সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অগ্রন্থিত গল্প
জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [১৫ অগাস্ট ১৯২২-১০ অক্টোবর ১৯৭১]
শতবর্ষে ও নক্ষত্রমথিত রাত্রির শিশির নির্বাপিত হলেও, আমাদের সঘন চৈতন্যের সামনে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন অনম্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ । আমাদের জানা আছে, খুব বেশি লেখেননি তিনি, অথচ তাঁর শিল্প-অন্বেষা ও অভিপ্রায় এবং সৃষ্টি অমোচনীয় রক্ত ও নিশ্বাস অতিক্রম করে গেছে। তাঁর জন্মশতবর্ষ আমরা পার করেছি সম্প্রতি। সেটি উপলক্ষ হলেও, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সবসময় আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতা ও পরিসর বাড়িয়ে চলেছেন। তাঁর স্মরণে প্রকাশ হলো দুইটি রচনা এবং এই লেখকের একটি দুষপ্রাপ্ত গল্প।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পগ্রন্থ মাত্র দুটি- নয়নচারা (১৯৪৫) এবং দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫)। এ দুটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গল্প সতেরটি। তাঁর অগ্রন্থিত গল্পের সংখ্যা এর দ্বিগুণেরও বেশি। সৈয়দ আকরম হোসেন সম্পাদিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলির সর্বশেষ সংস্করণে (চারুলিপি, ২০১৩) সংকলিত ৩২টি অগ্রন্থিত গল্পের বাইরে বিভিন্ন গবেষক পুরোনো পত্রপত্রিকা থেকে আরো কয়েকটি লেখা উদ্ধার করেছেন। তবে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হুমায়ুন কবির সম্পাদিত সাময়িকপত্র চতুরঙ্গ-র চতুর্দশ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৫৯ [১৯৫২ খ্রি.]) প্রকাশিত ‘এক আর নয়’ (পৃ ২৮-৩২) শিরোনামের নাতিদীর্ঘ গল্পটি অধিকাংশ ওয়ালীউল্লাহ্-গবেষকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
সংগৃহীত গল্পে কয়েকটি শব্দের বানানে অসমতা লক্ষা করা গেছে। যেমন : সিগারিট-সিগারেট, হতো-হোতো। রয়েছে দু-একটি মুদ্রণপ্রমাদ। যেমন : কাঁচ। এসব ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ও অভিধানসম্মত রীতি অনুসরণ করে সমতা আনা হয়েছে।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা : রেজাউল করিম সুমন
এক আর নয়
কাছারির কাছে লোকারণ্য, ঘাস-ওঠা সাদা মাঠের কোণে কেরামত আলীর পানবিড়ির দোকান। কেরামত আলী ব্যস্ত মানুষ, হাত চলে মেশিনের মতো, কথা কয় কাজে চোখ রেখে, গলার আওয়াজে মানুষ চিনে কুশলাদি শুধায়, ইচ্ছে হলে খানিক খোশ গল্পও করে। কিন্তু চোখ তুলে তাকায় না। যখন হাতের একটু সবুর মেলে, তখন কোণ থেকে লাল সুতোয় বাঁধা ময়লা খাতাটি বের করে হিসেব কষে। কী হিসেব কষে কেউ জানে না। কিন্তু খদ্দেররা সবাই জানে ওর হিসেবের খাতা আছে যাতে কী সব হিসেব কষে। ভোঁতা সে পেনসিলটা বারে বারে জিভে ছুঁয়ে, পিঠ গুঁজে পা দুটো সামনে লম্বা করে ও হিসেব কষে। আর যখন হিসেব কষে তখন লোকদের কথার জবাব হুঁ-হাঁ করে সারে। তবে যখন এক আর নয়-এর তফাতটা পরিষ্কার করবার চেষ্টায় থাকে তখন হুঁ-হাঁটাও হয়ে ওঠে না।
