেধার কদর না থাকলে প্রতিভার সমঝদার না থাকলে প্রতিভা জন্মাবে কীভাবে? এখানে লেখকদের পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার একটা প্রবণতা এই কারণেই দেখা যায়। মূল্যায়নের জায়গাটা বড্ড গোলমেলে। মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনেক জাগতিক সমীকরণ। ফলে একটা অসুস্থ দৌড় প্রতিযোগিতা আমাদের চারপাশকে ঘিরে রয়েছে।
লেখক কাজাখ কবি আলিমবায়েভের সরকারের দেওয়া ফ্লাট দেখে অবাক হন। ভাবেন :
আঠারো শতকের শেষেও এই কাজাখরা যাযাবরের জীবনযাপন করত। ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল কিছুই ছিল না। তীরের মতো ঘোড়া ছুটাত, ভেড়া চরাত। বিনা চিকিৎসায় মরত হাজার হাজার মানুষ। আজ সেই কাজাখস্তানের সমৃদ্ধি দেখে চোখ কপালে ওঠে। ৫০ বাছরে সোভিযেত সরকার অসাধ্য সাধন করেছে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষা যে কাজটা করতে পেরেছে সেটা আমাদের মতো দেশে কেন জানি হয়ে ওঠে না। শিক্ষার গলদ নাকি জাতিসত্তার মধ্যে কোথাও কোনো শূন্যতা রয়ে গেছে? শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্মান দেখানো একটা সংস্কৃতিমনা জাতির পরিচয়। আমাদের দেশে সেখানেও একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়ে গেছে। লেখকের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয় এই সফরে। দুই কাজাখ ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং তিনশ টাকার মতো রুবল তার হাতে ধরিয়ে দেয়। এই কারণে যে, তাঁর লেখা কয়েকটি কবিতা তারা অনুবাদ করেছিল। সে বাবদ সম্মানী। এসব কথা অনেকটা রূপকথার মতো শোনায়। যে দেশ গুণীদের সম্মান দেয় সেখানেই গুণীদের বাড়-বাড়ন্ত ঘটে। একথা নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই।
লেখকেরা কাজাখ থেকে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে যান। সেখানে আরেকটি সম্মেলন ছিল। পথে প্লেনে আলাপ হয় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী দ্বিতীয় ভারতীয় হরিবংশ বচ্চনের সঙ্গে। তিনি হিন্দিভাষীর বাইরেও পরিচিত ছিলেন তাঁর লেখার জন্য। এই তাসখন্দেই লেখকরা অনুষ্ঠানসূচির অংশ হিসেবে সমরখন্দ ও বোখারা ভ্রমণ করেন। মধ্য এশিয়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ এই দুই শহরে নতুনের সঙ্গে পুরোনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন পাশাপাশি অবস্থান করছে। সমরখন্দের তাইমুর লঙ এবং বোখারার ইমাম আল বোখারি তাদের কর্মের জন্য বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে আছেন। সমরখন্দ নিয়ে লেখক বলছেন :
সমরখন্দ বিখ্যাত হয়ে আছে প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, তার ভৌগোলিক অবস্থান। দ্বিতীয়, বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র। চীন এবং পাশ্চাত্যের বাণিজ্য পথের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিতি এবং উচ্চ বিদ্যাশিক্ষার ইসলামী কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত সমরখন্দকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
এই শহরে আছে তাইমুরের স্মৃতিসৌধ। যেটা গোর-ই আমির নামে পরিচিত। এটা আসলে তাইমুর রাজবংশের স্মৃতিসৌধ। সমরখন্দ ২৭৫০ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে পারসিক, গ্রিক, তুর্কি, আরব, মঙ্গল, উজবেক, রুশ শাসকদের অধীনে এসেছে। কেউ কেউ রাজধানী বানিয়েছে। এর ফলে এখানে বহুবিচিত্র সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে।
