সহজাত নন্দনের পরিসরে আবুল হোসেনের কবিতা
জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
আবুল হোসেন [১৫ অগাস্ট ১৯২২-২৯ জুন ২০১৪]
বসন্তের হাওয়ায় দুর্মর দুঃসাহসে কালের উতরোল অন্ধকার এবং ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিলেন আঠারোর এক তরুণ। দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, সরকারি চাকরিসূত্রে। কিন্তু কৌতূহল ছিল সেসব দেশের মানুষ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রতি। ফলে উচ্চপদের দায়িত্ব পালনের পরও ঈর্ষণীয় বন্ধু-পরিসর গড়ে উঠেছিল তাঁর। তিনি আবুল হোসেন। বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার সূচনাকারী বলে কথিত। সময়ের বিচারে সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পকলার তাৎক্ষণিকতার অনেককিছু ক্লিসে হয়ে উঠলেও তিনি আমাদের নমস্য। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশ হলো তিনটি গদ্য।
বহুদিন বাদে আবুল হোসেনের কবিতা পড়ে কেমন অনুভব হচ্ছে প্রশ্ন করি নিজেকে? কারণ এতো চিত্রবিচিত্র কবিতার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে আমাদের পাঠরুচি কতটা যে বদলাইয়া গেছে, তা পরখ করার একটা উপলক্ষ্য যেন জুটলো এই অবসরে। একেকটা যুগে প্রকাণ্ড সব অট্টালিকার গৌরবের তলে সহস্র শিল্পকুটির যে তলাই যায়, সহস্র মানুষের শ্রম যে হারাই যায় দুই একজন বীরের মহিমায়, তা মনে পড়তেছিল। আমরা তো বড় হই উঠছি, জীবনানন্দ নামক এক বটগাছের ছায়াতলে। পরে উল্লম্ফনের নিয়মে আরও একটা ঢিবিতে যেন এসে দাঁড়াইলাম, পঞ্চাশের দশক নামে যাহা আমাদের কানকে বহু বিমিশ্র ধ্বনি ও ব্যঞ্জনা থেকে দূরে সরাই রাখার জন্য সদা নিয়োজিত শত লোকের জবান। তাও আবার দুই মহীরুহ রাহমান, মাহমুদ নামের ডালে ডালে গুঞ্জরিত। ইত্যবসরে আরও আরও বহু কবির মতো এই দুই গিরির মধ্যখাতে যে চল্লিশ বয়ে যাইতেছিল, তা যেন স্বল্প উল্লেখে ক্রমে একটা শীর্ণ জলধারায় পরিণত। সে ধারারই আরও ক্ষীণ কোনো বাতির মতো কবিতার ইতিহাসের স্রোতে এখনো নীরবে জল ঢালতেছেন যে কবি, আবুল হোসেন, আজ তরুণ পাঠকের মর্মকুঞ্জ থেকে একটু দূরেই যেন বা কল্লোলিত। আমি এক পাথর হয়ে সে কল্লোলে কান পাতলাম। আজ এই ফাল্গুনের রোদের দুপুরে কোনো এক প্রত্যন্তে যেন শব্দটুকু বাজিয়ে নিতে চাইলাম নিজের পাথর শরীরের স্পর্শ শিহরণে। ধীরে ধীরে যেন তার সুর প্রবেশ করল আমার শরীরে। দেখলাম, কী চমৎকার করে একটু তফাতে গিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চলছে