পাঠ প্রতিক্রিয়াপাঠপর্ব

সিনেমার রাজনীতি : পাঠ পর্যালোচনা

বিশ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্র। এর মধ্য দিয়ে একটি দেশের রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিফলন দেখা যায়। আরও সংক্ষিপ্ত করে বললে—সিনেমায় সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রকাশ ঘটে ভীষণভাবে। সিনেমা যেমন দর্শকদের কয়েক ঘণ্টা বিনোদনের সুযোগ করে দেয়; তেমনি বড় পর্দার সামনে উপস্থিত চরিত্র ও গল্প তাদের এক বাস্তবতার সামনে নিয়ে আসে, যা হয়তো তার ধরাছোঁয়ার বাইরে; অথবা দর্শকের আশপাশেরই চিত্র—যা হয়তো তিনি আগে এভাবে দেখেননি। সিনেমা জনমত গঠনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি জনগণের মানসগঠন, তার চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি গঠনেও এ শিল্পমাধ্যমের শক্তিশালী রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি মূলত সাংস্কৃতিক রাজনীতিরই বিকট প্রকাশ। তবে বিভাজনের রাজনীতিকে উৎসাহিত করার দিক থেকে এর ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর বিভিন্ন সময়ে এর প্রকাশ ঘটেছে ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্তির সমন্বয়ে। এই ক্ষমতা কাঠামো এবং তার সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রকাশ, যা ঘটেছে সিনেমার মাধ্যমে—সেটিকে আ-আল মামুন প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন ‘সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতি: আধুনিকতা জাতীয়তা আত্মসত্তা’ গ্রন্থে।

গ্রন্থটি সম্পর্কে ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে, “সিনেমা নিয়ে বই, অথচ এ বই সিনেমাবিদ্যার নয়। সিনেমাকে একটা ‘ফিল্ড’ ধরে দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র এবং আমাদের যাপিত সময়কে বুঝবার একটা প্রচেষ্টা। সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এ বইয়ের ভাষা তৈরি করে দিয়েছে। বাংলা সিনেমায় হাজির হওয়া কিছু সামাজিক প্রতর্কে লেখক লিপ্ত হয়েছেন। অধ্যায়গুলো সেভাবেই বিন্যস্ত। সময়টাও নির্দিষ্ট—একবিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশক। সিনেমার রেপ্রিজেন্টেশন আমলে নিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এবং পাঠ করেছেন কতিপয় প্রবণতা। আর এ সফর শেষ করেছেন একটা প্রস্তাবনা হাজির করে। সে প্রস্তাবনা অনেকেই হয়তো মানবেন না, তবে সেগুলো নিয়ে না ভেবেও পারবেন না।”

সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের এখানে গবেষণা কম হয়নি। তবে সমসাময়িক কাজের সঙ্গে আগেকার কাজের কিছু পার্থক্য রয়েছে। সংস্কৃতিকে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বর্গের সঙ্গে মিলিয়ে বক্তব্য হাজির করার প্রয়াসটা আগে সেভাবে দেখা যেত না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন ধাঁচের এ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আসছে। আর এ ক্ষেত্রে ‘নিউ লেফট’ ঘরানার একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক রাজনীতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আন্তোনিও গ্রামসির নীতিগত প্রভাব ভীষণভাবে ক্রিয়াশীল। গত অনেক দশকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, এই চিন্তার প্রভাব আমাদের এখানে সুস্পষ্টভাবেই পড়েছে। সমসাময়িক বহু লেখক, গবেষক এ ধারায় বা কাছাকাছি চিন্তায় কাজ করছেন।

আলোচ্য গ্রন্থের লেখক আ-আল মামুনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেও এ প্রভাব লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে লেখক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আশির দশকের ইংল্যান্ডে যে নতুন সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন শুরু হল তার উৎসাহ এসেছিল আন্তোনিও গ্রামসির সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিষয়ক লেখালেখি থেকে। সে কথা স্টুয়ার্ট হলও তার লেখায় গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। একই সময়ে ভারতে ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ্যার সমালোচনা আকারে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চাও শুরু হয়েছে গ্রামসির লেখালেখি থেকে উৎসাহী হয়ে। পার্থ মনে করেন, এই দুটি ধারা আধুনিকতা ও সংস্কৃতি নিয়ে একাডেমিক আলাপ-আলোচনার প্রসঙ্গগুলোকেও অনেকটা বদলে দিয়েছে। ‘আধুনিকতা’ বর্গটি পুরোপুরি সমস্যায়িত হয়ে পড়ায়, তার মতে, এখন আর পূর্ণ বিকশিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলো দিয়ে জনপ্রিয় সংস্কৃতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; বরং আমাদের শুরু করতে হবে জনপ্রিয় সংস্কৃতির চর্চাগুলো থেকেই। সেগুলোর বিভিন্ন ফর্মের ভিতরে অবগাহন করেই ক্রিটিক গড়ে তুলতে হবে। এ রকম এক তত্ত্বীয় ও পদ্ধতিগত জায়গা থেকেই আমি সিনেমার দিকে তাকিয়েছি। আমাদের বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমি বস্তুত এ ধরনের ক্রিটিকেই আগ্রহী।”

