চলচ্চিত্রশিল্পকলা

মৃণাল সেনের মহাপৃথিবী : ‘সমাজবিরোধী’ চলচ্চিত্র

‘এক দুই শতাব্দীব্যাপী শোষণ চলার পর জাতীয় সংস্কৃতি কঙ্কালসার হয়ে পড়ে। সংস্কৃতি হয়ে ওঠে কতগুলো স্বয়ংক্রিয় অভ্যাস, পোশাক-আশাকের ঐতিহ্য এবং কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।’
—ফ্রানৎস ফানো

‘সংস্কৃতি কারখানা’ (Cultural Industry) অভিধাটি বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্যাপক অর্থে প্রচলিত ছিল না। সবেমাত্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের বিকশিত চেহারা (Late Capitalism) প্রকাশ পাচ্ছে, তবে জ্ঞানচর্চার পরিমন্ডলে এনলাইটেনমেন্ট প্রস্তাবিত প্রতিশ্রুতিসমূহ (Commitment) তখনো পোক্ত। এমন পরিবেশে, ফ্রাঙ্কফুর্ট চিন্তাধারার (School of Thought) তাত্ত্বিকরা (Adorno, Horkheimer প্রমুখ) এনলাইটেনমেন্ট প্রদত্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তাবোধের উৎপাদন ও প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের কার্যপদ্ধতিগত প্রক্রিয়াকে জেরার আওতায় আনেন। মার্কসীয় চিন্তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় যুক্ত করেন এর দ্বান্দ্বিক চরিত্রের খতিয়ান।

এবারে আমরা সংস্কৃতি কারখানার মূল প্রস্তাবনার সাথে সিনেমার অবধারিত সম্পর্ককে পরিষ্কার করতে খানিক মনোযোগ দাবি করছি।

‘উল্লেখযোগ্য অর্থে, সাংস্কৃতিক কারখানার কার্যপ্রণালী আরও উদার শিল্পভিত্তিক জাতিগুলির থেকে আসে, এবং এর সমস্ত বৈশিষ্ট্যযুক্ত মিডিয়া, যেমন চলচ্চিত্র, রেডিও, সংগীত এবং ম্যাগাজিনগুলো সেখানেই বিকশিত হয়। অর্থাৎ, নিশ্চিতভাবে এর উৎপত্তির গোড়া পুঁজির সাধারণ সূত্রের মধ্যে নিহিত।’ (ভাবানুবাদ)

এনলাইটেনমেন্ট ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করে ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা, যুক্তিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার অগ্রসরতার দোহাই দিয়ে চূড়ান্ত অবস্থায় ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামোর দাস করে তুলেছে। শিল্পের বদলে সিনেমা হয়েছে পণ্য; যা দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করছে সিংহভাগ অর্থের মালিক গুটিকয়েক মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠান।

‘এটা সংস্কৃতি কারখানার গর্বের ব্যাপার হতে পারে যে তারা পূর্বের অচল শিল্পকে সফলভাবে ভোগ্যপণ্যের কাতারে নিয়ে আসতে পেরেছে।’ (ভাবানুবাদ)

‘সিনেমা ও রেডিওর আর শিল্পের ভড়ং ধরে থাকার প্রয়োজন নেই। সত্য এই যে, এগুলো শুধুই ব্যবসা।’ (ভাবানুবাদ)

‘কোনো সিনেমার ব্যবসাসফল হওয়ার মৌলিক শর্ত অন্য সব পণ্য থেকে আলাদা নয়। অর্থাৎ, সিনেমারও উপযোগিতা মূল্য বা দর্শকের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষমতা থাকতে হবে।’ তাই দর্শকের চাহিদার উৎপত্তি ও তার নিবারণ প্রক্রিয়ার পারস্পরিক কার্যকরণ সম্বন্ধটুকু বোঝা দরকার। সাধারণ অর্থে গণহারে পরিচিত নাচ, গান, এ্যাকশনধর্মী সিনেমাগুলোর বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বিপণনের রাজনীতির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হল, জনগনের সর্বোচ্চ অংশকে ভোক্তা বা দর্শকশ্রেণিতে পরিণত করার সর্বাত্মক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা। যেহেতু, মানব ইতিহাসে সর্বদা সমাজের শোষিত অংশই সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায় তাদের চাহিদাগুলোই এখানে প্রাধান্য পাবে। তবে আরো কয়েকটা শক্তিশালী উপায়কে কাজে লাগানো হয়; যেহেতু সিনেমা উৎপাদনের অর্থ, প্রযুক্তি, লোকবল সব একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির মুষ্টিমেয় অংশের সম্পদ এবং শ্রেণিটির সামগ্রিক স্বার্থও অভিন্ন তাই, ‘জোর যার মুল্লুক তার’—নীতির ব্যবহার এখানে প্রকট। এছাড়া চাহিদা যদি ‘নির্মাণ’ করা যায় এবং তার মধ্য দিয়ে শোষণযন্ত্র ‘রাষ্ট্র’ প্রতিনিয়ত আধিপত্যশীল, বলবান হয়ে উঠতে পারে তবে আর চিন্তা কি!

সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, নানান পীড়ায় জর্জরিত মানুষগুলোর বাস্তবতা থেকে পালানোর সাময়িক ব্যবস্থা করে এই ‘পণ্য-সিনেমা’। কিছু গৎবাঁধা (Stereotype) প্রেম, বীরত্ব, সুখ-দুঃখসহ বিভিন্ন ধাঁচের (যার যেমনটা ভাল লাগে) রোমাঞ্চকর বিষয়বস্তু নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোতে শোষিত শ্রেণির ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সংকটের অন্ত থাকে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় পারিবারিক সম্পর্কের ভিতরেও বিশৃংখলা, সংঘাত দানা বাঁধে। সকল আশ্রয় থেকে বিতাড়িত হয়ে একসময় সে ভাগ্য কিংবা ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়। একটু আনন্দ, আত্মিক প্রশান্তির সন্ধান যেখানেই পাওয়া যাক—মসজিদ, গীর্জা কিংবা সিনেমার পর্দায়—সেখানেই নিজেকে সঁপে দেয় সে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, নানান পীড়ায় জর্জরিত মানুষগুলোর বাস্তবতা থেকে পালানোর সাময়িক ব্যবস্থা করে এই ‘পণ্য-সিনেমা’। কিছু গৎবাঁধা (Stereotype) প্রেম, বীরত্ব, সুখ-দুঃখসহ বিভিন্ন ধাঁচের (যার যেমনটা ভাল লাগে) রোমাঞ্চকর বিষয়বস্তু নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে। আমরাও অবচেতনে অবাস্তব, ভ্রম সর্বস্ব কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত জীবনের স্বাদ পেতে পর্দার চরিত্রগুলোর সাথে অনুভূতির সম্পর্ক স্থাপন করি। আমাদের মন আনন্দ, সুখ আর আত্মতৃপ্তিতে আচ্ছন্ন হয়। যাপিত জীবনের কষ্ট, বঞ্চনা ও শোষণের গ্লানিকে প্রতিস্থাপিত করে-সন্তুষ্টি; যা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দীর্ঘমেয়াদি স্বস্তিতে রাখে। এভাবে আমরা একটি চক্রের ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকি যেখানে কল্পনা ও বাস্তবের ভেদ রেখা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় আমরা চিন্তার চর্চা থেকে ছিটকে দূরে সরে যাই অথবা নিক্ষিপ্ত হই অন্ধকারে কেননা,

‘আমোদ-প্রমোদ বলতে সর্বদাই কোন কিছুর ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা না করাকে বোঝায়; এমনকি তা দৃশ্যমান প্রকটিত ভোগান্তিকেও ভুলিয়ে দিতে চায়। আদতে, এ এক অসহায়ত্বের দশা।’ (ভাবানুবাদ)

অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ খুঁজে না পাওয়া অপেক্ষা ভীতিদায়ক হল দ্বিধাহীনতার সাথে তা মেনে নেওয়া। সস্তা ও জনপ্রিয় সিনেমাকে ব্যবহার করে এটাই ঘটানো হয়েছে বহুকালব্যাপী। থার্ড সিনেমা বা পলিটিক্যাল সিনেমা এই প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পণ্য থেকে সিনেমাকে শিল্পে পরিণত করবার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর ‘শিল্প জনগনের সম্পদ, ব্যাপকতম মেহনতি জনের ঠিক গভীরেই তার শিকড় যাওয়া দরকার।’১০