তবু চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে তাইমুর ও তার উত্তর-পুরুষদের আমলে এই শহর সমৃদ্ধির শিখরে ওঠে। আরবরা এ অঞ্চলকে দিয়েছিলেন ইসলাম, স্থাপন করেছিলেন সমরখন্দে মুসলিম বিশ্বের প্রথম কাগজের মিল। সে আবিষ্কার দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম বিশ্বের অবশিষ্ট অংশে এবং সেখান থেকে ইউরোপে। তাইমুরের স্বপ্ন ছিল সুদূরপ্রসারী। ভারত থেকে তুর্কি পর্যন্ত বিস্তৃত যে বিশ্ব-সাম্রাজ্যের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি, সমরখন্দকে তার রাজধানী করেন ১৩৭০ সালে। তার পরবর্তী ৩৫ বছরে যে সব দেশ তিনি জয় করেছিলেন সেখানে থেকে মিস্ত্রি, কারিগর, শিল্পী নিয়ে এসে এক নতুন শহর গড়ে তোলেন তাইমুর।
আরও কিছুর বর্ণনা লেখক দেন। ইতিহাসের হাত ধরে তিনি আমাদের সেই স্বর্ণোজ্জল সময়ে নিয়ে যান। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে তাইমুরের মঙ্গলপত্নী বিবি খানমের নির্মিত বিশাল বিবি খানুম মসজিদ। এটা নিয়ে প্রচলিত গল্পটিও বলেন লেখক। সঙ্গে তার পৌত্র উলুগ বেগের মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রসঙ্গ।
এই মাদ্রাসায় ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও বিজ্ঞান, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা পড়ানো হতো ১০০ ছাত্রকে। অসাধারণ জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ নিয়ে উলুগ বেগ গড়ে তুলেছিলেন এক অসামান্য বৈজ্ঞানিক স্কুল। শাসকের চেয়ে বোধহয় জ্যোতির্বিদ হিসেবেই বেশি নাম করেন তিনি। জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে তার রচনাদি ইউরোপেও সুপরিচিত ছিল। ১৪২০ সালে তিনি যে বিশাল তিনতলা সমান উঁচু এস্ট্রোল্যাব যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, নজিরহীন নির্ভুলতায় নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য, এত বড় মান-মন্দির পৃথিবীতে খুব কমই নির্মিত হয়েছে।
সমরখন্দের মহিলাদের আরবদের মতো বোরকা পড়ার শুরুর গল্পটাও এক ফাঁকে লেখক বলে নেন। মধ্যযুগীয় সমরখন্দের মধ্যমণি রেজিস্তানেও যান তারা। যেটা মধ্য এশিয়ার বিস্ময় জাগানো দর্শনীয় স্থান।
এক বিরাট চতুর্ভুজের তিনদিকে তিনটি বিশাল মাদ্রাসা। অন্যদিকে মসজিদ। মাদ্রাসা ও মসজিদের মেঝে ও দেয়ালে জ্যামিতিক নকশা এবং উৎকীর্ণ রঙীন মোজাইক ও জেল্লাদার কাচের টাইল। পাঁচশ-সাড়ে পাচশ বছর পরেও স্থপতি ও শিল্পীর এইসব অপূর্ব কাজ এখনো অবিকৃত।
এখানে মুসল্লিদের নামাজ পড়তে দেখে বিস্মিত হন লেখন। কেননা ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে এশিয়ার মুসলিম গরিষ্ঠ রিপাবলিকগুলোর বেশিরভাগ মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিল কমিউনিস্ট সরকার। সমরখন্দ থেকে বুখারায় এসে লেখক কিছুটা হতাশ হন। অনেকটা নিষ্প্রভ মনে হয় এই শহরটাকে। দুইশ বছর আরবদের দখলে ছিল। বর্তমানে পুরোনো সকল স্মৃতি প্রায় হারাতে বসা এই শহর সেজেছে নতুন রং-এ। বুখারার ঐতিহ্য পুকুর যেগুলো কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ করে দেয়। কেবল রয়ে যায় লিয়ার-ই হাউস আঁসাবল।
লেখক মস্কোয় এসে কাকতালীয়ভাবে দেখা পান ছাত্রজীবনের বন্ধু বেলা দত্তগুপ্তর। এভাবেই এই সফর শেষ হয় তাঁর। তিনি দ্বিতীয়বার সিঙ্গাপুরে যান কলম্বো প্ল্যান কনসালটেটিভ কাউন্সিলের অধিবেশনে বাংলাদেশ ডেলিগেশনের অন্যতম সদস্য রূপে। ২৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট একটা দ্বীপের সমৃদ্ধি দেখে লেখক বিস্মিত হয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের নেতা লী কোয়ান ইউ। আর মাত্র এক দশকের কম সময়ে কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল? এই দ্বীপের একমাত্র আয়ের উৎস সমুদ্রবন্দর। দেশটির উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। এর অবকাঠামো থেকে ব্যক্তির আচরণ সবকিছুতেই পরিবর্তন আর উন্নয়নের ছোঁয়া। এভাবে পরিভ্রমণের গল্পের মধ্যে লেখক একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণেরও প্রয়াস পান।
