স্মরণ

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের গঠন ও নন্দন

জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [১৫ অগাস্ট ১৯২২-১০ অক্টোবর ১৯৭১]
শতবর্ষে ও নক্ষত্রমথিত রাত্রির শিশির নির্বাপিত হলেও, আমাদের সঘন চৈতন্যের সামনে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছেন অনম্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ । আমাদের জানা আছে, খুব বেশি লেখেননি তিনি, অথচ তাঁর শিল্প-অন্বেষা ও অভিপ্রায় এবং সৃষ্টি অমোচনীয় রক্ত ও নিশ্বাস অতিক্রম করে গেছে। তাঁর জন্মশতবর্ষ আমরা পার করেছি সম্প্রতি। সেটি উপলক্ষ হলেও, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সবসময় আমাদের পাঠের অভিজ্ঞতা ও পরিসর বাড়িয়ে চলেছেন। তাঁর স্মরণে প্রকাশ হলো দুইটি রচনা এবং এই লেখকের একটি দুষপ্রাপ্ত গল্প।

ইতালিতে প্রচলিত Novella সাহিত্যকর্মের পরিবর্তিত ও নানা পরিক্ষীত রূপ হিসেবে Novel এর জন্ম হয়। Novel মূলত Novelty শব্দটার অর্থদ্যৈাতকতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিল। দুঃখের বিষয় Novel নিয়ে নানা ঘটনাবর্তের ইতিহাস আমাদের সন্মুখে রয়েছে, হাজার হাজার উপন্যাস এসেছে নানান Form বিষয় ও ভিন্ন চেতনা নিয়ে তবু সবসময় তাতে সেই মৌল বৈশিষ্ট্য Novety বা নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই দৃশ্য আরো হতাশাব্যাঞ্জক। কুশলী শিল্পীর অভাব যেমন আমাদের ছিল তেমনি ছিল জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে, সামাজিক পট পরিবর্তনে নতুন নতুন হাওয়া সঞ্চরণের অভাব। যেসব ঘটনাবর্ত আমাদেরকে উত্তেজিত করেছিল তাকেও সঠিক শিল্পকর্ম মনন দিয়ে, মনযোগ (Concentration) দিয়ে শিল্পের ঋদ্ধ পাটাতনে উন্নীত করতে পারিনি সবসময। ফলস্বরূপ কথকতার সহজ হালকা ফেনিলোচ্ছ্বাস আমাদেরকে বালকসুলভ চপলতা উপহার দিয়েছে পৌনঃপুনিকতার ভারে ন্যুজ ভারাক্রান্ত হয়ে গড়েছে আমাদের উপন্যাস-কাঠামো। নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিক শিল্পী তার সমস্ত অনুভব দিয়ে সমগ্র মানুষকে উপলব্ধি ও বোধের জোয়ারে ভাসিয়ে দেবেন উপন্যাসের দেহ, নিজস্ব জনমানসকে সামাজিক রাষ্ট্রীক বৈশ্বিক আবহের সাথে সরলীকরণ করবেন, ভাষাকে ইন্দ্রিয়ঘন দার্শনিক-মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতার নিগঢ়ে জড়িয়ে নেবেন এমন আশা করি। জানি বাঙালির মেরুদণ্ডে এত শক্তির জোগান দেওয়া সবসময় সম্ভব হয়নি। তবু আমাদের সফলতার সীমাকে খাটো করে দেখবার মতো নয়। আপন রক্তমাংস মেদ মজ্জা নিয়ে তার শরীরও বেশ স্থূল পেলব হয়ে উঠেছে, সন্দেহ নেই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭০) মাত্র তিনটি উপন্যাস (পরবর্তী পর্যায়ে আরো দুটো লিখেছেন ইংরেজিতে) লিখেছিলেন, স্বল্প সময়ে তা নয়, এমনকি সুযোগ পাননি তাও নয়। দীর্ঘসময় ধরে মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখলেন তাকে মানোত্তীর্ণ করার জন্য; উপন্যাস লেখার এবং তা শিল্পের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ করার যে প্রত্যয় তাঁর ছিল তা সফল বলা চলে। বাংলা সাহিত্যে তথা বাংলাদেশের সাহিত্যে তাঁর উপন্যাস নতুন সংযোজন- কী গল্পে কী কৌশলে, কী অন্তর্গত নিগূঢ় তীক্ষ্মধী বিশ্লেষণে। একজন শিল্পী আত্মসচেতন, আত্মসচেতন বলেই পারিপাশ্বিক জীবনযাত্রা, ঘটনা সবকিছুতেই তিনি সচেতন। শুধু সচেতন বললে উপযুক্ত মূল্যায়ন হয় না, সাহিত্যের এই আধুনিক ও জটিল মাধ্যমকে সঠিক গঠনে নির্মাণ করতে তাকে আরো অগ্রসর হতে হয়- The novelist has been quicker than the poet or philosopher to borrow their specialties, than they have to borrow. শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী তাই সর্বত্রগামী, চলমান ঘটনাস্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভবিতব্য নির্মাণ, চরিত্রের মানসিক প্রাবল্য এবং অভাবিত অগ্রসরতা- নিম্নগামিতা এবং আত্মিক সংকটও তাকে ধারণ করতে হয়। মোট কথা জীবনের সমগ্রতাকে স্পর্শ করাই তার মূল লক্ষ্য। লেখকের মানসোৎকর্ষ যত পরিণত বা সম্পন্ন ততই তার উপন্যাস শিল্প সার্থক ও নতুনত্বের স্বাদে উজ্জ্বল।

ওয়ালীউল্লাহর মানস-প্রত্যয় এবং শিল্পবোধ ছিল পরিণত প্রগতিশীল এবং সমসাময়িক কালের সারা বিশ্বের শিল্প সাহিত্যের সাথে একাত্ম, সঙ্গত কারণেই তাঁর উপন্যাস নব নব পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে, ঘটনা সেখানে বড় কোনো উৎপাদক নয়। আমরা জানি অনবরত ঘটনার আমদানি ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র এমনকি রবীন্দ্রনাথও উপন্যাসের কাঠামো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন না। আধুনিক পর্যায়ের উপন্যাসে ঘটনার হুড়োহুড়ির পরিবর্তে গুরুত্ব পেয়েছে জীবনমুখিনতা, আত্মবিশ্লেষণ ও প্রতিটি ঘটনাকে জীবন জিজ্ঞাসার বেদীতে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। বাংলা উপনাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আবির্ভূত হয়ে তাঁর প্রথম উপন্যাসকে এই নবধারার সাথে সম্পৃক্ত করলেন। সুতরাং তাঁর উপন্যাস বিচারে নতুন দৃষ্টিকোণ আবশ্যক, প্রচলিত ধ্যানধারণা দিয়ে তাঁর উপন্যাসকে বিচার করা যাবে না। ইউরোপীয় উপন্যাসের হাওয়া ওয়ালীউল্লাহ্কে স্পর্শ করেছিল; শিল্পীর স্পর্শকাতর, সংক্রামক অনুভূতি অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভবকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে গোটা শিল্পে যে স্থূল বাঁক তা তাঁর নজর কখনোই এড়াতে পারে না। বলাবাহুল্য, ওয়ালীউল্লাহর ক্ষেত্রে এই দৃষ্টির প্রাখর্য ছিল আরো বেশি শাণিত। উচ্চশিক্ষিত, দেশবিদেশে দীর্ঘদিন অবস্থান ইত্যাদি কারণে তাঁর বিশ্বকেন্দ্রিক সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটেছিল। সাহিত্যে বিশেষভাবে উপন্যাসে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছিল, ওয়ালীউল্লাহ্ তা গভীর তাৎপর্যের সাথে লক্ষ করেছিলেন। সামাজিক-ব্যক্তিক ঘটনাস্রোত নিয়ে যে অবকাঠামো নিয়ে উপন্যাস ইতোপূর্বে লেখা হতো সেখানে স্থান দখল করল বিশ্লেষণধর্মী উপন্যাস। জীবনের রহস্যকে পরিবর্তিত আবহাওয়ার সাথে সুসামঞ্জস্য করে তোলা, আত্মকিত জিজ্ঞাসার আলোকে প্রতিটি ঘটনার পর্যবেক্ষণ এবং অগ্রসরণ, অবেচতন-চেতন বোধের স্বরূপও সূক্ষ্ম ভেদ-বুদ্ধি-প্রবণতাকে যাচাই, সামাজিক ব্যর্থতা গ্লানিকে ইঙ্গিতময় ঘটনা দ্বারা উপস্থাপন; মোট কথা চলমান জগৎ জীবন পরিবেশের সঙ্গে মানব মনের সূক্ষ্ম অনুভবের অনিষ্টতা ও তার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নতুন কালের উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশ শুরু হল। Stream of Conciousness বা সচেতনতার অতল প্রবাহ নামে যে নতুন ধারণা আধুনিককালে বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা উপনাাসে ওয়ালীউল্লাহ্ প্রথম তার প্রয়োগ দেখালেন। অস্তিত্ববাদী চিন্তাচেতনা, ব্যক্তিমানুষের আস্তিত্বিক যন্ত্রণা (Egomanias), ভীতি (Angst), চেতনজাত অভিজ্ঞতা প্রভৃতির ব্যবহারিক উদাহরণ তাঁর উপন্যাসে মেলে। সুতরাং উপন্যাসে যে নতুনত্বের আস্বাদন আমাদের চিরকালীন চাওয়া তার বেশ কিছু পাওনা আমরা তাঁর উপন্যাসে পেয়েছি, নিন্দুক হয়েও একথা বলা চলে।

