প্রবন্ধ

আগস্ট বেবেল: কক্ষচ্যুত নক্ষত্রদের গল্প

How many roads must a man walk down
Before you call him a man?
[Bob Dylan]

“নারীদের দিয়ে কোনো বড়ো কাজ হবে না। তাদের চরিত্র সক্রিয় নয়, নিষ্ক্রিয়। সন্তানের জন্ম দিতে, সন্তান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামতো মত প্রকাশ করতে দেওয়া হবে না। পুরুষের চেয়ে নারীদের জীবনে ঘটনাও কম ঘটবে আর ছোট-খাট বিষয় নিয়েই তারা থাকবে। শিশুদের লালন-পালন করা, শিক্ষা দেওয়া নারীদের কাজ, কারণ নারীদের নিজেদেরই শিশুসুলভ মানসিক অবস্থা থেকে যায়—তারা থাকে শিশু ও পুরুষের একটা মাঝামাঝি অবস্থায়। পুরুষরাই একমাত্র ঠিক ঠিক মানুষ।… মেয়েদের ঘরকন্নার কাজ করা ও বাধ্য হয়ে চলা শেখানো দরকার… নারীরাই হবে সম্পূর্ণ অকেজো বিপরীত পক্ষের লোক।”

বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক Schopenhauer (১৭৮৮-১৮৬০)-এর এই যুক্তিবিবর্জিত মন্তব্য এটা প্রমাণ করে ইউরোপীয়ান সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থান কেমন। সমাজ এগিয়েছে, বিকাশের ধারায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু নারীর জীবন সহজ, সাবলীল আর মানবিক হয়নি। যে আলো আমাদের জীবনযাত্রাকে বহতা নদীর গতি এনে দিয়েছে সেই আলো সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর কাছ অবধি পৌঁছতে পারেনি। এক অদ্ভুত আঁধারে আচ্ছন্ন নারীর ত্রিকালিক জীবন। আমাদের এই বক্তব্য অনুমাননির্ভর নয় মোটেও। আগস্ট বেবেল (১৮৪০-১৯১৩) তাঁর Woman in the Past, Present and Future গ্রন্থে তথাকথিত প্রাগ্রসর জার্মানি তথা ইউরোপের সমাজে নারীর অতীতের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা অভাবিত ঋণাত্মক অনুভবে জারিত করে। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ যে খুব একটা আশাব্যঞ্জক তাও নয়।

জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক পণ্ডিত, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অন্যতম নেতা আগস্ট বেবেল। মার্কস এঙ্গেলস-এর বন্ধু ও সহকর্মী বেবেল মার্কসবাদী মতাদর্শের চিরায়ত সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্মরণীয় ব্যক্তি। তাঁর এই জার্মান ভাষার লেখা বইটির ইংরেজি অনুবাদ অনেক আগে হলেও দিল্লির ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার’ ১৯৭৬ সালে ইংরেজি ভাষায় পুনর্মুদ্রণ করে। পরে শ্রীমতি কনক মুখোপাধ্যায়ের করা বাংলা অনুবাদ ‘একসাথে’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৮২ সালে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। এই অনূদিত গ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ অংশে প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেন :

মাকর্সবাদী বিশ্লেষণমূলক চিরায়ত সাহিত্য ভান্ডারে বইখানি মূল্যবান সম্পদ। যদিও আমাদের দেশের পটভূমিকায় লেখা নয়, তবুও যে ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজ বিকাশের ধারার সঙ্গে নারী জাতির অবস্থার পরিবর্তনের সম্বন্ধ বিশ্লেষণ করেছেন, তার মূল বক্তব্য সব দেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের পক্ষেই প্রযোজ্য এবং যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈপ্লবিক প্রত্যয়ের সঙ্গে শ্রেণী-শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজে নারী জাতির পূর্ণ মুক্তির চিত্রটি তুলে ধরেছেন তাও সর্বসাধারণের জন্যই। অনেক ক্ষেত্রেই এই বইখানি এঙ্গেলস্ এর “Origin of Family, Private Property and State” গ্রন্থখানির এবং নারীদের প্রশ্নে মার্কস-এঙ্গেলস্ এর অন্যান্য বিশ্লেষণমূলক রচনাগুলির পরিপূরক।

