বৃহস্পতিবারে লিখে রাখা সুইসাইড নোটস
১
চলে যাওয়া সহজ। তুমি যেমন চলে যাচ্ছ ক্রমশ বহমান সময়ের বলি। কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাবে কে? (আমার থেকে)
নিজেকে খুঁজে দেখেছি। হারিয়েও দেখেছি অনেক। উৎসবের পায়ে মাথা কুটে পূজা করেছি বিষণ্নতার। হেসেছি যতটা, কান্নার বাষ্পে ভিজেছি ততটুকুই।
নিজের শরীরের সাথে ঘুমিয়ে দেখেছি, নিদ্রা এলে স্নিগ্ধ হয় মুখ। অথচ সরব হও তুমি, তোমার পালকসমূহ।
মানুষ ঘুমালে প্রজাপতি হয়ে যায়। লাল এবং নীল। আর কবিরা কেবল, ক্ষতবিক্ষত শুয়োপোকার সমাধি।
সমাজ, রাষ্ট্র আর বিদগ্ধ ব্যর্থতাগুলো একঘেঁয়ে খুব। আই লস্ট এপিটাইট ফ্রম ইভেন মাইসেলফ, ডিয়ার। আর তুমি অযথা চোখ রাঙাও আমাকে, বিষণ্নতারা?
নিজের থেকে একটু আলাদা থাকব বলে তোমাকে না বলেই ফিরে এসেছিলাম পথে। আজও কেবলই হাঁটছি অনির্বাণ। পিছনে অনাহুত আমি? আর চোখে ঝুলে আছে তোমার ম্রিয়মান ছায়াপথ আর ভবিষ্যৎসমূহ!
চলে যাওয়া সহজ। আমি যেমন চলে যাচ্ছি ক্রমশ সময়ের বহমান বলি। কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবে কে? (তোমার থেকে)
৫ জানুয়ারি, ২০২৪
এইট ডেইজ এ উইক, লাবণী পয়েন্ট, কক্সবাজার
২
শূন্যতা মূলত দুইজন মানুষের ভিতরকার বোঝাপড়া। যারা পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে শুনেছিল যে: শব্দকে সবসময়ই কি কথা বলতে হয়? আর যে অক্ষর আঙুল লিখে, তার উপযুক্ত কাগজ কে? তাকে খুঁজে আনো।
‘ইউক্রেন বোঝো মানবতা, অথচ ফিলিস্তিন বোঝো না!’
আসলে ভালোবাসার থেকেও কঠিনতর হচ্ছে, ভালোবাসতে না পারা। মানে, চাইছি, কিন্তু না।
সন্ধ্যাগুলো হাহাকার লাগে। ইস্পাতের মতো ক্লান্তিকর লাগে তোমার হাতে মরে থাকা আমার আঙুলেরা।
এই যে আমরা সবখানেই আছি, অথচ কোথাওই নেই। আর এগুলো নিয়ে কথা বললেই বলো যে আমি শুধু প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কবিতা লিখি। বিষয়টা অস্তিত্ব আর অনস্তিত্ব ডিয়ার সিস্টার। তুমি বুঝবে না কখনো।
যদিও রাত্রিগুলো লিওনার্ড কোহেনের জন্যই লেখা হয়েছিল, তোমরা পড়তে পারোনি কোনোদিন তাদের।
তাই একই সময়ে। একই আবর্তে। একটি অনন্তকাল, বন্দি কিছুক্ষণ। সবখানে থাকতে গিয়ে, কোথাও না।
অ্যামবুলেন্সের মতো নিঃস্ব আমাদের ক্যালেন্ডারেরা। সাইরেনের মতো নিঃশব্দ আর খাপছাড়া মুহূর্তগুলো।
মনের মধ্যে মাছি উড়ে সারাদিন, ক্লান্তিকর ড্রোন! মধুর লোভে পড়ে অন্ধকারে কেবল হাবুডুবু দীর্ঘশ্বাস।
ওরা ভুলে গেছে বেমালুম প্রিয়তমা। সূর্য কখনো শরীর গলে ফোটাতে পারিনি সময়ের বিরলতম সূর্যমুখী ফুল।
তাই একই সময়ে আর আবর্তে। বলে চলো কেবল: বিষণ্নতাই ধ্রুব। অনস্তিত্বই শাশ্বত। নির্বাসনই, চিরন্তন।
২৯ ডিসেম্বর, ২০২৩
এইট ডেইজ এ উইক, লাবণী পয়েন্ট, কক্সবাজার
৩
সন্ধ্যারা বেগুনি হলে, আমাদেরও কথা ছিল খুব। হারানোর কিছুক্ষণ আগে। বলেছিলে? বলা যায়?
আমার শরীরের কানাগলিতে এসে হাবুডুবু খাবে তোমার স্নিগ্ধ নালা নর্দমারা একদিন। তুমি অজস্র আঙুল খুলে জমে যাবে রক্ত নীল কঠোর জোছনারা।
তোমার কাছে ফেলে এসেছি পৃথিবির সর্বশেষ ঘড়ি। তাই দেরি হওয়ার ভয় পাই না আজকাল আমি আর।
আর বৃহস্পতিবার? পৃথিবীর সর্বশেষ স্থান, কাল ও পাত্ররা মিলেমিশে। তখনই একমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় তোমাকে, জানো?
এই যে তোমার সাথে হুট করে অটোতে ঘুরেফিরি রাত বিরাত, একটা সারা শহর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে কালো রাস্তায়। এলেমেলো চুলগুলো খাই মনে মনে। ভুলেভালে দুজন দুজনের হাত ধরে থাকি আমরা তখন। কথা শেষে, কথা বলে নীরবতা। দ্য থিংস আই ডু ফর নাথিং।
কাচের তরল ছুরিগুলো ভেঙে যাচ্ছে খুব বেশি। হৃদয়ের কঠিনতর উপকূলে গড়ে উঠছে, আরও ভগ্ন বন্দর। মেঘেরও মন আছে রোদের মতো, দুঃখ আছে কিছু। তোমরা যারা বৃষ্টিকে কান্না বলে গালি দাও অযথা, দিবে না আর আজ থেকে। কান্নাকে করা হল নিষিদ্ধ।
তোমার কাছে ফেলে এসেছিলাম সবটুকু শ্রবণ ও দৃশ্যের দায়। তাই দেরি হলেও হল না জানা আমার, গেল না শোনা, কি তুমি বললে কথা, বেগুনি সন্ধ্যায়। যেদিকে গেছি, যা কিছু করেছি, কেবল ভুল ছিল সব। ভুলেরও কি ভুল করে ইচ্ছে হয় মাঝেমাঝে, ঠিক হতে?
হারানোর কিছুক্ষণ আগে। বলেছিলে। বলা যায়। তাই দেরি হওয়ার ভয় পাই না আজকাল আমি আর।
৭ ডিসেম্বর, ২০২৩
এইট ডেইজ এ উইক, লাবণী পয়েন্ট, কক্সবাজার
৪
আমি সেই কর্পূর। যে মিলিয়ে যাওয়ার আগে চোখে চোখ রেখেছিল নিজের একান্ত শবদেহের সাথেই।
আর এছাড়া, নির্বাসনে যে যাব আমি, এমন একটাও জায়গা ছিল না অবশিষ্ট সেদিনের পর।
তোমার হৃদয় খুঁড়ে নেমে গেছে পৃথিবীর শান্ততম দীঘির জল ও সোপান। আমি সাঁতার ভুলে ক্রমশ ম্রিয়মান!
অথচ সেখানে ঠিক জমে আছে বিশ্বস্ত দুঃখের মতো তোমাদের মরে যাওয়া মুখ। যেতে চাই খুব, নেবে?
সেদিন যুদ্ধের বাজারে আমি শান্তির বেসাতি করব বলে আঙুলে উড়িয়েছিলাম তোমার সাদা শাড়ি। অথচ সেখানে কেবলই রক্তের দাগ। বোমারু বিমান থেকে নেমে আসছিল অক্লান্ত ঘুমের ওষুধ, সীমান্ত জুড়ে রকেটের ভিড়ে বিষণ্ন অলিভের গাছসমূহ, জীবন্ত জ্বলেছিল মানুষ ও মানুষের মন। আহ ফিলিস্তিন!
