একজন তমেজের অসহায়ত্ব
এতে কোনো সন্দেহ নাই যে আমি খারাপ মানুষ। আমার বউ জানল, আমার বাচ্চারা জানল, ভবিষ্যতে যেই বাচ্চাগুলি আমার হবে তারা জানবে, আমার বাপ মা ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন সবাই জানল যে, তাগের তমেজ একটো লুচ্চা, আরেকজনের বউয়ের ঘরে ঢোকে। আর শুধু জানলই না যে তাগের তমেজ নিজের বউ রাইখা আরেকজনের বউয়ের ঘরে ঢুকতে গিয়া ধরা পড়ছিল, তারা দেখলও যে কাঁচা কুঞ্চি দিয়া ৫০টো বাড়ি দিয়া তমেজের গলায় জুতার মালা দিয়া সারা গ্রাম ঘুরানো হইছে।
আর তারা আরও জানে যে তমেজ নামের জাইরাডো এখন তার ঘরে এই দুপুইরা রইদ্যের মইদ্যে খ্যাতা গায়ে দিয়া শুয়া আছে আর তার বউ-ছল ঘরের দুয়ারে চৌকাঠের ওপর বইসা থাইকা থাইকা কাইন্দা উঠতেছে।
আমি শুধু ভাইবা পাইতেছি না, এরপরেও আমি মুখ দেখাব কিবা কইরা? অবশ্য এই গ্রামে আমি একাই তো আর মাইনষের ঘরে ঢুকি নাই। আঙ্গের গ্রামের সবথেকে নামি দামী লোক, ২৫ বছরের মেম্বার, এলাকার সবথেকে ধনী লোকটো যখন তার ভূতআলা ধর্ম বিটির ঘরে লুঙ্গি থুয়া দৌড় দেয়, সেইখানে আমার মতো তমেজ আর কী এমন অপরাধ করছে! তাছাড়া আমি তো খারাপ চেহারার মানুষের ঘরে ঢুকি নাই। বদি ঠিলার মতো তো আর আমি মোবারক ভেদার ফকিন্নির নাকলা ময়লা দাঁতাল বউয়ের ঘরে ঢুকি নাই। জিল্লুর মতো বাইটা জাহালমের বউয়ের নাকলা পাগলি আর বালের মতো দেখা যায় এমন বিউটির ঘরেও ঢুকি নাই। কাঙাল মাস্টারের মতো ঘোড়াক ধইরাও গোয়া মারি নাই। খাটাজল বাইটার বেটার মতো মাইনষের ছাগলের ওপরেও চড়ি নাই।
তারপরও ঘটনাটো রাতে ঘটার পর থেকে যে আমি মাথা নিচমুখ করছি, আর তোলার সাহস পাইতেছি না। কিন্তু না তুললেও তো কোথায় কী হইতেছে সব জানতে পারতেছি। আমার আর হাশেমের ঘরে মাঝখানে খালি মোতালেব আর তার ভাই আমিরুদ্দির ঘর। সাথেই আবার তার বাপ মায়ের ঘর, বড় ভাই হাসমত জমশেদের ঘর। কোন কলজা নিয়া আমি ঘরে ঢুকতে গেছিলাম আল্লা জানে! আমার ঘর রাস্তার সাথে। শুধু রাস্তা হলেই কথা শেষ হইত, ঘরের সাথেই মোতালেবের মনাহারি দোকান। আল্লার রাইত পোয়াইবার পায় নাই মানুষ জড়ো হয়া গেছে।
যেই মান্নানের বেটা মাসুদের সাথে প্রতিদিন ঘাস ছুলতে যাই, সেই মাসুদই কিনা আজকে আমাক এইভাবে ধাইন্দা ধাইন্দা গাইল পারতেছে? নাকি শালির মাথায় বাল তোলার ওষুধ ঢেলে দিছিলাম আর ঘা হয়া গেছিল দেখে সেই প্রতিশোধ আজকে নিচ্ছে?