লেখক ভূমিকায় নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। পশ্চিমা আধুনিকতা, সেক্যুলারিজম, ধর্ম ও রাজনীতি, মুসলমান পরিচয়, পরিচয়ের রাজনীতি ইত্যাদি তাঁর আগ্রহের জায়গা এবং এ বিষয়গুলোকে কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিচারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। যে ছাঁচ চাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে লেখক এর বাইরে গিয়ে আত্মসত্তার পরিচয় খুঁজেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলা, সে হামলার সূত্রে জারি হওয়া ‘সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধ’, মিডিয়ার নির্মাণ, যুদ্ধের অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সক্রিয় চিন্তাভাবনা লেখকের সাবঅল্টার্ন ভাবনাকে আরও বিকশিত করেছে। আলোচ্য গ্রন্থে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।

সিনেমা হচ্ছে লালন সাঁইকে নিয়ে; কিন্তু তা দেখা হচ্ছে জমিদারের চোখে। আর এ কারণে লালনের তত্ত্ব প্রাধান্য পায়নি, যা তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল; বরং তাঁর জীবনের বিশেষ কিছু অংশ প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে নির্মাতাদের স্বার্থসিদ্ধ হয়।

গ্রন্থটিতে ভূমিকাসহ ছয়টি অধ্যায় ও একটি পরিশিষ্ট রয়েছে। অধ্যায় ১: বাংলা সিনেমায় শ্লীলতা-অশ্লীলতার ডিসকোর্স/ বাংলা সিনেমা উদ্ধারপ্রকল্প: চন্দ্রকথা, ব্যাচেলরদের পোয়াবারো। এ আলোচনায় লেখক শ্লীল-অশ্লীল বিতর্কের এক ভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। আর এখান থেকে কারা কীভাবে লাভবান হয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন, তথাকথিত অশ্লীল চলচ্চিত্রগুলোকে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র দর্শকের কথা মাথায় রেখে নির্মিত হয়। বাংলাদেশের সিনেমা হলে যখন শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির যাতায়াত প্রায় বন্ধ, তখন ওই মধ্যবিত্তদের হলে ফিরিয়ে আনতে ‘ব্যাচেলর’ ও ‘চন্দ্রকথা’র মতো সিনেমা নির্মিত হয়। লেখক এই চলচ্চিত্রগুলোকে সমানভাবে ‘অশ্লীল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন—পূর্ববর্তী ‘অশ্লীল’ সিনেমাতে যেমন উদ্দাম যৌনতা দেখানো হতো; এর জায়গায় নতুন ধারার ‘অশ্লীল’ সিনেমায় মধ্যবিত্ত দর্শকের আকাঙ্ক্ষিত যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া সংলাপের মাধ্যমে তা করা হয়। ‘অশ্লীলতা’ জারি রেখে নিয়ন্ত্রকদের চেহারা বদলে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে কথিত গণমাধ্যমকেও লেখক প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। গণমাধ্যম নামধারী মিডিয়া যখন মধ্যবিত্তশ্রেণির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নির্মিত সিনেমার জয়গান জারি রাখে, তখন এসব মাধ্যম সমাজের কোন শ্রেণির স্বার্থে কার্যক্রম চালিয়ে যায় তা খুবই স্পষ্ট।

অধ্যায় ২: চলচ্চিত্র পুরস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি/ বুদ্ধিবৃত্তির বিকার: মেরিল-প্রথম আলো ‘চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কারের’ রাজনৈতিক অর্থনীতি। শিরোনামের মধ্যেই প্রকাশিত হয় লেখকের অভিব্যক্তি। মূলত ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি সিনেমার বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, আমাদের দেশে যেসব পুরস্কার দেওয়া হয় জাতীয় পর্যায়ে, তার মধ্যে তুলনামূলক ‘ভালো’ মেরিল-প্রথম আলো চলচ্চিত্র পুরস্কারও দেওয়া হয় গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক স্বার্থে। সেবার মেরিল-প্রথম আলো নিয়োজিত ‘সমালোচকদের দৃষ্টিতে’ সেরা চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে প্রাথমিকভাবে মনোনীত হয় তারেক মাসুদ প্রযোজিত ‘অন্তর্যাত্রা’, ফরিদুর রেজা সাগর প্রযোজিত ‘আয়না’ এবং দিদারুল আলম প্রযোজিত ‘নন্দিত নরকে’। ‘সমালোচকদের রায়ে’ সেরা চলচ্চিত্র বিবেচিত হয় ‘আয়না’। সেরা চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী (নারী) হিসেবেও নির্বাচিত হন আয়নার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়কারী সোহানা সাবা। জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক; সদস্য ছিলেন শিবলী সাদিক, বাদল রহমান, সাইদুল আনাম টুটুল ও শামীম আখতার।