ইউরোপীয় আধুনিক ঔপন্যাসিকের মধ্যে টমাস মান, হেনরি জোনস, কনরাড, জয়েস, প্রস্তু, কাফকা, কামু ও ভার্জিনিয়া ওলফ প্রমুখ ঔপন্যাসিকের প্রভাব ওয়ালীউল্লাহর রচনায় লক্ষ করা যায়। এঁদের মধ্যে কাফকা ও কামুর প্রভাব সবচে বেশি। কোনো কোনো স্থানে হুবহু মিলে গেছে ঘটনার বর্ণনা। তবু সার্বিক বিবেচনায় এই প্রভাব ঔপন্যাসিকের মৌলিকতার কোনো ক্ষতি করেনি। কারণ, মূল কাহিনি সম্পূর্ণ আলাদা পটভূমির নতুন পরিমণ্ডলে চরিত্রগুলোর যে চারিত্র্য বর্ণনা তাও নিজস্ব। সর্বোপরি ওয়ালীউল্লাহ্ ভাষাগত উৎকর্ষ বিশ্লেষণধর্মিতা অভিনব; যে কথা মননসম্পন্ন স্থৈর্য্যরে সাথে তিনি বিস্তার করেছেন, সেদিকের বিবেচনায় তাঁর উপন্যাস শ্রেষ্ঠ সমুন্নতির মর্যাদা পাবে নিঃসন্দেহে।

মজিদ প্রকৃত অর্থে কোনো ছকে বাঁধা চরিত্র নয়। ঔপন্যাসিকের অভিনব স্ট্রাটেজিতে মাঝবয়সী শীর্ণ মজিদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ হিসেবে অবতীর্ণ; সামাজিক জীবনের, ধর্মীয় জীবনের দুর্বলতাকে অপসারণ করার মানস-প্রত্যয় নিয়ে যে চরিত্রকে লেখক নির্মাণ করেছেন তা যেমন যথোপযুক্ত তেমনি ক্রুর, হিংস্র, তৎপর ও বুদ্ধিমান।

পাঠকের হৃদয় খনন করার জন্য নতুন নতুন ধারণা দিয়ে চরিত্রের চিত্রণ এখানে আরো অভিনব, অভিনিবিষ্ট অভিজ্ঞ পাঠকের জন্য লেখকের শাণিত বাকভঙ্গিমা আলাদা প্রসাদ বয়ে এনেছে। বর্ণনাকারী হিসেবে নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিমা পাশাপাশি প্রকৃতির সরলতাকে অতিরিক্ত ব্যঞ্জনাসিক্ত করে রূপময় করে তোলার ব্যাপারে লেখক অপূর্ব মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।

লালসালু (১৯৪৮) উপন্যাসের গঠনকৌশল আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক উপন্যাসের মতো হলেও এর গঠনগত বৈশিষ্ট্য বেশ আলাদা। সামাজিক সমস্যা নিয়েই লালসালুর কাহিনি বিবর্তিত হয়েছে, তবে প্রচলিত সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাসের মতো (যেমন : আব্দুল্লাহ) এক মৌল সমস্যা সাদামাটাভাবে বিস্তৃত হয়নি। মহব্বতনগর গ্রামে একদিন নিরাক পড়া স্তব্ধ দুপুরে মজিদের আবির্ভাব দিয়ে উপন্যাস শুরু। মজিদ মাঝবয়সী; কৃশ-শীর্ণ মুখে ক-গাছি পাতলা দাড়ি; সে যখন মহব্বতনগর গ্রামের আসার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফসলভারাক্রান্ত মাঠের দিকে তাকিয়ে দুহাত উঁচু করে মোনাজাত করছিল, তখন কারো কল্পনা করাও কষ্ট হবে যে এই মজিদ এক ভয়ঙ্কর শক্তিশালী নায়ক চরিত্র। সাধরণত পুরাতন মধ্যযুগীয় ধারায় পিকারেস্ক জাতীয় উপন্যাসে এই রকম চেহারার চরিত্র থাকে, যারা সচারচর টাইপ চরিত্র। মজিদ প্রকৃত অর্থে কোনো ছকে বাঁধা চরিত্র নয়। ঔপন্যাসিকের অভিনব স্ট্রাটেজিতে মাঝবয়সী শীর্ণ মজিদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ হিসেবে অবতীর্ণ; সামাজিক জীবনের, ধর্মীয় জীবনের দুর্বলতাকে অপসারণ করার মানস-প্রত্যয় নিয়ে যে চরিত্রকে লেখক নির্মাণ করেছেন তা যেমন যথোপযুক্ত তেমনি ক্রুর, হিংস্র, তৎপর ও বুদ্ধিমান। মজিদের একমাত্র অবলম্বন গ্রামের সহজ সরল মানুষের ধর্মীয় জ্ঞানের অপরিপূর্ণতা এবং এই দুর্বলতাই তার একমাত্র পুঁজি। উপন্যাসে মজিদের নতুন সফল জীবন নির্মাণ করতেই কাহিনির বিস্তার। ছোট-বড় বাধা দূর হয়েছে; মজিদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে গঠিত ধর্মে সে সবাইকে সম্পৃক্ত করেছে গভীরভাবে। নিঃস্ব অসহায় মজিদ যে অভিনব বাণিজ্য মিশন নিয়ে মহবত নগর গ্রামে প্রবেশ করে, সত্যিকার অর্থে তার মিশনে কোনো সদস্য ছিল না, পণ্যদ্রব্যও ছিল না, সম্পূর্ণ খালি হাতে, বিনা শক্তিতে, চালিয়াতি করে সে সম্রাট বানিয়েছে নিজেকে। মৃত একজন মানুষের কবরকে জনৈক বিখ্যাত মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে চালিয়ে দিয়ে গোটা গ্রামাবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে। তার বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই, সবাই এক অজানা ভয়ে, অজানা বিশ্বাসে তার কাছে প্রজা বনে গেছে। লক্ষণীয়, সামাজিক উপন্যাসের মোড়কে লেখকের তীক্ষ্ম দৃষ্টি, অভিনব কৌশল উপন্যাসটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

আগেই উল্লেখ করেছি, কাহিনির ঘনত্ব দান অর্থাৎ ঘটনার মারপ্যাঁচে উপন্যাসের কলেবর টেনে নিয়ে যাওয়া ওয়ালীউল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। তাই মজিদের পূর্বজীবনের কোনো কাহিনি আমরা জানতে পারি না। মজিদের দেশ শস্যহীন, যেখানে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি, জীবিকার তাড়নায় সে এই সাংঘাতিক পেশা বেছে নিয়েছে, এতটুকুই আমরা জানি।