আব্বাক আইসা যখন একে একে মানুষ পুইচ করতেছে, ‘ক্যাগো, ঘটনা কি সত্যি?’
‘সত্যি কিনা ওই শালিক গিয়া জিগাও, আমাক কও ক্যা? এইসব বালের প্যাচাল, এই হোলের আলাপ নিয়া আসবা না আমার কাছে, আজ থেকে জানবা তমেজ আমার বেটা না। কথা শ্যাষ।’
একটু থেমেই আবার শুরু কইরা দিল, আগের মতো, ‘ওরে শালি, জাইরা শালি, আজক্যা তুই ক্যা আকাম চোদাবি আর মানুষি ক্যা আমাক এই হোলের কথা বলতে আইসপো, কুত্তার বাচ্চা, তুই এখনও মরস নাই ক্যা? কুরকুরি থামাইতে পারস না, আগে কবি না, এই শালি, শালি রে শালি নিরবা শালি, শালি ভেজার বিটিক দিয়া তর হইতেছে না তুই আগে কবি না, এই চুতমারানি, তক বিয়া দশটো করামু, তর হোলের কত ধার দেখতাম, তুই এই এবা একটো কাজ কইরবার পারলি? তক আমিই জন্ম দিছি? কোন শালি নাকি কইবার পারব যে তর বাপ একাব্বর মালি কারো পুটকিত হাত দিছে কোনো দিন, আর তুই কিনা মাইনষের ঘরে ঢোকস, এই শুয়রের বাচ্চা, তুই মরলি না ক্যান এই কথা শোনার আগে? এই শালি, বারা ঘর থেকে তুই, যা কোনে যাবি যা। এই মাগি, তর বেটাক গিয়া ক, বাড়িত থেকে বের হয়া যাইতে। শালি তুই বার ঘর থেকে। তর বউ ছল আমি পালমু। তর আর এই বাড়িত জায়গা নাই। যা শালি যা।’
আল্লা জানে কতবার যে এইসব শুনতে হইছে আজ। কিন্তু আমি তার জন্য আমার বাপেক কিছু বলতে পারি? একাব্বর মালি কইরা বললেও তো কেউ কোনোদিন আমার বাপের নামে কোনো দুন্নাম করে নাই। মুখ খারাপ বেশি করার জন্য মানুষ মালি কইরা কয়। কিন্তু মানুষ তো খারাপ কইবার পারে নাই কোনোদিন। কিন্তু আমি তো খারাপ। আমাক গাইল পারবে না তো চুমা দিব? দেইক গাইল। মন ভইরা দেইক। আরও দেও আব্বা। যত মন চায় দেও।
মাইনষেও মুখের ওপর বলে দিয়া যাচ্ছে, তোঙ্গের আর লজ্জা শরমও নাই, বেটা এত বড় একটো আকাম করছে তাও তোঙ্গের গলা নামতেছে না।
আমার মাও আরও এক কাঠি সরেস। আলাপের মানুষের অভাব হইলে প্রতিদিন রাস্তা থেকে মানুষ ধইরা ধইরা নিয়া আইসা দুনিয়ার আলাপ জুইড়া দেয়। আজকে আর তার রাস্তা থেকে মানুষ ধরা লাগতেছে না। মানুষই তার কাছে আসতেছে। আর বলতেছে, ‘এহ, ছি ছি ছি, থু, তমেজের মাও, তোঙ্গের তমেজ এইডো একটো কাম করল? ছলপল বড় হয়া গেছে, বুইন বিয়া দিছে তিনডো, আরও দুইটো অবিয়াইত্যা বুইন ঘরে রাইখা, এইরকম একটো আকাম মানুষ করে, বুইনদের ঘরে অশান্তি হবে না? এই ছোটগুলার আর বিয়া হবো?’