কোনো গাছ। জানে সে বটবৃক্ষের নিচে তার বৃদ্ধি নাই। ফলে সে নিজেকে গড়ল অন্য নিয়মে, বুদ্ধিদীপ্ত দূরত্বে। ফুল, পাখি, প্রকৃতি ও নৈঃশব্দ্যের জীবনানন্দীয় জগৎ থেকে হোসেন কিছুটা কোলাহলময়, কিছুটা ইটকাঠপাথর। একটা আধুনিক ভাষা, আদতেই তা নতুন শহর ঢাকার বাকস্ফুরণের সমস্ত সম্ভাবনাকে তওলায়া দেখতেছে। তিরিশের ভাষা থেকে বেশ সরে এসে হোসেনে একটা কথকতার আবহ পাই আমি। মানে ‘জলদগম্ভীর’ কবিত্ব নাই। আছে একমনে বলে যাওয়ার ‘বাকপ্রতিভা’। সাধারণ কথা থেকে এসব খুব দূরে নয়। কবিতার কসরত নাই কিন্তু তাতে কবিতার ভণিতায়ও টান পড়ে না।
আবুল হোসেন যেন সত্যই নগর জীবনের কবি। তবে বানানো অনিকেত জীবন, নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর ক্লেদের নর্দমায় মুখ ডুবিয়ে মরেন নি। তার কবিতায় উল্লিখিত জীবন তার যাপনের বা তার সময়ের একটা স্তর হয়ে রইছে যেন। ফলে কবিতার গতরে অনেক কালচিহ্ন রয়ে যায় তা দিয়ে আমাদের নাগরিক সভ্যতার একটা চিত্র আমরা কল্পনা করে নিতে পারি।
কাল মোর এতটুকু হয় নাই ঘুম,
সারা রাত কাটিয়েছি জেগে বিছানায়,
অদূরে পথের পাশে অবিরাম সুরে
ডাইনামো একটানা দ্রুত ধ্বনি তোলে।
শহর গভীর ঘুমে নিস্তব্ধ নিঝুম,
সে শব্দ কাঁপন তোলে শাখায় পাতায়,
আকাশে উঠছে তার গান ঘুরে ঘুরে,
আমার নয়নে সে যে স্বপ্ন-সিঁড়ি খোলে।
ট্রামের ঘর্ঘর ধ্বনি থেমেছে এখন,
আকাশ আঁধারে ঢাকা, মৃত্তিকা নিসাড়।
জেগে জেগে আমি শুনি নিশীথের বুকে
আর কোন্ হৃদয়ের তুমুল ক্রন্দন।
ডাইনামো যেন কভু থামবে না আর।
অবিশ্রান্ত সুর তার ভরে দিল মন,
রাত্রি শোনে সে সংগীত সীমাহীন সুখে,
জেগে জেগে শোনে তারা, তরু, মাঠ, বন।
[ডাইনামো:নববসন্ত-১৯৪০]
আবুল হোসেনের প্রথম বই থেকে দ্বিতীয় বইয়ের দূরত্ব প্রায় তিন দশক। এর মধ্যে বাংলা কবিতাভাষার বহু বদল ঘটে গিয়েছে। কিন্তু হোসেন থেকে গিয়েছেন তার সেই আদি বা আবির্ভাব যুগের ধারাবাহিকতাতেই। এটাতে যেটা বোঝা যায়, হোসেন নিজের সাহিত্যচিন্তার প্রতি কতটা আস্থাশীল। আরেকটা ব্যাপার হইলো, তার স্বাতন্ত্র্যও এতে ঠিক থাকল। পরে নিয়মিত বিরতিতেই বই বেরিয়েছে। কিন্তু তার যে সুললিত ভাষাভঙ্গি তাতে ছেদ পড়েনি এতটুকু। তিনি রয়ে গিয়েছেন প্রথম যৌবনের মতো স্মার্ট-অনাড়ষ্ট।