লোকেদের কৌতূহলের শেষ নেই। ভুরু কুঁচকিয়ে কেরামত আলী যখন হিসেব কষে তখন তারা আড় চোখে তাকায়, কেউ গলা দীর্ঘ করে রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা করে। কেরামত আলী এমত ক্ষেত্রে পিঠটা একটু ঘুরিয়ে দেয়।
প্রসেস সার্ভার বিষ্ণু বলে,
– তেজারতির হিসেব কি অমনি করে হয়? কালি কলম লাগে। লাল খাতা লাগে। কেরামত আলী পিঠটা আরেকটু ঘুরিয়ে দেয়।
সন্ধের সময় আপিস বন্ধ হলে মাঠটা হঠাৎ যখন খাঁ-খাঁ করতে শুরু করে মরা-শূন্যতায় তখন কেরামত আলী আলকাতরা-রঙা কেরোসিন টিনের বেড়া দেয়া মঞ্চের মতো দোকান থেকে নেমে, দোকানে ঝাপ দিয়ে একটি বিড়ি ধরিয়ে বাড়িমুখো রওনা হয়।
পথটা দীর্ঘ, অনেক মাঠ ঘাট পেরিয়ে, বন জঙ্গল এড়িয়ে। ঘরের দুয়ারে যখন পা দেয় তখন বাঁশ বনে একপাল শেয়াল তারস্বরে ডাকা শুরু করে দিয়েছে। তারপর হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে। বউ-এর পানে তাকায় না। বউটি নথ নাড়ে, ঘোমটা টানে খামখা, কাঁচের চুড়িতে আওয়াজ করে সে তাকায় না। বউ ইচ্ছে করে কাসার গেলাসটা খালি রাখে আর কেরামত আলী ঢক ঢক করে পানি খাবার তৃষ্ণায় গেলাস তুলে আবার রেখে দেয় আস্তে, বলে না, পানি দেও। বউটি তখন উঠে পানি ভরে দেয়, কত দিন আঁচলটা দিয়ে চোখটা মোছেও। কেরামত আলী তাকায় না, বলে যে, কথা সে জানে না। জানলেও বলত না কিছু। কেরামত আলী বউ-এর সঙ্গে কথা বলে না।
বউ-এর দিকে এক নজর চেয়ে কাঁধে গামছা ফেলে নদীতে গোসল করতে যে গেল তারপর থেকে বউ-এর সঙ্গে কথা কয় না, তার দিকে তাকায় না। রাতে যখন বউ ঘুমের ভান করে হাতটি তার গায়ের সঙ্গে ঠেকায় তখন কেরামত আলী সরে যায়। সরে যায় কেবল, নিজের হাত দিয়ে তার হাত সরায় না। নিজের হাত দিয়ে তাকে ছোঁয় না।
কথা বলে না আজ মাস ছয়েক। ছ মাসের মধ্যে একটি কথাও বলেনি বউ-এর সঙ্গে, মুখের দিকে তাকায়ওনি। বউ কেঁদেছে, বউ গোসা করেছে, বউ রান্না বন্ধ করে উপুড় হয়ে শুয়ে না খেয়ে পড়ে রয়েছে দুদিন—তাতে কেরামত আলীর কিছু হয়নি। শুধু দোকানে গিয়ে হিসেবটি করেছে ঘন-ঘন, আর খন্দের বিড়ি চাইলে দিয়েশলাই এগিয়ে দিয়েছে তাকে। কেরামত আলী কী একটা কেরামত দেখাবে যেন। কেরামত দেখাবে বলে বউ-এর সঙ্গে কথা বন্ধ করেছে। যদ্দিন না কেরামত দেখায় তদ্দিন কথা কইবে না, মুখের পানে চাইবে না। তবে হিসেব করতে গিয়ে এক আর নয়-এর গোলমালটা কাটিয়ে উঠতে পারে না; কোনোবার নয়-কে এক পড়ে, কোনোবার এক-কে নয় পড়ে। এবং যে-ভাবেই পড়ুক না কেন, শেষ পর্যন্ত হিসেব মেলে না। তখন সে নয়-কে এক পড়ে আর এক-কে নয় পড়ে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই ব্যাপার—হিসেব মেলে না।
প্রসেস সার্ভার বিষ্ণু বলে,
—অত হিসেব কিসের গো ?