আজকে আমাক হাড়ে হাড়ে বুঝায়া দেওয়া হইছে। এইডো আমার পাওনা। আমি পাইছি। আরও বেশি দিলেও তো আমার করার ছিল না। কেউ তো আমার পক্ষে কথা বলে নাই। কারণ একজন দুইজন তো সাক্ষী না। ৪/৫ জন মানুষ আঙ্গের দেখছে।
‘ওই জাইরা জানে, আমার কাছে ইগল্যা প্যাচাল নিয়া আসবা না। ওই জাইরাক গিয়া কও। আর না হয় ঘরে ঢুকছিলই, কিছু তো করে নাই, আমার বেটার হোলে জোর আছে বলেই গেছে। তা জাইরা গেলিই যখন আঙ্গের মাটি দিয়া থুয়া যাইবার পারোস নাই? তর জন্য ক্যা আজ মানুষ বাড়ির ওপর আইসা এগলা বলবে? এই জাইরাকি বলে আমি পেটে থুছিলাম। আল্লা আমাক তুইলা নেও না ক্যা? এই জাইরাদের মুখ আমি আর দেখপ্যার চাই না। আগে জানলে গলাত টিবি দিয়া মাইরা থুইতাম। তর মত বেটা আমার নাগে না। জাইরার জাইরা, … ’
গালি দেইক। মারুক পিটুক। আজ আমি কারো দোষ দিব না। যে নাগর আমাক সাথে কইরা নিয়া গেছে তাকেও দোষ দিব না। আমি তো নাগরের কেনা গোলাম না। আমি না গেলে তো আর নাগর আমাক বাইন্দা নিয়া যাইতে পারত না। আর সত্যি কথা বলতে, আমি কি চাইতাম না যে হাশেমের বউয়ের শরীরকে আমি জড়ায়া ধরি? তার উপরে চড়ি? এই গ্রামের এমন কেউ আছে যে হাশেমের বউয়ের চেহারার নিন্দা করতে পারবে? নায়িকা শাবনূরের নাকলা এত সুন্দর মানুষকে জড়ায়া ধরতে কার না মন চাবে? আমি তো তাদের থেকে আলাদা কেউ না। তাদের মতোই মানুষ। যতই আমার বউ থাকুক আর যতই আমি নিজেই হ্যান্ডেল মারি না ক্যা, মন তো চায়। মনটাকে বাইন্দাই রাখছিলাম তো এতদিন, কত শত বার তো আমার ইচ্ছা হইছে গিয়া অন্তত একটু জড়ায়া ধরি, একটো চুমা খাই। কিন্তু আমি তো এর ফল আন্দাজ করতে পারতেছিলাম। যা আজকে আমাক হাড়ে হাড়ে বুঝায়া দেওয়া হইছে। এইডো আমার পাওনা। আমি পাইছি। আরও বেশি দিলেও তো আমার করার ছিল না। কেউ তো আমার পক্ষে কথা বলে নাই। কারণ একজন দুইজন তো সাক্ষী না। ৪/৫ জন মানুষ আঙ্গের দেখছে। খুব বেশি রাতও তো হইছিল না। হাশেমের মাছ মারতে যাওয়ার কথা ছিল। কে জানে যে যায় নাই। শালা ঘরের ভেতর বউ নিয়া ঘুমাইছে। বিকালে তো কইছিল জাল নিয়া যাবে। এত সুন্দর বউ থাকলে কি আর বউ রাইখা মাছ মারতে যায় ঠেকা না পড়লে? মাছ মারতে যায় নাই হাশেম। তার সুন্দরী বউয়ের সাথে গলা ধইরা শুয়া ছিল। আমি আর নাগর, হাশেমের ঘরে ঢুকছিলাম। গরিব মানুষের শোলার বেড়া, দড়ি কেটে দিয়া ঢুকতে খুব একটো কষ্ট হয় নাই। ঢুকে অবাক