কবিতা পাঠের কাজে ভাষার আলাপ আমরা গুরুত্ব দিয়াই করি। যেহেতু কবিতা এক ধরনের ভাষা বিষয়ক প্রকল্পও বটে। এই পরিসর ধরে আলাপ করলে হোসেনের কাছে পাই মেদহীন কাব্যভাষা। প্রথাগত ছন্দের শাসন না মানা এক কবি। তিনি মূলত কথাকে বাঁধতে চেয়েছেন কবিতার অনুভব দিয়ে। তবে সংহতি ও পরিমিতির ক্ষেত্রে তিনি কখনোই আপোষ করেন নাই। যেখানে এলানো ভাব আছে, সেখানে আছে কোনো না অণু-আখ্যান অথবা যাপিত জীবনের বিচ্ছুরণ। তার সাহিত্যচর্চার দ্বিতীয় পর্যায়ে ষাট বা সত্তরে প্রগলভতার জোয়ার দেখা গিয়েছিল বাংলা কবিতায়। আবুল হোসেন নিরাপদ দূরত্বে থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছেন নিজেরই কাব্যকলায়। আমরা হয়তো এই ভাষাকে প্রভাবশালী হিসাবে বাহবা দিব না। কিন্তু নিজের কথাটি কহিবার এক আপন ভাষা নির্মাণের স্রষ্টা হিসাবে হোসেন থেকে শিখতে পারব আমরা আরও দীর্ঘকাল।
কারো কবিতা পড়লে আমি সবসময় একটা জিজ্ঞাসা হাজির করি মনে মনে, তিনি কি কবি? কেন কবি? আবুল হোসেনে ডুব দিয়ে আমি দুইটা প্রশ্নেরই সদুত্তর পাই। একটা নিরেট ও সরস কাব্যভাষা যেমন পাই, পাই দুনিয়াকে দেখার ও নিজের চুল্লিতে তাকে পরিপাক করে পরিবেশন করার মতো কাব্যবস্তু। ফলে তার সারা জীবনের আয়োজনকে নতুন কালের বিবেচনায় গ্রহণ করার বহু সুযোগই রয়ে গেছে এখনো।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত আবুল হোসেনের ‘নির্বাচিত কবিতা’ পড়েই আমার এইসব আলাপ। নির্বাচিতে ফর্ম সম্পর্কে পষ্ট ধারণা পাওয়া গেলেও, বিষয়ের বিবর্তন নিয়ে ধারণা পাওয়া একটু টাফ। যদিও গড়ে একটা ধারণা তৈরি করা যায়। হোসেনের কবিতা বিষয়ের দিক থেকে স্পেসিফিক কোনো এরিয়া সেভাবে তৈরি করতে পারে নি। তার আগে, পরে এবং সমকালে বেশ কয়েকজন কবি নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে পারছেন নিজের লেখার একটা জগৎ তৈরি করার কারণে। সেই চিহ্নায়নের জায়গায় হোসেন বড় একটা শূন্যস্থান রেখে গেছেন। এই কারণে তাকে আমি পাঠ করতে চাই ভাষা ও বিষয়ের যৌথ সংশ্লেষের জায়গা থেকে। তার কবিতা মসৃণ। পড়তে বেগ পেতে হয় না। আগাম প্রস্তুতি লাগে না। কিন্তু তার মানে এই নয়, ‘স্বভাবকবিত্ব’ তার বৈশিষ্ট্য। ভাষার ওপর দখল ও বিষয়ের ওপর প্রত্যয় থাকলে সহজে বলে ফেলবার যে আত্মবিশ্বাস জন্মায় হোসেনের কবিতায় এটা প্রবলভাবেই আছে। বাকসংহতি তার এই সরল ভঙ্গিকে প্রগলভতার ঝোঁক থেকে বরাবরই মুক্ত রেখেছে। পূর্বেই বলেছি, তার কবিতাচর্চার মূল সময়টায় প্রগলভতার বেশ প্রাধান্য ছিল। আবুল হোসেন প্রথম তারুণ্যের স্মার্টনেস দিয়ে ঐ প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন। ফলে তার কবিতার নিজস্ব রং কখনোই ফ্যাকাশে হয়ে যায় নি। এমনকি শেষ বয়সের কবিতায়ও রয়েছে অনুভবের চমৎকার দীপ্তি।
সেনের বাজার থেকে ষোলপুর
কত দূর?