দুই

‘সিনেমার ভাষা প্রধানত ক্যামেরার ভাষা।’
—সত্যজিৎ রায়১১

সময়ের হিসাব করলে সিনেমার আবির্ভাব অল্পদিনের। একেবারে গোড়ার দিকের বিবেচনায় একে শিল্পকলার শাখা না বলে বরং মানুষের কৌতুহলী সত্তার প্রযুক্তিগত ফলাফল বলাটা অধিকতর উপযুক্ত। এই চমকপ্রদ আবিষ্কার বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেললেও স্বয়ং লুমিয়ের সিনেমার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তেমন উচ্চাশা প্রকাশ করেননি। তবে বিশ্ববাসী ব্যাপারটা উপভোগ করছে এটা তাঁর উচ্ছ্বাসের কারণ হয়েছিল। কিছু বছরের মধ্যেই প্রেক্ষাপট পাল্টাতে আরম্ভ করে। অনেকের ক্রমাগত আর স্বতঃস্ফূর্ত চেষ্টায় সিনেমার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে দ্রুত গতিতে। পঞ্চাশের দশকের শেষে সিনেমা মানুষের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়। শব্দ সংযোজন, তৃতীয় মাত্রার ইলিউশান সৃষ্টি, নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পদ্ধতির সংযোজনের মধ্য দিয়ে—বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও মননক্রিয়ার আশ্চর্য সমন্বয়ে—এই পটপরিবর্তনের বিশিষ্টতর ইতিহাস মূহুর্তের জন্যও থেমে থাকেনি।

ছোটবেলা থেকেই মৃণালের বই পড়ার নেশা ছিল। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতিসহ অসংখ্য বিষয়ে হাতের কাছে যা আসত পড়ে ফেলতেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে থাকার সময় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওখানে থেকে দিনের অনেকটা সময় বিচিত্র বিষয়ের বইপত্র দেখতেন। এভাবে একদিন সিনেমার নন্দনতত্ত্বের উপর জার্মান লেখকের একটি বই পড়ে সিনেমার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ জন্ম নেয়।

সিনেমার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পুঁজিপতিরা ব্যবসা করেছে, নব্য উপনিবেশবাদের সমর্থনে সম্মতি তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে, কলুষিত করেছে অনুন্নত বিশ্বের ভাষা ও সংস্কৃতিকে; তাতে করে সিনেমা ‘মাধ্যম’ হিসেবে মুখ থুবড়ে পড়েনি। উল্টো থার্ড সিনেমার নির্মাতারা তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে তেঁতিয়ে তুলতে সেই ক্যামেরাকেই হাতিয়ার করে তোলে। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে সার্বভৌমত্ব অর্জন করা দেশগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রাম বেহাত হয়েছে। মেহনতি মানুষের মুক্তির ফলাফল আত্মসাৎ করেছে সাম্রাজ্যবাদ। আরও চতুর কায়দার শোষণ কাঠামোর শিকার হয়েছে তৃতীয় বিশ্ব।১২

‘কোনো উপনিবেশ কিংবা পরাধীন দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করল, তার অঞ্চল থেকে সমস্ত বৈদেশিক সামরিক ঘাটি অপসারিত করল, সমস্ত বৈদেশিক ফৌজ অপসারণ করাল, অতীতে তার উপর জোর করে চাপানো অসম সন্ধিচুক্তিগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল—তখনও এমন হতে পারে যে, উপনিবেশবাদ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হলোনা।’১৩

নব্য উপনিবেশবাদ মূলত নতুন কায়দার নির্ভরশীলতার জন্ম দেয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনৈতিক মুক্তির তাগিদকে ধামাচাপা দিয়ে সমাজের গভীরে প্রোথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিকড়কে উপড়ে ফেলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। বিকল্প পথে বলপ্রয়োগসহ সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শিক অঙ্গগুলোর সাহায্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায় সর্বদা। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, সংগ্রাম ও প্রতিবাদের ইতিহাস বহুস্বরে প্রতিধ্বনিত হলেও একটি জায়গায় সকলে অভিন্ন; আর তা হল শ্রেণি-সংগ্রাম।

ঐতিহাসিক শিল্প-আন্দোলনগুলোর নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠিতে থার্ড সিনেমার বিরাট ক্যানভাসকে বোঝাপড়ার ঝুঁকি রয়েছে কেননা, প্রকৃতিগত কারণে এটি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সময়ের কাছে বাঁধা পড়ে না এবং এর আঙ্গিকগত রকমফেরেও রয়েছে বৈচিত্র্য। কেউ সিনেমায় গেরিলা যুদ্ধের টান টান উত্তেজনা ও সহিংসতাকে জোর দিয়েছেন, আবার কেউ নিজ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও পরিচয় নির্মাণ করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ভিতকে আঘাত করেছেন। এভাবে বুর্জোয়া ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিপরীতে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণের দায় নিয়ে সমানতালে এগোচ্ছে থার্ড সিনেমার বহুমাত্রিক লড়াই। পুঁজির যাদুকরি শক্তির কাছে মাথানত না করে থার্ড সিনেমার নির্মাতারা ছবি তৈরির ব্যয় সংকোচনের অভিনব সব পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়েছেন, গল্পের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত ফর্মকে ভেঙেচুরে নিয়েছেন, নান্দনিক সৌন্দর্যের উপরে স্থান দিয়েছেন রাজনীতি ও আদর্শের তাড়নাকে। মানুষের মাঝে শ্রেণিসচেতনার সংবিৎ সৃষ্টির এই আন্দোলনের গতিমুখ বহুধারায় বিভক্ত ও পরিবর্তনশীল হলেও বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার প্রতিজ্ঞায় এটি বৈশ্বিক। বিশ্ব জুড়ে ক্যামেরাকে বন্দুকের নলে পরিণত করা এইসব সাহসী নির্মাতাদের তালিকায় মৃণাল সেন এক ব্যতিক্রমী নাম।