হয়া গেছি। কী করব বুঝতেছি না। ঢুকছিই যেহেতু আজকে আর না কইরা যাওয়াযাওয়ি নাই। আমরা দুইজন মানুষ। দুইজনই শক্তিশালী। একজন হাশেমকে ধইরা আরেকজন ওর বউকে ধরতে যামু, কিন্তু তার আগে টের পায়া গেল হাশেমের বউ। চিল্লাচিল্লি শুরু কইরা দিল। আমরা বের হতে হতেই মুখ চিনা ফেলল। আমরা দুইজনেই দুই দিকে দৌড় দিলাম। হাশেম খুলে যাওয়া লুঙ্গি পিন্দিতে পিন্দিতে নাগরের পিছন পিছন দৌড় দিল। মুখ যেহেতু চিইনা ফেলছে, আর বাঁচন নাই।
কিন্তু বাঁচার বহু চেষ্টাই আমার জন্য করছে আমার বাপ। ভাবছিল কিছুই হবে না। খালি তো ঘরেই ঢুকছে, করে নাই তো কিছু। প্রথমে নাগরেক কইছিল নাম না কইতে। হাশেমেকও কইছিল। টাকা দিয়া হইলেও যাতে মুখ বন্ধ রাখে। ইউনুস কাক্কুর বেটা এরশাদও তো হাশেমের বউয়ের ঘরে ঢুকছিল। ঈদের আগের রাতে। শালা এতেকাফে বসছিল তিনদিনের জন্য। এতেকাফ থেকে উঠে মানষের বউয়ের ঘরে ঢুকছে। এরশাদও ধরা পড়ছিল। কিছুই হয় নাই। ইউনুস কাক্কু তো ধনী মানুষ। মসজিদ তার বাড়িতে। বিচার সালিশে তাকে ডাকা হয়। তাই হয়তো বিচারই বসল না। সেইবারও নাকি হাশেমের বউই চিক্কুর দিয়া উঠছিল। শালী মাগিক মনে করতাম নটি। চাইলেই শুয়ে পড়বে ভাবতাম। দুই দুইবার এইভাবে ডস দিব? আমি আর নাগর না হয় কালা ছিলাম, বউ-ছলও আছে আঙ্গের। কিন্তু এরশাদ তো সুন্দর, ওর কাছে কেন দিল না? দিনে তো ভালোই ইয়ার্কি ফাইজলামি করে, টকস টকস কইরা কথা কয়। পরির নাকলা সুন্দর মানুষ, পান খায়া মুখ টকটকা বানায়া যখন ইয়ার্কি করতে থাকে, মনে হয় মাগিক ওইখানেই পাইড়া ফালাই। তা মাগি বাইঙ মাছের মতো খালি পিছলায়াই যায় না, শিং মাছের মতো কাঁটাও ঢুকায়া দেয়।
আজ কারো দোষ দিব না আমি। তমেজকে আজকে যাই করা হোক, কোনো দোষ তার হবে না। তমেজ পাপী, তমেজকে গালি দেও। তমেজ লুচ্চা, তমেজকে মারো। তমেজ মাইনষের বউয়ের ঘরে ঢোকে, তমেজের ঘরেও আজকে তোমরা ঢোকো। তমেজ মানুষকে মান মারতে যায়, আজকে তমেজকে তোমরা মান মারো। খাড়া থেকে মারো। বসে থেকে মারো। শুয়ে থেকে মারো।
মেম্বার হুকুম দিল মারার, সে যে আরেকজনকে বছরের পর বছর ধর্মের বিটি বানায়া আকাম করল, তাকেও কিছু বলব না। রবি মোল্লা গলায় জুতার মালা পড়ায়া দিল তাকেও কিছু বলব না,