মাঝ পথে দেয়াড়ায়
বুড়ো বট গাছতলা।
সেখানে আমরা মুনি আর আমি
মারবেল খেলি সারা সকাল বেলা
হাত তালি দেয় দেখে আয়েশা।
কত কাল আর তারা নেই।
ষোলপুরও গেছে ভৈরবের বানে।
আজ নব্বইয়ে পড়ে যখন
আমি চোখে ভালো দেখি না
কানেও শুনি আরও কম,
বুড়ো বট গাছটি শুনি
ডাল-পাতা মেলে ঝলমল করে
যৌবনের তেজে।
[বট গাছ ও আমি-২০১৪]
বয়সের বিপন্নতাকে পুঁজি করে কী চমৎকার মিহি বিষাদে ভরে তুলতে পারেন পাঠকের অন্তর, এই কবিতা তার চমৎকার উদাহরণ। পাশাপাশি এটাও যে, একজন কবির কবিত্বকে প্রৌঢ়ত্ব যে গ্রাস করতে পারে নি, সেটাও সাক্ষ্য দেয় এই কবিতা।
আবুল হোসেনের কবিতায় বিষয় হিসাবে তার যাপন বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। সময়কে নিজের ভাষ্যে প্রকাশ করার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। তবে এ সমস্ত জায়গায় তিনি সবসময়ই সতর্ক। কারণ ন্যারেটিভ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে এই ধরনের কবিতায়। হোসেন বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে গিয়েছেন। উল্লম্ফনও লক্ষ্য করি কোথাও কোথাও। যেমন,
আলসে সকাল।
খড়ো চাল
চিক্ চিক্ করে রোদে আর চিলে।
ঝলসানো নীলে
ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে শকুন। দুপুর।
উঠোনে কুকুর।
থমথমে সাঁঝ।
কিসের আওয়াজ
ভাঙ্গা কাঁচা পথ।
দুই পাশে তার খেজুর কদম-
সারি সারি হাঁটে দিনের প্রেত!
[দেয়াড়ায়: বিরস সংলাপ-১৯৬৯]
বর্ণনাকে গদ্যের মধ্যে ছড়িয়ে না দিয়ে এইভাবে সুরের এলানো ভাবের মধ্যে সংহতির রাশ টানা আবুল হোসেনের কবিতাভাষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি যেখানে যতটুকু প্রয়োজন কল্পনাশক্তির ব্যবহারও উত্তমরূপে করেছেন তিনি । সাধারণ গদ্যে আমরা কোনো কিছুর বর্ণনা যেরূপে চাই কবিতায় সেই চাওয়াটা হয় ভিন্নরকম। এমনকি গদ্য কবিতার বেলায়ও। এখানে একটা সীমারেখা না টানলে গদ্য ও কবিতা আর আলাদা ফর্ম হিসাবে থাকে না। আবুল হোসেন এই ভেদরেখা আঁকার জন্য দুইটা কাজ করেছেন,
১. তিনি কল্পনা প্রযুক্ত করেছেন যেখানে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে।
২. আবেগ চারিয়ে দিয়েছেন শব্দের সাধারণ বিন্যাসের মধ্যে।
ফলে বাক্য আর সাধারণ বর্ণনার সরল বাহন না থেকে কাব্যস্বভাব লাভ করেছে। দুইটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
১.
শেষ রাতে বর্ষার মাতম থামল এই মাত্র,
রূপালী ঝর্ণার মতো চিকচিকে সকাল
নামছে আকাশের গা বেয়ে।
………………………………………………………
হয়তো সন্ধ্যায় ডেকে উঠবে শিয়ালের পাল
ভূতের মতন অন্ধকারে,
সকালের এই ঝকঝকে বন
তখন যেন রাশি রাশি প্রেত,
চোখ নেই মুখ নেই তাদের কী নিঃশব্দ সংকেত পরস্পরে
কাল রাতে দেখেছি যা আসার পথে,
[আমার সোনার দেশ:নববসন্ত-১৯৭৭]
কিংবা,
আমরা কি এই আশ্চর্য আকাশকে মনে রাখব,
যে আকাশ থেকে সোনালী ধানের মতো রোদ আসে, বর্ষা
নামে চোখের জলের মতো আর জ্যোৎস্না ছড়ায় রক্তের
ফিনকি দিয়ে।
[উত্তরাধিকার: নববসন্ত-১৯৭৭]
২.