মজিদের চরিত্র নির্মাণ করতে যেসব অনুষঙ্গ অতীব প্রয়োজনীয়, যে যে চরিত্র আবশ্যক তাই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। এই ব্যাপারে লেখকের স্বল্পবাক অর্থাৎ পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। মজিদের পাশাপাশি, খালেক ব্যাপারী, আমেনা, রহীমা, তহুরার বাপ, হাসুনির মা, আওয়ালপুরের আগত পীর ও জমিলা, মোটামুটিই এরাই উপন্যাসের পাত্রপাত্রী। মজিদের মৌল উদ্দেশ্য বাস্তবে রূপ দেবার জন্য আনুষঙ্গিক ছোটখাটো ঘটনার আবর্ত নেয়া হয়েছে।

উপন্যাসের সৃষ্টিকৌশল বিবেচনায় আনলে লেখকের বর্ণনাভঙ্গিমা নাটকীয়তা ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা কাব্যময়তা, নিস্পৃহতা এবং চরিত্রগুলোর আত্মকিত রহস্য উন্মোচনের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। উপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচার বা শিল্প সৌকর্যকে বিচার করতে হলে উপরোক্ত বিবেচনা ছাড়াও লেখকের প্রকরণগত সৌন্দর্যচেতনা, আলঙ্কারিক প্রয়োগ ও লক্ষ করতে হবে। আমরা ওয়ালীউল্লাহর তিনটি উপন্যাস পূর্ববর্ণিত অভিধায় বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য এখন মূল উপন্যাসের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করব, অবশ্য ইতোপূর্বে আমরা প্রাসঙ্গিকভাবে লালসালু সম্পর্কে কিঞ্চিত পরিচিতি তুলে ধরেছি।

লালসালু ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস হলেও এতে কাঠামোগত ও শিল্পগত কোনো ক্রটি নেই। তবে পরবর্তী পর্যায়ের দুটো উপন্যাসের জটিল বিশ্লেষণধর্মিতা ও কাহিনির রহস্যময়তা এখানে নেই। এ উপন্যাসের শুরুর বর্ণনাটা বেশ চমকপ্রদ, অন্তর্মুখী দৃষ্টি নিয়ে লেখকের পরিপক্ক বোধ প্রথম বাক্যেই প্রকাশ পেয়েছে- ‘শস্যহীন জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদা সন্ত্রস্ত করে রাখে।’ একটা বাক্যেই উপন্যাসের সমগ্র গভীরতা পরিস্ফুট হয়েছে; আমরা প্রথমেই মূলভাবনার মধ্যে ডুবে যাই। উপন্যাসের আরো কিছু তাৎপর্যময় উদাহরণ তুলে ধরছি :

ক. অজগরের মত দীর্ঘ রেলগাড়ীর কি ধৈর্য্যরে সীমা নেই? তার দেহ ঝনঝন করে, লোহলক্কড়ের ঝংকারে উত্তাপলাগা দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে, কিন্তু হঠাৎ উঠে ছুটে পালায় না। দেহচ্যূত হয়ে অদুরে অস্পষ্ট আলোয় ইঞ্জিনটা পানি খায়। পানি খায় ঠিক মানুষের মত। আর অপেক্ষা করে। ধৈর্য্যরে কাঁটা নড়ে না।

খ. খোদার এলেমে বুক ভরে না তল পেট শূন্য বলে।

গ. এক সময় ভাবে, ঝলক দেয়া লালসালু কাপড়ে আবৃত নকল মাজারটিই এদের উপযুক্ত শিক্ষা, তাদের নিমকহারামির যথার্থ প্রতিদান।

ঘ. তার চোখ জ্বলছে একটা জ্বালাময়ী অথচ পবিত্রক্রোধে।

ঙ. বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে চোখ।

তাৎপর্যময় গভীর অর্থদ্যোতনাক্রান্ত এই সব বাক্যগুলো অভিনিবেশ সহকারে পড়লেই উপন্যাসের মূল রহস্য বা অভ্যন্তরীণ জটিলতার গিঁট ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করবে। তাঁর ভাষা ব্যবহারের নৈপুণ্যই শুধু বড় ব্যাপার নয়, একইসঙ্গে এর গভীরতা ও ইঙ্গিতময়তা উপন্যাসকে আরো বেশি শিল্প-সুষমামণ্ডিত করেছে।

ভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গে বলা যায় উচ্চশিক্ষিত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রামীণ মানুষের মুখের কথা সহজে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষানবীস কালের দেশ-পরিক্রমণ তাঁকে বাড়তি মসলা জুগিয়েছে। গ্রাম্য কৃষক যে ভাষা ব্যবহার করে তাতেই তার প্রাণের প্রকৃত স্বরূপ ধরা পড়ে সেই নিরিখে আধুনিককালে সৃজনশীল সাহিত্যে, এমনকি কবিতাতেও এই আঞ্চলিক ভাষা (Dialect) ব্যবহৃত হচ্ছে। ওয়ালীউল্লাহ্ এ ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন, তাই পাত্রভেদে তিনি ভাষার পরিবর্তন করেছেন। লালসালুতে ব্যবহৃত এই ভাষারীতি কখনো আঞ্চলিক Slang জাতীয় ভাষার মতো। লেখক কাহিনির পটভূমির নিরিখে, জীবনমুখিনতার স্বপক্ষে এটা করেছেন সচেতনভাবে।

ক. অমন করি হাঁটতে নাই বিবি, মাটি ন গোস্বা করে। এই মাটিতেই একদিন ফিরি যাইবা- থেমে আবার বলে মাটিরে কষ্ট দেওন গুণাহ। (মজিদ)

খ. আমি গরীব মুরুক্ষ মানুষ (দুদু মিঞা) গরীব মানুষ, খাইবার পারি না।

গ. খানকির বেটি নিকা করবো বলাই তো মানুষ টারে খাইছে।

অথবা

ওরে মরার ব্যাটা তুই কী ভাবছস? ভাবছস বুঝি পোলাগুলি তোর জন্মের। আল্লা সাক্ষী হেগুলি তোর জন্মের না, তোর জন্মের না। (কাদেরের মা)

ঘ. তুমি আমার স্বামী। স্বামী হইলে এ্যামনেই বোঝে। (রহিমা)

লক্ষণীয়, আঞ্চলিক ভাষার এই প্রয়োগ সফল এবং একটা বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখনিঃসৃত। আমরা ভাষা ব্যবহারের সুষ্ঠ প্রয়োগ দেখানোর জন্য উপরোক্ত উদাহরণের আশ্রয় নিয়েছি; এতে উপন্যাসের সফলতার আরেকটি দিক উন্মোচিত হবে। দেশি শব্দ ব্যবহারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ঔপনাাসিকের মৌল বৈশিষ্ট্য, তবে পাত্র-পাত্রীর অবস্থান ধর্ম গোত্র ইত্যাদির নিরিখে উপযুক্ত ভাষা নির্মাণ করা অধিকতর যোগ্যতার বিবেচক। ধর্মীয় পটভূমি আশ্রিত গল্প সংশিষ্ট ধর্মীয় পরিভাষায় হবে এমন আশা সাধারণত করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা যেমন আরবি, ফার্সি উর্দূ কিংবা আরো ভিন্নসব বিদেশি ভাষারও যথার্থ প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। শিল্পীকে মূল শেকড়ের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। প্রকৃত বা বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র চিত্রিত করতে এর বিকল্প নেই; এবং সেটাই শৈল্পিক কুশলতারই পরিচয় বহন করে। লালসালুতে ব্যবহৃত এ জাতীয় কিছু শব্দের প্রয়োগ :