কেরামত আলী পিঠটা আরেকটু ঘুরিয়ে দেয়। তারপর ভিজে লাল তেনাটি তুলে বানানো পান হতে একটি পান বিষ্ণুকে দেয়, সেই হাত দিয়েই পানের পয়সা নিয়ে ফুটো করা টিনের মধ্যে ছেড়ে দেয়। খাতার পাতা উল্টিয়ে দিনকার পাতায় টোকে, এক। ঠেকে ঠেকে সাবধান হয়েছে, অতি সন্তর্পণে পেনসিল ঘুরিয়ে লেখে, এক। তারপর এক নজর পরব ক’রে দেখে পেনসিল জিভেয় ঘসে। আরেক নজর পরখ করে দেখে একের ওপরে আবার পেনসিল ঘোরায়। যখন মনে হয় এক একের মতোই দেখাচ্ছে তখন পেনসিলটা কানে গুঁজে পাতা উল্টিয়ে পেছনের হিসেবে চলে যায় যেখানে এক নয় হয়ে আছে আর নয় এক।
দিনকার পাতায় সন্ধ্যা পর্যন্ত উঠল গোটা তিরিশেক এক আর পাঁচটা নয়। নয় হয় বাবুরা এসে যখন ইস্টার-মার্কা সিগারেট চায়। তার এক প্যাকেটের দাম নয় পয়সা এবং সেটা বিকেলে খাতায় তুলতে হয় নয়। তোলে সাবধানে, ঠেকে ঠেকে শিখেছে কিনা। এবং যখন তোলে তখন নয়-এর চেহারা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। সন্দেহটা আসে পরে যখন নয় আর একের চেহারা একই দেখায়। তখন সে মনে মনে চুল ছেঁড়ে, কাপড় তুলে রান চুলকায় আর পান দিতে গিয়ে বিড়ি দেয়। কেরামত আলীর সমস্ত কেরামতি সেই সময়ে বড় মার খায়। প্রসেস সার্ভার বিষ্ণু বলে,
—কিসের হিসেব গো বলো না।
বিষ্ণু মুখে পান পুরে দেখে কেরামত আলী পিঠ আরো ঘুরিয়ে বসছে।
আজ বিষ্ণু চার পয়সা দিয়েছে। তা চার পয়সা দিক দু পয়সাই দিক, বাকি থাক আর খুচরো পয়সা ফিরিয়ে নিক, খাতায় ওঠে এক। কারণ পানের দাম এক পয়সা। এক পয়সা বাজারে প্রায় নেই-ই। কাজেই ইস্টার-মার্কা সিগারেটের সঙ্গে বাবুরা যখন দশ পয়সা করবার জন্য আরেকটা পয়সা খরচ করেন একটা পান কিনে, তখনো তার দাম থাকে ন পয়সা। এর আর ফরাখ হয় না, এক দুই হয় না, নয় দশ হয় না। এবং হয় না বলে কেরামত আলী গলদঘর্ম হয়ে যায় হিসেব মেলাবার চেষ্টা করে-করে, এবং হিসেব না মিললে শাড়িটা কেনা হবে না, এবং শাড়িটা না কিনলে বউ-এর সঙ্গে কথা কওয়া যাবে না। আড়ির মূল কারণ তো শাড়িই। শাড়ি চাইল বউ এবং কেরামত আলী দিতে পারল না বলে বউ কোমরে হাত দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে কড়া কথা শোনাল। শুধু তাই নয়। বাপের বাড়ির লোকটি এলে তার কাছে নালিশ করল, আর সে বউ-এর সাজানো হুঁকোয় কষে দম দিয়ে এক গাল হেসে খোঁটা দিয়ে কথা শোনাল। শুনে কেরামত কিছু বলেনি, কিন্তু তার কানের লতি লাল হয়ে উঠেছিল রাগে ও অপমানে। বউ-এর দিকে এক নজর চেয়ে কাঁধে গামছা ফেলে নদীতে গোসল করতে যে গেল তারপর থেকে বউ-এর সঙ্গে কথা কয় না, তার দিকে তাকায় না। রাতে যখন বউ ঘুমের ভান করে হাতটি তার গায়ের সঙ্গে ঠেকায় তখন কেরামত আলী সরে যায়। সরে যায় কেবল, নিজের হাত দিয়ে তার হাত সরায় না। নিজের হাত দিয়ে তাকে ছোঁয় না। একদিন আকাশ কালো করে তুফান এসেছিল। সে কী হাওয়ার গোঙানি ও দাপট, কী নিদারুণ ঠাটা পড়ার আওয়াজ। বউ ভয়ে কেরামত আলীকে জড়িয়ে ধরলে সে বিদ্যুৎ বেগে উঠে গেল। ও যখন ডুকরে কাঁদল ভয়ে ও অভিমানে তখন কেরামত আলী পাথরের মতো বসে রইল।
ভোঁতা পেনসিলটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে আধ ইঞ্চিতে নেমেছে। কিন্তু কেরামত আলীর হিসেব মেলে না। একদিন মুখ ফিরিয়ে বিষ্ণুর দিকে তাকাল। বললে, —তোমার পেনসিলটা দাও। একটু হিসেব কষি।
গালে পান পুরে প্রসেস সার্ভার বিষ্ণু বলে,
—কিসের অত হিসেব গো?