আর এই প্রাসঙ্গিকতার কারণেই লেখাটিকে উল্টে-পাল্টে দেখার আয়োজন। দেয়ালহীন বিশ্বের ভাবনায় কোনো সমস্যাই আর স্থানকেন্দ্রিক নয়। নারীর ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি প্রযোজ্য। বেবেলের লেখায় সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের মুক্তির প্রসঙ্গ বা নারীভাবনা ফুটে উঠেছে। এছাড়া রাষ্ট্রের সামাজিক এসব প্রেক্ষাপট তথা শাসনব্যবস্থার এই প্রক্রিয়াগুলোকে অতিক্রম করেও নারীকে, নারীর অবস্থানকে তুলে ধরার প্রয়াস এই লেখায় আমরা দেখতে পাই। কালের যে ব্যাপারটি রয়েছে অর্থাৎ বেবেলের বর্তমান একশ বছর আগের সময়কে বোঝায় সে হিসেবে ভবিষ্যৎ আজকের দিনগুলো। কিন্তু এই কালানুক্রমিক বিবর্তন জীবনযাত্রায় সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেললেও নারীকেন্দ্রিক ইস্যুতে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে—এমন প্রশ্নের উত্তর এখান থেকে খোঁজা যেতে পারে। ক্রমশ আলোর অনুগামী মানবসভ্যতা আসলে কতটা উজ্জ্বল সেটা তলিয়ে দেখার জন্য আমাদের বেবেলের মতো চিন্তকদের কাছে যেতে হয়। আমরা সত্যিকারের চিত্রটা দেখে আশ্বস্ত হতে চাই। জীবনের গল্পে কতটা জীবন আছে সেটার মতো নারীর মধ্যে কতটা মানুষের অস্তিত্ব সমাজ লালন করে সেটাও খুঁজে দেখা যায়। যদিও এটা এমন একটি বিষয় এই দেখার পর সে অর্থে আমাদের কিছুই করার থাকে না।

বেবেল নারীর অতীত অবস্থা নিয়ে বলেন:

ইতিহাসের গোড়া থেকেই যে নারী ও শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ চলে আসছে বলে বলা হয়েছে সে কথাটা নারীদের বেলায় বিশেষভাবে সত্য। মানবজাতির মধ্যে নারীই সর্বপ্রথম দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছে। নারীর দাসত্ব শুধু [শুরু] হয়েছে, ইতিহাসে দাস প্রথারও পূর্বে। সমস্ত রকম শোষণের মূলেই হলো যারা শোষণ করছে তাদের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। নারীদের অবস্থা অতীতেও যা ছিল এবং এখনো তাই আছে।

বেবেল জার্মান সমাজব্যবস্থার নিরিখে তাঁর আলোচনা উপস্থাপন করলেও মূলত প্রাচীন পৃথিবীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। আদিম যাযাবর মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কোথাও কোথাও শারীরিক শৌর্যে নারীরা পুরুষের সমকক্ষ বা কখনো কখনো এগিয়ে ছিল এমনও দেখা যায়। কিন্তু সন্তান ধারণ, জন্মদান এবং লালন-পালনের জন্য সময় দিতে গিয়ে নারীদের পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে। আর নারীর এই সাময়িক অসহায়তাকে পুরুষ পুঁজি করে তার ওপর হিংস্র হয়েছ। যুদ্ধবিগ্রহ, সম্পদ আহরণ এমন সব ঘটনার মধ্যে নারী ও শিশুদের অপাঙক্তেয় মনে হয়েছে পেশীশক্তির আধার পুরুষদের। গ্রীক নগররাষ্ট্র স্পার্টাতেও অসুস্থ শিশুপুত্রদের হত্যার রীতি ছিল। যেভাবে অন্য সমাজে মেয়ে শিশুদের হত্যা করা হত। নারী ছিল দলের বা গোত্রের সম্পত্তি। নারীকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার কথা আদিম সমাজে দুএকটা ব্যতিক্রম বাদে ভাবাই যায় না। কোনো কোনো উপজাতির মধ্যে নারীর নেতৃত্ব কিংবা নারীকে পুরুষের সমকক্ষ কল্পনা করা হতো। সেটা সংখ্যায় খুবই কম।