এ অধ্যায়ের বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তিন সিনেমার তুলনামূলক আলোচনায় লেখক দেখিয়েছেন, সেরার তালিকায় জায়গা করে নেওয়া সিনেমাটি দুর্বলতর নির্মাণ ও অভিনয়ের সাক্ষর রেখেছে। শেষের দিকে লেখক খুবই জোরালো ভাষায় এই পুরস্কারের রাজনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘…ব্যক্তিক সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ কাঠামোগত সন্ত্রাসকে আড়াল করে। গার্মেন্টস মালিকের মহত্ত্ব এবং মালিকের বিশ্বস্ত কর্মচারীর দায়বদ্ধতা ও পদোন্নতির গল্প শ্রম শোষণের বৃহত্তর আয়োজনকে এবং শিশুশ্রমের ব্যবহারকে আড়াল করে। মালিক আর মাত্র হাজার-বারোশ টাকা মাইনে পাওয়া শ্রমিকের এজেন্ডা যেন এক হয়ে ওঠে—তারা গার্মেন্টসের উন্নতিতে এবং এর মাধ্যমে জাতীয় উন্নতিতে এক কাতারে একসাথে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, ওভারটাইমের ন্যায্য প্রতিদান, এমনকি একটা সর্বনিম্ন মজুরি কাঠামোও আলাদাভাবে এজেন্ডা হয় না প্রথম আলোয়, বরং মালিকের স্বর বেশি প্রবল হয়ে ওঠে মজুরি কাঠামো নির্ধারণের বেলায়।’

লেখক আরও বলেন, ‘‘আয়না প্রথম আলোর এজেন্ডা অনুকৃত একটা চলচ্চিত্র। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মালিক ফরিদুর রেজা সাগর চ্যানেল আইয়েরও কর্তাব্যক্তি। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান চ্যানেল আইতে সম্প্রচার করা হয়। চ্যানেল আই প্রথম আলোর প্রধান মিডিয়া পার্টনার। তাদের মতাদর্শও অভিন্ন। সুতরাং নিজেদের কলাই তো তারা দেখাবে, সমাজসেবার মুখোশের আড়ালে লোভী মুখটাও আড়াল করবে। আর শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবীরা ভাড়া খাটবেন! এসব কারণে আয়না যখন প্রথম আলো নিয়োজিত ও নির্মিত বুদ্ধিজীবী ‘সমালোচকদের রায়ে’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয় তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। একইভাবে সোহানা সাবার শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী (নারী) নির্বাচনও কিছুমাত্র অবাক করে না।’’

অধ্যায় ৩ : বাঙালি মুসলমানের সেকুলার ভাবনা, ইসলাম ও জঙ্গি প্রসঙ্গ/ সিনেমা রেপ্রিজেন্টেশন: বোমা-জঙ্গি-মাদ্রাসা-ইসলাম এবং বাংলাদেশ/ ফারুকীর টেলিভিশন, দূর-দর্শনের মিডিয়া এবং ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। চলচ্চিত্রে যেভাবে মাদ্রাসা ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও ইসলামি লেবাসকে ‘জঙ্গিবাদ’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত দেখানো হয়, যা অনেকটা সরলীকরণ—এমন প্রচারের সাংস্কৃতিক রাজনীতিটা লেখক উপস্থাপন করেছেন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সেক্যুলার ও মুসলিম বাঙলিত্বের ভেতরকার দ্বন্দ্বে কীভাবে জঙ্গিবাদের চিন্তা হাজির করা হয়, কীভাবে অন্য সব মাধ্যমের মতো সিনেমাতেও এর প্রতিফলন ঘটে, তা এ অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে।