আজ কাউকে দোষ দিব না। যারা আমাক মারছে, তাদেরকেও না। যেই ইউনুস কাক্কু আজ বিচারের মানী মানুষ হইছিল, যার বেটা একই মানুষের ঘরে ঢোকার পরেও বিচার হয় নাই, তাকেও কিছু বলব না। যেই হবি মেম্বার হুকুম দিল মারার, সে যে আরেকজনকে বছরের পর বছর ধর্মের বিটি বানায়া আকাম করল, তাকেও কিছু বলব না। রবি মোল্লা গলায় জুতার মালা পড়ায়া দিল তাকেও কিছু বলব না, সে যতই মসজিদের টাকা মাইরা খাক, তার বেটারা যতই মানুষকে কানা কইরা দিক, যতই মানুষের ছাগল মুরগি হাঁস ধইরা ধইরা নিয়া খাক, যতই ফেনসিডিল আর বাবার ব্যবসা করুক, কিচ্ছু বলব না। কারণ তারা বিচারক।
তা বিচার করুক। শুধু মারলেও তো হইত। গুইনা গুইনা পঞ্চাশটো বাড়ি দিছে। কাঁচা কুঞ্চি দিয়া। তাও সেকেন্দার ভাইয়ের যে মোটা শরীর। শরীরের সব শক্তি এক কইরা পেটন মারছে। সেই সেকেন্দার ভাইও কিন্তু মাত্র ৫ কেজি জেলাপির জন্যে সাহালম পাগলার বেটিক চাইর পাঁচজন মানুষ সাথে কইরা নিয়া মান মারছিল। আজকে সেই আমাক শাস্তি দিল। তা বাড়ি দিল দিলই, তার উপর আবার জুতার মালা দেওয়া লাগে?
এক মন বলতেছে জুতার মালা দেওয়া অবশ্যই অন্যায় হইছে। কিন্তু আরেক মন বলতেছে যে আর কেউ না জানলেও আমার করা পাপের জন্যই আল্লা এই শাস্তি তইরি রাখছিল। ঘাস ছুলতে গিয়া একদিন এক মাজা কালাইয়ের খেতের ভেতর কটাপুইরা ট্যাবড়া যে ছেরিডো ছাগল চরাইতে আসছিল, তাক যে ঠাইসা ধরছিলাম সেই শাস্তিই যেন আল্লা আমাক দিল। কিন্তু ছেরিডো একটু মোছরামুছরি করলেও দিতে না করে নাই। পায়জামার ফিতা খুলতে দিছিল। প্রথমে খালি দুধই খাইতে দিছিল। কিন্তু আমি বারবার চাপ দিতেছিলাম পায়জামার ফিতা খুলতে। শেষ পর্যন্ত কাবু হইল। আগে দেইখা নিল যে কালাই যথেষ্ঠ লম্বা কিনা।
তবুও আমার নামে ওইরকম খারাপ রিপোর্ট কিন্তু কখনোই ছিল না। সবাই ভালো হিসাবেই আমাক জানে। কারো সাথে কোনোদিন মারামারি করি নাই। কারো সাথে অন্যায় করি নাই। কিন্তু আজ হয়া গেল। সবাই জানল।
ঘটনাটা–আমি, মানে আমরা, আমি আর নাগর–ঘটাইছি। কীভাবে ঘটাইলাম ঘটনাডো ভাবতেও আমার অবাক লাগে। এমন না যে আমার বউ নাই, বা এমনও না মাগি মানুষের স্বাদ আমি পাই নাই। তাও একজন না, আগেও আরেকটো বিয়া আমি করছিলাম, ৩/৪ মাস সংসার করছি। তারপর বউডো আমার চলে গেল। চলে গেল আর কী? ভাগায়া দিল। আমার মাও। বাপের বাড়ি থেকে বেশি জিনিস আনতে পারে নাই। ঠিকমতো কথা শোনে না।
অথচ আরেক গরিবের বিটিক নিয়া আইসা দিছে। যার বাচ্চা হইল না ৭/৮ বছর। কত গালাগালি করল, আরেকটো বিয়া করাবার চাইল আমাক, বউ তালাক দিতে কইল। কিন্তু আমি আর বিয়া করমু না বলে দিছিলাম। ব্যবসা হয়া গেছে? বড় দুই বিটিকও দুইবার বিয়া দিছে। চালি দিয়া আমার পয়লা বউটাও ভাগায়া দিছে। আরও বিয়া? মইরা গেলেও না। ধরেই নিলাম যে বউ বাঞ্জা। তাই পরে ভাত দিতে পারে না এমন একজন তার ছলকে পুইষন্যা দিব। নিয়া আসলাম। গায়ের রং দুধের মতো ধলা ফকফকা। নাম দিল ওর দাদা ধলাই। আসার পর বাচ্চাডো এক মাস খালি খাইল আর খাইল। একদম টেমটেমি একটো বাচ্চা। পেটটো ইন্দুরের মতো। পাছাটো একদুল্লা চুনের খুটি। কত আদর যত্ন কইরা বড় করলাম। স্কুলে ভর্তি করায়া দিলাম। কোনোদিন বুঝতে দেই নাই তাক পুইষন্যা নিয়া আসছি। ধলাইকে নিয়া আসার ৩ বছর পরই আল্লার রহমতে বউয়ের পেট হইল। জাদু হইল। ধায় ধায় কইরা দুই ভাই বড় হতে লাগল। এই দুইডো স্কুল যাইতে না যাইতেই আরেকটো পেটে আসল। সেইদিনের সেই ধলাই, আজ কত বড় হইছে। সেই ধলাই আজকে তার বাপের আকামের দুর্ভাগ্য নিয়া কান্দিতে কান্দিতে চোখ মুখ ফুইলা তুলছে। ছোট বেডাটো আমার পিছে পিছেই দৌড়াইল। বাপের গলায় জুতার মালা পরানো দেইখা ব্যাপক খুশি।
আমি আজকে কোনোভাবেই বুঝতে পারতেছি না আমার পুইষন্যা নিয়া আসা বেটা ধলাই বেশি অসহায়, নাকি আমি বেশি অসহায়? কে বেশি পরিচয়হীন?
রাস্তার ধারে বরই পাড়তে আসলে যখন ধলাই বাধা দেয় কিংবা ক্ষেতে ছাগল লাগলে ধলাই যে ছাগল ধইরা আনতে যায়, আর তখন ধলাইকে যে পরাই পরাই মাইনষে খ্যাপায় তমেজ তো তর বাপ না, তর বাপ মার পরিচয় নাই, তক পুইষন্যা নিয়া আসছে, তুই কে বলার? তুই ক্যা ছাগল ধরবি? তখন যেরকম অসহায় মনে হয় ধলাইয়ের, আমার এই এখনকার থেকেও কি তা বেশি ভয়ের? ধলাইকে না হয় মানুষের কাছ থেকে আমি বাঁচাইতে পারি এই বইলা যে আমি ধলাইয়ের বাপ, বড় নদী থেইকা দাঁত মাইজা আইসা কথা বলবি।
কিন্তু আজক্যা আমাক কেউ বাঁচাইল না। সেই মাইর আর জুতার মালার থেইকা বেশি কষ্ট হইতেছে ভাইবা যে এই মুখটো আমি কীভাবে দেখামু? খিদায় যে আমার পেট চো চো করতেছে কীভাবে আমি আমার বউয়ের কাছে ভাত চামু? বেটারা যে আমার কাইন্দা চোখ ফুলায়া ফেলছে, কীভাবে বেটাক আমি কোলে নিমু? কোন মুখে নামাজ পড়তে যামু? কোন মুখ নিয়া আমি বাজারে যামু? কারা বাঁচাব আমাক?

হুসাইন হানিফ
জন্ম: জানুয়ারি, ১৯৯৯। চর ঘাগুয়া, সারিয়াকান্দি, বগুড়া। প্রকাশিত বই: বহিষ্কার (গল্পগ্রন্থ, ২০২৩)। পেশা: ফ্রিল্যান্স বুক ডিজাইনার।