বব ডিলানের গানের শক্তি

কিছু গানের শক্তি এত বেশি, পাল্টে দিতে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব আত্মার সঙ্গে বেঁধে দিতে পারে আপনার প্রাণ। আমাদের গণমানুষের শিল্পী কফিল আহমেদের ভাষায়, ‘প্রাণে প্রাণ মেলাব, বলে রাখি’। বব ডিলানের গানও তেমন। তাঁর গানের ভাষা এত শক্তিশালী যে, লাখো মানুষকে তো বটে অনেক বিখ্যাত শিল্পীর জীবনও পাল্টে দিয়েছে। কবি-লেখকের সাহচর্যে এসে যেমন অনেকে হয়ে ওঠেন লেখক, বড় শিল্পী যে কাউকে অনুপ্রাণিত করবে সেটাই যেন স্বাভাবিক। ডিলানও অনেকের সুপ্ত মনে রুয়ে দিয়েছেন শিল্পের বীজ। বিখ্যাত রক ব্যান্ড ‘লেড জেপেলিনে’র গায়ক রবার্ট প্লান্টের কথায় ধরুন। তাঁর সংগীতজীবনে সরাসরি প্রভাব পড়েছে ডিলানের। মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের সংগীতশিক্ষা শুরুর জন্য ঘর ছেড়েছিলেন প্লান্ট। শ্রোতা হিসেবে ডিলানকে আবিষ্কারের পর সংগীতের প্রতি উন্মাদনা তৈরি হয় তাঁর।

এরপর তো কয়েক বছর ক্যাঙারুর মতো এক দল থেকে আরেক দলে লাফ দিয়ে চললেন প্লান্ট। শুরুর দিকে ‘দ্য ক্রলিং কিং স্ন্যাক’ ব্যান্ডেও গেয়েছেন। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় ড্রামার জন বোনহামের সঙ্গে। পরে ‘ইর্য়াডর্বাডস’ ছেড়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন গিটার মায়স্ত্রো জিমি পেজ। লেড জেপলিন ভক্তরা নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন কী হয়েছে এরপর। যুক্তরাজ্য তো বটে, পুরো সংগীত দুনিয়ায় আলোড়ন তুললেন তাঁরা। ব্লুজ, রক ও মেটালের মিশ্র কণ্ঠে ৭০-৮০ দশক কাঁপিয়েছেন প্লান্ট।

মানুষের অধিকার ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের সহায়তার জন্য অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গে গান করেছেন তিনি।

লেড জেপলিনে যোগ দেওয়ার দশক পরে, এক অনুষ্ঠানে এসে নিজের কয়েকটি প্রিয় গানের কথা বলেছিলেন প্লান্ট। তার মধ্যে একটি ছিল ডিলানের গান, ‘ডাউন দ্য হাইওয়ে’। শৈশবের কথা স্মরণ করে প্লান্ট বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৫ বছর, গানটি আমাকে বিশেষ ও চমৎকারভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।’ কেবল ওই গানটিই নয়। ডিলানের দ্বিতীয় স্টুডিও অ্যালবাম ‘দ্য ফ্রিউইলিং বব ডিলান’ যেন জীবন পাল্টে দিয়েছিল প্লান্টের। সে বছরই তিনি ঘর ছাড়েন। সংগীতের টানে আমাদের রকস্টার জেমসও কিশোর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, প্লান্টের মিউজিক্যাল ক্যারিয়ারের পুরো দায় ডিলানের।

কেবল কি প্লান্টের ওপরে পড়েছিল ডিলানের গানের প্রভাব? বাংলা গানের দুই কিংবদন্তি কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্তের কথায় ধরুন। সেসব কথা আজ কে না জানে! তারপরও এই সুযোগে দুটো উদাহরণ দিয়ে দিই। ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ শোনেনি এমন সংগীতপ্রেমী পাওয়া যাবে না বললেই চলে। যার মুখটা এমন —‘How many roads must a man walk down/ Before you call him a man?’। সুমনের ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?/কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানা’— এই দুটো গানের কথায় কেবল এক নয়, হুবহু মিল আছে সুরেও। তাই বলে এই নয় যে, ডিলান থেকে চুরি করেছেন সুমন।

অঞ্জন দত্তের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ শোনেনি এমন সংগীতপিয়াসিও পাওয়া দুস্কর। অনেকে মনে করে থাকেন, ১৯৭৫ সালে রিলিজ হওয়া ডিলানের ‘ব্লাড অন দ্য ট্র্যাকস’ অ্যালবামের ‘ইফ ইউ সি হার, সে হ্যালো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ গেয়েছিলেন অঞ্জন। তবে এসব গুঞ্জনও হতে পারে। কারণ লিরিক ও সুরে ডিলানের সেই গানটির তেমন মিল না থাকলেও ভাবে রয়েছে। প্রসঙ্গ যেহেতু এলো, নিজের অনূদিত ‘ইফ ইউ সি হার, সে হ্যালো’ লিরিকের কিয়দংশ এখানে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না—‘যদি তুমি যাও তার খুব কাছাকাছি/আমার হয়ে তাকে এক চুমু দিও গালে/সব সময় আমি, তাকে জানাই সম্মান/সে যা করেছে ও করেছিল, মুক্তির ছলে।’

বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর মিলে যে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেছিলেন সেখানে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলস ছাড়াও গান গেয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন ও ডিলান।