তিন

‘মহৎ শিল্প চিরদিন সংযতবাক, সহজ, অনাড়ম্বর। কৌশল করে সে, যার বলার কিছুই নেই।’
—উৎপল দত্ত১৪

মৃণাল সেনের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ঝিলটুলিতে। সতের বছর বয়স পর্যন্ত এখানে থেকেই তিনি মাধ্যমিকের পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। তাঁর বাবা দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী যুবকদের হয়ে আইনি লড়াই করতেন তিনি। গান্ধীর আমরণ অনশনের সময় মৃণালের বাবা ফরিদপুরের আইনজীবিদের সাথে নিয়ে আদালত বয়কট করেছিলেন। ছোট থেকেই দেশের রাজনৈতিক বলয়ের সাথে মৃণালের পরিচয় ঘটেছিল। তাদের বাড়িতে প্রায়ই রাজনৈতিক অতিথিরা এসে অবস্থান করতেন। সুভাষচন্দ্র বসুকেও খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মৃণাল। দেশভাগের আগে ফরিদপুরের পাট চুকিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে তিনি কলকাতা চলে আসেন। পরবর্তীতে কলকাতার সামাজিক বাস্তবতায় মৃণাল নিজেকে মেলে ধরলেও তাঁর স্মৃতি থেকে এপার বাংলা পুরোপুরি মুছে যায়নি। বর্তমানে মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে যারা বাস করেন তাদের একজন তামান্না সেতু। তার বরাত দিয়ে আমরা জানতে পারি,১৫ মৃণাল সেন বোনের মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বহুবছর যাবৎ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফরিদপুরের বাড়িতে আসতেন। তাঁর বোন রেবা বাড়ির আঙিনার পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল। মৃণাল সেসব নিয়ে স্মৃতিচারণ করতেন। বাড়ির সমস্ত কোণা তাঁর চেনা ছিল। কোথায় মা আচার শুকাতেন, কোথায় তিনি লুকিয়ে থাকতেন বাচ্চাদের মতো আঙুল নাড়িয়ে তিনি এসবের বর্ণনা দিতেন।

ছোটবেলা থেকেই মৃণালের বই পড়ার নেশা ছিল। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতিসহ অসংখ্য বিষয়ে হাতের কাছে যা আসত পড়ে ফেলতেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে থাকার সময় ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওখানে থেকে দিনের অনেকটা সময় বিচিত্র বিষয়ের বইপত্র দেখতেন। এভাবে একদিন সিনেমার নন্দনতত্ত্বের উপর জার্মান লেখকের একটি বই পড়ে সিনেমার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ জন্ম নেয়। পরবর্তীতে ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। কাছাকাছি সময়ে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাও ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মাধ্যমে প্রথমবার কলকাতার মানুষ বিভিন্ন ধারার বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পায়। ঐতিহাসিক প্যারাডাইস ক্যাফে’র আড্ডা প্রসঙ্গেও কিছুটা বলা প্রয়োজন। দেশভাগের পরের কয়েক বছর এখানে নিয়মিত আসর বসাতো উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, আইপিটিএ সম্পাদক নিরঞ্জন সেনসহ বহু প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। সেখানে রাজনীতি, চলচ্চিত্র, নাটক বিষয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হত। বিশ্বের থিয়েটার, চলচ্চিত্রের সকল খবরাখবর রাখতেন তাঁরা। মৃণাল সেন এসময়ে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় কিছু তাত্ত্বিক প্রবন্ধও লেখেন। প্যারাডাইস ক্যাফে’র এই স্মরণীয় আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের একজন নৃপেণ গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন, প্যারাডাইস ক্যাফে শুধু চায়ের দোকান ছিল না, ছিল সিনেমা ও নাটকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

অভিনয়ের আবেদন বোঝাতে তিনি প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন গল্প শোনাতেন, যেগুলো তাদেরকে চরিত্রের ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করত। এমনকি সিনেমার জন্যে তিনি কখনো পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট করেননি; সবকিছুর মোটামুটি একটা পরিকল্পনা তাঁর মাথায় কিংবা কখনো টুকরো কাগজে লিখে রাখতেন। বাকি অংশটুকুকে নির্ভর করতে হত শুটিংয়ের সময়ের ইম্প্রোভাইজেশনের উপর।