সে-কথার জবাব দেয় না কেরামত আলী। দূরে মাটির পথটার দিকে তাকিয়ে থাকে নীরবে। বিষ্ণু শেষে দেড় ইঞ্চিটাক লম্বা এক পেনসিল এনে দেয়। সেদিন কেরামত আলী পানের দাম তোলে না।
একদিন হিসেব মেলে। মেলে মানে আয় ব্যয় কষে কেরামত আলী দেখে ছ’মাসে তার যা লাভ হয়েছে সে লাভটা খেয়ে-দেয়ে একটা শাড়ি কেনার মতো উপযোগী। কাজেই আগামী ছ’মাসে এমনি লাভের ভরসায় সে ধার নিতে পারে মণি মিয়ার কাছে থেকে। মাসে-মাসে করজ শোধ করবে সুদশুদ্ধ। সেই দিনই কেরামত আলী চলে গেল মণি মিয়ার কাছে। তারপর গেল হাটে। শাড়ি কিনতে। নীল রঙের শাড়ি, ঝিরঝিরে যার জমিন। দর কষাকষি করে, শাড়িটা অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে অবশেষে কেরামত আলী ঝুপ করে টাকা রাখল পাটাতনের কোণে।
বাঁশ-বনের কাছে পৌঁছতেই শেয়ালগুলো ডাকতে শুরু করল। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ডোবা থেকে মেটে-মেটে গন্ধ আসছে। মোটা অশত্থ গাছ পেরুলেই ঘর। কিন্তু ওই অশত্থ গাছ পর্যন্ত পৌঁছে কেরামত আলী হঠাৎ থমকে গেল। পা দুটো থেমে গেল এবং এমন ভাবে থেমেই রইল যেন ওখানে শিকড় গজাচ্ছে। পা নড়ে না কারণ হঠাৎ একটা ভাবনা এলো মনে। ভাবনা এলো আর পা গেল থেমে। ভাবনার সুরাহা হয় না। ভাবতে-ভাবতে কানের লতি পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল, নিশ্বাস প্রশ্বাস হলো দ্রুত। শাড়িটা নাড়ল-চাড়ল, মনটাকে ঘোরাবার জন্য। কিন্তু শাড়িটা ভাবনাকে আরো প্যাঁচালো করে তুলল। কূলকিনারাহীন হয়ে উঠল তার ভাবনা।
একবার ভাবে, সে ঘরে ঢুকেই শাড়িটা ছুঁড়ে দেবে বউ-এর দিকে, দিয়ে বলবে এই নাও তোমার শাড়ি। কিন্তু তার জন্য রাগের দরকার। কেরামত আলীর মনে আর রাগ নেই। মনটি যেন হেমন্ত।
তারপরে শেয়ালগুলো ডাকে, পশ্চিম থেকে একটা পেঁচা এসে বসে অশত্থ গাছে—কেরামত আলীর ভাবনা ফুরায় না। শাড়ি তো হলো কিন্তু কী করে শাড়িটা দেয় বউকে। একবার বন্ধ হয়েছে যে মুখ তা সে খোলে কী করে। এ সাংঘাতিক সমস্যা। এক ও নয়ের চেয়েও বেশি কঠিন সমস্যা। একবার ভাবে, সে ঘরে ঢুকেই শাড়িটা ছুঁড়ে দেবে বউ-এর দিকে, দিয়ে বলবে এই নাও তোমার শাড়ি। কিন্তু তার জন্য রাগের দরকার। কেরামত আলীর মনে আর রাগ নেই। মনটি যেন হেমন্ত। মেঘ উড়ে গেছে বর্ষার শেষে। হালকা ঝিরঝিরে মন। তাতে রাগ নেই। এবং রাগ নেই বলে কেমন একটা ভয়ানক লজ্জা এসেছে। এ লজ্জা কাটানো মুশকিল।
অনেকক্ষণ মাথা চুলকে কেরামত আলী ভাবলে, এ-ভাবনা এমন ভাবনা যে এক সন্ধ্যায় তা কাটে না। ভেবে ভেবে রাত দুপুর হবে, ভেবে ভেবে ভোর হবে, সন্ধ্যা হবে। সুরাহা হয় যদি তা হবে অনেক ভাবার পর। অতএব এ শাড়িটা বাঁশ-বনের অন্ধকারে ঢুকে পাতাটাতা দিয়ে ঢেকে লুকিয়ে রাখল।
রাত দুপুর হবার আগে ঘুমটি এসে গেল বলে ভাবনাটি বেশি ভাবা গেল না বটে, কিন্তু ভোরে উঠে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজা শুরু করার আগেই ভাবনাটা কিলবিল করে এলো মাথায় আর পথ না পেয়ে ঘুরতে লাগল বোঁ বোঁ করে। দোকানে যাবার পথে, দোকানে বসে, মানুষদের পান-বিড়ি-সিগারেট নিতে-নিতে সারাদিন অনেক ভাবল। ভিড় না থাকলে বাঁশ-বন থেকে তুলে নিয়ে আসা শাড়িটি নেড়েচেড়ে দেখলেও কবার। কিন্তু ভাবনা শেষ হয় না। কারণ সমস্যাটা জটিল, অতি জটিল। যার সঙ্গে ছ-মাস কথা কইনি তার সঙ্গে হঠাৎ কথা কইতে যাওয়া একটা গুরুতর সমস্যা বৈকি। এক ও নয়-এর সমস্যা এত গুরুতর নয়। তাতে নয়- কে এক কিংবা এক-কে নয় পড়লেও বালাই চুকে যায়। হয় এটা হবে নয় সেটা হবে। এর ওর মধ্যে সমস্যাটা সীমাবদ্ধ।