ইতিহাস বলছে বিবাহ প্রথা চালু, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার উদ্ভব এবং এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা অতি নিকট সম্পর্ক রয়েছে। সেই প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ যখন এখন গোষ্ঠীবদ্ধ ধারণার মধ্যে নিজেদের এনে ফেলে তখনই সামাজিকভাবে কর্মবিভাজন শুরু হয়ে যায়। মূলত জেন্ডারের ধারণা তখন থেকেই বিকাশ লাভ করে। সেই প্রাচীন সমাজে শিক্ষার আলো থেকে বহুদূরে অবস্থান করা মানুষেরা কেবল শক্তির নিরিখে নারীকে ভৃত্য বানিয়ে রাখা শুরু করে। সমাজবিকাশের ধারায় নারীর ভূমিকা কোনো অংশেই কম ছিল না। বেবেল বলছেন :

নারী ছিল পুরুষের প্রধান ভৃত্য; নারী শুধু সন্তান পালন এবং ঘরকন্নার কাজই করত না পরিধেয় প্রস্তুত করত, বাসের জন্য কুটির অথবা তাঁবু তৈরি করত, আবার যখন পরিবারগুলি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বাস করবার জন্য চলে যেত। তখন সেই কুটির তাঁবুগুলি ভেঙে বয়ে নিয়ে যেত। চাষাবাদের কাজ শুরু হবার পর যখন লাঙল আবিষ্কার হল, তখন নারীরাই প্রথম লাঙল টানার কাজ করত তারাই সবচেয়ে বেশি ফসল সংগ্রহ করত।

কিন্তু এ ধরনের কাজ নারীকে পুরুষের চোখে শ্রদ্ধাশীল করে তোলেনি, এ বিষয়ে বেবেলের পর্যবেক্ষণ দেখা যাক:

পুরুষ প্রভুর ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকল, তার উপর যে ধরনের দায়িত্ব ছিল তা পালন করতে গিয়ে তার চিন্তাশক্তি ও চেতনা বাড়তে থাকল। সুতরাং তার শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকল, তার [আর] নারীদের উপর চাপানো হলো দ্বিগুন বোঝা-দাসত্ব এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দাসত্বের উপযোগী ব্যবহার। ফলে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করতে করতে তাদের মানসিক দিকটা আর বাড়তে পারল না।

পুরুষ কর্তৃত্ব করতে অভ্যস্ত হয়ে গেল।

যে কর্তৃত্বের ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। সমাজের সব দিকেই কমবেশি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের আচরণের তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। সম্পত্তি হিসেবে নারীর একটা মূল্য সমাজে রয়েছে। যুদ্ধের সময় লুটের মাল হিসেবে নারী খুব মূল্যবান ছিল। আগে কোনো কোনো সমাজে তরুণী কন্যার পিতাকে বিনিময় মূল্য দিয়ে পুরুষ নারীকে গ্রহণ করত। বলা যায় নারীর মালিকানা লাভ করত। আজকের দিনেও কোনো কোনো সভ্যতার আলো বিবর্জিত সমাজে এমন প্রথা আছে। যেখানে নারীর মালিকানা পেয়ে পুরুষরা তাকে যথেচ্ছা ব্যবহার করে। যদিও সভ্য সমাজের এই চিত্রটা অনেকটা একইরকম। সম্পত্তির অধিকারী নারীদের ভাবা হতো না। ফলে তাদের সবসময় পুরুষদের বশ্যতা স্বীকার করতে হত।

আরেকটি উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে নারীর যৌনজীবন ও নারীর সতীত্বের ধারণাটা আধুনিক কালের। আগে তাকে ইচ্ছামতো পুরুষ ব্যবহার করত। তখন সে একভাবে নিপীড়িত হতো। কিন্তু সভ্যতার আলো এসে নারীকে গৃহবন্দি করে এবং তার সতীত্ব রক্ষার অনুভব পুরুষদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে। এর ফলেও নারীর ওপর আরেক ধরনের শোষণ নেমে আসে। এ কারণে অনেক নারী বিবাহিত জীবনের চেয়ে হেতেরে (Hetaurae) প্রথা বা পতিতার স্বাধীন জীবন পছন্দ করতে শুরু করে। এরা ভালো বংশ থেকে আসত। নিজেদের গুণসম্পন্ন শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারত। যেটা বিবাহিত নারীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর ‘হেতেরে’দের আকর্ষণ পুরুষদের কাছে খুব বেশি ছিল। গ্রিসের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ ছিলেন। এছাড়া কুমারী মেয়েদের তৎকালীন সমাজ এভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত ছিল। ব্যবিলনিয়ান সাম্রাজ্যের শক্তিশালী রাজধানী বেবিলনে এমন আইন ছিল কুমারী মেয়েকে একবার হলেও মিলিটা দেবীর (Goddess Mylitta) মন্দিরে যেতে হবে এবং দেবীর সম্মানার্থে সেখানে আগন্তুক পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এরকম নিয়ম আরমেনিয়া, মিশর, সিরিয়া, ফোনিসিয়া, সাইপ্রাস, কারথেজ, গ্রীস, রোমেও প্রচলিত ছিল। ‘জেসার (J. Scherr)-এর মতে প্রাচীন জার্মানদের মধ্যে যে রীতি প্রচলিত ছিল তা হল এই যে অতিথিদের প্রতি সৌজন্য দেখাবার জন্য লোকে নিজের স্ত্রী বা কন্যাকে তাদের সঙ্গে রাত্রি বাস করতে দিয়ে দিত।’ এই গল্পটি প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও ছিল যা পৌরাণিক আখ্যানে দেখা যায়। এথেন্সে প্লেটোর সময় (৪০০ খ্রি.পূর্ব) ‘হেতেরে’ বা পতিতাদের দেবীর নামে একটি মন্দির উৎসর্গ করা হয়। করিনথ-এর আফ্রোডাইট দেবীমন্দিরে অন্তত হাজার খানেক পতিতা ছিল। এরা গ্রীসের অভিজাত পুরুষদের প্রশংসার পাত্রী ছিল।

শক্তিশালী বক্তা ডিমসথিনিস (Demosthenes) এথেন্সবাসীদের যৌন-জীবনের সম্বন্ধে বর্ণনায় বলেছেন, “আমরা বিবাহ করি বৈধ সন্তানদের জন্য এবং বিশ্বস্ত গৃহরক্ষকের জন্য। রক্ষিতাদের রাখি আমাদের প্রতিদিনের সেবার জন্য, পতিতাদের কাছে যাই প্রণয়ের স্ফূর্তির জন্য।” তাদের স্ত্রী ছিল শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর বাড়ি পাহারা দেবার বিশ্বস্ত কুকুর। বাড়ির কর্তা যেমন খুশি তেমন জীবনযাপন করত। নারী সম্বন্ধে এবং যৌনসম্বন্ধ বিষয়ে প্লেটো (PLATO) তাঁর “রাষ্ট্রে’র জন্য যে চিন্তা করেছিলেন, আমাদের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী তা অত্যন্ত স্থূল এবং চরমপন্থী বলে মনে হয়। তিনি চেয়েছিলেন দলগত বা গোষ্ঠীগতভাবে স্ত্রী রাখার পদ্ধতি এবং নির্বাচনের দ্বারা বংশ বা প্রজন্ম নির্ধারণ করা।” অ্যারিস্টটল (ARISTOTLE) আরো বুর্জোয়া, তাঁর “পলিটিকা”তে (“POLITICA”) তিনি বললেন যে নারীরা স্বাধীন, যদিও তারা পুরুষদের চেয়ে নিচে, কিন্তু তিনি বললেন যে নারীদের ‘সৎপরামর্শ দেবার’ অধিকার আছে। থাকিডাইডস (Thukydides)-এর মতের সঙ্গে এখানকার অনেক সাধারণ লোকই একমত হবে। তিনি বললেন, “সেই স্ত্রীই সবচেয়ে বেশি প্রশংসার যোগ্য যার সম্বন্ধে বাড়ির বাইরে ভালো বা মন্দ কিছুই শোনা যাবে না”। সুতরাং তিনি চান যে নারীদের মধ্যে কোনো উদ্যোগ বা সচেতনতা থাকবে না, তারা যেন কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষদের সীমা ছাড়িয়ে না যায়। . . .
. . .

এই রকমই এক সামাজিক আবহাওয়ার মধ্যেই থাকিডাইডস বলতে পেরেছিল: “নারী বাত্যাহত তরঙ্গের চেয়ে, অগ্নির উত্তাপের চেয়ে, উষ্মও জল প্রপাতের চেয়ে অশুভ: যদি কোনো দেবতা নারীকে সৃষ্টি করে থাকেন তবে তিনি যেখানেই থাকুন, তিনি জেনে রাখুন যে তিনি হলেন সবচেয়ে অশুভ শক্তির অসুখী সৃষ্টিকর্তা”।