৯/১১ বা যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পর রচিত মুসলিম চরিত্রে ব্যাপক হারে জঙ্গি বা বিপথগামীদের দেখানো হয়। বাংলাদেশি মুসলিম চরিত্রকে এভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সিনেমাকে তখন থেকে ব্যাপক আকারে ব্যবহার করা হতে থাকে। প্রথম প্রবন্ধে এ বিষয়টিই আলোচিত হয়েছে। তবে এ অধ্যায়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধে লেখক ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’-এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে তিনি আরও তিনটি সিনেমা ব্যাখ্যা করেছেন—আবু সাইয়ীদের ‘অপেক্ষা’ (২০১০), তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ (২০১০) এবং জাকির হোসেন রাজুর ‘জ্বী হুজুর’ (২০১২)। লেখক বলেন, “তিনটা সিনেমা মিলে গড়ে ওঠা মিথের কাঠামো একটু খোলাসা করি: ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’র বিভ্রান্তিতে বিপথগামী ও ভয়ানক জঙ্গি হয়ে ওঠা সন্তানের জন্য অপেক্ষা চলে সাইয়ীদের অপেক্ষাজুড়ে। কিন্তু তারেক মাসুদের রানওয়ে সেই সন্তানকে সমাজে ফিরে আসবারই নিশানা দেখায়, ফলত অপেক্ষার অবসান ঘটে। আবু সাইয়ীদ যখন ব্যাখ্যাহীনভাবে ভুল পথের বয়ান হাজির করেন, তখন তারেক মাসুদ ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’র কারণ অনুসন্ধান করেন। কোন পরিস্থিতিতে, কোন বাস্তবতায় আমাদের সমাজে ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’ তৈরি হয় এবং মাদ্রাসাপড়ুয়া যুবকরা মোহাচ্ছন্ন হয় তার ইশতেহার হাজির করেন। ফলে ধর্মের ভুল-সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করে আমাদের সন্তানেরা তখন রানওয়ে ধরে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ঘরে ফিরে তো সেই সন্তান বসে থাকতে পারে না। এবার সঠিক পথের নিশানা ধরে সে হাঁটবে—জীবনযাপনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দেশের সকলকে সেই পথে আহ্বান করবে। তাই, জাকির হোসেন রাজু ধর্মের ‘সঠিক ব্যাখ্যা’ বা ‘সহি’ রাস্তা মেলে ধরেন আমাদের সামনে—যে রাস্তা রাষ্ট্র অনুমোদিত, রাষ্ট্র কর্তৃক আরাধ্যও বটে।”

তবে ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ এক ভিন্ন বাস্তবতায়, ভিন্ন আঙ্গিকে খুব ভালো নির্মাণে বাঙালি মুসলিমের এক ভিন্ন সেক্যুলার আখ্যান তুলে ধরেছেন। সিনেমায় ‘টেলিভিশন’ নানাভাবে কাহিনির কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে তুলে আনা হয়েছে। গল্পের প্লট নির্মাণ হয়েছে মিঠানুপুর গ্রামে। এ গ্রামটি কার্যত বাংলাদেশের একটি রূপক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আধুনিক জাতি-কল্পনা ও জাতীয়তাবাদে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনপরিসরে ধর্মের ভূমিকা নিতান্তই নৈতিকতা শিক্ষার। এমন এক ‘বিকল্প’ দেশ-কল্পনা থেকে ফারুকী ‘টেলিভিশন’ নির্মাণ করেছেন বলে লেখক ওই প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এটি কার্যত বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পেরই অংশ।

লেখকের মতে, যা কিছু নির্মিত হচ্ছে এবং তার যে অর্থ সমাজে গড়ে উঠছে তা এক বহুপক্ষীয় লড়াইয়ের ক্ষেত্র। বাঙালি পরিচয়ের সত্তা নির্ধারণের চেষ্টা ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; আবার ক্ষমতা সম্পর্কের বাইরেও নয়। এ ভূখণ্ডের মানুষ যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তখন ‘বাঙালি’ পরিচয়টা মুখ্য হয়ে ওঠে। আবার ১৯৪৭ সালের আগে এখানকার ওই বাঙালিরাই ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’-এর মিছিলে সামিল হয়েছিল। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারণে দুই বাংলার মানুষের চিন্তা-চেতনা এক হওয়ার কথা নয়।

অধ্যায় ৪: জাতিসত্তার প্রশ্ন এবং বাউল-ফকির পরিবেশনার রাজনীতি/ মনের মানুষ: বেশরা ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে ভদ্দরলোকদের সূক্ষ্ম প্রেমের মর্ম বোঝা ভার!!/ বাংলা চলচ্চিত্রে বাউল ও ফকির পরিবেশনার রাজনীতি। এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় হলো—ফকির লালনকে ঘিরে গড়ে ওঠা জাতি ও জাতিসত্তার রাজনীতি। লেখক দেখিয়েছেন, লালন কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিসত্তা, আধুনিক জাতি ও জাতিরাষ্ট্র, জাতীয়তাবাদ ও পরিচয়ের রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠেন। তিনি আরও দেখিয়েছেন, ‘ফকির’ তত্ত্বের অনুশীলনের পরাজয় ও বিনাশের বিপরীতে ‘বাউল’ বর্গটির উত্থানের সঙ্গে জাতিসত্তা ও পরিচয়ের রাজনীতিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এ কারণেই ফকির ও বাউলের সাধারণীকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় প্রায়ই ঢাকা বা পূর্ববঙ্গকে একটা মুসলিম ও গ্রামীণ ধাঁচে উপস্থাপন করা হয়। নামী নির্মাতা, যারা নিয়মিত ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে রয়েছেন, তারাও যখন এই চিন্তা সিনেমায় ফেরি করেন, তখন বুঝে নিতে হয়, এটি সাংস্কৃতিক রাজনীতিরই অংশ। সেই সঙ্গে পূর্ববঙ্গের যা কিছু উদারতা, তার সঙ্গে সনাতন-সংযোগ এবং মুসলিম-বিচ্ছেদ টানার একটা সুস্পষ্ট চিন্তা লক্ষণীয়।

এ ক্ষেত্রে লালন ও ফকির, বাউল ঘরানাকে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমায় উপস্থাপনা লেখকের বিশ্লেষণের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। ফকিরপন্থার সাধনার সঙ্গে বাউলপন্থার চর্চার সাধারণীকরণের প্রচেষ্টাও বেশির ভাগ সিনেমায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। লালন বিষয়ক আলোচনায় ‘মনের মানুষ’ ও ‘কসমিক সেক্স’ সিনেমা দুটোকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখে এগিয়েছেন লেখক। ‘কসমিক সেক্স’ সিনেমায় সাধকদের দেহসাধনাকে স্থূলভাবে দেখানো হয়। একটি নিতান্তই দুর্বল নির্মাণ। এ সিনেমা দেখলে কারও মনে হতে পারে, দেহতত্ত্বের গুপ্ত বিষয়গুলোই ফকিরি। অথচ এটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সমগ্র নয়। লেখক দেখিয়েছেন, ফকিরপন্থার নামে যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া এ সিনেমা কার্যত সমাজকে আরও যৌন সংকীর্ণতা ও পর্নোগ্রাফিক জীবনের দিকে ধাবিত করে। ফকিরপন্থাকে শুধু মানুষের কামবাসনা চরিতার্থ করার পথ হিসেবে উপস্থাপনের সাংস্কৃতিক রাজনীতি লেখক তুলে ধরেছেন।

তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে পরিচালক গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’। এর মাধ্যমে দর্শকের মস্তিষ্কে লালন সাঁইয়ের ‘লালন চন্দ্র কর’ পরিচয়টি গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায়। সেই সঙ্গে লালনের ‘ঋষি’ রূপটি ফুটিয়ে তোলা হয়।

লেখক এ প্রসঙ্গে গ্রন্থে লিখেছেন, “নতুন বাঙালি সমাজ গড়বার জন্য মনের মানুষ সিনেমায় লালনের অবয়বজুড়ে জাতপাত না মানা একজন হিন্দু ঋষির প্রতিমা গড়ে তোলা হয়েছে। আমার আপত্তি লালনকে নিয়ে এই হিন্দু ঋষি-ইমেজ নির্মাণের বিরুদ্ধে। কারণ, গত শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যেমন লালনকে শরিয়তি ধারার ‘সুফি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার এক সাম্প্রদায়িক চেষ্টা সবার নজরে এসেছিল, গৌতম-সুনীলের প্রচেষ্টা তারই উল্টোপিঠ। ইসলামপন্থিদের প্রচেষ্টা আমাদের চোখে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে সহজেই শনাক্ত হতে পারে। কিন্তু গৌতম-সুনীলের প্রচেষ্টাকে আমরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলে চিনতে পারি না। কারণ, সাধারণত প্রকাশের উপরিতল অধ্যয়ন করে আমরা মনে করি যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সবসময় কেবল ধর্মীয় ‘চিহ্ন’ বা ইস্যুগুলোকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু জাতিসত্তার রাজনীতিতে এটাও দেখা যেতে পারে যে ধর্মীয় ‘চিহ্ন’ প্রতিস্থাপিত হয়ে সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকতার ‘চিহ্ন’ হয়ে উঠেছে—গত শতকের প্রথমার্ধে ‘নবজাগরিত সংস্কৃতিবান হিন্দু জনগোষ্ঠীর বেলায় যেরূপ হয়েছিল। এসব সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার সাম্প্রদায়িক ঝোঁক চেনা দরকার-বিশেষত তা যখন একজন বেশরা ফকিরকে ‘বাঙালির প্রাণের ধন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তার প্রাণস্পন্দনটুকুই হরণ করতে উদ্যত হয়। মনে রাখা দরকার, জাতি আর কাহিনির যে কল্পনা আমাদের মনে উদয় হয় তার প্রকৃতি একই রকম—সময়ের মিথের ভিতরেই তার বাস। আর সে মিথ নির্মাণ প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক অভিলাষে পূর্ণ।”