মৃণাল সেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ সদস্য না হলেও এর সাংস্কৃতিক শাখার সাথে যুক্ত ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির আবহেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। সুমিত মিত্রকে দেয়া ১৯৭৩ সালের এক সাক্ষ্যাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক পরিবেশে মানুষ। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতিতে আসি। স্বাধীনতার আগে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরও বামপন্থী রাজনীতি থেকে আমার বিশ্বাস টলেনি।’ সত্তরের দশকের মাঠের রাজনীতি শুধু বামপন্থী বলয় নয়, সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। মৃণাল সেই রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনের বহুমুখী অন্তর্দ্বন্দ্বকে তাঁর চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন।

সিনেমার বোঝাপড়া ও নির্মাণ-পদ্ধতিতে মৃণাল সেন ছিলেন বাকিদের থেকে আলাদা। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়েও যে ভাল ছবি হতে পারে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। সিনেমাকে বরাবর সম্মিলিত শিল্প হিসেবে দেখতেন। তাঁর ছবিতে অভিনয় করা শিল্পীদের ওপর কখনোই কিছু চাপিয়ে দিতে চাননি। অভিনয়ের আবেদন বোঝাতে তিনি প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন গল্প শোনাতেন, যেগুলো তাদেরকে চরিত্রের ভিতরে ঢুকতে সাহায্য করত। এমনকি সিনেমার জন্যে তিনি কখনো পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট করেননি; সবকিছুর মোটামুটি একটা পরিকল্পনা তাঁর মাথায় কিংবা কখনো টুকরো কাগজে লিখে রাখতেন। বাকি অংশটুকুকে নির্ভর করতে হত শুটিংয়ের সময়ের ইম্প্রোভাইজেশনের উপর। এভাবে মৃণাল সেনের সিনেমা সহজ, সাবলীল ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার শৈল্পিক নমুনা হয়ে উঠেছে। তাঁর একাধিক সিনেমায় কাজ করা গুণী শিল্পী মমতাশংকর অভিনয় জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লেখেন,

‘রোজ শুটিংয়ে যেতাম পুরো রেডি হয়ে; কিন্তু বেশ কদিন আমার কোন শটই হয়নি। শুধু মিঠুনকে নিয়েই শুটিং হয়েছে। হঠাৎই একদিন মৃণালদা বললেন, ‘মম, ওখান থেকে কলসিটা নিয়ে সামনের নদীতে যাও। তারপর কলসিটায় জল ভরে ওদিকে চলে যাও।’ আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সেটা করলাম, মৃণালদা বললেন, ‘কাট, ভেরি গুড।’ জীবনের প্রথমের ফিল্ম শট হয়ে গেল। বুঝতেই পারলাম না কিভাবে কী হলো! এভাবেই ‘মৃগয়া’র পুরো শুটিং হয়েছিল।’১৬

মৃণালের চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শিল্পীরা যাতে নিজেদের বস্তু-জগতের সাথে পর্দায় অভিনীত চরিত্রের অনুভূতিগত দূরত্বকে ঘুচিয়ে, শিল্পের অন্তর্গত চৈতন্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে তার জন্যে এমন স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে; যাতে মেকি ঢঙ ও কৃত্রিমতার কোনরকম রঞ্জিত মিশেলে চরিত্রগুলোর নিপাট সাবলীলতা আহত না হয়। সিনেমায় শিল্পগুণের বিশুদ্ধতা রক্ষার প্রশ্নে মৃণাল সেন কোনপ্রকার আপসে বিশ্বাসী ছিলেন না। দৃষ্টির উপযুক্ত আঙ্গিক-কৌশল ও শব্দকে ব্যবহার করে তিনি মানবমনের জটিল, অদৃশ্য স্তরগুলোকে ক্যামেরার মাধ্যমে উন্মোচন করতে চেয়েছেন। সময়ের বিশৃঙ্খলাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদানগুলোর সাহায্যে, চিত্রকল্পের সুষ্ঠু প্রয়োগ মারফত এক অতিজাগতিক ক্ষেত্র তৈরি করছেন যার সমস্তটার অস্তিত্ব বাস্তবেই রয়েছে, তবে সেগুলো চিহ্নিত করে পরিপূর্ণ উপলব্ধির পথে মানুষকে আরও একধাপ এগিয়ে নেয়াটা ছিল তাঁর লক্ষ্য। এটাই মৃণাল সেনের সৌন্দর্য। তিনি ইতিহাসের আলোকে উৎপন্ন সময়কে ব্যাখ্যা করছেন মাত্র। অবধারিত অর্থে, বিষয়বস্তুর কেন্দ্রে থাকছে দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা, বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ ও মৃত্যুর মিছিল, মধ্যবিত্ত মানুষ ও তার সম্পর্কের টানাপোড়েন, বেকারত্ব থেকে হতাশা আর চূড়ান্ত পর্যায়ে ফেটে বেরোনো সহিংস ক্রোধ।

মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের সমালোচক ও বিপ্লবী বন্ধুদের অনেকে তাঁর অপেক্ষাকৃত পরের দিককার কাজগুলোকে রাজনৈতিক দৃশ্যায়নের বিচারে তুলনামূলকভাবে ‘দুর্বল’ দাবি করেছেন। মৃণাল সম্পর্কে এই সমালোচনা যদি উপযুক্ত ধরে নিই তথাপি তিনি তা সচেতনভাবে, আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে করেছেন। কেননা হলিউডের সিনেমার বিপরীতে তিনি মধ্যবিত্তের হতাশার ক্ষতে বিপ্লবের মলম সরবরাহ করতে গিয়ে আরেকটি ‘কল্পরাজ্য’ তৈরি করতে চাননি। করলে হয়তো বামপন্থীদের একদল চারু মজুমদারের লাইনের মত মৃণাল সেনের সিনেমার লাইনকেও ‘হঠকারী’ তকমা লাগিয়ে দিতেন। এই হঠকারীতাকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা গেলেও মৃণাল সেন নিজস্ব অবস্থানে অটল থাকতেন কারণ, শিল্পকে কাজে লাগিয়ে দর্শককে প্রতারিত করা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল। অপরাপর, প্রথম দিককার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর ভুলকে তিনি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে নিজেকে ক্রমে পরিপক্কতার দিকে ধাবিত করেছেন। স্থিতাবস্থার হস্তক্ষেপকে দৃঢ়তার সাথে রুখে দিতে এই সরল জীবনবোধ তাঁকে শক্তি জুগিয়েছে। মৃণাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গীতা সেন লিখছেন,

‘জনৈক প্রযোজক একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কেবল রাজেশ খান্নাকে নিয়ে একটা ছবি করলে ওঁকে পাঁচ লাখ টাকা দেবেন। এমনকি তাঁর কথা শুনে একদিন রাজেশ খান্না নিজে ফোন করে ফেললেন। কিন্তু ছবিটা উনি করেননি। করতে চাননি বলেই। আর তারপরেই নিজের মনে মনে কেমন কুন্ঠাবোধ করেছেন। একদিন দুপুরে খাবার সময় আমাকে আর আমার ছেলেকে প্রায় জবাবদিহিতার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ছবিটা করলাম না, তোমরা হয়তো ভাবছ অনেকগুলো টাকা পাওয়া যেত।’ শুনে আমরা তো অবাক। আসলে প্রচুর পরিমাণ সচ্ছলতা আমাদের দিতে পারেননি বলে একটা আক্ষেপ ওঁর মধ্যে তৈরি হচ্ছিল।’১৭

তবে ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে মৃণাল প্রযোজকের কথা রেখেছিলেন। প্রযোজক বললেন, আপনার যা ইচ্ছা করুন তবে সেটি হতে হবে ওড়িয়া ভাষায়। মৃণাল সেন ওড়িয়া জানতেন না তবে দরিদ্র আদিবাসীদের সাথে মিশে তাঁর মনে হয়েছিল, ভাষা কোন বাঁধার সৃষ্টি করবে না কারণ, পৃথিবীর সর্বত্র অনাহারে থাকা বঞ্চিত মানুষের ভাষা একটাই; ক্ষুধার ভাষা। আর তিনি সেটা বোঝেন।

চার

“মৃণাল যখন রক্তমাখা ময়দানের ঘাস থেকে হাঁটতে হাঁটতে মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে এসে ঢুকছেন তখনও তিনি রণাঙ্গনে।”
—কৌশিক রায়চৌধুরী১৮

মৃণাল সেনের ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১) সিনেমায় আমরা দেখি, বাড়ির মেজো ছেলে বুলু রাজনীতির দায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে বাবা-মা নিজ হাতে তাকে খিড়কির দরজা দিয়ে বের করে দিলে খানিক পরেই গুলির শব্দে হাহাকার করে ওঠে ফ্রেম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে পালিয়ে বেকার জীবনের অবসান ঘটাতে ছ’মাসের কথা বলে ছ’বছরের জন্য পশ্চিম জার্মানিতে পাড়ি জমায় আরেক ছেলে সোমু। সংসারের হাল ধরার দায়িত্ব তাঁর উপরে বর্তালেও বিদেশে গিয়ে সে অর্থকষ্টে পড়ে। সংসারের সকল ভার এসে পড়ে বড় ছেলের বিধবা স্ত্রীর উপর। এ গল্প অতি সাদামাটা, আশির দশকের কলকাতার অনেক পরিবারের গল্প।

