কবিতা

বটতলি স্টেশন ও অন্যান্য কবিতা

একটি গোপন প্রমাদ

তোমার ছায়ার ভিতর থাকি। তুমি দিলে পথের নদী। নদীপাড়ের চায়ের দোকান। ফুলকপির ক্ষেত। হাতের বাঁধন দিলে। পথ-ঘাট, রিকশা, বৃন্দাবনী, টমেটোর রং, সূর্যমুখী, নুন, নৌকা সব দিলে। তবু উইপিং উইলোর ধারে কাঁদে পথের দীর্ঘ পা, ঝরাপাতায় ঢাকা। পথের পায়ে বসি কোনোদিন তোমার ডান পাশে, একা। ঢেউ ঢেউ ঘুম এসে ভিজিয়ে দেয় আরক্ত কথার কবর।

অনেক পথের শেষে পুরনো এক পথ পেয়ে গেলে দাঁড়াও সমুখে। আমার মাথায় চুলের কাক আর রক্তে কাকস্য পরিবেদন। তোমার হাতে ক্যামেরা, আর পেছনে সূর্য। সূর্য তোমাকে দেখে বিকেলের রং মাখিয়ে। আমি সূর্যকে অস্বীকার করে তোমার দিকে তাকিয়ে রই। তুমি ফটো তোলো একটা। তারপর কাছে এসে বলো, ‘দেখো এই ছবিতে রয়েছি আমিও’। দেখি সূর্য আড়াল করে তোমার দিঘল ছায়া এসে আশ্লেষে আছড়ে পড়েছে আমার উপর।

একদিন আমি তোমার ছায়ার ভিতর হারিয়ে গিয়েছি বলে এখনো তোমার দেহে লেগে থাকে আমার শরীরের দাগ। আর থাকে একটি গোপন প্রমাদ।

বটতলি স্টেশন

তুমি কোনোদিন দুপুরের পর প্রিয় মানুষটিকে সঙ্গে করে স্টেশন রোডে হাঁটতে হাঁটতে, কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে বিকেলের পেটে ঢুকে পড়বে। তোমাদের শরীরে তখন মরুভূমির নির্জনতা, ওষ্ঠাধরে গতজন্মের তৃষ্ণার আফসানা। তারপরও তোমরা বসে আরো অজানিত পাখি, বনপাহাড়, রাক্ষস, পরি ও পালকের কথা বলবে ভেবে বটতলি স্টেশনে ঢুকে পড়বে। রেললাইন পার হয়ে মাঝখানের প্লাটফর্মের পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে পড়বে। ওই প্লাটফর্মের উপর ছাউনি নেই বলে আকাশ তোমাদের তখনো দেবে আলতো রোদেভেজা আলোর ছায়া।

তোমরা কোনোদিন অনেক বছর আগে রাতের স্টেশনে দেখা পাওয়া জনৈক রূপজীবার যন্ত্রণার কথা বলতে বলতে তোমাদের হাওয়া ঝিরিঝির বিকেল ঢুকে পড়বে সন্ধ্যার মন খারাপ করা পেটে। তোমাদের যার যার ঘরে ফেরার সময় এসেছে বলে তোমরা চোখ থেকে মুছে ফেলতে চাইবে পরস্পরের ছবি। পারবে না।

তোমরা উঠে দাঁড়াবে। যে-পথে ঢুকেছিলে সেই পথের গেইট বন্ধ দেখবে। তাই হাঁটতে থাকবে নতুন স্টেশনের গেইটের দিকে। ততক্ষণে এসে পড়েছে আন্তঃনগর ট্রেইন। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে গেইটের দিকে। গেইটম্যান চেক করছে টিকিট। কিন্তু তোমাদের হাতে কোনো টিকিট নেই। ভাববে এখন কী হবে তবে?

তোমরা যে ট্রেইন থেকে নামোনি সেই কথা কেমন করে প্রমাণ করবে?

তখন তোমার মানুষটি তোমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে উলটোদিকে। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে তোমরা চলে যাবে কদমতলি রেলক্রসিং-এ। সেই রেলক্রসিং খোলা থাকে সকল সময়। তারপর তোমরা বিভাগ হয়ে যাবে যে যার পথে। কিন্তু বটতলি স্টেশনের সেই প্লাটফর্মের পাড়ে পড়ে থাকবে তোমাদের তৃষ্ণাকুসুম, চিরদিন চিরদিন।

আমার নাম

প্রতিরাতেই তোমাকে আকাশে খুঁজে বেড়াই। প্রেম ধীরে মুছে যায় না, কিন্তু নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, এই জেনে ভয়ে ভয়ে খুঁজি। পেয়ে যাই, জ্বলে থাকো তীব্র, সবুজ আগুনের তারা। তারাকে বিন্দু ভেবে বৃত্ত বানাই মনে। বৃত্তে ঢুকে শান্তি হয়ে থাকি, যেন বা গাঢ় রাত্রির ভাঁজে গাঁয়ের টলটলে শান্ত পুকুর।

প্রতিরাতে তোমাকে আকাশে খুঁজে বেড়াই। প্রেম ধীরে মুছে যায় না জেনে কোটি কোটি নক্ষত্র সরিয়ে খুঁজি। যদি না পাই, ভাবি তুমি পৃথিবীতে নেমে কোথাও বনপাহাড়ের ধারে কোনো প্রেমিকের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছো। তোমার জানালার বাইরে পাতাবনে বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাচ্ছে সকল আকাশ। তুমি আশ্লেষে প্রেমিকের পিঠের পাতায় নখের আঁচড়ে লিখে দিচ্ছ আমার নাম, আর নৈঃশব্দ্য।

দৃশ্যের দাগ

দৃষ্টি ক্ষয় হয়, দৃশ্য থেকে যায়। গজদন্ত মিনার যেন বা কোমল রেখার ডাহুক, কার গ্রীবায় ধরা পড়েছিল সেই দৃশ্য তেমনই আছে। কেবল দ্রাক্ষার বনে রোদে পুড়ে গেছে সলোমনের গান।

একটি রাত্রিই জানে, না ফোটা কুসুমের ভাঁজে বিঁধে আছে চিরদিন তীব্র অভিমান।

দৃষ্টি ক্ষয় হয়, দৃশ্য সে থেকে যায়। জানালায় বাঁধা বনের ছবি পাহাড়ের ভাঁজে নাচে। ঝিরিঝির বাদলে পাতা ও সন্ধ্যা ভিজে যায় এখানে-ওখানে, যেখানে তৃষ্ণা তার রাত্রিকে ছিঁড়ে কাছে টেনে আনে।

হলুদ দুপুর

সন্ধ্যার পর একটা গোলাপের ভিতর ঢুকে পড়ি। গোলাপের ভিতর একটা প্রকাণ্ড দুপুর শুয়ে হলুদ। দুপুরের পেটের বোতামে জমা সূর্যের স্বেদ। আমি ঝিরিঝিরি চোখ রাখি এই দৃশ্যে। তারপরে ফুরিয়ে যাব ভেবে শুয়ে পড়ি দুপুরের পাশে, একই বালিশে মাথা রাখি। বালিশের পিঠে আঁকা কবেকার হারানো বনের হিজল। এইসব দেখে দেখে দুপুর ভেঙে রাত্রি হয়, রাত্রি হয়।

রূপকথার জন্ম

বহুদূরে আমার জন্মান্ধ প্রেমিকারা গাঢ় লাল হয়ে আছে। তারা চুল থেকে কাঁটা খুলে হাতে নেয় প্রতিরাতে, খুঁচিয়ে অন্ধ করে দিতে চায় নক্ষত্রের প্রাচীন চোখ। তারা আমাকে কখনো দেখেনি বলেই পৃথিবীতে রূপকথার জন্ম হয়।

রূপকথার ভিতর একটা কবন্ধ রাজহাঁস আসে, ডানা মেলে হয়ে যায় কালো, রাত্রিবেলা আমার জন্মান্ধ প্রেমিকাদের খোলা চুল যেমন ঢেকে রাখে দৃশ্যের সকল আলো।

লেখাটি শেয়ার করুন :

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। জন্ম ২৪ অগাস্ট ১৯৮১, চকরিয়া, কক্সবাজার, বাংলাদেশ। লেখালেখি আর ছবি আঁকাই মূল কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত বই ২০টি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!