শঙ্খ ঘোষের কবিতা : নৈঃশব্দ্যের নন্দন
শঙ্খ ঘোষের (১৯৩২-২০২১) প্রথম কাব্য দিনগুলি রাতগুলি। এর অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে লেখা। আর কাব্য আকারে প্রকাশ ১৯৫৬ সালে। তারপর বছর চারেকের বিরতি: এইসময়ে কোনো কবিতা প্রকাশিত হয়নি, লিখেছেন যদিও, কিন্তু ইচ্ছে ছিল ‘নিরুচ্চার লুকিয়ে ফেলবার’১। অতঃপর আবার প্রকাশ, দ্বিতীয় কাব্য: যমুনাবতী (১৯৬১)। সেই থেকে লিখেছেন অবিরল, সেসব প্রকাশও পেয়েছে: পরিমিত কিন্তু ধারাবাহিক। কিন্তু, এই ‘প্রকাশ’ অর্থ: বই আকারে বের হওয়া বা এক মলাটের ভেতর দৃশ্যগ্রাহ্য রূপ লাভ করা ভিন্ন অন্যকিছু নয়; কেননা, কবিতায় শঙ্খ ঘোষ প্রকাশ নয় বরং অপ্রকাশকে বাঙ্ময় করে তোলেন। সেখানে প্রকাশ অর্থে, অর্থের অভিব্যক্ত হওয়া বা এইরকম আরও যা বোঝাতে পারত তা আসে বস্তুরূপে নয় বরং কবির ‘সত্তা’ হিসেবে। তবুও, কবিতা আস্বাদের ফল হিসেবে শেষ পর্যন্ত বোধের যে অনুরণন তৈরি হয় তার নেপথ্যে পাঠকের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির সাদৃশ্যমান সম্পর্ক স্বীকার করেও বলা যায়: তাঁর কবিতায় অপ্রকাশের অন্তরালেও একরকমের প্রকাশ তো থাকেই! কিন্তু তা কিছুতেই প্রকাশের আভিধানিক যে অর্থ অর্থাৎ ‘ব্যক্ত হওয়াকে’ বোঝায় না। কেননা, জীবনের সঙ্গে কিংবা জীবনের প্রত্যক্ষ অর্থময়তার স্থূলতার সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। বরং জীবনের সঙ্গে কবিতার সম্বন্ধের কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ যে বলেছেন, ‘সেটা কোনও প্রকট সম্বন্ধ নয়’২, শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রসঙ্গেও কথাটি সাধারণভাবেই প্রযোজ্য। জীবনানন্দ দাশের উক্তিতে ‘প্রকট’ শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষ করবার মতো: কাব্যতত্ত্ব নিয়ে বলতে গিয়ে কয়েকটি শব্দের উপর বারবার জোর দিয়েছেন তিনি: অন্তঃসার আভা, ভাবপ্রতিভা আর ভাবনাপ্রতিভা৩। এছাড়া লিখেছেন, ‘হাড়ের ভেতর বোধ করবার শক্তি’র কথা (জীবনানন্দ দাশ ২০০২: ১৬)। এটা মনে করিয়ে দেয় ইয়েটসের (William Butler Yeats, ১৮৬৫-১৯৩৯) সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি: ‘He that sings a lasting song/ Thinks in a marrrow-bone’ (Yeats ১৯৮৯: ২৮২)। এইসব ভাবনা কবিতা বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের প্রজ্ঞার খানিকটা ধারণা দেয়। বোঝা যায়, তাঁর লেখার শরীরের একেবারে ভিতরদিকে একটা স্রোত বয়ে যায়, তাতে সময় বিষয়ক প্রত্যক্ষ শব্দপুঞ্জের উল্লিখন ছাড়াও এক একটি কবিতা স্পর্শ করে মূলে। সেখানে কেউ কষ্ট পাচ্ছে, দরদের চোখে সেটা দেখা আর তা বলা শুধু নয়, নিজেই সেই কষ্টটা হয়ে ওঠার ব্যাপার থাকে। তখন আর কথা থাকে না, ভাষা বিলুপ্ত হয়; ‘না বলাই’ তখন কবিতায় ‘বলা’র সবটুকু জায়গা দখল করে; শব্দের স্থান নিয়ে নেয় নৈঃশব্দ্য; আর তখনই সম্ভব হয় সমস্ত সত্তা দিয়ে পাওয়া; অপ্রত্যক্ষের আড়াল থেকে সামূহিক বোধ আহরণ করে মজ্জাভূতভাবেই যা কাজ করে যায়।
‘শব্দহীন হওয়া’ বলতে তিনি আসলে কী বোঝাতে চান? ‘মূক-জীবনও’ তো তাঁর আরাধ্য নয়! কেননা, সারাজীবনই সমস্ত অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি সরব, কলরোলময়। তাহলে? নিজেকে তিনি উপদেশ দেন, প্রত্নস্মৃতি আর মর্মরবেদনাগুলোর জারণে মৌন হও, মৌনতার মৃদুমঞ্জির আখরে দাগ কাটো সময়ের গায়ে
২
প্রথম কাব্য থেকেই ‘পাবনার বাণারিপাড়া পাকশি আর সুপুরিবনের সারি ঘেরা ঘর-বাড়ি’ এই পরিসরটাই শঙ্খ ঘোষের লেখায় বারবার ফিরে আসে, দেশ হয়ে। কলকাতা আর ভারতবর্ষ সেখানে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত। ওই দেশ কীরূপে আশ্রয় দেয়, এই দেশ কীভাবে ছুড়ে ফেলে; এই বৈপরিত্যেমোড়ানো প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত তাঁর সমূহসত্তা। এই আশ্রয় দেওয়া আর ছুড়ে ফেলা বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বোঝানো হয় তাতে সরলীকরণের সম্ভাবনা সত্ত্বেও সেটি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়, বরং সেটি একটি দার্শনিক সমস্যা: অতীতকে ছুঁয়ে বর্তমানকে বুঝবার চেষ্টায় অস্তিত্বের সমস্ত শর্তসহ ‘আমি’ হয়ে উঠবার সমস্যা। শঙ্খ ঘোষের এই সমস্যার শেকড় যাপিত-জীবনের কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যায়, আর সেখান থেকে রস আহরণ করে প্রতীকের মতো করে কবিতায় পরিবেশন করে। ফলে, একই বেদনাবহ-স্মৃতি একদিকে ‘ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষকে’ ক্ষত-বিক্ষত করে, অন্যদিকে ‘কবি শঙ্খ ঘোষকে’ করে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। কেননা, বেদনার-ঐশ্বর্যে মানুষ যেখানে দীন সেখানে তো প্রকাশ নেই, বরং অন্তস্থ বেদনাকে নিজে শোষণ করে উদ্বৃত্ত যা থাকে তাই দিয়েই তো প্রকাশ: ‘লোহা গরম হতে হতে যতক্ষণ না তার দীপ্তি তাপ পর্যন্ত যায়, ততক্ষণ তো তার প্রকাশ নেই। আলো তো তাপেরই ঐশ্বর্য’ (রবীন্দ্রনাথ ১৪২২ক: ৪২৫); আরেক অর্থে আত্মদহনের ফল, আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। ‘মানুষের যে-সকল ভাব স্বকীয় প্রয়োজনের মধ্যেই ভুক্ত হয়ে না যায়, যার প্রাচুর্যকে আপনার মধ্যেই আপনি রাখতে পারে না, যা স্বভাবতই দীপ্যমান তারই দ্বারা তো মানুষের প্রকাশের উৎসব’ (রবীন্দ্রনাথ ১৪২২ক: ৪২৫)। এই প্রকাশের প্রকৃতিই এমন যে, নির্দ্বিধায় তাকে আপন বলে চিনে নেওয়া যায়, কেননা কবিপ্রজ্ঞায় নির্বিশেষকে ধারণ করে সবরকমের ভোগবাদি-মলিনতা থেকে সে মুক্ত করে। আর তখনই তা হয়ে ওঠে এক বিশেষ প্রকাশ। শব্দে যার রূপ থাকে ঢাকা, কেবল নৈঃশব্দ্যের নিঃসীম প্রান্তরেই যা অবারিত হয়। কবিজীবনের প্রাকপর্বেই শঙ্খ ঘোষ এই বোধে উদ্ভোদিত হন, তখন তাঁর মনে হয়: ‘লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা। শব্দই জানে কেমন করে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ সূত্র না ছিড়েও। তাঁর জন্য বিষম ঝাঁপ দেবার দরকার আছে দুঃসহ আড়ালে থেকে (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১২)।’ এই ‘আড়াল’ ঈপ্সিত হলেও দুঃসহ; কেননা ‘অন্তরাল সহ্য করাই মানুষের পক্ষে সবার চেয়ে কঠিন। আবার এই আড়াল অর্থ অবস্থানগত নৈর্বক্তিকতাও নয়, বরং অর্থের চাপে হারিয়ে যায় যেসব অমূল্য ও হার্দিক অনুরণন একান্ত প্রযত্নে সেসবকে ছেঁকে তুলে আনা; তারই অন্তরালে থেকে মানুষের শেষ দায়টাও নিতে চান তিনি। সেকারণে দিনগুলি রাতগুলি থেকেই জীবন-প্রেম-বিপ্লবসহ আরও বিবিধ বিষয় কবিতায় উঠে আসে কবির মনন এষণা ও নান্দনিক অভিজ্ঞানের সূত্রধরেই। সেখানে নির্জন নৈঃশব্দ্যে ‘মার্জিত, সর্বংসহ’ চেহারার অন্তরালেও ফুটে ওঠে ‘বেদনাবোধ’ ও ‘বিষণ্নতা’। এর একটায় কবির ‘দৈনন্দিন অস্তিত্ব’, অন্যটায় ‘অন্তর্গত সত্তা’। শঙ্খ ঘোষের কবিতার উৎসমুখ এই দুটিই। তবে শঙ্খ ঘোষের কবিতায় যে অপরিসীম বেদনাবোধ, বিষণ্নতা আর অন্ধকার টের পাওয়া যায়, তা সর্বার্থে সমার্থকও নয়। এই বেদনাবোধ বা বিষণ্নতা একটি ‘মানসিক দশা’ (state of mind) মাত্র, ‘নিরাশা’ নয়; কেননা ‘নিরাশা’ও তো স্টেটমেন্ট! এই মানসিক দশার সাথে (বিষণ্নতা বা বেদনাবোধ) অনেক কিছু একসঙ্গে জড়ানো থাকে। আর অন্ধকার! ‘সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ১৯) সে তো তাঁর আরাধ্যই, কেননা ‘আলুলায়িত বেদনার কালো’র ভেতরেই নিঃশব্দে দীর্ঘকাল এ তাঁর ‘বন্ধ মোহ গতশ্বাস আলুথালু বাঁচা’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ১৯)। তাই ক্লিবত্বের জ্বালাময় এই দৈন্য থেকে তিনি পরিত্রাণ চান; কবিতায় লিখেন: ‘বাড়ি ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো? / চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ৮৬) আর গদ্যে বলেন: ‘মনে হয় যেন খুব বেশি বলা হয়ে গেল এই কতদিনে। সমস্ত দিনের পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গ্লানির মতো লাগে’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)।’ কিন্তু কেনো? কথার প্রতি তাঁর এই বিতৃষ্ণার কারণ কী? কারণটাও তিনি নিজেই বলেন: ‘কথা, কথা। যেন একটু চুপ ছিল না কোথাও, থাকতে নেই, হাতে হাত রাখতে নেই। যে-নীরবকে খুঁজতে বেরিয়েছিলে সবাই মিলে, কোথায় সেসব মিলিয়ে গেল বাতাসে, যেন সেসব জানতে নেই (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)। সেজন্য, কবির আশ্রয় হয়ে থাকা ‘নিজেকে’ তিনি শাসনও করেন, বলেন, ‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো/ শব্দহীন হও?/ পুষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৬৭)। এখানে ‘শব্দহীন হওয়া’ বলতে তিনি আসলে কী বোঝাতে চান? ‘মূক-জীবনও’ তো তাঁর আরাধ্য নয়! কেননা, সারাজীবনই সমস্ত অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি সরব, কলরোলময়। তাহলে? নিজেকে তিনি উপদেশ দেন, প্রত্নস্মৃতি আর মর্মরবেদনাগুলোর জারণে মৌন হও, মৌনতার মৃদুমঞ্জির আখরে দাগ কাটো সময়ের গায়ে; বলেন, ‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৬৭)! কিন্তু শব্দহীন হয়েও কোনোভাবে কি লেখা কি সম্ভব! মৌনতার সুতোয় কি জোড়া সম্ভব শতচ্ছিন্ন শৈশব আর ক্লেশক্লিষ্ট জীবনের পাল? হয়তো সম্ভব, কেননা ‘জটিল বন্ধনের মধ্যে মুক্তির প্রত্যাশায়, বাঁধন পরানো বাঁধন খোলানোর খেলাতেই তো শিল্পীর তৃপ্তি (শঙ্খ ঘোষ ১৪২০: ২৬)। এই তৃপ্তির অন্বেষণেই ‘নিঃশব্দের তর্জনী’তে দার্শনিক কীয়ের্কেগার্ডকে (Soren Aabye Kierkegaard, ১৮১৩-১৮৫৫) উদ্ধৃত করে তিনি বলেন: ‘ঈশ্বর বিষয়ে মানুষের কি কিছু বলার অধিকার আছে আরেক মানুষকে? তখন তো, টুকরো টুকরো হয়ে যাবে পরমের সঙ্গে সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্কেরই তো অন্য নাম নীরবতা’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)। অর্থাৎ, ‘পরমকে স্পর্শ করবার যোগ্য পরম ভাষা হলো নীরবতা। বাক্য যেন সত্যের দিকে এগিয়ে যাবার এক বাণিজ্যিক পদ্ধতি মাত্র, সে যেন শুধু বেচাকেনার বাজার’ (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১০)। এই বাজারে কেউ কারোর চোখের দিকে তাকায় না, কেবল সবাই সবার মুখ দেখে: বড়ো বেশি বেড়ালের চোখে ভরে গেছে সমাজ, চাতুর্য বড়ো অনায়াস, সুলভ, সর্বসাধ্য (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)। চাতুর্যে ভরা বাজার আর বেড়ালের চোখে ভরা এই সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে শঙ্খ ঘোষের মনে হয়, ‘একটি মুখোশ বরং ভালো। কবি সবারই মধ্যে লুকিয়ে থাকবে ভিড়ে সকল-সাজের মুখোশ নিয়ে। ইচ্ছে হয় তার মধ্যে খুব আড়াল থাকতে, কাঁচা জীবন সবুজ কথার ছায়ায়’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)। ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষের মুখোশের আড়লে কবি শঙ্খ ঘোষকে সংগুপ্ত রেখেই তিনি গড়ে তুলতে চান নীরবতার অন্তরতম সুর। সেজন্যই খুঁজে ফেরেন, ‘এমনও কথা কি নেই যাতে নীরবও গড়ে ওঠে’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)? সেই খোঁজেই কবি ডুব দেন নিজেরই জীবনের গভীরে। অতঃপর মনে হয়: ‘সঙ্ঘে আমি একলা থাকি বটে/ একার পথে সঙ্ঘ টের পাই’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ১৮৬)। এই সমবোধনে, ঘুরে ফিরে সেই জীবনই তো তাঁর কাঁচামাল। আর তাঁর তখনকার জীবন তো বড়ো এলোমেলো! শৃঙ্খলার সেখানে নিতান্ত অভাব: মূলত তখন নিয়মের বাইরেই তাঁর পদচারণা! তবুও শঙ্খ ঘোষ তাঁর রুচি ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে সেই এলোমেলো জীবন থেকেই নিঃশব্দের উপাদান নির্বাচন করে নেন (বাসন্তী মুখোপাধ্যায় ২০১২: ০৪), কবিমুদ্রাক্ষরে উঠে আসে কৃতবিদ্য কবিতাসমূহ।
৩
‘একধরনের অতিমাত্রিক আত্মবিলাস, যা রোমান্টিক কবিতার প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল, মডার্নিজমের ঘেরাটোপে এসে তার রূপান্তর ঘটেছে মাত্র: সেই আত্মনাভিমূলসংক্রমণের অভীপ্সা দূরীভূত হয়নি মোটেও’ (খোন্দকার আশরাফ হোসেন ২০১০: ০৯)। এই উক্তিতে অতিমাত্রিক যে আত্মবিলাসের কথা উচ্চারিত হয়েছে, তা মূলত পূজিসভ্যতার উপজাত; ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তা ঔপনিবেশিক মননসঞ্জাত কাব্যপ্রযত্নের ফল। কিন্তু ‘রোমান্টিক কবিতার প্রান্তিক পর্যায়’ বলতে এখানে কোন সময়টিকে বোঝানো হয়েছে? রবীন্দ্রনাথের সায়াহ্নপর্বের সমানুবর্তী কালকে কী? তখন তো জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) এসে গেছেন! ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬) লিখা হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিকতাজর্জর সমাজের মর্মের বেদনা তাঁর হাতে প্রত্নরূপ নিতে শুরু করেছেমাত্র। কিন্তু ‘মডার্নিজমের ঘেরাটোপ’ তখনও কি তাকে বলা যায়? তাছাড়া এই আশ্রয়কে অভিলক্ষ্য করে ‘আত্মনাভিমূলসংক্রমণের অভীপ্সা’জাত বেদনাবিলাস কি আদৌ বাংলা কবিতার পর্ণ অবয়ব পেয়েছে? ‘নবোত্থিত ও ক্রমে পরিণত’ জীবনানন্দের তাবৎকাব্যপ্রয়াস কি মাত্র এটুকু প্রতীকে সীমায়িত? তাছাড়া ‘মডার্নিজম’ বলতে পশ্চিমে যা বোঝায়, তার ‘আত্মবিড়ম্বিত বিভাবনা ও বিশুদ্ধ শব্দের পাপ’ কি আদৌ অর্জিত হয়েছে বাংলা কবিতায়? যদি না হয়ে থাকে, তবে এই উক্তি কি তাবৎবিশ্বকবিতার আধুনিক যুগকে লক্ষ করে প্রণিত এক সরল সিদ্ধান্ত, নাকি কেবল প্রতীচ্যের শিখরস্পর্শী আধুনিকতার প্রতি দৃকপাত? যদি তা-ই হয়, তবে এ সিদ্ধান্ত নির্দ্বিধ যে, এমন দ্বিধাসংকুল ও প্রশ্নজর্জর মন্তব্যের কোনো অংশের সাথেই শঙ্খ ঘোষের কাব্য-প্রযত্নের ন্যূনতমও যোগ নেই। কেননা, সৌন্দর্য-চেতনায় ‘অপরিণত ও পরিণত ভাবের’ যে দুটি স্তর কল্পনা করা হয়, শঙ্খ ঘোষের যাত্রা তার দ্বিতীয়টির দিকে- ইন্দ্রিয়-আশ্রিত উপভোগমূলকতা থেকে বোধি-আশ্রিত সংযম-অভিমুখে: ‘যেখানে মঙ্গলের সঙ্গে সৌন্দর্যের মিলন’ (সত্যেন্দ্রনাথ রায় ২০১১: ১৬)। কিন্তু সেই সৌন্দর্য আসলে কী? এই যে প্রাত্যহিক যাপন এবং তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সে-ও তো সুন্দর! সুন্দর, কিন্তু সূক্ষ্ম-অর্থে নয়; এ হলো বাইরের স্তরের সুন্দর, ‘জীবনের পরিধি ছুঁয়ে থাকা ঢেউ’; আর আমাদের ভিতরে গভীরে, কেন্দ্রের দিকে, জমে ওঠে যে যাপনের নির্যাস (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১২); তা ভিতরের স্তরের সুন্দর। ‘তার আছে এক পরিবর্তমান অবয়ব’- তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বান্দ্বিক পরিপ্রেক্ষিতসহ রুচিমান অভিব্যক্তিতে উন্নীত করাতেই কবিতার সৌন্দর্য। ‘সেই সৌন্দর্যের সামনে কবির আমি আর তাঁর বাইরের সমাজ কেবলই মুখোমুখি হয়, কেবলই তার সংঘর্ষ, আর সেই সংঘর্ষ থেকে কেবলই আরেকটি তৃতীয় সত্তার উন্মেষ’ (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৩); যে মৌন, নিঃশব্দ। তাই প্রাত্যহিক যাপিত-জীবনের সামনে তৃতীয় সত্তাকে দাঁড় করানো, পরখ করা, করে ভাঙা এবং গড়ে তোলা মধ্যবর্তী এক নিরন্তর আবর্তনের মধ্যে, আর এই ভাঙা-গড়ার পথ ধরেই কবির যাত্রা চিরন্তন সৌন্দর্যের দিকে। সেই যাত্রাতেই যখন কবি টের পান যে, ‘বাইরের স্তরের অভ্যস্ত শব্দমালায় আর তার বিন্যাসে প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে মিথ্যের কলরব’ (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৪) তখন জীবনের প্রথম কবিতাতেই কূটকৃত্যাক্ষরে উঠে আসে:
এমন আকাশ হবে তোমার চোখের মতো ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির হবে মৃতের প্রাণের মতো উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছো সর্বময় রাত্রির গহনে মিশে- আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনো অবসাদে মূক আর কঠিন কুটিল রাত্রি জুড়ে-
হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্রিময় মালা,
মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা,
আমার জীবন তুমি জর্জরিত করো এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে
(শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ১৯)