আমরা সকল কিছু ভুলে গিয়ে নতুন জোয়ারে গা ভাসাতে চাইলেও মৃণাল সেন আমাদেরকে স্বস্তি দেন না। দুঃস্বপ্নের মত আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায় তাঁর মহাপৃথিবী; যা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের দেয়ালগুলোর ভেতর আটকা পড়েছে।

সিনেমায় নকশালবাড়ির ঝড়ে নড়বড়ে হয়ে যাওয়া অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর যেকোনো একটির কিছু টুকরো সময়কে দেখানো হয়। বাকিদের মত এই পরিবারের সদস্যরাও বিপ্লবের তত্ত্ব, অতশত পন্থা জানেনা; জানার প্রয়োজনও পড়েনি। চারু মজুমদারের শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন অনুসরণ করে এসব বাড়ির কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী ছেলেরা বইপত্র ফেলে যখন হাতে বন্দুক তুলে নিয়ে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন বাবা-মায়েরা মৌখিকভাবে তাদের কঠোর বিরোধিতা করলেও মনের কোথাও থেকে যেন একটু সমর্থনও দেন। দেশোদ্ধারে নামা—কথাটায় বাঁকা বিদ্রুপের সাথে সন্তানকে নিয়ে কিঞ্চিৎ গর্বও লুকিয়ে থাকে। রাষ্ট্রদ্রোহী, জঙ্গি নিধনের অভিযানে পুলিশ এদেরকে হত্যা করে কিংবা পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বলি হয় তারা; তারপর কিছু বছরের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়া, অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিভক্তির জেরে বিপ্লবের সূর্য প্রায় অস্তমিত হলে যেন সব চুকেবুকে যায়।

‘মহাপৃথিবী’ (১৯৯১) চলচ্চিত্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগাম প্রেক্ষাপট তুলে ধরে। ততদিনে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার প্রাচীর ধ্বসে পড়েছে। ভারতবর্ষের বিপ্লবের প্রজ্জ্বলিত শিখাটুকু নিভু নিভু জ্বলছে। তবে উত্তাল সত্তরের কোনো মীমাংসা হয়নি। না পার্টি কোনো উত্তর দিয়েছে, না রাষ্ট্রকে করা গেছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন। তবে কি ইতিহাসের বড় বড় পালাবদলের পিছনে সাম্যের দাবিতে খুন হওয়া হাজারো সম্ভাবনাময় তাজা প্রাণ মিথ্যে হয়ে গেল! আমরা সকল কিছু ভুলে গিয়ে নতুন জোয়ারে গা ভাসাতে চাইলেও মৃণাল সেন আমাদেরকে স্বস্তি দেন না। দুঃস্বপ্নের মত আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায় তাঁর মহাপৃথিবী; যা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের দেয়ালগুলোর ভেতর আটকা পড়েছে। সেই ঘরগুলোতে প্রবেশ করলে, আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। মৃণাল দেখতে চান ঘরের মানুষগুলোর অসহনীয় যন্ত্রনার সাথে আমরা কীভাবে মানিয়ে নিই, প্রতিক্রিয়া দেখাই অথবা সবাই মিলে বিশৃঙ্খল ট্রমার ভেতর তলিয়ে যাই কিনা।
মূল কাহিনী আবর্তিত হয় সিনেমার শুরুতে মায়ের আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে। মাঝে মাঝে কিছু মন্তাজে সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপট, বার্লিন প্রাচীরের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। মায়ের মৃত্যুর আগের ও পরের দৃশ্যপটের বিবরণ সমান্তরালে চলতে থাকে। সিনেমার শুরুতেই মায়ের আত্মহত্যা পুরো পরিবারটাকে স্থবির করে ফেলে। এই স্থবিরতা ছবির পুরোটা সময় জুড়ে থেকেছে। মেজো ছেলের খুন হওয়ার অভিঘাত, আরেক ছেলে দেশ ছেড়ে যাওয়ায় তার উপর অভিমান এবং যে সাম্যের রাজনীতি এসবের জন্য দায়ী, সবশেষে তার সমূহ পরাজয়কে তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল বুলুর মত যারা প্রাণ দিয়েছে তারা মিথ্যে হয়ে গেছে। বিপ্লবের মাশুল দিতে গিয়ে কীভাবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাঙন, অবিশ্বাস, দূরত্ব ও অপরাধবোধ বাসা বাঁধে; কীভাবে মানুষ উদ্বেগ, উত্তেজনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার ভেতর তলিয়ে যায় সে বিষয়ে এক অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয় মহাপৃথিবী’র দর্শকদের। যেন পার্টি, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাসীকে মৃনাল সেন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জানতে চাইছেন, বুলু মরল কেন? মা কেন আত্মহত্যা করল?