আরেকটি বিষয় লেখক এ গ্রন্থে বেশ শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করেছেন—সিনেমা হচ্ছে লালন সাঁইকে নিয়ে; কিন্তু তা দেখা হচ্ছে জমিদারের চোখে। আর এ কারণে লালনের তত্ত্ব প্রাধান্য পায়নি, যা তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল; বরং তাঁর জীবনের বিশেষ কিছু অংশ প্রাধান্য পেয়েছে, যেখানে নির্মাতাদের স্বার্থসিদ্ধ হয়। জমিদারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে মিথ্যাচারও করা হয় ওই উপন্যাস ও সিনেমায়।

লেখক গ্রন্থে শক্তিনাথ ঝা-এর লেখা উদ্ধৃত করেছেন—“রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে নানা ধরনের কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক, গ্রন্থাকার এবং উচ্চবর্গের ভদ্রলোকেরা। সর্বত্র ‘দাতা’ রবীন্দ্রনাথ, গ্রহীতা লালন।… জমিদারদের দিয়ে [লালনের] সমাধি বাঁধানোর চেষ্টা করেছিলেন মনিরুদ্দীন [শাহ]। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জমিদাররা এতে কোন সাহায্য করেনি।… আর ভোলাই, মানিক শীতলের মৃত্যুর পর আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পড়ে এবং জমিদারগণ ১৯৪৫-এর ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি খরিদ করে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন।”

আরেক গবেষক সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, “… একটা কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে লালন বা বাউল নিয়ে যেমন মেতেছিলেন পরবর্তীকালে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। যদিও রবীন্দ্রনাথের নানা গানে বাউল গানের অন্তঃস্পন্দ শোনা যায়, তবু কোনো কারণে বাউলদের সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক উৎসাহে ভাঁটা পড়ে।… বাউলদের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের ভাবালুতা তাঁকে এককালে যতটা উদ্বেলিত করেছিল পরে তাদের জীবনযাপনের মুক্ত ধরন, বস্তুবাদ ও তর্কমুখী তাত্ত্বিকতা তাঁকে ততোটা টানেনি।”

লেখক এ দুই গবেষকের মন্তব্যের পর নিজের বিশ্লেষণ টেনে বলেছেন, “আমাদের জন্য যে মার্গ সংস্কৃতির প্রতিমা গড়েন রবীন্দ্রনাথ সেই প্রতিমার বেদী হিসেবেও বেশরা ফকির লালনের বস্তুবাদিতা, নারী-পুরুষের মুক্ত সম্পর্ক চর্চা কিংবা তর্কমুখিতা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য শুধু সেটুকুই যা মার্গ সংস্কৃতির খাপে আঁটে। তবু যখন মনের মানুষ সিনেমায় ঠাকুরবাড়ির জানালার গরাদ ভেদ করে লালনের জীবনে প্রবেশ করতে হয়, তার ভিন্ন প্রয়োজন, ভিন্ন এক উদ্দেশ্য নজর এড়ায় না। তাই বলছিলাম, জমিদার ঠাকুর পরিবারের জৌলুস আরও বাড়িয়ে তোলার জন্যই মনের মানুষ সিনেমা এ রকম ‘পাট্টা’ লিখে দেওয়ার গুজবকে প্রতিষ্ঠিত করে—সেটা বলা যাবে না। বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন ধরে ধরেই আমাদের এগোতে হয়। আমরা দেখতে পাই, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ঠাকুরবাড়ির ফ্রেম আর তার নিশানা ধরে লালনের জীবন বাত্ময় হয়ে ওঠে। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ এমন এক আইকন যার সংস্পর্শে বেশরা ফকির লালন ‘বাঙালির প্রাণের ধন’ হিসেবে এই সিনেমা মারফত হিন্দু মধ্যবিত্তীয় পরিসরে আত্মসাৎ হয়ে যান। তবে এটুকুও বলে রাখা দরকার যে, লালনের প্রাণস্পন্দন গোপন করেই কেবল মার্গ সংস্কৃতি তাকে হজম করার চেষ্টা করতে পারে। কারণ, তার প্রাণস্পন্দনটুকুর স্বীকৃতি দিতে হলে খোদ মার্গ সংস্কৃতিরই বেসামাল হয়ে পড়বার আশঙ্কা থাকে।”