এই এষণায়- মৃত্যুকে মনে হয় ফুল, প্রাণদাহী উদাসীন মালা; ফলে যে আকাশের স্বপ্ন দেখেন কবি তা হবে ‘নির্বাক পাথর’ আর তার দৃষ্টি হবে ‘স্থির: মৃতের প্রাণের মতো উদাসীন নির্মম শীতল’। জীবন তাঁর কাছে ‘ক্লান্তির কফিন’, সেখানে অন্ধকার: ‘তমস্বিনী মর্মরিত রাত্রিময় মালা’। সেখানেই মাটির প্রবল বুকে ‘তৃণের মতোন’ মিশে যাবার স্বপ্ন তাঁর, বাসনা অন্ধকারের গভীর আড়ালে তৃণময় শান্তি হবার। এই অন্ধকার চেতনা শঙ্খ ঘোষের নৈঃশব্দ্যতাড়িত জীবনবীক্ষণের ফল। তবে জীবনানন্দ দাশসহ উত্তর ত্রিশের কাব্যচেতনায় নেতিদর্শনের নন্দনরূপে আসে যে অন্ধকার, শঙ্খ ঘোষের মননে অন্ধকারের চিত্ররূপ তার চেয়ে ভিন্নতর। বরং তা সুপ্তিমুখি, হলাহলজাত হাহাকারের বহিঃপ্রকাশ। সেকারণে, বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) যে আঁধার আলোর অধিক (১৯৫৮) কাব্যটির বিপরীতে বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) যখন লেখেন সেই অন্ধকার চাই (১৯৭৭) কিংবা তারও পূর্বে রবীন্দ্রনাথ যে বহুতল অন্ধকারের কথা বলেন (রবীন্দ্রনাথ ১৪২২ক: ৫৮২), শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ঠিক তা নয়, সেইসব মনন-অভীপ্সাজাত (Intellectual curiosity) নিরাশা নয়, বরং আশা-নিরাশায় জড়িয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা সত্তা-অবস্থান তৈরি করে, প্রণয়ন করে জীবনের অন্য মানে- কবিতায় তার রূপ:
যেখানে যাও অতৃপ্তি আর তৃপ্তি দুটো জোড়ায় জোড়ায়
সদরে অন্দরে।
উদাসিনী নও কিছুতে- বুঝতে পারি তোমার বুকে
অন্য কিছু আছে,
যন্ত্রণা তার পাকে পাকে হৃদয় খোলে, সে-খোলাটার
অন্য মানে আছে।
(শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ২৯)
তাঁর কবিতার মধ্যে জীবনবোধের ও মানস-অভিক্ষেপের ঋজুতা ও স্বচ্ছতা আছে। আর আছে বিশ্বব্যাপ্ত বোধের ইশারা, সৃজনে মনন-অভিজ্ঞানের সংশ্লেষণে জীবন ও জগৎকে নতুনতর চোখে দেখতে পাবার ক্ষমতা। সেখানে জীবন বা জগৎ বিষয়ে একক কোনো সিদ্ধান্ত হয়তো মেলে না, কিন্তু তা ন্যূনতম একটি জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলে: সেই জিজ্ঞাসা থেকেই আলোড়ন ওঠে, অভিমুখীনতা তৈরি হয়। তাতে মানুষ ও তার মানবিক মর্যাদা সবিশেষ গুরুত্ব পায়,
এইভাবে, যন্ত্রণা আর তার পাকে পাকে খুলে যাওয়া হৃদয়ের যে বেদনা, যেখানে তৃপ্তি আর অতৃপ্তি মিলে মিশে থাকে, জোড়ায় জোড়ায় ‘সদরে অন্দরে’; এই বোধ শঙ্খ ঘোষের প্রজ্ঞাশাসিত মননের পরিচায়ক। প্রাকঔপনিবেশিক কালের পরিবেশনরীতিপ্রধান কাব্যের শ্রুতিফল থেকে উত্তরিত রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার পথ ধরে উত্তর-রাবীন্দ্রিক এষণাসমূহের জারিত অভিক্ষেপ এর মূলে। কেননা, হয়তো অভ্যাসেই অসচেতনভাবে ইজ্জবাংলা কবিতায় প্রায় একই বাগ্ভঙ্গী ও বচনবিন্যাস বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে অভ্যাসতাড়িত সেসব উচ্চারণ ক্রমেই হয়ে উঠেছিলো ক্লিশে নিষ্প্রাণ ক্লান্তিকর আর গ্লানিময়। ব্যবহৃত হতে হতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার নতুন যুগের নতুন অনুভবকে ধারণের ক্ষমতা। তখন বহুকালের অভ্যাসের পৃথিবীতে শঙ্খ ঘোষ নৈঃশব্দ্য থেকে আহরণ করে আনেন মৌনতামথিত শব্দ বাক্য ভাষা, বাচনের অনুপম-রীতি:
ক. আবার প্রভাত হলে পৃথিবী উন্মুখ হবে, রৌদ্র হবে ব্যধের মতন। (১৪২১: ১৯)
খ. আমাকে আবৃত করো ছায়াস্তৃত একখানি ধূসর-বাতাস-ঢালা অকরুণ আলোর মালায়। (২০১৫: ১০)
গ. কত ভালোবসে মৃদু স্বরে-সুরে বলি তাকে, রে দুরন্ত চোখ, স্পর্শ তাকে কোরো না কোরো না। (১৪২১: ২০)
ঘ. কতদিন মুঠো মুঠো এমন প্রভাত তুমি ধরেছ কিশোর? (২০১৫: ১০)
এইসব পঙ্ক্তিতে চিত্তের যে সংবেদনময় স্পন্দন চিত্ররূপ পায়, তা কোনো ‘প্রভাবপুষ্ট-কল্পপ্রভা’ বা ‘নৈমিত্তিক জীবনের চলচ্ছবিময়’ ঘটনামূলক আবেগমাত্র নয়। এর নেপথ্যের প্রাণনার মধ্যে উপলব্ধির দায় ও সৃজনের গভীরতার এক আবিশ্বশাসিত হৃদকম্পন আছে। উচ্চারণের গাঢ়তায় তারই বেদনাবেগ স্পন্দিত হয়: ইমনমথিত আদিপ্রেমাতুর বিরহব্যাকুলতায়, আহেরী-ভৈরবীর সুপ্তিনির্ঝর-কলকল্লোলে। সেকারণেই, শঙ্খ ঘোষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার চঞ্চল প্রাণধারাও ‘অন্তঃসার আভা, ভাবপ্রতিভা আর ভাবনাপ্রতিভায়’ জারিত হয়ে, দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে, বিরাটের মধ্যে থিতু হয়। এটি সম্ভব হয় কেননা, তাঁর কবিতার মধ্যে জীবনবোধের ও মানস-অভিক্ষেপের ঋজুতা ও স্বচ্ছতা আছে। আর আছে বিশ্বব্যাপ্ত বোধের ইশারা, সৃজনে মনন-অভিজ্ঞানের সংশ্লেষণে জীবন ও জগৎকে নতুনতর চোখে দেখতে পাবার ক্ষমতা। সেখানে জীবন বা জগৎ বিষয়ে একক কোনো সিদ্ধান্ত হয়তো মেলে না, কিন্তু তা ন্যূনতম একটি জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তোলে: সেই জিজ্ঞাসা থেকেই আলোড়ন ওঠে, অভিমুখীনতা তৈরি হয়। তাতে মানুষ ও তার মানবিক মর্যাদা সবিশেষ গুরুত্ব পায়, ‘অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা’ ও ‘ভাব-চেতনায়’ স্বচ্ছ বলে মতামতের গোড়ামীকে একেবারেই এড়িয়ে চলেন তিনি। কেননা, ‘মানুষ নিয়েই সাহিত্য, মতামতের গোঁড়ামিতে মানুষ ছোট হয়ে যায়’ (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ২০১২: ৫৩)। সেকারণে, যাবতীয় সীমাবদ্ধতা ও আদিম-পাপসমেত মানুষকে বড়ো করে তুলে ধরে স্পষ্ট ও তীর্যক কিন্তু আন্তঃবচ ধ্বনিতরঙ্গে শঙ্খ ঘোষের হাতে সাম্য সুশাসন আর মানবিক মর্যাদার পক্ষে বাণীবন্ধ রচিত হয়। আপাতবীক্ষণেই তাতে দেখা যায় বিপ্লবী-এষণার অনুরণন :
ক.
আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে-
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার
সবটুকুতেই শস্য যেনো ফলে।
নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
আমার হাড়ে পাথর করো জমা-
মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে
অস্ত্র গোড়ো আমায় করো ক্ষমা।
(শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৩২)
খ.
নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!
নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
মৃত্যুরই গান গা-
মায়ের চোখে বাপের চোখে
দু-তিনটে গঙ্গা।
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে নিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এপথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।
(শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৪৬)
উদ্ধৃতি ‘খ’তে প্রায় নিভন্ত বিপ্লবের চুল্লিতে পুনর্বার আগুন সঞ্চারের আর্তি তাঁর। যদিও নেকড়ের থাবায় মৃত্যু নিশ্চিত আর বাবা-মার চোখে ‘দুতিনটে গঙ্গা’, তবুও তিনি মৃত্যুরই গান গেয়ে যেতে বলেন, কেননা তিনি জানেন, এই যমুনা ও তার প্লাবধন্য মনুষের ইতিহাস রুখে দাঁড়াবার, পথ তৈরি করে পথ করে দিয়ে এগিয়ে যাবার। কিন্তু বিস্মৃতপ্রায় এই জনপদের ইতিহাসকে মাটিচাপা দিয়ে বেজে চলেছে পুজির ও পণ্যায়নের যে কিম্ভূত দামামা, তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলতে চান ‘নিপাত যাও’ বলতে চান ‘চুপ’ কিন্তু বলতে পারেন না, তাই ‘নিজেকে ছিঁড়ে ফেলেন দিনের পর দিন’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ৯১)। আর প্রথম উদ্ধৃতিটিতে কবির যেরূপ মৃত্যুবাসনা তার মজ্জায় লুকিয়ে আছে লজ্জা, গণমানুষের কল্যাণে কিছু করতে না পারার গ্লানিবোধ। সেকারণে, সবটুকু গোপন রক্তের বিনিময়ে হলেও একটু শস্যের স্বপ্ন তাঁর। আর আছে মহাঋষি দধীচির মতো এক অন্তিম বাসনা: দধীচি যেমন অসুরবধের অস্ত্র গড়বার জন্য তাঁর অস্থি দান করেছিলেন, কবিও বাসনা করেন, আবার মানুষ হবার যজ্ঞে তাঁর হাড়েই যেনো অস্ত্র গড়া হয়, আর তিনি যেনো নিঃশেষে ক্ষমাটুকু পান। এই যে আত্মধ্বংসী দ্রোহ ও তদ্সঞ্জাত তীব্র আর্তি, তা থেকে মানবিক মর্যাদা ও সাম্যদর্শনের প্রতি কবির ভাবাদর্শগত দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তো তিনি এমন মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা করেন, যার মধ্য দিয়ে মহাকালের দরবারে অমৃতের যাচাই হতে থাকে। খ্রিস্টীয় পুরাণে খ্রিস্টের মৃত্যুসংবাদকে এভাবেই মহিমান্বিত করা হয়েছে। মৃত্যুর আঘাতেই তাঁর অমৃতের শিখা পেয়েছে উজ্জ্বল-প্রকাশ। কেননা, মানুষের কাছে, ভীড়ের উপদ্রপের ভিতরে পাওয়া জয়ধ্বনিকে কোনো অর্থেই অমৃতের প্রকাশ বলে না। বরং যে মৃত্যু মানুষের জন্য, যেখানে তা অমৃত, সেখানে লোকদৃষ্টি নাইবা গেল, জাগতিকে হিসেবের পাল্লায় কিংবা স্মৃতির পরিমাণেই তো অমৃতত্বের পরিমাণ নয়। তাই তো কবিবোধের এই যে এষণা, তা মানবিক মর্যাদাকে ধারণ করে ক্ষণিকের মধ্যেই অনন্তকে দেখিয়ে দেয়, কারোরই ধারণায় আশ্রয়ের অপেক্ষা তার নয়। তাইতো একণ্ঠেই উচ্চারিত হতে পারে এমনও নিবেদন: ‘তোমার সূর্য আলো তোমার তোমারই থাক/ আমায় শুধু একটু কবর দিয়ো/ চাই না আমি সবুজ ঘাসের ভরা নিবিড় ঢাকনাটুকু/ মরাঘাসেই মিলুক উত্তরীয়’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৩২)। এইসব উক্তিতে উপলব্ধির যে মাত্রা, শঙ্খ ঘোষ তাতে ভীষণই সংবেদনশীল, প্রতীকী এবং ইঙ্গিতময়। পুরো কবিজীবনে এই প্রকরণসাধনাই ব্রত তাঁর। জীবনে একবারই মাত্র সরাসরি লিখেছেন ‘মারের জবাব মার’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ১৪৪)। কিন্তু সেখানেও গভীর অভিনিবেশসহ লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেই কবিতারও সারবস্তু শুধু এই একটি কথাতে নয়, পুরো কবিতা থেকে এটি একটি উদ্ভিন্ন-দৃষ্টান্ত মাত্র। কিন্তু পুরো কবিতার পরিপ্রেক্ষিতসহ পাঠ করলে এই পঙ্ক্তির দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনা মুহুর্মুহু পাল্টে যায়: দুপঙ্ক্তি দুপঙ্ক্তিতে গাঁথা বেশকিছু স্তবক, যার মধ্যে বারবকার ধুয়োর মতো আসে ঐ কথাটি: ‘মারের জবার মার’; কিন্তু, ‘স্লোগান’ শীর্ষক এই কবিতার শেষ দুটি পঙ্ক্তিতে কবি বলেন: ‘কথা কেবল মার খায় না কথার বড়ো ধার/ মারের মধ্যে ছল্কে ওঠে শব্দের সংসার (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ৩২)।’ এই কবিতার বিষয়ে শঙ্খ ঘোষের সরল স্বীকারোক্তি: ‘হিংসা-রাজনীতির যে হাওয়া বইছিল সেই সত্তর দশকের গোড়ায়, ওইসব স্লোগানের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল কত ‘ব্যক্তি’ হয়ে উঠবার সম্ভাবনা, সেই বোধ থেকেই লিখা হয়েছিল ওই কবিতা (শঙ্খ ঘোষ ২০০৯: ৬৩)।’ কিন্তু কবিতাটির শেষ দুই পঙ্ক্তিতে কথা দিয়ে বা শব্দ দিয়ে মারের একটা পাল্টা শক্তি তৈরি হয়। কেননা, তাঁর মননে মারের চেয়ে শক্তিশালী মনে হয় কথাকে বা শব্দকে; আর শব্দের চেয়ে নীরব নিঃশব্দকে। তাই নিঃশব্দ দিয়েই তিনি ধারণ করতে চান পরমভাবাপন্ন বোধকে, অযথার্থ শব্দের উচ্চারণমাত্রই যা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কথাটিকে আারও সঘনভাবে বলেন তিনি, ‘মানুষের কি কিছু বলার অধিকার আছে আরেক মানুষকে? কেননা তখন তো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে পরমের সঙ্গে সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্কেরই তো অন্য নাম নীরবতা’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১)। এই নীরবতার মধ্য দিয়ে কিংবা সেসব কথা ‘যাতে নীরবও গড়ে ওঠে’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১১) তার মধ্য দিয়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতায় মৌনমর্মর-নন্দন স্থাপিত হয়; তাতে ব্যক্তিমানস ও সমাজমানসের দায় মিলে মিশে থাকে। এই দুই মানসের যথার্থ সম্মিলনের ফলেই তাঁর কবিসত্তার সর্বজনীন আস্থাবাচক মাণদণ্ড তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৯৩) বলেন :
শিল্পের মধ্যে শিল্পী শুধু নিজেকে নয়, সমাজকেও প্রকাশ করে। যা তার নিজের জীবন তাও সমাজের সঙ্গে ভাষ্য, বিশ্বাস, আচার-বিচার প্রভৃতির মাধ্যমে অচ্ছেদ্য সম্পর্কে সম্পর্কিত। সমাজ সরাসরি, কার্যকারণসূত্রে, শিল্পে আত্মপ্রকাশ করে না বা প্রতিবিম্বত হয় না। শিল্পীসত্তা এতদুভয়ের মধ্যে এতদুভয়ের অংশরূপে- বিচ্ছিন্ন-স্বতন্ত্রভাবে নয়, জাগ্রত ও সক্রিয়। (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ২০০৭: ৯)
শঙ্খ ঘোষের কাব্যপ্রযত্নকে তুলনা করলে তাঁর কবিতায় স্পষ্টতই তিনটি অভিমুখ দেখা যায়, যার একটি আত্মমুখি নির্জন ব্যক্তিসত্তাময়; দ্বিতীয়টি তীক্ষ্ণ-পর্যবেক্ষণক্ষম ও সমাজমানসসম্ভূত; আর তৃতীয়টি, ব্যক্তিবোধ ও সমাজমানসের দ্বান্দ্বিক মিথস্ক্রিয়াজাত। এই ত্রিমুখি অভিমুখেই শঙ্খ ঘোষের কবিকৃতিত্ব নৈঃশব্দ্যের ভাষা-নির্মাণে। কিন্তু এই নিখিল নৈঃশব্দ্যময় চেতনার অন্তরালে ব্যক্তিকবির বোধ ও আত্মজ-অনুরণন হারিয়ে যায় না; বরং বাহ্যিক-আলোড়নের প্রবল প্রতাপ সহ্য করেই শরীরময় অনুভব ও নিঃস্পৃশ্য প্রেম শতমুখ উৎসারিত হয়।
দেবীপ্রসাদের এই শিল্পবীক্ষণের সাথে শঙ্খ ঘোষের কাব্যপ্রযত্নকে তুলনা করলে তাঁর কবিতায় স্পষ্টতই তিনটি অভিমুখ দেখা যায়, যার একটি আত্মমুখি নির্জন ব্যক্তিসত্তাময়; দ্বিতীয়টি তীক্ষ্ণ-পর্যবেক্ষণক্ষম ও সমাজমানসসম্ভূত; আর তৃতীয়টি, ব্যক্তিবোধ ও সমাজমানসের দ্বান্দ্বিক মিথস্ক্রিয়াজাত। এই ত্রিমুখি অভিমুখেই শঙ্খ ঘোষের কবিকৃতিত্ব নৈঃশব্দ্যের ভাষা-নির্মাণে। কিন্তু এই নিখিল নৈঃশব্দ্যময় চেতনার অন্তরালে ব্যক্তিকবির বোধ ও আত্মজ-অনুরণন হারিয়ে যায় না; বরং বাহ্যিক-আলোড়নের প্রবল প্রতাপ সহ্য করেই শরীরময় অনুভব ও নিঃস্পৃশ্য প্রেম শতমুখ উৎসারিত হয়। সেখানে প্রকৃতি যেন সমস্ত অশূচিকে কিংবা ‘বেঢপ প্রকাশের লজ্জাকে’ অপ্রকাশের শ্যামল অমৃতের ধারায় ধুয়ে দেয়। তাতে প্রস্ফুটিত হয় যে পুষ্পরাজি তা অন্তর্লোক থেকে বহন করে নিয়ে আসা ডালিতে প্রতাপ ও প্রকাশের কলুষিত পদচিহ্নগুলোকে লাবণ্যে ভরিয়ে তোলে। জানিয়ে দেয়, এতটুকুমাত্র হলেও কমনীয়তা আর চিরকালীনতার মূল্য কী! সেখানে আত্মগত সবটুকু অহংয়ের নিঃশর্ত সমর্পণে প্রণয়ভাষ্যও নৈঃশব্দ্যে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে :
ক.
মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে,
বলা হয় না কিছু-
আকাশ যেন নামতে থাকে নিচুর থেকে নিচু
মুখ ঢেকে দেয় মুখ ঢেকে দেয়, বলা হয় না কিছু।
(শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ২২)
খ.
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রূপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কীভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?
(শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ২১৬)
এমন কবিতাগুলোয়, ‘একটিও অতিরিক্ত শব্দের ব্যবহার সম্ভব নয়, এই নির্দেশের দ্বারা, বাইরের দিকে যা মুক্ত তাকে ভিতর থেকে বিন্যস্ত করে নেওয়া হয় গাঢ়তায়’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২০: ১৭)। কিংবা জলে ভাসা খড়কুটোয় (২০১১) একেবারে কথা বলার গদ্যচালে একটা ভাসমান সংলাপের মতন কথা বলেন তিনি। খুব গোপন কথা। শরীর দিয়ে ভালোবাসবার কথা। একেবারে শেষে জুড়ে দেন মিশ্রকলাবৃত্তে লেখা চার টুকরো কবিতা, সেখানে এসেই ছিঁড়ে যায় স্রোতটি, তার জন্যই দারুণ এক আসক্তি আর মুক্তির স্বাদ তৈরি হয়। সেই কবিতাসমূহ মিশে যায় দেশের জলমাটির সঙ্গে। বটপাকুড়ের ফেনায় (২০১১) আবার তিনি অজানা অনামী সব হিতকরী উদ্যোগের কথা বলেন, যেখানে ‘শেঁকড়-পচা’ ‘পাতা-ঝরা’ ‘কুঁড়ি না ফোটা’ বর্তমান সময়টিরও আশা করবার মতো একটা চরিত্র তৈরি হয়। একই সঙ্গে, এখন সব অলীক (১৪০১) বা অবিশ্বাসের বাস্তবের (২০০৩) মতো কাব্যে নিজের সময় এবং যাপিত-জীবন নিয়ে একটি হতাশাবোধ অনুভব করা যায়। তবে তাকে আশা-নিরাশার কোনো দ্বিকোটিক বিভাজনে বিন্যস্ত করা যায় না। একই সময়ে হতে পারে এসব: একই মুহূর্তে হতে পারে এই দুই বিপরীত অনুভব! তবে, যে-বইয়ের শেষ লেখার নাম ‘আর এক আরম্ভের জন্য’ তা কেন অতো হতাশাজনক হয়? এখন সব অলীকের বেশির ভাগ লেখাতেই তো আছে তাঁর যৌবনদিনগুলির কথা, দেখা-কিছু আশ্চর্য মানুষজনের কথা, ইচ্ছে করলেও যাঁদের বা যেসব আর ছুঁতে পারা যাবে না। কিংবা অবিশ্বাসের বাস্তব: সেখানে তো আছে সম্পর্কগত অবিশ্বাসের প্রবহমানতাকে বুঝে নিয়ে তাকে দূর করবার কিছু কর্মপ্রকল্পনা বা স্বপ্নকল্পনা। চারদিকে একটা অবিশ্বাসের হাওয়া ছড়ানো আছে, কিন্তু তাকে সরিয়ে দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি ভূমি, দেরি হয়ে গেলেও এখনও তা সম্ভব, এটিই তো বিশেষভাবে বলা আছে তাতে?
৪
‘একালে কবিদের কাছে বস্তু ও বিষয়ের নিজস্ব গুরুত্ব অপেক্ষা ব্যবহার-তাৎপর্যের মূল্য অনেক বেশি’ (ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় ২০০৮: ২৮০), শঙ্খ ঘোষের সমকালীন বাংলা কবিতা বিষয়ক যে পরিবীক্ষণ থেকে এবং যে অভিলক্ষ্যে এই উক্তি উঠে এসেছে; শঙ্খ ঘোষের কাব্যএষণা তার থেকে শুধু ভিন্নতরই নয় বিপরীতও। কেননা, বস্তু ও বিষয়ের বাহ্যিক আবেদন ও ব্যবহারিক তাৎপর্যমূলক স্থূল কাব্যপ্রযত্ন থেকে নিজেকে বিরত রাখার ব্যাপারে তিনি প্রায় প্রথম থেকেই সতর্ক। একেবারে নিহত পাতাল ছায়া (১৯৬৭) থেকেই। ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ তখনই লেখা। এমনকি ‘নিশঃব্দের তর্জনী’কে নিহিত পাতালছায়ার ভূমিকাও বলা যায়। এ প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ নিজেই বলেছেন:
বাইরের কোনও তাগিদ ছিল না। কেউ চায়নি, কেউ চেপে ধরেনি, এমনি এমনি একটা গদ্যলেখা হয়ে গেল, জীবনে মাত্র ওই একবারই ঘটেছিল সেটা। ১৯৬৬ সালে। সেই সময়ের মধ্যে লেখা হয়ে গিয়েছিল ‘নিহিত পাতালছায়া’র প্রায় সব কবিতাই। তাই ঠিক ভূমিকা না বলে ওকে ও-বইয়ের পক্ষে একটা কোনও ম্যানিফেস্টো হয়তো বলা যায়। (শঙ্খ ঘোষ ২০০৯: ৬৫)
অর্থাৎ, তখন থেকেই কেবল অন্তরের আলো বা অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্যের ইঙ্গিতময় অর্থের অনুপূরক ভাব ও বিভাবনার সাপেক্ষে সমাজপরিপার্শ্বকে তিনি চিনে নিতে সচেষ্ট। সেই চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টায় যে বিচিত্রবিধ অভিজ্ঞতা হয়, তাঁর কবিতায় সেসব অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ে মাত্র। ফলে, ‘লোকাভিজ্ঞানের স্পর্শ লাগে কবির শিল্পভাবনায়’ (বিপ্লব চক্রবর্তী ২০০৬: ৪১০)। তাতে জারিত কবিপঙ্ক্তিতে উঠে আসে এমন কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো একেবারে অনুভবের গভীরে গিয়ে বিঁধে। অসাঢ় ভাষার মধ্যে এই স্পর্শকাতরতা জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয় ছকবাঁধা বিন্যাসের অনায়াস পারম্পর্য ভেঙে নতুনতর বিন্যাসভঙ্গিতে পৌঁছানোর, মিথ্যে অভ্যেসের ‘গাঁটগুলিকে’ ভেঙে ফেলার। ‘একটি বাক্য বা বাক্যখণ্ডের মধ্যে শব্দ সাজাবার যে পদ্ধতি, তারই মধ্যে থেকে যায় এই গাঁটগুলি। ঠিক শব্দের উপরেই আঘাত তত জরুরি নয়, যতটা জরুরি মধ্যবর্তী ঐ অংশগুলির উপরে আঘাত, দুই শব্দের সংযোগ-বিন্দুর উপরে (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৬)।’ কিন্তু সেই সংযোগ-বিন্দু তো অদৃশ্য! তাহলে? ‘আমাদের অস্তিত্ব এমনিতেই ভিতর থেকে নানাখানা হয়ে আছে এবং তার একটা দিক বাইরে মুখ-ফেরানো, অন্যদিক ধরা আছে কেন্দ্রে। বাইরের দিকটায় সদা-সতর্ক প্রহরির মতো পরিবীক্ষণরত আছে যে চোখ তা যদি একবার ‘ফিরে আসে মূলে’ অমনি ‘খুলে যায় রজনীর নীল’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ৯১); কবি তখন নিচু হয়ে নিজেকেই জিজ্ঞেস করেন: ‘পুরোনো গাছের গুঁড়ি, বাকলে ধরেছে কতো ঘুণ? (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ৯১)। এই প্রশ্নে প্রকম্পিত হয়ে বাহির আর ভেতর এই দুইয়ের সর্বায়ত-সংগতি যতই ছিন্ন হতে থাকে, কবিতা হয়ে ওঠে ততই বেদনারক্তিম, ততই টান-টান চেতনা ধরা পড়তে থাকে এই দুই বিপরীত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১২)।’ বাইরে ফেরানো চোখে ধরা পড়ে এই ‘রণ-রক্ত-সফলতার’ পৃথিবী, আর ভেতরের অসংখ্য চোখে অনন্ত সংবেদনকেন্দ্রে ধরা পড়ে জন্মের ভূমি: পাবনার বানারিপাড়া পাকশী পদ্মা, তার জলে ডুব দিয়ে জেগে ওঠা; বিপুল-প্রতিষ্ঠিত হয়েও ভীষণ-উন্মূল উদ্বাস্তুতা, দুঃস্বপ্ন আর তার অবয়বহীন অভিমানময় ভালোবাসার বিপুল উত্থান, চরাচরব্যাপী বিষণ্নতা। যা তাঁর এক হাতে তুলে দেয় ‘দেশনিহিত কাল’ আর অন্যহাতে তুলে দেয় ‘দেশোত্তর কালের যন্ত্রণা’। নিজেরই এই হাতদুটি দিয়ে স্পর্শ করলে, তিনি জানেন, ‘ভস্ম হয়ে যাবে ঐ মুখ’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ২১০)। ফলে ‘ভস্মাসুরের মতো’ দুই হাতে দুই বিষমবোধ ও বোঝা নিয়ে তিনি টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অস্থির সময় আর তার তপ্ত পাটাতনের উপর। সময়ের এই জটিল প্রত্যাঘাতই তাঁর চেতনা ও চেতনার উপজাত কবিতাকে এক মুহূর্ত থেকে অন্যমুহূর্তে ‘ঠেলে সরিয়ে দেয়’। নিজের ব্যক্তিকাল নিয়ে নিঃসংশয় হওয়া তাঁর আর হয়ে ওঠে না। ‘সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন’ হয়ে গেলে ‘বজ্র থেকে পাঁজর আবার খুলে যায়, আকাশ থেকে ঝোলে গাছের মূলে’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ১০১)। আরো একটু ‘অন্তর্যানী’ হয়ে তিনি এই ব্যক্তিকালকে অন্যএকটি সময়ের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় দেখেন। যে সময়কে বলা যায় মানবকাল: ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’, ব্যক্তিকালের বিলোপের পরও মানবকাল থাকে। আরও একটু ‘অন্তর্যানী’ হয়ে তিনি অনুভব করেন বিশ্বজাগতিক অনাদ্যন্ত কালপ্রবাহের মধ্যে সত্তার বিম্ব-অবস্থান: ‘ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব-চরাচর।/ অস্ফুট মন আকাশে, জগত সংসার ভাসে’ (স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৬: ১০৩)।’ তাতেও ক্ষান্ত হয় না, ধীরে ধীরে সেই ছায়াদল ‘মহালয়ে’ প্রবেশ করে, ‘‘বহে মাত্র ‘আমি আমি’ এই ধারা অনুক্ষণ’’ (স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৬: ১০৩)। সে ধারাও বদ্ধ হয়, শূন্যে শূন্য মিলিয়ে যায়, ‘‘অবাঙমনসোগোচরম’ বোঝে প্রাণ বোঝে’ (স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৬: ১০৩)। মানস গোচরের ‘অবাঙ’ এই বোধ একইসঙ্গে ‘ভঙ্গুর ভারাতুর ভীতিময়, আবার তা একই সঙ্গে রঞ্জিত রহস্যাতুর রতিময়জ্জতার ধারক সেই প্রবাহ হলো এক বিশ্বকাল (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৩)। শঙ্খ ঘোষ যখন এর বাইরে এসে দাঁড়ান পরিব্যাপ্ত কোনো ‘না-আমির’ মধ্যে তখন প্রতিমুহূর্তে নিজেকে দেখেন এই ‘ব্যক্তিকাল মানবকাল আর বিশ্বকালের’ সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রে। কখনো সেই সম্পর্ককে মনে হয় সমন্বয়ের দিকে যাত্রা আবার কখনওবা তাকে আবিষ্কার করেন প্রবল সংঘর্ষে। এই অনুভবের ঢেউ কখনো কখনো এগিয়ে এসে পৌঁছে যায় ঔদাস্যপূর্ণ নিশ্চয়তার তটে, আবার কখনওবো তা দূরে সরে যায়। এই ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেই জড়িয়ে যেতে থাকে তাঁর সমস্ত ব্যক্তিকাল মানবকাল আর বিশ্বকাল: কবি শঙ্খ ঘোষের ব্যক্তিগত সমাজ ইতিহাস স্মৃতি আর প্রকৃতি। নিজেকে নিজের বাইরে এনে, এর যে-কোনো-একটির সঙ্গেই কেবল নিবিড় সম্পর্ক পাতিয়ে তিনি লিখতে পারেন না প্রত্যক্ষ-অর্থের আলোড়নময় কোনো কবিতা। কেননা, উন্মূল শৈশবচূত দুঃস্বপ্নকাতর চেতনা অবলীলায় জড়িয়ে যায় আরও সব আভ্যন্তরিক সম্পর্কে। তখন আর কোনো অর্থ তৈরি হয় না, নিরর্থকে আশ্রয় করে পৌঁছানোও যায় না কোনো সিদ্ধান্তে: ‘এটাই লজ্জার। এখনও মজ্জার/ভিতরে এতা আগুপিছু’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ২৩৬)। কেননা, জীবন যেনো দ্বিধাথৈথৈ এক কৃপণ সমুদ্র, আর ‘অগস্ত্যের চুমুক শুষে নেয় সব জল’ (শঙ্খ ঘোষ ১৪২১: ২৩৭); এই শূন্য নিরালম্ব হাহাকারময় মরুতে দাঁড়ানো ব্যক্তির বাইরের জৌলুস চুল্লিতে শবের স্বাস্থ্যের মতো খসে পড়ে, ‘যা কিছু ব্যাক্তিগত’ তার সব ‘নিয়ন আলোয় পণ্য হয়ে যায়’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৫: ১৩৪)। সেখানে, ‘শব্দের উৎসভূমি সমৃদ্ধ ও স্বতঃপ্রবাহী ঐতিহ্যলোক, সমাজ ও দ্বান্দ্বিক প্রতিবেশ-প্রকৃতি। এই অবতল থেকে গড়ে-ওঠা আবর্তনশীল ভাষাকাঠামো কবিতার আকরণে শব্দশিল্পীর রহস্যময় মনোজগৎ স্পর্শে বহুমাত্রিক অর্থ নির্মাণ করে’ (বেগম আকতার কামাল ২০১৩: ২৪৯); তাকে সূত্র করে শঙ্খ ঘোষ ডুব দেন নৈঃশব্দ্যের অতলে, মন্ত্রগুপ্তির মতো ঈষৎ অর্থের নিঃসীম অন্বেষণে।
৫
‘সবটা বলার কথা নয়/ কথার শরীরে মাথা রেখে/ কেবল হারিয়ে যেতে হয়’ (শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৪: ৭৪), এইকথা সাক্ষ্য দেয় যে, ‘শব্দহীন’ হওয়া বা ‘নৈঃশব্দ্যের নিবেদন’ মানে ‘শব্দ থেকে পালানো’ নয়, ‘শব্দকে ঈথারমণ্ডিত করে তোলা: অভ্যস্ত শব্দসম্পর্কের আলস্য ভেঙে দিয়ে তার মধ্যে সত্যের প্রবাহ নিয়ে আসা’ (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৪)। শঙ্খ ঘোষ কবিতায় এই কাজটিই করেন, ‘মৌনতা’ দিয়ে ‘নীরবতাকে’ নয় বরং ‘শব্দ’ দিয়েই নৈঃশব্দ্যকে’ রচনা করেন তিনি। সেকারণেই ‘নতুন শব্দের সৃষ্টি’ নয়, বরং ‘শব্দের নতুন সৃষ্টি’ই তাঁর অভিপ্রায় হয়ে ওঠে। এই শিল্পপ্রকল্পনায় নিঃশব্দকে স্পর্শ করতে গিয়ে তিনি রচনা করেন ‘নিঃশব্দে কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা’। কেননা, কেবল ‘শব্দই জানে কেমন ক’রে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ সূত্র না ছিঁড়েও’। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ কোথায় পেলেন তার খোঁজ? প্রকৃতিতে? না। কেননা ‘সে তো ছাড়ে না কখনো, তার সঙ্গে রয়ে গেছে দিনরাতের লড়াই। প্রকৃতিও বিষম বাচাল। মৌন জানে শুধু মানুষেরই বুক’ (শঙ্খ ঘোষ ২০১৪: ১৩)। ব্যাপ্তির চেয়ে গভীরতার চাপ সেখানে খুব বেশি, পরিধির চেয়ে কেন্দ্রের। আর কবিতা যখন সেই কেন্দ্রকেই ছুঁতে চায়, তখন সে হয়ে আসে কথাবিরল সাজবিহীন। খুব সহজেই তা মৌন হতে জানে, ডুব দিতে পারে নৈঃশব্দ্যের অতলে। যেখানে সে পেয়ে যায় নিবিড় আয়তন; শব্দের অবধারিত অর্থের অনিবার্য উপযোগিতা; তার বাইরের যাবতীয় অরংকারকেই সে অনায়াসে ছেঁটে ফেলতে পারে। তখন কবিতায় থাকে শুধু যাপনের নির্যাস। আছি, আমি আছি- এই ধ্বনি তখন শোনা যায় প্রশ্বাসের আবর্তে, আর দলবাঁধা শব্দসব ধাবিত হয়ে চলতে থাকে শেষহীন নীরবের দিকে’ (সন্দীপন চক্রবর্তী ২০২০: ২১৫): সুজান সান্তাজ (Susan Sontag, ১৯৩৩-২০০৪) যে-অভিলক্ষ্যে বলেছেন, ‘… he is more satisfied by being silent than by finding avoice in art’ (Susan Sontag ২০০৯: ১৫), সে-অর্থেই শঙ্খ ঘোষও তাঁর কবিতার ভেতরে এই নীরবতাকে প্রণয়ন করে চলেন- নীরবতারই মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য; ‘যেখানে কণ্ঠ ফিরে পায় তার সুঠাম স্বর, গতি ভিতরে জায়গা রেখে দেয় যতির জন্য’।
তথ্যপঞ্জি
১. সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে আলাপচারিতায়, চার বছর কবিতা লিখেও প্রকাশ না করবার প্রসঙ্গটি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন এভাবে : ‘বছর চারেক লিখিনি তেমন কিছু। …ভেবেছিলাম, কিচ্ছু হচ্ছে না লেখা, তাই লিখবই না কিছু। ওরই মধ্যে কখন টুকরো টুকরো কয়েকটা লাইন লিখেও ফেলতাম এলোমেলো, যাকে মনে হত না-লেখা। এ কিন্তু সন্দীপনের অর্থে সেই না-লেখকের না-লেখা নয়। সন্দীপনের না-লেখা ছিল চলতি লেখার উচ্চারিত প্রতিবাদ। আমি ভাবছিলাম নিরুচ্চার লুকিয়ে ফেলবার কথা।’ (হর্ষ দত্ত ২০০৯: ৬৩)
২. জীবনের সাথে কবিতার সম্বন্ধের কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন: ‘আমি বলতে চাই না যে কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনো সম্বন্ধ নেই; সম্বন্ধ রয়েছে- কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকটভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুইরকম উৎসারণ; জীবন বলতে আমরা সচরাচর যা বুঝি তার ভিতর বাস্তব নামে আমরা সাধারণত যা জানি তা রয়েছে, কিন্তু এ অসংলগ্ন অব্যবস্থিত জীবনের দিকে তাকিয়ে কবির কল্পনা-প্রতিভা কিংবা মানুষের ইমেজিনেশান সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় না; কিন্তু কবিতা সৃষ্ট করে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনা-মনীষা শান্তিবোধ করে।’ (জীবনানন্দ দাশ ২০০২: ১৭)
৩. কবিতার কথা শীর্ষক গ্রন্থের ‘কবিতার কথা’ শীষক প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ এই শব্দসমূহ বারবার ব্যবহার করেছেন।
রচনাপঞ্জি
খোন্দকার আশরাফ হোসেন (২০১০), কবিতার অন্তর্যামী, নান্দনিক, ঢাকা
জীবনানন্দ দাশ (২০০২), কবিতার কথা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (২০০৭), রূপ রস ও সুন্দর, নয়া উদ্যোগ, কলকাতা
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (২০১২), আমরা ও তাঁহারা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় (২০০৮), কবি ও কবিতার বিষয়-আশয়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
বাসন্তী মুখোপাধ্যায় (২০১২), ‘কবিতা ও আধুনিকতা’, আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখো, প্রকাশ ভবন, কলকাতা
বিপ্লব চক্রবর্তী (২০০৬), ‘শঙ্খ ঘোষের কবিতায় লোকাভরণ’, লোকাভরণ: আধুনিক কবিতার শৈলী, পুস্তক বিপনি, কলকাতা
বেগম আকতার কামাল (২০১৩), কবির চেতনা: চেতনার কথকতা, ধ্রুবপদ, ঢাকা
শঙ্খ ঘোষ (১৪২০), ছন্দের বারান্দা, অরুণা প্রকাশনি, কলকাতা
(১৪২১), কবিতাসংগ্রহ্ল-১, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
(১৪২২), কবিতাসংগ্রহ্ল-২, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
(১৯৯৭), ‘পা তোলা পা ফেলা’, কবিতার মুহূর্ত, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
(২০০৯), ‘সকলেই একটি আশ্রয়ের কথা ভাবছে’, বইয়ের দেশ (সম্পাদক: হর্ষ দত্ত), জুলাই-সেপ্টেম্বর, কলকাতা
(২০১৪), নির্বাচিত প্রবন্ধ: নানা প্রসঙ্গ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা
(২০১৫) শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
শচীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯৯৪), প্রণীত অসুখ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৪২২), ‘কেকাধ্বনি’, বিচিত্র প্রবন্ধ, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা
(১৪২২), ‘সাহিত্যের পথে’, সাহিত্য, বিশ্বভারতী গ্রন্থবিভাগ, কলকাতা
সত্যেন্দ্রনাথ রায় সম্পা. (২০১১), ‘ভূমিকা’, রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎ: শিল্পচিন্তা, গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটিড, কলকাতা
সন্দীপন চক্রবর্তী (২০২০), ‘নীরবতা ধ্বনি চায়, ধ্বনিও চেয়েছে নীরবতা’, পুনশ্চ বাংলা পত্রিকা (সম্পাদক: পিনাকেশ সরকার), বাংলা বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
স্বামী বিবেকানন্দ (২০১৬), ‘পাতঞ্জল-যোগসূত্র’, রচনাবলী, স্বামী বিবেকানন্দ গবেষণা কেন্দ্র, কলকাতা
Susan Sontag (২০০৯), ‘The Aesthetics of Silence’, styles of radical will, Penguin Classics, United States
W. B. Yeats (১৯৮৯), ‘ A Prayer For Old Age’, The Collected Poems (edited by: Richard J. Finneran), Macmillan Publishing Company, New York

আবুল ফজল। জন্ম ১৯৮৫। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। অধ্যাপনা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র : ভাবাদর্শ; আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব; সংস্কৃতি অধ্যয়ন; দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, জেন্ডার অধ্যয়ন, উত্তর-উপনিবেশবাদী ও ব্যুপনিবেশবাদী সাহিত্য ও তত্ত্ব। ২০২৩ সালে প্রকাশ হয়েছে মহাভারতের দেশ। সাহিত্যপত্রিকা ‘শিল্পধাম’ সম্পাদনা করেন।