ক. আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ।

খ. আমার বাপেরও খতনা অয় নাই তানোরে আগে দেন।

গ. সোহবাতে সোয়ালে তুরা সোয়ালে কুনাদ (সুসঙ্গ মানুষকে ভালো করে)। শুনে জমায়েতের অর্ধেক লোক কেঁদে উঠে। তারপর তিনি যখন বাকিটা বলেন, সোহবতে তোয়ালে তুরা তো য়ালে কুনাদ (কুসঙ্গ তেমনি তাকে আবার খারাপ করে)।

ঘ. চেঁচামেচি করতা কিছুকা ওয়াস্তে?
কাহে? জ্বাহরকা নামাজ দুয়া।

এছাড়া অসংখ্য আরবি, ফার্সি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, উৎসাহী পাঠক দেখে নিতে পারবেন। এখানে একটা কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। উপরোক্ত উদাহরণে সম্পূর্ণ বাক্য ব্যবহারে শব্দের সংশ্লিষ্ট অনুষঙ্গও পাঠকের নজর কাড়বে, এবং উপযুক্ততা বিচার করতে পারবেন।

উপন্যাসের সার্বিক সফলতা বিচারের জন্য সমালোচকের বিচক্ষণতা, অনুসন্ধিৎসার সাথে পাঠকের অভিনিবিষ্টতা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং শৈল্পিক সাফল্য বিচার দৃশ্যত পাঠকের তীক্ষ্ম বিচার শক্তির উপরে বর্তায়। লালসালু থেকে কিছু আলঙ্কারিক বাক্যের প্রয়োগের উদাহরণ দেওয়া যাক।

ক. অজগরের মত দীর্ঘ রেলগাড়ীর কিন্তু ধৈর্য্যরে সীমা নেই।

খ. নিরাকপড়া শ্রাবণের সেই হাওয়া শস্য স্তব্ধ দিনে তার জীবনের যে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল মাছের পিঠের মত সালু কাপড়ে আবৃত নশ্বর জীবনের প্রতীকটির পাশে সে জীবন পদে পদে এগিয়ে চললো।

গ. গলা ভালো তার, পড়বার ভঙ্গিও মধুর। একটা চমৎকার সুরে সারা বাড়ি ভরে যায়। যেন হাস্নাহেনার মিষ্টি মধুর গন্ধ ছড়ায়।

ঘ. পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে বকের মত গলা বাজিয়ে পীর সাহেবকে একবার দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু কালো মাথায় সমুদ্রে দৃষ্টি কেবল ব্যাহত হয়ে ফিরে আসে।

সৃষ্টিশীল রচনার মৌল চারিত্র্য হল তা প্রচলিত ছকে বাঁধা নিয়মনীতি পুরোপুরি মেনে চলে না, তাই বলে, তাকে বিধিবদ্ধ অনুসাশনের (Dicta) কঠিন রশিতে বেঁধে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়ার অধিকারও সমালোচকের নেই, আর সেটা প্রকৃত সমালোচনার পদ্ধতিও নয় বলে মনে হয়। প্রকৃত অর্থে সৃষ্টিশীল রচনা, তা সমালোচনা অথবা কথাসাহিত্যই হোক, কোনো সুনির্দিষ্ট বা পূর্বনির্ধারিত ব্যকরণ মানে না, তার এই অমান্যতাই পরবর্তীকালে নতুন রীতির আধার হয়ে উঠে।

ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমবস্যা (১৯৬৪) ও কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) উপন্যাস নিয়ে যে সমালোচনা হয়েছে তা আপাত এবং বিস্তৃত নয়। এই গুণী শিল্পীর রচনাকে আরো বিস্তৃত আকারে সমালোচনা প্রয়োজন।

চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের গঠনকৌশল স্বতন্ত্র ধারার। প্রচলিত ধারণা থেকে অনভিজ্ঞ পাঠক একে মৃত্যুরহস্যমণ্ডিত রহস্যোপন্যাস বলতে পারেন। অবশ্য সরদার ফজলুল করিম একসময় একে তা-ই বলে ছিলেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত। মৃত্যুজনিত ঘটনা নিয়ে জনৈক যুবক স্কুল শিক্ষক আরেফ আলীর আত্মদহন, আত্ম-বিশ্লেষণ, ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পুনঃপুন যুক্তি-তর্কের অবতারণা এবং জীবন সম্পর্কে তার সহজাত দায়বদ্ধতা নিয়েই উপন্যাসের অবয়ব গড়ে উঠেছে। দাদা সাহেবের ছোট ভাই (তথাকথিত দরবেশ) কাদের মিঞা গ্রামের জনৈক স্বামীহীন মাঝির বউয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের কারণে গোপনে এক রাতে বাঁশবাগানে গলা টিপে হত্যা করে। সেই রাতে যুবক শিক্ষক শারীরিক প্রয়োজনে বাঁশবাগানের নিকটবর্তী স্থানে গেলে মানুষের চিৎকার শোনে। হয়তো তার উপস্থিতি না ঘটলে মাঝির বউ মারা যেত না। যুবক শিক্ষক আলো অন্ধকারের মধ্যে একটি যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। দরিদ্র, ভীতু যুবক শিক্ষক এরপর তার নিজস্ব মানবিক দায়বদ্ধতার কারণে মৃত্যু সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। জানতে পারে কাদের হত্যাকারী, তবু তার বিশ্বাস হয় না, একজন মানুষ আরেকজন মানুষ হত্যা করতে পারে কীভাবে! এই বোধ তাকে বিচলিত করে। সে নিজে পরের দিন অনেকটা অসম্বিতের মধ্য থেকে কাদের মিয়ার সাথে যুবতীর লাশ নদীতে ফেলে আসে। ভয়ে বিমূঢ়তায় যুবতীর মুখের দিকে তাকাবার সাহস তার হয়নি। এই একটা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা এতে নেই। নিস্পাপ সহজ শিশুসুলভ বাস্তবতার বোধশূন্য যুবক শিক্ষকের হৃদয়ে একজন অনাত্মীয়া মানুষের (যার সাথে তার কোনো পরিচয় ছিল না) মৃত্যুজনিত প্রতিক্রিয়া, দায়িত্ববোধ এবং এতদসংক্রান্ত ভিক্তির যথার্থতা নির্ণয়- এই সব নিয়ে উপন্যাস এগিয়ে চলেছে। সামাজিক চিত্র হিসেবে দাদা সাহেবের ইসলাম প্রীতি ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত হয়েছে কৌশলে, স্বল্প পরিসরে। এসব ক্ষুদ্র সংলগ্নতা বাদ দিলে যুবক শিক্ষকের নিজস্ব চেতন-অবচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে উপন্যাস তা সত্যিকার অর্থে নতুন জটিল এবং অত্যাধুনিক বিশ্লেষণধর্মী শিল্পকুশলতার বৈশিষ্টমণ্ডিত। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের সাহিত্যে এই জাতীয় উপন্যাসের নমুনা এটাই প্রথম।

চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে কোনো বিধিবদ্ধ কাহিনি নেই, ঘটনা, উপঘটনা দ্বারা উপন্যাসের কলেবরকে বৃদ্ধি করারও কোনো প্রবণতা নেই। যেসব চরিত্র এসেছে তা লেখকের বক্তব্যের স্থিরতা ও পূর্ণতা প্রকাশের জন্য। তাই চরিত্রগুলোর ব্যক্তি জীবনের কোনো ঘটনাও নেই।

লেখকের মনোসমীক্ষণজাত অনুধাবন ক্ষমতা, ঘটনার সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ, যুক্তিতর্কের মানদণ্ড, চরিত্রের অগ্রসরণ, ওয়ালীউল্লাহর মানোসৎকর্ষকে আরো বেশি উজ্জ্বল করেছে। কাহিনি ছাড়া এভাবে এগিয়ে যাবার কৌশলও আমাদের উপন্যাসে নতুন। মাঝির বউ পৃথিবীর একজন মানুষ, হোক সে অপরিচিত গরিব, নিম্নজাতের তাই নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে যুবক শিক্ষক তার জন্য বিচার প্রার্থনা করে। জীবনের জন্য জীবনের এই আকুতি, উপন্যাসকে সার্বজনীন করে তুলেছে। এই বোধ, প্রত্যয়, জিজ্ঞাসা ও তাড়না উপন্যাসকে দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে। আগেই বলেছি, চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে কোনো বিধিবদ্ধ কাহিনি নেই, ঘটনা, উপঘটনা দ্বারা উপন্যাসের কলেবরকে বৃদ্ধি করারও কোনো প্রবণতা নেই। যেসব চরিত্র এসেছে তা লেখকের বক্তব্যের স্থিরতা ও পূর্ণতা প্রকাশের জন্য। তাই চরিত্রগুলোর ব্যক্তি জীবনের কোনো ঘটনাও নেই। যুবক শিক্ষককে বাদ দিলে কাদের মিঞা ও দাদা সাহেব এখানে উল্লেখযোগ্য চরিত্র। কাদের মিয়া সম্পর্কে যতটুকু তথ্য আমরা পাই তা অসম্পূর্ণ; এই অসম্পূর্ণতার মধ্যে লেখকের ভিন্ন এক উদ্দেশ্য নিহিত আছে। দরবেশ জাতীয় চরিত্র বলে কাদেরের যে পরিচিতি দিয়েছে দাদা সাহেব, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তার ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে এই চরিত্র মেলে না। কাদের কর্ত্তৃক মাঝির বউ নিহত হওয়ার ঘটনা দিয়েই এই কথার সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। দুটো দিক এখানে লক্ষণীয়: কাদের প্রকৃত অর্থে ধার্মিক নয়, ধর্মকে ব্যবহার করে সে তার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছে। দাদা সাহেব সামন্ত শ্রেণির চরিত্র। এবং কাদের তার উত্তরসূরী। আমরা দাদাসাহেবকে কোনো ক্রাইম করতে দেখি না সত্য তবে ইসলামের জন্য যিনি এতই পেরেসান, সেই ব্যক্তি কীভাবে কাদেরের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে? তাছাড়া মাঝির বউয়ের স্বামী নেই, প্রতিবেশী শাশুড়ি ও ননদী; মোট কথা সে সম্পূর্ণ অসহায়, শক্তিহীন। তার দিক থেকে প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই।

উপন্যাাস কিংবা অন্য কথাশিল্পের গঠন ও শিল্প সার্থকতা বিস্তারে কবিতার মতো বিধিবদ্ধ আলঙ্কারিক সাজুয্য সবসময় বিচারের মাপকাঠি নয়। এক্ষেত্রে কাহিনির নতুনত্ব, বর্ণনাকৌশল, ভাষার স্বাভাবিক সততপ্রবাহ, উপযুক্ত প্রেক্ষিত অনুযায়ী ভাষার পরিবর্তন, শক্তিশালী ভাষা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র বিচার অধিক গুরুত্ববাহী। কাব্যিক ভাষা নির্মাণ কোনোক্ষেত্রে উপযুক্ত উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সর্বোপরি নিজস্ব স্টাইল লেখককে আলাদা মর্যাদা দেয়।

চাঁদের অমাবস্যাতে ঔপন্যসিকের যুক্তিবোধ অত্যন্ত পরিশীলতি, নিরাসক্ত ও বাস্তবনিষ্ঠ এবং কখনো কখনো হার্দ্যকি। উপন্যাসের ভাষিক নৈপূণ্য বিচার ও চূড়ান্ত সফলতা বিচারের জন্য আমরা লেখকের বর্ণনা কৌশল, নাটকীয়তা কাব্যময়তা ও যুক্তি পরম্পরায় উদাহরণ তুলে ধরছি।

নাটকীয়তা ও বর্ণনা কৌশল

ক. চরকির মত, লেজে কেরসিনের টিন বেঁধে দিলে কুকুর যেমন ঘোরে তেমনি। কেন তা সে বলতে পারবে না। কেবল একটা দুর্বোধ্য নির্দয় তাড়না বোধ করে বলে দিশেহরা হয়ে অবিশ্রান্ত ভাবে মাঠে ঘাটে ছুটাছুটি করে, অফুরন্ত জ্যোৎস্নালোকে কোথাও গা ঢাকা দেবার স্থান পায় না। আবার ছায়াছন্ন স্থানে নিরাপদও বোধ করে না।

(মৃত্যদেহ দেখবার পর যুবক শিক্ষক)

খ. সাপের মুখ গহবরে ঢুকে ব্যাঙের আওয়াজ যেন হঠাৎ; পা বা মস্তক দেহচ্যুৎ হলে মুখের আওয়াজ যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়। দেহচ্যুত মাথা এখনো হয়তো আর্তনাদ করছে। কিন্তু তাতে আর শব্দ নাই।

গ. অনভিজ্ঞ সরলচিত্ত যুবকের মনের আকাশে কোন বিপদাশঙ্কার অভাস নাই। ভয় দ্বিধা নাই, উপরে স্বচ্ছ আকাশে সুন্দর উজ্জ্বল মায়াময়ী চাঁদ নির্ভয়ে একাকী বিরাজ করে। একটু ঝুঁকে সে একটা পড়ন্ত শাখা তুলে নেয়। তার তরুণ মুখে একটা কৃত্রিম আশঙ্কা কৌতুক মেশানো আশঙ্কা।

লক্ষ করলে দেখা যায় ওয়ালীউল্লাহর বর্ণনাভঙ্গি কত মোহন, গভীর, নিরাসক্ত ও দার্শনিক অবলোকন দ্বারা নির্মিত। প্রকৃতির বিভিন্ন আবহের সাথে যুবক শিক্ষকের মনের অতলান্ত বিস্ময়, আশঙ্কা, দ্বিধা ও দায়বদ্ধতা একাকার হয়েছে। জীবন প্রকৃতি ও হৃদয় নিঃসৃত বোধের সম্মিলনে তাঁর বর্ণনাভঙ্গি আলাদা সৌকর্য লাভ করেছে। বলতে দ্বিধা নেই, ঘটনার পেছনে ঘটনার লাগামহীন দৌড় প্রতিযোগিতা ছাড়া এভাবে উপন্যাসের পরিসর বৃদ্ধি করার এই কৌশল সত্যি অভিনব, এক সফল পরীক্ষা বলা চলে।

কাব্যময়তা ও অলঙ্কার

এ উপন্যাসে রোমাণ্টিক কোনো ঘটনা নেই, নায়ক চরিত্রের ভাবুলতা নেই সুতরাং রোমাণ্টিক প্রেমের জোলোচ্ছ্বাসময় কর্দমাক্ত বর্ণনা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বলাবাহুল্য, সেরকম কোনো প্রয়াস গ্রহণ করার ইচ্ছেও ঔপন্যাসিকের ছিল না। সাধারণ পাঠককে মাত করার কোনোরকম কৌশল তিনি সর্বোতভাবে এড়িয়ে গেছেন। তবু উপন্যাসের দীর্ঘ বিস্তীর্ণ পাটাতনে চলাচল করার সময় একটা আকর্ষণ উপন্যাসের কাঠামোতে লেখককে রেখে যেতে হয়। কাব্যগুণ বলতে প্রচলিত অর্থে যা বোঝায় ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে তা নেই। এক্ষেত্রে শক্তিমান বাকভঙ্গি এবং অপূর্ব মমত্বময় বর্ণনাকেই আমরা কাব্যময়তা হিসেবে বিবেচনায় আনছি।

ক. শ্লথগতি হলেও কুয়াশা সদাচঞ্চল। নড়ে চড়ে ঘুমায়। হালকা হয়। সুতরাং এক সময়ে হঠাৎ চমকে উঠে উপরের দিকে তাকালে যুবক শিক্ষকের শীর্ণ মুখে এক ঝলক রূপালী আলো পড়ে। স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশে কুয়াশামুক্ত চাঁদ আবার ঝলমল করে। স্নিগ্ধ প্রশান্ত চাঁদের মুখ দেখে অকারণে সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে আবার ছুটতে শুরু করে।

খ. যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগী-মুখে হালকা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে। বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ কষ্ট মহামারী হত্যাকারী রাতে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই।

গ. সময় দীর্ঘ ঢেউয়ের মত, ধীরে ধীরে বয়ে যায়। চোখের অন্ধকার আরো নিবিড় কালো হয়, তার সমস্ত জ্ঞানেন্দ্রিয়, শিল পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে থাকে।

ঘ. তারপর এক সময়ে ক্ষুধার্ত শামুকের মত পরিণাম ভয়শূন্য হয়ে খোসা ছেড়ে সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে।

গতিময় অথচ শান্ত সমাহিত, ঋদ্ধ মননের ঝিলিকে তাঁর বাক্য ধীরে ধীরে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে, সমস্ত অভিব্যক্তি উপলব্ধির ব্যঞ্জনসহ। বলা চলে, নিরাসক্ত স্বভাবেরও একটা স্বাভাবিক আসক্তি আছে, সে আসক্তি সাদামাটা তবু স্থির সংহত সৌন্দর্যের প্রতীক।

যুক্তি তর্কের ভিত্তিতে যুবক শিক্ষক শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কথা থানায় বলেছে। তার নিজের ক্ষতি হবে এই ভেবে সে এতটা সময় নেয়নি। হাজার প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সে বলেছে মৃত্যুর রহস্য, প্রকৃত খুনী কে। যে সময়টুকু সে নিয়েছে ভাবতে সেই ভাবনাই উপন্যাসের আখ্যান। যুবক শিক্ষক মেরুদণ্ডহীন, তবু জীবন্ত মানুষের পক্ষে অন্যের জীবন সম্পর্কে নিরাসক্ত হওয়াও সহজ নয়, সে কারণে যুবতীর মৃত্যু সম্পর্কে সে যেমন ভেবেছে, ভেবেছে কাদের সম্পর্কে। যুবক শিক্ষক আরেফ আলী অনুপুঙ্খ সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ, বিচার বিশ্লেষণ করেছে। কখনো এগিয়েছে কখনো পিছিয়েছে। সে দুর্বল হলেও জীবন সম্পর্কে তার যে কমিটমেন্ট তাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে পারে না। তার সব ধারণা, যুক্তি তার নিজস্ব জীবন বিশ্বাস ভালোবাসার মাপকাঠিতে অভিসিক্ত।

ক. আজ রাতে যুবক শিক্ষক শান্ত-চিত্তে তাকে (কাদের) ভালো করে দেখে। খাটো মানুষ কিন্তু বংশজাত চওড়া হাড়। কালো রঙ, চেহারার গঠন ধারালো। তবে তার চেহারায় দুটি জিনিস শীর্ঘ চোখে পড়ে। প্রথমতঃ তার অর্ধনিমীলিত চোখ। সে যেন নিদ্রাজাগরণের মধ্যে কোথাও সর্বদা বিরাজ করে। নিদ্রাবিষ্ট চোখের প্রভাব তার সারা মুখেও বিস্তারিত। দ্বিতীয়তঃ তার মাথায় চুলের বাহার। তেল চকচকে মাথায় একটি চুলও অস্থানে নাই। তার অর্ধঘুমন্ত মুখে সে চুলের বাহার কেমন বেমানান মনে হয়।

কাদেরের সঙ্গে যুবতী মৃত্যুদেহকে অনেকটা হত বিহবল অবস্থায় বহন করে আসার পর মৃত্যু সম্পর্কে যুবক শিক্ষক উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অকস্মাৎ তার মনে নানা প্রকার প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। এই ফোটার মত একটির পর একটি। সারাদিন যে মন স্তব্ধ হয়েছিলো, সে মনের প্রশ্নের এ বিস্ফোরণে সে কেমন বিহবল হয়ে পড়ে। তবে নৈর্ব্যক্তিক দর্শকের যে পরম স্বস্তিভাব সে বোধ করে সে স্বস্তিভাব আরো গাঢ় হতে থাকে। মৃত্যু সম্পর্কে কাদের জড়িত কিনা, জড়িত হলে সে কেন জড়িত, সে নিজে জড়িত কিনা ইত্যাকার প্রশ্ন এবং তার উত্তর সে খোঁজে গভীর অর্ন্তদৃষ্টি ও যুক্তি দিয়ে। কতকগুলো প্রশ্ন সে মনে মনে নির্বাচন করে, এবং উত্তর খোঁজে; যুবক শিক্ষক অন্ধকার রাতে বাগানে কি করছিল? সে নিজেও কেন বাঁশঝাড়ে গিয়েছিল, কাদের কি সত্যি দরবেশ? কাদের কি যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিল? হত্যার ব্যাপারে যুবক শিক্ষক কাউকে কিছু বলেনি কেন, কাদেরকে কি হত্যাকরী ভাবা যায়, সে রাতে কাদের কেন তার ঘরে এসেছিল, যুবতী নারীর মৃতদেহটিকে গুম করে দেবার অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্তের কারণ কি, সাহায্যের জন্য কাদের তার কাছে কেন আসে, ইত্যাদি অসংখ্য প্রশ্ন যুবক শিক্ষক নির্বাচন করে, পক্ষপাতহীনভাবে বিষেশ্লষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে কাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে যুবক শিক্ষক স্থির সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয় যে কাদের যুবতীর হত্যকারী। সুতরাং তাকে ব্যাপারটা দাদাসাহেব এবং থানায় অবশ্যই বলতে হবে।

যুবক শিক্ষকের এই অনুসন্ধিৎসু মন ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কেউ কেউ এই উপন্যাসের রহস্যোপন্যাসের গন্ধ (?) পেয়েছেন। প্রকৃতঅর্থে, যুবক শিক্ষকের সমস্ত কার্যক্রম তার আত্মদহন থেকে উৎপত্তি। শিক্ষিত, গরিব, বিবেকবান, যুবক শিক্ষক সামজিক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী পুরুষ। সে দুর্বল বলে এর চেয়ে বেশি কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

সামগ্রিক বিচেনায়, উপন্যাসে লেখকের মননশীলতা, যুক্তির তীক্ষ্ণতা, ভাষার কাঠামোগত অভিনবত্ব, নিস্পৃহতা ও ক্রমাগত স্থির নির্মোহ অবলোকন উপন্যাসটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। মুসলমানদের বিবেকবোধ, নতুন জীবনবোধ, বাস্তবতার সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয়ে উনিশ শতকের সমাজ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল ক্রমাগত। শত বাঁধার প্রাচীর সত্ত্বেও তা আপোষহীন এবং সেই মনোভাবের সার্থক চরিত্র যুবক শিক্ষক আরেফ আলী।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তৃতীয় উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। ঔপন্যাসিকের ধারাবাহিক নিরীক্ষাধর্মিতার সফল উদাহরণ। প্রথম উপন্যাস দুটোর কাহিনি, গঠন, বর্ণনাক্রম, ও দার্শনিকসুলভ অন্তর্মুখিতা লক্ষ করলে এই শেষোক্ত উপন্যাসের নতুনত্ব সহজে চোখে পড়বে। এখানে তিনি আরো বেশি শাণিত। কী ভাষার উজ্জ্বলতায়, কী বর্ণনার অভিনবত্বে। সর্বোপরি নিজস্ব স্থির নির্মোহ সূক্ষ্ম অবলোকন উপন্যাসের গল্পে নতুন এক বিন্যাসরীতি লক্ষণীয়। প্রচলিত ধারার একক কোনো যুথবদ্ধ কাহিনি এখানে নেই, কিংবা চরিত্রের কোনো বিশেষ স্থান, গুরুত্ব নেই। মনে হতে পারে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব কমিটমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার জন্য একের পর এক চরিত্র এসেছে। লক্ষণীয়, এই উপন্যাসে চরিত্র অসংখ্য, যা ইতোপূর্বে দেখা যায়নি।

লালসালুতে অন্ধ বিশ্বাসের চড়ায় আটকে পড়েছিল মহব্বত নগরের গ্রামবাসী। মুসলিম সমাজের সামগ্রিক শিক্ষা-সচেতনতার যে সংকট তাই হয়তো বা এখানে সবচেয়ে বড় বাধা, বড় প্রাচীর। তাই যুবক শিক্ষক আরেফ আলী (চাঁদের অমাবস্যা), মোহাম্মদ মোস্তফা কেউ সে সংকট মোকবিলা করতে পারে না।

কুমুরডাঙ্গা গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা, বাকাল নদীর সাথে তাদের জীবন-সংলগ্নতা, প্রাত্যহিক জীবনযন্ত্রণা, নদী বিধৈাত ছোট্ট শহরের অজস্র অসহায় মানুষ এবং তার সাথে নায়ক চরিত্র মোহাম্মদ মোস্তফা যে অন্য এক গ্রাম থেকে এসেছে ছোট হাকিমের পদে নিযুক্ত হয়ে কুমুরডাঙ্গার মানুষের সঙ্গে তার যে সর্ম্পক তা আন্তরিক নয়। এমনকি ঔপন্যাসিক আন্তরিকতা দেখাবার প্রয়াসও পাননি। মোহাম্মদ মোস্তফার ব্যক্তিগত জীবন যন্ত্রণা, শৈশব-যৌবন, পারিবারিক সংকট, বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা এবং অবশেষে আত্মহত্যা এ সবের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে কুমুরডাঙ্গার কাহিনি মেলে না, তবে একটা জায়গায় তা সমগোত্রীয়। বাকাল নদীতে চর পড়ার কারণে কুমুরাাঙ্গার মানুষের জীবনের সব সফলতা যেমন নদীর চরে আটকে পড়েছে, মোহাম্মদ মোস্তফাও তার সব সফলতাতে অসার বাসনা সাব্যস্ত করেছে। ফুফাত বোন খোদেজার মৃত্যুতে (যে মোহাম্মদ মোস্তফার বিবাহের সংবাদ পাবার পর আত্মহত্যা করেছিল) সে অসহায় অবস্থায় পড়ে। উভয়ক্ষেত্রে জীবনসংকট, জীবনের সামগ্রিক বিকাশ যেন এক চড়ায় আটকে পড়ে আছে। লালসালুতে অন্ধ বিশ্বাসের চড়ায় আটকে পড়েছিল মহব্বত নগরের গ্রামবাসী। মুসলিম সমাজের সামগ্রিক শিক্ষা-সচেতনতার যে সংকট তাই হয়তো বা এখানে সবচেয়ে বড় বাধা, বড় প্রাচীর। তাই যুবক শিক্ষক আরেফ আলী (চাঁদের অমাবস্যা), মোহাম্মদ মোস্তফা কেউ সে সংকট মোকবিলা করতে পারে না। যুবক শিক্ষক তবু ছিল অল্প শিক্ষিত, কিন্তু কাঁদো নদী কাঁদোর মোহাম্মদ মোস্তফা উচ্চশিক্ষিত, তবু তার সংকট কাটে না। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত মানসিক জটিলতার গল্প বয়নের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক সামগ্রিক অর্থে একটি অবিকশিত সমাজে মানুষের অস্তিত্বের নানান সংকট চিহ্নিত করেছেন।

কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে বাকাল নদী মূলত বাংলাদেশের যেকোনো বৃহৎ নদী, কুমুরডাঙ্গা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ। একটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-কান্না সুখ-দুঃখ সব কিছু মিলিয়ে দুঃখের প্রবল জোয়ার উথলে ওঠে বেশি করে। প্রকৃত অর্থে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের সামগ্রিক বেদনার নির্যাসে একক স্রোত হয়ে নদীর বুকে প্রবাহিত সবার যন্ত্রণা ধারণ করার সঠিক এবং একমাত্র বিকল্প নদীর কান্না; সেকারণে নদী কাঁদে এবং ধীরে ধীরে অনেকেই তা শুনেতে পায়। যারা সূক্ষ্ম হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তারা শুনতে পায়, কান্না মূলত প্রতিধ্বনিত হয় নিজের বুকেই। কুমুরডাঙ্গার জীবনচিত্র, নদীর কান্না, স্টিমারের যাত্রী, অপূর্ব কথক তবারক ভুইঞা সব মিলিয়ে উপন্যাসটি একটা মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা প্রকাশ করেছে। কাহিনি নির্মাণের এই অভিনব কৌশল যেমন সার্থক তেমনি তা নিরীক্ষার অপূর্ব নিদর্শন।

বর্ণনাভঙ্গি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এ উপন্যাস যেমন নাটকীয়, তেমন সচল এবং নতুন মাত্রাগত সফলতা নিয়ে এসেছে। স্টিমার যাত্রা চলছে নদীবক্ষে, অনেকগুলো মানুষ বিমূঢ়ভঙ্গিতে শুনছে তবারক ভুইঞার গল্প। অন্যদিকে ঔপন্যাসিক নিজে উত্তম পুরুষে বলে চলেছেন তার চাচাত ভাই মোহাম্মদ মোস্তফার আত্মকাহিনি; পাঠক দুটোই শুনেছে বলেই উভয় কাহিনির একটা যোগসূত্র নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। কথক যে তবারক ভুইঞা সেটাও নির্দ্বন্দ্ব হয়ে বলতে পারছেন না ঔপন্যাসিক। সে হয়তো হরতনপুর নামক একটি অখ্যাত গ্রামের মকসুদ জোলা। ঔপন্যাসিক জানেন সে তবারক ভুইঞা হোক বা না হোক তাতে কাহিনির কোনো ক্ষতি নেই, কাহিনিকে খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার ইচ্ছেও ঔপন্যাসিকর নেই। যে জীবনযাত্রার কথা তিনি বলেন তা বলার জন্য উপযুক্ত একটা প্রেক্ষিত তৈরি করাই তাঁর উদ্দেশ্য। কাহিনিতে জীবন ঘনিষ্ঠতা, বর্ণনাকৌশল ও নিস্পৃহতাই বড় সম্পদ। এই সম্পদই তাঁকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।

তবারক ভূইঞা গল্প বলার যে ধরণ তা দেখে মনে হয় তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সাদামাঠাভাবে সহজ ধীর লয়ে সে এক নিস্তরঙ্গ জীবনকাহিনি বলেছে। শ্রোতারা না শুনে পারে না। ঔপন্যাসিকের নিজস্ব কথকতার নিরিখেই সবাই শ্রোতা, পাঠক বুঁদ হয়ে শোনে তার কাহিনি। তবারক ভূইঞার মতো সদর্থক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র নির্মাণে লেখক যে ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন তার কিছু উদাহরণ লক্ষ করা যাক।

ক. লোকটিকে যখন দেখতে পাই তখন অপরাহ্ন, অসংখ্য যাত্রীর উষ্ণ নিঃশ্বাসে দেহতাপে এমনিতে উত্তপ্ত তৃতীয় শ্রেণীকে আরো উত্তপ্ত করে তুলেছে।…

খ. লোকটির বয়স চল্লিশের মত বা কিছু বেশি, কারণ কানের চুলে বেশ পাক ধরেছে। গা-এর রঙটি এমন যে মনে হয় একদা তা ফর্সা ধরনের ছিল কিন্তু আজ জ্বলে পুড়ে মলিন হয়ে গিয়েছে।

গ. চোখ খুলে দেখি, পরিপাটি স্বভাবের লোকটি কিছু বলছে, ধীরে ধীরে থেমে থেমেই সে বলে যেন কী বলবে সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেনি, শ্রোতাদের সম্বন্ধেও নিশ্চিত নয়।… আরো পরে মনে হয় তার মুখ দিয়ে অবলীলাক্রমে যা নিঃসৃত হয় তার ওপর সে শাসন সে হারিয়েছে, খুরধার ধারা রোধ করার ইচ্ছা থাকলেও রোধ করার কৌশল তার জানা নাই, বস্তুত তার বাক্যস্রোত রীতিমত একটি নদীর ধারায় পরিণত।