তথ্যসূত্র

1. ফ্রানৎস ফানো, জগতের লাঞ্ছিত, আমিনুল ইসলাম ভুইয়া অনূদিত, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৭, পৃ. ১৭২
2. Theodor W. Adorno, Max Horkheimer, Dialectic of Enlightenment, Verso, 1997, p. 110-111
3. See, Immanuel Kant, What is Enlightenment?, Cambridge University Press, 1999, p. 11-22
Immanuel Kant’s essay “What is Enlightenment?” is a significant philosophical work thatexplores the concept of enlightenment and the individual’s role in seeking knowledge and freedom from authority. Written in 1784, this essay remains influential in discussions of autonomy, reason, and progress in Western thought.
4. Adorno, Horkheimer, ibid, p. 113
5. ibid, p. 102
6. ফরহাদ মজহার, সিনেমাপাঠ, ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন, ২০২৩, পৃ. ১৮-২০
7. The man with leisure has to accept what the culture manufacturers offer him. See, Adorno, Horkheimer, ibid, p. 104
8. ‘Marked differentiations such as those of A and B films, or of stories in magazines in different prize ranges, depened not so much on subject matter as on classifying, organizing, and labeling consumers. Something is provided for all so that none may escape; the distinctions are emphasized and extended.’ ibid, p. 103
9. ibid, p. 120
10. ভ. ই. লেনিন, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, ১৯৬৮, পৃ. ১৭২
11. সত্যজিৎ রায়, বিষয় চলচ্চিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮২, পৃ. ১১
12. চিরাচরিত উপনিবেশবাদের সঙ্গে নয়া উপনিবেশবাদের পার্থক্য হল এই যে, এর বিভিন্ন রকম-ধরন আর পদ্ধতি আরও বহুতর, এর মর্মবস্তু আরও বেশি জটিল। দেখুন, ইয়ে. ঝুকভ, ল. দেল্যুসিন ও অন্যান্য, তৃতীয় দুনিয়া (সমস্যাবলী ও পরিপ্রেক্ষিত), প্রগতি প্রকাশন, পৃ. ৭০
13. পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৫
14. বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়, সজল আহমেদ সম্পাদিত, প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন মৃণাল সেন, কবি প্রকাশনী, ২০২২, পৃ. ১০৩
15. বিস্তারিত দেখুন, তামান্না সেতু, মৃণাল সেন অথবা রেবার জন্য, ২ জানুয়ারি, ২০১৯
16. বাণীব্রত মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৫
17. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৫-১২৬
18. পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৫

গ্রন্থপঞ্জি

ইয়ে. ঝুকভ, ল. দেল্যুসিন ও অন্যান্য, তৃতীয় দুনিয়া (সমস্যাবলী ও পরিপ্রেক্ষিত), প্রগতি প্রকাশন
ফরহাদ মজহার, সিনেমাপাঠ, ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন, ২০২৩
ফ্রানৎস ফানো, জগতের লাঞ্ছিত, আমিনুল ইসলাম ভুইয়া অনূদিত, মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৭
বাণীব্রত মুখোপাধ্যায়, সজল আহমেদ সম্পাদিত, প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন মৃণাল সেন, কবি প্রকাশনী, ২০২২
ভ. ই. লেনিন, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রগতি প্রকাশন, ১৯৬৮
সত্যজিৎ রায়, বিষয় চলচ্চিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৮২
Fernando Solanas, Octavio Getino, Toward A Third Cinema, Cineaste, 1970, 4(3), 1-10
Glauber Rocha, THE AESTHETICS OF HUNGER (Brazil, 1965), Film Manifestos and Global Cinema Cultures: A Critical Anthology, edited by Scott MacKenzie, Berkeley: University of California Press, 2014
Kwame Nkrumah, Neo-Colonialism: The last Stage of Imperialism, International Publishers New York, 1966
Mike Wayne, Political Film: The Dialectics of Third Cinema, Pluto Press, 2001
Roman Dixit, Naxalite Movement in India: The State’s Response, Journal of Defense Studies, 4 (2), 2010
Theodor W. Adorno, Max Horkheimer, Dialectic of Enlightenment, Verso, 1997

লেখাটি শেয়ার করুন :

আশিকুর রহমান

আশিকুর রহমান জন্ম যশোর জেলায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের স্নাতক শিক্ষার্থী। সিনেমা ও চিত্রকলা বিষয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!