আমার কোনো দায় নেই কিছুতেই। সমাজ, রাষ্ট্র অথবা বিশ্ব রাজনীতির বাইরে আমি বহুদিন। তারপরও কেন আমাকেই বহন করতে হয়েছে যুদ্ধের ভার ও ক্লান্তি? সভ্যতার স্নিগ্ধ জলকামানের মুখে উপহাস ছুড়ে কেন ব্যর্থ হয় বারবার, বিদগ্ধ লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড?
আমার মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে এখনই। না হলে বন্ধ করে দেব তোমাদের টিয়ারশেল, জলকামানের জোগান। রাষ্ট্র হয়েছ বলে কি ভুলে গেছ হে!
আমারই ট্যাক্সের টাকায় কেনা বুটের লাথি, আমারই সস্তা শ্রমের সারপ্লাস থেকে আমাকেই ভর্তুকি দাও?
এইসব অহেতুক শহর ও শরীর ছেড়ে তোমারই দরজার কাছে গিয়ে শেষমেশ ভুলে গেছি পথ। শশব্দে বলেছি:
তোমার হৃদয় খুঁড়ে নেমে গেছে পৃথিবীর শান্ততম দীঘির জল ও সোপান। আমি সাঁতার ভুলে ক্রমশ ম্রিয়মান!
আর এছাড়া, নির্বাসনে যে যাব আমি, এমন একটাও জায়গা ছিল না অবশিষ্ট সেদিনের পর।
৪ নভেম্বর, ২০২৩
এইট ডেইজ এ উইক, লাবণী পয়েন্ট, কক্সবাজার
৫
একটা বিকট ঘোলা দুপুর জুড়ে পৃথিবী থমকে আছে আর আমি দূর্বার নিশ্চিন্ত ছুটে যাচ্ছি। আমার পায়ের নিচে পড়ে মুহূর্তে গলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে অলস ও বিভ্রান্ত যতসব স্থান, কাল, পাত্রের কনসোর্টিয়াম। অথচ তোমরা ভাবছ ঠিক উল্টোটা। সরলীকরণ!
জীবন যদি এতই সরল হত ডিয়ার সিস্টার, তাহলে তো আমরা একই সাথেই থাকতাম এখন, এতদিন পর।
অযথা পথ চলবার অনন্ত কাঠগড়া থেকে বলছি তবে: ধরে নাও এটা সত্য স্বীকারোক্তি, আত্মসমর্পণের পরে।
এই যে আমাদের আঙুলে অন্যায্য জমে আছে আত্মগ্লানি, এক চোখে বিমূঢ় অভিমান আর অন্যটাতে দাবানল, এই যে আমরা অক্লান্ত বেঁচে থাকবার দায় থেকে অহেতুক ভালো থাকার, ভালো রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছি স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, একেই বলে আত্মপ্রবঞ্চনা। করবে, চলো? কুয়াশাকে বিষণ্ন আর শিশিরকে কোমল বলে বিশ্বাস করে এসেছ যারা, তাদের জন্য এই কবিতা লিখলাম।
শীত মূলত একটা বেগুনি মাফলারে জড়ানো সূর্যের অন্ধকার গ্রীবা, যে ঘেমে গিয়ে তুমুল বর্ষণ হয়েছিল।
যে তোমাদের উদ্ধত হৃদয়ে ঝরে গিয়ে ভেবেছিল, বেঁচে গেলাম এবারের মত হয়তো-বা। এখানেই জীবন শেষ।
কিন্তু জীবন কি এত সহজেই শেষ হয় ডিয়ার সিস্টার? তুমি আমাদের সেই কবিতা, যাকে লেখা যায়নি, যাবে না কখনোই। যে কেবল নিরন্তর মোচড় দিয়ে থেকে যাবে, ক্লান্ত বর্ষণমুখর ও কিছুটা অস্থায়ী বুকের ভিতর। অথচ তোমরা ভাবছ ঠিক উল্টোটা। সরলীকরণ!
১৯ অক্টোবর, ২০২৩
এইট ডেইজ এ উইক, লাবণী পয়েন্ট, কক্সবাজার

নাইম আহমেদ
জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে লেখাপড়া করেছেন। এখন মানবিক সহায়তা কর্মী হিসেবে কক্সবাজারে কাজ করছেন।