অধ্যায় ৫: আত্মসত্তার রাজনীতি ও তারেক মাসুদ/ ভিজুয়ালের রাজনীতি: তারেক মাসুদের শিল্প ও সাধনা। লেখক গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ে তারেক মাসুদকে একটি আদর্শ হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। যদিও তিনি তারেক মাসুদকেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখেননি। আর এ আলোচনার মধ্য দিয়ে লেখক কার্যত সিনেমা নির্মাণের মূল লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, তা তুলে ধরেছেন। সিনেমা নির্মাণ, কাহিনি, সংলাপের সঙ্গে ব্যক্তি তারেক মাসুদের জীবন, বেড়ে ওঠা, চিন্তা—এসবই আমলে নিয়ে ভিন্নমাত্রার আলোচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে লেখক আত্মার সন্ধান করা তারেক মাসুদকে আবারও উন্মোচন করেন।

লেখক এ গ্রন্থে সিনেমাকে শুধু একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে ‘বিনোদন’ দানের জায়গা থেকে বের করে এনেছেন। সিনেমার নির্মাতা কারা, মেসেজটা কী, সিনেমার লক্ষ্য বা টার্গেট দর্শক কারা এর মধ্যে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিদ্যমান, যা মানুষকে ভেতর থেকে কোনো চিন্তার দিকে ধাবিত করে বা করতে পারে; সে উদ্দেশ্য ও বিধেয় পাঠকের সামনে তুলে ধরাই এ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য।

লেখক এ গ্রন্থে সিনেমাকে শুধু একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে ‘বিনোদন’ দানের জায়গা থেকে বের করে এনেছেন। সিনেমার নির্মাতা কারা, মেসেজটা কী, সিনেমার লক্ষ্য বা টার্গেট দর্শক কারা এর মধ্যে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিদ্যমান, যা মানুষকে ভেতর থেকে কোনো চিন্তার দিকে ধাবিত করে বা করতে পারে; সে উদ্দেশ্য ও বিধেয় পাঠকের সামনে তুলে ধরাই এ গ্রন্থের মূল লক্ষ্য। এটি শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, নির্মাতাকে এর বাইরে যে সৃজনশীলতা ও ইতিহাসের যে জ্ঞান রাখতে হয়; রাজনৈতিকচিন্তার প্রভাব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কীভাবে পড়তে পারে, বা এর উল্টো ঘটনাও যে অস্বাভাবিক নয়, তা এ গ্রন্থে উঠে এসেছে। কোনো সিনেমা কখন নির্মিত হচ্ছে, সেটিও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর তা রাজনীতি ও সেই সময়টাকে ভীষণভাবে প্রভাবিতও করতে পারে।

তারেক মাসুদের মূল্যায়ন করা ফরহাদ মজহারের একটি লেখার কথা উল্লেখ করে আলোচ্য গ্রন্থের লেখক আ-আল মামুন বলেন, ‘ফরহাদ মজহারের প্রধান বক্তব্য হলো, বাঙালি জাতীয়তাবাদী ন্যারেটিভের যে সমস্যা, তারেক মাসুদ তার বাইরে বেরুতে পারেননি; তবে সেই ন্যারেটিভের সংকটের জায়গা দারুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। এ কথা সত্যি; সাক্ষাৎকারভিত্তিক চলচ্চিত্রকথা বইটি থেকেও জানা যায়, মুক্তির গান নির্মাণের পরে তারেক মাসুদের ভিতরে একটা সংকট তৈরি হয়। তিনি নিজেই বলেছেন যে, মুক্তির গান এক ধরনের জাতীয়তাবাদী জঙ্গিপনা উসকে দিয়েছে। ১৯৯৫ সালের দিকে, আওয়ামী লীগ সরকার তখনো ক্ষমতায় আসেনি, সে সময় সাংগঠনিকভাবেই সারা দেশের বিভিন্ন শহরে সিনেমাটিকে তারা নানাভাবে প্রমোট করেছে। তবে এটাও সত্যি যে বাংলাদেশের শ্রুতি ও দৃশ্যজগতে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এই নানান কিছুর দীর্ঘ অনুপস্থিতির মাঝে হঠাৎ করে মুক্তির গানের স-রব ও স-রং হাজিরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। হঠাৎ করে জাতিগত লাঞ্ছনা ও গণহত্যার স্মৃতি আছড়ে পড়ে আমাদের মনোজগতে ও জনপরিসরে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রথম প্রদর্শনীটি দেখেছিলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। নিজে বিস্ময়ে-বেদনায় বিমূঢ় হয়েছিলাম, অন্য দর্শকদের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। যাহোক, জাতীয়তাবাদী জঙ্গিপনার উদ্বোধনেও এই সিনেমা অবদান রেখেছে বলে তারেক মাসুদ নিজেও মনে করতেন।’

পরিশিষ্ট: শরীর ও লিঙ্গীয় রাজনীতির চলচ্চিত্র-ভাষা দিয়ে গেলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুপর্ণ শুধু একজন সাধারণ সিনেমা নির্মাতা নন। একজন চিন্তাশীল, মননশীল, সৃজনশীল নির্মাতা, যিনি দর্শকের কাটতির জন্য নয়; নিজের চিন্তার ছাপ রাখেন প্রতিটি কাজে। আর এ কাজই তাকে অন্যদের চেয়ে পৃথক করেছে। পরিশিষ্টের লেখাটি এই ক্ষণজন্মা নির্মাতার প্রতি লেখকের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঋতুপর্ণের নির্মাণ ও চিন্তা সম্পর্কে লেখক বলেন, “ঋতুপর্ণের শেষ কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে আমাদের সামনে হাজির থাকছে চিত্রাঙ্গদা (২০১২)। চিত্রাঙ্গদার চালচ্চিত্রিক নবজীবন এবং অতঃপর অকালমৃত্যুর মাধ্যমে এই ধরাধামে ঋতুপর্ণের অনুপস্থিতি একটা আয়রনি বিশেষ হয়ে রইল। নিশ্চিতভাবেই এর প্রতীকী তাৎপর্য বহুকাল বাংলা চলচ্চিত্রকে তাড়িত করবে। চলচ্চিত্রভাষ্য হিসেবে তিনি রবিঠাকুরের কাব্যনাটক চিত্রাঙ্গদাকে এমন কায়দায় বিনির্মাণ করেছেন, যা হয়ে উঠেছে অটোবায়োগ্রাফিকাল। চিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং নিজে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রুদ্রের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন। আর এই সকল তৎপরতার মাধ্যমে লিঙ্গীয় পরিচয়ের রাজনীতিতে তিনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। বলা যায়, তার আত্মপরিচয় সন্ধানের জীবনব্যাপী সফরের চূড়ান্ত পরিণতি ও প্রকাশ ঘটেছে চিত্রাঙ্গদায়। নিজের পরিচয় অসংকোচে দৃঢ়ভাবে নির্মাণ ও পরিবেশনের মধ্যেমে তিনি পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গীয় পরিচয় চিহ্নকারী ‘নারী-পুরুষ’ বৈপরীত্যযুগলের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং মূল্যচেতনাকে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত করে ছেড়েছেন। কিংবা হয়তো এভাবে বলাই যথার্থ হবে যে, এই নির্মাণ ও প্রস্থানের মাধ্যমে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের নবযাত্রার অভিমুখ তৈরি করে দিয়ে গেছেন।”

বিবদমান সাংস্কৃতিক রাজনীতি কীভাবে সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করছে—এ গ্রন্থ তার একটি বিবরণ পাঠকের সামনে তুলে ধরে লেখক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ভূ-রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন ব্যাকরণ এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধ’ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু ওই উপাদানগুলো কার্যকর হয়ে সমাজের ঘাসমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েই।

আ-আল মামুন এ গ্রন্থে যে কাজের ধরন দেখিয়েছেন, তা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক, খানিকটা একাডেমিক। রাজনীতির মূলধারা এ ধরনের কাজ দ্বারা প্রায় কখনোই সরাসরি প্রভাবিত হয় না। বিশেষত, বাংলাদেশের মতো একটি সমাজকাঠামোতে, যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার বিতর্ক বা ভিন্নমত বিকশিত হওয়ার সুযোগ সীমিত। তবে তা নতুন চিন্তকদের প্রভাবিত করে এবং সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের ভাষাকে প্রভাবিত করে। পাঠকরা নতুন চিন্তার সন্ধান পান এবং কেউ কেউ এই চিন্তার বিকাশে কাজ শুরু করেন। মূলধারার রাজনীতিতে প্রভাবটা পড়ে এর পরের ধাপে। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠীর চিন্তা কাঠামোতে যখন এই প্রভাব ক্রিয়াশীল হতে শুরু করে, তখন সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আসন্ন হয়ে পড়ে।

সিনেমার সাংস্কৃতিক রাজনীতি : আধুনিকতা জাতীয়তা আত্মসত্তা
আ-আল মামুন
কথাপ্রকাশ
মূল্য : ৬০০ টাকা

লেখাটি শেয়ার করুন :

লাবণী মণ্ডল

লাবণী মণ্ডল। জন্ম টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে। দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই আলোচনা লেখেন। যৌথ সম্পাদনায় তাঁর ৫টি বই প্রকাশ হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!