পৃথিবীর মহান সব দার্শনিকদের নারী নিয়ে এমন মন্তব্য আমাদের হিমশীতল স্পর্শে জারিত করে। চারপাশ এক গহিন আঁধারে ছেয়ে যায়। জীবনের এই বিভীষিকাময় সত্যকে সাথে নিয়ে নারীরা পথ চলছে। পিতা কুমারী মেয়েকে পতিতাবৃত্তি করিয়ে টাকা সংগ্রহ করে এবং সেই টাকায় ঐ মেয়েকে পাত্রস্থ করে। আর স্বামীরূপী পুরুষটি সব অধিকার পেয়ে যায় স্ত্রী নামক সত্তাটির ওপর। এমনকি তাকে দাসী হিসেবে বিক্রিও করে দিতে পারে। গ্রীসের মতো রোমান আইনেও নারীর কোনো আইনি অধিকার ছিল না। রোমান আইন অনুসারে পুরুষই ছিল নারীর কর্তা, নারীর নিজস্ব কোনো ইচ্ছার মূল্য ছিল না। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারও কেবল পুরুষদেরই ছিল যদিও পৃথিবীর অনেক বড় বড় আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে অথচ পুরুষতন্ত্র সেটাকে মাথায় নেয়নি। এমনকি খৃষ্টধর্ম প্রচারে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও বাইবেলে “নারীদের উল্লেখ দাসদাসী এবং গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে একসাথে করা হয়েছে।” করিনথিয়ানদের মতে, “প্রত্যেকটি পুরুষের প্রভু খৃষ্ট আর প্রত্যেকটি নারীর প্রভু হলো পুরুষ।” বেবেল তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন নারীর প্রতি অবিচারের ব্যাপরগুলো কেবল খৃষ্টধর্মে নয় গ্রীক, ব্যবিলন, ভারতীয় সভ্যতাতেও বিরাজমান ছিল। তবে সভ্যতার অগ্রগতিতে নারীদের অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে যেখানে খৃষ্টধর্মের কোনো কৃতিত্ব নেই।

“‘জাস প্রাইমা নকটিস’ (Jus Primae Noctic) বা ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’ বা বিবাহের প্রথম রাত্রিতে কনের সঙ্গে বাস করবার অধিকারও ছিল জমিদারদের, অবশ্য তারা ইচ্ছা করলে কিছু মূল্য নিয়ে সে অধিকার ছেড়ে দিতে পারত।” প্রাচীন এই প্রথাটা দুটো বিষয়কে নির্দেশ করে যেমন: নারীর প্রতি অবমাননা এবং ক্ষমতার কারণে পুরুষও সেই নিপীড়নের শিকার হয়। তাহলে ক্ষমতাধরদের হাত থেকে কেউই রেহাই পায় না। লড়াইটা হলো ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির এক অর্থে। পুরুষ সুপিরিওর এই ধারণাটা তো সেখান থেকেই এসেছে। একারণে ছেলে সন্তানও মায়ের ওপর কর্তৃত্ব প্রকাশ করে থাকে। Odysey-তে দেখা যায় Telemachus বয়ঃপ্রাপ্ত হলে মা Penelope-কে আদেশ করে পাণি-প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘরে চলে যেতে। মায়ের পুত্রের আদেশ মানা ছাড়া কিছু করার ছিল না। পুত্রই সিদ্ধান্ত নেয় পিতা এক বছরের মধ্যে না ফিরলে সে মায়ের বিয়ে দেবে। গ্রীসের “ইফিজেনিয়া ইন টরিস” (Iphigenia in Tauries)-এ বলা হয় পুরুষের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অনেকদূর অবধি যেতে পারে কিন্তু নারীর জন্য সে পথ খুবই সংকীর্ণ। এই সত্য আজকের একুশ শতকের সমাজেও স্পষ্ট।

প্রাচীন জার্মানেও স্ত্রী স্বামীর পদানত ছিল। কেবল দুএকটা ব্যতিক্রম বাদে সব জার্মান পিতৃপ্রধান সমাজে নারীর অবস্থা এক। বেবেল বলছেন:

দীর্ঘকাল ধরে এই নিপীড়ন এবং তারই অনুকূলে প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষায় দরুন নারীরাও তাদের প্রভু পুরুষদের একতরফা রীতিনীতিতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে উঠল যে তারাও নিজেদের এই হীন অবস্থাটাকেই সঠিক ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে লাগল।