সেদিনও সমস্যার সমাধান হলো না দেখে শাড়িটা আবার লুকিয়ে রাখল বাঁশ-বনে।
সেদিন রাতে বউ মরাকান্না জুড়ে বসল। আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়েছিল পাঁচ মিনিট, তারপর হঠাৎ যেন ডাকাত পড়ল। বউ হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। ডুকরে ডুকরে কান্না। কান্না শুনে জীবনে প্রথম কেরামত আলীর রক্ত শীতল হয়ে গেল। এমন কান্না সে কখনো শোনেনি। কী করবে ভেবে না পেয়ে কেরামত আলী ঘুরে উপুড় হয়ে শুয়ে দাঁত দিয়ে আঙুল কাটতে লাগল। মিনিট দশেক পরে বউ-এর মুখে কথা ফুটল। পাহাড়ি নালার পানি যে রকম পাথর ঠেলে দেয় সামনে তেমনি তার শব্দগুলো ঠেলে ঠেলে বের করল তার কান্না। আপাতত আঙুল কামড়ানো বন্ধ করে কান পেতে এলোপাথালো শব্দগুলোর অর্থ বের করায় মনোযোগ দিল কেরামত আলী। অর্থ যখন পরিষ্কার হলো তখন কেরামত আলী হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বাইরের অন্ধকারে চলে গেল। এখন রাগে তার শরীর জ্বলছে। রাগ হবে না? শুধু বাড়ি যাবার বাসনা প্রকাশ করেই বউ যদি ক্ষান্ত হতো তাহলে একটা কথা হতো। কিন্তু কেরামত আলীর চৌদ্দ গুষ্টিশুদ্ধ গালাগাল করলে কার সহ্য হয়। বিশেষ করে ও যখন জানে যে উত্তরে কেরামত আলী কোনো কথা কইবে না। ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল তার শরীর। গায়ের আগুনের দাপটে সামনের অন্ধকার যেন জ্বলে উঠল। সেই রাগের ঠেলায় সে বাঁশ-বনে গিয়ে শাড়িটা পুড়িয়ে দিল। চোখ তার লাল, সামনে আগুনের শিখা, থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর।
পরদিন দশ মাইল হেঁটে বউকে পৌঁছে দিল তার বাপের বাড়ি। যখন সে দোকানে পৌঁছল তখন অনেক বেলা। বিষ্ণু আসতেই সে এক গাল হেসে বললে,
—তোমার পিনসিলে কাজ হয় না। লাল খাতা কিনে দোয়াত কলম কিনে এবার হিসেব কষব।
পান মুখে পরে বিষ্ণু বললে,
—অত কিসের হিসেব গো?
গম্ভীর হয়ে কেরামত আলী বললে,
—এবার লাল খাতা কিনে ভালো করে হিসেব করব। ভোঁতা পিনসিলে অক্ষর গুলিয়ে যায়। আর হিসেব না করলে বুঝব কী করে কত আয় হলো ? বউকে যখন আবার আনতে যাব তখন শাড়ি দিতে হবে না? শাড়ি কেনার পয়সা হিসেব করতে হবে। ব’লে বিষ্ণুর দিকে চেয়ে কেরামত আলী চোখ টিপল। তারপর খাতাটা টেনে বের করে তাতে সযত্নে বড় বড় করে টুকলো, এক।
শেষে খাতা বন্ধ করে অকারণে ফিক করে হেসে আবার বললে,
—বউ শাড়ি চায়। বড় শখ। চায় নীল রঙের শাড়ি যার জমিন হবে মিহিন—কলের শাড়ির মতো।
সংখ্যা ১। বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫৯
রেজাউল করিম সুমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের খন্ডকালিন শিক্ষক। ভাস্কর নভেরা-গবেষক। নির্মাণ নামক ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন।