কথাসাহিত্যগল্প

মানুষ খাওয়া ভালো না

মহিলার মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা সবাই জানত।

সবাই জানে তার মত খারাপ মানুষ আর দুনিয়ায় নাই। যে মানুষের মাংস খাইতে পারে, সেকি মানুষ হয়? তবু কেউ তাকে এড়ায়া চলতে পারে না। কেননা, মানুষের মাংস খাইলেও, মানুষগুলি কখনও মারা যাইত না। আর মানুষ মরলেও সেইটা বোঝা যাইতো না যে তার কারণেই মরছে। হয়তো অনুমান করে মানুষ, এই মহিলাই হয়তো মৃত্যুর পেছনের কারণ। তার হয়তো বদনাম করছিল কিংবা তার বাপের নামে সত্য কথা বলছিল, ফলে হয়তো কোনোভাবে মাইরা ফেলছে। কিন্তু সরাসরি প্রমাণ কেউ দিতে পারত না। যেহেতু মানুষ মরে না বা তার হাত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাইতো না, তাই তারা এইটাকে অতটাও সিরিয়াসলি নিত না। যেহেতু সে কারো মেয়ে, বোন, বউ, মা, শ্বাশুড়ি, জাউ, ননদ, কারো বা প্রতিবেশী—তাই তাকে এড়ায়া যাওয়া যায় না সহজে। তারা ব্যথা পায়, দূরে যায়, আবার কাছে আসে, কেন কীসের টানে কী সম্মোহনে আল্লাই ভালো জানে।

তাছাড়া এই এলাকার সবথেকে সম্মানি মানুষটার মেয়ে সে। তার বাপ ভাইয়ের গুষ্টি অনেক বড়, টাকা পয়সাও কম না। এই চরে তাদের বাড়িই সবার আগে হইছে। এই এলাকায় সবার আগে কল দিছিল তারা। সবার আগে টিভি কিনছে, সবার আগে সোলার কিনছে। বাজারের সবথেকে বড় দোকানটাও তার বাপের। তার বাপ এলাকায় পঁচিশ বছর ধরে মেম্বারি করছে।

মহিলার আদর আপ্যায়নের সুনাম আছে; যদিও সেইটা দেখানো, নাকি সত্যি; তা বোঝার মত বুদ্ধি সবার থাকে না; যাদের থাকে; তারা তার কাছে যায় না যায় না করেও কীভাবে কীভাবে যেন আবারও তার কাছে যায়, হয়তো বছর লেগে যায়, হয়তো দশক লেগে যায়, তবু তারা তার কাছে যায়; এবং আবারও তার নোংরা আক্রমণের শিকার হয়ে আবারও শত্রুতা করে বসে; এমনকি ছেলে হয়েও মায়ের দুন্নাম করে বেড়ায় যে তার মাও মানুষের মাংস খায়। এমন রাক্ষস মা যেন দুনিয়ায় আর কারো না হয়। তার ছেলেরা কখনও কখনও তার মুখের ওপরেই বলে ফেলে, আমি তোমাকে ঘেণ্না করি, তোমার পেটে জন্ম হইছে আমার, এর থেকে বড় লজ্জা আর নাই।

মাংস খাওয়ার জন্য সে সবসময় আপন মানুষদেরকেই বেছে নেয়। স্বামী, ছেলে, আর ছেলেদের বউ তার মাংসের প্রধান উৎস হলেও; প্রায় সময়, বাপ, মা, ভাই, বোন, ভাই-বউদের টার্গেট করে; প্রতিবেশিরা তো আছেই, এমনকি অপরিচিত লোকজনকেও টার্গেট করে ফেলে সে।

মাংস খাওয়ার কথা চালু থাকলেও সে আসলে মানুষের কলিজা আর মগজকেই প্রাধান্য দেয়; এবং এটাই তার প্রিয় খাবার। মাংস সে খায় না এমন না; মাংস খাওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে সফল হইতে পারে নাই। একবার সে তার সবথেকে খারাপ ছেলেটার ওপর রাগ করে বটি দিয়া কোপ মারছিল হাতে। কিন্তু তার স্বামী সেইখানেই ছিল বলে তাকে বাধা দিতে পারছিল। তার স্বামী তাকে এক থাপ্পড়ে অজ্ঞান করে ফেলছিল।

জীবনে কোনোদিন ভোটার আইডি কার্ড দেওয়ার জন্য টাকা লাগে নাই, তার বাপ ভাইদের আমলে আইসা টাকা লাগতেছে, অথচ আমরা ভোটই দিতে পারি না জন্মের পর থেইকা, স্মার্ট কার্ড দিয়াই বানি কী করমু! সেই মহিলা একজনকে টার্গেট করে ফেলছিল, যে তার বাপভাইকে চোর বাটপার আর ভোটচোরও বলছিল;  

একবার স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে বলে সবার কাছ থেকে ২৫০০ টাকা করে নেওয়া হইলো। কী করবে এত টাকা দিয়া? সাধারণ ভোটার আইডিকে স্মার্ট কার্ড করা হবে এবং একটা ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিবে, সেই ২৫০০ টাকা ওই একাউন্টে জমা থাকবে। কখনো চাইলে তুলতে পারবে এবং দুই কি আড়াই মাসের মধ্যে টাকা আবার জমা রাখতে হবে।
গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা কী জানি কী ভেবে স্মার্ট হওয়ার লোভে স্মার্ট কার্ড বিতরণের লাইনে গিয়া খাড়া হইলো, সেই গিজগিজ করা লাইনের ভেতর বউ-ঝিরা যখন নিজেদের গলার মালা, কানের দুল হারাইতেছিল, তখন মাংসখাওয়া সেই মহিলার বাপ ভাইদের গালিগালাজ করতেছিল সবাই—যে এইটা তাদেরই কাজ; কেননা, জীবনে কোনোদিন ভোটার আইডি কার্ড দেওয়ার জন্য টাকা লাগে নাই, তার বাপ ভাইদের আমলে আইসা টাকা লাগতেছে, অথচ আমরা ভোটই দিতে পারি না জন্মের পর থেইকা, স্মার্ট কার্ড দিয়াই বানি কী করমু! সেই মহিলা একজনকে টার্গেট করে ফেলছিল, যে তার বাপভাইকে চোর বাটপার আর ভোটচোরও বলছিল; সে গিয়া তার চুলের মুঠি ধরে একের পর এক চর থাপ্পড় দিতেছিল আর সেইখানেই না থাইমা মাংস খাওয়ার অভ্যাসটাও প্রায় প্রয়োগ করে ফেলছিল। মানুষজন না ঠেকাইলে হয়তো এইটাই মানুষখাওয়া এই মহিলার হাতে প্রথম খুনের ঘটনা হইতে পারত, যেইটার সাক্ষী প্রমাণ আছে।

কিন্তু সে খুনী না, হইলেও কেউ প্রমাণ নাই। এমনকি সে নিজে ভাবে, লোকেরা তাকে কেন খারাপ বলে, সে তা বুঝতে পারে না; কেননা, সে ঠিকমত নামাজ কালাম পড়ে, মানুষকে কোরান শিক্ষা দেয়, খালি আজানের সময়ই না, প্রায় সবসময় সে মাথায় কাপড় দিয়া রাখে, তাছাড়া কোনোদিন পর পুরুষ নিয়া তার কোনো দুন্নামও নাই, মানুষের সুখ দুঃখে পাশে থাকে, কারো বিটির বিয়া হয় না, বিয়া দিয়া দেয়, এর বাপের মজলিশ হয় না, চাল তুলে টাকা দিয়ে মজলিশ করায় শরিক হয়; তাইলে মানুষ তাকে খারাপ বলবে কেন, সেইটা সে বোঝে না।

আরেকবার সে তার মেয়ের বিয়াতে সবথেকে ভালো বেটার বউটার দিকে বটি ছুইড়া মারছিল। কিন্তু বটিটা তার গায়ে লাগে নাই আর এক ইঞ্চির জন্য।
এগুলো তার মাংস খাওয়ার প্রকাশ্য কিন্তু ব্যর্থ কিছু চেষ্টা ছিল। তবে কলিজা আর মগজ কেউ তার হাত থেকে লুকায়া রাখতে পারে না।

সে প্রথম কোনো একজনকে সিলেক্ট করবে, তারপর তাকে নানান বাক্যবাণে কাবু করে ফেলবে; এরপর সে তার কানের কাছে গিয়া জিহ্বাটা সমানে নড়াইতে থাকে; এভাবে হঠাৎ করে তার জিহ্বাটা লম্বা হইতে থাকে আর মানুষের মগজটা আস্তে আস্তে গলতে গলতে চিকন হয়া কান দিয়া প্যারাসুটের মত বাইরে বের হইতে থাকে আর বড় হইতে থাকে আর সে নিজের নোংরা জিহ্বাটা দিয়া সেই মগজে গরু পোষনানোর মত বারবার আঘাত করে করে রস বের করে খায়। কলিজা খাওয়ার জন্য তার সেই বিশাল জিহ্বা ফস করে মানুষের মুখের ভেতর দিয়া কলিজায় গিয়া ঠেকে, চাইটা চুইটা তার রস খায় আবার বের করে ফেলে। তার এই উদ্দাম খুদা থাইমা গেলে জিহ্বা গুটায়া নেয়, আর মগজটাও আস্তে আস্তে ভেতরে সান্ধাইতে থাকে। মানুষজন হা করে তাকায়া তাকায়া এই দৃশ্য দেখে আর মজা পায়। কেউ কেউ তাকে আরও উৎসাহ দেয়, এমনকি যাদের নিজেদেরও কখনও নিজের মগজ আর কলিজা খাইতে দিতে হইছিল এই মহিলাকে, তারাও তাকে উসকায়া দেয়, অন্য জনের মগজ খাওয়ার দৃশ্য দেখে তারা তুমুল আনন্দে হাত তালি দিয়া ওঠে। নিষ্ঠুরের মত বলে, এই মানুষটো, তোমাক এত আদর যত্ন করছে, তার তো অধিকার আছেই তোমাক খাওয়ার। তাছাড়া তুমি তো মরোও নাই।

তার মাংস খাওয়ার আরেকটা তরিকা আছে, যেইটা অতটা ইন্টারেস্টিংও না, সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর এই কর্ম শেষ করে ফেলে। যার মাংস খাবে বলে ঠিক করে, তাকে ঘিরে সারাদিন সে মত্ত থাকে, কখনও সেইটা দূরত্ব বজায় রাইখা, কখনও সরাসরি। যেহেতু বাড়িটা রাস্তার ধারে, সারাদিনই কেউ না কেউ বাড়িতে আসে, ফলে যেই আসবে, তার কাছেই নির্ধারিত ব্যক্তির মাংস খাওয়ার নানান গল্প করতে থাকে। শুধু গল্পই না, গল্প যে সত্যি তা প্রমাণ করার জন্য তাদের দেখাইতে হয় যে কীভাবে সে মাংস খায়। টার্গেট দশ হাত দূরে বসে থাকলেও তার জিহ্বা গিরগিটির জিহ্বার মত ঠিকই পৌঁছে যায় মাংস খাইতে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে মানুষ কখনও কখনও টেরই পায় না যে মাংস খাওয়া হচ্ছে। কয়েকবার যদিও দুর্ঘটনা ঘটছিল দূরের টার্গেটের মাংস খাইতে, আঘাত পাইছিল, পুড়ে গেছিল, বাড়িও খাইছিল; অনেক সময় মাটি, ময়লা, গু গোবরও চলে যায় মুখে, তবু সে মানুষের মাংস খাওয়ার লোভ সামলাইতে পারে না। যেইটা কোনো কোনো দিন একশবারও করতে হয় তাকে। ফলে এইটার আকর্ষণ নাই হয়া গেছে।

অন্য কেউ হলে এই সংসার কবে দেউলিয়া হয়ে যাইত। আমার একটাই দোষ মানুষের উন্নতি করি আমি। আমি কার মেয়ে জানেন তো আপনারা? তাহলে আর কথা বলেন কেন? মানুষের মাংস খাওয়া কি এতই খারাপ? কেউ কি মরছে কোনোদিন? আমি বাইচা থাকি, তা আপনারা চান না। আমার শত্রুরা আগেও আমাক বহুবার মারার চেষ্টা করছিল, পারে নাই।

সবার মাংস খাইলেও, সে কখনও তার মেয়ের মাংস খাইত না; বরং মেয়ের সুখ নিশ্চিত করতে যত রকমের চেষ্টা—সবই করে; তবে ওই মাংস খাওয়ার স্বভাবটা সে কখনও বাদ দিতে পারে না। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কারো ক্ষতি না করলেও তার স্বভাবের সবটুকু আঁচই তারা পায়। এবং তারা জানে তার যত কীর্তিকাহিনী। এইসব জানার পেছনের কারণটা অবশ্য সেই। কেননা, সে যেসব বেটার বউদের মাংস খাইছে, তারা একসময় দূরে চলে গেছে, এবং পরবর্তীতে তার এই কাজের প্রতিশোধ হিসাবে তার মেয়ের সংসারে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছে; যেহেতু তারা অল্পবুদ্ধির অধিকারী, আর তারা নিজেরাও কিঞ্চিত মাংস খাওয়ার স্বভাবে দোষী, ফলে তাদের মিথ্যাচার গ্রহণযোগ্যতা পায় নাই। মানুষখাওয়া সেই মহিলা কেন নিজের মেয়েকে এত ভালোবাসে তার কারণ: মেয়েটা আল্লার কাছ থেকে বহু চেয়ে চিন্তে পাইছে। আর সবথেকে বড় কথা—মেয়েটা তার ভক্ত—ছোটবেলায় মেয়েটা তার অঙ্গভঙ্গি আর কথা বলার স্টাইল পুরাপুরি রপ্ত করে ফেলছিল।

তার এই মানুষের মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়া মাঝেমাঝে যে সে দুঃখিত হয় না, তা না; প্রায়ই সে বিলাপ করতে বসে তার পেয়ারের মানুষদের ডাইকা নিয়া; সে বলে, কী আর করার, বিকল্প দেখান। আমি তো আর নাঙ করি নাই; মানুষও মারি নাই। মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করছি। আমার ছেলে মেয়ে বলে তারা এত উন্নয়ন করতে পারছে। অন্য কেউ হলে এই সংসার কবে দেউলিয়া হয়ে যাইত। আমার একটাই দোষ মানুষের উন্নতি করি আমি। আমি কার মেয়ে জানেন তো আপনারা? তাহলে আর কথা বলেন কেন? মানুষের মাংস খাওয়া কি এতই খারাপ? কেউ কি মরছে কোনোদিন? আমি বাইচা থাকি, তা আপনারা চান না। আমার শত্রুরা আগেও আমাক বহুবার মারার চেষ্টা করছিল, পারে নাই। যারা বলে আমার স্বামীর মৃত্যুর পেছনেও আমার দায় আছে, তারা জেনে রাখুক, সবাইকে একদিন মরতে হবে; সেইদিন আল্লা বিচার করবে তাদের। আল্লার বিচার আল্লাই করবে। একদিন আমাকেও এত কষ্টের ভেতর দিয়ে যাইতে হইছিল; আমাকে কাফনের কাপড় পরানো হইছিল, মুরদা রাখার খাটে শোয়ানো হইছিল; তখন তোমরা কই ছিলা?

আর যখনই সে প্রশ্নের সাথে আর পাইরা ওঠে না, তখনই তাদের ছোট করতে আর খোটা দিতে বলে ওঠে, এই সংসারটা আমার বাপের গইড়া দেওয়া। আমার বাপ বিয়ার সময় যদি গরু দানে না দিত, যদি দুইটা কানের মারকি না দিত, তোদের কোন বাপের ক্ষমতা ছিল যে এতগুলি জমি করবে, এত বড় সংসার বানাবে? আমার বাপের জমি আর মারকি বেইচা ৫ বিঘা জমি করছিল। সেই জমি আজ তোরা আবাদ করে খাস, আর আমিই আজ খারাপ হয়ে গেলাম?

লোকেরা বরাবরের মতই দ্বিধায় পড়ে যায় যে তার দুঃখে সমব্যথী হবে নাকি মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়া তাকে ঘৃণা করবে।

একদিন তার এক ছেলে, আর সহ্য করতে না পাইরা, এমনকি কিছুটা কৌতুহল থেইকাও, মোবাইল বের করে তার মায়ের এই কাণ্ড ভিডিও করে ফেলে। সে সবসময় বিশ্বাস করত, এই জঘন্য মহিলা যে কতটা জঘন্য তা দুনিয়াবাসীকে সে জানাবে, এবং সে এই কাজ করবেই। একদিন রাতে ভিডিওটা ফেসবুকে আপলোড করে দেয়। প্রথম ১/২ ঘণ্টায় তেমন কোনো ভিউ হয় নাই। ২/৩ টা লাইক পড়ছে। ১০/১১ জন দেখছে। মন খারাপ করে ঘুমায়া পড়ে। ঘুম থেকে উঠে দেখে তার মাও ভাইরাল হয়ে গেছে। ১০ মিলিয়ন মানুষ দেখছে সেই ভিডিও; প্রায় ৭ লাখ মানুষ শেয়ার করছে। লাইক কমেন্টের বন্যা হয়ে গেছে। সপ্তাহ না যাইতেই এই ভিডিও ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে উঠে গেল। প্রায় ১৫ কোটি মানুষ এই ভিডিও দেখল।

মানুষখাওয়া মহিলার বাপমাও ভাই বোন সবার ইন্টারভিউ নিতে থাকল মিডিয়া। একেকজন একেক কারণ বলতে থাকল, কীভাবে তার এই রূপটা বের হল।

কেউ বলল, তার কখনও সর্দি লাগে না। এই কারণেই বোধহয় জিহ্বা বড় হয়ে গেছে। কেউ বলল, ছেলে মেয়েরা কথা শোনে না, এই জন্য চিল্লাইতে চিল্লাইতে এই অবস্থা হইছে। কেউ বলল মানুষকে মনে কষ্ট দিছে খুব, যার তার মুখ ভ্যাঙচাইছে, নাম পাল্টাইছে, তাদের অভিশাপেই হয়তো এই অবস্থা। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করল, বেচারি বোধহয় জীবনে অনেক দুঃখ পাইছে।

গোসল দিয়া কাফনের কাপড় পরায়া যে কবরে শোয়াইতে যামু, ওমনি সে জাগা পাইছে। যে তাক ধইরা কবরে শোয়াইতে ধরছিল, তাক ধইরা সে খাওয়া শুরু করে দিছিল। মানুষ ভয়ে ছিঁইড়া ছিট্টা দৌড় দিছিল। আমি যেহেতু বাপ, এইরকম আজব একটা ঘটনা দেইখা পা নড়াইতে পারতেছিলাম না। ডাক দিয়া কইলাম, মানুষ খাইস না মা, মানুষ খাওয়া ভালো না। তক বাড়িত যায়া মাংস আইন্ধ্যা দিমু নি।

তবে তার বাপ মাও যেই গল্প বলল, তাই বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করল। তারা বলল, খুব ছোটবেলায় একদিন খুব রাগ করে কান্দিতে কান্দিতে এমন এক চিক্কুর দিছে যে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। আমরা মনে করছিলাম যে সে মরে গেছে। গোসল দিয়া কাফনের কাপড় পরায়া যে কবরে শোয়াইতে যামু, ওমনি সে জাগা পাইছে। যে তাক ধইরা কবরে শোয়াইতে ধরছিল, তাক ধইরা সে খাওয়া শুরু করে দিছিল। মানুষ ভয়ে ছিঁইড়া ছিট্টা দৌড় দিছিল। আমি যেহেতু বাপ, এইরকম আজব একটা ঘটনা দেইখা পা নড়াইতে পারতেছিলাম না। ডাক দিয়া কইলাম, মানুষ খাইস না মা, মানুষ খাওয়া ভালো না। তক বাড়িত যায়া মাংস আইন্ধ্যা দিমু নি। আস্তে আস্তে মানুষজন আসলো। আইসা দেখে যে কিছুই হয় নাই। সে কবর থেকে উঠে ভালো মানুষের মতই চলাফেরা করতেছিল। এভাবেই এক সময় বিয়াও হয়া যায়। তারপর তো এখন দেখতেছেনই।

দুনিয়ার মানুষ এইটা নিয়াই চর্চা করতে থাকলো দুই তিন দিন। বহু কনটেন্ট ক্রিয়েটর, টিকটাকার আইসা মানুষখাওয়া এই মহিলার সাথে সেলফি তুলল, কেউ কেউ নিজে সাইধা তার মগজ আর কলিজা তাকে খাইতে দিল। দীর্ঘ তিন মাস মানুষ এই সার্কাস উপভোগ করল। ব্যাপারটা যতটা জঘন্য ছিল, সবাই মিইলা তার থেকে আরও বেশি জঘন্য বানায়া ফেলল।

দেশ বিদেশ থেকে বহু সংস্থা বহু প্রতিষ্ঠান মানুষখাওয়া মহিলার একটা ব্যবস্থা করতে চাইল। তার চিকিৎসার জন্য ফান্ড গঠন হইতে থাকল। তাকে ঠিক করার নানান পদ্ধতি নিয়ে বৈঠক চলল একের পর এক। তার কোনো ক্ষতি হবে না এই আশ্বাস দেওয়া হলো। কিন্তু মহিলা আরও হিংস্র হয়ে উঠতে থাকল। বাইরের চাপের মুখে কিছুটা নমনীয় দেখা যাইতো, যেই তারা চলে যাইতো আবারও হুংকার ছুঁড়ে দিত। মানুষ ধন্দে পড়ে গেল। শুধু সেই না, আরও অনেকেই জানে সে যা করছে তা দুনিয়ার বাইর। তার শেষ শক্তি দিয়ে অর্জিত সবকিছু আঁকড়ে ধরে থাকল।

তারপর পৃথিবীতে আবারও আগের মতই সূর্য উঠতে থাকল, সারাদিন আকাশে ঝুলে থাইকা সূর্য ডুবতে লাগল, নির্জন এক গ্রামে মানুষের মাংস খাওয়ার গল্প আগের মতই চলতে থাকল, আর তার আত্মীয় স্বজনরা হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করতে থাকল, এই গল্পের যেন দ্রুত সমাপ্তি হয়, এই মহিলার মরণ ছাড়া তাদের বাঁচন নাই, তারা খুব ক্লান্ত, তারা আর সহ্য করতে পারতেছে না, বলতেও পারতেছে না, যেকোনো মূল্যে এই মহিলার হাত থেকে মানুষ বাঁচতে চায়, মানুষ মুক্তি চায়…

[২রা জুলাই, ২০২৩]

লেখাটি শেয়ার করুন :

হুসাইন হানিফ

হুসাইন হানিফ জন্ম: জানুয়ারি, ১৯৯৯। চর ঘাগুয়া, সারিয়াকান্দি, বগুড়া। প্রকাশিত বই: বহিষ্কার (গল্পগ্রন্থ, ২০২৩)। পেশা: ফ্রিল্যান্স বুক ডিজাইনার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!