বলা যায় এই প্রক্রিয় আজও অব্যাহত। নারী পিতৃতান্ত্রিক সেই কাঠামো থেকে আর বেরুতেই পারল না। উনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মানিতে নতুন আইন কার্যকর হয়। যেখানে নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারসহ আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা পায়। বেবেল প্রশ্ন তুলেছেন ‘তাহলে তারা কি তখন প্রকৃতই মুক্ত, স্বাধীন হয়ে গেল? তাদের জীবনের পূর্ণ বিকাশ কি সম্ভব হল? সম্ভব হল কি কার্যক্ষেত্রে তাদের স্বাভাবিক যোগ্য ভূমিকা পালন করা?’ এই প্রশ্নগুলো সকলের। বেবেল ‘অতীত যুগে নারীর অবস্থা’ শিরোনামে প্রথম অধ্যায়ে এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বর্তমান যুগে নারীর অবস্থা যৌন প্রেরণা, বিবাহের ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্ন’। শিরোনাম থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে নারীদের যৌনজীবন, বিবাহসংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে কথা আছে। ‘নরনারী উভয়ে মিলেই একটি সম্পূর্ণ সত্তা। একে অপরের পরিপূরক’ কান্টের এই কথাটা সমাজ মেনে নিলে নারীদের পদে পদে লাঞ্চিত হতে হত না। পুরুষ তার যৌনসঙ্গী হিসেবে নারীকে ভেবেছে কেবল এর বেশি কিছু নয়। বিবাহিত জীবন নারীর ক্ষেত্রে অত্যাচারিত হওয়ার আরেক ধাপ বলা যায়। জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, ‘আজকের দিনে বিবাহই হল একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে আইনত দাসপ্রথা বজায় আছে।’ আধুনিক নারীবাদীদের একদল তাই বিবাহের বিপক্ষে কথা বলেন। যা-ই হোক, নারীদের জীবনে শোষণের প্রক্রিয়াটা একইরকম আছে কেবল ক্ষেত্রবিশেষে কিছু রকমফের চোখে পড়ে।

এখানে বেবেল নারীদের শিক্ষা বিষয়েও কথা বলেন। আসলে পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা নারীর অবমাননাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ব্যালজ্যাক বলেন, ‘পুরুষদের মতো শিক্ষা পেলে নারীরা তাদের গুণাবলীকে চমৎকারভাবে বিকশিত করে স্বামীদের এবং নিজেদের জীবন সুখী করে তুলতে পারে।’ বেবেলের লেখায় উল্লেখ আছে গ্যেটে তাঁর কনফেশনস অব বিউটিফুল সোল গ্রন্থে বলেন, ‘লোকে শিক্ষিত নারীকে বিদ্রূপ করে থাকে, এমনকী যে নারীরা বেশ জানে বোঝে তাদের অপছন্দও করে। তার কারণ বোধ হয় এই যে মেয়েদের বেশি জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞ পুরুষদের লজ্জার মধ্যে ফেললে সৌষ্ঠব নষ্ট হয়।’ গ্যেটে যেভাবেই বলুন না কেন কথাটা কিন্তু ঠিক। নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে সমাজ চিরকাল অনুৎসাহিত করে এসেছে। শিক্ষার নাামে নারীকে যা দেওয়া হয় তা হচ্ছে কল্পনাপ্রবণ হওয়া, হৃদয়বৃত্তির চর্চা করা আর সংবেদনশীল হতে শেখা। অথচ পুরুষ যে শিক্ষা পায় তাতে তার বোধশক্তি বাড়ে। চিন্তাশক্তি ধারালো হয়, বিজ্ঞানমনষ্ক ও যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে পারে। ফলত নারী-পুরুষের শিক্ষার এই ফারাক তাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে। বেবেল মনে করেন বুর্জোয়াদের বিধিব্যবস্থায় নারীকে শিক্ষার নামে যা শেখানো হয় তাতে শোষণের বহুবিধ কার্যকলাপকে সে মেনে নেয় অবলীলায়।