দীর্ঘায়াত দীপ্ত বর্শার মতো মধ্যদিন:
ছুটছি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ।
সামনে পিছে ওপরে নীচে তরঙ্গিত পর্বত,
শন্শন এক প্রকাণ্ড ঝড়ো চিল
উড়ছে নীলে অক্লান্ত পাখায় ঘুরে ঘুরে
[ডি. এইচ. রেলওয়ে: বিরস সংলাপ-১৯৬৯]
এমন অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে যেখানে হোসেন কাব্যকলায় উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন।
কয়েকটা কবিতা যেগুলোতে গল্পময়তা আছে, আছে আখ্যানের আভাস, চমৎকার খেলেছিল সেই কবিতাগুলা আবুল হোসেনের হাতে। ‘চার পাঁচ জন বুড়ো লোক’, ‘মা ছিলেন’, ‘সোহরাবের লাশ নিয়ে, রুস্তম’ ইত্যাদি। আবেগের ঘনীভবনে আর শেষ দিককার পাঞ্চ লাইনে কবিতাগুলি অনবদ্য হয়ে ওঠে। তিনটা কবিতা-ই পাঠ শেষে মায়াবী বিষাদে হৃদয় ভরে ওঠে। চার পাঁচজন বুড়ো তাদের জীবনের শেষ দিনগুলি কীভাবে উদযাপন করছে, অসুখ ও অবসন্নতা কীভাবে তাদের অবসরকে ব্যাথাতুর করে তোলে, সংসার ও সমাজের কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়া, মনযোগের প্রান্তে থাকা, জীবনের গন্তব্য ধূসর হয়ে আসা মানুষগুলির সঙ্গ-নিঃসঙ্গতার এতো বাস্তবানুগ চিত্র বিরলই লাগলো। প্লটের জায়গা থেকে যেমন কবিতাটা চমৎকার, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও সংহত বর্ণনাও তেমনি মনোহর। কবিতাটা পড়ে শুধু এই চার পাঁচ জন নয়, সমস্ত প্রৌঢ় মানুষের প্রতি একটা আকুল আবেগ সঞ্চারিত হয় মনে।
মাকে নিয়ে লেখা ‘মা ছিলেন’ কবিতাটাও বেশ আবেগময় পরিস্থিতি তৈয়ার করে। বিশেষত একজন সৌখিন মা, যিনি সবসময় পরিপাটি থাকেন, ঘরে কোথাও ধুলা পড়লেও তার চোখ এড়াতো না- এমন পরিচ্ছন্ন স্বভাবী। সেই মা-ই যখন ব্যাংকক থেকে ফিরে এলেন রুহছাড়া হয়ে, তখন তার সে নিঃস্তব্ধতাকে কবি যেভাবে বর্ণনা করেন, সেটা আমাদের মর্মের গিয়ে ধাক্কা দেয়।
সোনালী কাঠের বাক্স থেকে সিয়ামী ফুলের গন্ধ
ছড়াল ঢাকার পাকা কাঁচা সড়কে অন্দরে,
খুশিতে উজ্জ্বল হ‘য়ে উঠল না তাঁর মুখ,
এমনকি চোখ মুছতে মুছতে সবাই যখন
শুইয়ে দিলেন তাঁকে নরম মাটিতে,
যেখানে পিঁপড়া কেঁচো আরো কত রকমের পোকা মাকড়রা
আসর জমায়, ভয় পেলেন না তিনি,
রেগেও উঠলেন না আর,
সব রাগ খুশি ভয় কান্না ও ভাবনা
মা রেখে গেলেন শুধু আমাদের জন্যে।
[মা ছিলেন: হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস-১৯৮২]
সোহরাব-রোস্তম কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠা কবিতাটাও আবেগকে উদ্দীপিত করে। প্লট পরিচিত। কিন্তু বর্ণনার মুন্সিয়ানার কারণে তা ভিন্নতর ব্যঞ্জনা নিয়া হাজির হয়।
শুধু আবেগের কারবার নয়, সমাজ সচেতনতাও আবুল হোসেনের কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। সমকালীন রাজনীতি, অর্থনীতির ক্রিটিক হিসাবেও তিনি কখনো কখনো নিজেকে চিনাইতে পারছেন।
‘গৌরিসেন’, ‘মন্বন্তর’, ‘মায়াবিনী’, ‘দেশকাল’ এমন বেশ উদাহরণ দেওয়া যাবে যেখানে কবিতা হয়ে উঠেছে যাপন সংকটের প্রতিচিত্র। তার সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় (যদিও বর্গ অর্থে তখনও পুরাপুরি এমন ধারা গড়ে উঠেনি) সুভাষ, সুকান্ত, দিনেশ, বীরেন্দ্র প্রমুখের কাজের ভিতর দিয়ে প্রতিবাদী ঘরানা বেশ প্রমিনেন্ট হয়ে উঠেছে। যাদের রোখ ঢাকার দিকে সরে গেছে তাদের কবিতার বিষয়-চিন্তাও স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে। আবুল হোসেন নিশ্চিতভাবেই এগুলো খেয়াল করে থাকবেন। এবং নিজের কবিস্বভাবের উপযোগী করে সেই সচেতনতার স্বরটাকে আত্মস্থও করে নিয়েছেন।
হোসেন বাংলা কাব্যের সেই ঘরানার কবি নন, যার টেক্সট চোখ ধাঁধিয়ে দিবে। কিন্তু তার কবিতা ধীরে ধীরে কাজ করতে থাকবে পাঠকের অন্তঃকরণে। একটু একটু করে বহু বিচূর্ণ বোধ ও অনুভব সঞ্চারিত হতে থাকবে মনে। এভাবে একটানা পাঠে ভিন্নরকম এক ব্যঞ্জনা পাওয়া যায় তার কবিতায়। শুরুতেই বলেছি জলদগম্ভীর কবিত্ব নয়, এক সুখপ্রদ সাধারণ কবিতা যেটা পাঠক অনুভব করতে পারবেন সহজাত নন্দনের পরিসরে। এ যেন সমুদ্রের দুরন্ত কল্লোল নয়, বাড়ির পাশের ছোট নদীর মৃদুমন্দ চলন।
আবুল হোসেনের কবিতায় কবিতা করে তোলার কসরতের চেয়ে জীবনের নানা মাত্রার দ্যুতি সত্য আবিষ্কারের মতো হাজির থেকেছে। ফলে প্রায়শ-ই তার কবিতা কোনো না কোনো উপলব্ধি বা সারবস্তুর দিকে যেতে চায়। ইন্দ্রিয়ের চেয়ে বুদ্ধি, উপভোগের চেয়ে উপলব্ধি, সৌন্দর্য্যরে চেয়ে সত্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বর্ণনা এসে অনির্ণেয় বা অনির্দেশ্য কোথাও স্তম্ভিত করে না। সবকিছু পষ্ট। কিন্তু কবিতাটুকু মার খায় না শব্দের দরদি বিন্যাসের কারণে। কবির নরম হৃদয়ের ওম শব্দগুলিকে তা দিয়ে দিয়ে পুষ্ট করে তোলে। ফলে আমরা মানে পাঠক তার কবিতার স্বাদ পেতে আগ্রহী হয়ে উঠি। এ কারণে হোসেন বর্ণিত উৎসবের দিন কবিতার “এই সব দিন এত শিগগির/দেখতে-না-দেখতেই ফুরিয়ে যায়-/আমাদের জীবনের মতো” পঙ্ক্তিসমূহকে পাশ কাটিয়ে আমরা বরং পাঠ-পুনর্পাঠের তালিকায় রাখতে পারি। যাপিত জীবনের ভিতর পুষতে পারি আবুল হোসেনের এই স্নিগ্ধ আত্মতৃপ্তির অনুভূতিকে :
আমার শান্ত নদীর পানি,
আঁজলা ভ’রে ঘরে আনি।
আছে বনের ফুল ও পাখি,
বুকের ভেতর ধরে রাখি।
খালি পায়ে পথে হাঁটি
সঙ্গে শুধু একতারাটি।
তুমি রাজা, মহাধিরাজ-
তোমার পাশে সারা সমাজ।
আমার আছে একখানা বই,
সেটা নিয়েই একলা ঘুমোই।
[তুমি ও আমি: রাজকাহিনী-২০০৪]
আরও পড়ুন :

মোস্তফা হামেদী
জন্ম : ১৯৮৫, ২৭ আগস্ট, দেইচর, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ , নোয়াখালী । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ [২০১৫], তামার তোরঙ্গ [২০১৮], জড়োয়া [২০১৯], শেমিজের ফুলগুলি [২০২০], ঋতুরহস্যের ধারে [২০২২], ভুঁইচাঁপার ঘ্রাণ [২০২৩]| পুরস্কার: হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার ২০২০|