সুতরাং বোঝা যায়, এই যে কথাচারণ তা অনিবার্য জীবনামৃত, তা না শুনে উপায় নেই। গল্পকে বিশ্বাস্য করে (খানিকটা) তোলার জন্য তবারক ভুইঞার কিছু পরিচয় ঔপন্যাসিক দিয়েছেন যা তার গল্প বলার ধরন থেকে বোঝা যায়। তবারক ভূইঞা মূলত দার্শনিক, দার্শনিকের চোখ দিয়ে সে জীবন জনপদ কে দেখেছে : ‘ছোটবেলাতেই লোকটির মধ্যে কৌতূহলটা দেখা দিয়েছিল। তার সমবয়সী ছেলেরা যখন মাঠে-মাঠে খেলা করে গৃহস্থের বাড়ির ফলমূল চুরি করে নদী পুকুরে সাঁতার কেটে সময় কাটাতো তখন সে সব কিছু ভুলে ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষের জীবনযাত্রা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। সে সময়ে কত দেউড়ি-খিড়কির পথ দিয়ে সে ছায়ার মত আসা যাওয়া করেছে। এ বাড়ি সে বাড়ি গিয়ে কত নর-নারীর দৈনন্দিন জীবনটাকে মশগুল হয়ে দেখে সময় কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সে জন্যই সে চক্ষু সর্বস্ব নিশাচর পাখির নাম পেয়েছিল।’ জীবন কত বৈচিত্র্যময় লোভনীয় আশ্চর্য এবং মায়াবী তা তবারক ভূইঞার পরিচয়ে জানা যায়। তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ফলে জীবনের গভীর দ্যোতনা, প্রবণতা, নির্যাস উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়। ওয়ালীউল্লাহর নিজস্ব শব্দ-নির্মাণ, কুশলী বাক্য নির্মিতি এবং নিজস্ব প্রবণতাকে সূক্ষ্মভাবে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করানোর কৌশল সাধারণ ঔপন্যাসিকের মতো নয়। একটা আলাদা অবকাঠামোগত শৈলী তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ কথা বললে আশা করি সংশ্লিষ্ট কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ পরবর্তী উপন্যাস-ধারাক্রমে ঔপন্যাসিকের ঋদ্ধ-মননজাত উপলব্ধিবোধ ও বিশ্লেষণধর্মিতার উদাহরণ নেই। এমনকি এই নতুন নিরীক্ষা বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ সাহিত্যে ছিল না। সুতরাং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গভীর তীক্ষ্ণ-হার্দিক বাণী বিন্যাস যে একটা নতুন বর্ণনারীতিতে পৌঁছে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু উজ্জ্বল বাক্যের উদ্ধৃতিসহ উপরোক্ত বিবেচনা প্রতীয়মান করার চেষ্টা করা যাক।

ক. জোতদার আত্মনাদ করে চলে, যে আত্মনাদ অতল কোন গহ্বর থেকে উঠে এসে অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।

খ. অজানা মেয়েটির দুঃখ সে যে বুকে কোথাও ব্যথা বোধ করেছিলো তা নয়, মেয়েটির চোখের আলো পুষ্পরেণুর মত অদৃশ্যভাবে ভেসে এসে তার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিলো কেবল। সে-অশ্রু, চোখের অশ্রু হৃদয়ের অশ্রু নয়, হৃদয়ের অশ্রু দেখা দিতে সময় লাগে।

গ. এ সময়ে যাত্রীরা স্টীমারের দেহের স্পন্দন এবং গতি সম্বন্ধেও যেন সর্ব প্রথম সজ্ঞান হয়, তার পর তাদের দৃষ্টি যায় দূরে তীরের দিকে দিগন্তের দিকে উন্মুক্ত আকাশের দিকে, উন্মুক্ত আকাশের তলে দিন-রাতের সন্ধিক্ষণে যে বিচিত্র অসীমতা প্রকাশ পায় তারই স্পর্শে তারা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। নীরবতা আরো ঘনীভূত হয়। এবার শুধু নিকটের পানির গর্জন নয়, দূরে যে ঢেউ দীর্ঘশ্বাসের মত অস্ফুট শব্দ করে ছড়িয়ে পড়ে তার ক্ষীণ শব্দও শুনতে পায়, আরো দূরের ঢেউ যে ঢেউ-এর শব্দ শোনা যায় না, সে ঢেউ সহসা দৃষ্টি গোচর হয়, হয়তো বা ছায়াছন্ন আকাশে দৃষ্টিহীনভাবে উড়তে থাকা পথ-হারা কোন পাখিও নজরে পড়ে।

প্রচলিত অর্থে আলঙ্কারিক বিচারে, ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস বিশ্লেষণ করলে হয়তো বা তেমন নতুনত্ব, কোনো মাত্রাগত সাফল্য আমাদের চোখে পড়বে না। সে পথে যাবার ইচ্ছেও আমাদের নেই। কারণ আগেই উল্লেখ করেছি নতুন সৃষ্টির মূল্যায়নে আমরা শুধু ঔপন্যাসিকের নতুন প্রবণতা, প্রকল্প, অনুক্রম, শব্দযোজনা, গভীর সূক্ষ্মতা, জীবনের নির্মোহ দার্শনিক অবলোকন এবং তাঁর গল্পের নতুন কাঠামোগত রীতি-পদ্ধতিতে বিচারের মাপকাঠি হিসেবে নিয়েছি এবং সন্দেহ নেই এত বড় গুণীশিল্পীর এই মূল্যায়ন আপাত বিচার। নতুন কাঠামোগত কৌশল, চিন্তার গভীরতা, মনোযোগ, জীবনবোধ, পরিবেশ-প্রতিবেশ জ্ঞান, শক্তিশালী ভাষা, নির্মোহ দৃষ্টি, বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং প্রতিটি ঘটনা পরস্পরকে শাণিত যুক্তির আলোকে উপস্থাপন করার জন্য ওয়ালীউল্লাহর এই তিনটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রাগত সাফল্য পেয়েছে।

মুসলমান সমাজের জন্য লিখতে গিয়ে তাদের মোহগ্রস্ততা কাটাবার যে প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেছিলন, সাংবাদিকতার ঊর্ধ্বে উঠবার যে সংকল্প তিনি করেছিলেন, আমাদের দৃঢ় ধারণা, তাতে তিনি সফল হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি পাঠকের গড় দৃষ্টিসীমা, প্রবণতা তিনি নতুন এই জটিল আবর্তে মিশিয়ে দিয়েছেন, প্রচলিত সীমানা ভেঙে আন্তর্জাতিক মোহনায় নিয়ে গেছেন আমাদের কথাসাহিত্যে। তৎকালীন অনগ্রসর সমাজ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য উপন্যাসে যেভাবে প্রতিফলিত- ইঙ্গিতময়, কাব্যিক। আরোপিত নয়। শৈল্পিক সিদ্ধিতে তাঁর উপন্যাস সফলতার চূড়ান্ত শীর্ষ স্পর্শ করেছে। তাঁর উপন্যাস মূল্যায়নে সেজন্য প্রয়োজন বোধের প্রাখর্য।

আরও পড়ুন :

লেখাটি শেয়ার করুন :

মোস্তফা তারিকুল আহসান

মোস্তফা তারিকুল আহসান। জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০; সাতক্ষীরায়। কবি ও কথাসাহিত্যিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর বিভাগে অধ্যাপনা করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মহাপ্রস্থান, কয়েকটি বালকদিগের গল্প, মাহবুবের কুটিরশিল্প, নমস্কার, কাআ তরুবর, যতিচিহ্নের খোঁজে। উপন্যাস: অবগাহন, প্রজাপতি পাখা মেলো। কবিতা: যদিও জাতিস্মর নই, এ দৃশ্য হননের, কন্টিকিরি রাত, মেঘেদের ইশতেহার, কপিলাবস্তুর পথে, কাব্যনাট্য: আনত কুসুমের ঘ্রাণে। প্রবন্ধ: সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য, বাংলাদেশের কবিতা: উপলব্ধির উচ্চারণ, সৈয়দ শামসুল হকের সাহিতকর্ম, বাংলাদেশের কথাসাহিত্য: মেঘ ও রৌদ্র, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চা: তত্ত¡ ও অধ্যয়ন, ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতির জীবন ও সাহিত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!