গ্রন্থের তৃতীয় অংশের শিরোনাম ‘বিবাহের ক্ষেত্রে অধিকতর বাধাবিঘ্ন—নারী পুরুষের আনুপাতিক হার—তার কারণ ও ফল’। প্লেটো তাঁর রিপাবলিক-এ নারীদের পুরুষদের মতো লালন-পালন করার কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন ছিল বা বলা যায় আছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রমিকরা যেমন মালিকদের দ্বারা শোষিত হয় নারীরাও তেমন পুরুষদের দ্বারা, এখানে বেবেল বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় মানুষের শোষিত হওয়ার রূপ তুলে ধরেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন নারীদের শোচনীয় পরিণতি মূলত এই বৈষম্যভিত্তিক সমাজের কারণেই। পরবর্তী ‘গণিকাবৃত্তি-বুর্জোয়া দুনিয়ার একটি প্রয়োজনীয় বিধান’ অংশে এই পেশায় নারীরা কীভাবে বাধ্য হয়ে আসে আর এর কুফল বহন করে সে বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। দারিদ্র্য আর পুরুষতান্ত্রিকতা নারীকে এই পেশায় আসতে বাধ্য করে—এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন বেবেল। এর পরের ‘জীবিকার ক্ষেত্রে নারীদের স্থান : নারীর মানসিক শক্তি ডারউইন তত্ত্ব ও নারীর সামাজিক অবস্থা’ অংশে দেখানো হয়েছে বুর্জোয়া সমাজ নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে নারীদের উপার্জনের স্বাধীনতাকে আইনগত অধিকার দিয়েছে। তাদের জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ের শ্রমশক্তির প্রয়োজন।

নারীর শিক্ষা এবং কর্মে যোগদানের ব্যাপারে বেবেলের ধারণা ইউরোপের চেয়ে আমেরিকা এগিয়ে আছে। ইউরোপ তার পচা সংস্কার নিয়ে বিশ্বাস করে নারীদের এত শিক্ষার প্রয়োজন নেই। এখানে বেবেলের মন্তব্য এমন—প্রতিভা স্বয়ম্ভু কোনো ব্যাপার নয়। একে বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। যেটা পুরুষ পেলেও সমাজের কূপমণ্ডূক বোধের কারণে নারীরা পায় না। প্রাচ্যের রামমোহন, রোকেয়া এঁরাও এমন কথা বলেছেন। নারী অনুকূল সামাজিক পরিবেশ পেলে পুরুষের মতোই নিজের দক্ষতা প্রকাশ করতে সক্ষম। এটা দিনের আলোর মতো একটা সত্য ব্যাপার এবং সহজ ব্যাপার। যদিও কেউ কেউ পড়ে আছেন নারী ও পুরুষের মস্তিষ্কের ওজনের তারতম্য নিয়ে। এটা অর্থাৎ এই পার্থক্যের ব্যাপারটা আসলে খুব বেশি কার্যকর না এমন সিদ্ধান্তে আসেন বেবেল। ডারউইন বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী নারীদের তালিকা দেন যেখানে পুরুষদের চেয়ে তারা এগিয়ে। কেবল যত্ন আর স্বীকৃতির অভাবে তারা হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়া মার্কস, বাকল্ এরাও নারীদের অধিকারকে সম্মান দেখিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রে আর এটা সমাজের মূল স্রোতধারায় বহমান আছে—পুরুষ স্বীকার করুক বা না করুক।

এই গ্রন্থের পরের অংশের শিরোনাম ‘নারীর আইনগত অধিকার ও রাজনৈতিক সম্পর্ক’। এখানে দেখানো হয়েছে নারীরা কীভাবে এক কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। ভোটাধিকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার নিয়ে অনেক জলঘোলা করেছে পুরুষতন্ত্র। অবশেষে কিছুটা অধিকার লাভ করেছে নারী এসব ক্ষেত্রে । ‘রাষ্ট্র ও সমাজ’ অংশে ধনতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিমানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর ‘সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তর’ অংশে নতুন সমাজব্যবস্থায় জীবন কেমন হবে, নারী পুরুষের পারস্পারিক ব্যাপারগুলো কতটা কণ্টকমুক্ত হবে এমন বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আগস্ট বেবেল যে চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তিনি এভাবে দেখবেন। তবে ‘নারী-ভবিষ্যৎ কালে’ অংশে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘নতুন সমাজে নারী হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন, কোনো শোষণ, নিপীড়নের শিকার হবে না। নারী হবে সম্পূর্ণ মুক্ত, পুরুষের সমান।’ তবে এই সমাজ বুর্জোয়ানিয়ন্ত্রিত নয় এটা সমাজতান্ত্রিক চেতনাধারী সমাজ। কিন্তু একশ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজ নারীর জন্য এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘আন্তর্জাতিকতা’ অংশে বলেন পৃথিবীব্যাপী এমন একটা সম্পর্ক স্থাপিত হবে যেখানে উন্নয়নটা সার্বজনীন হবে। যেটা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করলেও পুঁজিবাদ করে না। ‘অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা’ অংশে বলা হচ্ছে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পৃথিবীর যে তিন চতুর্থাংশ ভূমি অনাবাদী পড়ে আছে সেটা কাজে লাগানো যায়। যা ধনতান্ত্রিক সমাজ করছে না। যেটা না করে নারীর সন্তানধারণ নিয়ে বিরূপ আলোচনা চলছে। ‘উপসংহার’ অংশে বেবেল বলেন ‘১৮৪৮ সালের প্রথম জার্মানির বুর্জোয়ারা নিজেদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে শ্রেণীসচেতন হয়ে ওঠে।’ কিন্তু সেখান থেকে বেরুনোর জন্য কাল মার্কস, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস চেষ্টা করেন। একটা সমবণ্টনভিত্তিক সমাজে সব নৈরাজ্য কমে যাবে, নারী-পুরুষ সকলে পাবে সমান অধিকার—এমন ভাবনা বেবেলের।