বলা হয়ে থাকে, আপনি যদি ষাটের দশকের লোক হোন বা সেই সময়ের টগবগে টিনেজার, তবে বব ডিলানকে না চেনা মানে হলো অসম্ভব ও আশ্চর্যের বিষয়। মানে দাঁতে জিহ্বা কামড়ানোর মতো ব্যাপার। সেক্ষেত্রে আমরা তাঁর গান শুনছি একুশ শতকে। ডিলান যদিও গায়ক হিসেবে পরিচিত, তবে তিনি তারচেয়েও বেশি কিছু। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করে গেছেন তিনি। খোলা চোখে ডিলান আমাদের কাছে একজন আমেরিকান ফোক সিঙ্গার ও গীতিকার। যিনি ভিন্নধারা ও নতুন কাব্যিক গানের জন্য ২০১৬ সালে নোবেল পেয়েছেন। এই পুরস্কারের জন্য তাঁকে কম সমালোচনাও সহ্য করতে হয়নি। গায়ক বা গীতিকার হিসেবে ডিলান ছাড়া অন্য কেউ সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন কি না আমাদের অজানা। তবে এসব ছাড়াও ডিলানের গানকে কেবল ফোক (সযতনে এর আক্ষরিক ‘লোকশিল্পী’ শব্দটি এড়িয়ে গেলাম) বললে ভুল হবে। তাঁর কণ্ঠে ‘লং ব্ল্যাক কোট’, ‘র্হাড রেইন গনা ফল’, ‘সারা’র মতো ব্লুজ ও রকের মিশেলের গানও উঠে এসেছে। এর বাইরে তাঁর পরিচয় নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী হিসেবে। মানুষের অধিকার ও যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের সহায়তার জন্য অসংখ্য শিল্পীর সঙ্গে গান করেছেন তিনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা চালানোর প্রতিবাদে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্কর মিলে যে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেছিলেন সেখানে বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলস ছাড়াও গান গেয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন ও ডিলান। মানুষের অধিকার আদায়ের সপক্ষে তিনিই প্রথম মিউজিশিয়ান যিনি গিটার হাতে নেমে পড়তেন সবার আগে।

ডিলান তো অনেক গায়ককে প্রভাবিত করেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে চলুন একটু ঘুরে আসি ডিলানের ছেলেবেলা থেকে। মিনোসোটার দুলুথে ১৯৪১ সালের ২৪ মে রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান নামে এক শিশু জন্ম নেয়। দেখতে দেখতে এই শিশু এখন ৮১ বছরের এক গানপাগল তরুণ। ‘গড গিফ্টেড’ আমাদের কাছে বেশ পরিচিত শব্দদ্বয়। ডিলানের সংগীতজীবনও যেন ঈশ্বরপ্রদত্ত। শৈশবেই পিয়ানোতে হাতেখড়ি হওয়ার পর হারমোনিকা ও গিটার বাজানোটাও রপ্ত করে নেন। তবে একটু বলে রাখি, ফোক গানের জন্য গিটারের কর্ড-নোটের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। কানাঘুষো আছে, ডিলানও কাজ সারার মতো কয়েকটি কর্ড শিখেছিলেন। ১৯ বছর বয়সে কলেজ ছেড়ে দেন তিনি। যাকে বলে ‘ড্রপড আউট’। এরপর নিউইয়র্কে চলে আসেন মিউজিক ক্যারিয়ার গড়তে। সাক্ষাৎ হয় আরেক ফোক সিঙ্গার উডি গুথ্রির সঙ্গে। এই বিখ্যাত আমেরিকান ফোক সিঙ্গারই মূলত ডিলানের আইডল।

নিউইয়র্কের জীবন সহজ ছিল না ডিলানের জন্য। মুটে-মজুরদের নিয়ে লেখা লিরিক ও কর্কশ কণ্ঠের জন্য শুরুতে ডিলানের গান তেমন শুনত না কেউ। অনেকের কাছে সেসব ছিল ‘ঘ্যানঘানানি, প্যানপ্যানানি’। কিন্তু ষাটের দশকে গানের বিপ্লবে বড় অবদানটিই রাখেন ডিলান। পরবর্তীকালে তাঁর সেসব গানই নতুন করে ধরা দিতে থাকে শ্রোতাদের কানে।

সম্ভবত বিশ্ব সংগীতে সবচেয়ে বেশি কাভার হওয়া তালিকায় থাকবে ডিলানের ‘নকিং অন হ্যাভেনস ডোর’। ‘গানস অ্যান্ড রোজেসের’ গিটারিস্ট স্ল্যাশ ও ভোকাল অ্যাক্সেল রোজ মিলে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন গানটিকে। গানও যে আন্দোলনের অংশ হতে পারে সেটি দেখিয়েছিলেন ডিলান। বন্ধু ও সাবেক প্রেমিকা জোয়ান বায়েজের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সংগীত জগতের এই বিখ্যাত জুটি বেশিদিন হাত ধরে না হাঁটলেও উপহার দিয়েছেন অসংখ্য কালোত্তীর্ণ গান। বিষাদমাখা হারমোনিকার সঙ্গে সামান্য কয়েকটি কর্ডে বাজতে থাকা গিটার আর স্পিডব্রেকারে ঘষা ট্রাকের চাকার মতো রাগী গর্গরে কর্কশ কণ্ঠই যেন আলাদা ব্যঞ্জনা দিয়েছে ডিলানের গানকে। আর এখনও সেসব গান প্রভাবিত করে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে।