মিজোরামের তাজমহল : স্মৃতির অলংকারে সাজানো
কথাটা প্রথমে শুনেছিলাম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বহুখ্যাত ‘মোনালিসা’ চিত্রটি নিয়ে, সেটি এরকম: ‘পৃথিবীর মানুষদের দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে-এক পক্ষে থাকবেন যাঁরা সামনাসামনি ছবিটি দেখেছেন, আরেকপক্ষ যারা সরাসরি দেখেননি।’ ২০০০ সালে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভারত সফরে এসে এই কথাটিই বলেছিলেন তাজমহল প্রসঙ্গে। তা আমি এখনও দুটোতেই আছি দ্বিতীয় দলে। তবে এর মাঝে সচক্ষে দেখে নিয়েছি অন্য এক তাজমহলকে, যেটি মিনি বা ছোট তাজ হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। এটির অবস্থিতি দিল্লি-আগ্রা থেকে বহুদূরে ভারতেরই দক্ষিণ-পূর্ব কোণের রাজ্য মিজোরামে। সে যেন এক বনফুল-খুব বেশি মানুষ দেখেনি তাকে, ফুটে আছে বনমধ্যে, বসরাই গোলাপের মতো নাম-ডাক নেই তার।
মিজোরামে গিয়েছিলাম ২০২২ সালের শেষাশেষি-শীতকালীন ছুটিতে। করোনার কারণে বিগত দুবছর তেমন ঘোরাঘুরি হয়নি। সেসময় কোভিডের কোপ কিছু কমে যাওয়ায় একটু বেরুনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কর্মস্থল নোয়াখালী হতে ভারতবর্ষে প্রবেশের জন্যে নিকটতম সীমান্ত পারাপার আখাউড়া-আগরতলাকেই বেছে নিলাম। আমার দুই ছেলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির শুরু ও শেষ এমন যে, তাদের চাপে ভ্রমণসূচি স্যান্ডউইচ হয়ে গেল। ভাবলাম তবে ত্রিপুরা তো যাই, সেখান থেকে সেভেন-সিস্টার রাজ্যগুলোর কোনো একটি ঘুরে আসা যাবে। ত্রিপুরার তিনদিকে বাংলাদেশ, পূর্বদিকে আসাম ও মিজোরাম। আসাম কিছুটা দেখা আছে আমদের। তাই মনিপুর-নাগাল্যান্ড-অরুণাচল ইত্যাদির কথা ভাবছিলাম। তবে ইন্টারনেট ঘেঁটে শেষতক মিজোরামই ঠিক হল। কী আছে এই রাজ্যে? সমুদ্র কিংবা মরুভূমি নেই; বরফের বালাই নেই ঘোর শীতেও। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এই রাজ্যে দর্শনীয় প্রাচীন বা বিশাল তো দূরের কথা, ছোটখাটো মন্দির-মসজিদও খুঁজে পাওয়া ভার। রাজনৈতিক ইতিহাসের মঞ্চেও রাজ্যের তেমন কোনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল না কোনোকালেই, তাই নেই কোনো দর্শনীয় বা বিশাল দালান-দরবার। তবু পাহাড়-বনভূমির এই রাজ্যে গেলাম, তার অন্যতম কারণ ওয়েবসাইটে হঠাৎই চোখে পড়লো এক তাজমহলের কথা।
তবে মিজোরামে যাওয়ার পর ওই তাজমহলে যাওয়ার আর সময় হয়ে উঠছিল না। কারণ, আমরা যে কয় রাত থাকব, তা শুধু রাজধানী আইজলেই। কাজেই দূরের দ্রষ্টব্যগুলো আগে দেখে নিতে হবে; ‘তাজমহল’টি নাকি কাছেই, কাজেই সে পরে হবে। কোনোদিন যাচ্ছি মুইফাং পাহাড়ের চূড়ায়, কোনোদিন যাই ফালকৌনে মিজোদের গ্রাম দেখতে। ফিরে এসে সুন্দর-পরিচ্ছন্ন আইজল শহরের রাস্তায় ঘুরি, কিংবা দেখে আসি দৃষ্টিনন্দন সলোমন টেম্পল। আসলে আর যা ঘটছিল তা হচ্ছে, এই ছোটতাজের নাম-সাকিন নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। একেকজন সেখানে যাওয়ার একেরকম দূরত্ব ও মাধ্যমের কথা বলছিল। বিদেশিদের বিভ্রান্ত করার দুষ্টবুদ্ধি থেকে যে এমনটি করছিল, তা কিন্তু নয়-যেমনটি আমরা অনেকেই করে থাকি আর কী। বস্তুত, মিজো জাতি সহজ-সরল, সদা সহাস্য এবং আন্তরিকভাবেই সাহায্যপরায়ণ। সেকারণে ভাষাও সমস্যা করছিল না। ভারতের এই এক রাজ্য যেখানে হিন্দি খুব কমজনই বোঝে। ইংরেজি জানে বেশির ভাগ মানুষ-শিক্ষার হারে রাজ্যটি বেশ এগিয়ে-সম্ভবত দ্বিতীয়। সড়কে-শপিং মলে মুম্বাই চলচ্চিত্রের সেলিব্রেটিদের ছবি চোখে পড়ে না। আররে, বিজেপি-কংগ্রেসের নেতানেত্রীর ছবিও কোথাও দেখিনি! হিন্দি গানও শুনিনি। সারাবছর উৎসবে মেতে থাকা এই রাজ্যে এই ক্রিসমাসের কালেও হিন্দি গান বাজছে না কোথাও-রাস্তার উপর কনসার্টে কিংবা ক্লাব থেকে ভেসে আসে ইংরেজি বা মিজো ভাষার গান। তবে একটু নিম্নস্তরে-যেমন হোটেল বয় বা ম্যানেজার (মানে আমরা যে হোটেলে ছিলাম-জারকার্ট এলাকার হোটেল চাহলনাতে) কিংবা ড্রাইভাররা তো ‘ইয়েস-নো-ভেরিগুডে’র চাইতে খুব বেশি ইংরেজি জানে না। তাইতে তাজমহল চিনতে বেশ ঝক্কি হচ্ছিল। মানে আমরা তো সেই নেটদুনিয়া থেকে দেখে ‘মিনি তাজ’, ‘ছোটা তাজ’ বলে চলেছি, ওরা তখন আগ্রার তাজমহলের কথা ভেবে বড়ো সমস্যায় পড়েছে-কীভাবে আমাদের সে দূরদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেবে! পর্যটক ও শিক্ষিতজন ছাড়া মিনি তাজ বা তাজমহল বলে সবাই হয়তো এখনও একে জানে না। আর হ্যাঁ, এটির আসল নাম ‘কে ভি প্যারাডাইস’।
শোককাতর স্বামী ঠিক করলেন, প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিকে কেন্দ্র করে তিনি সৌধ বানাবেন। তা এমনই দৃষ্টিনন্দন হবে যে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ সেটি দেখতে আসবে। রোসাংলুই ভার্ট বিশ্ব দেখতে যেতে পারেননি, এখন সারা বিশ্ব থেকে মানুষ যেন তাকে দেখতে আসে।
একজন মিজো ক্হাওলরিং ছাওনথুয়ামার (Khawlhring Chhawnthuama) K এবং তাঁর স্ত্রী রোসাংপুই ভার্ট (Rosangpuii Varte)-এর V-এই দুই আদ্যক্ষর দিয়ে নাম রাখা হয়েছে কে ভি প্যারাডাইস। এ স্বর্গ নয়, একটি সমাধি। সেখানে শুয়ে আছেন রোসাংলুই ভার্ট-যিনি ছিলেন জনপ্রিয় স্কুল শিক্ষক, যাঁর শখ ছিল বেড়ানো। সেজন্যে স্বামী-স্ত্রী মিলে আলাদা করে টাকা-পয়সা জমাচ্ছিলেন। ৩১ লাখ রুপি পর্যন্ত সঞ্চিতও হয়েছিল-কারণ স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল বহির্দেশ দেখার। কিন্তু ২০০১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁদের সব শখ-স্বপ্নের শেষ হয়। এদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় ভার্ট মৃত্যুকে বরণ করেন মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে। স্বামী ছাওনথুয়ামা কী করবেন তখন? একমাত্র সন্তান পুত্র ভানলাল্রুয়াইয়ার বয়স মাত্র এগারো। সেই জমানো টাকায়ই বা কী করবেন? নাহ্, তিনি আর বিশ্বভ্রমণে বেরুবেন না। কিন্তু পরিকল্পনা যা করলেন, তাতে সে টাকাও যথেষ্ট নয়। শোককাতর স্বামী ঠিক করলেন, প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিকে কেন্দ্র করে তিনি সৌধ বানাবেন। তা এমনই দৃষ্টিনন্দন হবে যে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ সেটি দেখতে আসবে। রোসাংলুই ভার্ট বিশ্ব দেখতে যেতে পারেননি, এখন সারা বিশ্ব থেকে মানুষ যেন তাকে দেখতে আসে।
ভ্রমণ খাতের সেই জমানো টাকায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মিটেছিল। মেঝের গ্রানাইট ও মার্বেল পাথর নেওয়া হয়েছিল রাজস্থান থেকে। ১২ মিলিমিটার পুরু নকশা কাঁচ সংগ্রহ করা হয়েছিল চেন্নাই থেকে আর দর্শনীয় ঝর্না আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। শুধু আলোকায়নের জন্যেই ৬ লক্ষ রুপি ব্যয়িত হয়েছিল। এভাবে লাখ নয়, খরচের হিসেব গিয়ে ঠেকেছিল কোটি রুপির ঘরে। ছয় বছর ধরে দোতলা এই স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ চলেছিল। এটি নির্মাণের পর ‘দি টেলিগ্রাফ; পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে ক্হাওলরিং বলেছিলেন: “I think I have done everything for her. In life I gave her my heart, my love. After her life ended, I still wanted to give her the best.” আইজল শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৭.৭ কিলোমিটার উত্তরে দুর্তলাং (Durtlang) পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই ব্যক্তিনির্মিত দর্শনীয় স্থাপনাটি। মিজোরাম ছাড়ার আগের দিন সকালে আমরা সেটি দেখতেই রওনা হলাম।
দিনটি ছিল ২৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ ক্রিসমাসের আগের দিন। মিজো ড্রাইভার চ্যাং বার বার বলছিল পথে খুব জ্যাম হবে। সেকথা অবশ্য মিজোরামের লেংপুই বিমানবন্দরে নামার পর থেকে সব ড্রাইভারের মুখেই শুনে আসছি। জনসংখ্যার শতকরা ৮৭ ভাগ খ্রিষ্টান, তাদের সবচেয়ে বড়ো অনুষ্ঠান। তাই আমি সে সম্ভাবনাকে স্বাভাবিক ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এই কয়দিন জ্যাম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার পর যা দেখিয়েছে, তাতে মনে হল, এদের সবকটাকে যদি বাংলাদেশের যেকোনো জেলা শহরে নিয়ে যেতে পারতাম! তবেই বুঝত, জ্যাম কত প্রকার ও কী কী। পার্বত্য শহরের দুই লেনের রাস্তাগুলোতে শপিঙের সময়ে তো মাঝে-মধ্যে গাড়িগুলোকে দু-দেড় মিনিটের জন্য আটকে পড়া লাগতেই পারে। দ্রুতই আবার চলতে শুরু করছে। করবেই তো, পাশের বিপরীতমুখী লেন খালি থাকলেও কেউ তাতে ঢুকে পড়ছে না, তাই জটও বাঁধছে না। অকারণে হর্ন দেয় না এরা, আর হর্ন দেওয়ার কারণও সহজে ঘটে না। ওরকম দাঁড়িয়ে থাকার সময় একবার অসাবধানতবশত চ্যাঙের হাত স্টিয়ারিঙের মাঝে পড়েছিল হর্ন বাজানোর জায়গায়। আমি সামনের সিটেই ছিলাম। জানালা দিয়ে পথিপার্শ্বের দোকানপাট দেখছিলাম, বিশেষ করে তাকিয়েছিলাম ওই ফলের দোকানটির দিকে, যেখানে কোনো বিক্রেতা নেই। প্রত্যেক সামগ্রীর পাশেই দাম লেখা আছে, ক্রেতারা তাই দেখে বাক্সে টাকা রেখে ফল নিয়ে যাচ্ছে। মিজোরাম জুড়েই এমন দোকান চোখে পড়ে। আমাদের দেশ হলে… সম্ভবত এসব ভাবতে গিয়েই আমার কানে পোঁ-পুঁ কিছুই আসেনি। তবে একটু হলেও হর্ন বেজেছিল নিশ্চয়, না হলে চ্যাং ওভাবে আগে-পিছের ড্রাইভার-বাইকারদের দিকে নমস্কার ও মাফ চাওয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে হাতজোড় করে ‘সরি, সরি’ বলবে কেন? তারাও যে ক্ষেপে কিছু একটা বলেছে এমন নয়। শুধু ভ্রু-কোঁচকানো একটু-রাগ নয়, কিছুটা বিস্ময় সেসব চাহনিতে।
দ্রুতই ব্যস্ত রাস্তা শেষ হয়ে গেল। একসময় মাটির রাস্তা পড়লো একেবারে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে। ভয় মনের মধ্যে জেঁকে না বসতেই সে রাস্তাও শেষ হল। গাছপালার মধ্যে সিঁড়ির রেলিঙের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভার সেদিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করে দুটো ইংরেজি বর্ণের মিজো উচ্চারণ করলো-কে ভি। প্যারাডাইসই হবে, নইলে পথ কেন ঊর্ধ্বপানে? সমাধি তো নিচের দিকে। গাছপালার মধ্য দিয়ে সুসজ্জিত সিঁড়ি চলে গেছে আকাশ পানে। আর হ্যাঁ, এখানকার আকাশও খুব বেশি নীল। আসমানি রং বলতে আমরা যে হালকা নীলকে বুঝি সেরকম নয়। কোনো বিচ্ছেদ-বেদনার কারণেই কি এখানে আকাশ এতোটা গাঢ় নীল? হতে পারে, এক মৃত্যুর কাহিনি মনের মধ্যে নিয়ে এসেছি বলেই এমনটা লাগল। আবার রৌদ্রালোক ছিল বলে আকাশ ছেয়ে আনন্দ-আবেশও ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার আগেই সিঁড়ি শেষ হয়ে গেল।
ইনি নিশ্চয়ই গৃহকত্রী-স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে। অচিরেই ভুল ভাঙলো। সেটি আসলে রোসাংলুই ভার্টের প্রমাণ সাইজের রঙিন ছবি। বস্তুত, ঘরটির মধ্যে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে কেউ নেই। বসবার আসন নেই কোনো। সাদা দেয়ালের সে ঘর অনেকটাই ফাঁকা-মাঝখানে কালো মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত কবরখানি।
দেখা দিল এক উঁচু দোতলা বাড়ি-শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ। সামনে বেশ বড় লন কংক্রিটে মোড়া। মাঝে-মাঝে অবশ্য ফুলগাছ লাগানো হয়েছে মাটি খালি রেখে। পুরো প্রাঙ্গণ রেলিং-ঘেরা। সেটি শুধু সৌন্দর্যের জন্যেই নয়, সুরক্ষার জন্যেও বটে। কারণ সম্পূর্ণটাই নাতিউচ্চ এক টিলার উপর। এখান থেকে আইজল শহরটি দেখা যায় মনোজ্ঞ রূপে। অপর দিকে পাহাড়ের ওপারে পাহাড়। তারও ওপারে পাহাড়। এখানে এলে যে কেউ প্রথমে ছুটে যাবে ওই রেলিঙের ধারে। প্রকৃতিকে অপূর্ব মুগ্ধতায় দেখবে। ছবি তুলবে। আমরাও তেমনটি করছিলাম। কিন্তু নির্জন আর সুউচ্চ এই স্থানটিতে বাতাস কেমন যেন রহস্যময়! মনে হল, কী যেন বলতে চায়। হয়তো, স্মারণ করিয়ে দিচ্ছিল কেন হেথা আগমন। তাই তো, কোথায় সেই সমাধি? সেটি দেখার জন্যে চারজনের টিকেট কাটতে হলো-জনপ্রতি ত্রিশ রুপি। রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত প্রদর্শনের সময়। টিকেট-বিক্রেতা ইশারায় প্রাসাদের সম্মুখের বড় দরজা দেখিয়ে দিলেন। সেখানে জুতা খুলে রাখার নির্দেশনা। হতেই পারে; মনে হচ্ছিল বড় একটা বাড়ির ড্রইংরুমে ঢুকব, জুতো খোলাই তো দস্তুর। তাজমহলের ছবি শৈশবে দেখে যেমন মসজিদ ভাবতাম, এ-ও তেমনই এক ধনীগৃহই বোধ হচ্ছে-শীর্ষচূড়ার ক্রসচিহ্নটি সত্ত্বেও। আর হ্যাঁ, ঢুকতেই সুসজ্জিতা হাসিমাখা মুখের রমণীকে দেখছি যে! ইনি নিশ্চয়ই গৃহকত্রী-স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে। অচিরেই ভুল ভাঙলো। সেটি আসলে রোসাংলুই ভার্টের প্রমাণ সাইজের রঙিন ছবি। বস্তুত, ঘরটির মধ্যে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে কেউ নেই। বসবার আসন নেই কোনো। সাদা দেয়ালের সে ঘর অনেকটাই ফাঁকা-মাঝখানে কালো মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত কবরখানি। মাথার দিকে ভার্টের হাস্যোজ্জ্বল আবক্ষ ছবি। ছবির নিচে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখটি লেখা আছে। নামের নিচেই ‘Kum’ বা বয়স লেখা হয়েছে 44। ওখানে আরও আছে বেশ কিছু ফুলের স্তবক। রঙিন ক্রসচিহ্ন। সমাধিশায়িতার পায়ের দিকে আমরা দাঁড়িয়েছি নিঃশব্দে। আর মাথার দিকের দেয়ালেই প্রমাণসাইজের সেই ছবিটি। এতো প্রাণবন্ত যে ভার্টের মৃত্যু তারিখটি অবান্তর-উপেক্ষণীয় মনে হল। ওই চুয়াল্লিশ বয়সটিই চিরসত্য মনে হল। কিন্তু দেয়ালের আরেক দিকে এক কিশোরের সাদাকালো আবক্ষ ছবি। নাম লেখা ভানলাল্রুয়াইয়া। তার মানে কে ভি দম্পতির একমাত্র সন্তান। কিন্তু তার জীবনরেখারও অন্ত দেখছি! ২০১০ সালে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর কারণটি জানা গেল না। তবে উপরতলায় শিলং-এর আসাম রাইফেলস পাবলিক স্কুলের ছাত্রদের একটি বাঁধানো শোকবার্তা আছে। শোকবার্তা কি? সেটিতে তো লেখা হয়েছে যে, তারা মনে করে প্রিয় সহপাঠী এখনও তাদের মাঝেই আছে।
ডুপ্লেক্স ধরনের এই প্রাসাদটির উপরতলায় উঠবার সিঁড়ির দেয়ালেই ক্হাওলরিং-ভার্টের বিবাহদিনের ছবি টাঙানো। দোতলায় মরণ নয়, সপ্রাণতার আবহ। বড় একটি ওয়ার্ডরোবে ভার্টের ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, কয়েক জোড়া জুতো-এমনভাবে সাজানো যে, মনে হবে এগুলো এখনও নিয়মিত ব্যবহার করেন এর অধিকারিণী। হয়তো এই মুহূর্তে বাইরে আছেন, সান্ধ্য-অনুষ্ঠানে এখান থেকেই নতুন কোনো পোশাক নিয়ে পরবেন। কিন্তু এসব পরিচ্ছদের সাথে যখন সেই দুর্ঘটনার দিনে পরিহিত লাল পোশাকটি আর তার সাথে মিলিয়ে লাল হাতব্যাগটি চোখে পড়ে, তখন আবার বাস্তবে ফিরে আসতেই হয়।
কিন্তু রোসাংলুই ভার্টের মৃত্যুই কি শেষ কথা-চূড়ান্ত বাস্তব? এখানে এলে তা মনে হয় না। এখানে স্মরণের আবরণে মরণকে ঢেকে রাখা হয়েছে তাজমহলের মতোই। আয়তন, স্থাপত্যিক বিশিষ্টতা, পরিচিতি, নির্মাণব্যয়, ইতিহাসখ্যাতি প্রভৃতি প্রায় সব দিক দিয়েই, তাজমহলের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র কে ভি প্যারাডাইস। কিন্তু ওই অন্তরবেদনা ও প্রেমময় আবেগের দিক দিয়ে একটুও ছোট নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশি’ কবিতায় যেমন শিল্পের ভুবনে ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ’ থাকে না, তেমনি এখানে প্রেমের ভবনে মোগলরাজ শাজাহানের সাথে মোটেলমালিক ক্হালরিং এক হয়ে যান।
ক’জনই বা শাজাহানের মতো সমাধিমহল বানাতে পারে, সবাই তো আর ক্হলারিঙের মতো গোরগৃহও গড়তে পারে না, আবার হয়তো কারো কাছে প্রিয়জনের সামান্যস্মৃতিবস্তুও নেই। এমনকী কারো বা আকাশপ্রদীপ না জ্বাললেও চলে! এমনিতেই তো রাতের দূর-আকাশে তারা জ্বলে ওঠে।
শুনেছি, এদিককার নতুন বরবধূ নাকি এখানে এসে ছবি তোলেন। কেউ একজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একারণে যে, আনন্দঘন বিবাহ-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যখন নতুন জীবনে প্রবেশ করা হচ্ছে, তখন কেন মৃত্যুর সামনে আসা! বস্তুত, এরা সমাধির কাছে নয়, প্রেমের স্মারকের সামনে আসে। জীবন তো সীমিতসময়ের এবং সেই সীমাটাও আবার অনিশ্চিত; তাই এরা চায় সেই প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করতে, যে প্রেমে ‘জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ বন্ধু সদা থাকবে দাঁড়ায়ে। সেজন্যেই অমর প্রেমের সাক্ষ্য ভার্টের সমাধি-সদনে আসা। এই সঙ্গে যোগ করি, অকালে আপনজন হারানো শোকার্তদের প্রিয়ের স্মৃতি-স্মারক রাখার অনুমতি দিয়েছেন মিস্টার ক্হালরিং।
অবশ্য সেরকম কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। কোটিতে ক’জনই বা শাজাহানের মতো সমাধিমহল বানাতে পারে, সবাই তো আর ক্হলারিঙের মতো গোরগৃহও গড়তে পারে না, আবার হয়তো কারো কাছে প্রিয়জনের সামান্যস্মৃতিবস্তুও নেই। এমনকী কারো বা আকাশপ্রদীপ না জ্বাললেও চলে! এমনিতেই তো রাতের দূর-আকাশে তারা জ্বলে ওঠে। এই যেমন আজ রাতের আকাশের কথাই বলি। বিকেলের দিকেই ফিরে এসেছি আইজল শহরে। ক্রিসমাসের আগের দিন এদিকের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দুপুর হতেই। চেনা-চেনা হাস্যোজ্জ্বল মুখের অসংখ্য-অচেনা মানুষের সঙ্গে আমরাও হেঁটে বেড়িয়েছি এই ছোট্ট শহরে। রাস্তাজুড়ে পণ্য নিয়ে বসেছিল পসারিরা, চলেছিল নাচগান, খানাপিনা তো বটেই। এখন সবকিছুই স্তিমিত। কাল মিজোরাম ছেড়ে যাব। তাই রাত করে দোতলায় ছোট্ট উঠোনের মতো যে বারান্দা, সেখানে এসে দাঁড়িয়েছি। শেষবারের মতো শহরের রাতের রূপটি দেখতে চাই। অন্ধকারে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে জোনাকির মতো আটকে আছে বাড়িগুলো। একসময় চোখ গেল আইজলের আকাশে। কিছুটা ঠান্ডা থাকলেও কুয়াশার কণা নেই এই ডিসেম্বরের শেষেও। আর তাই দেখা গেল বাংলাদেশের-একেবারে বরিশালের কবির ‘নক্ষত্রের রাত’!-
যে-নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে;
যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি-
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়-কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে
কাতারে-কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
‘হাওয়ার রাত’-এ আকাশের তারকারাজি দেখে জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুকে পরাজিত হতে দেখেছিলেন। ঊর্ধ্বাকাশের ওই নক্ষত্রমালা এক পরমসত্তার সৃষ্টি। আর এই মর্ত্যভূমিতেও পথে-প্রান্তরে স্মরণের আবরণে মুত্যৃ ঢেকে রাখতে চাইছে ক্ষুদ্র-নশ্বর মানুষ। তারই একটি কে ভি প্যারাডাইস-এবার মনে হলো, সত্যিই স্বর্গ সে, সমাধি নয়।

মাসুদ রহমান। জন্ম ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭০। কুষ্টিয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। শিক্ষকতা করেন নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকাশিত গ্রন্থ- হুমায়ুন কবির : জীবন ও সাহিত্য; রবীন্দ্রনাথের সংসার, রবীন্দ্রনাথ : ছিন্নপত্র; রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়; আহমদ শরীফ : জীবন ও কর্ম; ছোটগল্পের দর্শন ও নিদর্শন ইত্যাদি।