আগস্ট বেবেলের ভাবনা আমরা জানলাম। তাঁর বিষয়গুলোর প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দুএকটা কথা বলা যেতে পারে। তিনি সমাজ বিকাশের ধারায় পদে পদে নারীদের হোঁচট খেতে দেখেছেন যা আজও কোনো না কোনো ভাবে বিদ্যমান। ইতিহাস আর বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাবনা তুলে এনে নারীর ত্রিকালিক জীবনের ছবি ইউরোপ এবং আমেরিকার সমাজের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন। সেটা আসলে আর বাকি পৃথিবীরও চিত্র। এটা খুব একটা গবেষণা না করেও বলা যায়। বর্তমানে শিক্ষার আলো, সভ্যতার সকল সুবিধা ব্যক্তিমানুষের জীবনকে সহজ, গতিশীল স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং বিলাসবহুল করেছে। কিন্তু বাহ্যিক এই পরিবর্তন আদতে ভেতরে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে? নারীর বিষয়ে পুরুষের অভিব্যক্তি কতটা আধুনিক হয়েছে? এমনকি নারী নিজেকে কতটা মানুষ ভাবছে? নারী-পুরুষকে পৃথকসত্তা কল্পনা না করে সমাজদেহের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভাবা যেতে পারে। আসলে সৃষ্টির প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তাদের শারীরবৃত্তীয় গঠনেই কেবল কিছু পার্থক্য রয়েছে যা তাদের চিন্তার এবং কাজে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। যদি না সমাজ জেন্ডারের নামে একটা ছকে তাদের বেঁধে ফেলে। এই ছক তথা কাঠামো থেকে বের হয়ে আসার সময় এসেছে। সিমোন দ্য বোভেয়ার যেটাকে বলছেন সমাজের বানিয়ে তোলা প্রথা। আর জুডিথ বাটলারও বলছেন এমন—যে নারী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারটা আমাদের চেতনায় গেঁথে গেছে। এটা একটা কাঠামো যা তৈরি হয়ে আছে নারী ও পুরুষ উভয়ের অবচেতন মনে। যেভাবেই দেখি না কেন আমাদের বিশ্বাস নারী ও পুরুষের ভূমিকা জীবন যাপনে সমান গুরুত্ববহ করে। প্রভুত্ব বিস্তার নয় প্রয়োজন পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ আর সংবেদনশীলতা দিয়ে জীবনকে জীবনের পথে এগিয়ে নেওয়া। প্রার্থনা কেবল অন্ধকার থেকে এই আলোর যাত্রায় শামিল হোক পৃথিবীর সকল মানুষ। শুভবোধ জাগ্রত হোক, কক্ষচ্যুত নক্ষত্র হিসেবে নয় নারী সৌরজগৎসদৃশ জগৎ সংসারে নিজ কক্ষেই সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে জীবনকে উপভোগ করুক।

লেখাটি শেয়ার করুন :

নূর সালমা জুলি

নূর সালমা জুলি জন্ম রাজশাহীতে ৭ আগস্ট, ১৯৮১ সালে।  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। শিক্ষা বিষয়েও পড়েছেন। বর্তমানে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। 'মাহমুদুল হক : একজন কথাশিল্পীর প্রতিকৃতি' গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!