লেখক ১৯৮০ সালে যুগোস্লাভিয়ায় স্ট্রুগা কবিতা উৎসবে যোগ দেন। এটাকে বলা হয় ইউরোপের একটি অন্যতম মর্যাদাবান কবিতা উৎসব। লেখক এখানে একমাত্র বাংলাদেশি প্রতিনিধি। ‘কবিতা কি করতে পারে’ এই শিরোনামে একটি আলোচনায় কবি অংশ নেন। এখানে লেখকের সাথে আলাপ হয় আমেরিকান থিওডোর ওয়াইজ, এডিথ জনসন সারমিন, রেমন্ড প্যাটারসন, ড্যানিশ কবি এরিক স্টিনুস, সিপ্রিওট দিনা পিয়াস্সল কাটসৌরি, বসনীয় কবি ইজেৎ সারায়েলিচের সঙ্গে। আছে কবিতা নিয়ে বহুবিধ আলাপ। এই লেখা শেষ হয়েছে স্ট্রুগার কবিতা উৎসবের স্মৃতি নিয়ে লেখক কবি আবুল হোসেনের নিজের কবিতা দিয়ে।
দেশ, দেশের মানুষ, প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ সবকিছুই বিশ্লেষণের প্রয়াস লক্ষ করা যাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে লেখকের একটা পর্যবেক্ষণ বেশ আগ্রহোদ্দীপক :
ষাটের দশকের শুরুতে বিদেশে চাকরি করতে যাওয়র সময় দেখে যাই তার রাজনৈতিক জীবনের অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। জেলের ভাত আর সরকারের তাড়া খেতে খেতে এক তরুণ একগুয়ে ছাত্রনেতা কিভাবে দেড় দশকের মধ্যে তার সমসাময়িক, সমবয়সী ও অগ্রজ সহযাত্রীদের রাজনীতির ময়দানে পেছনে ফেলে, নয়তো মিইয়ে যেতে দিয়ে, উঠে এসেছেন এক আপোসহীন চড়াগলার নেতার আসনে। সাড়ে ছয় বছর পরে যখন দেশে ফিরে এলাম তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা। সরকারের বিপক্ষে।
এই মহিরুহ হয়ে ওঠা নেতার রাজনৈতিক জীবনের অনেক বিষয় এখানে উঠে এসেছে। এসেছে পরবর্তীকালের শাসকদের বিষয়ও। তাদের কর্মপন্থা, পরিধি, পরিণতি নিয়ে লেখক কথা বলেন।
স্বপ্ন ভঙ্গের পালায় লেখকের সময় বিশ্লেষণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তিনি তাঁর চোখে দেখা রাষ্ট্রকাঠামোয় বিভিন্ন দিককে, শাসকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে, দেশের মানুষের ভাবনাকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দুটো বিষয়ে মিশ্রণ ঘটেছে এখানে। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৈরি হওয়ার চেষ্টা আর এর উত্থান-পতনের কিছুটা দালিলিক বিবরণ যেখানে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে আশা পূরণ হয়নি বলেই গ্রন্থের নামকরণ এমন। আর একটি বিষয় লেখকের শিল্পী মনের আলোকে বৈশ্বিক শিল্প-সাহিত্যের ঠিক তুলনামূলক আলোচনা। তিনটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান এবং এর অভিজ্ঞতার বর্ণনা গ্রন্থটিকে ভিন্ন এক মর্যাদা দিয়েছে। পাঠকের কাছে খুলে গেছে এক ঐশ্বর্যময় জগৎ। তাই স্বপ্ন ভঙ্গের পালা অনেক নেতির মাঝেও আসলে এক স্বপ্নলোকের গদ্য। যার পরতে পরতে এক স্বপ্নময় জগতের স্বপ্ন উঁকি মেরে যায়।

নূর সালমা জুলি
জন্ম রাজশাহীতে ৭ আগস্ট, ১৯৮১ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষা বিষয়েও পড়েছেন। বর্তমানে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। ‘মাহমুদুল হক : একজন কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি’ গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের।